ডাক চোর (পোষ্ট-আফিসের ডাকপত্র ও মণি-অর্ডারাদি হরণ-রহস্য!)
প্রথম পরিচ্ছেদ
ইংরাজী ১৮৮৩ খৃষ্টাব্দের মে মাসে একদিবস দিবা দুইটার সময় সংবাদ পাইলাম, অনেক টাকাকড়ি লইয়া একটি পোষ্ট আফিসের একজন ডাকপিয়ন পলায়ন করিয়াছে। সংবাদ পাইয়া আমি সেই ডাকঘরে গমন করিলাম; দেখিলাম, পোষ্টমাষ্টার নিতান্ত বিষণ্ণবদনে বসিয়া রহিয়াছেন। তিনি আমাকে চিনিতেন না, তাঁহার নিকট আমার পরিচয় প্রদান করিলে, তিনি বসিবার নিমিত্ত তাঁহার নিকট একখানি আসন প্রদান করিলেন। আমি সেইস্থানে উপবেশন করিয়া তাঁহাকে জিজাসা করিলাম, “আপনার পিয়ন কিরূপে ও কত মূল্যের দ্রব্যাদি লইয়া পলায়ন করিয়াছে?”
উত্তরে পোষ্টমাষ্টার কহিলেন, “কত মূল্যের দ্রব্যাদি লইয়া যে পলায়ন করিয়াছে, তাহা এখন স্থির করা নিতান্ত অসম্ভব। আমাদিগের নিয়মানুযায়ী ডাক আসিলে, উহার ভিতর রেজেষ্টারী চিঠি, মণিঅর্ডার, পার্শেল প্রভৃতি যে সকল দ্রব্যাদি থাকে, তাহার সমস্তই বিলি করিবার নিমিত্ত পিয়নদিগকে দেওয়া হয়। যে পিয়নের যতদূর এলাকা, সেই এলাকার মধ্যে বিলি করিবার নিমিত্ত যাহা কিছু থাকে, তাহা সেই পিয়নকেই দেওয়া হয়। যে পিয়ন আজ পলায়ন করিয়াছে, তাহার নাম রামচরিত্র তেওয়ারি। রামচরিত্রের এলাকা বড়বাজারের ভিতরস্থিত একটি অংশ, কাট্রা প্রভৃতিও তাহার এলাকার ভিতর। তাহার এলাকার সে সকল চিঠিপত্র ছিল, তাহা সমস্তই লইয়া দিবা দশটার সময় সে এখান হইতে বহির্গত হয়। সে যে সকল পত্রাদি লইয়া যায়, তাহার ভিতর ন্যূনাধিক একশতখানি রেজেষ্টারীপত্র ছিল, এবং ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির নামীয় প্রায় দুই সহস্রমুদ্রার মণিঅর্ডার ছিল। ইহা ব্যতীত পত্র যে কত ছিল, তাহার কিছুমাত্র হিসাব নাই। দিবা বারটার মধ্যে তাহার প্রত্যাগমন করা উচিত; কিন্তু, যখন বারটা বাজিয়া গেল, এক এক করিয়া অপরাপর পিয়নগণ সকলে প্রত্যাবর্তন করিল, সে প্রত্যাগত হইল না, তখন ক্রমেই আমার মনে সন্দেহ হইতে লাগিল। ক্রমে সাড়ে বারটা বাজিয়া গেল; তথাপি সে প্রত্যাগমন করিল না। একটা বাজিল, তথাপি তাহার কোন সংবাদ নাই। কাজেই তখন এ সংবাদ আমার ঊর্ধ্বতন কর্ম্মচারীর নিকট প্রেরণ করিলাম। এখন প্রায় তিনটা বাজিবে, তথাপি রামচরিত্রের কোন সন্ধান নাই; এরূপ অবস্থায় বলুন দেখি মহাশয়! রামচরিত্রের পলায়ন ব্যতীত আর কি হইতে পারে? মনিঅর্ডারের টাকা দেওয়ার নিমিত্ত তাহার নিকট নগদ দুই সহস্ৰমুদ্রা ছিল, ইহা ব্যতীত একশত রেজেষ্টারী চিঠির ভিতর যে কত টাকা আছে, তাহা কেমন করিয়া বলিতে পারি?”
আমি। সে ত হঠাৎ কোনরূপ রোগাক্রান্ত হয় নাই?
পোষ্টমাষ্টার। যদি সে কোনরূপে রোগগ্রস্ত হইয়া এখানে আসিতে অসমর্থ হইত, তাহা হইলে কোন না কোন ব্যক্তির দ্বারা সে নিশ্চয়ই সংবাদ প্রদান করিত। অথবা রাস্তাঘাটে যদি পড়িয়া থাকিত, তাহা হইলে সে সংবাদ কাহারও না কাহার নিকট হইতে অবগত হইতে পারিতাম।
আমি। রামচরিত্রের বাসা কোথায়, তাহা কেহ জানে কি?
পোষ্টমাষ্টার। অনেকেই তাহার বাসা জানে। তাঁহার বাসায় আমি লোক পাঠাইয়া ছিলাম, বাসায় কেহই তাহার সংবাদ বলিতে পারে না; সে বাসায় যায় নাই।
পোষ্টমাষ্টারের সহিত যখন আমার এইরূপ কথাবার্ত্তা হইতেছিল, সেই সময় আরও কয়েকজন পুলিস-কৰ্ম্মচারী এবং দুইজন ঊর্ধ্বতন কর্ম্মচারী গিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হইলেন। পুলিস-কর্মচারীগণের মধ্যে আমার অপেক্ষা নিম্নপদের কর্ম্মচারীই অধিক, কিন্তু ঊর্দ্ধপদেরও দুইজন ছিলেন। তাঁহাদিগের মধ্যে একজন ইংরাজ ও একজন মুসলমান।
পোষ্টমাষ্টারের নিকট হইতে আমি যে সকল বিষয় অবগত হইয়াছিলাম, তাহার সমস্তই তাঁহাদিগের নিকট কহিলাম। আমার কথা শুনিবামাত্র ঊর্ধ্বতন ইংরাজ-কর্মচারী নিম্ন কর্মচারীগণের মধ্যে কয়েকজনকে ডাকিলেন, এবং তাহাদিগের মধ্যে একজনকে হাবড়া ষ্টেশনে, একজনকে শিয়ালদহ ষ্টেশনে, দুইজনকে গঙ্গার ঘাটে প্রেরণ করিলেন; রামচরিত্রকে যাহারা চেনে, এরূপ এক একজন লোক প্রত্যেক কর্মচারীর সহিত গমন করিল। মুসলমান কর্ম্মচারী রামচরিত্রের অবয়ব-আকৃতি প্রভৃতি উত্তমরূপে লিখিয়া লইয়া স্থানে স্থানে টেলিগ্রাফ করিবার নিমিত্ত, টেলিগ্রাফ আফিসে গমন করিলেন। এখন কলিকাতার ভিতর প্রায় প্রত্যেক পোষ্ট-আফিসেই টেলিগ্রাফ আফিস স্থাপিত হইয়াছে, কিন্তু আমি যে সময়ের কথা বলিতেছি, তখন সে পদ্ধতি প্রচলিত ছিল না। যাহা হউক, এইরূপে কর্ম্মচারীগণ স্থানে স্থানে প্রেরিত হইলে আমি পুনরায় পোষ্টমাষ্টারকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “রামচরিত্র কতদিবস পর্য্যন্ত এই কার্য্য করিতেছে?” পোষ্টমাষ্টার। সে বহুদিবসের পিয়ন। আমার বোধ হয়, তাহার চাকরি কুড়ি বৎসরের কম হইবে না।
আমি। যে ‘বিটে’ সে এখন পত্র বিলি করিতেছে, কতদিবস হইতে সে এই বিটে আছে?
পোষ্টমাষ্টার। বোধ হয় পাঁচ সাত বৎসরের কম হইবে না।
আমি। আজ যে পরিমাণ টাকা, এবং রেজেষ্টারীপত্র বিলি করিবার নিমিত্ত তাহাকে দেওয়া হইয়াছিল, এত টাকা বা রেজেষ্টারীপত্র লইয়া, সে ইতিপূর্ব্বে আর কখনও বিলি করিয়াছে?
পোষ্টমাষ্টার। আজ যে পরিমাণ টাকা লইয়া সে পলায়ন করিয়াছে, ইহা অপেক্ষা অনেক অধিক টাকা, এবং রেজেষ্টারীপত্র, সে অনেক দিবস বিলি করিয়াছে। পূর্ব্বে যদি মনে করিত, তাহা হইলে ইহা অপেক্ষা অনেক অধিক অর্থ লইয়া সে প্রস্থান করিতে পারিত।
আমি। সে যতদিন এখানে কর্ম্ম করিতেছে, তাহার মধ্যে আপনি কখনও তাহার কোন দোষ দেখিতে পাইয়াছেন?
পোষ্টমাষ্টার। আমি কখনও তাহার কোন দোষ পাই নাই। সে অন্যান্য সকল পিয়ন অপেক্ষা পরিশ্রমী, এবং বিশ্বাসী বলিয়া আমার বোধ ছিল। কিন্তু এখন দেখিতেছি, বরাবরই আমি ভ্রম-বিশ্বাসকে মনে স্থান দিয়া আসিয়াছি।
আমি। সে কোন দেশের লোক, আপনি জানেন কি?
পোষ্টমাষ্টার। তাহার বাসস্থান বেলিয়া জেলায়, কিন্তু আমি কখনও তাহাকে তাহার দেশে যাইতে দেখি নাই! বহুদিবস হইতে স্ত্রীপুত্র লইয়া, সে এইস্থানে বাস করিতেছে।
আমি। রামচরিত্রের আচার ব্যবহার, স্বভাব চরিত্র প্রভৃতি আপনি যতদূর অবগত আছেন, তাহাতে আপনার কি অনুমান হইতেছে, যে, সে সরকারী টাকা সহ পলায়ন করিয়াছে? কি, কোনরূপ বিপদ্গ্রস্ত হইয়া, এ পর্য্যন্ত ফিরিয়া আসিতে পারে নাই?
পোষ্টমাষ্টার। এতদিবস পর্য্যন্ত যেরূপ বিশ্বাসের সহিত সে কার্য্য করিয়া আসিতেছিল, তাহাতে যে সে পলায়ন করিয়াছে, একথা সহসা বিশ্বাস করিতে পারা যায় না। কিন্তু সমস্ত দিবসের মধ্যে যখন সে প্রত্যাগমন করিল না, বা কোনরূপে তাহার সংবাদ পাইলাম না, তখন সে যে অবিশ্বাসের কার্য্য করিয়া পলায়ন করিয়াছে, এই ভিন্ন আর কি অনুমান করা যাইতে পারে?
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
পোষ্টমাষ্টারের সহিত আমার যে সকল কথাবার্তা হইল, তাহাতে আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, পোষ্টমাষ্টার, এবং অপরাপর সকলেরই বিশ্বাস—রামচরিত্র সরকারী টাকা লইয়া প্রস্থান করিয়াছে। কিন্তু জানি না, কেন আমার মন সেদিকে ধাবিত হইল না। আমাকে যেন কে বলিয়া দিল, হয় রামচরিত্র পীড়িত অবস্থায় কোনস্থানে পড়িয়া আছে, না হয়, এমত কোনরূপ বিপদগ্রস্ত হইয়াছে যে, নিজে আগমন করিতে, বা অপরের দ্বারা কোনরূপে সংবাদ পাঠাইবার কোন প্রকারে সুযোগ করিয়া উঠিতে পারিতেছে না। এই ভাবিয়া আমি পুনরায় পোষ্টমাষ্টারকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “পত্রাদি বিলি করিবার নিমিত্ত পোষ্ট-আফিস হইতে বহির্গত হইয়া কোন্ পথ অবলম্বন করিয়া সে কোনদিকে গমন করিত, তাহা আপনি বলিতে পারেন কি? আমি জানি, প্রত্যেক পিয়নই আপন-আপন সুবিধার নিমিত্ত একদিক্ দিয়া পত্র বিলি করিতে করিতে গমন করে, ও সেইরূপে অপরদিক্ দিয়া প্রত্যাগমন করে। আর ইহাও আমি অনেক সময় দেখিয়াছি, যে পিয়নগণ সহজে তাহাদিগের পথ পরিবর্তন করিতে চাহে না; তাহারা যে পথ প্রথমে অবলম্বন করে, চিরকালই তাহারা সেই পথে প্রথম হইতে আরম্ভ করিয়া ক্রমে পত্রাদি বিলি করিতে করিতে অগ্রবর্তী হয়। এইরূপ উপায় অবলম্বন করিলে পত্র বিলি করার পক্ষে তাহাদিগের অনেক সুবিধা হয় বলিয়াই, তাহারা এই নিয়মের অনুসরণ করিয়া থাকে।”
পোষ্টমাষ্টার। সে যে কোন্ পথ হইতে বিলি আরম্ভ করিয়া কোনদিকে গমন করিত, তাহা আমি ত জানি না এবং অপরাপর কর্ম্মচারীগণও জানে বলিয়া আমার বিশ্বাস হয় না। কারণ, যতদিবস সে পত্রাদি বিলি করিতেছে, তাহার মধ্যে কোন ব্যক্তিরই তাহার সহিত গমন করার প্রয়োজন হয় নাই। সুতরাং তাহার গমনের পথ ঠিক্ যে কেহ বলিতে পারিবে, তাহা আমার বোধ হয় না।
আমি। আপনি কহিলেন না যে, প্রায় সাত বৎসর হইতে সে এই বিটে পত্রাদি বিলি করিতেছে?
পোষ্টমাষ্টার। হাঁ, পাঁচ সাত বৎসর হইতে সে এই বিটেই আছে।
আমি। ইহার মধ্যে সে কখনও ছুটি গ্রহণ করে নাই?
পোষ্টমাষ্টার। তাহার স্ত্রীপুত্র এইস্থানে আছে, সে দেশে গমন করে নাই; সুতরাং, তাহার কখনও ছুটি লইবার প্রয়োজন হয় নাই।
আমি। সে দেশে না যাউক, বা অধিক দিবসের ছুটি গ্রহণ না করুক, তাহার নিজের কোন কাৰ্য্যবশতঃ অথবা অসুস্থতা নিবন্ধন সে দুই চারি দিবসের ছুটিও কখন গ্রহণ করে নাই?
পোষ্টমাষ্টার। তাহার মাতৃবিয়োগ হইলে আমার বোধ হয়, সে সাতদিবসের ছুটি লইয়াছিল। কিন্তু মহাশয়! আমি একটি কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতে চাই, যদি রাগ না করেন।
আমি। রাগ করিবার কোন কারণ নাই। আপনার যাহা ইচ্ছা হয়, তাহা আমাকে অনায়াসে জিজ্ঞাসা করিতে পারেন?
পোষ্টমাষ্টার। আপনি যে বিষয়ের অনুসন্ধান করিতে এখানে আগমন করিয়াছেন, তাহা না করিয়া বাজে কথায় মিথ্যা সময় নষ্ট করিতেছেন কেন? যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি আমাকে লইয়া নানাকথা জিজ্ঞাসাবাদ করিতেছেন, ততক্ষণ যদি পলায়িত পিয়নের অনুসন্ধান করিতেন, তাহা হইলে বোধ হয়, কোন সংবাদ পাইলেও পাইতে পারিতেন।
আমি। আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা নূতন কথা নহে, একথা আমাকে মধ্যে মধ্যে প্রায়ই শুনিতে হয়। বিশেষ যখন এইরূপ গোলযোগের অনুসন্ধান আসিয়া উপস্থিত হয়, তখন অনেক স্থানে এইরূপ কথামাত্রই যে আমাদিগকে শুনিতে হয়, তাহা নহে; মধ্যে মধ্যে কটুকাটব্যের দুই একটি মধুরধ্বনিও দূর হইতে আমাদের কর্ণে প্রবেশ করে। আপনি একজন পুরাতন কর্মচারী; এই কার্য্য করিতে করিতে আপনার কেশ শুক্লবর্ণ ধারণ করিয়াছে, একার্য্যে আপনার উত্তম ব্যুৎপত্তি জন্মিয়াছে। সুতরাং আপনাদিগের কার্য্য যত সহজে আপনি বুঝিতে পারেন, আমরা কি তাহা সেরূপ পারি? পূর্ব্বে যে বিষয় কখনও দেখি নাই, যাহা কখনও উত্তমরূপে শ্রবণও করি নাই, তাহা সহজে বোধগম্য হওয়া সহজ নহে। তবে আমরা যে কার্য্য উপলক্ষ করিয়া দিন অতিবাহিত করিতেছি, যে কার্য্যে দিন ব্যাপৃত হইতেছে, তাহা সম্পূর্ণ বুঝিতে না পারিলেও, সে আপনাদিগের অপেক্ষা বুঝিব, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। আমি বিনা-উদ্দেশ্যে আপনাকে যে এই সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি, তাহা ভাবিবেন না। যে সকল কথা শুনিয়া আপনি চিন্তা করিতেছেন—ইহার কোন উদ্দেশ্য নাই, জানিবেন—বিনা উদ্দেশ্যে সেই সকল কথা আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি না। সে যাহা হউক, আপনি কহিলেন, পূর্ব্বে একবার সে সাতদিবসের অবকাশ গ্রহণ করিয়াছিল। তাহার পরিবর্ত্তে সেই সময়ে যে কার্য্য করিয়াছিল, তাহার নাম আপনার মনে হয় কি?
পোষ্টমাষ্টার। হাঁ মনে হয়, অপর আর একজন পিয়ন সেই কয়েক দিবস তাহার কর্ম্ম করিয়াছিল, তাহার নাম বালকরাম।
আমি। বালকরাম এখন কোন্ পোষ্ট-আফিসে আছে?
পোষ্টমাষ্টার। এইস্থানেই কর্ম্ম করিতেছে।
আমি। তাহাকে একবার ডাকাইতে পারেন?
পোষ্টমাষ্টার। পারি।
এই বলিয়া বালকরামকে ডাকিবার নিমিত্ত অপর আর একজন পিয়নকে প্রেরণ করিলেন।
আমি। যে সকল পত্র বিলি করিবার নিমিত্ত পিয়নদিগকে দেওয়া হয়, বোধ হয়, তাহার কোন হিসাব আপনাদের নিকট থাকে না?
পোষ্টমাষ্টার। না।
আমি। একটি পত্র যে সকল রেজেষ্টারীপত্র, এবং মণিঅর্ডার আজ রামচরিত্রকে দেওয়া হইয়াছে, তাহা বোধ হয়, আপনাদিগের খাতায় লেখা আছে?
পোষ্টমাষ্টার। আছে।
আমি। কোন্ ঠিকানায়, এবং কাহার নামে ঐ সকল বিলি হইবে, তাহা পুস্তক দেখিয়া বোধ হয়, আপনি বলিতে পারিবেন?
পোষ্টমাষ্টার। তাহা পারিব।
আমি। অনুগ্রহ পূৰ্ব্বক যত শীঘ্র পারেন, তাহার একটি তালিকা প্রস্তুত করিয়া আমাকে দিউন। যে সকল ব্যক্তি উহা প্রাপ্ত হইবে, তাহাদের নাম এবং ঠিকানা পাইলেই আমার উদ্দেশ্য সফল হইবে।
পোষ্টমাষ্টারের আদেশ মত একজন কর্মচারী আমার প্রস্তাবিত একটি তালিকা প্রস্তুত করিয়া দিল। এদিকে বালকরামও আসিয়া উপস্থিত হইল।
বালকরাম আমার নিকট আগমন করিলে, আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “রামচরিত্র তেওয়ারি যে বিটে এখন পত্রাদি বিলি করিয়া থাকে, সেই বিটে তুমি কখনও পত্রাদি বিলি করিয়াছিলে কি?”
বালকরাম। হাঁ মহাশয়! করিয়াছিলাম। এক সময়ে রামচরিত্র সাতদিবসের ছুটি লয়, সেই সাতদিবস আমিই তাহার বিটে পত্রাদি বিলি করি।
আমি। তুমি তাহার এই বিটের পথ প্রথমে কিরূপে চিনিতে পারিয়াছিলে?
বালকরাম। রামচরিত্র ছুটি লইয়া যাইবার একদিবস পূর্ব্বে আমাকে সঙ্গে করিয়া, তাহার বিটে লইয়া যায়। সে নিয়মিতরূপে তাহার পত্রাদি বিলি করিতে করিতে গমন করে, আমিও তাহার সঙ্গে সঙ্গে যাই; সুতরাং তাহার বিটের সকল স্থান আমি জানিতে পারি। পরদিবস হইতে যখন আমাকে পত্রাদি বিলি করিতে হয়, তখন আমিও রামচরিত্রের অনুকরণে পত্রাদি বিলি করি।
আমি। তুমি যে স্থান হইতে প্রথম আরম্ভ করিয়া পত্রাদি বিলি করিয়াছিলে, তাহা এখন তোমার মনে আছে কি? তুমি আমাকে এখন সেই পথ দেখাইয়া দিতে সমর্থ হইবে কি?
বালকরাম। হাঁ মহাশয়! আমার বেশ মনে আছে, আপনি আমার সহিত আগমন করুন, যে স্থান হইতে পত্র বিলি আরম্ভ করিয়া যে স্থানে আসিয়া শেষ করিয়াছি, তাহা এখনই আমি আপনাকে দেখাইয়া দিতেছি।
বালকরামের কথা শুনিয়া ভাবিলাম যে বিষয় জানিবার নিমিত্ত আমার এতদূর ইচ্ছা হইয়াছিল, তাহা দেখিতেছি, বালকরামের দ্বারাই সম্পন্ন হইবে, এবং এই পথ অবলম্বনে আমার মনোবাঞ্ছা সম্পূর্ণরূপে সিদ্ধ না হইলেও, যে কতক পরিমাণে সুসিদ্ধ হইবে, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।
এই ভাবিয়া বালকরাম, এবং পোষ্টমাষ্টার-প্রদত্ত সেই তালিকাটি, সঙ্গে লইয়া আমি পোষ্ট-আফিস পরিত্যাগ করিলাম।
আমি এই পন্থা অবলম্বনে কিরূপে অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হই, তাহা দেখিবার নিমিত্ত পোষ্টমাষ্টারবাবু আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ অপর আর একজন পোষ্ট-আফিস কর্মচারীকে প্রেরণ করিলেন। এই ব্যক্তি যে আমার সাহায্যের নিমিত্ত প্রেরিত হইল, তাহা নহে। পলাতকের অনুসন্ধান না করিয়া আমি যে কেন বিপথে গমন করিতেছি, তাহাই দেখিবার নিমিত্ত এই ব্যক্তি আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ প্রেরিত হইল।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
বালকরাম আমাকে সঙ্গে লইয়া কটন ষ্ট্রীটের ভিতর প্রবেশ করিল, ও বরাবর কটন ষ্ট্রীট দিয়া, ক্রমে পগেয়া পটীতে গিয়া উপনীত হইল। এই পগেয়াপটী হইতেই রামচরিত্রের বিট আরম্ভ হইয়াছে। পগেয়াপটীর মোড়ে দাঁড়াইয়া বালকরাম কহিল, “এইস্থান হইতে আরম্ভ করিয়া পত্রাদি বিলি করিতে রামচরিত্র আমাকে দেখাইয়া দেয়।” বালকরামের কথা শুনিয়া আমি তাহাকে কহিলাম, এইস্থান হইতে আরম্ভ করিয়া যে যে স্থানে তুমি পত্র বিলি করিয়াছিলে, সেইস্থান দিয়া তুমি আস্তে আস্তে গমন করিতে থাক, আমিও তোমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হই।
বালকরামকে এই কথা বলিয়া পোষ্টমাষ্টার প্রদত্ত সেই রেজেষ্টারী পত্রের এবং মনিঅর্ডারের তালিকা আমার পকেট হইতে বাহির করিয়া হস্তে লইলাম, ও ক্রমে বালকরামের অনুসরণে প্রবৃত্ত হইলাম। বালকরাম ক্রমে কাট্টার দ্বারে গিয়া উপস্থিত হইল। পগেয়া পটীর মোড় এবং কাট্টা এই উভয়ের মধ্যস্থিত স্থানের ভিতর দেখিলাম, পাঁচখানি রেজেষ্টারীপত্র এবং দুইখানি মনিঅর্ডার বিলি হওয়া আবশ্যক। এক এক করিয়া আমি সেই সাতজনের নিকটেই গমন করিলাম। তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করায় জানিতে পারিলাম, রামচরিত্র পিয়ন দিবা দশটার পরই সেই সকল স্থানে গমন করিয়া তাহাদিগের পত্র, রেজেষ্টারীপত্র, এবং মণিঅর্ডার প্রভৃতি যাহা কিছু ছিল, তাহা প্রদান করিয়া কাট্টা অভিমুখে গমন করিয়াছে।
দোকানদারগণের নিকট হইতে এই সকল কথা জানিতে পারিয়া, আমিও কাটরার ভিতর প্রবেশ করিলাম। আমার হস্তস্থিত তালিকা দেখিয়া বুঝিলাম, কাট্টার ভিতরের জন্য আট দশখানি রেজেষ্টারীপত্র, এবং পাঁচ সাতখানি মণিঅর্ডার রামচরিত্রের নিকট ছিল। তাহার মধ্যে একখানি তৃতীয় তালাস্থিত এক ব্যক্তির, অপর সমস্তগুলিই দ্বিতীয় তালা-বাসী দোকানদারবর্গের।
এক এক করিয়া দোতালার প্রত্যেক দোকানদারের নিকট গমন করিলাম। তাঁহারা সকলেই কহিলেন, রামচরিত্র তাঁহাদিগের নিকট সমস্ত পত্রাদি নিয়মিতরূপে বিলি করিয়া চলিয়া গিয়াছে।
এই সকল অবস্থা জানিতে পারিয়া ভাবিলাম, পোষ্টমাষ্টারবাবু রামচরিত্রের উপর যে অভিযোগ করিতেছেন, তাহা প্রকৃত নহে। যখন দেখিতেছি—সে রেজেষ্টারীপত্র, এবং মণিঅর্ডার প্রভৃতি নিয়মিতরূপে বিলি করিয়াছে, তখন সে পলায়ন করিবে কেন? কোন কার্য্যবশতই হউক, বা অসুস্থতা নিবন্ধনই হউক, সে প্রত্যাগমন করিতে পারে নাই মাত্র; সময়মত আসিয়া উপস্থিত হইবে। মনে এইরূপ চিন্তার উদয় হওয়ায় একবার ভাবিলাম, এখন এ অনুসন্ধান পরিত্যাগ করাই কর্তব্য। কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে হইল, যে পন্থা অবলম্বনে অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়াছি, তাহার শেষ করাই উচিত। কারণ, এইরূপে যদি জানিতে পারি, সমস্ত পত্রাদি রামচরিত্র বিলি করিয়াছে, তাহা হইলে তাহার উপর আর কোন সন্দেহই রহিবে না। আমরাও নিঃসন্দেহে তখন এই অনুসন্ধান করিয়া স্বস্থানে প্রস্থান করিতে সমর্থ হইব; এই ভাবিয়া সেই কাট্রার তৃতীয় তালার উপর উঠিলাম। সেইস্থানে গঙ্গাবিষণের নামে একখানি রেজেষ্টারীপত্র ছিল। গঙ্গাবিষণ যে গৃহে থাকে, দেখিলাম—সেই গৃহের তালা বাহির হইতে বন্ধ; বুঝিলাম, গঙ্গাবিষণ কোন কার্য্যোপলক্ষে বাহির হইয়া গিয়াছে।
গঙ্গাবিষণের সহিত সাক্ষাৎ না হওয়ায় জানিতে পারিলাম না যে, তিনি তাঁহার রেজেষ্টারীপত্র পাইয়াছেন কিনা। গঙ্গাবিষণ কোন্ সময়ে প্রত্যাগমন করিবে, তাহা কাহারও নিকট জানিতে না পারিয়া, আমরা সেইস্থান পরিত্যাগ পূর্ব্বক অপর যে সকল স্থানের পত্রাদি রামচরিত্রের নিকট ছিল, একে একে সেই সকল স্থানে ক্রমশঃ গমন করিতে লাগিলাম। কিন্তু যাঁহারই নিকট গমন করিলাম, তিনিই কহিলেন, অদ্য তাঁহার নিকট কোন পিয়ন গমন করে নাই এবং কেহই কোন পত্রাদি বা মণিঅর্ডার প্রভৃতি কিছুই প্রাপ্ত হয়েন নাই।
এইস্থান হইতে দেখিলাম, অনুসন্ধানের আর এক নূতন অধ্যায় আরম্ভ হইল। ইতিপূর্ব্বে আমার মনে যে চিন্তা আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল, এখন দেখিলাম, সেই চিন্তার পরিবর্তে অপর চিন্তা আমার হৃদয় অধিকার করিল। এখন বুঝিতে পারিলাম, রামচরিত্র তাহার নিকটস্থিত সমস্ত চিঠিপত্র বিলি করে নাই। সেইস্থান হইতে যতই অগ্রবর্ত্তী হইতে লাগিলাম, সেই সন্দেহ মনোমধ্যে ততই দৃঢ় হইতে লাগিল। দেখিলাম, কাট্রার পর কোনস্থানে রামচরিত্র সেইদিবস গমন করে নাই, বা অপর কেহই তাহার নিকট হইতে সেইদিবস পত্রাদি প্রাপ্ত হয়েন নাই।
এই সকল অবস্থা দেখিয়া চিন্তিতান্তঃকরণে আমি পুনরায় পোষ্ট-আফিসে প্রত্যাগমন করিলাম। আমার অনুসন্ধানের পন্থা অবলম্বনে পোষ্টমাষ্টার প্রভৃতি সেইস্থানের কর্ম্মচারীগণ সকলেই হাস্য করিলেন, ও পরিশেষে পোষ্টমাষ্টার কহিলেন, ‘কেমন মহাশয়! এখন আপনি সন্তুষ্ট হইলেন ত? রামচরিত্র যে টাকাকড়ি লইয়া প্রস্থান করিয়াছে, একথা এখন আপনার বিশ্বাস হইল ত? দেখুন দেখি মহাশয়! পূর্ব্বে যদি আপনি আমার কথায় বিশ্বাস করিয়া রামচরিত্রের অনুসন্ধানে লিপ্ত হইতেন, তাহা হইলে এ সময়টা মিথ্যা নষ্ট হইত না। যাহা হউক, যে সময় নষ্ট হইয়া গিয়াছে, তাহা আর পাওয়া যাইবে না; অতঃপর আপনি রামচরিত্রের অনুসন্ধানে লিপ্ত হউন। দেখুন, এখনও যদি তাহার কোনরূপ সন্ধান করিতে সমর্থ হন।”
পোষ্টমাষ্টারবাবুর কথা শুনিয়া মনে মনে আমার একটু ক্রোধের উদয় হইল; কিন্তু মনের ভাব মনেই গুপ্ত রাখিয়া তাঁহার কথার কোনরূপ উত্তর না দিয়া, সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম। যাইবার সময় পোষ্টমাষ্টারবাবুকে কেবল এইমাত্র বলিয়া গেলাম, “আপনি যাহা বলিতেছেন, এখন হইতে তাহাই হইবে, আপনার পরামর্শমত এখন রামচরিত্রের অনুসন্ধানে আমি লিপ্ত হইলাম। যদি কোন সন্ধান পাই, তাহা হইলে আপনাকে সংবাদ প্রদান করিব।”
যখন আমি পোষ্ট-আফিস হইতে বহির্গত হইলাম, তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। রামচরিত্র সম্বন্ধে আর কোনরূপ অনুসন্ধান না করিয়া, আমি আমার বাসায় প্রত্যাগমন করিলাম। ভাবিলাম, পরদিবস প্রাতঃকাল হইতে রামচরিত্রের অনুসন্ধানে লিপ্ত হইব, রাত্রিকালে আর কোনস্থানে গমন করিব না।
বাসায় আসিয়া নিয়মিতরূপ আহারাদি করিয়া শয়ন করিলাম, কিন্তু কোন প্রকারেই নিদ্রা আসিল না। রামচরিত্র—সম্বন্ধীয় নানাপ্রকার চিত্তা সমস্ত রাত্রি আমাকে তাস্থির করিল। কোন পন্থা অবলম্বন করিলে রামচরিত্রের সন্ধান পাইতে পাইব, তাহার আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব বা অন্য কোন ব্যক্তিদ্বারা জানিতে পারিব যে, রামচরিত্র কোথায়? এইরূপ নানাপ্রকার চিন্তা করিতে করিতে সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত করিলাম; কিন্তু অনেক চিন্তার পর মনে মনে ইহাও স্থির করিলাম যে, অতি প্রাতঃকালে পুনরায় আর একবার কাট্টায় গমন করিব, সেইস্থানে গঙ্গাবিষণের সহিত সাক্ষাৎ করিব। তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইলেই জানিতে পারিব, রামচরিত্র তাঁহার রেজেষ্টারীপত্র বিলি করিয়াছে, কি না। আর যদি তিনি আপনার পত্রাদি পাইয়া থাকেন, তাহা হইলে হয় ত বলিলেও বলিতে পারিবেন যে, তাঁহাকে পত্রাদি দিয়া পিয়ন কোনদিকে গমন করিয়াছে। আর যদি পিয়ন তাঁহাকে পত্রাদি না দিয়া থাকে, তাহা হইলে বুঝিব, রামচরিত্র ইহার টাকাও আত্মসাৎ করিয়াছে।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
পরদিবস অতি প্রত্যূষে শয্যা হইতে গাত্রোত্থান করিয়াই, প্রথমে কাট্টা-অভিমুখে গমন করিলাম। সেইস্থানে কাহাকেও কিছু না বলিয়া ক্রমে কাট্টার উপরে উঠিলাম। তৃতীয় তালায় গমন করিয়া দেখিলাম, গঙ্গাবিষণ গৃহে নাই, গৃহের তালা পূর্ব্বমতই বন্ধ আছে। এই অবস্থা দেখিয়া ভাবিলাম, গঙ্গাবিষণ কেবলমাত্র নামে এই বাসায় থাকেন; কাজে বোধ হয়, তাঁহার থাকিবার অন্য কোনস্থান আছে। অথবা এই কলিকাতা সহরের অনেক বাবুর ন্যায় ইঁহারও অবস্থা, অর্থাৎ কোন কুহকিনীর কুহকে অথবা তাহার মায়ায় মুগ্ধ হইয়াছেন, ও তাহারই গৃহেবাস করিয়া থাকেন। এই ভাবিয়া সে সময় সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম।
দিবা নয়টার সময় পুনরায় আর একবার সেইস্থানে গমন করিলাম, দেখিলাম, গৃহের অবস্থা পূর্ব্বের ন্যায়ই রহিয়াছে। সেই সময়ে সেস্থানে অপরাপর যে সকল ব্যক্তিকে দেখিতে পাইলাম, তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়াও গঙ্গাবিষণের কোন সন্ধান পাইলাম না। কোন কোন ব্যক্তি কহিল, “অল্পদিবস হইতে গঙ্গাবিষণ নামক এক ব্যক্তি এই ঘর ভাড়া করিয়াছেন; কিন্তু, তিনি সকল সময়ে এইস্থানে থাকেন না, বা এস্থানে তাঁহার কোন কার কারবারও দেখিতে পাই না। তাঁহার এখানে আসিবার, বা এইস্থান হইতে বাহিরে যাইবার, কোন স্থিরতা নাই।”
এই সকল অবস্থা অবগত হইয়া সে সময় আমি সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। ভাবিলাম, আমি রামচরিত্রের অনুসন্ধানে লিপ্ত হইয়াছি, তাহারই অনুসন্ধান করিব, গঙ্গাবিষণের অনুসন্ধান করিলে, আমার কিছুমাত্র ফললাভের সম্ভাবনা নাই। এই ভাবিয়া অপরাপর যে সকল কর্ম্মচারী রামচরিত্রের অনুসন্ধানে লিপ্ত ছিলেন, তাঁহাদিগের নিকট গমন করিলাম। তাঁহারা যেরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া রামচরিত্রের অনুসন্ধান করিতেছিলেন, আমিও সেইরূপ উপায় অবলম্বন করিলাম, অর্থাৎ রামচরিত্রের বন্ধুবান্ধব বা তাহার পরিচিত ব্যক্তিবর্গের অনুসন্ধান করিয়া তাহাদিগের প্রত্যেককেই রামচরিত্রের কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম কিন্তু, রামচরিত্র সম্বন্ধে কেহই কোনরূপ সন্ধান প্ৰদান করিতে সমর্থ হইল না—সে কোনস্থানে গিয়াছে বা কোন পীড়ায় আক্রান্ত হইয়াছে, তাহা কেহই বলিতে পারিল না।
মানবের স্বভাব—মনে কোন চিন্তা হঠাৎ উদ্ভাষিত হইলে, সেই চিন্তাকে পরিত্যাগ করিব ভাবিলেও, সহজে সেই চিন্তা মনকে পরিত্যগ করিতে চাহে না। গঙ্গাবিষণ সম্বন্ধে যে চিন্তা হঠাৎ আমার মনে উদয় হইয়াছিল, যে চিন্তার বলে দুই তিনবার গঙ্গাবিষণের অনুসন্ধানে তাঁহার বাসায় গমন করিয়াছিলাম, এবং পরে গঙ্গাবিষণের অনুসন্ধান অপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় যে চিন্তা পরিত্যাগ করিবার বাসনা করিয়াছিলাম, কৈ, সে চিন্তাকে ত সহজে পরিত্যাগ করিতে পারিলাম না। অন্যরূপ অনুসন্ধানে লিপ্ত থাকিলেও সেই চিন্তা পুনরায় আমার মনের উপর অধিকার বিস্তার করিল; সুতরাং, ঘুরিতে ঘুরিতে পুনরায় আমাকে সেই গঙ্গাবিষণের বাসায় যাইতে হইল।
এবার যখন গঙ্গাবিষণের বাসায় গিয়া উপস্থিত হইলাম, তখন চারটা বাজিয়া গিয়াছে। দেখিলাম, গঙ্গাবিষণের গৃহ পূর্ব্বরূপই আবদ্ধ। শুনিলাম, গঙ্গাবিষণ সেদিবস একেবারের নিমিত্তও বাসায় আসে নাই।
গঙ্গাবিষণের এইরূপ অবস্থা দেখিয়া আমার মনে কেমন একরূপ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল। মনে করিলাম, উঁহার গৃহের ভিতরটি একবার দেখিলে হয় না কি? কেন যে উহার গৃহের ভিতর প্রবেশ করিতে আমার ইচ্ছা হইল, তাহা আমি নিজেই তখন বুঝিতে পারিলাম না, অপরকে বুঝাইব কি প্রকারে?
গৃহের ভিতরের অবস্থা দেখিবার নিমিত্ত আমার যেমন ইচ্ছা হইল, অমনি আমি সেই তালাবদ্ধ গৃহের নিকট গমন করিলাম। দরজায় হাত দিয়া একটু ধাক্কা দিয়াই দেখিলাম, দুই কবাটের সন্ধিস্থল একটু ফাঁক হইয়া পড়িল। এই ফাঁকের ভিতর দিয়া গৃহের ভিতর দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলাম, কিন্তু প্রথমে গৃহের ভিতরস্থিত কোন দ্রব্যই দৃষ্টিগোচর হইল না; সমস্ত যেন অন্ধকারে পূর্ণ বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। পরে অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত সেই অন্ধকারের ভিতর দৃষ্টি স্থির রাখিলে, পরিশেষে গৃহের ভিতর দ্বারের সন্নিকটে যাহা দেখিলাম, তাহাতে আমার মনে আর একটি নূতন সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল। যে সন্দেহ আমি কখনও মনে স্থান দিই নাই, আমার মনের ভিতর যেরূপ সন্দেহের উদয় হইবার কোন কারণই কখন উপস্থিত হয় নাই, এখন গৃহের অবস্থা দেখিয়া সেই সন্দেহই হঠাৎ আমার মনে উদয় হইল। আমার মনে যে কিরূপ সন্দেহ উদয় হইয়াছে, তাহা কাহারও নিকট প্রকাশ না করিয়া, সেইস্থানের দুই তিনজন সম্ভ্রান্ত দোকানদারকে ডাকাইলাম। তাঁহারা প্রথমে আমার কথা অগ্রাহ্য করিয়া আমার নিকট আগমন করিতে অসম্মত হইলেন; কিন্তু পরিশেষে যখন তাঁহারা আমাকে পুলিস-কৰ্ম্মচারী বলিয়া জানিতে পারিলেন, তখন ইচ্ছা না থাকিলেও তাঁহারা ক্রমে আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
তাঁহারা সকলে আমার নিকট উপস্থিত হইলে, আমি সৰ্ব্বসমক্ষে গঙ্গাবিষণের গৃহের তালা ভাঙ্গিয়া দরজা খুলিয়া ফেলিলাম। গৃহের দ্বার উন্মোচিত হইবামাত্র, যে দৃশ্য আমাদিগের নয়নপথে পতিত হইল, (অনেক দিবসের ঘটনা হইলেও) তাহা আজ পর্যন্তও আমার সম্মুখে যেন সেইরূপ বিদ্যমান আছে। দেখিলাম, সেই গৃহের মধ্যস্থলে রক্তাক্ত কলেবরে একটি মৃতদেহ পড়িয়া রহিয়াছে, তাহার শরীর হইতে নিঃসৃত রক্তে সেই গৃহ একেবারে রঞ্জিত হইয়াছে; কেবল রঞ্জিত নহে, যেন রক্তের ঢেউ বহিতেছে। মৃতদেহ উত্তমরূপে দেখিলাম, কিন্তু আমি বা আমার সমভিব্যাহারী সেই দোকানদারগণ কেহই সেই মৃতদেহ চিনিতে পারিলেন না। উহার সর্ব্বশরীর উলঙ্গ, কিন্তু কোনরূপ বস্ত্রাদি নিকটে নাই;
বক্ষে এবং পৃষ্ঠে তিন চারিটি ভীষণ আঘাতের চিহ্ন, নিকটে কোন অস্ত্রাদিও দেখিতে পাইলাম না। এই অবস্থা দেখিয়া আমি আর গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম না; অধিকন্তু সেই গৃহের দ্বার বন্ধ করিয়া আমি সেইস্থানে উপবেশন করিলাম। প্রকৃতকথা বলিতে হইলে আমি কেবলমাত্র ইহা বলিতে পারি, হঠাৎ এইরূপ অবস্থা দেখিয়া আমার বুদ্ধির লোপ হইয়া গেল। এরূপ অবস্থায় কি করা কর্তব্য বা অকর্তব্য, তাহা স্থির করিতে না পারিয়াই, আমি সেই গৃহের দ্বার বন্ধ করিয়া সেইস্থানে উপবেশন করিলাম। পরিশেষে একটু স্থির হইয়া চিন্তা করায়, আমার মনে নিম্নলিখিত কয়েকটি কথার উদয় হইল।
১ম। এ মৃতদেহ কাহার, যখন স্থির করিতে পারিলাম না, তখন প্রথমেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া অনুসন্ধানে লিপ্ত হওয়া আমার কর্তব্য নহে।
২য়। যেরূপ অবস্থায় মৃতদেহ রহিয়াছে, এখন সেইরূপ অবস্থায় উহাকে রাখা উচিত। কারণ, এরূপ অবস্থায় পুলিসের সর্ব্বপ্রধান-কর্ম্মচারী সাহেব, ডাক্তার সাহেব, এবং করোণার সাহেব প্রভৃতি সকলেই আসিয়া এই অবস্থা দেখিতে পারেন।
৩য়। এ অবস্থায় আমার এইস্থান পরিত্যাগ করা উচিত নহে।
৪র্থ। যত শীঘ্র হয়, এই সংবাদ আমাদিগের প্রধান কর্ম্মচারীর নিকট প্রেরণ করা কৰ্ত্তব্য।
এইরূপ কয়েকটি সামান্য চিন্তার পর, সেইস্থানের একজন লোককে পথ হইতে একটি পাহারাওয়ালা ডাকিয়া দিবার নিমিত্ত প্রেরণ করিলাম। অনুসন্ধান করিয়া প্রায় পনের মিনিট পরে তিনি একজন পাহারাওয়ালা সমভিব্যাহারে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। পাহারাওয়ালাকে সমস্ত কথা বুঝাইয়া দিয়া আমাদিগের প্রধান কর্মচারীর নিকট সংবাদ দিবার নিমিত্ত তাহাকে পাঠাইয়া দিলাম, ও বলিয়া দিলাম যে, পথ হইতে একখানি ঠিকাগাড়ি ভাড়া করিয়া উহাতে আরোহণ পূর্ব্বক যত শীঘ্র গিয়া সংবাদ প্রদান করিতে পারে, তাহার বিশেষ চেষ্টা করিবে। আমার আদেশ প্রাপ্তিমাত্র সে দ্রুতপদে সেইস্থান পরিত্যাগ করিল, আমি সেইস্থানেই বসিয়া আমাদিগের প্রধান কর্মচারীর আগমনের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলাম।
আমি সেইস্থানে স্থিরভাবে বসিয়া রহিলাম সত্য, কিন্তু মনকে কোনরূপেই স্থির রাখিতে পারিলাম না। ঈশ্বরের নিয়মই নহে যে, বিনাকার্য্যে বা বিনাচিন্তায় কাহারও মন স্থির থাকে। সুতরাং সেই সময় কার্য্য না পাইয়া, মন পুনরায় চিন্তায় নিযুক্ত হইল। কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিয়া আপনাকে আপনি প্রশ্ন করিতে লাগিল, পুনরায় আপনিই আপনার প্রশ্নের উত্তর প্রদান করিতে লাগিল। প্রশ্ন ও উত্তরের সমস্ত কথা এইস্থানে আমি বর্ণন করিতে সমর্থ না হইলেও, তাহার কিয়দংশ পাঠকগণকে উপহার প্রদান করিতেছি।
প্রশ্ন। এ মৃতদেহ কাহার?
উত্তর। পিয়ন রামচরিত্র যখন ইহার পূৰ্ব্বস্থান পৰ্য্যন্ত পত্রাদি বিলি করিয়াছে, একথা সকলেই বলিতেছে, ইহার পরে আর কোনস্থানে পিয়ন গমন করে নাই, তখন বেশ বোধ হইতেছে, এই মৃতদেহ সেই পিয়ন রামচরিত্রের।
প্রশ্ন। ইহা যদি রামচরিত্রের মৃতদেহ হইবে, তাহা হইলে রামচরিত্রকে কে হত্যা করিল?
উত্তর। গৃহের তালা যে বন্ধ করিয়া রাখিয়াছে, তাহার দ্বারাই এই হত্যা হওয়া সম্ভব। যে এই গৃহে বাস করিত, তাহাকেই নরঘাতক বলিয়া বোধ হয়। বোধ হয়, গঙ্গাবিষণই এই হত্যার প্রধান নায়ক
প্রশ্ন। এই হত্যা যদি গঙ্গাবিষণের দ্বারা সাধিত হইয়া থাকে, তাহা হইলে এই হত্যার উদ্দেশ্য কি?
উত্তর। অপর উদ্দেশ্য না থাকিলেও পিয়নের নিকট, যাহা কিছু ছিল, তাহা অপহরণ করিবার মানসে এইরূপ, হত্যা হইলেও হইতে পারে।
প্রশ্ন। যদি হতব্যক্তি পিয়নই হয়, তাহার সময় সেই পত্রাদি সহিত সে ব্যাগ কোথায়?
উত্তর। গৃহের কোনস্থানে থাকিলেও থাকিতে পারে, বা হত্যাকারী সেই ব্যাগ লইয়া প্রস্থান করিতেও পারে।
প্রশ্ন। ভাল যেন তাহাই হইল, কিন্তু লাস বিবস্ত্র কেন? তাহার পরিহিত পেনটুলেন ও চাপকান গঙ্গাবিষণ খুলিয়া লইল কেন? এবং রাখিলই বা কোথায়?
উত্তর। এ কথার সম্ভবপর কোন উত্তর দেখিতে পাইতেছি না। হয় ত এমন কোন কারণ আছে যে, পরিশেষে সেই কারণ বাহির হইয়া পড়িবে।
প্রশ্ন। পিয়ন ব্যতিরেকে এ মৃতদেহ কি অপর আর কাহারও হইতে পারে না?
উত্তর। অপর কাহারও হওয়া অসম্ভব নয়।
প্রশ্ন। যদি অসম্ভব না হয়, তাহা হইলে এ মৃতদেহ আর কাহার হইতে পারে?
উত্তর। কোনরূপ দুরভিসন্ধি-সাধন-মানসে অপর কোন ব্যক্তিকে এইস্থানে কোনরূপে আনাইয়া, তাহাকেও হত্যা করিয়া গঙ্গাবিষণ পলায়ন করিতে পারে। গঙ্গাবিষণ যে পলায়ন করিয়াছে, তাহা নিশ্চয়। নতুবা যতবার তাহার অনুসন্ধান হইয়াছে, তাহার মধ্যে একবার না একবার, কেহ না কেহ তাহাকে দেখিতে পাইত।
প্রশ্ন। যদি গঙ্গাবিষণ অপরকে হত্যা করিয়া পলায়ন করিয়া থাকে, তাহা হইলে সে হত্যার উদ্দেশ্য কি?
উত্তর। উদ্দেশ্য অনেক হইতে পারে; মনোবিবাদ নিয়মই নহে এইরূপ কাৰ্য্য হইতে পারে, ধনসম্পত্তি অপহরণ কাৰ্য্য অসম্ভব নহে।
প্রশ্ন। গঙ্গাবিষণ, পিয়ন বা অপর আর কাহাকেও হত্যা করিয়া পলায়ন করিয়াছে, ইহা স্থির? কি অপর কাহারও দ্বারা গঙ্গাবিষণ নিজেই হত হইয়াছে, ইহা সম্ভব?
উত্তর। তাই ত, এও যে বিশেষ গোলযোগের কথা দেখিতেছি, এরূপ অবস্থায় গঙ্গাবিষণ অপর কাহারও কর্তৃক হত হওয়াও নিতান্ত অসম্ভব নহে।
প্রশ্ন। যদি এই মৃতদেহ গঙ্গাবিষণের হয়, তাহা হইলে গঙ্গাবিষণ কি নিমিত্ত হত হইয়াছেন?
উত্তর। হত হইবার কারণ অনেক থাকিতে পারে শত্রুতা, মনোবিবাদ, অর্থহরণ প্রভৃতি কোন না কোন একটি কারণের নিমিত্ত হত্যা হওয়া অসম্ভব নহে।
প্রশ্ন। হত্যা করিবার কারণ অনেক থাকিতে পারে সত্য; কিন্তু, এরূপ ভীষণ হত্যা কাহার দ্বারা হওয়ার সম্ভাবনা?
উত্তর। এ প্রশ্নের উত্তর নিতান্ত সহজ নহে। মৃতদেহের অবস্থা, গৃহের অবস্থা, গৃহস্থিত দ্রব্যসামগ্রীর অবস্থা দেখিলে, হত্যার উদ্দেশ্য কি, তাহার অনেকটা আভাস পাওয়া যায় সত্য; কিন্তু আমি এ পর্যন্ত এমন কোন কর্ম্মচারী দেখি নাই যে, সেই সকল অবস্থা দেখিয়া তিনি বলিতে পারেন, এ হত্যা কাহার দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে।
প্রশ্ন। ভাল, যদি স্থির হয়, এই মৃতদেহ গঙ্গাবিষণের, যদি বুঝিতে পারা যায়, এ হত্যার উদ্দেশ্য কি, তাহা হইলেও অপর একটি জটিল প্রশ্ন আসিয়া মনে উপস্থিত হয়। হত্যাকারী গৃহ হইতে বহির্গত হইবার সময় সেই গৃহের দ্বার কেন তালাবদ্ধ করিল?
উত্তর। এ প্রশ্ন, আর জটিল প্রশ্ন হইল কি প্রকারে? আমার বিবেচনায় পঞ্চমবর্ষীয় একটি শিশুসন্তানও ইহার উত্তর প্রদানে সমর্থ হইবে।
প্রশ্ন। তোমার কথা বুঝিতে পারিতেছি; তুমি কহিবে যে, হত্যা হইয়াছে—ইহা যত বিলম্বে জানিতে পারা যায়, হত্যাকারীর পক্ষে ততই সুবিধাজনক। হত্যাকারী পলায়ন করিবার ইচ্ছা করিলে, হত্যার বিষয় যত বিলম্বে প্রকাশ হইবে, হত্যাকারির পলায়ন করিবার তত অধিক অবসর ও সুবিধা হইবে। সুতরাং পলায়ন করিবার সময় দ্বার বন্ধ করিয়া প্রস্থান করাই বুদ্ধিমান্ নরঘাতকের পক্ষে অসম্ভব নহে। কিন্তু বল দেখি, যেরূপভাবে এই হত্যাকাণ্ড সমাপিত হইয়াছে, তাহাতে তুমি কি বিবেচনা কর? এই হত্যার পরও হত্যাকারীর মন স্থির ছিল, সে স্থিরভাবে আপনার হিতাহিত ভাবিয়া, পরিশেষে এই দ্বার বন্ধ করিয়া পলায়ন করিতে সমর্থ হইয়াছে? তাহা যদি হয়, তাহা হইলে সে একজন সামান্য ব্যক্তি নহে?
উত্তর। ইহাও একটি বিশেষ গোলযোগের কথা বটে!
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
আমি সেইস্থানে বসিয়া বসিয়া এইরূপ নানাপ্রকার ভাবনা ভাবিতেছি, এবং মনে করিতেছি, যে অনুসন্ধানে লিপ্ত হইয়া আমি এইস্থানে আগমন করিয়াছি, তাহার সহিত এই হত্যার কোনরূপ সম্বন্ধ আছে কি না? সেই সময় আমাদের প্রধান-কৰ্ম্মচারী সেইস্থানে গিয়া উপস্থিত হইলেন। দেখিতে দেখিতে আরও কয়েকজন কর্মচারী তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ উপস্থিত হইল, ছোট বড় কর্ম্মচারীবর্গের আগমনে ক্রমে সেই স্থান পূর্ণ হইয়া গেল। সর্ব্বপ্রধান কর্মচারীও গমন করিলেন, তাঁহার পশ্চাৎ ডাক্তারসাহেব গেলেন, তৎপশ্চাৎ করোণার সাহেবও সেইস্থানে পদার্পণ করিলেন।
যেরূপভাবে এই মৃতদেহ আমার নয়নগোচর হয়, তাহার সমস্ত অবস্থা আমি আমার ঊর্দ্ধতন-কর্ম্মচারীর নিকট বিবৃত করিয়া, যে গৃহে সেই মৃতদেহ পড়িয়াছিল, সেই গৃহ দেখাইয়া দিলাম। গৃহের দ্বার খুলিয়া আমার ঊর্দ্ধতন কয়েকজন প্রধান কর্ম্মচারী এই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলেন। উহার মধ্যে আর স্থান না থাকায়, আমি সেই গৃহে প্রবেশ করিতে না পারিয়া, বাহিরে দ্বারের সম্মুখে দাঁড়াইয়া রহিলাম। আর গৃহের ভিতর আমার ঊর্দ্ধতন-কর্ম্মচারী, ডাক্তারসাহেব, এবং করোণার সাহেব প্রভৃতির মধ্যে যে সকল কথাবার্তা হইতে লাগিল, তাহাই বিশেষ মনোযোগের সহিত শ্রবণ করিতে লাগলাম।
কৰ্ম্মচারী। মৃতদেহটি আপনি উত্তমরূপে দেখিলেন, উহাতে কি প্রকার জখম আছে?
ডাক্তারসাহেব। জখম অতি ভয়ানক! উহার বক্ষঃস্থলে একটি সাংঘাতিক চিহ্ন রহিয়াছে। তদ্ব্যতীত পৃষ্ঠদেশে দুইটি আঘাতের চিহ্ন আছে। তিনটি আঘাতই সাংঘাতিক।
কর্ম্মচারী। আঘাতের যে তিনটি চিহ্ন দেখিলেন, হত হওয়ার পক্ষে উহাই যথেষ্ট কি না?
ডাক্তার। তিনটি ত পরের কথা, কেহ শরীরে এইরূপ একটি আঘাত পাইলেই, তখনি তাহাকে ইহজীবন পরিত্যাগ করিতে হইবে।
কর্ম্মচারী। উহার শরীরে যে তিনটি আঘাত দৃষ্ট হইতেছে, তাহা কি একই অস্ত্রের দ্বারা হইয়াছে বলিয়া বোধ হয়?
ডাক্তার। সকল আঘাতগুলি এক প্রকারই অস্ত্রের দ্বারা হইয়াছে বলিয়া আমার বোধ হয়।
কর্ম্মচারী। ক্ষতস্তানগুলির অবস্থা দেখিয়া আপনি বলিতে পারেন কি, কিরূপ অস্ত্রদ্বারা এই সকল সাংঘাতিক আঘাত হওয়ার সম্ভাবনা?
ডাক্তার। কোন তীক্ষ্ণ অথচ চওড়া অস্ত্র শরীরের ভিতর জোরে প্রবিষ্ট করাইয়া দিলে যেরূপ ক্ষত হয়, ইহাও সেই প্রকারের ক্ষত বলিয়া আমার অনুমান হয়। ভোজালি বা সেইরূপ অপর কোন প্রকার অস্ত্রদ্বারা, এইরূপে আঘাত করা হইয়াছে বলিয়া আমার বোধ হয়।
কর্ম্মচারী। বক্ষে এবং পৃষ্ঠে উভয়দিকেই এইরূপভাবে আঘাত করা হইয়াছে, ইহার কারণ আপনার কি অনুমান হয়?
ডাক্তার। কারণ দুইপ্রকার হইতে পারেঃ—১ম, যাহারা এই হত্যা করিয়াছে, তাহারা দুই বা তিনজনের কম নহে। ইহাকে হত্যা করিবার নিমিত্ত তাহারা প্রথম হইতেই প্রস্তুত ছিল। একই সময়ে সম্মুখ ও পশ্চাৎ হইতে ইহাকে আক্রমণ করা হয়, এবং একই সময়, একই প্রকারের অস্ত্র ইহার বক্ষে এবং পৃষ্ঠে প্রবিষ্ট হয়।
২য় কারণ—এই হত্যা একব্যক্তি দ্বারাও সম্পন্ন হওয়া অসম্ভব নহে। হত্যাকারী প্রথমে ইহার বক্ষে সবলে এক আঘাত করে। সেই আঘাত সহ্য করিতে না পারিয়া, হতব্যক্তি সেইস্থানে উপুড় হইয়া পড়িয়া যায়। হত্যাকারী ইহাতেও সন্তুষ্ট না হইয়া, পরিশেষে তাহার পৃষ্ঠের উপর উপর্যুপরি আরও দুইবার সবলে আঘাত করে।
কর্ম্মচারী। আপনার বিবেচনায় এই হত্যা একব্যক্তি দ্বারাও হইতে পারে?
ডাক্তার। তা ত আমি এখনি আপনাকে কহিলাম।
করোণার। হত্যা করিবার কারণ কি? কি অভিপ্রায়ে এই হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হইয়াছে বলিয়া আপনার অনুমান হয়?
কর্ম্মচারী। হত্যার কারণ এখন পর্যন্ত অনুমিত হয় নাই। কে হত হইয়াছে তাহা জানিতে পারিলে, হত্যার কারণ সহজেই বাহির হইবার সম্ভাবনা; এবং কাহার দ্বারা এই হত্যাকাণ্ড সাধিত হইয়াছে, তাহাও প্রকাশ হইলে হইতে পারে।
প্রধান-কর্ম্মচারী, ডাক্তারসাহেব এবং করোণার সাহেবের মধ্যে এই প্রকারের অনেক কথাবার্তা চলিতে লাগিল। পরিশেষে সকলেই সেই গৃহ হইতে বাহিরে আসিয়া দণ্ডায়মান হইলেন।
সেইস্থানে সেই সময়ে আমি ও অপরাপর কর্ম্মচারিগণ যাহারা উপস্থিত ছিল, সর্ব্বপ্রধান-কৰ্ম্মচারী সকলকেই তাঁহার নিকটে ডাকিলেন ও কহিলেন, “এই অনুসন্ধানে লিপ্ত হইবার পূর্ব্বে তোমাদিগের সকলেরই কর্তব্য—কোন ব্যক্তি হত হইয়াছে, প্রথমে তাহার অনুসন্ধান করা। এই গৃহে যে ব্যক্তি বাস করিত, তাহাকে এইস্থানের অনেকেই চিনে; সুতরাং এই কাটরার কেহ না কেহ বলিতে পারিবে, এই মৃতদেহ তাহার কিনা?”
প্রধান-কর্ম্মচারীর এই আদেশ পাইবামাত্র কয়েকজন কৰ্ম্মচারী সেই কাটরার অপরাপর লোকদিগকে সেইস্থানে আনিবার নিমিত্ত প্রস্থান করিলেন। কেহ বা সেইস্থানে সমাগত লোকদিগকে একে একে সেই লাস দেখাইতে লাগিলেন, কিন্তু কেহই বলিতে পারিল না যে, উহা কাহার মৃতদেহ।
আমি কাহাকেও কিছু না বলিয়া যে পোষ্ট-আফিস-সংক্রান্ত অনুসন্ধানে লিপ্ত ছিলাম, সেই আফিসেই গমন করিলাম। সেইস্থান হইতে পোষ্টমাষ্টার এবং অপরাপর কয়েকজন লোককে সমভিব্যাহারে লইয়া, পুনরায় সেইস্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, প্রধান-কর্ম্মচারী তখনও সেইস্থানে বসিয়া আছেন। পোষ্টমাষ্টারকে সঙ্গে লইয়া আমি সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম। সেই মৃতদেহটি দেখিবামাত্র তিনি একেবারে চীৎকার করিয়া উঠিলেন ও কহিলেন, আমার পিয়ন রামচরিত্র তেওয়ারি। কে এরূপ সর্ব্বনাশ করিল? কে ইহাকে মারিয়া ফেলিল? আর কেই বা বস্ত্রাদি “এই সহিত ইহার সমস্ত দ্রব্য অপহরণ করিল? মহাশয় আমি যে সন্দেহ করিয়াছিলাম, তাহা মিথ্যা। এ ব্যক্তি সরকারি টাকাকড়ি লইয়া পলায়ন করে নাই, অর্থের লোভে কে ইহাকে হত্যা করিয়াছে।”
পোষ্টমাষ্টারের কথা শুনিয়া আমাদিগের প্রধান-কর্ম্মচারীও সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলেন। পোষ্টমাষ্টারবাবু তাঁহার নিকট রামচরিত্রের নিমিত্ত অনেক দুঃখ প্রকাশ করিতে লাগিলেন।
এইরূপ উপায়ে মৃতদেহ সনাক্ত হইল। ডাক্তারসাহেব ও করোণার সাহেব সেই মৃতদেহ পুনরায় দৃষ্টি করিয়া এবং পোষ্টমাষ্টারবাবুর সমস্ত কথা শ্রবণ করিয়া, সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। প্রধান কর্মচারী কিন্তু তাঁহাদিগের সহিত গমন করিলেন না। কিরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া এখন হত্যাকারীকে ধৃত করিতে হইবে, তিনি আমাদিগের সহিত তাহারই পরামর্শ করিতে লাগিলেন। এখন সকলেরই বেশ অনুমান হইল যে, যে ব্যক্তি এই গৃহে বাস করিত, এই হত্যা তাহারই দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে। সে-ই অর্থলোভে, এই ভয়ানক ব্যাপার সম্পন্ন করিয়া, মৃতদেহ গৃহের ভিতর ফেলিয়া গৃহ বন্ধ করিয়া প্রস্থান করিয়াছে। যে অভিসন্ধি করিয়া এই মৃতদেহ রাখিয়া গৃহ বন্ধ করিয়া সে প্রস্থান করিয়াছে, সে অভিসন্ধি কিন্তু তাহার পূর্ণ হইল না। এইরূপে যদি এই মৃতদেহ আবিষ্কার না হইত, সেই ঘরের ভিতরই ইহা পচিয়া গলিয়া যাইত, তাহা হইলে ইহা যে কাহার মৃতদেহ, তাহা সহজে কেহই জানিতে পারিতেন না; হয় ত মৃত্যুর কারণও অনুমিত হইত না। কিন্তু ঈশ্বরের কৃপায় ততদূর ঘটিল না। হয় ত পাপীর ভয়ানক পাপের প্রায়শ্চিত্ত নিকটবর্ত্তী হইয়া আসিয়াছে বলিয়াই, নিতান্ত সামান্য কারণে সেই মৃতদেহ বাহির হইয়া পড়িল।
প্রধান-কর্ম্মচারীর আদেশ অনুযায়ী সেই মৃতদেহ পরীক্ষার নিমিত্ত প্রেরিত হইল। পিয়নের বিরুদ্ধে যে বিশ্বাসঘাতকতা অপরাধে মোকদ্দমা উপস্থিত হইয়াছিল, তাহা পরিত্যাগ করিয়া অতঃপর আমরা কাহার দ্বারা সেই পিয়ন হত হইয়াছে, তাহারই অনুসন্ধানে লিপ্ত হইলাম। আবশ্যক-মত উপদেশ প্রদান করিয়া, প্রধান-কৰ্ম্মচারী সেইস্থান পরিত্যাগ করিলেন।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
হত্যাকারীর অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইবার পূর্ব্বে, আমাদিগের জানা আবশ্যক যে, সেই ঘরে যে ব্যক্তি বাস করিত, তাহার নাম কি, দেশ কোথায়, এবং কতদিবস হইতে সেইস্থানে অবস্থিতি করিতেছে? যাহার নিকট হইতে সে সেই ঘর ভাড়া লইয়াছিল, সে যদি ইহার কোনরূপ সংবাদ প্রদানে সক্ষম এই ভাবিয়া তাঁহার অনুসন্ধান করিলাম। জানিলাম, ইহার সমস্ত ঘর ভাড়া দেওয়া, সকলের নিকট হইতে ভাড়া আদায় করা প্রভৃতি যে কোন কার্য্য, তাহা জমীদার নিজে করেন না; সে সমস্ত ভার হরিবোল নামক একজন সরকারের উপরই ন্যস্ত আছে। অনুসন্ধানে হরিবোল সরকারকে পাইলাম, তাহার নিকট হইতে অবগত হইলাম যে, যে গৃহে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, কিছুদিবস পূর্ব্বে সেই গৃহ চিনশুকরাম নামক এক ব্যক্তি গ্রহণ করিয়াছেন। তিন মাসের ভাড়া একেবারে অগ্রিম প্রদান করায় তাহার বাসস্থান প্রভৃতির ঠিকানা হরিবোল কিছু জানিয়া লয় নাই। হিসাবে কেবল নাম লিখিয়া রাখিয়াছে মাত্র।
যে গৃহে মৃতদেহ পাওয়া যায়, পুলিসের নিয়মানুযায়ী সেই গৃহটি একবার উত্তমরূপে অনুসন্ধান করা আবশ্যক। এতক্ষণ পৰ্য্যন্ত মৃতদেহ গৃহের ভিতর ছিল বলিয়া, সেই গৃহ উত্তমরূপে দেখা হয় নাই। যে সকল পাঠক পুলিসের কৰ্ম্ম অবগত নহেন, তাঁহারা হয় ত জিজ্ঞাসা করিতে পারেন, যে গৃহে হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করিয়া হত্যাকারী পলায়ন করিয়াছে, সেই গৃহ অনুসন্ধানে কি ফল ফলিতে পারে? এ প্রশ্নের উত্তরে এইমাত্র বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, অনেক সময় দেখা যায়, হত্যাকারী হত্যা করিয়া প্রস্থান করিবার সময় অনবধানতাবশতঃ এরূপ দ্রব্য বা এরূপ চিহ্ন সেই গৃহে রাখিয়া যায়, যাহা অবলম্বনে অনুসন্ধান করিলে, পরিশেষে হত্যাকারী ধৃত ও দণ্ডিত হয়। এই কারণে যে স্থানে হত্যাকাণ্ড সাধিত হয়, সেইস্থান উত্তমরূপে অনুসন্ধান করা পুলিশের যেন এক প্রকার কর্তব্যকর্ম্মের মধ্যে পড়িয়াছে।
যে গৃহে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, সেই গৃহ হইতে উহা বাহির করিয়া পরীক্ষার নিমিত্ত প্রেরণ করিবার পর আমরা পুনরায় সেই গৃহে প্রবেশ করিলাম। সেই ঘরে যতগুলি জানালা ও দরজা ছিল, তাহার সমস্থই খুলিয়া দিলাম; গৃহটি আলোকে পূর্ণ হইয়া গেল। সুতরাং গৃহের মধ্যে যে সকল দ্রব্যাদি ছিল, তাহা উত্তমরূপে নয়নগোচর হইতে লাগিল।
দেখিলাম, সেই গৃহের একদিকে রাশীকৃত পত্রাদি ছিন্নবিচ্ছিন্ন অবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছে। তাহার সমস্ত গুলিই ডাকযোগে আসিয়াছে বলিয়া বেশ অনুমিত হইতেছে। তাহার মধ্যে রেজেষ্টারীপত্র, বেয়ারিংপত্র, মণিঅর্ডার, সংবাদপত্র, পার্শেল প্রভৃতি অনেক, কিন্তু সমস্ত গুলিই ছিন্ন। একস্থানে খাম, অপরস্থানে পত্র, একস্থানে ছিন্ন পার্শেল, অপরস্থানে তাহার উপরিস্থিত মমজামা, কাপড় প্রভৃতি।
রামচরিত্র পিয়নকে হত্যা করিবার কারণ আমরা যদিও একরূপ স্থির করিয়াছিলাম, এখন কিন্তু তাহাতে আর কিছুমাত্র সংশয় রহিল না। এই অবস্থা দেখিয়া সকলেই একবাক্যে বলিয়া উঠিলেন, এই হত্যার উদ্দেশ্য “ডাকচুরি।” আর হত্যাকারীও চিনশুকরাম ভিন্ন অপর আর কেহই হইতে পারে না। যাহা হউক, সেই সকল পত্রের শিরোনামগুলি আমরা একে একে পড়িয়া দেখিতে লাগিলাম। দেখিলাম, পত্র সমস্তই রামচরিত্রের বিটের অধিবাসিবর্গের। শিরোনামগুলি পাঠ করা সমাপ্ত হইলে, পত্রগুলি পড়িতে আরম্ভ করিলাম। নিজে যতদূর পড়িতে পারি—পড়িলাম; অবশিষ্টগুলি অন্যান্য সকলে পাঠ করিতে লাগিলেন। যে যে ভাষা আমরা কেহই অবগত নহি, সেই সেই ভাষায় লিখিত পত্রগুলি, সেই সেই ভাষায় অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের দ্বারা পড়াইয়া লইলাম। সমস্ত পত্রগুলি পাঠ করা হইলে জানিতে পারিলাম যে, সেই সকল পত্রের সহিত প্রেরিত নোট, চেক, হুণ্ডি প্রভৃতি কত টাকার ছিল। হত্যাকারী যে কত টাকা লইয়া প্রস্থান করিয়াছে, তাহা এইরূপ উপায়ে স্থিরীকৃত হইল। এখন আমরা জানিতে পারিলাম, চিনশুকরাম রামচরিত্রকে হত্যা করিয়া কি কি দ্রব্য অপহরণপূর্ব্বক প্রস্থান করিয়াছে।
রামচরিত্র কি নিমিত্ত সেই গৃহের ভিতর গমন করিয়াছিল, তাহার কারণও সেই পত্ররাশি পাঠে অবগত হইলাম। দেখিলাম, সেই ছিন্ন পত্রাবলীর মধ্যে একখানি রেজেষ্টারী পত্রের ছিন্ন অংশ পড়িয়া রহিয়াছে। উহার উপরস্থিত ডাকঘরের মোহর দেখিয়া বুঝিতে পারিলাম, সেই পত্রখানি এই সহরের বড় ডাকঘর হইতেই আসিতেছে; সেই পত্রের উপর নাম লেখা গঙ্গাবিষণ। বুঝিলাম, সেই রেজেষ্টারীপত্রবিলি করিবার অভিপ্রায়ে রামচরিত্র সেইস্থানে আগমন করিয়াছিল বলিয়াই, তাহার এইরূপ শোচনীয় দশা উপস্থিত হইয়াছে।
সহরের মধ্যবর্তী একস্থান হইতে নিকটবর্ত্তী অপরস্থানে টাকা প্রভৃতি পাঠাইতে হইলে, প্রায় কেহই উহা ডাকযোগে প্রেরণ করে না। যতদিবস পর্য্যন্ত আমি এই কলিকাতা সশহরে বাস করিতেছি, তাহার মধ্যে এরূপ ঘটনা কখন যে আমার নয়নগোচর হইয়াছে, তাহা আমার মনে হয় না। সরলহৃদয় পাঠক-পাঠিকাগণ! আপনারা এইরূপ উপায়ে রেজেষ্টারীপত্র প্রেরণ করিবার কারণ কিছু অনুমান করিতে পারেন কি? যদি পারেন, ভালই; নতুবা অগত্যা আমার অনুমানই আপনাদিগকে গ্রহণ করিতে হইবে। আমার বোধ হয়, এইরূপ উপায়ে রেজেষ্টারী পত্র সহরের ভিতরস্থিত একস্থান হইতে অন্যস্থানে প্রেরিত হইবার উদ্দেশ্য পূর্ব্বে সঙ্কল্পিত হত্যা করিবার একটি প্রশস্ত উপায় ভিন্ন আর কিছুই হইতে পারে না। প্রধান ডাকঘরে এই পত্র চিনশুকরাম বা গঙ্গাবিষণ ভিন্ন অপর কাহারও দ্বারা রেজেষ্টারী করা হয় নাই। চিনশুকরাম মনে মনে ইহা বেশ জানিত যে, এই রেজেষ্টারীপত্র ডাকঘর হইতে বিলি হইরার নিমিত্ত পিয়নের দ্বারা নিশ্চয়ই তাহার নিকট প্রেরিত হইবে। আরও জানিত,–যে পিয়ন কাট্টায় পত্র বিলি করে, তাহার সহিত রেজেষ্টারীপত্র প্রভৃতি মূল্যবান দ্রব্য অনেক থাকে। এইরূপ অবস্থায় পিয়ন তাহার নিকট গমন করিলে, তাহাকে হত্যা করিয়া সে অনায়াসেই অনেক অর্থ অপহরণ করিতে পারিবে। পূর্ব্ব হইতেই চিনশুকরাম বা গঙ্গাবিষণ মনে মনে এইরূপ সঙ্কল্প করিয়া আপনস্থান হইতে তাহার নিজ নামেই এই পত্র রেজেষ্টারী করিয়াছিল। আবার এদিকে নরঘাতী অস্ত্র সংগ্রহ করিয়া পিয়নের সর্ব্বনাশ সাধন-মানসে আপনার গৃহে তাহার অপেক্ষায় বসিয়াছিল। ইহাই আমার অনুমান।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
গৃহের ভিতর যেস্থানে পত্রগুলি পাওয়া গিয়াছিল, সেইস্থানে পিয়ন রামচরিত্রের পরিহিত কাপড়গুলিও পাওয়া গেল। কাপড়গুলি দেখিলে বোধ হয়, কোন অস্ত্রের সাহায্যে উহা যেন অঙ্গ হইতে বিচ্যুত করা হইয়াছে। কাপড়গুলি সমস্তই রক্তাক্ত। কাপড়ের নিকটবর্ত্তী আর একস্থানে একটি চামড়ার ব্যাগ, এই ব্যাগে রামচরিত্র বিলি করিবার পত্রাদি ডাকঘর হইতে লইয়া বাহির হইত। ব্যাগের নিকট দেখিলাম, একটি টিনের বাক্স রহিয়াছে, উহার ভিতর দ্রব্যাদি কিছুই নাই; কয়েকখানি পুরাতন পত্র পড়িয়া রহিয়াছে মাত্র। এ পত্রগুলির শিরোনামায় চিনশুকরামের নাম নাই। উহাতে লেখা আছে, গঙ্গাবিষণ—ঠিকানাও আবার অন্যস্থানের।
এই অবস্থা দেখিয়া আমার মনে অন্য প্রকারের এক নূতন চিন্তা আসিয়া উপস্থিত হইল। ভাবিলাম, চিনশুকরাম ও গঙ্গাবিষণ উভয়ে মিলিয়া কি এই হত্যাকাণ্ড সমাপিত করিয়াছে? অথবা একই ব্যক্তি, এই উভয় নাম ধারণ করিয়া, ভিন্ন ভিন্ন স্থানে, ভিন্ন ভিন্ন পরিচয় প্রদান করিয়াছে? এইরূপ চিন্তা ক্ষণকালের নিমিত্ত আমার মনে উদয় হইল সত্য; কিন্তু ভাবিয়া চিন্তিয়া ইহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না।
আমার সহিত অপরাপর যে কয়েকজন কর্মচারী ছিলেন, তাঁহাদিগের মধ্যে একজনকে হাবড়া রেলওয়ে ষ্টেশনে, ও অন্য আর এক ব্যক্তিকে শিয়ালদহ রেলওয়ে ষ্টেশনে পাঠাইয়া দিলাম। আমি নিজে সেইস্থান পরিত্যাগ করিয়া বড়বাজারের ভিতর পায়রাটোলার গলিতে গমন করিলাম। টিনের বাক্সের ভিতরস্থিত যে পত্রগুলিতে গঙ্গাবিষণের নাম ছিল, তাহাতে এইস্থানেরই ঠিকানা ছিল। গলির ভিতর প্রবেশ করিয়া পত্রের শিরোনাম-অনুযায়ী যে বাড়ীতে গঙ্গাবিষণ থাকিত, সেই বাড়ীর ঠিকানা বাহির করিলাম। সেইস্থানে অনুসন্ধানে জানিতে পারিলাম যে, গঙ্গাবিষণ নামক এক ব্যক্তি প্রায় দুইমাস হইতে সেই বাড়ীতে একটি ঘর ভাড়া করিয়া রাখিয়াছে। সে নিজে কখন সেই গৃহে অবস্থিতি করেন না, কিন্তু সময় সময় নানাপ্রকারের দ্রব্যাদি আনিয়া সেই গৃহে রাখিয়া দিত, এবং কখন কখন সেই সকল দ্রব্যাদি বাহির করিয়া লইয়া যাইত। আজ তিনদিবস হইল, সে সেই গৃহ পরিত্যাগ করিয়াছে, এবং তাহার যে সকল দ্রব্যাদি সেই গৃহে ছিল, তাহার সমস্তই লইয়া গিয়াছে।
গৃহস্বামীর নিকট পূর্ব্বোক্ত কয়েকটি কথা জানিতে পারিয়া, সেইস্থান পরিত্যাগ করিবার উদ্যোগ করিতেছিলাম, এইরূপ সময়ে হঠাৎ আমার কি মনে হইল, পুনরায় তাঁহাকে আরও দুই চারি কথা জিজ্ঞাসা করিবার মানসে তাঁহাকে পুনরায় ডাকিলাম। তিনি আমার আহ্বান মত নিকটে আসিলে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি গঙ্গাবিষণকে কতদিবস হইতে ও কিরূপ প্রকারে জানেন?”
গৃহস্বামী। যে পৰ্য্যন্ত সে আমার বাড়ীতে ঘর ভাড়া করিয়াছে, সেই সময় হইতে আমি ইহাকে জানি।
আমি। ঘর ভাড়া লইবার পূর্ব্বে আপনার সহিত উহার কোনরূপ জানা শুনা ছিল না।
গৃহস্বামী। না।
আমি। পূর্ব্ব হইতে উহার সহিত যদি আপনার জানা শুনা না ছিল, তাহা হইলে কি প্রকারে সে আপনার নিকট আসিয়া এই ঘর ভাড়া লইল?
গৃহস্বামী। সে হঠাৎ আমার বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হয়। বোধ হয়, কাহারও নিকট শুনিয়া থাকিবে, আমার বাড়ীতে ভাড়া দেওয়ার উপযুক্ত ঘর খালি আছে।
আমি। সে যখন আপনার নিকট ঘর ভাড়া লইতে আসিয়াছিল, তখন তাহার সহিত আর কে আসিয়াছিল?
গৃহস্বামী। তাহার সহিত অপর কেহ আসিয়াছিল বলিয়া আমার মনে হয় না। আমার বোধ হয়, সে একাকীই আসিয়াছিল।
আমি। সে আপনার বাড়ীতে কখনও রাত্রিযাপন করিয়াছে, বলিতে পারেন?
গৃহস্বামী। না।
আমি। অপর কোন ব্যক্তি তাহার সহিত কখনও আপনার বাড়িতে আসিয়াছিল?
গৃহস্বামী। না।
আমি। আপনি পূর্ব্বে বলিয়াছেন, সময়ে সময়ে দ্রব্যাদি আনিয়া সে এই গৃহে রাখিত?
গৃহস্বামী। হাঁ।
আমি। কি দ্রব্য আমিতে আপনি দেখিয়াছেন?
গৃহস্বামী। আমার বোধ হয়, দুই তিনবার তাহাকে দুই তিনটি বাক্স আনিতে দেখিয়াছি।
আমি। সেই সকল বাক্স সে নিজে আনিত কি?
গৃহস্বামী। নিজে সঙ্গে আনিত বটে, কিন্তু মুটিয়ায় উহা বহিয়া আনিত।
আমি। তিনদিবস হইল, সে তাহার সমস্ত দ্রব্যাদি লইয়া চলিয়া গিয়াছে কহিলেন। সেই সকল দ্রব্যাদি সে কি প্রকারে লইয়া গেল?
গৃহস্বামী। কেন, মুটিয়া ডাকাইয়া লইয়া গেল।
আমি। মুটিয়া সে নিজে ডাকিয়া আনিয়াছিল, কি অপর কাহারও দ্বারা ডাকাইয়া আনে?
গৃহস্বামী। সে নিজেই গিয়া মোড় হইতে মুটিয়া ডাকিয়া আনিয়াছিল।
আমি। কোন্ মুটিয়াকে ডাকিয়া আনিয়াছিল, তাহা আপনি বলিতে পারেন কি?
গৃহস্বামী। তাহা যদিও আমি ঠিক বলিতে পারি না, কিন্তু সেই মুটিয়াকে আমি অনেক সময় গলির মোড়ে বসিয়া থাকিতে দেখিয়াছি। আমার বোধ হয়, আমি তাহাকে দেখিলে চিনিতে পারি।
আমি। যদি আপনি আমার সহিত মোড় পর্যন্ত গমন করেন, ও সেই মুটিয়াকে দেখিতে পাইলে যদি আমাকে চিনাইয়া দেন, তাহা হইলে বিশেষ উপকৃত হই?
আমার প্রস্তাবে গৃহস্বামী সম্মত হইলেন, ও তৎক্ষণাৎ আমার সমভিব্যাহারে গলির মোড়ে পথের উপর গমন করিলেন।
সে সময়ে আমরা পথে গিয়া উপস্থিত হইলাম, সেই সময়ে একটি মুটিয়া ঝাকা-সহিত পূৰ্ব্বদিক হইতে আগমন করিয়া, সেইস্থানে পথের উপর উপবেশন করিল। তাহাকে দেখিয়াই গৃহস্বামী কহিলেন, “আমার বোধ হয়, এই মুটিয়াই সেইদিবস গঙ্গাবিষণের বাক্স লইয়া গমন করিয়াছিল।”
গৃহস্বামীর কথা শুনিয়া আমি সেই মুটিয়াকে ডাকিলাম, ডাকিবামাত্র সে আমার নিকট আগমন করিল। আমি তাহাকে কিছু না বলিয়া, গৃহস্বামীর সহিত সেই গলির ভিতর প্রবেশ করিলাম। মুটিয়া মোট পাইবার প্রত্যাশায় আমাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিল। যখন আমরা সেই গৃহস্বামীর বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম, তখন তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “অদ্য তিনদিবস হইল, তুমি এই বাড়ী হইতে বাক্স প্রভৃতি যে মোট লইয়া গিয়াছিলে, তাহা তোমার মনে পড়ে?”
মুটিয়া। কেন মহাশয়!
আমি। তোমার সহিত আমি কি অপর কোন ব্যক্তি যদি না যায়, এবং সেইস্থানে লইয়া যাইবার নিমিত্ত যদি কোন দ্রব্য তোমাকে দেওয়া হয়, তাহা হইলে সেই দ্রব্য তুমি সেইস্থানে পৌঁছিয়া দিতে পারিবে কি না?
মুটিয়া। পারিব বৈ কি। যে স্থানে একবার গিয়াছি, সেইস্থান কি কখনও ভোলা যায়, বিশেষ সে দুই তিন দিবসের কথামাত্র।
আমি। সে দিবস তুমি কোথায় বাক্স লইয়া গিয়াছিলে, তাহা তোমার বেশ মনে আছে ত?
মুটিয়া। আছে বৈ কি।
আমি। আচ্ছা, বল দেখি কোথায় লইয়া গিয়াছিলে?
মুটিয়া। কেন মহাশয়! কয়লাঘাটের মালগুদামে লইয়া গিয়াছিলাম।
আমি। কয়লাঘাটের কোন মালগুদামে লইয়া গিয়াছিলে?
মুটিয়া। যেস্থানে রেঙ্গুন যাইবার নিমিত্ত মালপত্র লইয়া গিয়া থাকে, সেইস্থানে লইয়া গিয়াছিলাম।
আমি। তোমার মনে আছে দেখছি। আচ্ছা, তুমি এখন গমন কর, আমি দ্রব্যাদি আজ আর প্রেরণ করিব না। বোধ হয়, কল্য সকালে পাঠাইব, সেই সময় তোমাকে ডাকিয়া লইব। তোমাকে সেই মোড়েই পাইব ত?
মুটিয়া। মোট লইয়া যদি কোনস্থানে গমন না করি, তাহা হইলে আমাকে সেইস্থানেই পাইবেন।
আমি। যদি তুমি মোট লইয়া কোনস্থানে গমনও কর, তবে আমি তোমার অপেক্ষা করিব। যে পর্য্যন্ত তুমি ফিরিয়া না আইস, সে পৰ্য্যন্ত সেই দ্রব্য আমি পাঠাইয়া দিব না। তোমাকে না পাইলে আমার কোন কার্য্য হইবে না। কারণ, তুমি ভিন্ন সেইস্থান অপর আর কেহই অবগত নহে
আমার কথা শুনিয়া, মুটিয়া বোধ হয়, যেন একটু ক্ষুণ্ণ হইল। যাহা হউক, তৎপরে সে সেইস্থান পরিত্যাগ করিয়া মোড়ের দিকে প্রস্থান করিল।
মুটিয়ার নিকট যে কয়েকটি কথা অবগত হইতে পারিলাম, তাহাতেই আমার উদ্দেশ্য কতক পরিমাণে সিদ্ধ হইল; কিন্তু আসল কথা মুটিয়াকে কহিলাম না। প্রকৃতকথা অবগত হইলে মুটিয়া আমার কার্য্যে যে কোনরূপ ব্যাঘাত দিবে, সে ভয় আমার ছিল না; তথাপি তাহাকে প্রকৃতকথা বলিলাম না কেন? ভয়—প্রকৃতকথা জানিতে পারিলে, বা আমার প্রকৃত পরিচয় পাইলে, এদেশের ঐ শ্রেণীর ব্যক্তিগণ সর্ব্বদা যাহা করিয়া থাকে, এও যে তাহা না করিবে, তাহার প্রমাণ কি? হয় ত অবলীলাক্রমে বলিয়া বসিবে, “আমি কখন কোন বাক্স লইয়া কোনস্থানে গমন করি নাই, বা মোট পাইবার প্রত্যাশায় কখনও এ বাড়িতে আগমনও করি নাই। “ যাহা হউক, এই প্রকারে মিথ্যাকথা বলিয়া আমার কার্য্য উদ্ধারের চেষ্টা করিতে হইল। মুটিয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলে, আমিও সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম। গৃহস্বামীও আমাকে আর কোন কথা না বলিয়া বাড়ির ভিতর প্রস্থান করিলেন।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
পায়রাটোলার গলি হইতে বহির্গত হইয়া আমি কয়লাঘাটে গমন করিলাম। রেঙ্গুনে কোন দ্রব্যাদি পাঠাইতে হইলে যেস্থানে লইয়া যাইতে হয়, সেইস্থানে অনুসন্ধান করায় জানিতে পারিলাম যে, প্রায় তিনদিবস অতীত হইল, গঙ্গাবিষণ নামক এক ব্যক্তি কয়েকটি দ্রব্য রেঙ্গুনে পাঠাইয়া দিবার নিমিত্ত সেইস্থানে লইয়া যায়। সেই সকল দ্রব্য সেইস্থান হইতে গঙ্গাবিষণ প্রেরণ করিয়াছে, এবং রেঙ্গুনে উপস্থিত হইলে সেইস্থানে মাশুল দিয়া সেই ব্যক্তিই উহা গ্রহণ করিবে। আরও জানিতে পারিলাম যে, যেদিবস রামচরিত্র তেওয়ারি হত হইয়াছে, তাহার পরদিবস প্রত্যূষে একখানা ষ্টীমার কলিকাতা হইতে রেঙ্গুনে গমন করিয়াছে। ষ্টীমারঘাটে এই ব্যাপার জানিতে পারিয়া, আমার মনে একটু সাহস হইল। এখন আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম, গঙ্গাবিষণই চিনকরাম নাম ধারণ করিয়া কাট্টায় অবস্থিতি করিতেছিল; কিন্তু তাহার দ্রব্যাদি সমস্তই পায়রাটোলার গলিতে ছিল। পিয়নকে হত্যা করিয়া পলায়ন করিবার পূর্ব্বেই সে আপনার দ্রব্যাদি রেঙ্গুনে পাঠাইয়া দিবার বন্দোবস্ত করে, ও পরিশেষে আপনার অভিসন্ধি পূর্ণ করিয়া নিজেও রেঙ্গুনে প্রস্থান করিয়াছে। চিনশুকরাম নাম ধারণ করিয়া সে কাট্টায় বাস করিতেছিল, হত্যাকাণ্ড আবিষ্কৃত হইবার পর সকলেই ভাবিবে, চিনশুকরামই রামচরিত্রকে হত্যা করিয়া পলায়ন করিয়াছে; সুতরাং সকলেই চিনশুকরামের অনুসন্ধানেই লিপ্ত হইবে। চিনশুকরাম যে গঙ্গাবিষণ, তাহা কেহ জানিতে পারিবে না; সুতরাং কেহই গঙ্গাবিষণকে অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইবে না। এইরূপে সে পুলিসের চক্ষে ধূলিনিক্ষেপ করিয়া বিচারের হস্ত হইতে আপনাকে রক্ষা করিবে, ভাবিয়াছিল! ওদিকে পুলিস অপ্রকৃত পথ অবলম্বন করিয়া চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়াইবে!
আমার মনের ভাব কাহারও নিকট প্রকাশ না করিয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলাম, ও আমার ঊর্দ্ধতন ইংরাজকর্মচারীর নিকট গিয়া উপস্থিত হইলাম। এ পৰ্য্যন্ত যাহা কিছু অবগত হইতে পারিয়াছি, এবং যে বিশ্বাসকে আমার মনে স্থান দিয়াছি, আনুপূর্ব্বিক তাহা তাঁহার নিকট প্রকাশ করিলাম। দেখিলাম, তিনিও আমার মতে মত দিলেন, এবং আমি যে এই অনুসন্ধানের প্রকৃত পন্থা পাইয়াছি, তাহাতে বিশেষ সন্তুষ্ট হইয়া আমাকে ধন্যবাদ প্রদান করিলেন। পরিশেষে ইহাই সাব্যস্ত হইল যে, তৎক্ষণাৎ তারযোগে রেঙ্গুন সহরের পুলিসের নিকট সংবাদ প্রদান করা হইবে। ষ্টীমার সেইস্থানে উপস্থিত হইবামাত্র গঙ্গাবিষণ (ওরফে) চিনশুকরামকে তাহারা ধৃত করিবে ও তাহার সহিত বাক্স প্রভৃতি যে কিছু মালামাল আছে, তাহা সমস্ত আটক করিয়া এইস্থানে প্রেরণ করিবে।
সাহেব যাহা কহিলেন, তাহাতে আর আমি দ্বিরুক্তি করিলাম না, বরং তাঁহার মতেই মত দিলাম। কারণ, যদি তাঁহার মতের পরিবর্ত্তন হইয়া যায়, তারযোগে সংবাদ পাঠাইবার পরিবর্তে যদি কোন কর্মচারীকে সেইস্থানে প্রেরণ করেন, তাহা হইলে সে ভারটি আমার উপরেই পড়িবার সম্ভাবনা। এদিকে ষ্টীমারযোগে সমুদ্র বহিয়া রেঙ্গুনে গমন করা হিন্দুর পক্ষে নিতান্ত কম কষ্টের কারণ নহে।
যে সংবাদটি রেঙ্গুন পুলিসের নিকট তারযোগে পাঠাইয়া দিবেন, সাহেব তাহার মুসবিদা করিতে করিতে আমাকে কহিলেন, “আসামীর হুলিয়া (আকার-অবয়ব) কি, বল।”
এইস্থানে আমি একটু বিপদে পড়িলাম, চিনশুকরামের হুলিয়া আমি কাটরার লোকজনদিগের মুখে শুনিয়া লিখিয়া লইয়াছিলাম। কিন্তু পায়রাটোলা গলির ভিতরস্থিত বাটি গৃহস্বামীর সহিত আমার সাক্ষাৎ হইলে, সেইস্থানে গঙ্গাবিষণের অনুসন্ধান পাওয়াতে সেই সময় হঠাৎ আমার মনে এরূপ আনন্দের সঞ্চার হইয়াছিল যে, আমি আমার কর্তব্য কৰ্ম্ম ভুলিয়া গিয়াছিলাম। গঙ্গাবিষণের হুলিয়া কিরূপ তাহা আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করি নাই; সুতরাং উভয়ের হুলিয়ার সহিত আমি মিলাইয়াও দেখি নাই যে, গঙ্গাবিষণের হুলিয়া—চিনশুকরামের হুলিয়ার সহিত মেলে কিনা। যদি উভয়ের হুলিয়া পৃথক্ পৃথক্ হয়, তাহা হইলে উভয় নামই যে এক ব্যক্তির, তাহা ত কোনরূপেই হইতে পারে না। তাহা হইলে আমাদিগের অনুমান সম্পূর্ণরূপ মিথ্যা হইয়া দাঁড়াইবে। গঙ্গাবিষণ ও চিনকরাম যে একই ব্যক্তির নাম, তখন ত আর তাহা কোনরূপেই বলিতে পারিব না। যাহা হউক, একথা সাহেবের নিকট প্রকাশ করিয়া অনুসন্ধানের সময় নিজে যে মহৎভ্রমে পতিত হইয়াছি, তাহা আর তাঁহাকে জানিতে দিলাম না। চিনশুকরামের যে হুলিয়া আমার নিকট ছিল, তাহাই লিখাইয়া দিলাম।
আমার নিকট হুলিয়া প্রভৃতি লিখিয়া লইয়া সাহেব তারযোগে রেঙ্গুনে সংবাদ প্রদান করিলেন। তৎপরে আমি সেইস্থান হইতে বহির্গত হইয়া, মনের সন্দেহ মিটাইবার নিমিত্ত পুনরায় পায়রাটোলার গলিতে গমন করিলাম। সেইস্থানে গৃহস্বামীর নিকট হইতে গঙ্গাবিষণের হুলিয়া জানিয়া লইবার পর, আমার সন্দেহ মিটিয়া গেল। তখন মনে সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস হইল যে, একই ব্যক্তি পৃথক্ পৃথক্ নাম ধারণ করিয়া পৃথক পৃথক স্থানে অবস্থিতি করিতেছিল।
সেদিবসের অনুসন্ধান এইরূপেই শেষ হইয়া গেল, মনে করিয়া, আপনস্থানে গমন করিলাম। রাত্রি দশটার সময় সংবাদ আসিল, আমার প্রধান ইংরাজ-কর্মচারী আমায় অনুসন্ধান করিতেছেন। সংবাদ পাইবামাত্র আর স্থির থাকিতে পারিলাম না, তৎক্ষণাৎ তাঁহার নিকট গমন করিলাম। দেখিলাম, তিনি আমার অপেক্ষাতেই আফিসে বসিয়া রহিয়াছেন।
আমি তাঁহার নিকট গমন করিবামাত্র তিনি কহিলেন, “গঙ্গাবিষণ ওরফে চিনশুকরামের সংবাদ আমাকে একরূপ প্রদান করিলে, আমিও তোমার কথায় বিশ্বাস করিয়া তারযোগে রেঙ্গুনে সংবাদ প্রদান করিলাম। কিন্তু এখন এ আবার কিরূপ নূতন কথা শুনিতেছি?”
সাহেবের কথা শুনিয়া কহিলাম, “আমি আপনার কথা বুঝিতে পারিতেছি না; এখন আবার কি সংবাদ আসিয়াছে?” উত্তরে সাহেব কহিলেন, “অপর গৃহে আর একজন কর্মচারী বসিয়া আছেন, দেখ, তিনি কি সংবাদ আনিয়াছেন।” সাহেবের এই কথা শ্রবণ করিয়া, যে স্থানে অপর আর একজন কর্মচারী বসিয়াছিলেন, সেইস্থানে গমন করিলাম।
নবম পরিচ্ছেদ
সাহেবের নির্দেশমত গৃহে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, যে কৰ্ম্মচারীকে আমি হাবড়া রেলওয়ে স্টেশনে প্রেরণ করিয়াছিলাম, তিনি সেইস্থানে বসিয়া রহিয়াছেন।
তাহাকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি হে! এত রাত্রিতে তুমি কি সংবাদ লইয়া এইস্থানে আগমন করিয়াছ?”
কর্ম্মচারী। আসামীর একটু অনুসন্ধান পাইয়াছি।
আমি। কি অনুসন্ধান পাইয়াছ?
কর্ম্মচারী। জানিতে পারিয়াছি, আসামী কলিকাতা হইতে এলাহাবাদে গমন করিয়াছে।
আমি। তুমি কি প্রকারে জানিতে পারিলে, যে, আসামী এলাহাবাদে গমন করিয়াছে?
কৰ্ম্মচারী। হাবড়া ষ্টেশনে অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলাম যে, যেদিবস রামচরিত্র হত হইয়াছে সেই দিবস প্রাতঃকালে চিনশুকরাম মোট বাঁধিয়া কতকগুলি দ্রব্য এলাহাবাদে প্রেরণ করিয়াছে। ষ্টেশনের খাতাপত্র দেখিয়া আরও জানিতে পারা গেল যে, সেই সকল দ্রব্যাদি চিনশুকরাম নিজেই এইস্থান হইতে প্রেরণ করিতেছে; এবং এলাহাবাদে সেই সকল দ্রব্য পৌঁছিলে, চিনশুকরাম নিজেই সেই সকল দ্রব্য মাশুল দিয়া সেইস্থানে গ্রহণ করিবে। এরূপ অবস্থায় রামচরিত্র তেওয়ারীকে হত্যা করিবার পরে চিনশুকরাম এলাহাবাদে গমন করিতে পারে না কি?
আমি। তুমি যাহা বলিলে, তাহা যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে চিনশুকরাম এলাহাবাদে গমন করিলেও করিতে পারে।
কৰ্ম্মচারী। আমি যাহা জানিতে পারিয়াছি, আপনাকে তাহাই কহিলাম; সম্ভব অসম্ভব বুঝি না। আমার বিবেচনায় সম্ভবও যেমন, অসম্ভবও তেমনি। কারণ, পূর্ব্বে হয় ত তাহার মনে ছিল, সে শীঘ্র কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়া এলাহাবাদে গমন করিবে; এই নিমিত্তই সে আপনার দ্রব্যাদি সেইস্থানে প্রেরণ করিয়াছে। কিন্তু রামচরিত্র তেওয়ারীকে হত্যা করিবার পর তাহার সেই ইচ্ছা কতদূর থাকিবার সম্ভাবনা, তাহা বলা নিতান্ত সহজ নহে।
আমি। তাহার অন্তরের ইচ্ছা—এক প্রকার বলা যাইতে পারে। তাহার দ্রব্যাদি প্রেরণ করিবার পূর্ব্বেই সে বিশেষরূপে অবগত ছিল, সে পিয়নকে হত্যা করিয়া তাহার সমভিব্যাহারে যাহা থাকিবে, তাহার সমস্তই অপহরণ করিবে। যে দিবস সে নিজের নামে রেজেষ্টারীপত্র প্রেরণ করিয়াছিল, তাহার পূর্ব্বেই সে তাহার অভিসন্ধি স্থির করিয়া রাখিয়াছিল; সুতরাং হঠাৎ তাহার মতের পরিবর্তন হইতে পারে না। পূর্ব্ব হইতে ষড়যন্ত্র করিয়া এই হত্যা তাহার দ্বারা সম্পন্ন না হইয়া, ক্রোধ বা অপর কোন কারণের বশীভূত হইয়া সে যদি এই হত্যা করিত, তাহা হইলে তোমার প্রদর্শিত যুক্তি আমি অনায়াসেই গ্রহণ করিতে পারিতাম।
আমার কথা শুনিয়া কর্মচারী আর কোন কথা কহিল না। তখন কিন্তু আমি মনে মনে ভাবিলাম,—এ আবার কি? গঙ্গাবিষণ তাহার দ্রব্যাদি রেঙ্গুনে প্রেরণ করিয়াছেও সেইস্থানে সে নিজেই তাহার দ্রব্যাদি গ্রহণ করিবে। এদিকে আবার দেখিতেছি, চিনশুকরাম তাহার দ্রব্যাদি এলাহাবাদে প্রেরণ করিয়াছে; সেইস্থানে সে নিজেই উহা গ্রহণ করিবে। এরূপ অবস্থায় গঙ্গাবিষণ ও চিনশুকরাম যে একই ব্যক্তি, তাহা এখন আর কি প্রকারে বলিতে পারি? উহারা নিশ্চয়ই দুইজন, তবে হয় ত উভয়ের আকার-অবয়বের অনেক সৌসাদৃশ্য আছে।
এই প্রকার ভাবিতে ভাবিতে পুনরায় সাহেবের নিকট গমন করিলাম। সাহেব তখন পর্যন্তও আফিসে বসিয়া একখানি সংবাদপত্র পাঠ করিতেছিলেন। আমাকে দেখিবামাত্র তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “এরূপ অবস্থায় এখন তোমার কি অনুমান হইতেছে?”
আমি। এরূপ অবস্থায় কোন বিষয় সহজে অনুমান করা নিতান্ত সহজ নহে।
সাহেব। এই কৰ্ম্মচারী যাহা কহিতেছে, তাহা প্রকৃত বলিয়া তোমার বিবেচনা হয় কি?
আমি। অপ্রকৃত ভাবিবার আমি কোন কারণ দেখিতেছি না।
সাহেব। ইহাও যদি অপ্রকৃত না হয়, এবং তোমার প্রদত্ত সংবাদও যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে সেই ব্যক্তি একই সময়ে কি প্রকারে রেঙ্গুন এবং এলাহাবাদ দুইস্থানে গমন করিল?
আমি। এই সকল অবস্থা দেখিয়া আমার এখন অনুমান হইতেছে, গঙ্গাবিষণ ও চিনশুকরাম একই ব্যক্তি নহে, ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি। তবে উভয়ের আকার-প্রকারে ও বয়স প্রভৃতিতে অনেক সাদৃশ্য থাকিলেও থাকিতে পারে।
সাহেব। তবে এখন তোমার বোধ হইতেছে, উহারা পৃথক ব্যক্তি, পৃথক স্থানে গমন করিয়াছে?
আমি। এই অনুমান ভিন্ন অপর কোন প্রকার অনুমান, এখন আমার মনে উদয় হইতেছে না।
সাহেব। রেঙ্গুনের নিমিত্ত একরূপ বন্দোবস্ত পূর্ব্বেই করা হইয়াছে। আমার বোধ হয়, এখন একজন এলাহাবাদে গমন করিলেই আসামীর অনেক সন্ধান পাওয়া যাইতে পারে।
সাহেবের প্রস্তাব আমার মনের সহিত মিলিল; সুতরাং তাঁহার মতে মত দিয়া যে কৰ্ম্মচারী এই শেষোক্ত সংবাদটি আনয়ন করিয়াছিলেন, তাহাকেই এলাহাবাদে পাঠাইয়া দেওয়া স্থির করিলাম।
যে ব্যক্তি চিনশুকরামকে দেখিলে চিনিতে পারিবে, কাট্রা হইতে এরূপ একটি লোক সঙ্গে লইয়া কৰ্ম্মচারী এলাহাবাদে প্রস্থান করিলেন।
আমি কলিকাতাতেই থাকিয়া আরও যদি কোন প্রকার সংবাদ পাওয়া যায়, তাহার চেষ্টা করিতে লাগিলাম। কয়েকদিবস পরে এলাহাবাদ হইতে সংবাদ আসিল, “চিনশুকের প্রেরিত দুইটি বাক্স এইস্থানে আসিয়া পৌঁছিয়াছে। কিন্তু চিনশুকরাম বা তাহার প্রেরিত অপর কোন লোক এ পর্য্যন্ত সেই দ্রব্য গ্রহণ করিবার নিমিত্ত আগমন করে নাই।” কৰ্ম্মচারী আরও কিছুদিবস সেইস্থানে চিনশুকের প্রত্যাশায় বসিয়া রহিলেন; কিন্তু যখন দেখিলেন, কেহই সেই বাক্স লইতে আসিল না, অথবা আর আসিবার সম্ভাবনাও নাই, তখন তিনি ষ্টেশনের কর্ম্মচারীগণের সম্মুখে সেই বাক্স খুলিয়া ফেলিলেন। উহার ভিতর যে সকল দ্রব্যাদি দেখিতে পাইলেন, তাহাতে নিতান্ত বিস্মিত হইয়া, পরিশেষে আমাদিগকে সংবাদ প্রদান করিলেন। বাক্সের ভিতর আবশ্যকীয় বা মূল্যবান দ্রব্যাদি কিছুই ছিল না; মনুষ্যের পরিত্যক্ত কতকগুলি অসার এবং অব্যবহার্য্য দ্রব্যদ্বারা উহা পূর্ণ।
এলাহাবাদের এই ব্যাপার জানিতে পারিয়া, এখন আমার মনে পুনরায় সম্পূর্ণ বিশ্বাস হইল যে, চিনশুকরাম ও গঙ্গাবিষণ একই ব্যক্তি, আমাদিগকে বিপথে চালিত করিবার নিমিত্ত সেই দুষ্ট এই খেলা খেলিয়াছে। সে নিশ্চয়ই অবগত আছে যে, আমরা চিনশুকরামের অনুসন্ধানে লিপ্ত হইলে জানিতে পারিব যে, চিনশুকরামের দ্রব্যাদি এলাহাবাদে গমন করিয়াছে। সুতরাং আমারও অপর অনুসন্ধান পরিত্যাগ করিয়া তাহার প্রেরিত বাক্সের অনুসরণপূর্ব্বক এলাহাবাদে গমন করিব, এবং সেইস্থানে কিছুদিবস পর্য্যন্ত চিনশুকের অপেক্ষায় বসিয়া থাকিব। আর এদিকে সে নিৰ্ব্বিবাদে বহুদূর গমন করিয়া আমাদিগের হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাইবে। উঃ! কিরূপ ধূর্তের অনুসরণে আজ আমরা প্রবৃত্ত হইয়াছি?
দশম পরিচ্ছেদ
গঙ্গাবিযণ (ওরফে) চিনশুকরামের বুদ্ধি-কৌশলকে যদিও একবার প্রশংসা করিলাম সত্য কিন্তু মনুষ্য হইয়া মনুষ্যস্বভাবকে পরিত্যাগ করিতে পারিলাম না। এ স্বভাব যে কি, তাহা বোধ হয়, পাঠক-পাঠিকা! আপনারা বুঝিতে পারিয়াছেন। যে স্বভাবের গুণে আপনারা আপনাকে অন্যের অপেক্ষা অধিক বুদ্ধিমান্ বলিয়া বিবেচনা করিয়া থাকেন, সেই স্বভাবের গুণেই আমিও ভাবিলাম যে, গঙ্গাবিষণ ওরফে চিনশুকরাম যতই কেন কৌশলী বা বুদ্ধিমান্ হউক না, আজ আমার বুদ্ধির নিকটে সে পরাজিত হইয়াছে। দেখুন দেখি, আমি কিরূপ উপায়ে তাহার প্রকৃত গতি নির্ণয় করিতে সমর্থ হইয়াছি! না পারিব কেন? সেরূপ লোক যতই কেন বুদ্ধিমান্ হউক না, আমার বুদ্ধির নিকটে তাহাকে পরাজিত হইতে হইবে।
কিয়ৎক্ষণ বসিয়া মনে মনে এইরূপ চিন্তা করিতেছি, এবং মনে মনে আপনার বুদ্ধিকে বারম্বার ধন্যবাদ দিতেছি, এমন সময় একখানি টেলিগ্রাফ আসিয়া আমার হস্তে পড়িল। দেখিলাম, উহা খোলা অবস্থায় রহিয়াছে, এবং জানিলাম, আমার ঊর্দ্ধতন সেই ইংরাজ-কর্মচারী দেখিবার নিমিত্ত উহা আমার নিকট প্রেরণ করিয়াছেন। টেলিগ্রাফখানি যেমন দেখিলাম, অমনি আমার মনে হইল, কে বলে—দর্পহারী ভগবান্ নাই? দেখিলাম, হৃদয়ের মধ্যে যে দর্পের সহায়ে আত্ম-গরমা ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হইতেছিল যে দর্পের সহায়ে অপরের বুদ্ধি অপেক্ষা নিজের বুদ্ধি-বৃত্তিকে অধিকতর প্রশংসা করিতেছিলাম, সেই দর্প দেখিতে দেখিতে চূর্ণ হইল।
টেলিগ্রাফ পাঠে জানিতে পারিলাম, গঙ্গাবিষণ যে বাক্স রেঙ্গুনে প্রেরণ করিয়াছিল, তাহা নিয়মিত সময় সেইস্থানে পৌঁছিয়াছে। কিন্তু সেই ষ্টীমারে গঙ্গাবিষণ নামক, বা গঙ্গাবিষণের আকৃতি-বিশিষ্ট, কোন লোক সেইস্থানে গমন করে নাই। যদি কেহ সেই বাক্স লইতে আগমন করে, এই ভাবিয়া সেইস্থানের পুলিশ কয়েকদিবস অপেক্ষা করিয়াছিল। কিন্তু যখন দেখিতে পাইল, কেহই বাক্সের নিমিত্ত গমন করিল না, তখন বাক্স ভাঙ্গিয়া দেখিয়াছে, উহার অবস্থাও এলাহাবাদে প্রেরিত বাক্সের সমান; উহার ভিতরও দ্রব্যাদির পরিবর্তে কতকগুলি জঞ্জালে পূৰ্ণ।
এখন বুঝিলাম, কি ভয়ঙ্কর লোকের অনুসরণে আমরা প্রবৃত্ত! এবং তাহার বুদ্ধিবৃত্তি নিতান্ত নিকৃষ্ট (?) হইলেও আমাদিগের অপেক্ষা কত বিভিন্ন এবং কৌশলময়। এবং আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম,—গঙ্গাবিষণ ওরফে চিনশুকরাম রেঙ্গুনেও যায় নাই, এলাহাবাদেও গমন করে নাই। অপর কোনস্থানে প্রস্থান করিয়াছে।
এখন যে কোন্ পন্থা অবলম্বন করা যাইতে পারে; ভাবিয়া তাহার কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। পরে পুনরায় আর একবার পায়রাটোলার গলিতে গমন করিতে মনস্থ করিলাম। সেইস্থানে পূৰ্ব্বকথিত গৃহস্বামীর সহিত সাক্ষাৎ হইল। তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “মহাশয়! গঙ্গাবিষণ যতদিবস আপনার গৃহে দ্রব্যাদি রাখিয়াছিল, তাহার মধ্যে অপর কোন ব্যক্তির সহিত তাহাকে আপনার বাটীতে আগমন করিতে আপনি কখন দেখিয়াছেন কি?”
আমি কে, এবং কি অভিপ্রায়ই তাঁহার নিকট গঙ্গাবিষণের অবস্থা জানিবার নিমিত্ত গমনাগমন করিতেছি, তাহা তিনি এ পর্যন্ত অনুমান করিতে পারেন নাই। কিন্তু এবার তাঁহার মনে সন্দেহ হইল; তিনি স্পষ্টই আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “মহাশয়! আপনি কে, এবং কি নিমিত্ত গঙ্গাবিষণ সম্বন্ধে এতকথা আমাকে বার বার জিজ্ঞাসা করিতেছেন?”
গৃহস্বামীর কথা শুনিয়া, আমি আমার প্রকৃত পরিচয় প্রদান করিলাম। কি নিমিত্ত গঙ্গাবিষণের অনুসন্ধান করিতেছি, তাহাও তাঁহাকে কহিলাম, এবং তৎকর্তৃক আমরা যেরূপে প্রতারিত হইয়া অনর্থক এত সময় নষ্ট করিয়াছি, তাহাও আনুপূর্ব্বিক তাঁহার নিকট বর্ণনা করিলাম। আমার কথা শুনিয়া গৃহস্বামী যেন একটু ভীত হইলেন ও কহিলেন, “না মহাশয়! আমার যতদূর মনে হয়, তাহার মধ্যে গঙ্গাবিষণের সহিত অপর কোন ব্যক্তিকে যে আমি কখন দেখিয়াছি, তাহা বোধ হয় না।”
আমি। আপনাকে বিশেষ বুদ্ধিমান্ লোক বলিয়া আমার বোধ হইতেছে। বেশ ভাবিয়া চিন্তিয়া দেখুন দেখি, এমন কি উপায় আছে যে, সেই উপায় অবলম্বন করিয়া আমি গঙ্গাবিষণের সন্ধান করিতে সমর্থ হইতে পারি?
গৃহস্বামী। সেরূপ উপায় আমি ত কিছুই দেখিতে পাইতেছি না।
আমি। আপনি কহিলেন, কখন কোন ব্যক্তিকে আপনি তাহার সহিত দেখেন নাই। কিন্তু বেশ মনে করিয়া দেখুন দেখি, কখন তাহাকে কোন লোকের বাড়িতে গমন করিতে, বা বাড়ী হইতে বহির্গত হইতে, অথবা আপনার পরিচিত কোন ব্যক্তির সহিত কখন কথাবার্তা কহিতে, আপনি দেখিয়াছেন কি না?
গৃহস্বামী। সে প্রকারের কোন কথা আমার মনে হয় না। তবে যেন বোধ হয়, একদিন সন্ধ্যার পর তাহাকে আমি শ্যামাবাইয়ের গলির মোড়ে পানওয়ালীর দোকানের সম্মুখে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়াছি?
আমি। সে কতদিবস হইল বোধ হয়?
গৃহস্বামী। বোধ হয়, ২০/২৫ দিবস হইবে।
আমি। যে গৃহে সে থাকিত, এখন সে গৃহে কে আছে?
গৃহস্বামী। কেহই নাই, সে গৃহ এখন খালি আছে।
আমি। সে গৃহটি আমি একবার দেখিতে পাই কি?
গৃহস্বামী। কেন পাইবেন না; আমার সঙ্গে আসুন, আমি আপনাকে সেই গৃহে লইয়া যাইতেছি।
আমি। তবে চলুন।
এই বলিয়া গৃহস্বামীর পশ্চাৎ পশ্চাৎ তাঁহার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। এ বাড়ীটি যদিও নিতান্ত বড় নহে, তথাপি নিতান্ত ক্ষুদ্র নহে। দেখিলাম, অনেক লোক দ্বারা উহা পূর্ণ; তাহার মধ্যে পশ্চিম-দেশবাসী লোকের সংখ্যা অধিক। গৃহস্বামী আমাকে একখানি গৃহ দেখাইয়া দিয়া কহিলেন, “এই গৃহে সে থাকিত।” আমি সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, উহার ভিতর অত্যন্ত অন্ধকার। গৃহস্বামীকে একটি আলো আনিতে কহিলাম, তিনি একটি কেরোসিন ল্যাম্প আনয়ন করিলেন। দেখিলাম, সেই গৃহের ভিতর কিছুই নাই।
গৃহের ভিতর আমার আবশ্যকীয় কোন দ্রব্য না পাইয়া, সেই গৃহের বাহিরে আসিলাম। দেখিলাম, সেই সময় বাড়ির অনেক লোকই সেইস্থানে সমবেত হইয়া আমরা কি করিতেছি, দেখিবার নিমিত্ত প্রাঙ্গনে উপস্থিত হইয়াছে। গৃহ হইতে বাহিরে আসিয়াই আমি সেই সকল লোকদিগকে দেখিতে পাইলাম। আরও দেখিলাম, উহাদিগের মধ্যে এক ব্যক্তি আমার পরিচিত। আমাকে দেখিবামাত্র সে কহিল, “মহাশয়! আপনি আসিয়া, কাহার অনুসন্ধান করিতেছেন?”
উত্তরে আমি কহিলাম, “এই গৃহে গঙ্গাবিষণ নামক যে ব্যক্তি থাকিত, তাহারই অনুসন্ধান করিতেছি। তুমি এ সম্বন্ধে কিছু বলিতে পার কি? জান সে কোথায় আছে, বা অপর কোন ব্যক্তির সহিত তাহার পরিচয় আছে কি না?”
“জানিলেই বা আপনাদিগকে বলিব কেন? এক কথা বলিয়া কে নিজের কর্ম্ম কার্য্য পরিত্যাগ পূর্ব্বক আপনাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ ঘুরিয়া বেড়াইবে? এবং কাছারি আর ঘর করিবে?”
“কাহারও নিকট কোন সংবাদ পাইলে, আমি তাহাকে কিরূপ কষ্ট দিয়া থাকি, বা নানাস্থানে ঘুরাইয়া লইয়া বেড়াই, তাহা ত তুমি উত্তমরূপে অবগত আছ। তবে এরূপ কথা বলিতেছ কেন?”
“আপনাকে যেন আমি জানি; কিন্তু অপর পুলিস-কর্ম্মচারীগণ কি করেন, তাহা ত আপনি জানেন?”
“সে যাহাই হউক, এস্থানে আমি তোমার নিকট আসিয়াছি, বা অপর কোন পুলিস-কৰ্ম্মচারী তোমার নিকট আগমন করিয়াছে? যদি তুমি কোনরূপে আমাকে সাহায্য করিতে সমর্থ হও, তাহা তোমার করা সর্ব্বতোভাবে কৰ্ত্তব্য।”
“কৰ্ত্তব্য বলিয়াই ত এতকথা আপনাকে কহিলাম!” এই বলিয়া আমাকে লইয়া সে একান্তে গমন করিল, এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করিল, “গঙ্গাবিষণের অনুসন্ধান করিতেছেন কেন, সে কি করিয়াছে?”
“কাটায় যে খুন হইয়াছে, তাহা শুনিয়াছ?”
“শুনিয়াছি।”
“গঙ্গাবিষণ সেই খুন করিয়াছে।”
“উঃ! কি ভয়ানক! গঙ্গাবিষণ খুন করিয়াছে? না, তাহা হইতে পারে না।”
“হইতে পারুক আর না পারুক, তাহার কোন সন্ধান আমাকে তুমি প্রদান করিতে পার কি?”
“বিশেষ সংবাদ আমি কিছুই অবগত নহি, কিন্তু শ্যামাবাইয়ের গলির মোড়ে খিলিওয়ালীর দোকানের উপর একটি স্ত্রীলোকের নিকট তাহাকে কখন কখন আমি গমন করিতে দেখিয়াছি।”
“সেই স্ত্রীলোকটির নাম কি বলিতে পার?”
“সে পশ্চিম-দেশীয় স্ত্রীলোক, তাহার নাম রামপতিয়া।”
এই সামান্য সংবাদটুকুর সহিত গৃহস্বামীর কথা কতক পরিমাণে মিলিল, দেখিলাম। বলা বাহুল্য, সেইস্থানে আর কালবিলম্ব না করিয়া, রামপতিয়ার বাড়ীতে গমন করিলাম। সেইস্থানে গমন করিয়া দেখিলাম, রামপতিয়ার গুহের দ্বার ভিড়ান রহিয়াছে। দ্বার ঠেলিয়া আমি একেবারে গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম। পালঙ্কের উপর গঙ্গাবিষণ নিদ্রিত ছিল। এই সময়ে আমার মনে যে কিরূপ ভাবের উদয় হইল, সাধারণ পাঠক তাহার উপলব্ধি করিতে না পারিলেও, যে সকল পাঠক পুলিস-কৰ্ম্মচারী, তাঁহারা কিন্তু সবিশেষ উপলব্ধি করিতে সমর্থ হইবেন। যাহা হউক, আমি মনের ভাব এবং প্রকৃতকথা গোপন করিয়া রামপতিয়ার সহিত দুই একটি অপ্রয়োজনীয় কথা বলিয়া বাহিরে আসিলাম। তখন যত শীঘ্র পারি, নিকটস্থ পথ হইতে দুইটি পাহারাওয়ালা সংগ্রহপূর্ব্বক পুনরায় রামপতিয়ার গৃহে প্রবেশ করিলাম, এবং কাহাকেও কিছু না বলিয়া একেবারে সেই নিদ্রিত ব্যক্তিকে বন্ধন করিলাম।
এইরূপ অবস্থায় তাহার নিদ্রাভঙ্গ হইলে সে বলিয়া উঠিল, “আপনারা কাহার অন্বেষণ করিতেছেন?” উত্তরে আমি কহিলাম, “গঙ্গাবিষণের”।
সে কহিল, “আমার নাম গঙ্গাবিষণ নহে।” রামপতিয়া কহিল, “ইহার নাম রামশরণ।”
ইহাদিগের কথা শুনিয়া যদিও আমার মনে একটু সন্দেহ হইল; তথাপি আমরা উহাকে পরিত্যাগ না করিয়া, সেই গৃহস্বামীকে সেইস্থানে আনাইলাম। গৃহস্বামী উহাকে দেখিবামাত্র কহিলেন, “ইহার নামই গঙ্গাবিষণ।”
গৃহস্বামীর কথা শুনিয়া আর আমাদিগের কোনরূপ সন্দেহ রহিল না। পরিশেষে কাট্টার লোকেরাও আসিয়া ইহাকে সনাক্ত করিল ও কহিল, “ইহার নামই চিনওকরাম।”
রামপতিয়ার ঘর-তল্লাসি করিয়া যদিও কোন দ্রব্য পাওয়া গেল না; কিন্তু কঠোর অনুসন্ধানে পরিশেষে রামশরণের আর একটি বাসা বাহির হইয়া পড়িল, ও সেই বাসা হইতে অপহৃত প্রায় সমস্ত দ্রব্য বাহির হইল।
বিচারে রামশরণ চিরনির্ব্বাসিত, অর্থাৎ বিশ বৎসরের নিমিত্ত আন্দামানে গমন করিল। আন্দামানের ফেরত কোন কোন কয়েদীর নিকট হইতে জানিতে পারা যায় যে, সে এখন সেইস্থানে বিবাহ করিয়া গৃহসংসার করিয়াছে। কেহ বলে, সেইস্থানে অপর আর একটি দুষ্কর্ম্ম করায় তাহার প্রাণদণ্ড হইয়াছে। এ সম্বন্ধে কোন্ সংবাদ প্রকৃত, কোটি অপ্রকৃত, আমরা তাহা এখন বলিতে পারিতেছি না।
[ফাল্গুন, ১৩০১]