ডায়রি

ডায়রি

সেদিন একটা পুরস্কার পেলাম বেলজিয়ামের রয়্যাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স, আর্টস অ্যাণ্ড লিটারেচার থেকে। ওদিকে প্যারিস থেকে একটা ইউনিভার্সাল সিটিজেনশিপ পাসপোর্টও পেলাম।

এই পাসপোর্টটি রীতিমত স্বপ্নের মতো। কখনও হয়তো পৃথিবী এমন হবে, যখন কোনও দেশের সীমানা বা বর্ডার বলে কিছু থাকবে না, পৃথিবীই দেশ হবে সবার। কোনও ভিসা বা পাসপোর্টের দরকার হবে না কারও। যেখানে খুশি যাবার, যেখানে খুশি থাকার স্বাধীনতা থাকবে প্রতিটি মানুষের।

ইওরোপীয় পার্লামেন্ট, বেলজিয়াম সেনেট, রয়্যাল অ্যাকাডেমি, হিউম্যানিস্ট কনফারেন্স, সবখানেই পেয়েছি অভিনন্দন, সম্মান, আর বক্তৃতার পর স্ট্যাণ্ডিং ওভেশন। স্ট্যান্ডিং ওভেশনের বাংলাটা কী? কিছু কিছু শব্দ নিয়ে এত মুশকিলে পড়ি আজকাল। ইংরেজিটার বাংলা জানি না, অথবা বাংলাটার ইংরেজি জানি না। অনেক শব্দ আছে, যেগুলো অন্য ভাষায় ঠিকঠাক অনুবাদ করা যায় না। অভিমান শব্দটাকে আজো আমি ইংরেজিতে বোঝাতে পারি না। স্ট্যাণ্ডিং ওভেশন, আমি লক্ষ্য করেছি, ডাকসাইটে বক্তাদের কারও জুটছে না, কিন্তু আমার জুটছে। এবার বিখ্যাত বিবর্তন-বিষয়ক বিজ্ঞানী ব্লগার পিজি মায়ার্সকে ডাবলিনের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আচ্ছা বলুন তো, আপনারা এত বড় বড় স্পিকার, আপনারা স্ট্যাণ্ডিং ওভেশন পান না, আমি কেন পাই? আমার ভাষা ইংরেজি নয়, স্পিচে প্রচুর গ্রামারের ভুল, তার ওপর ভুল উচ্চারণ, আমাকে কী কারণে স্ট্যাণ্ডিং ওভেশন দেওয়া হয় সবখানে? পিজি বললেন, লোকে উচ্চারণ ভুল আর গ্রামার ভুলকে অত গ্রাহ্য করে না। তোমার স্পিচের সবচেয়ে শক্তিশালী জিনিস হলো, কনটেন্ট, বিষয়। সেটাই মানুষকে স্পর্শ করে। কী জানি, কনটেন্ট তো আমার মনে হয়, আমার বক্তৃ তার চেয়ে ওঁদের বক্তৃতায় কিছু কম নয়, বরং বেশি। ওঁরা যেভাবে ওঁদের মাতৃভাষা ইংরেজিতে বলতে পারেন, ব্যাখ্যা করতে পারেন, গাদা গাদা যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পারেন, তার ধারে কাছেও আমি পারি না। ভাষার সীমাবদ্ধতা তো আছেই, মস্তিষ্কও আমার অত ব্যাপক নয়, মেমরিও ভোঁতা। তাহলে কি সম্মানটা পাই নির্বাসন জীবন যাপন করি বলে? পাশ্চাত্যের শিক্ষিত বুদ্ধিমানদের যতদুর আমি জানি, কারও নির্বা সনের সমবেদনায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় না। মঞ্চ থেকে নেমে এলে ঘিরে ধরে আমাকে যারা, তারা কেউ আমার নির্বাসন জীবনের জন্য চোখের জল ফেলছে বলে না। কিছু একটা নিশ্চয়ই আমার মধ্যে তবে আছে। কী সেটা? সততা! নিষ্ঠা। জানি না কী, কিছু একটা হবে।

এই যে বিদেশে সম্মান জোটে, এ কিন্তু দেশের লোকেরা কেউ জানে না। কারণ দেশের কোথাও এসব খবর ছাপা হয় না। আমার একসময় মনে হতো, আমাকে হয়তো ভুলেই গেছে দেশের মানুষ। মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। যে দেশে আমার বই ছাপানো হয় না, পত্রিকায় লেখা ছাপানো হয় না, সে দেশে কতদিন আর মানুষ। মনে রাখতে পারে একজন লেখককে। কিন্তু আমাকে যে একেবারেই ভোলেনি কেউ, তার প্রমাণ পাই, যখন মিডিয়া রীতিমত ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার সম্পর্কে লেখে, এবং লেখাগুলো সশব্দে গোগ্রাসে গেলে পাঠককূল, আমাকে নিয়ে অবশ্য তখনই কিছু লেখা হয়, যখন আমাকে কেউ মারধোর করে, গালাগালি করে, বিদ্রূপ করে, অসম্মান। করে, যখন আমাকে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়, আমার বই নিষিদ্ধ করা হয়, আমার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। কিন্তু ভিড় করে মানুষ আমার বই কেনে, বই পড়ে প্রশংসা করে, বই পড়ে অনেকে সচেতন হয়, দেশে না জুটলেও বিদেশে অনেক সম্মান জোটে– এসব খবরের কোনও চিহও উপমহাদেশের কোথাও কিন্তু কখনও দেখা যায় না। হতে পারে বিদেশের মেইনস্ট্রিমের সব ঘটনা দেশি সাংবাদিকদের জানা সম্ভব নয়। কিন্তু জানা যদি সম্ভব হতো? আমার বিশ্বাস, আমার সম্মানের কথা কেউ কোথাও লিখতো না। এর কারণ সম্ভবত এই যে, মিডিয়া দীর্ঘদিন ধরে আমার বিরুদ্ধে লিখে লিখে, দীর্ঘদিন মিথ্যেচার করে করে, শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছে মানুষের মধ্যে আমার সম্পর্কে একটা রাগ, একটা ঘূণ তৈরি করতে, এখন আস্ত একটা ঘৃণার। বস্তু হিসেবে আমাকে পরিণত করার পর, তাদের এতদিনের পরিশ্রমের ফসলকে, এই ক্রিয়েশনকে দুএকটা ভালো খবর বা সত্য খবর লিখে নষ্ট করতে পারে না। আর পাঠকও আমাকে ঘৃণা করতে করতে বেড়ে উঠেছে, সেই ডাঙর পাঠককে এখন তো এমন কিছু খাওয়ানো যায় না, যা তার হজম হবে না। প্রশ্ন উঠতে পারে, মিডিয়ার কেন এত দরকার ছিল আমার বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগার! নিশ্চয়ই ছিল, এবং এখনও আছে। আমি নাস্তিক বলে, বা ইসলাম এবং ইসলামের আইন নিয়ে মন্দ বলেছি বলে রাগ? সেটা হয়তো কুড়িভাগ, আশিভাগ রাগ পুরুষতন্ত্রের নিন্দা করেছি বলে। অন্তত দেখেশুনে এরকমই আমার ধারণা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজটাকে যে মানুষ পাল্টাতে চাইছে, তাকে এক ফুয়ে ভ্যানিস করে দেওয়ার দরকার সবার। সরকারের, সমাজের, পরিবারের, পুরুষের। মিডিয়া সমাজেরই অংশ। সমাজ যেমন পুরুষতান্ত্রিক, মিডিয়াও পুরুষতান্ত্রিক। আর কোনওভাবে ধ্বংস করা না গেলেও কুৎসা রটিয়ে করা যায়, বিশেষ করে মেয়েদের। এ কথা যে কোনও গাধাও জানে।

অনেকে আমার শত্রু, মৌলবাদীই শুধু নয়, নারীবিদ্বেষী লোকও। এ আমার অজানা নয়। এর জন্য কিছু কি আসে যায় আমার? আমি কি ধর্মীয় মৌলবাদী বা পুরুষতান্ত্রিক মৌলবাদীদের সমর্থন চাই, চাই তারা আমার বন্ধু হোক? আমি কি জানি না তারা আমার বন্ধু হওয়া মানে আমার সর্বনাশ হওয়া। নিজের নীতি আদর্শ বিশ্বাস। জলাঞ্জলি দিয়ে নিশ্চিতই মরে যাওয়া।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীবাদীদের কণ্ঠরোধ করছে আজ থেকে নয়, শুরু হয়েছে। অনেক আগেই। অনেক দেশেই। আজও চলছে। প্রথার বিরুদ্ধে বলে পার পাওয়া অত সোজা, বিশেষ করে নারীবিদ্বেষীদের দেশে? আমার জন্মই হয়েছে অমন দেশে। কিছু যে ভালো মানুষ ছিল না পাশে দাঁড়াবার, তা নয়। ছিল। নির্বাসনের ঝড় এসে আমাকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে সেই মানুষগুলো থেকে। দেশ থেকে নির্বাসিত আজ কুড়ি বছর। এখন দেশ বলতে আমি আর দেশ বুঝিনা। বুঝি কিছু মানুষ। যারা সভ্য শিক্ষিত একটি সমাজের স্বপ্ন দেখে, যারা নারীর পূর্ণ স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে, যারা সমাজ থেকে পুরুষতন্ত্র, নারীবিদ্বেষ,সমকামঘৃণা ইত্যাদি দূর করতে চায়, রাষ্ট্র আইন-শিক্ষা ব্যবস্থার মাটি কামড়ে পড়ে থাকা ধর্মটিকে সরাতে চায়, যারা সৎ, সাহসী, যারা কুসংস্কারমুক্ত, ঈশ্বরমুক্ত– তারাই আমার সত্যিকার স্বদেশ। তারা যে কোনও রঙের, যে কোনও জাতির, যে কোনও লিঙ্গের, যে কোনও দেশের, যে কোনও ভাষারই মানুষ। এখন গোটা দেশটা, মানে মাটির ওই পিণ্ডটা এনে যদি হাতে দেওয়া হয় আমার, আমি হয়তো দেশটাকে নেবোই না। বরং সেই মানুষগুলোকেই আমি দেশ বলে জানবো যারা ভালোবাসে। যারা ঘৃণার লোক, ঘৃণাই যাদের সম্পদ, তাদের সঙ্গে বাস করে নিজের অকালমৃত্যু ঘটাবো কেন? জীবন কি শতবার আসে? সেই মানুষগুলোকেই দেশ বলে আমি বাকি জীবন মানবো, সুখে দুঃখে, বিপদে দুর্যোগে, যারা পাশে থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *