ডাকাতের দল আর গুরুদেব

ডাকাতের দল আর গুরুদেব

বছর দশেক আগেও বেলঘরিয়ার একটা জায়গায় ছিল বড়ো বড়ো ডাকাতের আড্ডা। দিনের বেলা রাস্তার ওপর মানুষ খুন, ব্যাংক ডাকাতি কিংবা চলন্ত ট্রেনের যাত্রীদের সব টাকাপয়সা কেড়ে নিয়ে চলন্ত ট্রেন থেকেই লাফিয়ে পড়া এই বেলঘরিয়ার ডাকাতদের পক্ষে ছিল অতি সহজ কাজ। কলকাতা কিংবা অন্য জায়গার নামকরা সব বড়ো বড়ো ডাকাতরাও লুকিয়ে থাকত বেলঘরিয়ার সেই গোপন জায়গাটায়।

পুলিশ অনেকবার সেখানে হানা দিয়েছে। বেশ কয়েকবার পুলিশের সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধও হয়েছে ডাকাতদের। দারুণ সাহস সেই ডাকাতদের, তাদের সঙ্গে থাকত স্টেনগান, মেশিনগান, আরও সব সাংঘাতিক অস্ত্র। দু-তিনবার পুলিশরাই হেরে গিয়ে ফিরে এসেছে। একবার ডাকাতদের গুলিতে তিনজন পুলিশ মারা যায়, তাদের মধ্যে একজন আবার বড়ো অফিসার। তার পরের দিন পুলিশের একটি বিরাট দল জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে ডাকাতদের গোপন আড্ডাখানাটা একেবারে ঘিরে ফেলে। সেবার পাঁচজন ডাকাত ধরা পড়েছিল আর দু-জন ডাকাত আহত হয়ে হাসপাতালে গিয়ে মরে গিয়েছিল। কিন্তু তা বলে বেলঘরিয়ার ডাকাতরা দমে যায়নি। ওই ঘটনার ঠিক দশ দিন বাদেই দুপুরবেলা একদল ডাকাত বেলঘরিয়া রেলস্টেশনে ঢুকে সব টাকা লুট করে নেয়। যাবার সময় তারা সমস্ত রেল-কর্মচারীদের হাত-পা বেঁধে রেখে গিয়েছিল। ডাকাতরা যেন বুঝিয়ে দিতে এসেছিল যে পুলিশকে তারা ভয় পায় না।

তাদের অবশ্য ডাকাত বলা হত না, বলা হত গুণ্ডা। বেলঘরিয়ার গুণ্ডাদের নাম সবাই শুনেছে। কিন্তু যারা টাকা লুট করে কিংবা মানুষ খুন করে, তাদের গুণ্ডা না বলে ডাকাত বলাই তো ঠিক।

বেলঘরিয়ার ডাকাতদের সম্পর্কে একটা অদ্ভুত ঘটনাও জানত অনেকে। ওই ডাকাতরা পুলিশকে ভয় পায় না বটে, কিন্তু একজন মানুষকে ভয় পায়। সেই মানুষটির নাম গুরুদেব। সেই গুরুদেবকে অবশ্য বেলঘরিয়ার অন্য কোনো লোক কিংবা পুলিশের লোকেরা চোখে দেখেনি কখনো।

যেসব ডাকাতরা পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিল, তাদের অনেক জোর করা হয়েছিল এই গুরুদেব সম্পর্কে বলবার জন্য। তারা কিছুতেই মুখ খোলেনি। গুরুদেবের নাম উচ্চারণ করলেই তারা কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করত।

পুলিশের অনেক বড়ো বড়ো অফিসার অবশ্য বলতেন, এই গুরুদেবের ব্যাপারটা একদম বাজে কথা। ওরকম কোনো লোক নেই। এত বাঘা বাঘা ডাকাতরা শুধু একজন লোককে ভয় পায়, তা কখনো হতে পারে? কোথায় সে থাকে, কী করে? অন্য কেউ তাকে দেখেনি কেন?

