ডাক্তার

ডাক্তার

ডাক্তার পালধি চেম্বারে চল্লিশ টাকা ফি নেন। এবেলা ওবেলা মিলে গড়ে জনা পঞ্চাশ রুগি। মানে দু’হাজার টাকা। দিনে গড়ে গোটা চারেক কল, বাড়ি গিয়ে রুগি দেখা। লোকাল কেস হলে একশো।। ব্লাড টেস্ট, ইউরিন টেস্ট ইত্যাদি করিয়ে প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরির কমিশন বাবদ গড়ে দুশো টাকা। এক্স-রে’র কমিশনটাও মন্দ নয়। একটা সিটি স্ক্যান করাতে পারলে আড়াইশো টাকা ছাক্কা। মেডিকেল সার্টিফিকেট দিয়েও শ’ খানেক টাকা ইনকাম হয়ে যায়। তা ছাড়া সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের কর্মচারীদের মেডিকেল বিল আছে। ডাক্তারের ফি বাবদ ওরা সরকারের কাছ থেকে পায় মাত্র চার টাকা, কিন্তু ডাক্তারের ফি চল্লিশ টাকা। এরকম সমস্যার সমাধান অনেক ডাক্তারবাবুর মতোই পালধি ডাক্তারকেও করতে হয়। পাশের ওষুধের দোকানের সঙ্গে ব্যবস্থা আছে। ফল্‌স ক্যাশ মেমো আনিয়ে নিলেই হল। অনেক সরকারি কর্মচারী অনুরোধ করেন— খরচা একটু বেশি করেই দেখিয়ে দিন। ডাক্তারবাবু অনুরোধ রাখেন। এ বাবদ বাজার চলতি কমিশন হল থার্টি পার্সেন্ট। আরও আছে। মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভরা এটা সেটা দেয়। ওষুধপত্রও তার কিছু কিছু দোকানে চালান হয়ে যায়। এটা হিসেব না করলেও দিনে সাড়ে তিন হাজার টাকা ইনকাম। পনেরো দিন চেম্বার বন্ধ রাখা মানে পঞ্চাশ হাজার টাকার উপর লস।

পনেরো দিনের জন্য চেম্বার বন্ধ করে নিজের দেশে এসেছেন ডাক্তার শিবতোষ পালধি। সামনেই ওঁর পিতা মঁতিলাল পালধির জন্মশতবর্ষ। একটা অনুষ্ঠান করবেন। সি ডি এম ও-কে আসতে বলেছেন। বি ডি ও, পঞ্চায়েত প্রধান, এঁরা তো থাকবেনই। বড় শালির মেয়েটাকেও আনা করাবেন। রেডিয়ো আর্টিস্ট। আর সেইদিনই উদ্বোধন হবে মতিলাল স্মৃতি দাতব্য চিকিৎসালয়।

ডাক্তার পালধি এখন লুচি ভাজার গন্ধ পাচ্ছেন। গাওয়া ঘি। জানালার মোটা শিকে তাঁর হাত। শিকের গায়ে পাখির বিষ্ঠা শুকিয়ে আছে। কী পাখির, শালিক ? টিয়া ? সামনের সজনে গাছের ডালে একজোড়া পাখি দেখলেন, চেনা, নাম মনে পড়ছে না। দুটো মাহিন্দর উঠানে বসে বাসি তরকারি দিয়ে জলভাত খেয়ে নিচ্ছে। দেওয়ালের পেন্ডুলাম ঘড়িতে ন’টার ঘণ্টা বাজতে শুরু করেছে। ডা. পালধি এই সময়ে ওঁর বেলঘরিয়ার চেম্বারে বসে যান। সকাল সোয়া আটটা নাগাদ স্নান ঘরে ঢুকে যেতে হয়। টেলিফোন-শাওয়ারটা ঘাড়ে-গর্দানে-বাহুসন্ধি উরুসন্ধিতে চলাচল করতে থাকলে ডাক্তার পালধি মন্ত্র পড়েন ওঁ কুরুক্ষেত্রং গয়া গঙ্গাং প্রভাস পুষ্করানিচ তীর্থন্যেতানি পুণ্যানী স্নানকালে ভবন্তিহ। বাবার শেখানো স্নানমন্ত্র। পুকুরে স্নান করার সময় পড়তে হত। সেই প্রাচীন পুকুরটাকে দোতলার জানলার শিকের ফাঁকে আর একবার দেখলেন শাপলা সমেত। ওর বেলঘরিয়ার বাড়ির বাথরুমে একটা জানলা আছে, পুবে। স্নানটা সেরে ফট করে সূর্যপ্রণামটাও সেরে নিতে পারেন ডাক্তারবাবু। স্নান সেরে কালী এবং বাবা-মার ছবিতে মালা-ধূপকাঠি দেন, ড্রেস করেন, জলখাবার খান, তারপর চেম্বার।

শ্যালো পাম্পের ডিগ ডিগ ডিগ ডিগ শুরু হল। এই শব্দটা এখনও নতুন নতুন লাগে। ছোটবেলায় এই শব্দটা ছিল না। পিঠে সিলিন্ডার বেঁধে হাতে পাইপ নিয়ে দু’জন লুঙ্গি পরা মুনিয। এ দৃশ্যটাও ছোটবেলায় ছিল না। একটা মাছরাঙা পাখি ছুঁয়ে গেল জল, জল কেঁপে উঠল। বহু পুরনো ছবি, তবু নতুন। কাঁঠাল গাছটার গা বেয়ে একটা কাঁঠবেড়ালি উঠছে। নারকোল গাছের মাথায় একটি ঘুড়ি আটকে গিয়ে বাতাসে কাঁপছে। ঘুড়িতে কাস্তে-হাতুড়ি। ডাক্তারবাবু ছবি দেখছেন। কিন্তু ছবি দেখলে চলবে কেন ? অনেক কাজ বাকি। দাতব্য চিকিৎসালয়ের চেয়ার টেবিল বেঞ্চির অর্ডার দিতে হবে, বাড়িটায় চুনকাম, বিকেলে ডাক্তারের ব্যাপারটা ঠিক করে ফেলতে হবে। দাতব্য চিকিৎসালয় হচ্ছে, অথচ ডাক্তারই ঠিক হল না এখনও !

দুই

পালধিদের গ্রাম কেশরকুনি থেকে গলসি তিন কিলোমিটার। এখানেই ব্লক-প্রাইমারি হেল্‌থ সেন্টার। হালে একটা নার্সিংহোেম হয়েছে এখানে। এখন বহুত নতুন কথার আমদানি। রুগিকে বলে পেসেন্ট, ডাক্তারকে বলে এসপেশালিস্ট। খাওয়া-দাওয়াকে বলে ডায়েট, পেট খসানোকে এম টি পি, গলসি বাজারের আর এম পি ডাক্তার রসরাজ যশ পালধি ডাক্তারকে দেখেই উঠে দাঁড়ালেন। আরে আরে, আয়, আয়, কী সৌভাগ্য। ডাক্তারবাবুর পিছনের দেওয়ালে নাড়িভূঁড়ির ছবি। আওয়ার ডাইজেসটিভ সিস্টেম। একজন রুগি, রুগি তো নয়, পেসেন্ট, টুলের সামনে জিভ বের করে বসেছিল, যশ ডাক্তার বললেন, জিভ এবার জিভের জায়গায় থাক। অন্য রুগিদের দিকে চেয়ে বললেন, ‘ইনাকে চিন ? কেশরকুনির শিব ডাক্তার। মস্ত ডাক্তার। কলকাতা থাকেন।’

ডাক্তার পালধি বললেন, ‘তোর কাছে একটু মতলবে এসেছি রসরাজ। বাবার নামে একটা দাতব্য চিকিৎসালয় করার ইচ্ছে ছিল, তার জন্য একটু পরামর্শ…’

পালধিকে নিয়ে ‘অপারেশন থিয়েটারে’ ঢুকলেন যশ ডাক্তার। একটা বেড, বেডের উপর বড় একটা আলো, একটা চেয়ার, স্যালাইন-অক্সিজেনের ব্যবস্থা, জল ফোটানোর ব্যবস্থা। ফোঁড়াটোড়া কাটা, কাটা জায়গায় সেলাই করা, এম টি পি…। অপারেশন টেবিলে উঠে বসলেন ডাক্তার যশ। বললেন—‘আগে তোর ছেলের খবর বল। পালধি বললেন—ছেলেকে চণ্ডীগড়ে ডার্মাটোলজিতে ভরতি করিয়েছি। যশ ডাক্তার বললেন ‘ডার্মা কেন ? স্কিনের ডাক্তার হয়ে কী হবে ? এখন হচ্ছে হার্টের বাজার।’

পালধি বললেন, ‘আমার ছেলের হচ্ছে গে সুখী সুখী নেচার। ঘুমতে বড্ড ভালবাসে। চামড়ার ডাক্তারকে রাতে কেউ ডাকে না। চামড়ার রুগি মরে না, সুতরাং হুজ্জোত হবার ভয় নেই। আর চামড়ার রোগ সারে না। কোনও রুগি একবার এলে এক বছরের জন্য নিশ্চিন্তি। তোর কেমন চলছে বল।’

যশ ডাক্তার সিগারেট ধরালেন। ক্ষোভে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘খুব খারাপ, খুব খারাপ। একটা নার্সিংহোম হয়েছে, দিনের বেলায় ওখানে স্পেশালিস্ট সেন্টার। বর্ধমান থেকে ডাক্তার আসছে। দুটো হোমিওপ্যাথ হয়ে গেছে বাজারে, তার উপর হেলথ সেন্টারে এখন ডাক্তার থাকে। আমার কাছে রুগি আসবে কেন আর ? বড়লোকরা নার্সিংহোম-এ যাচ্ছে, গরিবেরা হাসপাতাল।

হাসপাতালে শুনলাম ডাক্তার থাকে। ওই জন্য দেখলাম তোর চেম্বারে ভিড়টা কম কম লাগছে।— তো ডাক্তার থাকে যে বড় ? কেন ?

যশ ডাক্তার ঠোঁট উলটে বললেন, কে জানে কী মধু সেখানে। লেডি ডাক্তার। কোয়ার্টারেই পড়ে থাকে।

কুমারী ?

কুমারী কি না জানি না, অবিবাহিতা। হেসে উঠলেন ডাক্তার যশ। চোখেও কারুকার্য।

পালধি ডাক্তার একটু গম্ভীর মতো হয়ে গেলেন। চিরটাকাল শুনে এসেছেন হেল্‌থ সেন্টারে ডাক্তার থাকে না। অথচ…

পালধি ডাক্তার বললেন, ‘তা হলে, দাতব্য চিকিৎসালয়ে রুগি হবে না বলছ ?’ যশ বললেন—, না তা বলছি না, রুগি হবে ঠিকই, তা ছাড়া ওই লেডি ডাক্তার তো চিরকাল থাকছে না…।’

ঠিকই। লোক আসবে না, হতেই পারে না, প্রতিটি মানুষের রোগ। ওখানে ডাক্তার কাকে রাখব, এ নিয়ে পরামর্শ করতে এসিছি। ভেবেছিলাম হোমিওপ্যাথ রেখে দেব। আমাদের গাঁয়ের অশ্বিনী রেলে কাজ করত। ডাকযোগে হোমিওপ্যাথি পাশ দিয়েছে। বলেছিল দাতব্য চিকিৎসালয় করলে ও বসবে। আমি ওষুধের খরচা পত্তরটা দেব। এখন অশ্বিনী বলছে— রিটায়ার করেছি, ভাবছি হাটের বকুলতলায় নকুলের সারের দোকানের বারান্দায় বসব। বসুক গে, ওকে আর রিকোয়েস্ট করব না। গলসিতে যারা বসে তাদের একজনকে রাজি করাতে পারবে কি ?— মাসে মাসে কিছু দেব।’

যশ ডাক্তার বলল, ‘মনে হয় না ওরা কেউ যাবে। তবে আমি তো এখন সমিতির প্রেসিডেন্ট, বলে দেখতে পারি।’

সমিতি ? ডাক্তাররা মিলে অ্যাসোসিয়েশন করেছিস বুঝি ?

না, ওটা গলসি বাজার ব্যবসায়ী সমিতি।

ব্যবসায়ী সমিতির মধ্যে ডাক্তাররাও ? যশ তখন হে-হে-হে হাসেন। হাসিতে তেমন জোর নেই। চোখ নিচু, মুখ নিচু। পালধি ডাক্তার একটু ঘাড় চুলকে নেন। রসরাজ বললেন, তবে গ্যারান্টি দিতে পারব না ভাই। ওরা এটা ওটা বলে ঠিক কাটিয়ে দেবে। কে যাবে বল ঘরের খেয়ে বনের…

পালধি ডাক্তার বললেন— তা হলে কি আমার ওই স্বপ্নটা ইয়ে হয়ে যাবে ? ভেবেছিলাম বাবার নামে একটা দাতব্য চিকিৎসালয়… বাবা আমাকে কত খরচাপাতি করে ডাক্তারিটা পড়িয়েছিলেন…। যশ বললেন, এক কাজ কর। উদ্বোধনটা করে দে। ওটাই আসল। উদ্বোধনের পর তো কত কিছুই বন্ধ হয়ে যায়…।

পালধি চিন্তায় পড়েন। বলতে চাইলেন— বরং রসরাজ, তুই না হয় সপ্তাহে দু’দিন করে বোস। কিন্তু বলতে পারছেন না।

রসরাজ আর শিবতোষ একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়ত ক্লাস এইট অব্দি। তারপর রসরাজ পিছিয়ে পড়ে। রসরাজের বাবার বাষট্টি বিঘে, শিবতোষের বাবার বাহান্ন বিঘে জমি। দু’জনায় খুব ভাব ছিল। এক বাটিতে মুড়ি ছোলা খেত। বামুন শিবতোষ পালধি, আগুরি রসরাজের বোনের প্রেমে মজেছিল। কাশবনে দু’জনকে চুমুরত অবস্থায় রসরাজ দেখেও ফেলেছিল, কিন্তু রসরাজ পাঁচ কান করেনি। আলাদা করে আড়ালে বলেছিল ওকে, পারবি বিয়ে করতে ? তখনকার দিনে এরকম বিয়ে কঠিন ছিল। শিবতোষ নাক খুঁটছিল, যদিও তখন ওর ডাক্তারির সেকেন্ড ইয়ার। রসরাজ বলেছিল, আর এরকম করিস না। বদনাম হলে ওকে বিয়ে দিতে পারব না। ক’দিন পরে শিবতোষ ওর বোনের কাছ থেকে জানতে পেরেছিল রসরাজের বোন যুথিকার হাতে গরম তেল পড়ে ফোসকা পড়েছে। শিবতোষ কাকেই বা জিজ্ঞাসা করবে ওটা খুন্তির ছ্যাকা কি না ? পরে কিন্তু শিবতোষই রসরাজকে ডাকযোগে অ্যালোপ্যাথি শিক্ষা, সচিত্র মানবদেহ পরিচয় ইত্যাদি আনিয়ে দিয়েছিল। চণ্ডীচরণ চ্যাটার্জির ফিজিওলজি বইয়ের ছবি বুঝিয়ে দিয়েছিল। ওর ব্যাচমেট সতীশ কোঙার বর্ধমানে প্র্যাকটিস শুরু করলে ওকে কম্পাউন্ডার বানিয়ে দিয়েছিল। তারপর রসরাজ ভাগলপুর থেকে ছ’ হাজার টাকা খরচ করে রেজিস্টার্ড মেডিকেল প্র্যাকটিশনার সার্টিফিকেট আনিয়ে নিয়েছিল, তা সত্ত্বেও ডা. পালধি এম বি বি এস, একজন আর এম পি-কে বলতে পারছেন না— তুই বরং বোস না ভাই সপ্তাহে দুই দিন। সেই অপরাধ বোধ ? আচ্ছা, রসরাজ তো নিজে থেকেই বলতে পারত যে তোর চিন্তা নেই, আমিই বসব।

ডা. পালধি শেষ অব্দি বলেই ফেলল— তা হলে তুই একটা উপায় বাতলে দে রসরাজ।

রসরাজ বলল, দেখি, বুদবুদের সি এইচ এস ও-কে বলে দেখি, মাসে কিছু দিলে যদি আসে। সি এইচ এস ও মানে হচ্ছে তিন বছরের কোর্সের ডাক্তার। প্রয়াত প্রমোদ দাশগুপ্তের আইডিয়াতে তিন বছরের ডাক্তারি কোর্স চালু হয়েছিল। ওদের এখন অবস্থা খারাপ। মেডিকেল কাউন্সিল স্বীকৃতি দেয়নি, ওরাই গ্রামে পড়ে থাকে। কোনও প্রমোশনও নেই।

পালধি চুপচাপ। অপারেশন টেবিলে রসরাজও। রসরাজ বলল, আমার পেসেন্টরা সব বসে আছে অনেকক্ষণ…। পালধির অভিমান হল খুব। বাজারের বাইরে বের হলেন। রিকশা নিলেন একটা। রিকশাওলাকে বললেন, ‘কেশরকুনি যাব।’ রিকশাওয়ালা বলল, বহু দূর, বারো টাকা লাগবে। ঘাড়টা তেড়া, যেন উঠলে উঠুন—না উঠলে দরকার নেই। রিকশাওয়ালারা এ রকম ছিল না।

রাস্তার দু’পাশে সবুজের ব্যস্ততা। মাঠের বিশ্রাম নেই, এটা উঠলে তো ওটা রুয়ে দাও। রিকশাওয়ালাটির পিঠে চোখ পড়ল ডা. পালধির। ফোসকার মতো বেশ কয়েকটা। রিকশাটা থামাতে বললেন। ডা. পালধি পিঠটা দেখতে থাকেন। জি টি রোড দিয়ে ট্রাক ভরতি, মিৎসুবিসি— ওনিডা—কেলভিনেটার চলে যায়। রিকশাওয়ালাটির গায়ে এইট্টি স্পিডের হাওয়া লাগে। পালধি জিজ্ঞাসা করেন— খুব জ্বালা করে ? ছেলেটি বলল, করে।

খুব ?

মোটামুটি।

মোটামুটি মানে ?

গরম তেলের ফোস্কা লাগলে যেমন…

কদিন হয়েছে ?

গত মঙ্গলবারের দিন।

এ তো হারপিস জস্টার। পালধির মনে ছোট্ট হিসেব হয়ে গেল— চল্লিশ টাকা।

চিকিৎসা করাসনি ?

না ?

কেন ?

চিকেচ্ছা করিয়ে কী হবে। এটা একটা পাপ বেরিয়েছে। পাপ।

পাপ ?

আজ্ঞা।

কী পাপ ?

সে আছে।

এইসব কুসংস্কার নিয়েই গ্রামের মানুষরা সব বেঁচে আছে। অজ্ঞানতা, অশিক্ষা…। কিছু করার নেই। সাইকেল রিকশা গ্রাম্যশোভা ভেদ করে যায়। বটগাছ লাল বটফলে ভরে আছে। কাঠবিড়ালীর আনাগোনা। বটগাছের তলায় একটা লোককে ঘিরে তিন-চার জন বসে আছে। টুকরো কাগজে কী লিখে দিল লোকটা ? সাট্টার নম্বর ? সবুজ ধানে অবুঝ ঢেউ। পল্লিবধূ কলসি কাঁখে জল আনিতে যায়… কলসি কোথায় ? পলিথিনের জারিকেন জারিকেনে কী ? দিশি ? আহা ! কী বিশাল আকাশ। বেলঘরিয়াতে আকাশই দেখা হয় না। কী সুন্দর পাখি দোল খাইতেছে তরুশাখে। তরুশাখা নয়, ইলেকট্রিকের তার। তার থেকে হুক করছে কারেন্ট ওই চায়ের দোকানে। ডোবাতে বালক-বালিকা খেলা করিতেছে। খেলা না, গেঁড়ি-গুগলি খুঁজছে। ওই সেই হেলে যাওয়া মন্দির। মন্দিরের পাশে শহিদ বেদি। জোতদারের গুণ্ডাদের দ্বারা…। ওখানে এখন কী যেন হচ্ছে। সবুজ রঙের আবির উড়ছে। এখন আবিরের রং-এ কত কিছু বোঝা যায়। কী গ্রাম কী হয়ে গেল…।

কত ছিল ভাই ভাব

কতই শান্তি ছিল, যদিও অভাব

ম্যান্যজনে মান পেত, গরিব পেত দয়া,

বললে লোকে কথা শুনত, করিত না তর্ক।

মিলল না। না মিলুক বহুদিন পরে অন্তরে কেমন কাব্য জেগেছে। বেলঘরিয়ায় প্র্যাকটিসের ব্যস্ততায় এইসব সূক্ষ্ম অনুভূতির প্রজাপতি শুয়োঁপোকা হয়েই থাকে।

সেগুনের একটা হলুদ পাতা উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে পালধি ডাক্তারের ঠিক কোলে এসে পড়ল। দু’ পাশের রাস্তায় আকাশমণি গাছ। সামাজিক বন। সেগুন পাতা এল কোত্থেকে ? বাবার কথা মনে পড়ল ফের। ডা, পালধি ওর বাবার একটা ডায়েরি পেয়েছিলেন, তাতে নানারকম মনের কথা লেখা ছিল পদ্যে। যেমন—

সেগুনের বহু গুণ

দাম বাড়ে বহু গুণ

গোটা দশ সেগুন পুঁতে

সন্তানে রাখ দুধে ভাতে।

সেগুন-পাতাটা হাতে ধরে থাকেন ডাক্তার পালধি। মনে পড়ে বাবার লেখা—

সাতবর্ষ ধরি

বহু ব্যয় করি

পুত্ররে করিনু ডাক্তার।

তার হবে গাড়ি

তারই হবে বাড়ি

শতলোকে জানিবে নাম তার।

(আমি) রাখিব এ দেহ

জানিবে না কেহ

কী বা মোর ছিল অবদান।

আমি ভাবি মনে

ডাক্তারি পিছনে

রয়েছে ক’ হাজার বস্তা ধান।

(যদি) ডাক্তারি না পড়িত

(মোর) জমি বেড়ে যেত

কিম্বা করিতাম চাল কল।

গীতা কাছে আনি

মনে স্মরি বাণী

কর্ম কর, চাহিও না ফল।

বাবার মৃত্যুর পর নীল ডায়েরিটা হাতে পড়েছিল পালধির। কবিতাটা পড়েছিলেন। তখনই সংকল্প করেছিলেন বাবার নামে একটা দাতব্য চিকিৎসালয় করবেন। পিতৃঋণ তো শোধ হয় না, তবু যদি কিছুটা…।

যেদিন উদ্বোধন হবে, সেদিন যে বক্তৃতাটা দেবেন সেটাও কাব্যে দেবেন ভেবেছিলেন পালধি। পুরোটা না হলেও কিছুটা। বাবার থেকে কিছুটা কাব্যের জিন পালধির ক্রোমোজমেও এসেছে। বাবার একটু সাহিত্যবাতিক ছিল। বাবার কাঁঠাল কাঠের আলমারিতে কপালকুণ্ডলা, শ্রীকান্ত, অল পারপাস ইজি লেটার রাইটিং, দলিল লিখন, গৃহস্থের বন্ধু, রাই উন্মাদিনী, পাষাণের কান্না, প্রেমের আলেয়া, যাবার বেলায় পিছু ডেকো না, এ রকম কত বই রয়েছে। গতবার যখন এসেছিলেন, মুনিষ ডাকিয়ে আম-বকুলের পোকা মারার মেটাসিড স্প্রে করিয়েছিলেন আলমারিতে।

ডা. পালধি রিকশায় বসে ডি ভি সি বিধৌত ধান খেতের ওপারে দেখলেন অস্তগামী সূর্যের রিবোফ্লাবিন ট্যাবলেটের মতো রং। বকেরা ফিরছে। মাঠ দাপানো ডিজেল গন্ধ মাখা বাতাসে হাওয়াই শার্টের কলার কাঁপছে। পালধির মনে মনে ভাব এল।

পিতঃ, বহু ঋণে বেঁধেছ আমারে

সাধ্য নাই পিতৃ ঋণ শোধ করিবারে

তুমি ছিলে মহাপ্রাণ পুত্র বৎসল…

তারপর এই গোধূলি আলোয় অনন্ত চরাচরে সত্যি কথাটা বুকের ভিতরে এল—

লইয়াছি কত টাকা করি কত ছল।

কিন্তু এ সব কি প্রকাশ্যে বলা যায় ? এই একাকী অবস্থায় পালধির পুরনো কথা মনে হয়। কত টাকা কতভাবে উড়িয়েছে। অমিত, পিনাকী, বনশ্রী, আলপনাদের কথা মনে এল।

তুমি যবে শয্যা নিয়া ডাকিতেছ মোরে আমি মূঢ় মোহগ্রস্ত প্র্যাকটিসের ঘোরে—

এটা অনুতাপ। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এটা বলবেন পালধি। এম বি বি এস পাস করার পর প্রথম চাকরি আগরপাড়া জুট মিলে। বেলঘরিয়ায় ঘর ভাড়া করে থাকা। তারপর ওখানেই প্র্যাকটিস। বাড়ি কেনা, একদম রাস্তার উপর। নীচে চেম্বার। তারপর রোজগার আর ইনকাম। ইনকাম আর রোজগার। রোজগারের কত রকমের রাস্তা, কত রকম টেকনিক।

অন্ধকার নামছে। রিকশাওয়ালাটার পিঠের ওই হারপিস ঘা-কে অন্ধকার ঢেকে দিয়েছে। বাঁদিকে মোরামের রাস্তা। সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র ! ডা. পালধি হঠাৎই বললেন, বাঁদিকে ঘোরাও তো একটু, বাঁদিকে ঘোরাও। হাসপাতালে যাব। হঠাৎই ওই লেডি ডাক্তারটির কথা মনে হল পালধির। রসরাজের কাছে শুনেছিলেন এই হাসপাতলের ডাক্তারটি কোয়ার্টারেই থাকেন। ওকেই যদি একটু রিকোয়েস্ট করা যায়…!

রিকশাওয়ালাটি জিজ্ঞাসা করল, কার কাছে যাবেন ?

লেডি ডাক্তার।

আপনার কী রোগ ?

কঠিন প্রশ্ন। রিকশার টায়ারের সঙ্গে এখন পথের মোরামের কথা হচ্ছে খর খর—- খর খর। আমার একটু হাইপার টেনশন। বি পি ওয়ান ফিপটি বাই হানড্রেড টেন। একটু ইউসনফিল বেশি। একটু কুশিং সিনড্রোম, একটু ডারমাটো মাইওয়াসাইটিস। চোখের নীচটা ফোলা ফোলা, লোকে ভাবে খুব মাল খাই। আর একটা রোগ আছে। শান্তি পাই না। কিছুতেই শান্তি নাইরে ভাই…।

তিন

বারান্দার সামনে জুঁই লতিয়েছে। একটা কম পাওয়ারের বাল্‌ব জ্বলছে। ওখানে একটা বেতের চেয়ারে বসে চশমা চোখে, পাঞ্জাবি পরা একটা মেয়ে সিগারেট টানছে। কানে হেড ফোন। ক্যাসেট চলছে। রিকশাটা ওখানে থামতেই মেয়েটা কান থেকে হেড ফোন সরাল। শচীনদেবের গান। মেয়েটা সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলল— ‘কী ডাক্তার, কী খবর ?’

এ কেমন মেয়েছেলে ? ডা. পালধি ভীষণ অবাক। পালধিকে চেনে তা হলে। প্রথম দর্শনে এ কেমন সম্বোধন ? মাল-ফাল খেয়ে আছে নাকি? বিচিত্র নয়। সিগারেট ফুঁকছে যখন…

রিকশাওয়ালা বলল, ভাল আছি দিদি। আপনি ?

ভাল। তোমার ওই অর্জুনপুরের পেসেন্টের খবর কী ?

ইকেবারে আরাম হঁয়ে গেছে। চাষের কাজে লেব্যে গেছে।

ফাস ক্লাস।

ডা. পালধি ব্যাপারটা ঠাহর করতে পারেন না। কোনও ইয়ারকি নাকি ? পালধি ওদের দেখতে থাকেন।

মেয়েটা এবার পালধির দিকে তাকায়। সিগারেটটা ফেলে দেয়। বলে, বলুন, কী ব্যাপার।

ডাক্তার পালধি কীভাবে কথা শুরু করবেন বুঝে পান না। বলেন, আপনিই বুঝি এই পি এইচ সি-র…

হ্যাঁ, আমিই ইনচার্জ।

আপনি নাকি সবসময় এই হাসপাতালেই থাকেন…

হ্যাঁ, থাকি তো, দেখতেই পাচ্ছেন।

আমি ডাক্তার শিবতোষ পালধি। এখান থেকে দু’ কিলোমিটার দূরে কেশরকুনি গ্রামে আমার বাড়ি। কিন্তু কলকাতায় থাকি, ওখানেই প্র্যাকটিস করি। আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে।

লেডি ডাক্তার জোড়হাত করেন। বলেন, আসুন, ভিতরে আসুন।

পালধি বললেন— না না, এখানেই হয়ে যাবে। অল্প দুটো কথা।

লেডি ডাক্তার এগিয়ে গিয়ে ঘরের দরজা খুললেন। দরজার গায়ে কাঠের ব্লকে লেখা ডা. রত্ন সরকার, এম বি বি এস, ডি সি এইচ।

ঘরে বেতের চেয়ার ডবল খাট। খাটে একজন বৃদ্ধা বসে টিভি দেখছেন। লেডি ডাক্তার বললেন, আমার ঠাকুরমা। আমি আর ঠাকুরমা থাকি। ডা, পালধি মেয়েটির মাথার দিকে তাকিয়ে সিঁদুরের চিহ্ন খুঁজতে থাকলেন। আজকালকার মেয়েরা অনেকে বয়কাট চুলেও এক কুচি সিঁদুর লাগিয়ে রাখে।

বলুন কী ব্যাপার। লেডি ডাক্তার বলেন। পালধি তার মনোবাসনার কথা জানান। তারপর দু’বার আঙুল মটকিয়ে বলেন, বলছিলাম কী, আপনি যদি কাইন্ডলি সপ্তাহে দু’দিন করে আসেন…। আমি কিছু অনারিয়ামের ব্যবস্থা রেখেছি…

লেডি ডাক্তারটি বললেন— আচ্ছা, আমি ধরুন গেলাম, রুগি দেখলাম, প্রেসক্রিপশন করলাম, কিন্তু ওষুধপত্র ?

তাও কিছু কিছু কিনে দেব। যেমন ধরুন কারমিনেটিভ মিক্সচার, এলকালি মিক্সচার, কিছু মেট্রোজিল, সারফাগুয়ানিডিন, ক্লোরোকুইন আর মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভদের কাছ থেকে চেয়ে চিন্তে…।

এসব লাল ওষুধ— সাদা ওষুধ তো আমার হাসপাতালেই আছে। আপনি মেবিনডাজোল দিতে পারবেন— যা কৃমির উৎপাত ! ডক্সিসাইক্লিন দিতে পারবেন ? এরিথ্রোমাইসিন ? পেপটিক আলসারের জন্য র‌্যানিটিডিন ? ওমিপ্রাজোল দিতে পারবেন ?

বড্ড কস্টলি এসব…।

তবে আর বাবার স্মৃতি করে কী লাভ ?

ডাক্তার পালধি কিছুক্ষণ চুপচাপ। এ সময় মাথা চুলকোনো আনস্মার্টনেস। সোজাসুজি বললেন— তা হলে যাবেন না, এই তো ? লেডি ডাক্তার বললেন— যাব না বলিনি। আমার তো যেতেই হয় ওধারে। সাঁওতায় আমাদের সাবসিডারি হেল্‌থ সেন্টার আছে। আপনার গ্রামেও যাই। ওখানে আমাদের হেল্‌থ ওয়ার্কার আছেন— মালতী গড়াই। আমি যাব। এই কারণেই যাব— আপনি আজ ছোট করে শুরু করলে কাল ওটা বড় হতে পারে। আমি আজ ওখানে বসতে শুরু করলে কাল অন্য কেউ বসবে। কাজটা শুরু হোক না। আমি যাব। পালধির হাসি ফুটল মুখে। জুঁই ফুলের গন্ধ নিয়ে বাতাস ঢুকল ঘরে। লেডি ডাক্তারের বুড়ি ঠাকুরমা ইশারায় ডাক্তার নাতনিকে চা করার কথা বলেন। পালধি বলে, তা হলে কার্ড ছাপাই ? আপনার নাম লিখি ম্যাডাম ? লেডি ডাক্তার হাসলেন, ছোট্ট করে মাথা নাড়লেন। আর বললেন, এক মিনিট। ভিতরে গেলেন। চা-চামচের টুং টাং। ডা. পালধির গান মনে এল মধুর মধুর ধ্বনি বাজে। ওর মেয়ে গায়।

চায়ের ট্রে নিয়ে ঢুকলেন ডা, রত্না সরকার। তিনটে চা।

ডাক্তার— চা নিয়ে যাও…।

রিকশাওয়ালাটি ঘরে এসে চা নিল। পালধি বললেন, আচ্ছা, একটা কথা। আপনি যে বড় ওকে ডাক্তার ডাকেন, ও আবার রেসপন্ডও করে, ব্যাপারটা কী ?

রত্না খিলখিল করে হাসলেন। অনেকটা হাসি। হাসতে হাসতেই বললেন, ‘ও তো ডাক্তারই। তবে বলি, শুনুন। আমার কাছে ও প্রথম যেদিন এল একটা মেয়েকে এনেছিল। পোস্ট ডেলিভারি পেইন উইথ পিউএরপেরাল ফিভার। বলছে— আমার চিকিচ্ছেয় কাজ হল না, তাই আপনার কাছে আনলাম।

কী চিকিচ্ছে করে ও ? ঝাড়ফুঁক ?

ওকেই জিজ্ঞাসা করুন না।

রিকশাওয়ালাটা মেঝেতে বসে চা খাচ্ছিল। ও খুব বিনয়ের সঙ্গেই বলল— নাঃ আইজ্ঞে, সে রকম কিছু লয়, আমি তিনটা রোগের ওষুধ জানি। আমার বাপ আমায় বইলে গেছিলেন। আর কিছু না।

কী কী রোগ ?

ওই তো, কানপাকা, হেঁতাল ব্যথা, আর অর্শ রোগ।

কী চিকিচ্ছে ?

লতাপাতা

কান পাকায় কী দাও ?

কানশিরে পাতার বোঁটা ভেঙে রস।

হেঁতাল ব্যথাটা কী—

রত্না তখন বলেছিল, ‘পোস্ট ডেলিভারি পেইন।’

কী ওষুধ ?

বাপ চিনিয়ে দেছিল, গাছের নাম জানি না।

পালধি উঠলেন। বললেন, আপনি আমায় বাঁচালেন ম্যাডাম। আবার এসে কথা বলে যাব আসি।

রিকশাওয়ালাও বলল, আসি দিদি।

রত্না ওই রিকশাওয়ালাটির পিঠে হাত রাখলেন। রিকশাওয়ালা কঁকিয়ে উঠল।

কী রে, তোর পিঠে কী হয়েছে ?

ও কিছু না।

রিকশায় উঠে বেশ এবার একটা শান্তি শান্তি ভাব। আকাশে বরিক পাউডার মাখানো চাঁদ, ইউক্যালিপটাসের সামাজিক বনে চাঁদের আলোর অ্যানাসথেসিয়া।

সিগারেটখোর মেয়েটার জন্যই ওর কাজটা হতে চলেছে। বাবার আত্মা শান্তি পেতে চলেছে। পিতৃঋণের অন্তত একটা ইনস্টলমেন্ট শোধ হতে চলেছে। অবশ্য সিগারেট তো আজকাল অনেক মেয়েই খায়। টিভিতে তো হরদম দেখা যায়। আজকালেই বা কেন ? ডাক্তারি ক্লাসের আইভি বলে মেয়েটা, সে-ও তো খেত। খাগ গে সিগ্রেট, যদিও রিগ্রেট, তবে যাই বলো, মেয়েটার ব্যাভার কিন্তু মন্দ নয়। তা, বে’ থা করেনি কেন ? ওর কি বাপ-মা নেই ? আবার ঠাকমাকে নিয়েই বা আছে কেন ? ঝামেলা ভাল লাগে ? কাকা-জ্যাঠা-পিসি কেউ নেই তো আর হতে পারে না, এই রিকশাওয়ালাটার সঙ্গে ওর এত ভাব হল কী করে, কে জানে। ডা. পালধি রিকশাওয়ালাকে বললেন, হ্যাঁরে, ডাক্তার দিদিমণির সঙ্গে তোর এত ভাব হল কী করে র‌্যা ?

আমিও চিকিচ্ছে করি, উনিও করেন, তা বাদে আমুও রুগি দেখে ট্যাকা লি না, উনিও ল্যান না।

ওব্বাবা !

আমুও আমার সুখদুখের কথা উকে বলি, উ-ও সুখদুখ কথা আমাকে বল্যেন।

বাবা ! তোদের খুব মিল দেকচি।

মিল, কিন্তু গরমিলও আচে।

নাটকীয়ভাবে এইটুকু বলেই রিকশাওয়ালাটা ডানদিকে রিকশা ঘোরাল। কাঁচা রাস্তাটা দিয়ে কেশরকুনি কিলোমিটারটাক। বিশাল বটগাছটার তলা দিয়ে যাবার সময় ডান হাতটা হ্যান্ডেল ছেড়ে কপালে ছোঁয়াল।

মিল তো শুনলাম। এবার গরমিল কিছু কিছু শুনি ? পায়ের উপর পা তুলে বেশ আরাম করে রিকশার সিটে বসে আছেন পালধি ডাক্তার।

গরমিল তো অনেকই আছে। তার মধ্যে পরধান হচ্ছে— দিদিমণির কমমো তার বাপের দায় আর আমার ধমমো আমার বাপ যা চায়। ঝিঁঝির আওয়াজ, আকাশে ছায়াপথ, দূরে ট্রাক যায়। হেঁয়ালি হেঁয়ালি।

বাপের দায় মানে ?

মানে ? মানে হলগে—ওই দিদিমণির বাবা হচ্ছেন গে ডাক্তার। কলকাতার মধ্যে মানিকতলা আছে, হোতায় বসে।

ও, আচ্ছা।

রুগি ছুঁলেই পঞ্চাশ ট্যাকা লেয়।

বেশ তো।

রুগি এলেই বেলাড টেস পেসাব টেস। বর্ধমানের হোটেলে খদ্দের ধরে আনলে রিকশাওয়ালা যেমন কমিশন নেয়, ওই দিদিমণির বাপও তেমন কমিশন লেয়।

ঠিক আছে।

কমিশনের লোভে মিছামিছি টেস করায়।

ও।

কমিশনের লোভে শুধুমুদু বুকের কাঠির ফটোক তোলায়।

নাকি ?

তা বাদে সরকারি বাবুদের মিছা চিকিচ্ছার হিসাব দিয়ে কমিশন লেয়।

পালধি নিশ্চুপ।

দিদিমণির এসব মোটে পছন্দ লয়। এজন্য পটে না। ওই জন্যে ঘরে থাকে না। ওই জন্য ঠাকমা লিয়্যেঁ চলে আঁস্যেছে। বাপের কাজ নিজে করে ধম্মে থাকছে থির।

হাওয়াটা কি বন্ধ হয়ে গেল ? গা-টা একটু জ্বলছে। ইউসেনফিল বাড়ল নাকি ? চাঁদটা কি মেঘে ঢাকল ? অন্ধকার। পালধি কোনও কথা বলছেন না।

আর আমার কথা বলি। শুনছেন বাবু ? আকাশে ছায়াপথ। নক্ষত্রের হিরে কুঁচি। পালধি বললেন— বলো।

আমার বাপ আমাকে ক’টা গাছ চিন্যে দে বলেছিল, এই গাছ এইভাবে ব্যাভার করবি, আর রুগি এলে ফির‌্যা দিবি না, আর এ কাজে ট্যাকা পয়সা লিবি না। বুঝলেন বাবু ? পালধি জোনাকি দেখেন।

আমার ঠাকুরদাদা ছিলেন রোজা। তেনারও ছিল এমন ভাব। বিদ্যে বেচে পয়সা লিত না। বুঝলেন বাবু।

জোনাকি ! জোনাকি !

আমি বুইজলেন, একটা পাপ করে ফেল্যাছি। দিদিমণিকে ওটা বলব ভেবেছিলাম, লজ্জায় বলা হয়নি। রিকশাটা একটু থামায় ও। বলল, বড্ড অন্ধকার, লম্পটা ধরাব।

ও দেশলাই জ্বালে। চরাচর ভর অন্ধকারের মধ্য রিকশাওয়ালাটির মুখ। ও লম্প ধরায়।

পাপের কথাটা বল্যেই ফেলি আইজ্ঞা। একটা রুগি বাড়ি গিয়েছিলাম শনিবার। মেয়াঁছেলে। পরথম পোয়াতি। খুব সোন্দর। হেতাল ব্যথা। ওষুধ দিলাম। সোমবার দেখতে গেলাম।

ও চুপ করল। আর কিছু না বললেও পালধি ডাক্তার বুঝতে পারছেন কী পাপ। সুন্দর রোগিণীর সামনে নিজেকে কন্ট্রোলে রাখাটা…

গিয়ে দেখি ব্যথা নেই। আরাম হঁয়ে গেছে। মেয়াঁটার বাবা টাকা দিতে চাইল। উরা বড়নোক। আমার সামনে ধরা একটা পঞ্চাশ ট্যাকার নোট বাতাসে কাঁপছে। ট্যাকাটা লিয়ে নিলাম গো বাবু, গলসি বাজার থেকে একটা হরলিস কিনলাম আমার ছেল্যেটার জন্য, আর মঙ্গলবারে আমার পিঠ ফুঁড়ে বেরুল পাপ। পাপের চিন্ন।

কী একটা পাখি ডেকে গেল।

দু’ পাশের অন্ধকারকে সাপটে ধরতে চাইলেন পালধি। হাওয়া নেই। গায়ে বড় জ্বালা। পাপ ? আকাশটা বড় ঝুঁকে পড়েছে গায়ের ওপর। আকাশ, ক্ষমা করো। নিজের মাটি, দেশের মাটি, ক্ষমা চাইছি, বটবৃক্ষ, একটু ক্ষমা দাও। চোখে জল আসে কেন ? ধুস।

চারিপাশের অন্ধকারে রিকশাটার কেরোসিন আলোয় রিকশাওয়ালাটার মুখ জ্বলছে। পালধি বললেন, বাকি রাস্তাটুকু হেঁটেই চলে যাব রে। বুঝলি।

শারদীয় বর্তমান, ১৯৯৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *