ডায়েরি

ডায়েরি

পৃথিবীখ্যাত জাপানি পরিচালক কুরাশুয়াকে জিজ্ঞেস করা হলো, একজন বড় পরিচালক হতে হলে কী লাগে?

কুরাশুয়া জবাব দিলেন, একজন ভালো অ্যাসিসটেন্ট ডিরেক্টর লাগে।

এডগার এলেন পো-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, একজন বড় লেখক হতে হলে কী লাগে?

তিনি জবাব দিলেন, একটা বড় ডাস্টবিন লাগে। লেখা নামক যেসব আবর্জনা তৈরি হবে তা ফেলে দেওয়ার জন্যে।

লেখকরা ক্রমাগতই আবর্জনা তৈরি করেন। নিজেরা তা বুঝতে পারেন না। একজীবনে আমি কী পরিমাণ আবর্জনা তৈরি করেছি ভেবেই শঙ্কিত বোধ করছি। ‘ফাউনটেনপেন’ সিরিজের লেখাগুলি কি আবর্জনা না? যখন যা মনে আসছে। লিখে যাচ্ছি। চিন্তাভাবনার প্রয়োজন বোধ করছি না। লেখকের চিন্তাভাবনাহীন লেখা পাঠক যখন পড়েন তখন তারাও চিন্তাভাবনা করেন না। এই জাতীয় লেখার ভালো আশ্রয় ডাস্টবিন, পত্রিকার পাতা না। ঠিক করেছি কিছুদিন ফাউনটেনপেন বন্ধ থাকবে। ইমদাদুল হক মিলনকে বলব, ফাউনটেনপেনের কালি শেষ হয়ে গেছে।

কলমের কালি প্রসঙ্গে মনে পড়ল ছোটবেলায় ফাউনটেনপেনের কালি আমরা নিজেরা বানাতাম। কালির ট্যাবলেট পাওয়া যেত, এক আনা করে দাম। দোয়াতভর্তি পানি নিয়ে একটা ট্যাবলেট ফেলে দিলেই কালি। বিত্তবানদের ছেলেমেয়েরা এক দোয়াত পানিতে দু’টা ট্যাবলেট ফেলে কালি ঘন করত। কালো কালিতে কোনো এক অদ্ভুত আলো প্রতিফলনে সোনালি আভা বের

শৈশবে পড়াশোনা একেবারেই পছন্দ করতাম না। কিন্তু কালি আগ্রহের সঙ্গে বানাতাম। এই কালি ফাউনটেনপেনে ভরা হতো না। নিবের কলম দিয়ে লেখা হতো। অনেকের মতো আমার একটা অদ্ভুত দোয়াত ছিল। এই দোয়াত উল্টে গেলেও কালি পড়ত না। এই দোয়াতটাকে মনে হতো বিজ্ঞানের বিস্ময়কর অবদান। দোয়াত উল্টে গেছে কালি পড়ছে না–ঘটনা কীভাবে ঘটছে ভেবে শৈশবে অনেকবার মাথা গরম করেছি।

এখন কালি প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প। একবার ‘সুলেখা’ নামের কালির বিজ্ঞাপন লিখে দেওয়ার জন্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে হাত পাতা হলো।

কবি লিখলেন,

“সুলেখা কালি।
এই কালি কলঙ্কের চেয়েও কালো।”

অদ্ভুত সুন্দর বিজ্ঞাপন না?

পাঠক, বুঝতে পারছেন আমি কীভাবে যা মনে আসছে লিখে যাচ্ছি? এই ধরনের লেখা আমি ব্যক্তিগত ডায়েরিতে কিছুদিন লিখতাম। ব্যক্তিগত ডায়েরি শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিগত থাকে নি। দৈনিক বাংলায় ধারাবাহিকভাবে “আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই” শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।

ব্যক্তিগত ডায়েরির ব্যাপারটা আমি বুঝি না। এগুলি কেন লেখা হয়? যিনি লিখছেন তার পড়ার জন্যে? লেখক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হলে ঠিক আছে। তার ডায়েরি প্রকাশিত হলে সেই সময়ের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ বোঝা যাবে। জনাব তাজউদ্দিন আহমেদের অপ্রকাশিত ডায়েরি আমি সাপ্তাহিক পত্রিকায় নিয়মিত পড়ি। ২৩.১১.৫২ ও ২৪.১১ ৫২ তারিখে তার ডায়েরিতে কী লেখা?

২৩.১১.৫২

সকাল ৬টায় উঠেছি।

সকাল ৯টা থেকে রাত সোয়া ৯টা পর্যন্ত দোকানে। বিছানায় গেলাম রাত সাড়ে ১০টায়।

আবহাওয়া : আগের মতোই।

২৪.১১.৫২

ভোর ৫টায় উঠেছি।

দোকানে কাটালাম সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বেলা ১টা এবং বেলা আড়াইটা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত।

সাত্তার খান কয়েকদিন আগে আমার কাছ থেকে টি আর ফরম নিয়েছিলেন যা তিনি তার কাছে রেখেছিলেন। তিনি এলেন সকাল দশটার দিকে।

বিছানায় গেলাম রাত সাড়ে দশটায়।

আবহাওয়া : আগের মতোই।

২৭ তারিখে আবহাওয়া আগের মতোই ছিল না। তিনি লিখেছেন–

আবহাওয়া : আগের মতোই তবে ঠান্ডা একটু বেশি।

পাঠক হিসেবে ডায়েরি পড়ে আমি জানলাম, জনাব তাজউদ্দিন খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠেন। রাত দশটায় ঘুমুতে যান। আবহাওয়া থাকে আগের মতোই। তাঁর মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ কেন দিনের পর দিন গুরুত্বহীন বিষয় লিখে গেছেন কে জানে! তাঁর ডায়েরির গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলিই পাঠকের কাছে আসা উচিত।

সুরারিয়েলিস্টিক পেইনটিং-এর গ্রান্ডমাস্টার সালভাদর দালিও ডায়েরি রাখতেন। তবে সবদিনের না। যেদিন গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটত কিংবা নতুন কিছু ভাবতেন সেদিনই ডায়েরি লিখতেন। আমার কাছে যে কপি আছে সেটি ১৯৫২ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত। (Diary of a Genius). কাকতালীয়ভাবে একই সময়ে বাংলাদেশে (তখন পূর্বপাকিস্তান) জনাব তাজউদ্দিনও ডায়েরি লিখেছেন।

১৯৫৩ সালের সেপ্টেম্বরের ১৩ তারিখ তিনি লিখছেন–

সারা জীবন ছবি এঁকে গেলে আমি সুখী হতাম না। এখন আমার কাছে মনে হচ্ছে Goethe-র মতো মানসিক পূর্ণতা আমার হয়েছে। Goethe প্রথমবার রোমে এসে যে ভঙ্গিতে বলেছেন-অবশেষে আমার জন্ম হচ্ছে। আমারও সেই অবস্থা।

এডগার এলেন পো মাঝে মধ্যে ডায়েরি লিখতেন। তাঁর ডায়েরির ভাষা ছিল দুর্বোধ্য। মাঝে মাঝে সংকেতিক ভাষাও ব্যবহার করতেন। তাঁর সাংকেতিক লেখার পাঠোদ্ধার হয় নি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি ডায়েরি লিখতেন? তার লেখা ‘রাশিয়ার চিঠি’কে এক ধরনের ডায়েরি বলা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অত্যন্ত গোছানো মানুষ। কাউকে চিঠি লিখলে তার কপি রাখতেন! এইসব চিঠিই ডায়েরির কাজ করত।

সতীনাথ ভাদুড়ির ডায়েরি আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়েছে। তিনি দিনলিপির পাশাপাশি গল্পের খসড়া লিখে গেছেন। গল্পের খসড়া এবং মূল গল্প পাশাপাশি পড়তে অদ্ভুত লাগে।

সতীনাথ ভাদুড়ির অনুকরণে কিছুদিন আমি ডায়েরিতে গল্পের খসড়া লেখার চেষ্টা করেছি এবং একদিন সকালের ‘দুর ছাই’ বলে ডায়েরি যথাস্থানে অর্থাৎ ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছি।

ডায়েরি না লিখলেও আমি নানান তথ্য কিন্তু লিখে রাখি। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একদিন বললেন, মুমূর্ষ বলতে আমরা মৃত্যুপথযাত্রী বুঝাই। অভিধান তা বলে না। অভিধানের অর্থ হচ্ছে–মরিবার ইচ্ছা। যার মরতে ইচ্ছা করে সে-ই মুমূর্ষ। আমার তথ্যখাতায় এটা লেখা। লেখার নমুনা—

১০ এপ্রিল ২০১০

জাদুকর জুয়েল আইচের জন্মদিনে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ মুমূর্ষ শব্দের আভিধানিক অর্থ জানালেন।

উনি বললেন, মুমূর্ষ শব্দের মানে আমরা জানি মরণাপন্ন। আসলে তা না। অভিধান বলছে মুমূর্ষ হলো মরিবার ইচ্ছা। আমি জানি উনি ভুল করছেন। মুমূর্ষ অবশ্যই মরণাপন্ন। মুমূর্ষা হলো মরিবার ইচ্ছা। এই ভুল তথ্য আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বক্তৃতার মাধ্যমে দেওয়া ঠিক না। গুরুত্বহীন মানুষের ভুলে তেমন কিছু যায় আসে না। গুরুত্বপূর্ণ মানুষের ভুলে যায় আসে।

পাদটিকা

পটল সামান্য একটা সবজি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এই সবজির দু’টা ব্যবহার আছে।

‘পটলচেরা চোখ’

পটলকে লম্বালম্বিভাবে ফালা করলে টানা টানা চোখের মতো লাগে। সেই থেকে পটলচেরা চোখ।

‘পটল তোলা’

পটল ভোলা হলো মৃত্যু। তুচ্ছার্থে এর ব্যবহার। যেমন, হাবলু পটল তুলেছে।

পটল তোলার সঙ্গে মৃত্যুর কী সম্পর্ক আমি অনেকদিন জানতাম না। বাংলা ভাষার পণ্ডিতদের জিজ্ঞেস করেছি, তারাও কিছু জানাতে পারেন নি।

সম্প্রতি আমি এই বাগধারার উৎস জেনেছি। পাঠকদেরও জানাচ্ছি- “লিখে রাখো এক ফোঁটা দিলেম শিশির।”

ফলবান পটলগাছের সবগুলি পটল তুলে নিলে গাছটি মারা যায় বলেই পটল তোলা মৃত্যু বুঝায়।*

কুইজ

পাদটিকার সঙ্গে এখন থেকে কুইজ যুক্ত হচ্ছে। আজকের কুইজ–

কোন প্রাণীর হৃৎপিণ্ড থাকে তার মাথায়?

উত্তর : পিপীলিকা।

.

* তথ্যের উৎস : সরল বাঙ্গালা অভিধান, সুবল চন্দ্র মিত্র সংকলিত, নিউ বেঙ্গল প্রেস

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *