ডার্লিং
তখন পূর্ব ও পশ্চিম পাঞ্জাবে দাঙ্গা, গণহত্যা আর লুটপাট-আগুন চলছে।
বেশ ক’দিন ধরেই মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছিল। দমকল বাগে না আনতে পারলেও বৃষ্টিতে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শহরের আগুন নিভে গেছিল। কিন্তু প্রাণহানিতে কোনো বিরাম পড়েনি। মেয়েদের আগের মতোই তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। যুবকেরা মাঝে-মাঝেই দল বেঁধে বেরোত আর ভীতসন্ত্রস্ত অল্পবয়েসি মেয়েদের তুলে নিয়ে যেত।
কারোর বাড়িতে জবরদস্তি ঢুকে লোকজনকে মেরে বাড়ির জোয়ান মেয়েকে তুলে আনা বিশেষ কঠিন ছিল না বলেই শুনতাম। কিন্তু স-এর বক্তব্য ছিল অন্যরকম। তাকে নাকি এসব প্রাণ হাতে নিয়ে করতে হয়েছিল।
বাকি গল্পটা বলার আগে স-এর সঙ্গে আপনাদের একটু পরিচয় করিয়ে দিই।
স ছিল আর সবার মতোই সাধারণ একটা ছেলে। কোনো বিশেষত্ব ছিল না। বিনিপয়সার মালের প্রতি তার লোভ ছিল। কিন্তু সে লোভও অন্যদের তুলনায় বিশেষ আলাদা ছিল না। বরং বলা যায়, মাগনা জিনিসের প্রতি সে কখনো তাচ্ছিল্য দেখাত না। তবু তার জীবনে এক অদ্ভুত ট্র্যাজেডি ঘটেছিল যা উপলব্ধি করতে তার অনেকটা সময় লেগেছিল।
স্কুলে সে গড়পড়তা ছাত্রদের মধ্যে একজন ছিল। কিন্তু সবক’টা খেলায় অংশ নিত। খেলতে খেলতে মারপিট শুরু হয়ে গেলেও পিছু হটত না। খেলার সময় সবরকম মারপ্যাঁচ লাগালেও মারপিট শুরু হলেই সে পুরোপুরি সততার সঙ্গে লড়ত।
সে ভালো ছবি আঁকত। কিন্তু কলেজে ভর্তি হওয়ার পর অবস্থার ফেরে সেসব শিকেয় তুলে তাকে সাইকেলের দোকান খুলতে হয়।
দাঙ্গায় তার দোকান ভস্মীভূত হয়ে যাওয়ায় সে অন্যদের মতো লুটপাট শুরু করে দিল। প্রতিশোধ নিতে নয়, সময় কাটাতে! সেইসময় তার সঙ্গে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। সেই ঘটনা নিয়েই এই গল্প।
‘মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছিল। আমি এমন বৃষ্টি আগে কখনো দেখিনি। বাড়ির চিলেকোঠায় বসে সিগারেট খাচ্ছিলাম। সামনে লুটে আনা একটা থলি পড়ে। অনেক কিছুই ছিল তাতে। কিন্তু সেগুলো খুলে দেখার বিশেষ আগ্রহ ছিল না।
আমার দোকানও পুড়ে ছাই হয়ে গেছিল। কিন্তু তা নিয়েও ভাবছিলাম না। লক্ষ লক্ষ টাকার জিনিস নষ্ট হতে দেখেছি তো, তাই হয়তো!…মাথায় যে ঠিক কী চলছিল জানি না।…ক্রমাগত বৃষ্টি হচ্ছিল। কিন্তু আমার কেমন মনে হচ্ছিল চারিদিক নিস্তব্ধ, শুকনো।…
কোথাও একটা থেকে পোড়া গন্ধ আসছিল। আমার মুখে জ্বলন্ত সিগারেট। সিগারেটের ধোঁয়াতেও ওরকমই একটা পোড়া পোড়া গন্ধ!…কিছু ভাবছিলাম কিনা মনে নেই, এমন সময় হঠাৎই আমার শরীর শিরশির করে উঠল।
সঙ্গে-সঙ্গে মনে হল একটা মেয়েকে তুলে নিয়ে আসি। ভাবতে-ভাবতেই জোর বৃষ্টির আওয়াজ কানে এল। বাইরে দেখলাম সব জলে থই-থই করছে।…আমি উঠলাম। সামনে পড়ে থাকা থলি থেকে একটা সিগারেটের ডিব্বা তুলে নিয়ে রেনকোট পরে আমি নীচে নামলাম।…রাস্তা অন্ধকার। চারদিক সুনসান। কোনো সিপাইও নেই।
আমি অনেকক্ষণ ধরে এদিক-ওদিক টহল দিলাম। জায়গায় জায়গায় লাশ পড়ে! দেখতে দেখতে আমি সিভিল লাইন্সের দিকে এগোলাম। সেখানেও রাস্তা একদম খালি। রাস্তায় এখানে ওখানে নুড়িপাথর উপড়ে গেছে। তার উপর বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে ঠিক সাবানের ফেনার মতো দেখাচ্ছে।…হঠাৎ একটা মোটরের শব্দ পেলাম। পিছন ফিরে দেখলাম, একটা ছোট বেবি অস্টিন দিশেহারার মতো ছুটে আসছে। আমি রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাত নাড়তে লাগলাম যাতে থেমে যায়।…
মোটর আরো কাছে চলে এল। কিন্তু থামার কোনো লক্ষণ দেখলাম না।
মোটরের চালক গাড়ির মুখ একটু অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা করল। আমিও সঙ্গে-সঙ্গে সেদিকে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। মোটরের গতি যেন একটু কমে এল। আমি দাঁড়িয়েই রইলাম।
কিছু বোঝার আগেই জোরে একটা ধাক্কা খেলাম আর ফুটপাথে মুখ থুবড়ে পড়লাম। হাড়গুলো যেন ঝনঝনিয়ে উঠল। ভাগ্য ভালো যে সেরকম কোনো চোট লাগেনি। ওদিকে মোটরের ব্রেক কষতেই চাকা পিছলে গাড়িটা ফুটপাথের উপর একটা গাছে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল।…
আমি উঠে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। মোটরের দরজা খুলে একটা মেয়ে বেরিয়ে এল। গায়ে টকটকে লাল রঙের রেনকোট। আমার হাড়ের ঝনঝনানি বন্ধ হয়ে গেল। শরীরের শিহরন ততক্ষণে ফিরে এসেছে। রাতের অন্ধকারে যদিও শুধু রেনকোটটাই দেখতে পাচ্ছিলাম, কিন্তু তার ভেতরের নরম নারীশরীরের আশাতে টগবগিয়ে উঠলাম।…
তার দিকে এগোতেই সে আমার দিকে ফিরল। আমায় আসতে দেখে সে বৃষ্টির মধ্যে টলোমলো পায়ে দৌড় লাগাল। আমিও পিছনে ছুটলাম। কিছুদূর গিয়েই তাকে ধরে ফেললাম। তার মোলায়েম রেনকোটে আমার হাত পড়তেই সে ইংরিজিতে চেঁচিয়ে উঠল, ‘হেল্প…হেল্প!’
আমি তার কোমর ধরে তাকে কোলে তুলে নিলাম। সে আবার ইংরিজিতে চিৎকার করল, ‘হেল্প, হেল্প…হি ইজ কিলিং মি…!’
আমিও ইংরিজিতেই জিগ্যেস করলাম, ‘আর ইউ এ ইংলিশ ওম্যান?’
বলার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল ‘এ’ নয়, ওটা ‘অ্যান’ হত! সে উত্তর দিল, ‘নো…।’
ইংরেজ মেয়েদেরকে আমার অসহ্য লাগত। আমি বললাম, ‘দেন ইট ইজ অল রাইট।’
এবার সে উর্দুতে বলতে লাগল, ‘তুমি আমায় মেরে ফেলবে…তুমি আমায় মেরে ফেলবে…!’
আমি তখন তার গলার স্বর থেকে তার বয়স আর চেহারা কীরকম হতে পারে তা বোঝার চেষ্টা করছিলাম। কোনো জবাব দিলাম না। তার মুখের উপর থেকে হুড সরানোর চেষ্টা করতে সে দু’হাত দিয়ে হুডসুদ্ধ মুখ শক্ত করে চেপে ধরল। আমি ভাবলাম, ‘থাক! পরে দেখব! এখন মোটর অবধি তো নিয়ে যাই!’
মোটরের দরজা খুলে তাকে পিছনের সিটে ঢুকিয়ে নিজে সামনের সিটে এসে বসলাম। একটু জোর দিতেই গাড়ি স্টার্ট দিল। হ্যান্ডেল ঘোরালাম। গাড়ি ফুটপাথ ছেড়ে রাস্তায় উঠতে অ্যাক্সিলারেটরে চাপ দিলাম। মোটর ছুটল।…
বাড়ি পৌঁছে প্রথমে ভাবলাম চিলেকোঠায় নিয়ে যাই। তারপর মনে হল মেয়েটাকে উপরে তোলা আরেক ঝক্কি। তাই চাকরকে বললাম বৈঠকখানা খুলে দিতে। খোলা হলে মেয়েটাকে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসিয়ে দিলাম। ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মেয়েটা সারা রাস্তা একটা কথাও বলেনি। সোফায় বসেই সে আর্তনাদ শুরু করল, ‘ডোন্ট কিল মি…ডোন্ট কিল মি প্লীজ!’
আমি কাব্য করে বললাম, ‘আই ওন্ট কিল ইউ…আই ওন্ট কিল ইউ ডার্লিং!’
সে কাঁদতে শুরু করল। আমি চাকরকে বাড়ির ভেতরে পাঠিয়ে দিয়ে পকেট থেকে দেশলাই বার করলাম। সবকটা কাঠি দিয়ে চেষ্টা করলাম, কিন্তু একটাও জ্বলল না। বারুদ ভিজে নষ্ট হয়ে গেছিল। কারেন্টেরও বেশ কিছুদিন ধরে কোনো পাত্তা নেই। চিলেকোঠায় লুটের থলিটাতে ব্যাটারি ছিল। কিন্তু আর যেতে ইচ্ছা করল না। আলো দিয়ে কী হবে! ফটোগ্রাফি থোড়াই করব!…নিজের রেনকোটটা খুলে ফেলে আমি তাকে বললাম, ‘আসুন আপনার রেনকোটটা খুলে দিই!’
আমি তার দিকে এগোলাম। কিন্তু সে সেখানে ছিল না। চাকর দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়ে গেছিল। তাই বিশেষ চিন্তা না করে আমি অন্ধকারে তাকে খুঁজতে লাগলাম।
একটু পরেই একজন আরেকজনের সঙ্গে ধাক্কা খেতে একটা তেপায়ায় হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। মেঝেতে পড়ে আমি হাত বাড়িয়ে তাকে খুঁজতে লাগলাম। তার গলায় হাত লাগতেই সে আবার চিৎকার করে উঠল। আমি বললাম, ‘তুমি চিৎকার করছ কেন?… আমি তোমায় মারব না!’
সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল।
আবার হাত বাড়াতে আমার হাত গিয়ে পড়ল তার পেটে। তার শরীর শক্ত হয়ে গেল।
আমি কোনোভাবে তার রেনকোট খুলতে শুরু করে দিলাম। এই মোমের কাপড়গুলো বিচিত্র! জরাগ্রস্ত বুড়ো শরীরের মতো! সে কাঁদতে কাঁদতে ছটফট করতে লাগল। কিন্তু আমি সবকটা বোতাম শেষ পর্যন্ত ঠিক খুলে ফেললাম। হাতে ছুঁয়ে বুঝতে পারছিলাম যে সে শাড়ি পরে আছে। ভাবলাম, তা ভালো! সুবিধাই হবে!
আমি তার শরীরে হাত বোলাতে লাগলাম। সুডৌল পা। পায়ে হাত দিতে সে কঁকিয়ে উঠে একদিকে সরে গেল। এর আগে অবধি আমি এমনিই আলতুফালতু এই ওই করছিলাম। তার পা ছুঁতেই যেন আমার শরীরে চারশো চল্লিশ ভোল্টের বিদ্যুৎ খেলে গেল। কিন্তু আমি তাড়াহুড়ো করলাম না। সবুরে মেওয়া ফলে! আমি আবার কাব্য করতে শুরু করে দিলাম।
‘ডার্লিং!…তোমায় খুন করব বলে নিয়ে আসিনি!…ভয় পেও না। তুমি এখানে সুরক্ষিত।…বাইরে গেলে লোকজন জন্তুর মতো তোমায় ছিড়ে খাবে!…যতদিন দাঙ্গা চলছে, তুমি আমার সঙ্গে এখানেই থাকো।…তুমি শিক্ষিত মেয়ে!…ওই অশিক্ষিত লোকেদের হাতে পড়লে তোমায় ওরা ছেড়ে দেবে না!’
সে ফোঁপাতে ফোঁপাতে জিগ্যেস করল, ‘ইউ ওন্ট কিল মি?’
আমি বললাম, ‘নো স্যর!’
সে কাঁদতে কাঁদতে হেসে ফেলল। আমার তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে গেল, মেয়েদের ‘স্যর’ বলে না! নিজের উপর খুব বিরক্তি এল, কিন্তু একটু সাহস পেলাম যে সে হেসেছে। আর তাহলে একে বাগে আনতে কতক্ষণ! আমিও হেসে বললাম, ‘ডার্লিং, আমি ইংরিজিতে নেহাৎই কাঁচা।’
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে সে জিগ্যেস করল, ‘তুমি আমায় মারতে না চাইলে এখানে আনলে কেন?!’
কী বিদঘুটে প্রশ্ন! আমি ভাবতে লাগলাম, কী বলা যেতে পারে! তারপর ঠিক করলাম, যা একটা কিছু মনে আসে বলে দিই। অত ভেবে কী হবে!
‘আমি তোমায় মারতে চাই না। একেবারেই না। খুনোখুনি আমার ভালো লাগে না।…তোমায় এনেছি…কারণ…কারণ আমি একা ছিলাম। এই একাকিত্ব আর ভালো লাগছিল না।’
সে বলল, ‘কেন? তোমার চাকর তো আছে তোমার সঙ্গে!’
আমি না ভেবে উত্তর দিলাম, ‘যাঃ বাবা! চাকর দিয়ে কী হবে! ও তো কাজের লোক!’
সে চুপ করে গেল।
আমার মাথায় তখন কেন জানি না ভদ্রতা চেপে বসল। আমি বললাম, ‘তুমি যেতে চাইলে চলে যাও…আমি জোর করে আটকে রাখব না।’
আমি তার হাত ধরলাম। সে উঠে দাঁড়াল। তার পায়ের স্পর্শ মনে পড়তেই আমার শরীরে আবার ফুলকি দিয়ে আগুন জ্বলে উঠল। আমি তাকে বুকে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। আমার গলার উপর তার গরম নিঃশ্বাস। বৃথা সময় ব্যয় না করে আমি ঝটপট আমার ঠোঁট দিয়ে তার ঠোঁট দুটো চেপে ধরলাম। সে কেঁপে উঠল। আমি বললাম, ‘ডার্লিং…আমি তোমায় মারব না।’
সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘আমায় ছেড়ে দাও!’
আমি তাকে ছেড়ে দিলাম। পরমুহূর্তেই তাকে কোলে তুলে নিয়ে সোফায় শুইয়ে দিলাম। রাস্তায় বুঝতে পারিনি, কিন্তু তখন দেখলাম তার কোমর আর ঊরু মাখনের মতো নরম! তার হাতে একটা ব্যাগও ছিল। অন্ধকারে হাতড়ে সেটাকে নিয়ে ঘরের একপাশে ফেলে দিলাম। বললাম, ‘এতে কোনো দামি জিনিস থাকলেও তোমার চিন্তা নেই! এখানে কেউ কিচ্ছু নেবে না।… বরং তুমি চাইলে আমি তোমায় কিছু দিতেও পারি।’
‘আমি কিছু চাই না।’
‘কিন্তু আমি চাই।’
‘কী?’
‘তোমায়।’
সে আবার কেঁপে উঠল।
আমি মেঝেতে বসে পড়ে তার পায়ে আঙ্গুল বোলাতে লাগলাম। তার শরীর কাঁপছিল। আমি হাত বোলাতেই থাকলাম। সে যখন কোনো বাধা দিল না, আমার মনে হল হয়তো বাধ্য হয়ে সে সহযোগিতা করছে!
আমার মনটা তেতো হয়ে গেল। আমি বললাম, ‘দেখো, আমি জোর করে কিছু করতে চাই না…তোমার অসুবিধা থাকলে কিছু করব না। তুমি চলে যেতে পারো।’
আমি উঠতে যাব এমন সময় সে আমার হাতটা নিয়ে নিজের বুকের উপর রাখল। আমি উত্তেজিত হয়ে ‘ডার্লিং’ বলে তার সঙ্গে লেপ্টে গেলাম। দুজন দুজনকে চুমোয় চুমোয় ভরে দিলাম। সে শিউরে শিউরে উঠছিল আর আমায় ‘ডার্লিং’ বলে ডাকছিল। আমিও কীসব যেন আবোলতাবোল বকছিলাম। একটু পরে বললাম, ‘রেনকোটটা খোলো না! ভীষণ বিরক্তিকর!’
সে নেশাতুর গলায় বলল, ‘তুমিই খুলে দাও।’
আমি তাকে তুলে দাঁড় করিয়ে রেনকোটটা খুলে একদিকে ছুঁড়ে দিলাম। সে সোহাগী গলায় প্রশ্ন করল, ‘তুমি কে?’
আমার তখন নিজের বংশপরিচয় শোনানোর কোনো ইচ্ছা ছিল না। আমি আরো সোহাগের সঙ্গে বললাম, ‘তোমার ডার্লিং।’
‘ইউ আর এ নটি বয়’, বলে সে দু’হাতে আমার গলা জড়িয়ে ধরল। আমি তার ব্লাউজের বোতাম খুলতে যেতে সে অনুরোধ করল, ‘খুলো না!’
‘কী হবে! অন্ধকার তো!’
‘তাও! খুলো না…প্লীজ!’
আমি কিছু বলার আগেই সে আমার দুটো হাত ধরে চুমু খেতে শুরু করল। কাঁপা গলায় বলল, ‘লজ্জা করে!’
আমি অবাক হলাম। এতে আবার লজ্জা কী! কিন্তু কিছু বললাম না। ভাবলাম একটু পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি একটুক্ষণ চুপ করে রইলাম। সে ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করল, ‘তুমি রাগ করলে?’
আমি জানতাম না রাগ করেছিলাম কিনা। বললাম, ‘রাগ করব কেন?!… তুমি ব্লাউজ খুলতে চাও না তো খুলো না…কিন্তু…’, বলতে বলতে আমার হঠাৎ লজ্জা লাগল। আমি একটু ঘুরিয়ে বললাম, ‘কিন্তু কিছু তো হবে, নাকি?! শাড়িটাই খুলে ফেল না-হয়!’
সে শুকনো গলায় বলল, ‘ভয় করছে!’
আমি আদর করে বললাম, ‘কীসের ভয়?’
সে ডুকরে কেঁদে উঠল। আমি সান্ত্বনা দিতে বললাম, ‘আমি তোমায় কোনো কষ্ট দেব না। তোমার ভয় করলে কিছু করব না।…দু’তিনদিন এখানে থাকো…আমার ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হয়ে গেলে তখন না-হয় ভাবব।’
সে কাঁদতে থাকল, ‘না…না!’
তারপর আমার পায়ে মাথা রেখে ফোঁপাতে লাগল। আমি তার মাথায় হাত বোলাতে লাগলাম। আচমকা সে আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। সোফা থেকে তুলে নিয়ে তাকে মেঝের উপর আমার কাছে বসিয়ে দিলাম।… হঠাৎ চৌকাঠের নীচ দিয়ে যেন একটা আলোর রেখা দেখা গেল। তখুনি দরজায় আলতো ধাক্কা। আমি বললাম,’কে?’
চাকরের গলা, ‘লণ্ঠন এনেছি, হুজুর।’
আমি বললাম, ‘আচ্ছা।’
আমার ডার্লিং ভীতস্বরে বলল, ‘না…না!’
আমি বললাম, ‘কোনো অসুবিধা নেই! তোমার লজ্জা করবে না। আমি লণ্ঠনের আলো একদম কমিয়ে একটা কোণায় রেখে দেব।’
আমি চাকরের হাত থেকে লণ্ঠনটা নিয়ে দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিলাম। এতক্ষণ পরে হঠাৎ আলোতে চোখ দুটো ধাঁধিয়ে গেল। সে একটা কোণে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। আমি বললাম, ‘উফ! এত কীসের লজ্জা বল তো?…একটু আলোয় বসে গল্প করি, তারপর যখন তুমি বলবে নিভিয়ে দেব।’
সে কোনো উত্তর দিল না। আমি লণ্ঠন হাতে তার দিকে এগোতেই সে শাড়ির আঁচল টেনে দু’হাতে মুখ ঢেকে নিল।
‘বড্ড মুশকিল তো! নিজের বরের কাছেও লজ্জা!’
আমার সত্যিই মনে হচ্ছিল যে সে আমার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী। নতুন বরের মতো বললাম, ‘আচ্ছা বাবা! জেদ করলে কর!…তোমার লুকোচুরি খেলাতেও আমি রাজি।’
হঠাৎ বাইরে একটা বিস্ফোরণের শব্দ হল। চমকে উঠে সে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি বললাম, ‘ভয় পেও না!…মামুলি ব্যাপার…আকছার হচ্ছে!’
আমার দুম করে মনে হল, যেন আমি তার মুখ একঝলক দেখতে পেয়েছি! তার ডান কাঁধ ধরে তাকে সোজা দাঁড় করিয়ে ভালো করে তাকালাম…কী দেখলাম তোমায় কী বলব!…
ভয়ানক একটা মুখ! চিমসানো দুটো গাল! তাতে ঘন মেকআপ করা। বৃষ্টিতে ভিজে মেকআপ জায়গায় জায়গায় উঠে গিয়ে আসল চামড়া বেরিয়ে পড়েছে। যেন চল্টা ওঠা পুরনো দেওয়াল! প্রায় উঠে যাওয়া রুক্ষ চুলের মধ্যে অজস্র পাকা চুল যেন দাঁত বের করে আছে। এ কান থেকে ও কান পর্যন্ত একটা মোমের ফুল চুলের সঙ্গে জট পাকিয়ে গেছে!…
আমি অনেকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। আমার আর তখন মাথা কাজ করছে না! একটু বাদে সামলে নিয়ে আমি একদিকে লণ্ঠন রেখে দিয়ে বললাম, ‘তুমি যেতে চাইলে চলে যাও।’
সে কিছু একটা বলতে চাইল। কিন্তু আমায় তার রেনকোট আর ব্যাগ হাতে নিতে দেখে আর কিছু বলল না। আমি অন্যদিকে ফিরে তার হাতে জিনিস দুটো ধরিয়ে দিলাম। সে বোধহয় কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল। শেষে দরজা খুলে সে বেরিয়ে গেল…।’
গল্পটা শোনার পর আমি প্রশ্ন করলাম, ‘উনি কে ছিলেন জানো?’
স বলল, ‘না তো…!’
‘বিখ্যাত আর্টিস্ট মিস ম…!’
স আর্তনাদ করে উঠল, ‘মিস ম!! যার আঁকা ছবি দেখে দেখে আমি স্কুলে ছবি আঁকতাম!’
‘হ্যাঁ, সেই মিস ম।…একটা আর্ট কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন…মেয়েদের ছবি আঁকা শেখাতেন…নারীর আর ফুলের ছবি…শুধু নারী আর ফুলই আঁকা শেখাতেন উনি…আর ছেলেদের প্রতি নাকি বেশ বিরূপ ছিলেন!’
স কী যেন ভাবতে লাগল। তারপর চমকে উঠে প্রশ্ন করল, ‘উনি এখন কোথায়?’
আমি হেসে বললাম, ‘উপরে…!’
‘মানে?’
‘সেদিন রাতে…যেদিন তুমি ওনাকে বাইরে বের করে দিয়েছিলে, সেদিন রাতে…মোটর দুর্ঘটনা হয়ে উনি মারা যান!…শুধু আমিই জানি যে তাঁর খুনি আসলে তুমি!…না…শুধু ওনাকে না, দুজন নারীকে মেরেছিলে তুমি…একজন যাঁকে বিখ্যাত আর্টিস্ট হিসেবে পুরো পৃথিবী চিনত, আর অন্যজন যে প্রথমজনের খোলস ছেড়ে তোমার বৈঠকখানায় বেরিয়ে এসেছিল…যাঁকে শুধু তুমিই চিনতে।…’
স চোখ দুটো বুজে ফেলল।