ডানাওলা মানুষ

ডানাওলা মানুষ

সত্যি কথা বল তো, তুই কি আমাদের মতো জীবন চাস না?’

প্রায় পনেরো বছর পরে চন্দ্রশেখরকে প্রশ্নটা করে ফেলল ভানু। আমরা তখন মানেভঞ্জন থেকে ট্রেক করে চিত্রার দিকে এগোচ্ছি। এই দু-কিলোমিটার পথ অসম্ভব খাড়াই। তার ওপর পিঠে রুকস্যাকের বোঝা। আমি, ভানু, গৌর সবাই এই ঠান্ডাতেও ঘেমে স্নান করে উঠেছি। ফোঁস-ফোঁস করে দম ফেলছি। গায়ের জ্যাকেট কোমরে বাঁধা। চন্দ্রশেখর আমাদের থেকে অনেক কম ক্লান্ত। আসলে ওর অভ্যাস আছে। পুরো জীবনটাই তো ব্যাটার টো টো কোম্পানি।

ট্রেকিংয়ের প্রস্তাবটা এনেছিল গৌরের স্ত্রী দেবলীনা। এক কথায় সবাই রাজি, অনেক দিন পর দারুণ অ্যাডভেঞ্চার। শুধু ভানু কিছুটা পিছিয়ে এসেছিল, ‘হ্যাঁ রে এই চেহারা নিয়ে পারব তো!’

কথাটা অবশ্যি সত্যি। ঘুষের পয়সায় মাল খেয়ে শালা এমন বেঢপ চেহারা বানিয়েছে যে নিজের পুরোনো ছবি দেখলে ডেফিনিট সুইসাইড করবে। ভানুর বউ অঞ্জলি সাহস জুগিয়েছিল। ‘আরে সত্তর বছরের বুড়োবুড়ি পারছে আর তুমি পারবে না।’

আসলে বিজয়া দশমীর পর ক’দিন কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায় তাই নিয়ে কথা হচ্ছিল গৌরের বাড়িতে। দীঘা, ডুয়ার্স, অযোধ্যা পাহাড় ক্যানসেল করে সবশেষে ঠিক হল সান্দাককু।

‘তোমাদের বন্ধুকে বলবে না?’ প্রশ্নটা করেছিল আমার বউ লীনা।

‘আমাদের বন্ধু?’

‘হ্যাঁ, চন্দ্রশেখর।’

কয়েক মুহূর্ত সবাই চুপ। তারপর গৌর ইনিয়ে-বিনিয়ে বলেছিল, ‘ঠিক আছে বলে দেখব। তবে যাবে না ডেফিনিট।’

রাত্রে বিছানায় লীনাকে বললাম, ‘তুমি হঠাৎ চন্দ্রর কথা বললে?’ লীনা ঠেস মেরে বলেছিল, ‘তোমাদের তো জানি, তিন মাথা একসঙ্গে হয়ে শুধু অফিসের গল্প করবে আর ছাইপাঁশগুলো গিলবে। বরং ওই ছেলেটা সঙ্গে গেলে তবু আমরা ঘুরতে-টুরতে পারব।’

বেশ অবাক হয়েছিলাম আমি। শুধু এর জন্যই…! সেই কতদিন আগে লীনার সঙ্গে কথা হয়েছিল চন্দ্রের। অথচ?…আশ্চর্য! তবে চন্দ্র যে যাবে না সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত থেকে সেদিন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু বেলিয়াতোড়ে চন্দ্রের গ্রামের বাড়িতে খবর পাঠাতেই চন্দ্র রাজি হয়ে গেছিল। একেবারে এক কথায় রাজি হয়ে গেছিল। গৌর শুনে বলেছিল, ‘সে কী রে, ব্যাটা রাজি হয়ে গেল! টাকার জোগাড় করবে কোত্থেকে?’ যদিও একটা সময় আমি, ভানু, গৌর আর চন্দ্রশেখর শুধু যে একগ্রামের বন্ধু ছিলাম তা নয়, বরং তার চেয়েও বেশি কিছু। বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড়ে সেই স্কুলজীবন থেকে পরস্পরের হাতে হাত রেখে বড় হয়েছি। তারপর সেখান থেকে সোজা বউবাজারের মেসে থেকে সারাদিন চুটিয়ে টিউশন আর সিটি নাইটে পড়াশোনা। চন্দ্র কর্মাস নিয়ে পড়তে চায়নি। স্রেফ বন্ধুবিচ্ছেদের ভয়ে আর আমাদের জোরাজুরিতে কমার্স নিয়েছিল। গ্রাম ছেড়ে কলকাতা আসার পরেই আমাদের ডানাগুলো আরও দীর্ঘ হয়ে উঠেছিল। কফি হাউস থেকে নন্দন কিংবা কুমোরটুলি থেকে বাঁশবেড়িয়া সব জায়গায় একসঙ্গে উড়ে বেরিয়েছি আমরা। চুটিয়ে আড্ডার মধ্যে সার্ত্র কিংবা বর্হেস থেকে পিকাসো, বার্গম্যান, বড়ে গুলাম সবাই আসত। অবশ্য শুধু পরচর্চা নয়, আমার বাঁশি, ভানুর বরীন্দ্রসংগীত আর গৌরের ভরাট গলার আবৃত্তি ছিল আমাদের জীবন জুড়ে। চারজনের মধ্যে একমাত্র চন্দ্রশেখরই ছিল প্রতিভায় নির্বাক। ও দেখত, শুনত, প্রচুর পড়ত কিন্তু বলত কখনও-সখনও। হয়তো চন্দ্র একজন কবি ছিল। তবে ওকে কোনওদিন দু-কলম লিখতে দেখিনি কেউ। তবে ও মাঝেমধ্যে বিলিভ অর নট বিলিভ ধরনের কথা বলত। যেমন একবার আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রসঙ্গে আলোচনায় ও হঠাৎ বলে উঠেছিল—আজ থেকে বিশ হাজার বছর আগে মানুষ পাথরের অস্ত্র নিয়ে ব্রেন অপারেশন করত। আর একবার রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুচেতনা নিয়ে কথা হচ্ছিল। চন্দ্র বলছিল, আদিম যুগের মানুষ মৃত ব্যক্তিকে সযত্নে কবর দিত এবং কবরের ওপর জীবনের প্রতীক হিসেবে লাল রঙের ফুল ছড়িয়ে দিত। এইসব হাজার হাজার পুরোনো কথায় ও কী আনন্দ পেত জানি না। কিন্তু দেখতাম প্রাচীন ইতিহাসের কথা বলার সময় ওর চোখ চিকচিক করছে। ঠোঁটের পাশে লালা জমে উঠেছে। চন্দ্র কি ইতিহাসপ্রেমী ছিল? আদিম ইতিহাসপ্রেমী? জানি না, তবে ও আমাদের সঙ্গে ছিল। আমাদের মতো ছিল। মোটকথা আমাদের চারজনেরই একটা চুপিচুপি প্রতিজ্ঞা ছিল, দিন আনি দিন খাই জীবন নয়, আমাদের জীবনটা হবে ফুলের মতো। রোজ ভোরে জন্মে রাত্রে মরে যাব। এক-একটা দিন হবে এক-একরকম নতুন।

তারপর সবার প্রথমে চাকরি পেলাম আমি এসবিআই-তে। ভানু সেলস ট্যাক্সে। গৌর একটা ভালো এমএনসি-তে চান্স পেয়ে ঢুকে গেল। চন্দ্র শুধু হাত জড়ো করে বসে রইল। আমরা তিনজনে বহুবার খুঁচিয়েছি ওকে। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। বাড়ি বাড়ি লক্ষ্মীপুজো করার পুরুতের মতো সেই টিউশনকেই আঁকড়ে থাকল। হয়তো এর বেশি ওর দ্বারা আর কিছু হতও না। চাকরি পাওয়ার পর আমরা তিনজনেই কলকাতায় সেটল করে গেলাম। ফিরে গেল শুধু চন্দ্রশেখর।

তারপর ধীরে ধীরে খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাদের উন্নতি…ঘর-সংসার…আরও উন্নতি…আমরা তিনজন এবং চন্দ্রশেখর। নতুন দলটা তৈরি হয়েছিল এভাবে চন্দ্র কখনও-সখনও এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করত। হালকা গল্পগুজব। আগের সেই উষ্ণতা আর পেতাম না। সম্ভবত ও-ও না। ইতিহাস জড়িয়ে থাকা এই মানুষটা আমাদের কাছে অনেক ফিকে হয়ে গেলেও যেন নি:শব্দে আমাদের বউ-বাচ্চাদের ভেতর সেঁধিয়ে গেছিল। ও আসলেই ঝাঁপিয়ে পড়ত সবক’টা মিলে। আমরা পুরোনো তিনজন হয়তো তখন একটু ভুরু কুঁচকেই দেখতাম চন্দ্রর নতুন বন্ধুদের। শেষবার চন্দ্রর সঙ্গে দেখা হয় প্রায় মাস আষ্টেক আগে। হঠাৎ এসে উপস্থিত হয়েছিল গৌরের বাড়িতে। তখন চেহারাটা আরও ধসে গেছে। রোদে পোড়া তামাটে রং, চওড়া কাঁধ শুকিয়ে ছোট হয়ে গেছে, লালচে নোংরা দাড়ি-গোঁফ, চাঁদিতে হালকা টাক। শুধু চোখ দুটো ছিল সেই আগের মতো ভাসিয়ে দেওয়া। বেশ খারাপ লেগেছিল ওকে দেখে। এমন দশার কারণ জিগ্যেস করায় হেসে উত্তর দিয়েছিল, ও না কি ঝাড়গ্রামের কোন মিগ উপজাতির সঙ্গে প্রায় মাস তিনেক কাটিয়ে এসেছে। পাগলের খেয়াল আর কাকে বলে! সারাজীবন একভাবে থেকে যায় শুধু জড় পদার্থ আর পাগলরা। এই ফিলোজফিটাই আমরা বিশ্বাস করতে শিখে নিয়েছিলাম। শুধু চন্দ্র সেই আগের মতো উড়ত একা একা। কলেজ জীবনের পুরোনো ব্রাত্য ধারণাগুলো নিয়ে এলোমেলো উড়ে বেড়াত। ও কি বুঝত না আমরা ওকে অনেক ছাড়িয়ে চলে গেছি। তবে কেন আমাদের সঙ্গে যেতে রাজি হয়েছিল?

যাই হোক তবু অনেকদিন পর আবার চারজন। সঙ্গে আরও তিনজন মহিলা আর দুটো বাচ্চা। আমার ছেলে নীল ক্লাস ফোর। ভানুর মেয়েটা থ্রিতে পড়ে। গৌরের ঝিমলিও ক্লাস ফোরে। হোস্টেলে থাকে, পুজোর পরেই হোস্টেল খুলে গেছে বলে আসতে পারেনি।

ট্রেনে আমরা যখন শেয়ার মার্কেট, সেলসট্যাক্সের অন্দর মহল কিংবা গৌরের বসের লেডিস সেক্রেটারি প্রসঙ্গে আলোচনা করছিলাম তখন চন্দ্র এমনভাবে আমাদের দিকে তাকিয়েছিল, যেন ও অদ্ভুত তিনটে প্রাণী দেখছে। অসহ্য তাকানো। ভানু তখন গলায় ব্যঙ্গ মিশিয়ে বলেছিল ‘কী রে চন্দ্র তোর সেই মিগদের গল্প আমাদের বউদের একটু শোনা।’

বউগুলোর ‘পরে শুনব’ গোছের কিছু একটা উত্তর দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সবক’টা মিলে হামলে পড়ল। ‘হ্যাঁ-হ্যাঁ চন্দ্রদা, শোনান না কিছু।’

যাহ শাললাহ!

চন্দ্র একগাল হেসে বলেছিল ‘কী বলব, ওদের তো কোনও ভাষা নেই।’

‘মানে?’

‘আসলে ওরা ভাষায় বড় গরিব। মাত্র গোটা পাঁচেক বিশেষণ আর খুব প্রয়োজনীয় শব্দ ছাড়া ওদের অভিধানে আর কিছু নেই।

লীনা বলে উঠেছিল, ‘ওমা তাই, দারুণ ইন্টারেস্টিং তো! বলুন না ওদের কথা।’

চন্দ্রশেখর বলেছিল মিগদের গল্প। সত্যিই একটা উদ্ভট হাস্যকর গল্প। এমন একটা জাতি, যাদের সম্বল মাত্র হাতে গোনা কয়েকটা শব্দ। বাকিটা কাজ চালায় শারীরিক অঙ্গভঙ্গি দিয়ে। আনন্দ বা প্রশংসা জানায় হাততালি দিয়ে। নিন্দে, অপছন্দ বোঝায় কপালে হাত রেখে। ক্ষোভ দেখায় ঋজুভাবে হেঁটে। আর শান্তভাবে ধীরে ধীরে হেঁটে বুঝিয়ে দেয় সুখে-শান্তিতে আছে। আশ্চর্য!

ভানু টিপ্পনি কেটেছিল, ‘বলিস কী রে! তালে লাভারকে আই লাভ ইউ বলে কী করে?’

চন্দ্র হেসে বলেছিল, ‘নি:শব্দতা দিয়ে।’

ভানু যেন গালে একটা সপাটে ঘুষি খেয়ে চুপ করে গেছিল।

চন্দ্র আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘মজাটা কী জানিস অচিন্ত্য, ভাব প্রকাশের জন্য সভ্য জাতিদের মতো ওদের অজস্র ভাষা না থাকলেও ওরা অদ্ভুত সৎ, শান্ত, ওরা দারিদ্রসীমার নীচে কিন্তু কখনও চুরি করে না, লড়াই করে না, অন্যকে ঠকায় না।’

চন্দ্র কী ইঙ্গিত করছিল? বড্ড অস্বস্তি হচ্ছিল। শেষে নীল বাঁচাল।

‘চন্দ্রকাকু, আদিম মানুষদের কথা বলতে হবে কিন্তু।’

পটু বলে উঠল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ কাকু বলবে কিন্তু।’

চন্দ্রটা পারেও। যত অবসোলেট ব্যাপার নিয়ে ওর কারবার। ভানু একবার অবশ্য বলেছিল যারা বাস্তব জীবনে তেমন কিছু করতে পারে না, তারাই নীতি, অতীত এসবের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রেখে মুক্তি খোঁজে, সান্ত্বনা খোঁজে।

বাচ্চা দুটো চন্দ্রর হাত ধরে একটু এগিয়ে হাঁটছিল। বাকিরা একসঙ্গে পেছনে। ভানু হঠাৎ গৌর আর আমাকে ইশারা করে চন্দ্রর কাছে যেতে বলল, গেলাম। তারপর বাচ্চা দুটোকে ধমকাল, ‘অ্যাই অত ছুটোছুটি করে না। মায়েদের সঙ্গে থাক।’

ছেলেমেয়ে দুটো ব্যাজার মুখ করে পিছিয়ে এল। চন্দ্র আমাদের দিকে তাকাল। বোধহয় আন্দাজ করেছিল ভানু কিছু বলবে, তখন ভানু এগিয়ে এসে সরাসরি প্রশ্ন করল, ‘সত্যি কথা বলত, তুই কি আমাদের মতো জীবন চাস না।’

চন্দ্র হালকা হেসে উত্তর দিল, ‘আমি জীবন চাই না।’

‘কী চাস তবে?’

‘প্রাণ চাই, প্রাণ। জীবনটা তো একটা গোদা অভ্যেসের ব্যাপার। কী হবে ওই নিয়ে।’

গৌর হঠাৎ দুম করে বলে ফেলল, ‘তুই কি মনে করিস আমরা অসুখী?’

দুই

টুংলুতে এক রাত্রি থেকে সেখান থেকে কালিপোখরি। পরদিন বেলা দেড়টা নাগাদ সান্দাকফু পৌঁছোলাম। সত্যি কথা বলতে একেবারে জান বেরিয়ে গেছে হাঁটতে হাঁটতে। ট্রেকিংয়ের রিস্কটা না নিলেও হত। শালা এত হাঁটা গোটা জীবনে হাঁটিনি। ভানুর হাঁটু ফুলে ঢোল। বারে বারে চাইনিজ বাম লাগাচ্ছে আর অনর্গল খিস্তি ছোটাচ্ছে। টুংলুতে পৌঁছেই একবার ভেবেছিলাম ট্রেকার ভাড়া করে নেব। কিন্তু ব্যাটা চন্দ্রটা…এমন পাহাড়ি ছাগলের মতো ছোটে যে স্রেফ নিজের বউ-বাচ্চাদের কাছে হেয় হওয়ার ভয়ে ঘাড় গুজে হেঁটে গেছি। ফলত চন্দ্রর ওপর ক্ষোভটা আরও বেড়েছে। আমাদের ছেলেমেয়ে আর বউ তিনটে এরমধ্যে কেমন নির্লজ্জের মতো চন্দ্রর ন্যাওটা হয়ে গেছে। চন্দ্র কি ভুলে গেছে আমরা স্রেফ পুরোনো বন্ধু বলে করুণা করে নিয়ে এসেছি। শুধু করুণা করে। পুটু আর নীল সবসময় চন্দ্রর সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে রয়েছে। বার কয়েক বারণ করেছি, শোনেনি। শেষে ভানু একবার পুটুকে ধমক দিতে উলটে নিজেই বউয়ের কাছে ঠেলা খেয়েছে। ‘রয়েছে থাকুক না, তোমাদের তো কোনও অসুবিধে করছে না।’ এরা কে মাইরি! আমাদের বউ-বাচ্চা না অন্য কারও?

