ডাকাতের পাল্লায়
ভুটানে বেড়াতে গিয়ে একদিনও খবরের কাগজ পড়িনি। পাহাড়, নদী আর আকাশ দেখেই চোখ ভরে থাকত। ছাপা অক্ষর পড়ার কাজ থেকে চোখ দুটোকে ছুটি দিয়েছিলাম।
তারপর একদিন ভুটান থেকে আমরা নেমে এলাম। সমতলে। উঠলাম গিয়ে বরডাবরি বাংলোয়। সেখানে আরও দু-দিন কাটিয়ে তারপর কলকাতায় ফেরা।
সেই বাংলোয় বসবার ঘরে দেখলাম একটা খবরের কাগজ পড়ে আছে। অমনি পুরোনো অভ্যেসটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। টেনে নিলাম কাগজটা।
তাতে একটা খবর দেখে চমকে উঠলাম। সেবক রোডে গত এক সপ্তাহের মধ্যে তিন বার ডাকাতি হয়ে গেছে!
বাংলোর চৌকিদার কাছেই ছিল। তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি শুনেছ ডাকাতির কথা?’
সে চোখ বড়ো করে বলল, ‘ওরে বাবা, সে-কথা আর বলবেন না, সাহেব! সন্ধের পর আজকাল আর কেউ রাস্তায় বেরোতে চায় না। একে এদিকে রয়েছে পাগলা হাতির উপদ্রব, তার উপর শুরু হয়েছে ডাকাতদের হামলা।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী করে এই ডাকাতরা?’
চৌকিদার বলল, ‘এরা কোথা দিয়ে যে কখন আসবে তা বোঝার উপায় নেই। এরা লুকিয়ে থাকে জঙ্গলের মধ্যে। রাত্তির বেলা হঠাৎ বড়ো রাস্তার ওপর একটা মোটা গাছের গুঁড়ি ফেলে গাড়ি আটকে দেয়। তারপর সব লুটপাট করে নিয়ে চলে যায়। কেউ বাধা দিতে এলে গুলি করে মেরে ফেলে। এ পর্যন্ত দুটো গাড়ির ড্রাইভারকে মেরেছে। পুলিশ এদের কিছুতেই ধরতে পারছে না।’
খবরের কাগজেও দেখলাম, প্রায় ওই এক কথাই লিখেছে। তবে দুটো গাড়ির ড্রাইভারকে মেরে ফেলার কথাটা ঠিক নয়, তারা আহত হয়ে হাসপাতালে আছে। আর একটা গাড়িতে তারা আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল।
ডাকাতরা সংখ্যায় মাত্র তিন-চার জন। ছোটো ছেলেদের যেমন খেলবার মুখোশ পাওয়া যায়, তারা সেইরকম মুখোশ পরে থাকে। পুলিশ এখনও কোনো খোঁজ পায়নি।
আমি খবরের কাগজটা টেবিলের তলায় লুকিয়ে ফেললাম। ঝরনামাসি দেখে ফেললে আবার মুশকিল হবে। কারণ, আমাদের ফিরতে হবে ওই সেবক রোড দিয়েই।
কিন্তু ঝরনামাসির ছেলে বুবুন শুনে ফেলেছিল আমার আর চৌকিদারের কথাবার্তা। সে খাবারের টেবিলে বসে হঠাৎ বলে ফেলল, ‘মা, আজ সন্ধেবেলা ডাকাত দেখতে যাবে? এখানে রোজ মুখোশপরা ডাকাত বেরোয়।’
আর চেপে রাখা গেল না। ডাকাতের কথা এসে পড়লই। মেসোমশাই বললেন, ‘আমি শুনেছি, খুব ডাকাতি হচ্ছে এদিকে। গেটের সামনে কয়েকজন লোক বলাবলি করছিল। পরশুদিনও নাকি তিস্তা ব্রিজ পেরিয়ে মাইলখানেক দূরে সেবক রোডের ওপর একটা ডাকাতি হয়েছে।’
ঝরনামাসি বললেন, ‘তাহলে আমরা কুচবিহার দিয়ে যাব।’
মেসোমশাই বললেন, ‘কেন?’
ঝরনামাসি বললেন, ‘নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন যেতে হলে সন্ধের পর ওই সেবক রোড দিয়ে যেতে হবে! তোমাদের কী মাথা খারাপ হয়েছে? সঙ্গে এত জিনিসপত্তর।’
এই রে, ঝরনামাসি একবার গোঁ ধরলেই মুশকিল! কুচবিহার যাওয়া মানে এক ঝামেলা। অনেক সময় লেগে যাবে। আর এদিক দিয়ে নিউ জলপাইগুড়িতে গিয়ে দার্জিলিং মেল ধরলে আমরা পরদিন ভোরেই কলকাতায় পৌঁছে যাব!
বুবুন বলল, ‘না মা, আমরা ওই ডাকাতের রাস্তা দিয়ে যাব! আমরা ডাকাত দেখব।’
ঝরনামাসি এক ধমক দিয়ে বললেন, ‘চুপ কর তো! বড়ো দুষ্টু হচ্ছিস দিন দিন।’
কাছাকাছি একটা চা-বাগানের ম্যানেজার মেসোমশাইয়ের বন্ধু। পরদিন দুপুরে আমরা নেমন্তন্ন খেতে গেলুম তাঁর বাংলোয়।
কথায় কথায় ডাকাতের প্রসঙ্গ উঠল।
ম্যানেজারের নাম অজয়বাবু। তিনি বললেন, ‘আপনারাও ডাকাতের কথা শুনে ভয় পেয়েছেন নাকি?’
ঝরনামাসি বললেন, ‘ভয় পাব না? ডাকাতদের কে না ভয় পায়!’
বুবুন বলল, ‘আমি ভয় পাই না!’
অজয়বাবু বুবুনের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, ‘এই তো চাই।’
তারপর তিনি ঝরনামাসির দিকে ফিরে বললেন, ‘বাঘ, হাতি আর ডাকাতদের নিয়ে আমাদের থাকতে হয়। আমাদের কী আর ওসব ভয় পেলে চলে?’
মেসোমশাই জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমরা আজ ওই রাস্তা দিয়ে দার্জিলিং মেল ধরব ভেবেছিলাম, কিন্তু চিন্তা হচ্ছে।’
অজয়বাবু বললেন, ‘চিন্তার কী আছে? আমার জিপ গাড়িটা দিয়ে দিচ্ছি, আপনাদের পৌঁছে দিয়ে আসবে। ডাকাতরা জিপ দেখলেই ভাববে পুলিশের গাড়ি, অমনি পালাবে। যদি চান তো বন্দুকটাও দিয়ে দিতে পারি সঙ্গে।’
বুবুন বলল, ‘হ্যাঁ, বন্দুকটা চাই। ডাকাত এলেই গুড়ুম গুড়ুম করে গুলি করে দেব।’
ঝরনামাসি বললেন, ‘বন্দুক তো দেবেন, কিন্তু সেটা চালাবে কে?’
অজয়বাবু আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কেন, আপনারা কেউ জানেন না?’
আমি লজ্জা পেয়ে মাথা নাড়লাম, কোনোদিন আমি একটা সত্যিকারের বন্দুক হাতে নিয়েই দেখিনি। মেসোমশাই নাকি এককালে শিকার করতেন। কিন্তু ঝরনামাসি সে-কথা বিশ্বাস করেন না। সুতরাং মেসোমশাইও চুপ করে রইলেন।’
অজয়বাবু বললেন, ‘সে দরকার পড়লে আমার ড্রাইভারই বন্দুক চালাতে পারবে। দরকার হবে না অবশ্য…আমি নিজেই আপনাদের পৌঁছে দিতাম, কিন্তু আমার আবার একটা বিশেষ কাজ আছে…’
বিকেল থাকতে থাকতেই আমরা জিপ গাড়িতে মালপত্র চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ঝরনামাসি বললেন, ‘না হয় বেশিক্ষণ স্টেশনে বসে থাকব, কিন্তু সন্ধের পর ওই রাস্তা দিয়ে যাবার দরকার নেই।’
রাস্তাটা কিন্তু চমৎকার। দু-পাশে চা-বাগান, মাঝখান দিয়ে রাস্তাটা গেছে এঁকে বেঁকে। সমতল ভূমি ছাড়িয়ে একসময় পাহাড়ের গা দিয়ে যেতে হয়। তারপর তিস্তা নদীর উপর করোনেশান ব্রিজ। এমন সুন্দর জায়গা খুব কমই আছে। বিরাট চওড়া এখানে তিস্তা নদী, ঠিক যেন রুপো-গলা জল। ব্রিজ পেরিয়ে ডানদিকে গেলে কালিম্পং-এর রাস্তা। আমরা যাব বাঁদিকে।
বিকেল শেষ হয়েছে, হঠাৎ ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এল। এসব পাহাড়ি জায়গায় আস্তে আস্তে সন্ধে নামে না। যাই হোক আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমরা পৌঁছে যাব।
সারাটা রাস্তা বুবুন ব্যাকুলভাবে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থেকেছে। তার খুব আশা ছিল যে-কোনো মুহূর্তে পাশের জঙ্গল থেকে একপাল হাতি কিংবা ডাকাত বেরিয়ে আসবে। কিন্তু সেরকম রোমাঞ্চকর কিছুই ঘটল না।
আমাকে সে বারবার জিজ্ঞেস করছিল, ‘ও নীলুদা, বলো না, ডাকাতদের কীরকম দেখতে হয়?’
ওর ধারণা, ডাকাত বুঝি ভূত বা দৈত্যের মতন আলাদা ধরনের কিছু।
আমি উত্তর দিয়েছিলাম, ‘বড়ো বড়ো কান, চোখ দুটো দিয়ে আগুন জ্বলে, ডাকাতদের হাতে নখও থাকে খুব বড়ো বড়ো…’
পাহাড়টা সবে পার হয়ে আমরা সমতল রাস্তায় এসেছি, এমন সময় ঘ্যাস-স-ঘ্যাস-স আওয়াজ করে আমাদের জিপ গাড়িটা থেমে গেল।
ঝরনামাসি আঁতকে উঠে বললেন, ‘কী হল?’
ড্রাইভারটি নেপালি এবং খুব গম্ভীর! সে কোনো কথা না বলে রেগে গিয়ে গাড়ির বনেট খুলল। তারপর খুটখাট করতে লাগল অনেকক্ষণ ধরে।
ঝরনামাসি বললেন, ‘কী হল, এই নীলু, নেমে দ্যাখ না।’
বাইরে শীতের ফিনফিনে হাওয়া, তার মধ্যে নামতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু আর না নেমে উপায় নেই। ড্রাইভারটির পাশে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেয়া হুয়া? কতক্ষণ বাদ চলেগা?’
ড্রাইভার খুব সংক্ষেপে উত্তর দিল, ‘নেই চলেগা!’
‘অ্যাঁ?’
ততক্ষণে মেসোমশাইও নেমে এসেছেন, আমার চেয়ে গাড়ির যন্ত্রপাতির ব্যাপার তিনি ভালো বোঝেন। তিনি ভালো করে দেখে বললেন, ‘কী সাংঘাতিক ব্যাপার! গাড়ির রেডিয়েটার ফুটো হয়ে সব জল পড়ে গেছে রাস্তায়। আর ফ্যান-বেল্টও ছিঁড়ে গেছে। এখন এই গাড়ি চালাবার আর কোনো উপায়ই নেই।’
ঝরনামাসি সে খবর শুনে দারুণ রেগে গিয়ে বললেন, ‘তোমার ওই অজয়বাবুটার কী আক্কেল? এরকম একটা পচা গাড়ি দিয়ে আমাদের পাঠিয়েছেন।’
মেসোমশাই বন্ধুর সমর্থনে দুর্বলভাবে বললেন, ‘আহা, যন্ত্রপাতির কথা কী বলা যায়, কখন কোনটা খারাপ হয়?’
মেসোমশাই ঝরনামাসিকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘এদিক থেকে আরও গাড়ি যাবে তো, তাদের কাউকে বললে আমাদের নিয়ে যাবে নিশ্চয়ই!’
ঝরনামাসি জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে ট্যাক্সি পাওয়া যায় না?’
আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘এখানে জঙ্গলের মধ্যে কে তোমার জন্য ট্যাক্সি নিয়ে বসে থাকবে!’
ঝরনামাসি আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘তুই আবার হাসছিস? তোর লজ্জা করছে না? তখনই আমি বলেছিলাম কুচবিহার দিয়ে যেতে—’
এ রাস্তায় গাড়ি চলাচল সত্যি খুব কমে গেছে। অন্য সময় লরি আর প্রাইভেট গাড়ি যায়। কিন্তু দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যে একটা গাড়ি এল না। সবাই কী ডাকাতের ভয় পেয়েছে? লরি তো কখনো বন্ধ হয় না। একটা পুলিশের গাড়ি এলেও তো পারত।
প্রায় পনেরো মিনিট বাদে দূরে একটা গাড়ির হেডলাইট দেখা গেল। একটু কাছে আসতে দেখা গেল ট্রাক। একটা নয়, পরপর তিনটে। আমরা হল্লা করতে লাগলাম, ‘এই থামো থামো, আমাদের গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে, থামো!’
তারা তো থামলই না, বরং যেন আরও স্পিড বাড়িয়ে হুস করে বেরিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পর আবার দুটো ট্রাক এল পরপর। এবার আমরা আরও জোরে চেঁচালাম, এবারও তারা না থেমে চলে গেল একইভাবে।
আবার অনেকক্ষণ বাদে একটা গাড়ির আলো যেই দেখলাম, অমনি আমরা রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেলাম তিনজন। দু-হাত তুলে চেঁচাতে লাগলাম। আর যাই হোক, আমাদের তো চাপা দিতে পারবে না।
প্রায় চাপাই দিচ্ছিল আর একটু হলে। শেষ মুহূর্তে আমরা লাফিয়ে পড়লাম রাস্তার পাশে, ট্রাকটাও ব্রেক কষল। আমি দৌড়ে ড্রাইভারের কাছে গিয়ে বললাম, ‘বহুত বিপদে পড়া হ্যায়…হাম লোককো ট্রেন পাকড়ানে হোগা, গাড়ি খারাপ হুয়া…’
আমি কথা শেষ করতে পারলাম না। গাড়ির ভেতর থেকে একটা হাত বেরিয়ে এসে আমার মুখে একটা ধাক্কা দিল খুব জোরে। আমি ছিটকে পড়লাম রাস্তার মাঝখানে। গাড়িটাও এর মধ্যে স্টার্ট নিয়ে জোরে বেরিয়ে গেল।
ঝরনামাসি বললেন, ‘কী পাজি, শয়তান ওরা! নীলু, তোর বেশি লাগেনি তো?’
ধুলো ঝেড়ে উঠে এসে আমি বললাম, ‘একটা জিনিস বোঝা গেল, কোনো গাড়ি আমাদের নিয়ে যাবে না। দিনকাল খারাপ বলে অচেনা লোককে কেউ তুলতে চাইছে না।’
এবার মেসোমাশাইয়ের মুখটা কালো হয়ে এল। কোনো গাড়ি যদি আমাদের না নিয়ে যায়, তাহলে কী উপায় হবে? জিপটাকে আজ রাত্তিরের মধ্যে চালাবার কোনো উপায় নেই। সারারাত কী তাহলে আমরা পথের পাশে বসে থাকব?
দু-পাশে ঘন জঙ্গল। রাত্রিবেলা অন্ধকার জঙ্গলে গা ছমছম করে। এদিকে বাঘের উপদ্রব বিশেষ নেই। অবশ্য দু-একটা বাঘ ছিটকে চলেও আসতে পারে। আর আসতে পারে হাতি। অনেক সময়ই এইসব জঙ্গল থেকে হাতি বেরিয়ে এসে রাস্তা পার হয়। কিছুদিন আগেই আমরা জয়ন্তিয়ার কাছে দেখেছি যে হাতির দঙ্গল এলে সেখানে একটা-আধটা বন্দুক থেকেও বিশেষ লাভ নেই। তাদের খেয়াল হলে তারা আমাদের সবাইকে পায়ের পাতায় পিষে চ্যাপটা করে দিয়ে যেতে পারে।
এ ছাড়া ডাকাতের ভয় তো আছেই। সারারাত, আমাদের এখানে ডাকাতের ভয় নিয়ে থাকতে হবে।
তার চেয়েও বড়ো ভয় শীত। সারা রাত যদি জিপের মধ্যে বসে থাকতে হয় তাহলে আমরা ঠাণ্ডায় জমে যাব একেবারে। বাঘ, হাতি আর ডাকাতের ভয় নিয়ে এই দারুণ শীতের রাত কাটানো প্রায় এক অসম্ভব ব্যাপার। বিশেষত ঝরনামাসি আর বুবুনকে নিয়েই চিন্তা।
অথচ আর কী-ই বা করার আছে?
মেসোমশাই ঘড়ি দেখলেন। আর ঠিক এক ঘণ্টা বাদে দার্জিলিং মেল ছেড়ে যাবে। অথচ সেখানে পৌঁছোবার কোনো উপায়ই নেই। হঠাৎ তিনি রেগে গিয়ে নেপালি ড্রাইভারটিকে প্রচন্ড ধমক দিয়ে বললেন, ‘কাঁহে এইসা খারাপ গাড়ি লেকে আয়া?’
সে বলল, ‘হাম কেয়া করেগা সাব!’
জঙ্গলে কিছু একটা আওয়াজ হলেও আমরা চমকে উঠছি।
শুকনো পাতায় খসখস শব্দ, কে যেন হেঁটে আসছে! একটু পরেই শব্দটা থেমে গেল। সেদিকে টর্চ ফেলেও আর কিছু দেখা গেল না। কেউ কী লুকিয়ে আমাদের লক্ষ করছে?
ঝরনামাসিও এখন আমাদের বকুনি দিতে ভুলে গেছেন।
বুবুন আমার হাতটা শক্ত করে চেপে আছে। মেসোমশাই ঘন ঘন সিগারেট ধরাচ্ছেন।
হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ায় উলটোদিকের জঙ্গলের মধ্যে একটা গাছের ডাল মড়-মড় করে ভেঙে পড়ল। আমরা চমকে লাফিয়ে উঠলাম প্রায়।
আমি আর মেসোমশাই পরস্পরের মুখের দিকে চাইলাম। এইরকমভাবে কাটাতে হবে সারারাত? এরকম চমকে চমকে? অথচ কী যে করা যায়, ভেবেই পাচ্ছি না।
এই সময় উলটোদিকের রাস্তায় একটা হেডলাইটের আলো দেখা গেল। আমার বুকটা ধক করে উঠল। কিন্তু কোনো লাভ নেই। আমরা যেদিকে যাব গাড়িটা আসছে সেইদিক থেকেই। জোরালো আলো দেখেই বোঝা যায় ওটাও একটা ট্রাক।
নেপালি ড্রাইভারটি হঠাৎ বলল, ‘সাব, ট্রাক রোকেগা?’
মেসোমশাই বললেন, ‘ট্রাক থামবে? কী করে?’
সে সাদা দাঁতে ঝিলিক দিয়ে হাসল। তারপর দৌড়ে গিয়ে জিপ থেকে নিয়ে এল বন্দুকটা। তারপর সে আর একটা কাজ করল। পকেট থেকে একটা সাদা রুমাল বার করে সেটা বেঁধে ফেলল মুখে। অমনি তার মুখখানা হয়ে গেল মুখোশের মতন।
সে আমাকে বলল, ‘সাব, আপ ভি হামারা সাথ আইয়ে!’
তার কোমরে একটা ভোজালি ছিল। সেটা খুলে সে আমার হাতে দিল। তারপর ইঙ্গিতে বোঝাল, আমারও মুখে একটা রুমাল বেঁধে নিতে।
মেসোমশাই উত্তেজিতভাবে আবার ঘড়ি দেখে বললেন, ‘দ্যাখো যদি ট্রাকটা থামাতে পারো, তাহলে এখনও দার্জিলিং মেল ধরা যেতে পারে।’
আমি আর নেপালি ড্রাইভারটি গিয়ে দাঁড়ালাম রাস্তার মাঝখানে। মেসোমশাই তখন ঝরনামাসি আর বুবুনকে নিয়ে জিপের আড়ালে গিয়ে লুকোলেন।
…সেই সময় নেপালি ড্রাইভারটি বন্দুকের মুখ আকাশের দিকে তুলে গুড়ুম করে একটা গুলি চালাল…
হেডলাইটের আলো ঠিক যখন আমাদের মুখে এসে পড়েছে, সেই সময় নেপালি ড্রাইভারটি বন্দুকের মুখ আকাশের দিকে তুলে গুড়ুম করে একটা গুলি চালাল। আমার বুক ঢিপ ঢিপ করছে। ট্রাকটা যদি না থেমে আমাদের চাপা দিতে আসে তাহলে শেষ মুহূর্তে পাশের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়বার জন্য আমি তৈরি হয়েছিলাম।
কিন্তু ট্রাকটা থেমে গেল।
নেপালি ড্রাইভারটা সঙ্গে সঙ্গে বন্দুক উঁচিয়ে ড্রাইভারের কাছে ছুটে গিয়ে বলল, ‘রুক যাও। নেহি তো খতম কর দেগা!’
আমি অন্যদিকের জানালায় লাফিয়ে উঠে ভোজালি দেখিয়ে বললাম, ‘খবরদার।’
ট্রাকের ড্রাইভার ভয় পেয়ে বলল, ‘মারিয়ে মাত, মারিয়ে মাত।’
আমি আবার নেমে পড়ে চলে গেলাম পেছন দিকে। সেখানে প্রচুর মালপত্র রইলেও খানিকটা জায়গা খালি আছে। জিপ থেকে আমাদের মালপত্রগুলো এনে ছুড়ে দিলাম সেখানে। তারপর ঝরনামাসি আর বুবুনকে টেনে-হিঁচড়ে তুলে দিলাম ওপরে। মেসোমশাইও গিয়ে বসলেন ওদের পাশে।
আমি আবার ড্রাইভারের জানালার পাশে লাফিয়ে উঠে বললাম, ‘গাড়ি ঘুরাও।’
নেপালি ড্রাইভারটিও বন্দুকটা ড্রাইভারের কপালে ঠেকিয়ে বলল, ‘আভি গাড়ি ঘুরাও!’
ড্রাইভারের পাশে একজন শুধু ক্লিনার বসেছিল। সে বেচারি একেবারে ভয়ে কুঁকড়ে গেছে। আমি তার গায়ে খোঁচা মেরে বললাম, ‘এই হাটকে বইঠো না!’
ড্রাইভার ট্রাকটা ঘোরাল অনিচ্ছার সঙ্গে, কিন্তু তার আপত্তি করবার উপায় নেই, কারণ কানের পাশেই বন্দুকের নল।
গাড়ি ঘোরাবার পর আমি বললাম, ‘জোরসে চালাও।’
বাইরে বেশ কনকনে হাওয়া বলে আমি ভেতরে এসে বসলাম ভোজালি উঁচিয়ে। নেপালি ড্রাইভার বাইরেই রইল, নইলে বন্দুকটা তাক করা যাবে না! আমার খুব সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু উপায় নেই, তাহলে মুখ থেকে রুমালটা খুলতে হয়।
এখনও জোরে গেলে ট্রেনটা ধরতে পারি। চল্লিশ মিনিট সময় আছে। আমি ভোজালিটা একবার ড্রাইভারের চোখের সামনে ঘুরিয়ে বললাম, ‘জোরসে চালাও! আউর বহুত জোর।’
নেপালি ড্রাইভারটিও বন্দুকের খোঁচা মেরে বলল, ‘বহুত জোরসে।’
ট্রাক ড্রাইভার ভাবল, আমরা বুঝি পুরো ট্রাকটাই লুট করতে চলেছি।
দুর্দান্ত জোরে ছুটল। প্রায় আধ ঘণ্টার মধ্যেই দূরে দেখা গেল শহরের আলো। সে একটু একটু টেরিয়ে আমাদের দিকে তাকাল। যেন সে অবাক হয়ে ভাবছে, শহরের মধ্য দিয়ে আমরা যাব কী করে?
সে হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেই তো আমরা ধরা পড়ে যাব!
আমি আবার বললাম, ‘নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন চলো! জোরসে। বহুত জোরসে।’
সে বলল, ‘কেয়া? রেলস্টেশন?’
আমি এবার হো হো করে হেসে উঠলাম। মুখের রুমালটা খুলে ফেললাম। নেপালিটিও বন্দুক নামিয়ে বলল, ‘স্টেশন আয়া।’
সেদিন ট্রাক ড্রাইভারটি ডাকাতের পাল্লায় পড়লেও শেষ পর্যন্ত মেসোমশাইয়ের কাছ থেকে একশো টাকা বকশিস পেয়েছিল অবশ্য।