এই সময় ধনা হালদার নামে দারুণ কুখ্যাত একজন ডাকাত নিজে থেকে এসে পুলিশের কাছে ধরা দেয়। ধনা হালদার এমনই দুর্দান্ত যে পুলিশ তাকে কিছুতেই ধরতেই পারেনি, সে কত যে মানুষ খুন করেছে আর কতবার যে ট্রেন-ডাকাতি করেছে তার ঠিক নেই। সেই ধনা একদিন দুপুরবেলা নিজে থেকে লালবাজারে পুলিশ কমিশনারের অফিসে এসে বলল, আমার নাম ধনা হালদার, আমায় গ্রেফতার করুন।

পুলিশের কাছে ধনার ছবি ছিল, তাকে চিনতে একটুও অসুবিধে হল না। সবাই অবাক।

ধনা কেন ধরা দিল? সে বলেছিল, গুরুদেবের আদেশ।

তখন ধনাকেও গুরুদেব সম্পর্কে অনেক জেরা করা হল। কিন্তু সে আর কোনো কিছু বলতে চায়নি। সে শুধু বারবার বলেছিল, আমায় ফাঁসি দিন কিংবা যা খুশি করুন, গুরুদেবের আদেশে আমি এখানে এসেছি।

সেবারেও পুলিশের অনেক বড়ো অফিসার বলেছিলেন, ওই গুরুদেবের কথাটা ধাপ্পা! ধনা হালদার ধরা দিয়েছে অন্য কারণে। গুণ্ডাদের মধ্যেও অনেক দল থাকে, আর এক দলের সঙ্গে অন্য দলের প্রায়ই দারুণ মারামারি হয়। ধনা হালদার একদিন রাগের মাথায় অন্য একটা দলের সর্দার মেঘা দাসের নলি কেটে ফেলে। মেঘা দাস রাস্তার ওপর পড়ে ছটফট করতে করতে মারা যায়। ধনা হালদারের দলের চেয়েও মেঘা দাসের দলে গুণ্ডা বেশি। তারা নাকি সবাই প্রতিজ্ঞা করেছে মেঘা দাসের খুনের বদলা তারা নেবেই। যতদিন-না ধনা হালদারের গলার নলি ঠিক ওইভাবে তারা কেটে ফেলতে পারে, ততদিন তারা ভাতের সঙ্গে নুন খাবে না। ডাকাতরা কোথায় লুকোয় সে খবর পুলিশ ন-জানতে পারলেও অন্য ডাকাতরা ঠিক জেনে যায়। সেইজন্যই ধনা হালদারের আর বাঁচবার আশা ছিল না বলেই ভয় পেয়ে সে পুলিশের হাতে ধরা দিয়েছিল। ফাঁসি হয়নি অবশ্য! ধনা হালদার এখন যাবজ্জীবন জেল খাটছে।

সে যাই হোক, ধনা হালদার ধরা দেবার পর থেকেই বেলঘরিয়ার ডাকাতদের উৎপাত আস্তে আস্তে কমতে থাকে। অনেকে ধরা পড়ে যায়, অনেকে পালিয়ে যায়। যারা ধরা পড়েছিল, তাদের সবারই কেমন যেন মরা ভাব। তারা সবাই বলেছিল, আমরা ডাকতি করা ছেড়ে না দিলে গুরুদেব আমাদের মেরে ফেলতেন। গুরুদেবের জন্য ধরা পড়লাম।

বেলঘরিয়ায় আর এখন সেরকম ডাকাতের ভয় নেই। দু-চারটি নতুন গুণ্ডা মাঝে মাঝে মাথা উঁচু করে কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে তারা ধরা পড়ে কিংবা নিরুদ্দেশে চলে যায়। বেলঘরিয়াকে ডাকাতমুক্ত করার সব কৃতিত্ব পুলিশরাই নিতে চায় বটে কিন্তু সাধারণ লোকের ধারণা, সেই অদেখা গুরুদেবের জন্যই এসব হয়েছে।

