ডার্করুম
১
—“দাদার মৃত্যুটা কি সত্যিই স্বাভাবিক ছিল ডক্টর?”
ডঃ ব্যানার্জী মুখ তুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জরিপ করছেন আমায়। অনড় ট্র্যাফিক সিগন্যালের মতো অপলক দৃষ্টি! সে দৃষ্টির সামনে নড়াচড়া যায় না। শ্বাসপ্রশ্বাস স্তব্ধ হয়ে যায়। আমি রুদ্ধশ্বাসে বসেছিলাম। আরও কতক্ষণ ওভাবেই নিশ্চল, স্থবির হয়ে বসে থাকতে হত কে জানে। আচমকা ঘরের টিউবটা দপদপ করে উঠল! ভোলটেজের তারতম্যের সাথে সাথেই চোখের পাতা ফেললেন তিনি। তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ঢিমে উচ্চারণে বললেন,
—“তুমি এত সন্দেহপ্রবণ কেন দীপঙ্কর? সন্দেহটা ঠিক কোন্ বিষয়ে? তোমার দাদার মৃত্যুর বিষয়ে? না আমার ডাক্তারিবিদ্যের উপরে?”
আমি মাথা নিচু করেছি। হয়তো আমার সন্দেহ করা উচিত নয়। অথবা সন্দেহ হলেও চেপে যাওয়াই বাঞ্ছনীয় ছিল। ড. ব্যানার্জী নিজের অধীত জ্ঞানের বিষয়ে ভয়াবহ স্পর্শকাতর। বুঝলাম, তাঁর অহংবোধকে স্পর্শ করে ফেলেছি আমি।
—“শেষ কয়েকটা দিনের অ্যাক্টিভিটি লক্ষ্য করো দীপঙ্কর,” তিনি আমায় বোঝাতে শুরু করলেন, “পার্শিয়াল প্যারালাইসিস। যার জন্য তোমার দাদা জল খেতে পারছিলেন না। জল দেখলেই আঁতকে উঠছিলেন! গলায় খিঁচ ধরছিল।”
মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেল, “কিন্তু দাদা তো কখনও বলেনি যে ওর জল খেতে কষ্ট হচ্ছে বা গলায় খিঁচ ধরছে! ও শুধু জল দেখলেই ভয় পেত!”
ডাক্তারবাবুর মুখ বিরক্তিতে বেঁকে গেছে, “তোমার দাদা আদৌ কি তার সুবিধে-অসুবিধের কথা জানানোর মতো মানসিক অবস্থায় ছিলেন? ডোন্ট মাইন্ড দীপ, বাট একজন সাইকায়াট্রিক পেশেন্টের কাছে তুমি কী আশা করো? শেষ দু’বছর যে মানুষ কমিউনিকেট করার পর্যায়েই ছিল না, মৃত্যুর আগে সে কী করে নিজের কষ্টের কথা এক্সপ্রেস করবে? কষ্ট হচ্ছিল বলেই জল দেখে ভয় পাচ্ছিলেন। জল খেতে চাইছিলেন না।”
আমি চুপ করে থাকি। দাদার শেষ মুহূর্তের চিৎকারগুলো মনে পড়ে যায়! কী যন্ত্রণাময় আর্তনাদ! অত কষ্ট পাচ্ছিল বলেই কি ….
— “তাছাড়া ডিল্যুশন, হ্যালুসিনেশন, কনফিউশন, ইনসমনিয়া এগুলোও তো তোমার দাদার ছিল। এগুলো সবই হাইড্রোফোবিয়ার লক্ষণ। তোমার দাদা ঘুমোতেন না। ভয় পেতেন। উলটোপালটা জিনিস দেখতেন, সবচেয়ে বড় কথা যে জল খেতে পারছিলেন না, বা চাইছিলেন না।”
—“কিন্তু ডক্টর,” আমি তাঁর বক্তৃতায় বাধা দিয়ে বলি, “তবে যে দাদা সন্দেহ করত, তাকে কেউ বিষ খাওয়াচ্ছে!”
—“কী মুশকিল!” ড. ব্যানার্জী আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন গোটা একখানা ডিকশনারি লিখে ফেলার পর তাঁকে আমি ‘এ, বি, সি, ডি’ লিখতে বলেছি। স্বাভাবিক! আমার মতো লোক যদি ডাক্তারের সঙ্গে ডাক্তারি নিয়ে তর্ক করে, তবে বিরক্ত হওয়াই অবধারিত। নেহাত উনি আমাদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান ও নিপাট ভদ্রলোক বলে এখনও গলাধাক্কা দিয়ে চেম্বার থেকে বের করে দেননি! চেম্বারের বাইরে রুগি গিজগিজ করছে। আর আমি এখানে বসে ভদ্রলোকের সঙ্গে হ্যাজাচ্ছি।
—“ওয়েল দীপ, জলাতঙ্কের ওটাও একটা সাইন। ডিল্যুশন অব পার্সিকিউশন বা নির্যাতনমূলক ভ্রান্তি বলতে পারো। তার চেয়েও অবশ্য পার্ফেক্ট টার্ম ‘প্যারানইয়া’। তুমি তো জানোই, একজন প্যারানয়েড সবসময়ই অকারণে ভয় পায়। ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে! এবং সবসময় সন্দেহ করে যে তাকে ঘিরে কোনও ষড়যন্ত্র হচ্ছে! কেউ তাকে মেরে ফেলতে চায়! তোমার দাদা ‘বিষ… বিষ’ করে হিস্টিরিক হয়ে উঠতেন। প্যারানইয়া ইজ অলসো আ সিম্পটম অব হাইড্রোফোবিয়া! এর বেশি আর কী প্রমাণ দেব?”
আমি নিস্তব্ধ হয়ে ড. ব্যানার্জীর কথা শুনে যাই। উনি একের পর এক জলাতঙ্কের সিম্পটম বলে যাচ্ছেন। সত্যিই ভদ্রলোক অনেক কিছু জানেন। উনি ভুল বলছেন না। দাদার সিম্পটমগুলো সবই হাইড্রোফোবিয়ার। ওঁর অভিজ্ঞতা অনুযায়ী ঠিকই ধরেছেন। জলাতঙ্কের রোগিদের মধ্যে এই বিশেষ লক্ষণগুলো দেখা যায়।
কিন্তু একটা কথা উনি জানেন না। অথচ আমি জানি। এ বিষয়ে ওঁর থেকে আমার জ্ঞান স্বাভাবিকভাবেই বেশি! কথাটা ড. ব্যানার্জীকে বলাই যেত। কিন্তু মায়ের নিষেধ!
জলাতঙ্কের ভাইরাস, র্যাবিস, কোনও মানবদেহে সরাসরি আসতে পারে না। কোনও র্যাবিস আক্রান্ত কুকুর-বিড়ালের কামড় বা আঁচড়ের মাধ্যমেই আসতে হয় তাকে! এটা আমি বা ড. ব্যানার্জী ছাড়াও পৃথিবীর সমস্ত মানুষই জানে।
অথচ আমি জানি যে-কোনও কুকুর বা বিড়ালের আঁচড় বা কামড় দাদা কখনও খায়নি! আঁচড়, কামড় তো দূর, কোনও কুকুর বা বিড়ালের সংস্পর্শে সে কোনওদিনই থাকত না! শেষ কয়েকবছর ঘরবন্দী অবস্থাতেই কাটিয়েছে। যেদিন থেকে ওর মাথার গোলমাল প্রকট হয়ে ধরা পড়ল, সেদিন থেকেই লোকসমাজে আর পা রাখেনি! যে আড়ালে সে শেষ কয়েকটা বছর কাটিয়ে গেছে, সেখানে উটকো মানুষের চোখও তাকে স্পর্শ করতে পারত না। কুকুর-বিড়াল তো দূর অস্ত!
