ডাক
কত রকমের ডাকা আছে! এক-এক ডাকের এক একরকম প্রতিক্রিয়া। কোনও ডাকে বুক নানা আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে, কোনও-কোনও ডাকে হৃদয় নেচে ওঠে আনন্দে। যিনি ডাকছেন, তিনি ডেকে কিছু বলার আগেই মন বুঝে যায়, তিনি কী বলবেন। গৃহকর্তা বাইরের ঘরে বন্ধুবান্ধব নিয়ে বসে আছেন, এমন সময় মেয়ে এসে বলছে, ‘বাবা, মা তোমাকে একবার ডাকছে।’ কর্তা সঙ্গে-সঙ্গে উঠে আলনার দিকে গেলেন, জামার বুকপকেট থেকে একটা কুড়ি টাকার নোট বের করে অন্দরমহলের দিকে পা বাড়ালেন। তিনি জানেন, এই ডাকের একটিই বক্তব্য, সবাই এসেছেন, কিছু ছাড়ো, চা, জলখাবারের ব্যবস্থা করি। যাঁরা এসেছেন, তাঁরাও এ ডাকের অর্থ বোঝেন, সঙ্গে–সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘পাঁচু, শুধু চা, শুধু চা, অন্য কিছু আনাতে যেও না।।’
ছেলেবেলায় বোন যখন এসে বলত, ‘দাদা বাবা তোকে ডাকছেন!’ তখন বুক কেঁপে উঠত। পিঠ প্রস্তুত, গান প্রস্তুত। ধুমধাড়াক্কা যা হয়, একটি কিছু হল বলে। ছেলেবেলায় মানুষের জীবন হল অপকর্মের অখণ্ড একটি মালা। এমন কোনও মা নেই, যাঁকে বলতে শুনিনি, ‘এই ছেলেটাই হয়েছে আমার একমাত্র জ্বালা।’ আর বাবাদের মুখে একটিই কথা, ‘এটা আর মানুষ হবে না।’ তার মানে, বেশিরভাগ মানুষের বাচ্চাই, অমানুষ হয়ে জন্মায়, তারপর তাকে নানা ভাবে, নানা কায়দায় পিটিয়ে-পিটিয়ে যা হয়, খানিকটা মানুষ করা। কেউ-কেউ মহামানব হয়ে যান, কেউ-কেউ মনুষ্য পদবাচ্য। মানুষ হওয়ার দিকের বিভিন্ন ধাপে এক-একজন উঠে সেইখানেই বাকি জীবন থেবড়ে বসে থাকে।
আমাদের সময়ে স্কুলে দারোয়ান যখন এসে বলত, ‘যাও, হেডমাস্টারমশাই তোমাকে ডাকছেন’, তখন জিভ শুকিয়ে যেত। ঢোঁক গিললে ঢোঁক ফিরে আসত। আগেই চোখে ভেসে উঠত তাঁর ঘরের ছবি। দেওয়ালে ঝুলছে বিশাল-বিশাল অয়েল পেন্টিং। স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সেকালের কোনও জমিদার। স্বদেশিযুগের নেতা। কোনও বরেণ্য পণ্ডিত। এই ধরনের অয়েল পেন্টিং চিরকালই একটু মনমরা মতো হয়। কালচে রং। অস্পষ্ট! মুখটাই কিছুটা বোঝা যায়। সে মুখ আবার বেজায় গম্ভীর। হেডমাস্টার মশাইয়ের ঘরে আনন্দের ঘটনা তো ঘটেই না। ছোট এজলাসে ধোলাইয়ের পর গুরুতর অপরাধীকে এই বড় আদালতে পাঠানো হত। দেওয়ালে স্পেশাল বেত ঝুলছে। টেবিলে নানা মাপের ডাস্টার। আঙুলের ফাঁকে ঢুকিয়ে চাপ মারার স্পেশাল পেনসিল। যে ঘরে বসে রাস্টিকেট করা হয়, দরজা বন্ধ করে ছেলেদের পাশ ফেলের দান ফেলা হয়, সেই ঘরে যাওয়ার ডাক এলে, বুকের ডানপাশ ভাতের হাঁড়ির ঢাকনার মতো লাফাতেই থাকত। আর দেওয়ালের মহাপুরুষরা উত্তর পুরুষের শোচনীয় অধ:পতন দেখতে-দেখতে ক্রমেই কালো থেকে আরও কালো হতে শুরু করতেন।
স্কুলের পর কলেজ টপকে অফিসে আসার পরও সেই একই অবস্থা। দিন বেশ যাচ্ছে, বেশ যাচ্ছে, হঠাৎ এক-একদিন বেয়ারা এসে বলে—’বড় সায়েব ডাকছেন।’ ক্ষণিকের জন্যে হৃৎপিণ্ড থেমে আবার স্টার্ট নিল। গাড়ির মতো শরীরেও ঝাঁকুনি। সারা শরীরে নেমে এল একটা অবসাদ। পূর্বের সমস্ত ঘটনা স্মৃতির পর্দায় ভেসে উঠল। বড় সায়েবের ঘর মানে ‘ড্রাইক্লিনিং লন্ড্রি’। যাও, ধোলাই হয়ে ফিরে এস। জল নেই, সাবান নেই, ইস্ত্রি নেই। ড্রাই ওয়াশ। ঢুকলে ফিটফাট, বেরোলে ফিটফাট, কেউ বুঝল—না কি হল, কিন্তু হয়ে গেল। মন মরার ঘর। মানুষের পোশাকের তলায় তার নিজস্ব একটা পোশাক থাকে, যে পোশাক তৈরি হয় তার আদর্শ আর বংশমর্যাদার কাপড়ে, যে পোশাকের ‘কাটার’ হল তার অহঙ্কার, সেলাইয়ের সুতো হল তার আত্মবিশ্বাস। বড় সায়েবের ঘরে সেই অন্তরঙ্গ পোশাকটাই একটু-একটু করে খুলে নেবার চেষ্টা হয়। এ ডাকের অর্থই হল, যাও, একটু ছিন্নভিন্ন হয়ে এস। আর ওই ঘর থেকে বেরিয়ে আসার পরেই যখন রিসেপসানিস্ট টেলিফোনে ডেকে বলেন, ‘আপনার স্ত্রী ও ছেলে এসেছেন’, তখন ভেতরে একটা লড়াই শুরু হয়ে যায়। একটা ফাঁকা মানুষ ভেতরে হাহা করে হেসে ওঠে। দেহ ঘট, মুখে আঁকা হাসি নিয়ে এগিয়ে যায়। কেউ ধরতেই পারে না, ক্রমশই উলটে-উলটে ঘটের ভেতরের আত্মসম্মানের সব জলই প্রায় ঢেলে নিয়েছে। রুমালে মুখ ঘষছি। রুমাল মুখের ময়লা পরিষ্কার করতে পারে, ভেতরের কালি মুছে নেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। স্ত্রী যখন তার বান্ধবীর সঙ্গে সগর্বে পরিচয় করিয়ে দিতে থাকে, আর শিশুটি যখন হাসি-হাসি মুখে তাকিয়ে মনে-মনে ভাবতে থাকে, আমার বাবা কত বড়, তখন নিজেকে মনে হয় জোচ্চর।
যখন প্রতিবেশী এসে ডেকে বলে, ‘আমাদের লাইনে আপনার একটা কল এসেছে।’ তখন যেতে-যেতে পা কাঁপে। পরিচিতির বিশাল আকাশে খুঁজতে থাকি অসুস্থ মুখ। কেউ কি চিরতরে ঝরে পড়লেন। হঠাৎ মনে হয়, ছেলেটা এখনও ফেরেনি। এই ডাকে কি সেই খবর— সে আর ফিরবে না?
মনে পড়ে সেই ডাক, বসে আছে একঘর যুবক, মাথা নীচু করে। সামনে বন্ধ একটা ঘর। বাইরে একজন, তাঁর হাতে একটা কাগজ, পরপর নাম ধরে ডাকছেন। হঠাৎ ডাকলেন আমার নাম। চমকে উঠলুম। মুহূর্তে সমস্ত চিন্তাভাবনা স্তব্ধ হয়ে গেল। খুলে গেল বন্ধ দরজা। বিশাল টেবিল চারজন জল্লাদের মতো মানুষ। পণ করে বসে আছেন, ওরা একটা চাকরি চায়, আমরা কিছুতেই দেব না।
আর সেই ডাক—গভীর রাতে আমার বন্ধ দরজায় দুর্বল একটি হাতের আঘাত, ক্ষীণ কণ্ঠস্বর, ‘খোকা, খোকা।’ অসুস্থ মা কোনওক্রমে উঠে এসেছেন। তাঁর মাথার শিয়রে জাগার কথা ছিল, শুয়ে আছি ভোগশয্যায়। মা বলছেন, ‘আমাকে বোধহয় যেতেই হচ্ছে, খোকা। আমার ডাক এসেছে রে! আমার পায়ে চটি, সেই চটিটা খুলে মুখে মারার মতো কেউ ছিল না।
ওই ‘খোকা’ ডাকটাই বড় স্নেহের, বড় সত্য। ভেসে আসবে মহাসিন্ধুর ওপার হতে। দুটি মাত্র ডাক। মায়ের ডাকে আসা, মহামায়ের ডাকে যাওয়া।