এর মধ্যে মাত্র দু-বছর আগে আমার বন্ধু কৌশিকের একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল বেলঘরিয়ায়। সেটা ঠিক একটা গল্পের মতন। কৌশিককে আমি খুব ছেলেবেলা থেকে চিনি, খুব ভালো ছেলে, অকারণে মিথ্যে কথা বলা তার স্বভাব নয়। সেই জন্যই তার কথা অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।

কৌশিক থাকে ব্যারাকপুরে, সেখানে একটি কলেজে পড়ায়। বেলঘরিয়ায় কৌশিকের বড়োমামার বাড়ি। যখন বেলঘরিয়ায় খুব ডাকাতের উৎপাত বেড়েছিল, সেই সময় কৌশিকের বড়োমামা ভয় পেয়ে বাড়িঘরে তালা দিয়ে চলে এসেছিলেন কলকাতায়। সব ঝট মিটে যাবার পর তিনি আবার সেখানে ফিরে গেছেন। তাঁর কোনোদিন কোনো বিপদ হয়নি।

দু-বছর আগে কৌশিকের বড়োমামা খুব অসুখে পড়েছিলেন। তখন প্রত্যেক দিনই বিকেলবেলা কৌশিক ট্রেনে চেপে ব্যারাকপুর থেকে বেলঘরিয়ায় এসে বড়োমামাকে একবার করে দেখে যায়। সন্ধ্যেবেলা সে ট্রেনে করে আবার ফেরে।

তখন শীতকাল। জানুয়ারি মাসের শেষদিকে পরপর দু-দিন বৃষ্টি হওয়ায় আরও দারুণ কনকনে ঠাণ্ডা পড়েছে। রাত্তিরবেলা ট্রেনে ফেরার সময় ঠাণ্ডা হাওয়ায় যেন হাত-পা জমে যায়।

পরপর আট ন-দিন আসার পর বড়োমামার অসুখটা অনেক কম মনে হল। সেদিন বড়োমামিমা বললেন, এই ঠাণ্ডার মধ্যে তুই আর রোজ রোজ আসিস না। এখন তো উনি অনেকটা ভালো হয়ে গেছেন। শুধু শুধু তুই শীতে কষ্ট পাচ্ছিস কেন?

বড়োমামা সেরে উঠছেন বলে মামিমার মনটা ভালো ছিল, তিনি খিচুড়ি রান্না করে কৌশিককে খেয়ে যেতে বললেন। সেইজন্য সন্ধ্যেবেলা কৌশিকের ফেরা হল না। তাতে অবশ্য কোনো অসুবিধে নেই, রাত্তিরবেলা ব্যারাকপুরে ফেরার অনেক ট্রেন আছে।

সেদিন যেন শীতটা সবচেয়ে বেশি। কটসউলের শার্টের ওপর কৌশিক একটা মোটা ফুলহাতা, গলাবন্ধ সোয়েটার পরে এসেছে, তাও যেন ঠাণ্ডা লাগছে। বড়োমামিমা বললেন, তুই তাহলে তোর বড়োমামার শালটা গায়ে দিয়ে যা।

কৌশিক প্রথমে শালটা নিতে চায়নি। কিন্তু মামিমা বললেন, তুই তো আবার আসবি সামনের রবিবার, সেদিন শালটা ফেরত আনিস।

কৌশিকের বড়োমামার বাড়ি স্টেশনের উলটোদিকে বেশ খানিকটা দূরে। সাইকেল-রিকশা করে এসে, ওভারব্রিজ পেরিয়ে এদিকে এসে ট্রেন ধরতে হয়।

কৌশিক সাইকেল-রিকশা করে এসে যখন স্টেশনের ওপারে নামল, তখন রাত সাড়ে ন-টা বাজে। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে প্ল্যাটফর্মে এসে ওভারব্রিজে উঠতে যাবে, এমন সময় পাশের দিকে তাকিয়ে সে চমকে উঠল। ওভারব্রিজের ডান পাশে দুটি আট-দশ বছরের বাচ্চা ছেলে, হাতে একটা টিনের থালা। ওরা ভিক্ষে চায়। রেলস্টেশনে এমন বাচ্চা ভিখারি তো কতই থাকে। কিন্তু ছেলে দুটির সম্পূর্ণ খালি গা, এই নিদারুণ শীতের মধ্যে ওই অবস্থায় দুটি বাচ্চা ছেলেকে দেখলে চমকে উঠতেই হয়।

কৌশিক গেঞ্জির ওপর শার্ট, তার ওপর সোয়েটার, তার ওপর আবার শাল জড়িয়েছে, আর এই দুটি বাচ্চা খালি গায়ে বসে আছে। ওরা এই অবস্থায় বাঁচবে?

কৌশিক ভাবল, তার উচিত তার গায়ের শালটা খুলে ওদের দিয়ে দেওয়া। তাতে তার তো এমন কিছু অসুবিধে হবে না। কিন্তু শালটা তার নিজের নয়, বড়োমামার। সে কী এটা কারুকে দান করে দিতে পারে! বড়োমামার নিশ্চয়ই আরও শাল আছে, একটা দিলে কী আর হবে। তবে বড়োমামা-বড়োমামিমা হয়তো বিশ্বাস করবেন না যে কৌশিক শালটা কারুকে দান করেছে। ওঁরা ভাববেন, সে ওটা হারিয়ে ফেলেছে।

শালটা আর দিল না কৌশিক, ওদের থালায় আধুলি ফেলে দিয়ে উঠতে লাগল। কয়েক পা উঠে সে থমকে দাঁড়াল আবার। তার খুব খারাপ লাগছে। সে ফিরে এসে পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বার করে ওদের দিয়ে বলল, এই, তোদের আর বসে থাকতে হবে না। এবার বাড়ি যা।

ছেলে দুটি দশ টাকার নোটটা নিয়ে উলটে-পালটে দেখতে লাগল। কৌশিক আর দাঁড়াল না, ওভারব্রিজ পেরিয়ে এল স্টেশনের দিকে।

এদিকটা একেবারে নিঝুম, একটাও মানুষ নেই। অথচ এই সময় তো প্ল্যাটফর্ম লোকের ভিড়ে গমগম করে।

কাউন্টারে টিকিট কিনতে গিয়ে কৌশিক কারণটা বুঝতে পারল। শিয়ালদায় কীসের যেন গোলমাল হয়েছে খুব, সন্ধে থেকে ট্রেন চলছে না। কখন যে ট্রেন চলবে তার ঠিক নেই, আজ রাতে নাও চলতে পারে।

কৌশিক দ্রুত চিন্তা করে নিল। ট্রেন না চললেও এমন কিছু বিপদ নেই। এখান থেকে বাসেও ব্যারাকপুর যাওয়া যায়। এখনও গেলে বাস পাওয়া যেতে পারে। কৌশিক প্রায় দৌড়ে চলে গেল বাসস্ট্যাণ্ডের কাছে।

কিন্তু সেখানেও তাকে হতাশ হতে হল। ব্যারাকপুরে শেষ বাস এই একটু আগে চলে গেছে। আজ রাতে আর যাওয়ার উপায় নেই।

কৌশিক ঠিক করল, তাহলে বড়োমামার বাড়িতেই ফিরে যেতে হবে। রাতটা সেখানে কাটিয়ে সকালে যাবে ব্যারাকপুরে।

বিরক্তভাবে সে ফেরার পথে হাঁটতে লাগল। এবারে আর ওভারব্রিজে না-উঠে সে রেললাইনের ওপর দিয়েই হেঁটে চলে এল উলটোদিকে।

এপাশে এখন সাইকেল-রিকশাও নেই একটাও। ট্রেন চলছে না, যাত্রী নেই, তাই রিকশাওয়ালাও চলে গেছে। অন্ধকারের মধ্যে বেশ খানিকটা রাস্তা কৌশিককে হেঁটে যেতে হবে।

কৌশিক খানিকটা পথ গেছে মাত্র, এমন সময় দু-তিনজন লোক হুড়মুড় করে এসে পড়ল তার গায়ের ওপর। তারপর সে কিছু বোঝবার আগেই তারা তাকে ঠেলে ফেলে দিল মাটিতে, দু-হাত ধরে হেঁচড়িয়ে টেনে নিয়ে যেতে লাগল মাটির ওপর দিয়ে। কৌশিক চিৎকার করে উঠল, কিন্তু কেউ তার সাহায্যের জন্য এল না। একজন লোক তাকে একটা লাথি মেরে বলল, একদম চুপ! জানে মেরে দেব একেবারে।

ডাকাত-গুণ্ডার কথাটা কৌশিকের মনেই ছিল না একেবারে। পরপর ক-দিন ধরেই সে বেলঘরিয়ায় আসছে, কোনোদিন কিছু হয়নি। ভয়ের চোটে কৌশিক কিছু চিন্তা করতেও পারল না।

ওরা কৌশিককে একটা ঝোপের মধ্যে টেনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল, কী আছে, শিগগির দে!

বড়োমামার অসুখের জন্য যদি হঠাৎ কোনো দরকার লাগে, এইজন্য কৌশিক রোজ দেড়-শো দু-শো টাকা সঙ্গে নিয়ে আসে। ট্রেনে পকেটমারের ভয়ে টাকাটা সে রাখে গেঞ্জির মধ্যে, প্যান্টের পকেটে এমনি দশ-পনেরো টাকা থাকে।

সে বলল, আমার কাছে তো বিশেষ কিছু নেই।

একজন ডাকাত ঠাস করে তার গালে একটা চড় কষিয়ে দিয়ে বলল, ঘড়ি খোল! কী আছে শিগগির বার কর।

অন্য একজনের হাতে লম্বা একটা ছুরি সামান্য চাঁদের আলোয় চকচক করে উঠল। আর একজন বলল, গায়ের শালটা দামি, খুলে নে।

আবছা অন্ধকারের মধ্যে কৌশিক ডাকাতদের কারুর মুখ দেখতে পায়নি; কিন্তু একজনের গলার আওয়াজ তার খুব চেনা মনে হল। সে অমনি বলে উঠল, তুমি বিশ্বেশ্বর না? আমি কৌশিক বোস! চিনতে পারছ না? আমায় বাঁচাও!

এই কথাটা বলেই কৌশিক সবচেয়ে বড়ো ভুল করল। কৌশিকদের কলেজের ল্যাবরেটরির একজন বেয়ারা ছিল বিশ্বেশ্বর। সে ল্যাবরেটরির জিনিসপত্র ভীষণ চুরি করত। দু-তিনবার ধরা পড়েও তার স্বভাব বদলায়নি। তাই তার চাকরি যায়। সে-ই এখন গুণ্ডা হয়েছে।

কৌশিকের কথা শুনেই একজন ডাকাত বলল, এই, তোকে চিনে ফেলেছে। এই বিশে, ওকে খতম করে দে।

আর একজন বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, খতম করে দে। নইলে পুলিশের কাছে নাম বলে দেবে।

সব ক-টা ডাকাত মিলে কৌশিকের ওপর পড়ে তাকে ফেলে দিল মাটিতে। কৌশিক লড়াই করার চেষ্টা করেই বুঝল সে একলা কিছুতেই পারবে না ওদের সঙ্গে। সে প্রায় কেঁদে ফেলে বলল, আমায় বাঁচাও, আমায় প্রাণে মেরো না, আমি কারুকে বলব না, আমি সব টাকা বার করে দিচ্ছি, মেরো না।

যে ডাকাতটার হাতে ছুরি ধরা ছিল, সে হঠাৎ শূন্যে উঠে গেল।

একজন ডাকাত ছুরি তুলে বলল, চোপ।

ঠিক তক্ষুনি যেন বজ্রপাতের মতন আর কেউ বিকট গলায় বলে উঠল, এই।

যে ডাকাতটার হাতে ছুরি ধরা ছিল, সে হঠাৎ শূন্যে উঠে গেল।

কৌশিক তাকিয়ে দেখল, অন্ধকারের মধ্যে প্রকান্ড চেহারার একজন মানুষ সেখানে দাঁড়িয়ে। বেড়াল যেমন হঁদুরকে ধরে সেইরকমভাবে সেই লম্বা মানুষটি এক হাতে সেই ছুরিওয়ালা ডাকাতটাকে ঝুলিয়ে রেখেছে। তারপর কমলালেবুর খোসা ছোড়ার মতন সেই মানুষটি ডাকাতটিকে অনেক দূরে ছুড়ে দিল।

অন্য ডাকাত দুটো চেঁচিয়ে উঠল, বাপরে! গুরুদেব!

তারা পালানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু তার আগেই সেই দৈত্যের মতন লম্বা লোকটি দু-হাতে তুলে নিল ডাকাত দুটোকে, ঠকাস করে ঠুকে দিল তাদের দু’জনের মাথা। তারপর তাদের দুজনকেও ছুড়ে ফেলে দিল অনেক দূরে।

কৌশিক এমনই অবাক হয়ে গেছে যে কথা বলতে পারছে না। সে আস্তে আস্তে উঠে বসে হাঁ করে চেয়ে রইল। গুরুদেবের কথা কৌশিকও শুনেছে আগে! ইনিই সেই গুরুদেব?

লোকটি অন্তত সাত ফুট লম্বা, তেমনি চওড়া, মাথায় চুল জট পাকানো, খালি গা। শুধু একটা গেরুয়া রঙের লুঙ্গি পরে আছেন।

কৌশিককে চুপ করে বসে থাকতে দেখে সেই গুরুদেব বাজখাঁই গলায় বললেন, যা বাড়ি যা। আর ভয় নেই।

একটু আগেই কৌশিক ভেবেছিল, সে বুঝি মরেই যাবে। হঠাৎ বেঁচে গেল এই গুরুদেবের জন্য। দারুণ কৃতজ্ঞতায় সে গুরুদেবের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে গেল।

গুরুদেব সঙ্গে সঙ্গে পা সরিয়ে নিয়ে ধমক দিয়ে বললেন, ছুঁবি না। আমায় ছুঁবি না।

কৌশিক থতোমতো খেয়ে গেল। গুরুদেব আবার বললেন, ভিখিরি ছেলে দুটোকে তোর শালটা দিতে পারলি না? তোরা চোর-ডাকাতের হাতে জিনিস খোয়াবি, তবু প্রাণে ধরে কারুকে কিছু দান করতে পারিস না?

আর কিছু না বলে গুরুদেব পেছন ফিরে হাঁটতে লাগলেন।

কৌশিক উঠে দাঁড়িয়ে যেতে লাগল তাঁর পিছু পিছু। সে ভাবল, গুরুদেব বুঝি তাকে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। সে এতই অভিভূত হয়ে গেছে যে আর কোনো কথাও বলতে পারছে না।

গুরুদেব আবার মুখ ফিরিয়ে বললেন, আমার পিছু পিছু আসছিস কেন, যা, বাড়ি যা।

কৌশিক থমকে দাঁড়িয়ে গেল। কাছেই একটা পুকুর, গুরুদেব সেই পুকুরের জলে নেমে পড়লেন। তারপর বুকজলে গিয়ে গুরুদেব ডুব দিলেন, আর উঠলেন না।

কৌশিক আমাকে ঘটনাটা বলার পর জিজ্ঞেস করলাম, আর উঠলেন না? তুই নিশ্চয়ই চোখের ভুল দেখেছিস?

কৌশিক উত্তেজিতভাবে আমার হাত ধরে বলল, না, আমি ভুল দেখিনি। আমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম, তিনি আর উঠলেন না। সত্যি বলছি। বিশ্বাস করো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *