ডানাওয়ালা মানুষ
ছাদে রাখা চৌকো বাক্সটায় কিছুদিন হল, কয়েকটা পায়রা আনাগোনা শুরু করেছে৷ এমনি এমনি করেনি৷ রোজ দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর মায়ের কাছে থেকে চাল ধার করে ছাদে গিয়ে ছড়িয়ে আসে টুকু৷ প্রথম দু’দিন এমনিই পড়ে ছিল চালের দানা৷ কারও দেখা মেলেনি৷ তিন দিনের দিন টক-টকর ডাক শুনেই চমকে উঠেছিল টুকু৷ সাদার উপর খয়েরি ছোপ দেখেই মনটা নেচে উঠেছিল তার৷ এতটাই খুশি হয়েছিল যে একতলা থেকে নিনিকে ঘুমচোখে টেনে এনেছিল পায়রা দেখাতে৷
ভরদুপুরে দিদির এমন পাগলামি দেখে বেশ বিরক্ত হয়েছিল নিনি৷ অবশ্য মুখে কিছু বলেনি৷ টলোমলো পায়ে নীচে গিয়ে আবার শুয়ে পড়েছিল বিছানায়৷
টুকুর উৎসাহে কিন্তু ভাটা পড়েনি৷ স্কুল থাকলে সকালেই ছাদে এসে দানা ছড়িয়ে যায় ও, না থাকলে গোটা দুপুরটা ছাদেই কাটায়৷ দিনে দিনে পায়রার সংখ্যাও বেড়েছে৷ আপাতত সব মিলিয়ে গোটা আটেক৷ তার মধ্যে দুটো আবার নিতান্তই শিশু৷ উড়তে শেখেনি এখনও৷
পুজোর ছুটি৷ আজও ছাদে এসে চাল ছড়াচ্ছিল টুকু৷ পাশেই বসে গুনগুন করে কী একটা গান গাইছিল নিনি৷ পাশে ইতিহাস বইটাও পড়ে আছে৷ সেটা একবারও খুলে দেখেনি ও৷ চাল ছড়াতে ছড়াতে তাকে আড়চোখে একবার দেখে নেয় টুকু, ‘তুই নাকি ছাদে এসে ইতিহাস পড়বি!’
‘পড়েছি তো,’ অন্যমনস্কভাবে উত্তর দেয় নিনি৷
‘কই দে দেখি, পড়া ধরি৷’
বইয়ের উপর একটা হাত রেখেও তুলে নেয় সে৷ বলে, ‘তোর ছোটো পায়রাগুলো উড়তে শেখেনি এখনও?’
‘উহুঁ…’
‘কেন?’
‘মনে হয় তোর মতো ফাঁকিবাজ৷ মন দিয়ে প্যাকটিস করেনি৷’
কথাটা শুনে নিনির মুখ লাল হয়ে ওঠে, ‘আমি ফাঁকিবাজ?’
‘তবে নয়তো কী? বইটা খুলে অবধি দেখলি না একবারও৷’
‘আমাকে কেউ উড়তে শেখালে তক্ষুনি শিখে যেতাম৷ ইতিহাস বড্ড বিচ্ছিরি৷’
টুকু ঠোঁটের কোনা দিয়ে হাসে৷ উত্তর দেয় না৷ বাটির সবটুকুনি চাল ছড়িয়ে দিয়ে বোনের পাশে এসে বসে পড়ে সে৷ তারপর জামার হাতায় মুখ মুছতে মুছতে বলে, ‘জানিস নিনি, আমি যখন ছোটো ছিলাম তখন মা বলত, একসময় মানুষেরও নাকি ডানা ছিল৷’
‘আমি তো শুনেছিলাম, ল্যাজ ছিল৷’
‘মা ওরকমই, নিজের ইচ্ছামতো গল্পকে ঘুরিয়ে দেয়৷ বলত, মায়ের কথা শুনে চললে একসময় নাকি আমারও ডানা গজাবে৷’
নিনি মাথাটা একটু নাড়িয়ে বলল, ‘ওসব তোকে দিয়ে কথা শুনিয়ে নেওয়ার জন্যে৷’
‘সে তো এখন বুঝি৷ তখন মনে হত, সত্যি গজাবে৷ রোজ সকালে উঠে আয়নায় পিঠ দেখতাম৷’
টুকুর চোখ দুটো একটু একটু করে দূর প্রান্তে হারিয়ে গিয়েছে৷ কয়েকটা চালের দানা তার পায়ের কাছে পড়ে ছিল৷ একটা ছোটো পায়রা উৎসুক মুখে সেগুলো খুঁটিয়ে দেখে ঠোকর মারে৷ তারপর টুকুর পায়ের উপর ঠোঁট ঘষতে থাকে৷
‘তোকে আর ভয় পায় না ওরা৷’
দিদির মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে নিনি৷ কথাটা কানে যেতে সংবিৎ ফেরে টুকুর৷ সে একগাল হেসে পায়রাটাকে দু-হাতে ধরে ফ্যালে৷ বলে, ‘তোকেও পায় না মনে হয়৷ ধরে দেখবি?’
ভয়ে হাত সরিয়ে নেয় নিনি, ‘যাঃ৷ গায়ে হাত দিলে মা বকবে৷’
‘হুঃ, মায়ের কথা মেনে উলটে যাচ্ছিস যেন৷’
‘তোর থেকে বেশি শুনি৷’
টুকু ঝগড়াটাকে আর এগোতে দেয় না৷ ওর ভাবুক চোখ আবার দিগন্তে স্থির হয়েছে৷ একমনে কী যেন ভাবতে ভাবতে উদাস গলায় বলে, ‘কিছুদিন যেন মায়ের কী হয়েছে… আগের মতো কথায় কথায় বকা দেয় না আর৷’
নিনি মাথা নাড়ায়, ‘বাবারও৷ আগের মতো কথা বলে না৷ কী হয়েছে বল তো?’
‘আমিও জানি না৷ মাঝে-মাঝে বুঝতে পারি, দরজা বন্ধ করে ঝগড়া করে৷’
টুকু চোখ বড়োবড়ো করে বলে, ‘তুই মায়ের ঘরে আড়ি পাতিস? দাঁড়া, বলব আজ মা-কে৷’
‘ওহো৷ আর তুই পাতিস না যেন৷’ ঝাঁজিয়ে ওঠে নিনি৷
‘একদম না৷’
‘তাহলে জানলি কী করে, ঝগড়াটা মায়ের ঘরে হয় না বাবার ঘরে হয়?’ কথাটা বলে উঠে পড়ে নিনি৷ ছাদের দরজা দিয়ে নীচে চলে আসে৷
সিঁড়িটা পেরোতেই সুনন্দার ঘর৷ সেটার লাগোয়া বারান্দায় এসে দাঁড়ায় ও৷ একটুক্ষণ পরে টুকুও নীচে নেমে আসে৷ ও কিন্তু বারান্দায় দাঁড়ায় না৷ নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়৷ তারপর ধীরপায়ে এসে দাঁড়ায় আয়নাটার সামনে৷ চুলটা আঁচড়ে নেয়৷ সযত্নে দ্যাখে মুখটা৷ হঠাৎ কী মনে হতে পিছন ঘুরে দাঁড়ায়৷ পিঠের কাছ থেকে জামাটা সরিয়ে ভালো করে দেখার চেষ্টা করে৷ উৎসুক চোখ দুটো মুহূর্তে নিবে আসে৷ দরজার ছিটকিনিটা নামিয়ে দিয়ে বিছানার উপর চিত হয়ে শুয়ে পড়ে সে৷
দুপুরে ঘুম ভাঙতে সুনন্দা দেখেন, বিছানার উপরেই বসে আছে নিনি৷ গম্ভীর মুখ করে সুনন্দার কপালে হাত রেখে কী যেন বুঝতে চাইছে ও৷ কেমন ঠান্ডা-ঠান্ডা লাগে সুনন্দার৷ অর্থাৎ জ্বর এসেছে৷
‘তোর দিদি কোথায় রে?’ প্রশ্নটা শুনে হাত সরিয়ে নেয় নিনি৷ মুখ ফিরিয়ে বলে, ‘পাশের ঘরে গিয়ে দরজা দিয়েছে৷’
সুনন্দা পাশ ফিরে শুতে শুতে বলেন, ‘তোদের নিয়ে যে আমি কী করি৷ একটাও কথা শুনতে চাস না৷’
‘আচ্ছা, দিদিকে তুমি বলেছিলে মানুষেরও ডানা গজায়?’
‘বলেছিলাম নাকি? কী জানি, মনে নেই৷’
‘আমাকে তো বলোনি৷’
ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে একটুখানি হাসেন সুনন্দা, ‘কেন, তুই কী করবি ডানা দিয়ে?’
‘উড়ে বেড়াব৷ আবার কী?’
‘সে তো এরোপ্লেনে চেপেও আকাশে ওড়া যায়৷’
নিনি আর কিছু বলে না৷ নিজের একটা ডানা থাকা আর এরোপ্লেনে চেপে উড়ে বেড়ানোর তফাতটা মা-কে বোঝানো যাবে না৷ মুখ নামিয়ে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকে৷ তারপর হঠাৎ কী মনে পড়তে বলে ওঠে, ‘জানো তো মা, দিদি খুব হিংসুটে৷’
‘কেন রে? কী করেছে তোর সঙ্গে?’
‘কী আবার৷ ওয়াটার কালারটা চাইলাম৷ কিছুতেই দিতে চাইল না৷ বলল, আমি নাকি আজেবাজে ছবি এঁকে রং নষ্ট করব৷’
‘এ বাবা! এটা কিন্তু ঠিক করেনি৷ একবার দিতেই পারত৷’
নিনি রাগতস্বরে বলে, ‘হুঃ, নিজে যে কী হাতি-ঘোড়া আঁকে, আমার জানা আছে৷’
সুনন্দা হাসতে হাসতে বলেন, ‘আচ্ছা, তুই এত রাগ করিস কেন বল তো?’
কথাটা ভালো লাগে না নিনির৷ রাগের যথেষ্ট কারণ আছে৷ এই অক্টোবরে ওর দশ বছর বয়স হতে চলল, এক অঙ্কের সংখ্যা থেকে বেড়ে দুই অঙ্ক৷ অথচ সবাই তাকে ছোটো ভাবে৷ ওর ভাগ্যে একসঙ্গে পাঁচটার বেশি ফুচকা বরাদ্দ নয়৷ অথচ দিদি গপগপিয়ে খায়৷ বাবা বলেছে, মাধ্যমিক পাশ করলে মোবাইল ফোনও কিনে দেওয়া হবে টুকুকে৷ অবশ্য মোবাইল ফোনের ব্যাপারে অতটা আগ্রহ নেই ওর৷ খালি জলরংটার উপর লোভ আছে৷ মোটা দশ নম্বর তুলিটার ছুঁচোলো মুখটা একটুখানি মুচড়ে দিলে কী সুন্দর বিকেলের সূর্য আঁকা যায়৷ তারপর সরু তুলি দিয়ে সেই সূর্যের নীচে কয়েকটা সারবাঁধা ডানামেলা পাখি৷
হাত দিয়ে ঠেলে জানলার পাল্লাটা খুলে দেয় নিনি৷ মনে মনে ভাবা ছবিটার মতো করেই বিকেল নামছে৷ শুধু পড়ন্ত আলোর রেণুমাখা পাখিগুলোর দেখা নেই৷ আচ্ছা, যদি সত্যিই পাখির বদলে কয়েকটা ডানাওয়ালা মানুষ উড়ে যেত আকাশের গা বেয়ে… তাদের উড়ন্ত ডানা চুঁইয়ে বিকেল নামত পৃথিবীর মাটিতে? আচমকা জানলাটা বন্ধ করে দেয় নিনি৷ নাঃ এসব ভাবনা আর মাথায় আসতে দিলে চলবে না৷ তার এখন এক অঙ্কের না, দুই অঙ্কের বয়স৷
‘এই আহাম্মক… মায়ের জ্বর হয়েছে আর আমাকে ডাকিসনি?’
টুকুর ডাকে সংবিৎ ফেরে নিনির৷ পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখতে পায় দিদিকে৷ তারপর মুখ নামিয়ে নিয়ে বলে, ‘তখন তো অতটা ছিল না৷ আর মা ঘুমোচ্ছিল৷’
‘তাতে কী? আমি তো ঘুমোচ্ছিলাম না৷’
‘তোর ঘরের দরজা বন্ধ ছিল৷’
‘ঠেলা দিতে কী হয়?’
টুকু এগিয়ে এসে হালকা ঠেলা দেয় মা-কে, ‘মা… ও মা…’
ঘুমের ঘোরে আলতো চোখ খোলেন সুনন্দা, ‘ওঃ তুই৷ বোন কই?’
‘জানলার কাছে৷ ওষুধ খেয়েছ?’
সুনন্দা উত্তর দেন না৷ গভীর ঘুমে ঢলে পড়েন৷ আবার ঠেলা দেয় টুকু, ‘আরে, মাথাটা তো ধুয়ে নাও অন্তত৷’
‘ধুর, ওসব লাগবে না৷ আমার পা-টা টিপে দে তো রে৷’
টেবিলের উপর রাখা থার্মোমিটারটা তুলতে তুলতে নিনির দিকে তাকিয়ে ধমক দেয় টুকু, ‘এই গর্দভটা৷ এখনও হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস? দে, মায়ের পা টিপে দে৷’
বাক্যব্যয় করে না নিনি৷ বিছানার একপ্রান্তে বসে পা টিপতে থাকে৷ নিশ্বাসের গভীরে অস্পষ্ট কয়েকটা শব্দ শোনা যায়, ‘হুঁ:, ডানা গজানোর বেলায় ও, আর পা টেপার বেলায় আমি৷’
‘কী? কী বললি রে?’ আবার গর্জে ওঠে টুকু৷
‘কিছু না৷’
থার্মোমিটারটাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে আঁতকে ওঠে টুকু, ‘সর্বনাশ! একশো তিন জ্বর! ওষুধ কোথায় আছে?’
‘ড্রয়ারে৷’
এবার আর বলতে হয় না নিনিকে, সে নিজেই বিছানা থেকে নেমে দৌড় দেয় ওষুধ আনতে৷ সুনন্দা আবার চোখ বন্ধ করে বলেন, ‘বোনটার সঙ্গে ওরকম করিস কেন?’
‘কী করলাম আমি?’ অবাক হয়ে যায় টুকু৷
‘একদিন যদি দিতিস জলরংটা, কী ক্ষতি হত?’
‘কেন দেব?’ ঝাঁজিয়ে ওঠে টুকু, ‘ও আমার কথা কি ভাবে?’
‘ভাবে না?’
‘না৷’
‘হু… তবে তুই যে রোজ দুপুরে পায়রার গায়ে হাত দিস, সেটা এখনও বলে দেয়নি কেন আমায়?’
কথাটা শেষ হতেই ঘরে ঢোকে নিনি৷ ওষুধটা মায়ের মাথার কাছে রেখে আবার বিছানার উপর এসে বসে পড়ে৷ টুকু আড়চোখে একবার ওর দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলে ওষুধটা হাতে তুলে নেয়৷
সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে একটু থমকে দাঁড়ায় পরমেশ৷ মেয়েদের ঘরে গিয়ে একবার উঁকি দিয়ে দেখে আসে৷ পড়াশোনা করছে দু-জনেই৷ অথবা সিঁড়ির কাছে বাবার পায়ের আওয়াজ পেয়ে তড়িঘড়ি পড়াশোনায় মন দিয়েছে৷ ওদের চোখ দুটোর দিকে একবার ভালো করে তাকায় সে৷ তারপর মুখ নামিয়ে নেয়৷ ধীরপায়ে এগিয়ে আসে পাশের ঘরে৷
আলতো করে ভেজানো ছিল দরজাটা৷ একটু চাপ দিতেই খুলে যায়৷ ভিতরটা অন্ধকার৷ অথচ জানলা দিয়ে আসা চাঁদের ক্ষীণ আলোয় বোঝা যায়, একটা মানুষ শুয়ে আছে বিছানার উপরে৷ হাতের ব্যাগটা মাটিতে নামিয়ে রেখে দরজাটা বন্ধ করে দেয় পরমেশ৷ ছিটকিনি তুলে দিয়ে নিঃশব্দে বিছানার একপ্রান্তে এসে বসে পড়ে৷ সে জানে, সুনন্দা নিঃসাড়ে শুয়ে থাকলেও ঘুমোয়নি৷ একটা হাত ওর মাথায় রাখে, নীচুস্বরে বলে, ‘তুমি আজও বলতে পারোনি ওদের?’
অন্ধকারেই মাথা দোলায় সুনন্দা৷ ওর এলোমেলো চুলে রুপোলি আলো মাকড়সার জালের মতো ফুটে রয়েছে৷ সেদিকে তাকিয়েই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে পরমেশ৷ ওর বুক বেয়ে একটা দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে আসে, ‘এভাবে হবে না৷ আমাদের আরও শক্ত হতে হবে৷’
‘আর কত শক্ত হব বলো তো?’
‘জানি না৷’
‘আচ্ছা তুমিও তো বলতে পারো৷’
‘পারি,’ মাথা দোলায় পরমেশ, ‘কিন্তু এসব কথা তোমার মুখ থেকে শুনলে হয়তো আঘাত কম পাবে৷’
‘আমি পারব না৷’ সুনন্দার গলার স্বর কঠিন হয়ে আসে৷ হাতের উপর ভর দিয়ে কোনওরকমে বিছানার উপরে উঠে বসে, ‘একবার ভেবে দেখেছ ওদের বয়স কত৷ একজন দশ আর একজন তেরো৷’
বিছানা থেকে উঠে পড়ে পরমেশ৷ জামার পকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে বলে, ‘যাক গে, কাগজপত্র সব রেডি করতে হবে৷ কয়েকটা সইসাবুদ বাকি৷ আমিও আর বেশি দিন এখানে আসতে পারব না৷’
‘বেশ৷ তোমার যা ইচ্ছা৷ যেখানে সই করতে হবে বোলো, করে দেব৷’
‘হুঁ…’
কয়েকটা নিঃশব্দ মুহূর্ত কেটে যায়৷ জামাকাপড় বদলে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে পরমেশ৷ সারা দুপুর রোদ খেয়ে বারান্দাটা এখনও তেতে আছে৷ গরমের দিন; তা-ও একটুও বৃষ্টি হচ্ছে না৷ টুকুর ফিনফিনে গলায় পড়ার শব্দ ভেসে আসছে৷ মোঘল সাম্রাজ্য, আকবরের ধর্মনীতি, ঔরঙ্গজেব, জিজিয়া কর—ক্লাস সেভেনে পড়ে মেয়েটা৷ পরমেশের নিজের ছোটোবেলায় ক্লাস সেভেনে এত কিছু পড়তে হত না৷ থাকলে সে নিজে পাশ করতে পারত না৷
একটা সিগারেট ধরাতে গিয়েও থেমে গেল ও৷ মেয়ে দুটো কি আর কিছুদিন পর থেকেই ঘৃণা করবে ওকে?
ঘরের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে এল পরমেশ৷ একটা বালিশে আড় হয়ে মাথার নীচে একটা হাত রেখে কিছু লিখছে নিনি৷ টুকু একটু দূরে বসে দুলে দুলে পড়ছে৷ নিনির খাতায় উঁকি দেয় পরমেশ, জিগ্যেস করে, ‘হোমওয়ার্ক আর কতটা বাকি?’
‘হয়ে গেছে৷’ নীচুস্বরে জবাব দেয় নিনি৷
‘বেশ৷ তাহলে আজ আর পড়তে হবে না৷ মায়ের শরীর ভালো নেই, মায়ের কাছে যাও৷’
খুশি হয়ে বই বন্ধ করে উঠে পড়ে নিনি৷ তারপর বিছানা থেকে নেমে ঘরের বাইরে বেরিয়ে যায়৷ ঘরের আলোটা নিভিয়ে দেয় পরমেশ৷ এতক্ষণে অবাক হয়ে গিয়েছে টুকু৷ খানিকটা যেন ভয়ও লাগছে ওর৷ আজ দুপুরে তো অন্যায় কিছু করেনি সে৷ পায়রার গায়ে হাত দিয়েছে, সেটা মা তো আগেই জানতে পেরেছে৷ আজ তাহলে কীসের জন্য বকা খেতে চলেছে? বুক দুরুদুরু করতে লাগল ওর৷
‘তোর জন্মদিনটা কবে যেন?’
‘আঠেরোই জুন৷’
‘এসেই তো গেল৷ কত হবে যেন৷’
‘চোদ্দো৷’
‘বাঃ, বেশ তো বড়ো হয়ে গেলি দেখতে দেখতে৷’
টুকু আর কিছু উত্তর দেয় না৷ একইভাবে ঠায় বসে থাকে৷ পরমেশ আর-একটু ওর কাছে সরে আসে৷ বলে, ‘বড়ো হয়েছিস যখন তোকেই আগে বলি কথাটা৷ তুই না হয় বোনকে বলে দিস৷’
দূরে বাড়িগুলোতে সন্ধের শাঁখ বাজতে শুরু করেছে৷ কাঠের জানলার ভিতর থেকে ঘুণপোকার টকটক আওয়াজ হচ্ছে৷ কয়েকটা নিস্তব্ধ মুহূর্তের দখল নিল ওরা৷
‘আমি আর এ বাড়িতে থাকব না৷’
‘কেন? অন্য বাড়ি কিনবে?’
মাথা নাড়ে পরমেশ, ‘তোমরা থাকবে৷ আমি থাকব না৷’
‘ও৷’
‘শুধু মায়ের সঙ্গে থাকতে অসুবিধা হবে না তো?’
‘না৷’
‘বোনের খেয়াল রাখতে পারবি তো?’
আর কোনও কথা নেই৷ নানারকম উত্তর সাজিয়ে রেখেছিল পরমেশ কিন্তু তার কোনওটাই আর মুখে আনা গেল না৷ টুকু কী যে বুঝেছে, সেটাও বোঝা যাচ্ছে না৷ অথচ কথাটা একবার পাড়া গিয়েছে যখন পুরোটা বুঝিয়ে দেওয়াই ভালো৷
‘আমি কী বলতে চাইছি, বুঝতে পেরেছিস?’
উপরে-নীচে মাথা নাড়ে টুকু৷ ওর মাথায় একবার হাত বুলিয়ে পরমেশ উঠে দাঁড়ায়৷ কীরকম একটা অস্বস্তি গ্রাস করছে ওকে৷ কিছু কথা যেন বলা হল না৷ বলা ভীষণ দরকার…
দরজার কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় ও৷ পিছন ঘুরে বলে, ‘যেটা বললাম, মনে থাকবে তো? বোনকে কিন্তু তুই বোঝাবি৷’ কথাটা বলে আর দাঁড়ায় না সে৷ দ্রুতপায়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে৷
টুকু বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়৷ মাথার ভিতরটা কেমন যেন ভোঁ ভোঁ করছে ওর৷ পা দুটো দুর্বল হয়ে আসছে৷ মনে হচ্ছে, এখুনি টলে পড়ে যাবে৷ কোনওরকমে মনটা শান্ত করে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল ও৷
বাইরেটা এখন ফাঁকা৷ একতলায় নিজের ঘরে ফিরে গিয়েছে পরমেশ৷ পাশের ঘরের আলোটা এখনও নেবানো৷ সেখানেই ঢুকে আসে টুকু৷ অন্ধকার ঘরের জানলায় দাঁড়িয়ে আছে সুনন্দা৷ নিনিকে ঘরে দেখতে পাওয়া গেল না৷ ধীরপায়ে মায়ের ঠিক পিছনে এসে দাঁড়ায় টুকু৷ নীচু গলায় জিগ্যেস করে, ‘জ্বর কমেছে তোমার?’
সুনন্দা চমকে ফিরে তাকিয়ে মেয়েকে দেখতে পেয়ে একটা হাত বাড়িয়ে ওকে কাছে টেনে নেন, ‘এর মধ্যেই পড়া হয়ে গেল তোর?’
মাথা নাড়াল টুকু৷ তারপর হাত বাড়িয়ে জানলার একটা গ্রিল ধরে দাঁড়াল৷ তার মুখ চোখ ভাবলেশহীন৷ মায়ের মুখের দিকে এতক্ষণে একবারও তাকায়নি৷ আকাশে গোল চাঁদটা জানলার এক কোণ ছেড়ে প্রায় বেরিয়ে যাবার উপক্রম করেছে৷ টেবিলে রাখা ঘড়ির কাঁটার খচখচ শব্দ৷ এইসব আজ খুব বেশি করে কানে আসছে ওর৷
‘বাবা কিছু বলেছে তোকে?’ টুকুর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা আঁচ করতে পারেন সুনন্দা৷ মাথা দোলায় ছোট্ট মেয়েটা৷ ওর মাথার সামনের এলোমেলো চুল মুখ ঢেকে দিয়েছে৷ এক হাতে সেটা সরিয়ে দেয় সুনন্দা, ‘যা বলেছে, সব বুঝতে পেরেছিস তো?’
টুকু নিঃশব্দে মাথা দোলায়৷ বাইরের আলো-আঁধারি মাখা আকাশের দিকে তাকিয়ে কী যেন খুঁজছে সে৷
‘আর আমাকে কিছু জিগ্যেস করার নেই তোর?’ মেয়েকে কাছে টেনে জিগ্যেস করে সুনন্দা৷
একটুক্ষণ চুপ করে থাকে টুকু৷ কথাটা বলা উচিত হবে কি না ভেবে নেয়৷ শেষে প্রায় অস্পষ্ট গলায় উচ্চারণ করে, ‘তুমি আমাকে মিথ্যে বলেছিলে মা?’
‘কী মিথ্যে?’
‘মানুষের কোনওদিন সত্যিকারের ডানা গজায় না?’
কথাটা শেষ করেই আচমকা ঘর ছেড়ে দৌড় দেয় সে৷ ওর দুরন্ত পায়ের আওয়াজ সিঁড়ির উপর দিয়ে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে সুনন্দার কানে…
পরদিন সকালে ঘনঘন বাজ পড়া আর জানলায় বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভাঙল টুকুর৷ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, সাড়ে আটটা বাজতে চলেছে৷ অথচ মনে হচ্ছে যেন বিকেল হয়ে গেছে৷ বিছানা থেকে নেমে বাইরে বেরিয়ে এল ও৷ প্রথমে মায়ের ঘরে উঁকি দিল৷ ঘর ফাঁকা৷ একতলা থেকে দেখে এল সেখানেও কেউ নেই৷ কীরকম যেন ভয় লাগল ওর৷ বাড়ির সবাই আচমকা গেল কোথায়? সিঁড়ির কাছটায় দাঁড়িয়ে উঁচু গলায় ডাক দিল সে, ‘মা… নিনি… এই নিনি…’
বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ ছাড়া আর কোনও প্রত্যুত্তর শোনা গেল না৷ রাতে নিনি মায়ের কাছেই শুয়েছিল৷ আজ সকালে উঠে কি তাহলে সবাই মিলে বেরিয়েছে কোথাও? ওকে না জানিয়েই?
আর-একটু সিঁড়ির দিকে এগিয়ে এল টুকু৷ বৃষ্টির জল সিঁড়ির ধাপ বেয়ে দোতলার মেঝেতে এসে নেমেছে৷ কী আশ্চর্য! এত সকালে ছাদের দরজা খুলল কে? এক-পা এক-পা করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল টুকু৷
হ্যাঁ, যা ভেবেছিল তা-ই৷ ছাদের দরজার ঠিক নীচে পা মুড়ে বসে বৃষ্টির ফোঁটার দিকে তাকিয়ে আছে নিনি৷ ওর গায়ে এখনও রাতের জামা৷ চুলটা পর্যন্ত আঁচড়ানো নেই৷ নিনির পিঠে একটা হাত রাখল টুকু, বলল, ‘কী রে! এখানে বসে? ছাট লাগছে তো৷’
উত্তর দেয় না নিনি৷ যেন শুনতেই পায়নি৷ ভালো করে তাকিয়ে টুকু বুঝতে পারে, বৃষ্টির ছাদের ভিতর কয়েক ফোঁটা জলের ধারা নিনির গাল বেয়ে নামছে৷ কিছু একটা আঁচ করতে পারে টুকু৷ ক্রমশ ওর হাত পিঠ থেকে মাথায় উঠে আসে৷
‘মা কোথায় গেছে জানিস?’ জিগ্যেস করে টুকু৷
নিনি মাথা দোলায়৷ একহাতে চোখের জল মোছার চেষ্টা করে৷ টুকু বসে পড়ে ওর পাশটায়৷
‘তোকে মা কিছু বলেছে তার মানে?’
আচমকা যেন বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলে যায় দশ বছরের মেয়েটার সমস্ত শরীর জুড়ে৷ দিদির হাতটা একঝটকায় সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে৷ নিমেষে ছুটে যায় কুয়াশার মতো ঝমঝমে বৃষ্টির বুক লক্ষ্য করে৷ চমকে উঠে দাঁড়ায় টুকু৷ ছাদের ভিতর পা বাড়াতেই সারা শরীর ভিজে যায় ওর৷
‘নিনি… আরে, কোথায় যাচ্ছিস…’
আর-একটু এগিয়ে আসতে মিহি কান্নার শব্দ শুনতে পায় টুকু৷ বৃষ্টির আওয়াজে প্রায় ঢেকে গিয়েছে; তা-ও শোনা যায়৷ অসহায় যন্ত্রণাময় কান্নায় ভেসে যাচ্ছে নিনির কচি মুখটা৷
ওর সামনে এসে দাঁড়ায় টুকু৷ ছাদের একদিকের পাঁচিল ধরে দাঁড়ায় দু-জনে৷ কারও মুখে কথা ফোটে না৷ আস্তে আস্তে বোনের দিকে একটু এগিয়ে যায় টুকু৷ একবার ইতস্তত করে৷ তারপর আচমকাই দুহাতে কাছে টেনে নেয় ওকে৷ নিনির হাতদুটো এতক্ষণ মুখ ঢেকে ছিল এবার মুখ থেকে সরে তারা টুকুর গলা জড়িয়ে ধরে৷ কম্পিত বুকটা ছটফট করতে থাকে টুকুর দু-হাতের মাঝে৷
‘শোন-না… আরে শোন-না৷’ ফিসফিস করে উচ্চারণ করে টুকু৷
‘শুনছিস? … ওই…’
‘কী?’ কান্নার ফাঁকে কোনওরকমে শব্দটা বেরিয়ে আসে নিনির গলা থেকে৷
‘আমার ওয়াটার কালারটা দিয়ে দেব তোকে৷’
‘কেন? চাই না আমার… কিচ্ছু চাই না৷’
টুকু আর কিছু বলে না৷ আরও জোরে বোনকে বুকে চেপে ধরে সে৷ আর ঠিক তখনই অদ্ভুত একটা ব্যাপার চোখে পড়ে ওর৷ পায়রার খোপের ছোটো দরজাটা খোলা৷ বৃষ্টির জল ছাদের মেঝেতে আছাড় খেয়ে ছিটকে যাচ্ছে সেদিকে৷ দরজার কাছটায় একটা বড়ো পায়রা ছোটো পায়রা দুটোকে ডানার নীচে নিয়ে জবুথুবু হয়ে বসে আছে৷ ছিটকে-আসা জল একটুও লাগছে না ছোটো পায়রা দুটোর গায়ে৷ বড়ো পায়রাটার দুটো মোলায়েম অথচ দৃঢ় ডানা ঢেকে রেখেছে ওদের৷
টুকুর মনে হল, পাখির ডানা কেবল ওড়ার জন্য হয় না৷ প্রবল বৃষ্টির মাঝে বড়ো পাখির ডানা আশ্রয় দিতে পারে ছোটো পাখিকে৷ তেমনি করে মানুষও পারে৷ তেমন মানুষদেরও ডানা থাকে৷ মা মিথ্যে বলেনি তার মানে…
দু-হাতে বোনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সে৷