কিন্তু সেই দাদাই শেষপর্যন্ত মারা গেল হাইড্রোফোবিয়ায়!
—“এত কথার পরেও যদি তোমার বিশ্বাস না হয়, তবে জানিয়ে রাখি যে তোমার দাদার মৃত্যুর কিছু আগেই স্কিন স্যাম্পল নিয়েছি আমি। পলিমেরাস চেইন রি-অ্যাকশন, মানে পি সি আর টেস্টের পর ফাইনালি জানা যাবে রোগটা সঠিকভাবে হাইড্রোফোবিয়া কি না! যদিও আমি এখনই চোখ বুজে বলে দিতে পারি….”
—“ডাক্তারবাবু, স্কিন স্যাম্পল টেস্ট থেকে তো বিষের ট্রেসও পাওয়া যেতে পারে, তা-ই না?”
ড. ব্যানার্জী বিস্ফারিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন! যেন ‘বিষ’ শব্দটা শুনে মুহূর্তের জন্য শিউরে উঠলেন! কোনওমতে স্খলিত গলায় বললেন, “দীপঙ্কর! তুমি কি…”
মা বললেন, “নাঃ, থাক…”
২
আজকাল বাড়িটা ক্রমশ আমার অপরিচিত হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হয় দীর্ঘ তিরিশ বছর এ বাড়িতে থেকেও আসলে কিছুই, কাউকেই চিনতে পারিনি। কোথাও কিছু অপ্রকাশিত ছায়ারা লুকিয়ে ছিল, যারা আজকাল মাঝে মধ্যেই দুম করে বেরিয়ে আসে। তখন একটা অদ্ভুত বিস্ময় মেরুদণ্ড বেয়ে শিরশির করে উঠে আসে। আজন্ম পরিচিত বাড়িটা একনিমেষে অন্ধকূপ হয়ে যায়।
এইমুহূর্তে তেমনই একটা ছায়া মায়ের মুখে উঁকি দিয়েই মিলিয়ে গেল, যখন মা বললেন সেই শব্দটা, “নাঃ, থাক।”
—“কেন থাকবে? ড. ব্যানার্জীকে জানালে ক্ষতি কী?”
মা উত্তর দিলেন না। তার নীরব চলে যাওয়ায় ভেসে ওঠে আরও একটা উদাসীন ছায়া!
অসহ্য লাগে এই নীরবতা! দাদাও ছবি হয়ে গিয়ে সদ্য সদ্য নীরবতা শিখেছে। যখন বেঁচে ছিল তখনও অবশ্য খুব বেশি কথা বলতে দেখিনি। শুধু জলের গ্লাসটা এগিয়ে দিলেই,
—“বিষ! বিষ! বিষ আছে, জলে বিষ আছে, পাপ আছে… পাপ…! ঢাকনাটা খুলিস না খোকন, খুলিস না…”
সেই চিৎকার! এখনও আমার কানে ভাসে! কী প্রচণ্ড আতঙ্ক!
শেষ দিকে দাদার চোখে শুধু দুটো অনুভূতিই ছাপ ফেলত। ঘৃণা আর ভয়। চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে যেত। মুখ বেয়ে পড়ত লালা! কখনও মনে হত এই বুঝি সব ওলট-পালট করে দুমড়ে মুচড়ে দেবে! আবার কখনও যেন ভীষণভাবে কুঁকড়ে যেত! হ্যাঁচোড়-পাচোড় করে খুঁজত একটা আশ্ৰয়। শামুকের মতো একটা মানবখোল! শেষ কয়েকদিন দাদাকে জাপটে ধরে ভুলিয়ে ভালিয়ে শান্ত করতে হত। দাদা আমায় আঁকড়ে ধরে ঘুমোনোর চেষ্টা করত। তখন ওর হৃৎস্পন্দন বুকের উপর টের পেয়েছি! একটা শক্তিশালী টারবাইনের মতো হৃৎপিণ্ডটা ধুকপুক করে যাচ্ছে! প্রতিটা স্পন্দন নিরাপত্তাহীনের মতো চিৎকার করতে করতে বলত, “খুলিস না… খুলিস না… খুলিস না…”
কী ছিল গ্লাসের মধ্যে! বিষ! অসম্ভব! কে বিষ মেশাবে? তাহলে? পাপ আছে? কার পাপ? জল কেন খেতে চাইত না সে? কাকে ভয় পেত? কাকেই বা ঘৃণা? নাকি গোটাটাই এক মানসিক বিকারগ্রস্ত রোগির প্রলাপ? দাদা নেই আজ প্রায় দু’সপ্তাহ হল। তার আগে আরও পনেরো দিন তার এই উন্মত্ত প্রলাপ শুনেছি। মর্মার্থ আজও বুঝে উঠতে পারিনি!
—“জল! খালি চতুর্দিকে জল! খোকন, ও আমায় টেনে নেবে জলের ভেতর! খোকন, খুলিস না! ঢাকনাটা…”
দাদার আতঙ্ক এই বাড়ির দেওয়ালে অনুরণিত হতে হতে আজ ঘুমিয়ে পড়েছে! কীভাবে সে যেন অজান্তেই তার মনের অন্ধকার ঘরটায় চলে গেল, আর আলোয় ফিরল না!
এখন এই ঘরটাও নীরব। পায়ে বাঁধার শিকলটাও ঝনঝনানির বাচালতা ছেড়ে নিঃশব্দ ঘুমে মগ্ন! সন্ধ্যার নরম লালচে শেষ আলোটুকু এসে পড়েছে জানলার ফাঁক দিয়ে। নিষ্প্রভ আলো ছড়িয়ে পড়ছে বাড়ির পিছনের এঁদো পুকুরটায়। কচুরীপানাগুলোর সবুজ রং ফ্যাকাশে হলুদ আভায় বিচিত্রবর্ণ ধারণ করেছে! পাশের কুয়োটার অবস্থাও তথৈবচ! কতদিন আগে ওটার জল ব্যবহারযোগ্য ছিল কে জানে! আমি অবশ্য জন্মাবধি বাড়িতে টিউবওয়েলের ব্যবহার দেখে আসছি। তারপর এল ট্যাপ কল! কুয়োটার কোনও কাজ ছিল না! ওটা একটা প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর ফসিলের মতো আজও বিরাট অন্ধকার হাঁ করে বসে আছে! ভিতরের জল কর্দমাক্ত! বিষের মতো পিঙ্গল!
আগে এই ঘরটাতেই দাদা থাকত। একসময় আমার ফটোগ্রাফার হওয়ার খুব শখ ছিল। ভেবেছিলাম, এই ঘরটাকেই ডার্করুম করব। এমনিতে সব দিক দিয়েই ঘরটা ডার্করুমের উপযুক্ত। অন্যান্য ঘরের তুলনায় বেশ বড়। আলোর উৎস হিসাবে থাকার মধ্যে আছে একটা ছোট জানলা। ওটাকেও বেশ টাইট মেরে বন্ধ করে দিয়েছিলাম। সহজে খোলা যেত না! কিন্তু ডার্করুম করা শেষপর্যন্ত আর হয়ে উঠল না। দাদা এই ঘরটাতে এসে ঠাঁই নিল! ওর আলো সহ্য হত না। চোখে তীব্র আলো পড়লেই খেপে উঠত! হাতের কাছে যা পেত ছুড়ে মারত! দু-একবার বউদির উপরেও হিংস্রভাবে চড়াও হয়েছে। আঁচড়ে, কামড়ে প্রায় ফালাফালা করে ছেড়েছে। তাই বাধ্য হয়েই তাকে আমার শখের ডার্করুমটা ছেড়ে দিতে হল। দাদার দু’পায়ে শিকল পড়ল। যাতে যখন তখন কাউকে আক্রমণ না করতে পারে।
এখন যে বিছানাটার উপরে বসে আছি, সেটাতে কিছুদিন আগেও চুপ করে বসে থাকত দাদা। ভয়ে সিঁটিয়ে ফিসফিস করে বলত, “দেখেছিস খোকন! দেওয়ালে কে যেন হেঁটে বেড়াচ্ছে!”
আমি অবাক। প্লাস্টার অব প্যারিসের সাদা ধবধবে দেওয়ালে শুধু আমাদের দু’জনের হালকা ছায়া! দাদার চড়া আলো সহ্য হয় না বলে এ ঘরে মা আলোর বন্দোবস্ত করেননি। সন্ধে হলেই এককোণে একটা কেরোসিনের বাতি মৃদু রশ্মি ছড়াত। সেই রশ্মিতেই দু’জনের ছায়া দেওয়ালে ফুটে উঠেছে। স্পষ্ট নয়, শিখার সঙ্গে থেকে থেকে কেঁপে উঠছে!
অথচ দাদা সেই দেওয়ালের দিকে তাকিয়েই চিৎকার করত! কখনও হিংস্র অথচ অসহায় কণ্ঠে বলত, “কেন এসেছ? কেন এসেছ? আমি ভয় পাই না! যাও, চলে যাও! আর আসবে না! কক্ষনও আসবে না!” কখনও বা হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে জাপটে ধরত আমায়, “খোকন, ওকে চলে যেতে বল! ও আমায় ভয় দেখায়! সবসময় ভয় দেখায়। ওকে তাড়িয়ে দে! তাড়িয়ে দে!”
আমি বুঝে উঠতে পারতাম না কাকে তাড়াব! কেউ থাকলে তবে তো তাড়াব তাকে! শূন্য সাদা দেওয়ালে নিজের ছায়া দেখেই দাদা চমকে উঠত। ভয় পেত। আমায় আরও জোরে চেপে ধরত, “শুনছিস? ও চিৎকার করছে? আমি… আমি পারছি না! আমার মাথা ফেটে যাচ্ছে! ওকে তাড়িয়ে দে খোকন… নয়তো… নয়তো…” বলতে বলতেই জোরে জোরে মাথা ঠুকত দেওয়ালে! যেন তখনই নিজের মাথাটা দু’টুকরো করে ছাড়বে!
কোনওমতে তখন তাকে সামলাতে হত। দাদা প্রথমে ভেঙে পড়ত! তারপর আকস্মিক ভাবেই খেপে উঠে বলত, “কী ভেবেছে? এভাবে আমায় মারবে? দেওয়ালে যখন তখন ঘুরে বেড়াবে! আমি গোটা দেওয়ালটাই কালো করে দেব! কালোয় কিচ্ছু দেখা যাবে না! সাদা দেওয়াল বলে মাজাকি মারছ! দেওয়াল কালো হয়ে গেলে কী করবে? কী করবি শুয়োরের বাচ্চা! আমি দেওয়াল, ছাত, দরজা সব কালো করে দেব!”
সত্যিই তাই করেই ছেড়েছিল দাদা। মা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ঘরটার দেওয়াল ছাত সব লোক দিয়ে কালো রং করে দিয়েছিলেন। সেই দিনটা দাদাকে ভীষণ শান্ত দেখেছিলাম। এখন আর দেওয়ালে কিছু দেখা যাবে না ভেবে সে শান্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল!
এখনও এ ঘরের দেওয়ালটা কালো! আক্ষরিক অর্থে ডার্করুম! কিন্তু সেই ডার্করুমও দাদার মৃত্যু ঠেকাতে পারল না। ড. ব্যানার্জী ঠিকই বলেছেন। সবটাই দাদার হ্যালুসিনেশন ছিল। হয়তো ওঁর কথা মতো হাইড্রোফোবিয়ার লাস্ট স্টেজের সিম্পটম!
দাদা বেঁচে থাকতে এই জানলাটা খোলা হত না। এখন আমি খুলে দিয়েছি। এই জানলাটা দিয়েই একসময় সূর্যাস্ত দেখা যেত। সূর্যটা বেশ হাঁসের ডিমের কুসুমের মতো লাল হয়ে যেতে যেতেই টুপ করে ডুব দিত ঝিলে। মনে আছে যখনই সূর্যাস্ত হত তখনই সন্ধ্যার লোকাল ট্রেন ঝমঝম করে চলে যেত। তার শব্দ এখান থেকেই শোনা যেত তখন। এক ফোঁটা এদিক-ওদিক হতে দেখিনি কখনও। আর ঠিক তার ভোঁ-এর সঙ্গেই সুর মিলিয়ে তুলসিতলায় মায়ের শাঁখ বেজে উঠত।
এখন আর সে দৃশ্য দেখা যায় না! শব্দও শোনা যায় না। ঝুপ ঝুপ করে একগাদা বাক্সবাড়ি উঠে পড়ে প্রকৃতিকে বড় কৃপণ করে ফেলেছে!
—“ঠাকুরপো!”
বউদি কখন ঘরে এসে ঢুকেছে ঠিক টের পাইনি। শাঁখা-সিঁদুরহীন বউদিকে কেমন যেন অদ্ভুত লাগছিল। একটা স্বচ্ছ মোমের প্রলেপের মতো মুখে কীসের যেন ছায়া! মৃত্যু আর শোকের একটা প্রলেপ আছে। সঠিক বলতে পারব না। আমার অনেকটা নীলচে সাদা ছায়ার মতো মনে হয়। গাঢ় নীল নয়। অনেকটা বরফে ঢাকা শৃঙ্গের নীলচে শিরা-উপশিরার মতো। অথবা বার্নারের নীল শিখার আভার মতো! তেমনই একটা ছাপ!
মনে হচ্ছিল বউদি নির্লিপ্ততার মুখোশ পড়েছে! এটা ঠিক তার নিজের মুখ নয়! মুখোশই বটে! দাদাকে নিয়ে কোন্ সুখেই বা ছিল বউদি যে তার মৃত্যুতে শোকগ্রস্ত হবে? দাদাকে ভালোই বা বেসেছে কবে! বিয়ের কয়েক মাস বাদেই যে মেয়ে আবিষ্কার করে যে তার স্বামী পাগল, তার কি আর ভালোবাসার ক্ষমতা থাকে? অন্য কোনও মেয়ে হলে ডিভোর্স অবধারিত ছিল। কিন্তু বউদি গরীব ঘরের মেয়ে। সে বড় মেয়ে। এরপরে আরও চারটে বোন বিয়ের সারিতে আছে। তাই ফিরে যেতে পারেনি। বরং অন্য রাস্তা ধরেছিল…
বউদি বলল, “তুমি এখন চা খাবে?”
আমি বউদিকে স্থির দৃষ্টিতে জরিপ করছিলাম। মেয়েরা কি জন্মগতই অভিনেত্রী হয়? এখন দেখলে কেউ বলবে যে এই মহিলাই একদিন নিজের দেওরের বক্ষলগ্না হয়ে বলেছিল,
—“ওই লোকটা না থাকলেই ভালো হত, তা-ই না?”
আমিও জানতাম, না থাকলেই ভালো হত। মনে মনে কয়েকবার ভাবিনি যে তাও নয়। কিন্তু বউদির মুখ থেকে কথাটা শুনে কেমন যেন আহত হয়েছিলাম। কোথায় আঘাত লেগেছিল? বিবেকে? ঠিক জানি না! আমি লোভী, ইতর, পরস্ত্রীলোভী লম্পট হতে পারি— কিন্তু খুনী নই। সবচেয়ে বড় কথা হল যে তার সঙ্গে সঙ্গে আমি মহান ভন্ডও বটে! নিজের উন্মাদ দাদার স্ত্রীয়ের সঙ্গে শারীরীক ভাবে মিলিত হতে কোন আপত্তি নেই। অথচ যখন সেই মহিলাই এই কথা বলল তখন আমি বলেছিলাম, “ছিঃ!”
আমার অহঙ্কার ছিল আমি অন্তত খুনী নই। নিজের দাদাকে খুন করা তো দূর, সে কথাও ভাবতে আমার আপত্তি! তাই সেদিন ভ্রষ্টা স্ত্রীলোককে ‘ছিঃ’ বলতে আটকায়নি! অথচ সেই মহা ধার্মিকতার পিছনে কী ছিল? চূড়ান্ত কাপুরুষতা?
—“খোকন! পাপ! পাপ আছে! বিষ… বিষ আছে জলে, বিষ!” হঠাৎ টের পেলাম একটা অদ্ভুত সরীসৃপ আমার বুকের ভিতরের পাকদন্ডী বেয়ে উঠে আসছে। কার পাপ? কীসের পাপ? কে বিষ দেবে? কার ভয়? কাকে ঘৃণা! তবে কি দাদা সব জানত? বউদিই দাদাকে বিষ দেয়নি তো! সেকি তবে আমার পাপ! আমারই? অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল।
—“চা দেব?”
আমি তখনও আঁতিপাতি করে কী যেন খুঁজে ঢলেছি। প্রত্যেকটা ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত ঝেড়েঝুড়ে, তন্নতন্ন করে হাতড়িয়ে দেখছি, কোথাও কোনও অদৃশ্য ছায়া ছিল কি? কলঘরের অন্ধকারে, রাতের বিছানায়, চিলেকোঠার নিঃসঙ্গ একান্ত ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে কোনও চোখ কিছু দেখে ফেলেনি তো! দাদাকে তখনও তো বেঁধে রাখার প্রয়োজন পড়েনি। আমাদের চূড়ান্ত আনন্দের প্রতিটা পল, প্রতিটি মুহূর্ত আমার কাছে অসহ্য ঠেকছিল। ছিল? কেউ ছিল কি? অনভিপ্রেত কোনও চোখ?
—“কী হল?”
আমি বউদির দিকে তাকালাম। সঙ্গে সঙ্গেই চোখ পড়ল সামনের আয়নায়। নিজের মুখ দেখে নিজেই চমকে যাই! এই কি আমার মুখ! এত অবিশ্বাস কোথায় জমেছিল এতদিন? এমন অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে বউদির দিকে তাকিয়ে আছি কেন? চোখের রক্তাভ কোল থেকে ঝরে পড়ছে সন্দেহ!
—“না…”
—“তোমায় কেমন লাগছে,” বউদি পট করে আমার কপালে হাত রেখেছে। মুখে উদবেগ। ভুরুর সামান্য ভাঁজে উৎকণ্ঠা স্পষ্ট!
আমি সঙ্গে সঙ্গেই হাতটা কপাল থেকে সরিয়ে দিই,
—“না, আমি ঠিক আছি।”
—“তাহলে এমন লাগছে কেন?”
—“কেমন লাগছে?”
—“কেমন শুকনো শুকনো…”
শুকনো শুকনো! এত দিনের পরিশ্রমের পর কি গায়ে-গতরে লাগবে? একটা কঠিন জবাব দিতে গিয়েও থেমে গেলাম। চোখে পড়ল দরজার সামনে মা কখন যেন গোধূলির মতোই নিশ্চুপে এসে দাঁড়িয়েছেন। জানলার গরাদে তবু পূরবীর বিষণ্ণ ছায়া নেমে এসেছে। মায়ের অস্তিত্ব ছায়াহীন!
—“মা!” আমি তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াই। ধরা পড়ার ভয় মুখে খানিকটা হয়তো ছাপ ও ফেলেছিল। সেটা কাটিয়ে ওঠা খুব সহজ নয়। তবু প্রাণান্তকর চেষ্টা করতে করতেই বলি, “বাইরে দাঁড়িয়ে আছ কেন? কিছু বলবে?”
মা হিম শীতল দৃষ্টিতেই আমাদের দু’জনকে মেপে নিলেন! চোয়ালটা একটু যেন শক্ত হয়ে উঠেছে। একটা ঘোলাটে অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে বললেন,
—“না…থাক।”
আবার সেই একই শব্দগুচ্ছ!
৩
অদিতি চলে গেছে আজ একমাস হতে চলল। অদিতি চলে যাওয়ার পর দাদাও হিংস্র হয়ে উঠল! তারপর থেকে মা ও রহস্যময়ী হয়ে উঠেছেন! কখনও কখনও মনে হয় কিছু যেন বলতে চান। কিছু একটা বলার আকুতি তার মুখে স্পষ্ট হয়ে ছায়া ফেলে। আবার পরক্ষণেই সরে যায়। কিছু জানতে চাইলে বলেন, “নাঃ, থাক।”
অদিতি আমার জ্যেঠতুতো বোন। জ্যেঠু মারা যাওয়ার পর একেবারেই অনাথ, অসহায় হয়ে পড়েছিল। টগবগে সুন্দরী যুবতী। চমৎকার দেহের গড়ন। চট করে দেখলে যক্ষিণীমূর্তি বলে ভুল হত। মা তাকে একা একা জ্যেঠুর প্রাচীন বাড়িটায় থাকতে দিতে চাননি। মানুষের মনের নাগাল পাওয়া ভার। আর পুরুষের স্বভাবে গুণের তো শেষই নেই। জ্যেঠুর মৃত্যুর পর অদিতির জানলায় অনেক হাত এসে হাতছানি দিয়ে গেছে। হায়না, নেকড়ের ভিড়ে ওকে একা ফেলে রাখতে মা নারাজ ছিলেন। তাই শেষপর্যন্ত সে আমাদের বাড়িতেই আশ্রয় পেয়েছিল।
এখন ভাবলে হাসি পায়। মা অদিতির নিরাপত্তার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু দুনিয়ায় যে হায়না-নেকড়ের অভাব নেই তা হয়তো জানতেন না। ফলস্বরূপ এক বকাটে ছোঁড়ার সঙ্গে অদিতি একদিন পালিয়ে গেল! কোথায় গেল কেউ তা জানে না। পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু লাভ কিছু হয়নি।
অদিতির কী হয়েছিল কেউ সে খবর রাখে না। কিন্তু দাদা তারপর থেকেই আরও অসুস্থ হয়ে পড়ল। মেয়েটাকে বড় ভালবাসত। যেমন শিশু তার খেলার পুতুলটাকে ভীষণ স্বার্থপর আর ঐকান্তিকভাবে ভালোবাসে, দাদার ভালোবাসাও ঠিক তেমনই ছিল। নারী বলতে সে বউদিকে কখনই বোঝেনি। কারণ বউদি রক্তমাংসের কামনা-বাসনায় ভরা নারী। দাদা ওকে ভয় পেত। আর অদিতি বড় আদরের খেলার পুতুল! তাকে নিয়ে যা খুশি করা যায়। তার উপর একাধিপত্য বিস্তার করা যায়। বহুদিন দেখেছি দাদা অদিতির কোলে শুয়ে আপনমনে হাবিজাবি বকে চলেছে। আর মেয়েটাও হাসিমুখে সেসব অসংলগ্ন কথাবার্তা শুনে যাচ্ছে। বউদি যা পারেনি, অদিতি তা পেরেছিল। দাদা তাকে নিজের মতো করে সাজাত। কখনও ঠোঁটে কাজল আর চোখে লিপস্টিক দিয়ে তাকে ভয়ংকর কুদর্শনা করে তুলত। কখনও তার চুল নিয়ে খেলা করতে করতে জট পাকিয়ে একসা করত। অদিতির তা নিয়ে কোনও অভিযোগ ছিল না। কোনওদিন দাদার অত্যাচারে তাকে বিরক্ত হয়ে উঠতে দেখিনি! বরং দাদাই এমন এক একটা কাজ করে বসত যে আমরাই লজ্জা পেয়ে যেতাম! অথচ অদিতিকে লজ্জা পেতে দেখিনি। সে যেন দাদাকে সন্তানস্নেহে গ্রহণ করেছিল।
একদিন দেখি দাদা অদিতির সারা গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করছে। নারীদেহের প্রত্যেকটি চড়াই-উৎরাই, গোপন ভাঁজ ছুঁয়ে যাচ্ছে তার আঙুল। ওর বুকে হাত পড়তেই দাদা অবাক! সরল শিশুর মত প্রশ্ন করল, “এটা কী? তোমার আছে, আমার নেই কেন?”
অদিতি হেসে কী জবাব দিয়েছিল, আজ আর মনে নেই! শুধু মনে আছে বউদি বারান্দায় দাঁড়িয়ে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল সেদিকেই! দু’চোখ বেয়ে যেন বিষ ঝরে পড়ছে! ঈর্ষাকুটিল সে দৃষ্টি! সে চাউনি দেখে আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে গিয়েছিল! অব্যক্ত একটা ভয় বুকে জাঁকিয়ে বসেছিল! এ যে খুনীর চোখ! নিজের অভিপ্সিত বস্তু অন্যের হাতে চলে যাচ্ছে দেখলে মেয়েরা প্রাণ দিতে পারে, নিতেও পারে! প্রতিহিংসাপরায়ণা নারীর চেয়ে বিষাক্ত আর কিছু নেই।
আর তারপরই একদিন অদিতি চলে গেল। কে জানে, হয়তো রক্তমাংসের মানবী তার মধ্যেও জেগে উঠেছিল। খেলাঘর ভেঙে সেও বাস্তবের পুরুষ, বাস্তবের প্রেম আর বাস্তব ঘর-সংসার চেয়েছিল। তাই একরাতে পালিয়ে গেল পাশের বাড়ির ছেলেটির সঙ্গে। অবশ্য জানি ঘটকালিটা বউদিই চুপিচুপি করেছিল। বিশ্বসংসারকে ফাঁকি দিতে পারে এ নারী। আমাকে নয়! আমি জানি, বউদিই প্রচণ্ড প্রতিশোধে একটা বিশ্ববকাটে ছেলের হাতে তুলে দিয়েছিল অদিতিকে! জ্ঞানবৃক্ষের বিষময় ফল বউদিই খাইয়েছিল ওকে! নিজে দূতীর কাজটা গোপনে সারলেও আমার চোখ বউদির পরিবর্তন ধরে ফেলেছিল!
এরপরের ইতিহাস খুব সংক্ষিপ্ত। অদিতির অন্তর্ধান আমাদের মধ্যে খুব বেশি আলোড়ন তুলতে পারেনি। কিন্তু দাদাকে যেন তছনছ করে দিয়ে গেল। এরপর আর হাতে গোনা কয়েকটা দিনই দাদা আমাদের সঙ্গে ছিল! অজানা ভয়ে কুঁকড়ে থাকল! দেওয়ালে কাকে যেন হাঁটতে দেখত সে! জল খেতে ভয় পেত। জলের গ্লাস দেখলেই বলত,
—“বিষ! বিষ! বিষ আছে, জলে বিষ আছে, পাপ আছে… পাপ…! ঢাকনাটা খুলিস না খোকন, খুলিস না…”
লক্ষ্য করেছি ঠিক তখনই বৌদির সারামুখে একটা অদ্ভুত তৃপ্তির ছাপ ভেসে উঠত! সে তৃপ্তি প্রতিহিংসার! সে তৃপ্তি একজন খুনীর! যে মানুষ বিষের বীজ গোপনে পুঁতে দিতে সফল হয়েছে, সে-ই এমনভাবে হাসতে পারে! আচ্ছা, দাদা কি সত্যিই প্রলাপ বকছিল? না তার কথার পিছনে লুকিয়েছিল আসল সত্যটা! সত্যিই জলে বিষ ছিল না তো! অদিতি চলে যাওয়ার পরই দাদার অসুখ বাড়ল কেন? দাদাকে বউদি বিষ দেয়নি তো? অথবা অদিতি? অদিতিকে কি বউদি দাদাকে বিষ দিতে বলেছিল? তাকে কি বুঝিয়েছিল যে এই মানুষটি বেঁচে থাকতে সে স্রেফ খেলার পুতুল হয়েই থাকবে! বেঁচে থাকতে দাদা তাকে কোথাও যেতে দেবে না! রক্তমাংসের নারী হয়ে উঠতে পারবে না সে!
তাহলে কি অদিতি? না বউদি?
৪
তন্নতন্ন করে সারা বাড়িটা খুঁজে চলেছি।
আজ সকালেই বউদি আর মা মন্দিরে গেছে। ওদের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়েই তল্লাশি চালাচ্ছি। বউদির ঘর, মায়ের ঘর, কিচেন— কিচ্ছু বাদ রাখিনি নাঃ, সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়েনি। ইঁদুর মারার বিষ, বেগন স্প্রে’র মতো মারাত্মক বিষ আছে বটে, তবে এগুলো সবই খুব দ্রুত কাজ করে। সায়ানাইড, স্ট্রিকনিন বা ওইজাতীয় বিষ হলে তো কথাই নেই! দাদা দু’সপ্তাহ তো দূর, দু’মিনিটও বাঁচত না!
অনেক ভেবে দেখলাম যে এমন কোনও বিষ খোঁজা উচিত যা খুব ধীরে ধীরে কাজ করে। যেমন, আর্সেনিক, থ্যালিয়াম বা রাইসিন জাতীয় স্লো পয়জন আজকাল আবার নানারকম ড্রাগও আছে যা ব্যবহার করলে মানুষ বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যায়। ড. ব্যানার্জী যেমন বলেছেন, তেমন সিম্পটমও দেখা দেয়। কিন্তু তেমন ড্রাগের কথা এ বাড়িতে কে জানবে? মা? বিষ বলতে তিনি শুধু ইঁদুর মারার বিষই বোঝেন! বউদি সারাজীবনেও বিষ চোখে দেখেছে কি না কে জানে!
এ বাড়িতে দু’জন লোকই বিষের খোঁজ রাখতে পারে। একজন আমি। যার কাজ ডাক্তারদের ঘাড়ে পড়ে ওষুধ গছানো। অর্থাৎ মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ! আর অদিতি! যার বিষয় ছিল কেমিস্ট্রি! একজন কেমিস্ট্রির স্টুডেন্টের পক্ষে বিষের খোঁজ রাখা খুবই সহজসাধ্য! কোনটা কত পরিমাণে দিলে কী হতে পারে তা তার বেশ ভালোই জানা ছিল! তবে কি অদিতি?
আমি অদিতির ঘরে ঢুকলাম। সন্দেহ-কুটিল চোখে দেখে বেড়াচ্ছি তার ঘর! অদিতির উপস্থিতিতে এ ঘরে কখনও ঢুকিনি। একেই বউদির অদ্ভুত একটা ঈর্ষা ছিল তার উপরে। তার উপর আমাকে এ ঘরে দেখলে রক্ষে থাকত না! অদিতিকে নিয়ে আমাদের মধ্যে কম ভুল বোঝাবুঝি হয়নি! একবার অদিতির জন্মদিন উপলক্ষ্যে একটা দামি শাড়ি কিনে এনেছিলাম। অদিতি খুশি হয়েছিল। মাও খুশি হয়ে শাড়িটা তাকে পরিয়ে দিয়েছিলেন। আমার দেওয়া শাড়ি পরে সেদিন মহানন্দে পাড়া ঘুরে বেরিয়েছিল সে। সবাইকে জানিয়েছিল,
—“এটা আমায় দীপদা দিয়েছে। সুন্দর না?”
সেরাতে চরম মুহূর্তে হঠাৎ সরে গিয়েছিল বউদি! আমি পারছিলাম না! নারীরা অজগরের চেয়ে কিছু কম নয়! বড় মোহনীয় আর আগ্রাসী বেষ্টনে ধরে। পার্থক্য একটাই। অজগর যখন পরম যত্নে মানুষকে গিলতে থাকে তখনও মানুষটা ছাড়া পাওয়ার জন্য আপ্রাণ সংগ্রাম করে যায়। আর নারী যখন কোনও পুরুষকে গিলে নেয়, তখনও সে সংগ্রাম করে। ছাড়া পাওয়ার জন্য নয়, আরও গভীরে প্রবেশ করার জন্য!
আমি হাঁকপাক করছিলাম। কোনওমতে বলি, “কী হল? এসো?”
ছনছনিয়ে উঠল বউদি, “এখন আমাকে কেন? পেয়ারের বোনকে ডাকো!”
—“মানে?” দরদর করে ঘামছি। গোটা শরীরটা ফুঁসে ফুঁসে উঠছে। তবু বললাম, “কার কথা বলছ?”
—“কেন?” বউদির মুখটা অবিকল ডাইনির মতো দেখাচ্ছিল, “আজ যাকে আদর করে শাড়ি পরাচ্ছ, কাল তারই শাড়ি খুলবে তো! তোমাদের গোটা জাতটাকেই আমার চেনা হয়ে গেছে!”
আমি স্তম্ভিত! বউদির মনে এত বিষ! কখনও তো টের পাইনি! এসব কী উদ্ভট কল্পনা করছে! কেনই বা করছে!
—“শোনো,” বউদি আমার বুকে বুক ঘষতে ঘষতে বলল, “কাকে চাও? আমাকে না ওকে?”
—“আঃ… তোমাকে… তোমাকে!”
সে তখন আমার দুই উরুর উপরে বসে পড়েছে, “কে বেশি সুন্দর? আমি না ও?”
—“তুমি, তুমি!”
— “বেশ!” বউদি আবার ফিরে এল। আমাকে গ্রাস করতে করতে বলল, “তবে আমার দিব্যি রইল। ও মেয়ের দিকে তুমি তাকাবে না। তাকালে….”
—“তাকাবো না। প্লিজ!”
আমি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। বুকের উপর পরম সুখে এলিয়ে পড়েছে বউদি। বিড়বিড় করে বলল, “মনে থাকে যেন।”
মনে ছিল। অদিতির চোখে কখনও চোখ রাখিনি। ও অবশ্য ‘দীপদা, দীপদা’ বলে চারপাশে ঘোরাঘুরি করত। হয়তো কাছে আসতেও চাইত। কিন্তু বউদি আসতে দেয়নি। আমার রক্ষণাবেক্ষনের জন্য রীতিমতো পাহারাদারি করত সে।
আজ সেই অদিতির ঘরেই এসে দাঁড়িয়েছি। ঢুকতেই হালকা একটা মেয়েলি গন্ধ নাকে এসে ঝাপটা মারল। অদিতি চলে গেলেও তার গন্ধটা এ ঘর থেকে এখনও যায়নি। কুমারী মেয়ে আর বিবাহিতা নারীর গন্ধের একটা পার্থক্য আছে। অদিতির ঘরের গন্ধটা ধূপের মতো। আর বউদির গা থেকে নাগচম্পার গন্ধ আসে! কে জানে, অদিতির গায়ে এখনও ধূপের সৌরভ খেলা করে কি না! এখনও এ ঘর পরিপাটি করে সাজানো। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসার টুলটা এখনও বুঝি কারোর উষ্ণ স্পর্শের প্রতীক্ষা করছে। সাদা ধবধবে চিরুনি, মুখে মাখার ক্রিম, কয়েকগাছি ইমিটেশনের চুড়ি আর হালকা একটা ইমিটেশনের চেইন এমনভাবে পড়ে আছে যেন তাদের মালকিন এখনই নিজের দেহে সযত্নে তুলে নেবে তাদের। হেনাগন্ধী চুলে দাঁত বসাবে চিরুনি। চন্দনরঙা মুখে আলতো আঙুলের স্পর্শের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়বে ক্রিম! সব প্রস্তুত। কিন্তু আসল মানুষটাই নেই!
ড্রেসিং টেবিলের পাশে তার লেখার টেবিল। এখান থেকে বিষ্ণুদের বাড়ির বেডরুম দেখা যায়। বিষ্ণু, তথা সেই এঁচোড়ে পাকা অপদার্থ ছেলেটা! যার সাথে বেপাত্তা হয়েছে অদিতি! হয়তো এই জানলা থেকেই তাদের পূর্বরাগ। তারপর একের পর এক দানপর্ব-স্নানপর্ব-তাম্বুলপর্বটর্বও হয়েছে কি না কে জানে! বড়াই দূতী তো বাড়িতেই ছিল! অতএব শেষ পর্যন্ত মিলনপর্ব ঘটেছে অদিতির কপালে। মা জানতে পারলে সে বেচারির কপালে স্রেফ মাথুর পর্বই নাচছিল!
আমি অদিতির লেখার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালাম। লাল গোলাপের ছবি আঁকা রাইটিং প্যাডটা তখনও যথাস্থানেই রয়েছে। হয়তো অনেক প্রেমপত্রের সাক্ষী সে। এখনও সাদা বুকে কলমের আঁচড় পড়ার আশায় প্রতীক্ষারত!
সময় প্রায় পায়ের তলায় চাকা লাগিয়ে স্যাৎস্যাৎ করে এগিয়ে চলেছে। আর দেরি করা ঠিক হবে না। যে-কোনও মুহূর্তে মা আর বউদি ফিরে আসতে পারে! মা আমাকে এ ঘরে দেখলে অবাক হবেন। বউদি অনর্থ ঘটাবে। তাই যত তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করা যায় ততই ভালো।
সময় নষ্ট না করে উঠেপড়ে খোঁজা শুরু করলাম। কী খুঁজছি, কীসের সন্ধানে চোখদুটো প্রতিটা বর্গফুট মেপে নিচ্ছে তা আমিও জানি না। খুঁজছি অন্য কিছু। কিন্তু মন চলে যাচ্ছে অন্যদিকে। যতই ঘর হাতড়াচ্ছি, ততই বিস্ময় বাড়ছে! অদিতির আলমারিতে এখনও ভরতি শাড়ি, সালোয়ার কামিজ! সে এসব নিয়ে যায়নি! আশ্চর্য! তার লকারে দু’গাছা সোনার চুড়ি, কানের দুল সুরক্ষিত! যে মেয়ে এক নিঃসম্বল যুবকের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিল, সে নিজের স্ত্রী-ধনটুকুও নিয়ে যায়নি!
সবচেয়ে চমকে গেলাম আলমারির ড্রয়ার খুলে! ওখানে গোটা তিনেক পুতুল শুয়ে আছে। এই তিনটে পুতুলকেই আমি চিনি! এই নরম পশমের কুকুরটার নাম রাস্টি! হাততালি দেওয়া ভালুকটার নাম বিল্লু! আর বারবিটার নাম অ্যাঞ্জেল! এই তিনটে পুতুলই দাদার ভীষণ প্রিয় ছিল! রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে তিনটে পুতুলকে ঘুম পাড়িয়ে তবেই সে ঘুমোতে যেত! এই তিনটে পুতুল অদিতির ঘরে কী করছে! দাদা কি অদিতিকে পুতুলগুলো দিয়ে দিয়েছিল? রাস্টি, বিল্লু আর অ্যাঞ্জেল তার প্রাণের চেয়েও প্রিয়। দাদা নিজের অধিকারবোধ সম্পর্কে চিরকালই ভয়ানক একগুঁয়ে। যা তার নিজের, তা কিছুতেই অন্যকে দেবে না!
পুতুলগুলো হাতে নিয়েই খুব ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। দাদা তখন একদম স্বাভাবিক। তবু তার চরিত্রে একটা অদ্ভুত ক্রুরতা ছিল। এমনিতে আপাতদৃষ্টিতে সে নিষ্ঠুরতা দেখা না গেলেও কখনও কখনও ওর নরম-সরম স্বভাবের মধ্য থেকেই ঝিলিক দিয়ে উঠত শানিত ক্রুরতা! ছোটবেলায় মা ঠাট্টা করে বলেছিলেন যে আর একটু হলেই সে নাকি আমার, অর্থাৎ তার সদ্যোজাত ভাইয়ের গলা টিপে মারছিল!
আমি অবাক, “কেন মা?”
মা হাসছিলেন, “কেন আর! নেহাতই ছেলেমানুষী। ও ভেবেছিল ছোট ভাই এলে ওর মা আর ওকে ভালোবাসবে না। ছোট ভাইকে নিয়েই ব্যস্ত থাকবে। তাকেই ভালোবাসবে।”
আমিও তখন ছোট। দাদার কাণ্ড শুনে ভয় পেয়েছিলাম। বিস্ময় আর আশঙ্কা মিশিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “মা, দাদা কি এখনও আমাকে মারবে?”
মা হেসে ফেললেন, “পাগলের কথা শোন! এখন আর মারবে কেন? দাদা এখন নিজেই তোকে ভালোবাসে না?
সত্যিই দাদা আমায় খুব ভালোবাসত। তার চরিত্রে তখনও কিছু অস্থিরতা ছিল। কিন্তু যাকে সে ভালোবাসত, একেবারে প্রাণ দিয়েই ভালোবাসত! স্কুলে কেউ আমায় ধরে মারলে, দাদা উলটে তাকে মারতে যেত! অসুস্থ হয়ে পড়লে মা, বাবার উদ্বিগ্ন মুখের পাশে দাদার ব্যাকুল মুখটা সবসময়ই চোখে পড়ত। এর, ওর বাগান থেকে ফল চুরি করে এনে খাওয়াত। আমার ভুলের শাস্তি নিজের ঘাড়ে টেনে নিয়ে বাবার হাতে কতবার মারও খেয়েছে!
অথচ সেই দাদার সাথেই একরাতে প্রায় হাতাহাতি হওয়ার উপক্রম! দাদার একটা লাল টুকটুকে খেলনা গাড়ি ছিল। আমার বড় লোভের জিনিস ছিল খেলনাগাড়িটা। আমি ঘ্যানঘ্যান করে বায়না জুড়েছিলাম, “দাদা, গাড়িটা আমায় একটু দে না! খেলব।”
দাদা মুখ বেঁকিয়ে বলল, “তোর নিজের গাড়ি দিয়ে খেল গে! এটা বড়দের খেলনা। ছোটরা খেলে না!”
ওর জ্ঞানগর্ভ কথা শুনে আমার রাগ হল। কী আমার গুরুঠাকুর এসেছেন রে! মোটে তো পাঁচ বছরের বড়! তাতেই এত বড় বড় কথা! ব্যস, লেগে গেল হাতাহাতি! দাদাও গাড়িটা দেবে না। আমিও নিয়েই ছাড়ব! এই করতে করতে একসময় দাদা হঠাৎ কেমন যেন খেপে গেল! হিসহিসিয়ে বলল,
—“আমার গাড়ি তুই নিবি? দাঁড়া! এই নে … ‘
কথাগুলো বলতে বলতেই সে তার প্রিয় খেলনাগাড়িটাকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল কুয়োর মধ্যে! একটা ছপাৎ করে শব্দ! তারপর কুয়োর অন্ধকারে, জল কাদার ভিতরে কোথায় যে মিলিয়ে গেল গাড়িটা কে জানে!
তখনই মনে হয়েছিল, এই দাদাকে আমি ঠিক চিনি না! এই অদ্ভুত নিষ্ঠুর দাদা আমার আজন্মপরিচিত মানুষটা নয়। দু’চোখে ক্রুর দৃষ্টি নিয়ে সে তখনও সাপের মতো হিসহিস করছে, “নিবি? নিয়ে নিবি আমার খেলনা? যা নিয়ে আয়!”
আমি ভয় পেয়ে কেঁদে উঠলাম! মা তাড়াতাড়ি ছুটে এলেন। বাবা দাদার কান পেঁচিয়ে ধরেছেন। কিন্তু দাদার মুখে অদ্ভুত তৃপ্তি! যা তার নিজের ছিল, সে জিনিস সে অন্য কারোর হাতে তুলে দেবে না! কিছুতেই না…!
সেই দাদা অদিতিকে তার প্রাণের চেয়েও প্রিয়তর পুতুলগুলো দিয়ে দিয়েছিল! কেন?
—“ঠাকুরপো!”
বউদির গলার স্বরে সংবিৎ ফিরে পেলাম। কী সর্বনাশ! ওরা ফিরে এসেছে! বউদি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মা চৌকাঠে পা রেখে ইতস্তত করছেন!
— “তুমি এ ঘরে?”
হাতের পুতুলগুলো সাজিয়ে রাখতে রাখতে অপ্রস্তুতের মতো হাসলাম, “এই পুতুলগুলো দেখতে এসেছিলাম।”
— “ও,” বউদি আমার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়েছে, “এটা রাখো। কুয়োর পাশ থেকে তুলসীমঞ্চ অবধি আগাছায় ভরে গেছে। মা বলছিলেন, তুমি যদি সাফ করে দাও। ওঁর পায়ের বাতের ব্যথাটা আবার বেড়েছে। নয়তো নিজেই করতেন।”
প্যাকেটটা একটা উইডকিলার বা হার্বিসাইডের। এমন প্যাকেট তিন-চার মাস অন্তর অন্তর এ বাড়িতে আসে। মা-ই আনান। কুয়োর চতুর্দিকটা আগাছার জঙ্গলে ভরে গেছে। সেই জঙ্গল তুলসীমঞ্চ অবধি এসে পৌঁছোয়। তাই উইডকিলার দিয়ে মা নিজেই আগাছা সাফ করেন।
কোনওদিন প্যাকেটটা মন দিয়ে দেখিনি। আজ প্যাকেটের পিছনদিকটা চোখে পড়তেই চমকে উঠলাম! উইডকিলারের পিছনের লেভেলে আর্সেনিকের ভালো পার্সেন্টেজ খোদাই করা! এত কাছে ছিল জিনিসটা! মায়ের ঘরে এর একটা খালি প্যাকেটও দেখেছি। পাত্তা দিইনি! অথচ হাতের কাছেই ছিল আর্সেনিকের মতো ভয়ংকর বিষ! জানতেও পারিনি!
আকস্মিকভাবেই দাদার মৃত্যুর কিছুদিন আগের কথা মনে পড়ে গেল! মা দক্ষিণেশ্বরে পুজো দিতে গিয়েছিলেন। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে শুনেছিলাম মা বিড়বিড় করে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করছেন, “এভাবে আর ছেলেটাকে কষ্ট দিও না ঠাকুর। ওকে মুক্তি দাও… মুক্তি দাও!” তবে কি শেষপর্যন্ত স্বয়ং মা-ই এনে দিয়েছিলেন সেই ইপ্সিত মুক্তি?
আমার দু’চোখে তখন তীব্র সন্দেহ। মা বোধহয় কিছু আঁচ করেছেন। আমার দিকে তাকিয়ে যেন কিছু বলবেন বলে মনে হল। তাঁর অধর কিঞ্চিৎ ফাঁক হল। কিন্তু পরমুহূর্তেই ফিরে এল আবার সেই শব্দটাই,
—“নাঃ, থাক!”
৫
—“সব মানুষই অল্পবিস্তর পাগল দীপঙ্কর! আমাদের মনের মধ্যেই দুটো সত্ত্বা লুকিয়ে থাকে। ঠিক দুটো ঘরের মতো। একটা আলোকিত ড্রয়িংরুম। মানুষ সচেতন অবস্থায় ওই আলোকিত ঘরেই থাকে। ওখানেই তার বেশিরভাগ ঘোরাফেরা। আরেকটা ঘরের কথা সে নিজেই জানে না। ওই ঘরটাই আসলে ডার্করুম। মানুষের মনের অন্ধকার ঘর। একমাত্র অবচেতন মনই তার খোঁজ জানে। অচেতনে সে উঁকিঝুঁকি মারে ওই ডার্করুমে! তখনই অবচেতনের কথা স্বপ্ন হয়ে উঠে আসে। কিন্তু আলোকিত মন তাকে অগ্রাহ্য করেই চলে। তবে কিছু কিছু মানুষের মন একেবারে ঢুকে যায় ওই ডার্করুমে। আর বেরিয়ে আসতে পারে না। ডার্করুমের দরজা একবারই খোলে। মানুষ সেখানে প্রবেশ করতে পারে বটে, কিন্তু বেরিয়ে আসতে পারে না! তোমার দাদাও তেমনই একটা ডার্করুমে ঢুকে পড়েছেন। বেরোবার পথ নেই!
আমি ঘামছিলাম। অসহ্য গরম লাগছিল। ড. ব্যানার্জী আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন, “এই যেমন এখন তুমি উঁকি মেরেছ নিজের ডার্করুমে! দেখো, কত কালিঝুলি জমে আছে ঘরের কোণে কোণে! এই কালিঝুলি সাফ করলেও ওঠে না দীপঙ্কর! ওই দেখো, তোমার দাদা কী করছেন।”
আমি চমকে তাকালাম! ঘরটা ভীষণ অন্ধকার। মানুষদের ঠিকমতো দেখা যায় না। যেটুকু দেখা যায়, সেটুকু অবিকল নেগেটিভের ছায়া মানুষদের মতো! যেন এখনও ফিল্ম ডেভেলপ করা হয়নি। বউদিকে দেখতে পাচ্ছি! কিন্তু তাকে মানুষের মতো লাগছে না! দেখছি একটা সাপ হিসহিস করে এগিয়ে আসছে আমার দিকে! আমি নিশ্চিত জানি ওটা বউদিই!
—“খোকন!”
আমি চমকে তাকালাম! দাদার হাতে ওটা কী ঝুলছে? অবিকল অদিতির মতো দেখতে মানুষটাকে! অদিতির চুল ধরে তাকে কুয়োর মুখে ঝুলিয়ে রেখেছে দাদা। তার চোখে লিপস্টিক! ঠোঁটে কাজল। অদিতির মুখে যন্ত্রণার ছাপ নেই। বরং ভীষণ নিস্পৃহ! তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটা ছেলে। কে ওটা?
ছেলেটার দিকে তাকাল দাদা। ফিসফিস করে বলল, “নিবি? আমার পুতুল নিবি? অ্যাঁ? আয়, নিয়ে যা!”
ছেলেটা কয়েক পা এগোলো। আমি প্রাণপণে চিৎকার করে ওকে বারণ করতে চাইলাম। কারণ আমি জানি এরপর কি ঘটতে চলেছে! এ ঘটনা আমার শৈশবেও ঘটেছিল। ছেলেটাকে সতর্ক করে দিতে চাই। কিন্তু আশ্চর্য! গলা দিয়ে কোনও আওয়াজই বেরোলো না!
—“আমার পুতুল নিবি?” কুয়োর মুখে অদিতির ঝুঁটি ধরে অল্প অল্প দোলাচ্ছে দাদা। ছেলেটি হাত প্রসারিত করে বলল, “দাও।”
—“এই নে!” আমার চোখের সামনেই অদিতিকে কুয়োয় ফেলে দিল দাদা। হো হো করে অট্টহাসি হেসে বলল, “নে। এবার নিয়ে যা। নিয়ে যা। নিয়ে যা-আ-আ-আ!”
মোবাইলটা সশব্দে বেজে উঠেছে!
ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসি! এতক্ষণ তবে স্বপ্ন দেখছিলাম! কিন্তু স্বপ্ন এত বাস্তব হয়ে ওঠে কী করে! তখনও যেন কানের মধ্যে বাজছে দাদার চিৎকার, “খোকন… ঢাকনাটা খুলিস না! জলে বিষ আছে… পাপ! পাপ আছে! ও আমায় জলে টেনে নেবে!”
গলার কাছটা ভীষণ শুকিয়ে গেছে। জলের গ্লাসটার দিকে হাত বাড়িয়েই শিউরে উঠি! গ্লাসটাকে অবিকল কুয়োর মতো লাগছে না! অবিকল সেইরকমই দেখতে। মুখের কাছটা হাঁ করা! তলাটা সমান্তরাল ভাবে নেমে গেছে, যেমন কুয়োরও…! কয়েক মুহূর্তের জন্য রক্তজল হয়ে যায়। গ্লাসের উপরের ঢাকনাটা খুললে কী দেখব? ওই জলের মধ্যে কী আছে! দাদার পাপ! প্রেতরূপী অদিতি? অথবা অদিতির সঙ্গে বিষ্ণুও…! সেদিন রাতে কী হয়েছিল? রাতের কাজ সারার অছিলায় অদিতি কলতলায় গিয়েছিল। বিষ্ণু ও হয়তো এসেছিল! তারপর? তারপর কী? হলদেটে জলের নীচে কি বিষাক্ত শ্বাস ফেলছে দাদার কৃতকর্ম! সেই জন্যই কি জলে বিষ? জলে পাপ?
মোবাইলটা তখনও বেজে চলেছে। আমি বিমূঢ়ের মতো সেলফোনটা তুলে নিই
—“হ্যালো?”
ওপ্রান্ত থেকে ভেসে আসে ড. ব্যানার্জীর কণ্ঠস্বর, “আই কান্ট বিলিভ দিস দীপ! তোমার দাদার রিপোর্টে হাইড্রোফোবিয়া ধরা পড়েনি!”
নির্লিপ্ত স্বরে জানাই; “জানি”
—“তোমার কথামত বিষের ট্রেসও খুঁজেছিলাম। কিন্তু কোনও বিষের অস্তিত্ব নেই!”
—“জানি,”
—“তবে?” ড. ব্যানার্জী উত্তেজিত, “তবে কি ভুল ডায়গনোসিস করলাম?”
— “না। ঠিকই ধরেছেন,” আমি ক্লান্ত ভাবে বলি, “দাদার হাইড্রোফোবিয়াই ছিল।”
—“মানে?”
একবার ভাবলাম স্বপ্নের কথাটা ওঁকে বলি। কোনও স্বপ্ন এরকম বাস্তব ছবি আগে কখনও দেখিয়েছে কি? মিলছে, সব মিলছে। দাদার জলাতঙ্কের কারণ, গ্লাস দেখলেই ভয় পাওয়া, বারবার বিষ আর পাপের কথা বলা, সব মিলছে! আমার ডার্করুমে দাদার অন্ধকার স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। এখন ইচ্ছে করলেই ড. ব্যানার্জীকে সব কথা খুলে বলতে পারি। লোক ডেকে কুয়োটা পরিষ্কার করাতে পারি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস অন্তত দুটো লাশ ওই কুয়োর অন্ধকারে চুপচাপ শুয়ে আছে! আছেই! নিজের কৃতকর্মের শকটা নিতে পারেনি দাদা! তার ডার্করুমে ঘুরে বেড়াচ্ছিল গোপন পাপ, অদিতির বিষাক্ত অভিশাপ!
কী করব? বলব সব কথা? আমি কিছু বলতে গিয়েও থেমে যাই। অবিকল মায়ের মতো করেই বলি,
—“নাঃ, থাক।”