ডাক্তারের দপ্তর
।। এক ।।
শ্যামাসেহানবিশ, মুচিপাড়া থার্ড বাইলেন। আপনি লিখেছেন, ‘আমার গায়ের রং ছিল কালো। পাছে মনে দু:খ পাই, তাই সকলে বলতেন, শ্যামা আমাদের উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা। পাত্রপাত্রীর কলামে আমার জন্যে ইতিমধ্যেই দু-একটি বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে। তাতেও ওই একই কথা লেখা হয়েছে, গৃহকর্মে সুনিপুণা, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি আপনাকে চিঠি লিখছি যে কারণে, তা হল, ওই বিজ্ঞাপনের গুণে কিনা জানি না, দিন-দিন আমি সাদা হয়ে যাচ্ছি। কী রকম সাদা জানেন? কেমন যেন ফ্যাকাশে, ইটচাপা ঘাসের মতো। আয়নার সামনে দাঁড়ালে ভয় করে। চোখের মণিদুটোও বেড়ালের মতো ক’টা হয়ে আসছে। চুলও আর তেমন কুচকুচে কালো নেই। হাতের লোম কেমন যেন বাদামি-বাদামি হয়ে গেছে। এ আমার কী হল? আমি কোনও ব্লিচটিলচ ব্যবহার করি না। রক্তশূন্যতা, তা-ই বা বলি কী করে! মাথা ঘোরে না, দুর্বল লাগে না। আপনি অনুগ্রহ করে আলোকপাত করে আমার দুর্ভাবনা দূর করুন। আমার কি লিউকোমিয়া হয়েছে?’
শ্যামাদেবী, আপনার দুর্ভাবনার কোনও কারণ নেই। এই ঘটনা অনেকের জীবনেই ঘটেছে। মানুষ কেন, সব প্রাণীই প্রকৃতিনির্ভর। বিবর্তনের নিয়ম অনুসারে জীবজগতে হাজার-হাজার বছর ধরে একটু-একটু করে পরিবর্তন এসেছে। জিরাফের গলা লম্বা হয়েছে। উটের পিঠে কুঁজ এসেছে। ক্যাঙারুর পেছনের পা দুটো লম্বা হয়েছে। ক্রমে-ক্রমে বানরের ন্যাজ খসে মানুষ হয়েছে। সব গতিরই দুটো দিক আছে, অনেকটা গাড়ির মতো, সামনেও এগোতে পারে, পেছনেও যেতে পারে, কোনও বাধা নেই—ফরোয়ার্ড মুভমেন্ট, ব্যাকওয়ার্ড মুভমেন্ট। গিয়ারের খেলা। জীব পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিছু চেষ্টা চলে সজ্ঞানে, কিছু অজ্ঞানে, অর্থাৎ আপনাআপনিই হতে থাকে। একটা ঘটনার কথা বললে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। আমার এক বন্ধু তোলা উনুনকে তালাক দিয়ে গ্যাস নিয়েছিল। ভেবেছিল, ব্যাপারটা বুঝি খুব সহজ। বেচারা আশির দশকের কলকাতাকে ঠিক চিনতে পারেনি। আসলে দেশটাকে তার কাছে, কাগজে কলমে, বক্তৃতায়, পরিকল্পনায়, বিজ্ঞাপনে যেভাবে হাজির করা হয়েছিল, সেটা ছিল অনেকটা একালের খাঁটি দুধের মতো। তিনের চার ভাগই জল। রকের ভাষায় একে বলে গ্যাস খাওয়ানো। আমার সেই গ্যাসিফায়েড বন্ধুটির জ্ঞানচক্ষু যখন খুলল, তখন আর বুঝতে বাকি রইল না, যে গ্যাসে দেশ চলেছে, সে গ্যাস সিলিন্ডারে নেই, সে গ্যাস জ্বলে না, সে গ্যাস হল ফুসফুসের গ্যাস, বক্তৃতার হাপরের টানে ফুসুর-ফুসুর বেরোয়, কর্মহীন বাক্যস্রোতে পাকিয়ে-পাকিয়ে আসে। আসল যে গ্যাস, তা একবার ফুরোলে, আর একটি সিলিন্ডার কবে আসবে কেউ জানে না। আর গ্যাসের ধর্ম গ্যাসের মতোই, এই ছিল, এই নেই। অনেকটা চামচাদের মতো স্বভাব। বেশ জিন্দাবাদ- জিন্দাবাদ করছে। দাদা, দাদা করছে। হঠাৎ কোনও এক ফাইন মর্নিং-এ দেখা গেল কাকস্য পরিবেদনা। গ্যাসের গ্যাঁড়াকলে পড়ে, বেচারার প্রথম অভ্যাস হল, আধকাঁচা খাওয়া। চাল-চাল ভাত, ক্যাঁচকেঁচে আলু। কাঁটা থেকে সহজে ছেড়ে আসতে চায় না এমন মাছ। দরকচা মারা ঢ্যাঁড়স। আর ঝিঙে। ভিটামিনে ভরপুর। আজ খেলে, কাল হজম হয়। আধকাঁচা মাছ আর মাংস খেতে-খেতে স্বভাবের পরিবর্তন হতে লাগল। কেমন যেন মার্জার, শার্দুল-শার্দুল ভাব এসে গেছে। হাতপায়ের নখ ছুঁচলো হয়ে সামনের দিকে বেঁকে গেছে। চোখের মণি গোল থেকে ওপরে নীচে লম্বাটে হয়েছে। কেউ কাউকে সোহাগ করলে গলায় ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে। সংসার থেকে রান্নার পাঠ উঠে গেছে একেবারে। এখন সেখানে ধরো আর খাও। সময় আর খরচ দুটোই বাঁচছে। সকলের চেহারাও বেশ ফিরে গেছে। একটাই কেবল অসুবিধে, প্রত্যেকের আচার-আচরণ কিছুটা পালটে গেছে। তেমন আর নরম-নরম, মানুষ-মানুষ ভাব নেই।
শ্যামাদেবী, বিবর্তনের একটা ধাপে মানুষ দীর্ঘকাল আটকে ছিল। একই চেহারা, একই ধরনের স্বভাব। দ্বিপদ, দ্বিচক্ষুবিশিষ্ট লাঙ্গুলহীন এক জাতীয় বুদ্ধিমান প্রাণী। পরিবেশের চাপে মানুষের পরিবর্তন আসছে। চেহারায় ধরা-না পড়লেও আচার-আচরণে ধরা পড়ছে। মোটামুটি সকলেই বুঝতে পারছেন, মানুষ আর আগের মানুষ নেই। হয় অতিমানবের দিকে যাচ্ছে, না হয় যাচ্ছে অতিদানবের দিকে।
আপনি বিবর্ণ হচ্ছেন পরিবেশগত কারণে। অ্যানিমিয়া নয়, লিউকোমিয়াও নয়। এই ব্যাধির নাম ডার্কাসফার্সাস। লোডশেডিং-এর অন্ধকারে দিনের পর দিন থাকার ফলে গাত্রবর্ণ কালো থেকে ছাইছাই হয়ে ক্রমশ সাদাটে হচ্ছে। অন্ধকারে চোখ চালাতে-চালাতে, দেখার চেষ্টা করতে-করতে, চোখের তারা ঘুরে গিয়ে বেড়ালের মতো লম্বাটে হয়ে যাচ্ছে। ক্রমশ নীল কিংবা লাল কিংবা হলদেটে হয়ে যাবে। তখন আপনি রাতে স্পষ্ট দেখতে পাবেন। ইঁদুর দেখতে পাবেন, আঁস্তাকুড় দেখতে পাবেন, অন্ধকার ঘরে দেওয়ালের গায়ে উইচিংড়ি দেখে নেচে উঠবেন। কেউ বেশি বিরক্ত করলে, ফ্যাঁস করে আঁচড়ে দিতে ইচ্ছে করবে।
এ তো, ভাই, শাপে বর। রং ক’টা হলে বিয়ের ব্যাপারে সামান্য সুবিধা হওয়াই স্বাভাবিক। পাত্র ধরতে অন্তত হাজারপাঁচেক টাকা কম খরচ হবে। কালো জগৎ আলো, কাব্যের সান্ত্বনা। কালো সে যত কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ। সে হল কবির দৃষ্টি। কবিরা সাধারণত বিবাহের চেয়ে কাব্যোচিত প্রেমকেই বেশি প্রশ্রয় দেন। আপনি বেঁচে গেছেন। শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে কালো বলে গঞ্জনা সহ্য করতে হবে না। বিয়ের পরের পরের দিন সকালবেলা ও-মহল থেকে এ-মহলে কেউ তেড়ে আসবে না : ও মশাই, গোটাদুই ওয়াশের পর আপনার মেয়ে আরও কালো হয়ে গেছে, একসট্রা ফাইভ থাউজেন্ড ছাড়ুন। সেই ফাইভ ছাড়তে না পারলেই, আপনাকে হয়তো পাখার ব্লেড থেকে ঝুলতে হবে—টিকিটে লেখা থাকবে—মারার আগেই মরে গেছি, বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ চোষো।
।। দুই ।।
বিমান সিংহ, বর্মন স্ট্রিট থেকে লিখেছেন : ‘দিন-দিন আমি ছোট হয়ে যাচ্ছি। মনে নয়, দেহে। আমার উচ্চতা প্রায় ইঞ্চিখানেক কমে গেছে। ঘেরেও অনেকটা কমে গেছি। উচ্চতা কমেছে কী করে বুঝলুম, বলছি শুনুন। আমার শ্বশুর মহাশয় বিবাহের সময় যে খাটটি প্রথামত দিয়েছিলেন, তার দৈর্ঘ্য ছিল আমার স্ত্রীর মাপে। এর পেছনে নিশ্চয়ই তাঁর ব্যবসায়িক বুদ্ধি কাজ করেছিল : কারণ তিনি ছিলেন ঠিকাদার। লম্বায় খাটের মাপ খাটো করায় শ-পাঁচেক টাকা নিশ্চয়ই কম লেগেছিল। সেই পাঁচশোতে তিনি প্রথম জামাইষষ্ঠীটি সেরে প্রমাণ করেছিলেন, জামাইয়ের তেলে জামাই ভাজা যায়। অবান্তর কথা কিছু বলে ফেললুম, ক্ষমা করবেন। একে বলে গাত্রদাহ। সেই খাটে শুলে আমার পা তিন ইঞ্চি পরিমাণে বেরিয়ে যেত। স্ত্রীকে তাঁর পিতার মানসিক সঙ্কীর্ণতার কথা বলায় আমাকে সাধু ভাষায় বলেছিলেন—অন্যে সঙ্কীর্ণ হইলেও আপনে মহৎ হইয়া পা কিঞ্চিৎ হাঁটুর কাছ হইতে য়ামুড়ি কুকুরকুন্ডুলী হইয়া শয়ন করিয়া প্রমাণ করহ, আপনি অনুদার হইলেও আমার উদার হইতে বাধা নাই। আপনার পদদ্বয় যন্ত্রদানবের ন্যায় লৌহ নির্মিত নহে। শৈশবে অবশ্যই শুনিয়া থাকিবেন সেই অপূর্ব নীতি উপদেশ—যদি হয় সুজন তেঁতুল পাতায় ন’জন, যদি হয় কুজন মান পাতায় একজন। দিনকয়েক হইল হঠাৎ আবিষ্কার করিলাম আমারও শুদ্ধ ভাষা আসিতেছে, আমি খাটের মাপে এসে গেছি। ডাক্তারবাবু, আমার কেবলই ভয় হচ্ছে, এই রেটে কমতে থাকলে আমাকে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো হামা দিতে হবে। কেন এমন হল?
বিমানবাবু, আপনার দীর্ঘ চিঠি পড়লাম। আপনি অকারণে ভয় পাচ্ছেন। কলকাতার অনেকেরই দৈর্ঘ্য আর প্রস্থ ধীরে-ধীরে কমছে। এই ব্যাধির নাম—মিনিবাসাইটিস-বাঁটাইটিস। দীর্ঘকাল মিনিবাস নামক অদ্ভুত যানে চেপে ঘোরাফেরা করলে, দুটি অসুখ হতে পারে, প্রথমটির কথা বললুম, দ্বিতীয়টি হল—স্পন্ডিলাইটিস। দ্বিতীয় ব্যাধিটি আরও যন্ত্রণাদায়ক এবং কুৎসিত। সারাজীবন গলায় বগলস পরে আলসেশিয়ানের মতো ম্যানমেসিয়ান হয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়। এই ব্যাধি যে গ্রুপে পড়ে—সেই গ্রুপটির নাম প্রফেসনাল ডিজিজ। যেমন, যাঁরা বছরের পর বছর কোলে কুলো রেখে দুলে দুলে বিড়ি বাঁধেন, তাঁরা পরবর্তীকালে ওই পেশা পরিত্যাগ করলেও, কোথাও বসলেই দুলতে থাকেন, আর হাত দুটোকে বিড়ি পাকানোর ছন্দে ঘোরাতে থাকেন।
আপনারও হয়তো এমন অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে, বাসে কিম্বা সিনেমায় যিনি আপনার পাশে বসেছেন, তিনি বিরক্তিকরভাবে পা নাচাচ্ছেন। তাঁর সঙ্গে ঝগড়া করবেন না। জেনে রাখুন তিনি প্রফেসনাল ডিজিজে ভুগছেন—ভদ্রলোক হয় সেলাইকল চালান, নয়তো চালাতেন।
অনেকে, দেখবেন, কথা বলার সময় এপাশে, ওপাশে ভীষণ হাত নাড়েন। অনেক সময় আচমকা এই হাত নাড়ায় কারুর চোখের চশমা খসে যায়। যে চা নিয়ে আসছে, তার চায়ের কাপ ছিটকে চলে যায়। জেনে রাখুন, এও একই ব্যাধি। ভদ্রলোক এক সময় পুকুরে খ্যাপলা জাল ফেলতেন, মাথার ওপর হাত ঘুরিয়ে।
অনেকে, দেখবেন, কথা বলার সময় আচমকা চড়চাপড় মেরে দেন। বিশেষত মেয়েরা। জানবেন, এঁরা এক সময় মোগলাই পরটা তৈরি করতেন। মোগলাই পরোটা তৈরির সময় খুব চড়চাপড় মারতে হয়।
যাঁরা দাঁত তোলেন, তাঁরা অন্য কোনও জিনিস তোলার সময় হ্যাঁচকা টান মেরে তোলেন। এমন ঘটনাও ঘটেছে, ছেলেকে হাত ধরে তুলতে গিয়ে, হ্যাঁচ করে এমন টান মারলেন, হাতের খিল খুলে গেল।
আমার কাছে এক যুবক একবার চিকিৎসার জন্যে এসেছিলেন। তিনি চলতে গেলেই পায়ে পা জড়িয়ে পড়ে যেতেন। শক্ত সমর্থ যুবক। প্রেশার নর্মাল। হার্ট, লাংস, লিভার, পিলে সব নর্মাল, তবু কেন এমন হয়। প্রশ্ন করে-করে জানতে পারলুম, তিনি সাত বছর একটানা, প্রতিদিন ঘণ্টাতিনেক করে একটা গাছতলায় তাঁর প্রেমিকার জন্যে, পায়ে পা জড়িয়ে, কেষ্ট ঠাকুরটি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন।
বিমানবাবু, আপনি যদি আবার আপনার পূর্বের দৈর্ঘ্যে ফিরে আসতে চান, তাহলে মিনিবাস একেবারে বর্জন করুন। তা নাহলে আপনার আশঙ্কাই সত্য হবে। ক্রমে ছোট হতে-হতে শিশুর আকৃতি প্রাপ্ত হবেন। গোঁফ আর দাড়ি অবশ্য থেকেই যাবে। মাকুন্দ হওয়ার সম্ভবনা নেই। স্বভাবটি হয়ে যাবে নার্সারি-বালকের মতো। এই মানসিকতা এখনই এসে গেছে।
আমাদের চেতনাউদ্রেককারী জলাশয় নেই। এমন কেউ নেই, যে আমাদের হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে তার পাশে দাঁড় করিয়ে রেখে বলবে—ওই দ্যাখো, তুমি মানুষ। শুধু চেহারায় মানুষ না হয়ে মনে মানুষ হও। যাক, তা যখন হওয়ার আশা নেই, গোটাকতক মুষ্টিযোগ আপনাকে শিখিয়ে দি—এক, রোজ দাড়ি কামাবার সময় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকবেন। প্রথমে হাসবেন। দেখবেন, আপনার মুখও হাসছে। হাসি-হাসি মুখ, হাসি-হাসি চোখ, অনুভব করবেন নিজেই, দেখতে কত ভালো লাগে! দুই, এবার নিজেকেই নিজে চোখ রাঙাবেন, দাঁত খিঁচোবেন, দেখবেন বিশ্রী লাগছে। তিন, স্থির হয়ে নিজের হাসি-হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে, ধীরে-ধীরে সাতবার বলবেন, আমি মানুষ, নরখাদক নই, আমি মনে পূর্ণ, দেহে পূর্ণ।
সাতবার বলা শেষ হলেই, তড়াক করে লাফিয়ে উঠে জানালার গ্রিলের সবচেয়ে ওপরের পাটিটা দু-মুঠোয় চেপে ধরে চোখ বুজিয়ে ঝুলে থাকবেন তিন মিনিট। তখন মনে-মনে বলতে থাকবেন—আমি বড় হচ্ছি, আমি বড় হচ্ছি। সাবধান, ভুলেও ভাববেন না, আমি বাঁদর হচ্ছি।