হোটেল সানরাইজে দুটো রুম বুকিং ছিল, ব্যবস্থা দারুণ। সবক’টা মিলে বিছানায় সটান ধপাস। ঘুরে বেড়াবার সব ইচ্ছে বেলুনের মতো ফেটে গেছে। মনে হচ্ছে বাকি দিন দুটো এইভাবে শুয়ে থেকে কাটিয়ে দিতে পারলে বাঁচি। গৌর বলল, ‘শালা এই শেষ, আর জন্মে হাঁটার রিস্ক নিচ্ছি না।’

অঞ্জলি বলল, ‘সত্যিই কী অবস্থা তোমাদের! আমরা মেয়ে হয়ে পার করে দিলাম আর তোমরা…’

পুটু বলল, ‘আমরাও পেরেছি। বাবা তুমি বুড়ো হয়ে গেছ, হি-হি।’

‘অ্যাই চোপ’।

‘হি-হি-হি’।

‘আ-হ’ ঝাঁঝিয়ে উঠল ভানু।

চন্দ্র রুকস্যাক থেকে ওর জিনিসপত্র বার করতে করতে আমাকে বলল, ‘হ্যাঁ রে তোদের টুথপেস্টটা একটু দিস, আমারটা শেষ।’

‘সে কী রে, এরমধ্যেই শেষ। ক’টা দাঁত তোর?’

‘খেয়ে দিস নাকি?’ ভানু টোন কাটল।

লীনা বলল, ‘তোমাদের না খালি ইয়ার্কি’।

‘চন্দ্রকাকু ওই পাহাড়টা দেখো কী সুন্দর। ওটায় যাবে গো?’ পুটু আবদার করল।

চন্দ্র পুবদিকের কাচের জানলাটা দিয়ে পাহাড়ের দিকে তাকাল। ‘কালকে যাব।’

গৌর বলল, ‘একা-একা একদম এদিক-ওদিক যাবে না।’

পরিশ্রমের উত্তাপটা গা থেকে উবে যেতেই ঠান্ডা যেন কামড়ে বসল।

সবাই মিলে লেপের তলায় চাপাচাপি দিয়ে শুলাম। দুটো রুমে মোটা আটটা বেড, পুটু ওর মা-র সঙ্গে শুল।

বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকার পর দেবলীনা বলল ‘আরে পেট তো চুঁইচুঁই করছে।’

আমার বউ বলল, ‘সত্যি, এই ওঠানামা করতে করতে দু-দিনে পেটটাও রাক্ষসের মতো হয়ে গেছে।’

আমি বললাম, ‘হবে না কেন, দমদমের লোহা গোলা জল তো নয় যে এক বেলা খেলে অন্য বেলা শুধু ঢেঁকুর তুলে কেটে যাবে।’

চন্দ্র বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে বলল। ‘তোমরা রেস্ট নাও। আমি দেখছি।’

‘হ্যাঁ ভাই দেখ একটু। আর উঠতে পারছি না।’

‘কুঁড়ের হদ্দ সব’ লীনা হেসে বলল।

ভানু উত্তর দিল, ‘কেন বাবা, তোমরাই বা কী কোদাল চালাচ্ছ এখন।’

বাড়িতে হলে বোধহয় টান মেরে ছুঁড়ে ফেলে দিতাম। কিন্তু ট্যালট্যালে বিস্বাদ খিচুড়ি, পাতলা ওমলেট আর খানিকটা চাটনি দিয়ে দুপুরের খাওয়াটা যেন অমৃত লাগল। স্থানমাহাত্ম্য বোধহয়। খাওয়ার পর একটা চূড়ান্ত ঘুমের ইচ্ছে ছিল। ওদের জন্য হল না। সান্দাকফু থেকে যে রাস্তাটা পাহাড়ের গা দিয়ে ফালুটের দিকে চলে গেছে সেদিকে খানিকটা এগিয়ে ফাঁকা জায়গায় বসলাম। রোদ্দুর অনেক নরম হয়ে এসেছে। খুব ঠান্ডা হাওয়া, চারদিকে শুধু সবুজ আর নীল, দূরের পাহাড়গুলো সবুজ আর আকাশের রঙে মিশে একাকার।

লীনা বলল, ‘ওহ জীবনে একটা এক্সপিরিয়েন্স হল, কোনওদিন ভুলব না।’

‘ও বাবা জানো আমরা এখন ওয়েস্ট বেঙ্গলের সবচেয়ে বড় লোক,’ পুটু বলল।

‘ধ্যাৎ’ ভানু ভুরু কুঁচকাল।

‘বা রে আমরা এখন ওয়েস্ট বেঙ্গলের সবচেয়ে উঁচুতে রয়েছি না।’

চন্দ্র মিটিমিটি হাসছিল। বুঝতে পারলাম, বড়লোকের নতুন কনসেপ্টটা ওরই বানানো। বেশ কিছুক্ষণ গল্পগুজব হল। ভালোই লাগছিল। হঠাৎ খেয়াল হল বাচ্চা দুটো সেই চন্দ্রর গা ঘেঁষে বসে আছে। পিত্তি জ্বলে গেল দেখে। নীলকে অকারণ ধমক দিলাম। ‘একদম ধারে যাবে না। বড়দের সঙ্গে থাকবে।’ এমনভাবে তাকাল ছেলেটা…অবজ্ঞা না কি?…নিজের বাপকে! শালা দু-বেলা খাইয়ে পড়িয়ে বড় করছি…।

‘এবার খুব ভালো সময়ে এসেছি রে।’ চন্দ্র বলল।

‘কেন?’

‘রাত্তিরে দেখবি।’

গৌর বলল, ‘যা ভালো করেছিস মা, আর ভালোতে কাজ নাই।’

‘তোমার তো খালি বুড়োটেপনা।’ দেবলীনা খোঁচা দিল। তার পরেই বলল, ‘অ্যাই চলো না এই রাস্তাটা দিয়ে একটু হাঁটি।’

সঙ্গে সঙ্গে আর দুটো বউ রাজি। আমরা কেউ উঠলাম না। চন্দ্রও না। আমাদের সঙ্গে বসে রইল। সৌজন্যবোধ না কি?

‘ও চন্দ্রকাকু এসো না আমাদের সঙ্গে।’

‘আজকে তোমরা যাও। আমি কাল সকালে যাব।’

কলকল করতে করতে ওরা হাঁটা লাগাল। সামনের পাহাড়টার বাঁকে যেতেই অদৃশ্য। সব চুপ, ভীষণ চুপ।

ভানু বলল, ‘উহ! কী চুপচাপ রে মাইরি। কান ফাটিয়ে দিচ্ছে।’

সত্যিই। নিস্তব্ধতা যে এমন প্রচণ্ড হতে পারে কোনওদিন ভাবিনি!

খুব অস্বস্তি হচ্ছিল।

আমি জিগ্যেস করলাম ‘হ্যাঁ রে চন্দ্র এখনও টিউশনিই চালাচ্ছিস?’

‘হ্যাঁ।’ দাড়ি-গোঁফের ফাঁকে দাঁত বের হল।

‘কোচিং করেছিস?’

‘নাহ, বাড়ি গিয়ে পড়াই।’

‘ধুস শালা, এবার কোচিং খোল, এ লাইনে এখন দারুণ পয়সা।’

চন্দ্র হাসল।

‘এই জন্য তোর দ্বারা কিস্যু হবে না। সারাজীবন দাঁত কেলিয়েই গেলি।’ কথায় কথা বাড়ছিল। হঠাৎ গৌর বলল, ‘এ তো সন্ধে হয়ে আসছে গুরু। তেনারা সব গেলেন কোথায়?

ভানু বলল, ‘তাই তো, খেয়ালই হয়নি। একবার দেখবি না কি এগিয়ে।’ চন্দ্র গায়ের শাল ঠিক করতে করতে হালকাভাবে বলল, ‘ও চিন্তার কিছু নেই, চলে আসবে এরমধ্যে।’

‘হুঁহ, তোমার আর কী। বিয়ে-থা তো করনি। বউ-বাচ্চার জন্য টেনশন কী বুঝবে’ বলতে বলতে ভানু উঠল।

আমরাও উঠতে যাচ্ছি। তখনই পাহাড়ের বাঁকের ওদিক থেকে কিচমিচ শব্দ। ওরা ফিরছে।

রাত্তির সাড়ে আটটা। গরমগরম রুটি আর বাঁধাকপির তরকারি খেয়ে সবে যে যার বিছানায় চাপাচুপি দিয়ে শুয়েছি। এমন সময় চন্দ্র হন্তদন্ত হয়ে বাইরে থেকে এসে বলল, ‘শিগগির একবার দেখবি আয়।’

‘কোথায়?’

‘বাইরে।’

‘এখন! তোর কি মাথা খারাপ!’

‘আয় না একবার। তোদেরও মাথা খারাপ হয়ে যাবে।’

নীল মায়ের পেটের কাছে লেপের ভেতর সেঁধিয়ে ছিল। মুখ বার করে দারুণ উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘কী গো চন্দ্রকাকু?’

‘চাঁদ।’

ভানু বলল, ‘অ, চাঁদ উঠেছে, খুব ভালো। তুই আজ দেখে নে, আমরা কাল সকালে দেখব।’

‘কী বলছিস ভানু, যার জন্য এসময় আসা হল সেটাই দেখবি না!’

গৌর বলল, ‘বলল তো আমরা কাল দেখব।’

‘পাগল না কি! কাল হয়তো দেখবি বৃষ্টি হয়ে কিচ্ছু দেখাই যাবে না।’

দেবলীনা বলল, ‘চলো না, এতদূর এসেছি আর এইটুকু বেরোতে পারব না।’ অগত্যা বিছানা ছেড়ে লেপকম্বল সব গায়ে ঢাকা দিয়ে বেরোনো হল।

পৃথিবীর প্রথম কবিতা কি চাঁদকে নিয়ে লেখা হয়েছিল? কে সেই আদিমতম পুরুষ যে প্রথম চাঁদের প্রেমে পড়েছিল? এত রূপ…এত রূপ!

চারদিকটায় উজ্জ্বল পারদে মাখামাখি, আর ওপরে ঝকঝকে কালচে নীল এক সমুদ্রের স্থির গভীরে একটি নিটোল মুক্তোর মতো রূপসী বসে রয়েছে। হয়তো আমাদের দিকেই তাকিয়ে, পাহাড়ের নীচে নরম সাদা লেপের মতো মেঘ জমে আছে। মুহূর্তের মধ্যে আমরা সবাই যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। শুধু মুগ্ধতা নয়, এত সুন্দরের সামনে কেমন যেন ভয় লাগতে শুরু করেছিল। পুটু শুধু বলে উঠল, ‘উহ কী সুন্দর!’

চন্দ্র ফিসফিস করে বলল ‘কোজাগর’।

একটা তীব্র কনকনে হাওয়া দিল। ভেতরের হাড়গুলো যেন কেঁপে উঠল। ‘ওরে বাবা রে’ বলে ভানু দৌড় লাগাল ঘরের দিকে।

চন্দ্র খাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেখ নীচেটা। ঝাঁপ দিতে ইচ্ছে করছে।’

আমি হেসে বললাম, ‘দে ঝাঁপ।’

‘আহ, কী যে বলো না! আর চন্দ্রদা অত ধারে গেছেন কেন, এদিকে আসুন।’

আমার বউ ধমক দিল।

চন্দ্র একগাল হেসে সরে এল, দাড়ি-গোঁফের ফাঁকে সাদা ঝকঝকে দাঁত।

তিন

‘দিস ইজ টু মাচ চন্দ্র, তোরা গেছিস যা, বাচ্চাগুলোকে টেনে নিয়ে গিলি কেন?’ ঘরে ঢুকতেই ফুঁসে উঠল ভানু। হঠাৎ এমন একটা আক্রমণে থতমত খেয়ে গেল চন্দ্রশেখর। তারপর আমতা আমতা করে বলল, ‘আসলে…মানে এমন সুন্দর…।’

‘আরে ধোর, সুন্দরের নিকুচি করেছে। ওদের শরীর খারাপ হলে তুই দেখবি?’

‘এভাবে বলছ কেন? আমরা সবাই তো গেছি।’ অঞ্জলি বলল।

‘তোমাকে ওর হয়ে দালালি করতে হবে না।’

‘এসব কী বলছ! ভাষা ঠিক করো।’

‘আর ভাষা শিখিও না। বাচ্চাটা অসুস্থ হলে এখানে কোনও ডাক্তার নেই।’

‘হঠাৎ পুটুর জন্য তোমার দরদ উথলে উঠছে কেন? বাড়িতে তো মেয়েটার দিকে একবার ফিরেও তাকাও না।’ বলতে বলতে কেঁদে ফেলল অঞ্জলি।

‘নাহ এমনি এমনি হাওয়ায় বড় হচ্ছে তো।’

‘আহ ভানু চুপ করবি। সাতসকালে…’ ধমক লাগাল গৌর।

ভানু হনহন করে বাইরে বেরিয়ে গেল।

‘সারাটা জীবন আমার শেষ করে দিল, একটা ইতর।’

‘অঞ্জলি প্লিজ, যা হওয়ার হয়ে গেছে, একটু শান্ত হ’ আমার বউ গিয়ে ওঁর কাঁধে হাত রাখল।

‘তুই কিছু জানিস না লীনা…!’

‘আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে, ছাড় ওসব।’

অঞ্জলি গিয়ে লেপ চাপা দিয়ে শুয়ে পড়ল।

পুরো সকালটাই মাটি, আসলে সবাই সানরাইজ দেখতে গেছিলাম। বাচ্চা দুটোও গেছিল, ভানু যায়নি, ঘুম থেকে তোলা যায়নি, ফিরে আসার পরেই এই অ্যাকশন।

সবাই ঘরের মধ্যেই চুপচাপ ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে আছি। দেবলীনা ইশারা করে আমাদের ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলল, সুড়সুড় করে সবাই বেরিয়ে এলাম। ‘ধু-স শালা, পুরো সকালটাই ঝাড়। গৌর বলল, ‘মাল নিজে যাবে না আর আমাদের ওপর টেম্পার দেখাচ্ছে।’

চন্দ্র এতক্ষণ চুপ ছিল, এবার মিনমিন করে বলল, ‘বাচ্চা দুটোকে বোধহয় নিয়ে যাওয়া ঠিক হয়নি।’

এমনিতেই চন্দ্রর ওপর মাথাটা টং হয়েছিল। আমি খেঁকিয়ে উঠলাম। ‘বুঝেছিস যখন এবার চুপ থাক।’

চন্দ্র চুপ করে গেল। তারপর ধীরে ধীরে আমাদের কাছ থেকে চলে গেল।

গৌর চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, ‘চন্দ্রটাকে আনাই ভুল হয়েছে।’

সত্যিই সারাদিন পুরো নষ্ট। অনেক বোঝানোর পরেও অঞ্জলি বিছানা ছেড়ে এক পাও নড়েনি। ভানু একবার আমাদের কথায় বউকে পটাতে গেছিল। ঝাঁঝানি খেয়ে ফিরে এসে বলল, ‘ধু-র চলত, নিজেরাই ঘুরব। এত তেল মারা পোষায় না।’

বউগুলোর একটাও কেউ গেল না। ডেফিনিট ইচ্ছে ছিল। স্রেফ কার্টসির জন্য যেতে পারল না। বাচ্চা দুটোও থেকে গেল। আমরা তিনজন এদিক-ওদিক একটু ঘুরলাম। দুপুরের দিকে হোটেলে ফেরার সময় গৌর বলল, ‘চন্দ্রটা কোথায়?’ তাই তো খেয়ালই হয়নি। গেল কোথায়? আমি বললাম ‘আবার রাগু রাগু করে একা ফিরে গেল না তো?’

‘গেলে আপদ যাবে। শালার মুখ দেখতে আর ইচ্ছে করছে না।’ ভানু গজগজ করল। ‘দেখ হয়তো ফিরে দেখব ওদের সঙ্গে গল্প মারাচ্ছে।’

ঠিক তাই। হোটেলে ফিরতেই ছাইচাপা মেজাজটা আবার ভুস করে উঠল। দেবলীনা, চন্দ্র আর লীনা মেঝেতে বসে গল্প করছে। বাচ্চা দুটো চন্দ্রের কোল ঘেঁষে ক্যাচরম্যাচর করছে। অঞ্জলিও আর পাশ ফিরে শুয়ে নেই। বালিশে ঠেস দিয়ে বসা, হয়তো একটু আগে খানিক হেসেও ছিল। আমাদের দেখে গম্ভীর হয়ে উঠলেও ঠোঁটের কোণে একটু আগের হাসির রেশ লেগে রয়েছে।

‘ও বাবা জানো মিশরীয়দের আগে কারা মমি বানাতে জানত?’

আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, ‘জানি না।’

লীনা কি ইচ্ছে করেই চন্দ্রর একটু বেশি কাছে বসেছে!

চন্দ্র আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কোন দিকে ছিলিস তোরা? খুঁজে পেলাম না।’

‘তাই না কি, খুঁজতে গেছিলি? কোথায়?’

বাইরে বেরিয়ে এসে ভানু বলল, ‘চন্দ্রটা বোকা না ন্যাকা বোঝা যায় না!’

গৌর বলল, ‘বাদ দে, কাল লাস্ট দিন। রাত্রে তেড়ে মাল খেতে হবে।’

ভানু মুখ বিকৃতি করে বলল, ‘ওটাকেও গেলাতে হবে তো।’

আমি বললাম, ‘খাবে না বোধ হয়।’

‘ঠিক খাবে। পরের পয়সায় মাল…’

সত্যি কথা বলতে আমরা নিজেরাও ঠিক জানি না চন্দ্রর আসল দোষটা কী? অথচ ওর প্রতি একটা অসহ্য ক্রোধ কিংবা অন্য কিছু সবসময় মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়। ভানু সেলস ট্যাক্সের সি টি ও। দু-হাতে ঘুষ নেয় আর মাল খায়। গৌর এখন ওর কোম্পানির রিজিওনাল ম্যানেজার। সঙ্গে সুন্দরী সেক্রেটারি। মাসে দুটো প্লেজার ট্রিপ মারে কাজের নাম করে। ওদের তুলনায় আমার ডানা অনেক ছোট। বাধা ধরা সরকারি মাসমাইনে। তাই জন্য বুকের ভেতর একটু জ্বলন আছে। কিন্তু তবু আমরা তিনজনেই চন্দ্রর থেকে অনেক অনেক এগিয়ে। ওকে আমরা সঙ্গে এনেছি, সেজন্য ওর কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কিন্তু কেন আমাদের বউ-বাচ্চাগুলো সবসময় ওই ভ্যাগাবন্ডটার সঙ্গে লেপটে রয়েছে? কী জাদুতে? এত অপমান করি, তার জন্য মাঝেমধ্যে খারাপও লাগে, তবু শালা কেন যে এঁটুলির মতো লেগে রয়েছে। ওইরকম চুপ থেকে ও কী…কী অস্বীকার করতে চায়…?

চার

দু-পেগের পরই চন্দ্র বলল, ‘আর দিস না।’

‘কেন রে, আগে তো গলা পর্যন্ত টানতিস।’

‘সহ্য হয় না এখন।’

‘কী সহ্য হয় না। মাল, না আমাদের?’ গৌর নিজের গ্লাসে ঢালতে ঢালতে বাঁকা হাসি হেসে বলল।

চন্দ্র হাসল। ওর এই চুপচাপ হাসিটায় কেন যে এত পিত্তি জ্বলে যায়!

ভানু বলল, ‘বুঝলি চন্দ্র এভাবে জীবন চলে না। পালটা, এবার নিজেকে পালটা। সারাজীবন পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে আর অন্যের বউ-বাচ্চার কাছে হিরো সেজে চলবে না।’

এই রে, ভানুর বোধহয় চড়তে শুরু করেছে। অলরেডি তিনটে বড় পেগ কমপ্টি। এতক্ষণ হালকাভাবে চন্দ্রকে দিচ্ছিল, এবার সরাসরি বোম ছুঁড়তে শুরু করেছে।

চন্দ্র চুপ থাকল।

‘চুপ কেন? বল কিছু।’

‘আমি তোদের বিরক্ত করতে চাইনি।’

লীনা চন্দ্রর ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে গল্প করছে। ছবিটা হঠাৎ চোখের সামনে আসতেই মাথাটা আমার দপ করে উঠল। গ্লাসে চুমুক দিয়ে মুখ কুঁচকে জিগ্যেস করলাম ‘তবে কী করতে চেয়েছিলি?’

‘আসলে অনেকদিন পর একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার লোভটা ছাড়তে পারিনি।’

গৌর বলল, ‘শুধু আমাদের সঙ্গে কেন, আমাদের বউদের সঙ্গেও বল।’

চন্দ্র আলতো হেসে বলল, ‘পুটু আর নীল তো দুটো ফুল।’

‘হুঁহ ফুল!’ ভানু ব্যাঁকা হাসল। তারপর টেনে টেনে বলল, ‘দেখ চন্দ্র আই অ্যাম ভেরি সরি টু সে, অ্যাকচুয়ালি তুই এখানে এসেছিস স্রেফ অন্য কারণে।…যদিও ইউ হ্যাভ ফেইলড টু ডু সো। যতই ক্যারদানি দেখাস আমার বউ আমার মেয়ে আমার…ইয়েস আমার পয়সায় খায় সুতরাং আমার বগলের তলায় থেকেই বাড়ি ফিরবে।’

ভানু ফুল পিক আপে। মাথাটা আমারও ঝিমঝিম করছিল, চোখের সামনে সব কিছু থিরথির করে কাঁপছে। বেশ আরাম লাগছে ভানুর কথায়। এতদিন তিনজনেই ভেতর ভেতর জ্বলে এসেছি। কেউ কারও কাছে সরাসরি প্রকাশ করতে পারিনি।

‘ওভাবে বলিস না ভানু।’ চন্দ্রর ভুরু দুটো কুঁচকে উঠল।

এই তো এবার ব্যাটার ঘা লেগেছে।

গৌর বলল, ‘তাহলে কী ভাবে বলবে?…শাললাহ তোর আস্পর্দা আসে কোত্থেকে আমাদের ঘেন্না করার। হু আর ইউ?’

‘আমি ঘেন্না করি না।’

‘তবে কী করিস?…করুণা…অ্যাঁ করুণা!’ ভানু চেঁচিয়ে উঠল। ‘তোর করুণায় আমি পেচ্ছাপ করি।…শালা বিবেকের পাঠ মারাতে এসেছিস।’

চন্দ্র আর কিছু বলল না। চুপচাপ উঠে চলে গেল।

‘যাচ্ছিস কোথায়, শুনে যা…’ ভানু গলা নামাল। ‘অবশ্য বাইরের লোককে আর কী বলব, নিজের বাড়িতেই সব বেইমান পুষছি।’

গৌর কাঁপা হাতে নিজের গ্লাসে ঢালতে ঢালতে বলল, ‘বাদ দে, ভুলে যা ওসব।’

‘ভুলে যাব মানে! আমরা কোনদিক থেকে কমতি রে!’

লীনা চন্দ্রর আরও কাছে এসে বসেছে…আরও চন্দ্রর গরম নিশ্বাস পড়ছে লীনার ঘাড়ে…গলায়। আমার একটা হেঁচকি উঠল। তারপর হড়হড় করে সব উগরে দিলাম। শরীরটা অবশ হয়ে এল। দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে চোখ বুঝে বসে রইলাম। আবার একটা ছবি এল, চন্দ্র নীলের হাত ধরে কোথায় যেন চলে যাচ্ছে।…অসহ্য!

ভানু বলল, ‘এ্যাহ ঘর ভাসিয়ে দিলি পুরো।’

‘সহ্য হয়নি।’

‘তো খাস কেন?’

গৌর বিড়বিড় করে বলল, ‘তবু চন্দ্র মাইরি…কোথায়, কোথায় যে একটা, ধ্যার…’

‘গেল কোথায় মালটা?’

ভানুর কথায় খেয়াল হল, সত্যিই তো গেল কোথায়?

‘দেখ হয়তো আমাদের কারও বউয়ের কোলে বসে ক্ষীর খাচ্ছে।

আমার কথায় ভানু দপ করে জ্বলে উঠল। ‘শুয়োরের বাচ্চা…চল তো, অনেক সহ্য করেছি।…আজকে…’

কী করে যেন তিনজনেই টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালাম। একতলার ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই দেখলাম একটু দূরে খাদের পাশে চন্দ্র একা দাঁড়িয়ে আছে। সামনে কাঞ্জনজঙ্ঘা। চাঁদের আলোয় একটা প্রকাণ্ড স্থির মেঘের মতো মনে হচ্ছে। আহ…গা শিরশির করে উঠল। আমরা তিনজন যেন হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে চন্দ্রর পিছনে এসে দাঁড়ালাম। চন্দ্র আমাদের খেয়াল করল না। স্থিরভাবে দাঁড়িয়েছিল।

‘চন্দ্র’।

ভানুর ডাকে চন্দ্রশেখর পেছন ফিরল। অদ্ভুত শান্ত অসহ্য সেই দৃষ্টি।

‘তোর একটা বিচার হওয়ার দরকার।’ গৌর টেনে টেনে বলল।

‘বেসিক্যালি ইউ আর ওয়ার্থলেস, অথচ…অথচ নিজেকে মহান ভাবিস। সব জাদু করে দিবি। আসলে তোর দ্বারা কিস্যু হওয়ার নয়। তুই পুরোপুরি ফেলিওর অ্যান্ড ভেরি মাচ জেলাস টু…তোকে প্রয়োজন নেই…সো…সো…সো…’ আমরা তিনজন অবশভাবে চন্দ্রের দিকে এগোচ্ছিলাম।

চন্দ্র খাদের ধারে দাঁড়িয়ে। হাওয়াতে চন্দ্রর গায়ের শাল সাদা ডানার মতো ঝাপটাচ্ছিল।

‘তুই চলে যা’ বলে চন্দ্রকে হঠাৎ ধাক্কা দিল ভানু। ধাক্কায় চন্দ্র খাদের আরও কাছে চলে এল। চোখে তবু সেই শান্ত দৃষ্টি। ভেতরটায় মুহূর্তে কেমন করে উঠল। তিনজনেই ওকে ঠেলতে থাকলাম খাদের দিকে।

গৌর চিৎকার করে উঠল। তোকে ফেলে দিচ্ছি…ভয় পা…চন্দ্র ভয় পা…প্লিজ…।’

খাদের একেবারে কিনারে এসে ভানু বলল ‘তুই যা।’ তিনজনে সজোরে ধাক্কা দিলাম ওকে। নীচে তাকিয়ে দেখলাম খাদে জমে থাকা সাদা থোকা থোকা মেঘের মধ্যে ডানার মতো একা একা উড়তে উড়তে মিলিয়ে গেল একটু পরে। আবার বমি পাচ্ছিল আমার।

‘শেষ…আ…হ’। হা হা করে হেসে উঠল ভানু। ‘হা হা হা’ প্রচণ্ড চিৎকার করে হাসতে গিয়ে কেঁদে ফেলল। আমরা সবাই তীব্রভাবে হাসতে চাইছিলাম…।

ঠিক সেই সময় পুটু আর নীল কী যেন বলতে এসে ডাইনিং রুমের দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়ে ছিল। আর অবাক হয়ে দেখছিল ঘরের ভেতর ওদের বাবা-কাকারা কেউ আধবসা কেউ শুয়ে বমিতে মাখামাখি হয়ে চোখ বন্ধ করে পাগলের মতো হাসছে, কাঁদছে আর সামনের দিকে দু-হাত বাড়িয়ে মিছিমিছি কী যেন ঠেলছে!

শারদীয়া দেশ

২০০৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *