ডাক্তারবাবু
সত্যি মিথ্যে জানি না।
হলফ করে কিছু বলতে পারব না।
ডাক্তারবাবুরা মানী লোক, তাঁরা আমাদের প্রাণের প্রহরী। তাঁদের নিয়ে হালকা ঠাট্টা, হাসাহাসি মোটেই উচিত নয়।
গল্পটা আমাকে যিনি বলেছেন, তাঁর নাম বলা যাবে না। তিনিও মানী ব্যক্তি, একটু রাখ-ঢাক করে গল্পটা লিখছি।
না লেখাই বোধহয় ভাল ছিল। কিন্তু আমার তো পরিত্রাণ নেই। দিনান্তে, নিশান্তে, মাসান্তে আমাকে অনবরত হাসির গল্প লিখতেই হবে। এই আমার নিয়তি।
ডাক্তারবাবুরা নিজ গুণে দয়া করে ক্ষমা করবেন, আগে যেমন অনেকবার করেছেন।
একদিন সন্ধ্যাবেলা দক্ষিণ কলকাতার একটি বাজার থেকে ডাক্তারবাবু পরিচারকসহ বাজার করে বেরচ্ছেন। এটি তাঁর নিয়মিত অভ্যাস। হাজারো চাপের মধ্যেও সন্ধ্যায় একবার বাজারে আসা চাই। নিজের পছন্দমতো তরিতরকারি, ফলমূল, মাছ কিনতে তিনি ভালবাসেন।
বাজার থেকে বেরনোর মুখে একই পাড়ার এক ভদ্রলোক, ডাক্তারবাবুর পুরনো রুগি, তাঁর সঙ্গে দেখা।
এই ভদ্রলোক একটু তরল প্রকৃতির। পুজোর পরে ভদ্রলোকের সঙ্গে ডাক্তারবাবুর এই প্রথম দেখা। ভদ্রলোক বাজারে ঢুকছেন, ডাক্তারবাবু বেরচ্ছেন। দু’জনে মুখোমুখি হতে ডাক্তারবাবু নমস্কার করে ভদ্রলোককে বললেন, ‘শুভ বিজয়া’। ভদ্রলোকও যথারীতি প্রতি নমস্কার জানিয়ে বললেন, ‘শুভ বিজয়া।’
দু’জনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, ডাক্তারবাবু এরপর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেমন আছেন?’
ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘কেমন আছি শুনলে আপনি খুশি হবেন না।’
বিস্মিত ডাক্তারবাবু বললেন, ‘মানে?’
ভদ্রলোক বললেন, ‘ভাল আছি। কিন্তু আমি ভাল থাকলে তো আপনারই ক্ষতি, সে কথা শুনলে আপনি খুশি হবেন কেন?’
এরপরে কী হয়েছিল, জানি না। কিন্তু যে ভদ্রলোক এই গল্পটা আমাকে বলেছেন তিনি অনেকদিন আগে ডাক্তারবাবুদের নিয়ে অন্য এক ব্যাপার বলেছিলেন। সে ব্যাপারটা আমি তখনকার পাঠক-পাঠিকাদের জানিয়ে ছিলাম, নতুনদের জন্যে আবার লিখছি।
অধিকাংশ ডাক্তারবাবু রুগিকে একটা ধরাবাঁধা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন, ‘রাতে কী খান?’
রুগির চিকিৎসার জন্যে তার নৈশাহারের খোঁজ নেওয়া খুব জরুরি নয়। ডাক্তাররা না কি এই প্রশ্নের মাধ্যমে জেনে নিতে চান, রোগীর আর্থিক অবস্থা কেমন, সে অসুখের জন্য কতটা খরচ করতে পারবে।
কেউ হয়তো বলবে, রাতে আর কী খাব, ওই দিনে যা খাই ভাত-ডাল-তরকারি, মাছ থাকলে মাছ, অল্প করে খাই। অন্যজন বলেন, রাতে তেমন কিছু খাই না, একটু দুধ-খই খাই, কেউ হয়তো অম্বলের, ক্ষুধামান্দ্যের রোগী। রাতের বেলা এক মুঠো মুড়ি জলে ভিজিয়ে খান।
আবার অন্যদিকও আছে। সংগতি সম্পন্ন রোগী হুইস্কি সহকারে চিকেন তন্দুরি দিয়ে নৈশাহার সমাপন করেন। আবার সাত্ত্বিক প্রকৃতির ধনী মহিলা রাতে সামান্য আট-দশটা ঘিয়ে ভাজা লুচি রাবড়ি কিংবা রাজভোগ দিয়ে খান।
অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। রোগীর নৈশাহার অনুযায়ী ডাক্তারের বিল, রোগীর চিকিৎসা হয়।
সব ডাক্তারবাবু নিশ্চয়ই এরকম নন।
রোগীর আহারের সূত্রে সেই মরমি ডাক্তারবাবুর কথা মনে পড়ছে।
ডাক্তারবাবুর রুগিটি স্থূলোদর এবং খাদ্যলোলুপ। তার কোনও অসুখই নেই, আবার সব অসুখই আছে। রক্তচাপ, সুগার, মেদাধিক্য, পা ফোলা, ঘাড় ব্যথা ইত্যাদি নানা ঝামেলা, সবই অতিরিক্ত খাদ্যগ্রহণের ফলে ভয়াবহ মোটা হওয়ার জন্যে।
ডাক্তারবাবু রোগীর কাছে জানতে চাইলেন তাঁর দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে। বিস্তারিত বিবরণ শুনে ডাক্তারের চোখ কপালে উঠল, সকালে শিঙাড়া, নিমকি, জিলিপি ইত্যাদির প্রাতরাশ দিয়ে শুরু আর অনেক রাতে মাংস পরোটা দিয়ে সমাপ্তি।
ডাক্তারবাবু পরিবর্তিত খাদ্য তালিকা তৈরি করে দিলেন। ক্রিমক্রেকার বিস্কুট, শশা, মুড়ি, ছোট মাছ, হালকা ডাল, ভাত ইত্যাদি।
পরের মাসে ডাক্তারবাবু এসে দেখেন যে রোগীর ওজন আরও তিন পাউন্ড বেড়েছে। রোগী রীতিমতো হাঁসফাঁস করছে।
ডাক্তারবাবু অবাক। ব্যাপারটা কী?
অথচ রোগী বললেন, তিনি ডায়েটিং করছেন। ডাক্তারবাবুর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করছেন।
অনেক চেষ্টার পরে ডাক্তারবাবু বুঝতে পারলেন, ভদ্রলোক আগে শিঙাড়া, জিলিপি, পরোটা-মাংস যা যা খেতেন সেসব খেয়ে যাচ্ছেন, সঙ্গে যোগ হয়েছে এই ডায়েটিংয়ের বিস্কুট, শশা, ডাল-ভাত ইত্যাদি। ওটার বদলে যে এটা খেতে হবে রোগী সেটাই মানেনি।
পুনশ্চ
ডাক্তার-রুগির গল্প শেষ হওয়ার নয়। এর বাইরের একটা গল্প বলি।
একটি ছেলে তার বাবাকে বলল, ‘বাবা আমি পশু চিকিৎসক হব।’
বাবা অবাক। ছেলে চিকিৎসক না হয়ে পশু-চিকিৎসক হতে চাইছে কেন?
কারণটা অবশ্য পরিষ্কার। বালকটি প্রতিদিনই কাগজে দেখছে, চিকিৎসকেরা কারণে-অকারণে নিগৃহীত হচ্ছেন। হাসপাতাল, নার্সিংহোম ভাঙচুর হচ্ছে।
ছেলেটি বাবাকে বলল, ‘আর যাই হোক পশু-চিকিৎসক হলে, চিকিৎসায় ভুল-টুল যতই হোক মারধোর খেতে হবে না। জীবজন্তুরা ঝামেলা বাধাবে না।