ডাকাতরাও ভূতের ভয় পায়
অনেকেই জানে, জলার মধ্যে ওই বাড়িটা ভূতের বাড়ি নয়। ওখানে ডাকাতের আড্ডা। তবু কেউ কেউ সন্ধেবেলা ওদিকে তাকালেই ভয় পায়।
জায়গাটা আগে এরকম জলাভূমি ছিল না। সবুজ মাঠ ছিল, ছোটো-ছোটো বাড়িঘর আর একটা শিবমন্দিরও ছিল। আর একটা মস্তবড়ো জমিদার বাড়ি। একবার সেই যে ভয়ংকর বন্যা হল, সুনন্দ তখন বেশ ছোটো, কিন্তু তার বেশ মনে আছে সেই সময়কার কথা। তখন এদিককার সবকিছু জলে ডুবে গিয়েছিল, সুনন্দদের বাড়িও অর্ধেকটা জলের তলায়। দু-দিন বাড়ির ছাদে সবাই উঠে বসেছিল। সেভাবে তো বেশিদিন থাকা যায় না। রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়া হবে কী করে? জিনিসপত্র সব ফুরিয়ে এসেছে। তা ছাড়া জল যদি আরও বেড়ে যায়?
দু-দিন বাদে মিলিটারিরা নৌকো করে এসে তাদের উদ্ধার করে নিয়ে গিয়েছিল স্কুল বাড়িতে। সে জায়গাটা বেশ উঁচু।
সেই সময়কার একটা স্মৃতি সুনন্দের মনে এখন জ্বলজ্বল করে। নৌকো করে যেতে যেতে চোখে পড়েছিল একটা বাতাবি লেবুর গাছ। প্রচুর বাতাবি লেবু হত সেই গাছে। এত বাতাবি লেবু যে খেয়েও শেষ করা যায় না। রোজ খেতে খেতে অরুচি হয়ে যায়। সেই বাতাবি লেবু গাছটার অনেকটাই ডুবে গেছে। শুধু উঁচু হয়ে গেছে দুটো ডাল। তার একটা ডাল জড়িয়ে আছে মস্ত বড়ো সাপ, আর একটা ডালে একটা বিড়াল। এমনিতে সাপ আর বিড়াল খুব শত্রু, বিড়ালের গায়ে খুব লোম বলে সাপে ছোবল দিতে পারে না। আর সাপের চামড়া হড়হড়ে বলে বিড়ালও কামড়াতে পারে না। দেখা হলে এই দু’জনই রেগে ফোঁস ফোঁস করে। কিন্তু সেদিন বন্যার মধ্যে বিপদে পড়ে কেউ কারুর দিকে ফোঁস ফোঁস করছে না, দুজনেই তাকিয়ে আছে করুণভাবে।
তারপর এক সময় তো বন্যার জল সরে গেল। কিন্তু ওই দিক অনেকটা ঢালু ছিল বলে সেখানকার জল গেল না। অনেকটা জায়গা, কোনো পুকুর বা দিঘির চেয়েও অনেক বড়ো, প্রায় একটা হ্রদের মতন। লোকে বলে জমিদারের জলা।
বন্যার সময় জমিদার বাড়ির লোকজন অন্য জায়গায় সরে গিয়েছিল নিশ্চয়ই, তারা কেউ আর ফিরে আসেনি। সে বাড়ির একতলাটা এখনও জলের তলায়। নৌকোয় ছাড়া যাওয়ার উপায় নেই। তবু তো সে বাড়িটা এখনও টিকে আছে। অন্য অনেক ছোটো-ছোটো বাড়ি আর বেঁচে ওঠেনি। শিব মন্দিরটারও ভগ্নদশা।
সুনন্দদের বাড়ি এই গ্রামের দক্ষিণ পাড়ায়। সে পাড়ায় ফিরে এসেছে আগের অবস্থা। স্কুল-বাজার সবই খুলে গেছে অনেক দিন।
সুনন্দ স্কুলের শেষ পরীক্ষা দিয়েছে, এবার সে কলেজে পড়তে যাবে। সুনন্দর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ইচ্ছে, সেজন্য যেতে হবে খড়্গপুরে আই আই টি-তে। সুনন্দ জয়েন্ট পরীক্ষা দিয়ে সেখানেও সুযোগ পেয়ে গেছে। এখন অবশ্য কিছুদিন ছুটি।
সুনন্দদের বাড়ি থেকে জলাভূমির সেই জমিদার বাড়িটা দেখা যায়।
অত বড়ো একটা বাড়ি, কেউ থাকে না সেখানে, সেইজন্যই কেমন যেন রহস্যময় মনে হয়। দোতলা-তিনতলাতেও কতগুলো ঘর, কয়েকটা ঘরের দরজা-জানলা খসে গেছে। কয়েকটা ঘরের জানলা আছে। কোনো কোনো জানলা খোলাই থাকে, আবার জোরে হাওয়া উঠলে বন্ধ হয়ে যায়। সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে এমনিই মনে হয় যেন ঘরের মধ্যে কেউ ঘোরাফেরা করছে।
এক একদিন রাত্তিরে সে বাড়ির ছাদে দেখা যায় আলো। দুটো-তিনটে আলো, ঠিক মশালের মতন। সে আলোও স্থির থাকে না এক জায়গায়। উঁচু-নীচু। এদিক-ওদিক হয়, ঠিক যেন মনে হয়, কেউ আলোর মশাল নিয়ে সেখানে নাচে।
যে-বাড়িতে কোনো মানুষজন নেই, সে বাড়িতে রাত্তিরে বেশ আলোর নাচ দেখলেই অনেকে ধরে নেয়, এসব ভূতের ব্যাপার। অনেকে ধরে নেয়, সবাই নয়। গ্রামেও কিছু কিছু মানুষ এখন আর ভূত প্রেত বিশ্বাস করে না।
সুনন্দ বিজ্ঞানের ছাত্র, সে ভূতের কথা শুনলে হাসে।
ওদের বাড়ির কাজের মেয়ে বাসন্তী ওই আলোর নাচ দেখলেই ভয়ে চিৎকার করতে থাকে। চিৎকার করতে-করতে বলে, ওগো, ওদিকে কেউ তাকিয়ো না। তাকিয়ো না। ভূতের আগুন দেখলে চক্ষু অন্ধ হয়ে যায়।
সুনন্দ তাকে হাসতে-হাসতে বলল, বাসন্তীমাসি, ভূত-ফুতরা তো অন্ধকারের জীব। তারা আলো কিংবা আগুন নিয়ে কারবার করে না।
ভূতের সঙ্গে ফুত বলায় বাসন্তী দু-হাতে কান চাপা দিয়ে, চোখ বুজে দৌড়ে চলে গেল।
ভূত যদি না হয়, তাহলে কারা ওই বাড়িতে অন্ধকার রাতে আগুন নিয়ে নাচানাচি করবে? সাধারণ মানুষ কেউ ওখানে যাবে না। তাহলে চোর-ডাকাতরা নিশ্চয়ই?
সুনন্দর ছোটোমামা আকাশ বললেন, চোর-ডাকাতদের তো গোপনে লুকিয়ে থাকার কথা। তারা আগুনের খেলা দেখিয়ে ওদিকে তাকাতে বাধ্য করবে কেন? তাহলে খুব সম্ভবত আলেয়া।
আলেয়া নিয়ে অনেক রহস্য কাহিনি আছে। কিন্তু আলেয়া ব্যাপারটা আসলে কী তা সুনন্দ জানে।
এরকম জলা জায়গায় মাঝে মাঝে এক ধরনের গ্যাস জমে যায়। কখনো-সখনো সেই গ্যাস দপ করে জ্বলে ওঠে। দূর থেকে মনে হয়, কোনো মেয়ে যেন জলের মধ্যে আলো হাতে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। তাই ওই আলোর নাম দেওয়া হয়েছে আলেয়া।
আসলে মেয়েটেয়ে কেউ থাকে না। ওই আলোও একটু বাদেই নিভে যায়। লোকে ভাবে, অদৃশ্য হয়ে যায় সেই মেয়েটি। অনেক মানুষ সেই আলেয়া দেখলে পাগল হয়ে যায়, এমন গল্পও প্রচলিত আছে।
কিন্তু আলেয়ার আলো সব সময় জলের ওপরেই থাকে। তা তিনতলার বাড়ির ছাদে উঠবে কেন? এটা অসম্ভব।
আকাশ বলল, তাহলে এমন হতে পারে, চোর-ডাকাতরা এ আলো দেখিয়ে দূরে ওদের দলের লোকেদের কিছু সিগন্যাল দেয়। সেটা শুধু তারাই বোঝে, অন্য কেউ বোঝে না।
ও বাড়িতে সাধারণ মানুষ কেউ যায় না। তবু, আকাশ সুনন্দকে বলল, চল না, নৌকো করে আমরা ওই বাড়িটা একবার ঘুরে আসি। চোর-ডাকাতরা আমাদের দেখে কী করবে? আমরা তো পুলিশ নই, তাদের ধরতেও যাচ্ছি না। জমিদারদের বাড়িতে যে-কেউ যেতে পারে।
মা-বাবা শুনে দারুণ আপত্তি করলেন। তারা বললেন, কী দরকার ওইসব ঝামেলা করবার? একেই বলে, সুখে থাকতে ভূতের কিল খাওয়া। না, যেতে হবে না।
কিন্তু আকাশ খুব জেদি আর সাহসী। সুনন্দরও যাওয়ার খুব ইচ্ছে। কিন্তু বাবা-মায়ের সঙ্গে তর্ক করে সে জিততে পারত না। বাবা যদি বলতেন, যেতে হবে না, ব্যাস। তা হলে আর কথা নেই।
কিন্তু আকাশ বারবার বলতে লাগল, অত পুতু-পুতু করলে জীবনে কিছুই হয় না। এমনকী ইঞ্জিনিয়ার হতে গেলেও সাহস থাকা দরকার।
গ্রামের বিজ্ঞান-চেতনা সমিতির তিনটি ছেলেও দলে জুটে গেল।
নদী থেকে তুলে আনা হল নৌকো। জোগাড় করা হল পাঁচখানা লাঠি। একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে এই দলে যোগ দিলেন বিশু চৌধুরী। তিনি গ্রামসুদ্ধ সবারই বিশু কাকা। এক সময় মিলিটারিতে ছিলেন। এখন ফুটবল খেলার রেফারি হন।
এই বিশু চৌধুরীর আছে একটা রাইফেল। কিন্তু তাঁর কাছে একটাও গুলি নেই। অনেকদিন গুলি জোগাড় করা হয়নি। রাইফেলে গুলি চালাবার কোনো দরকারও হয়নি। বিশু চৌধুরীর ধারণা, শুধু রাইফেল দেখলেই বিশ্বশুদ্ধ সবাই ভয় পাবে।
সুনন্দরা যখন নৌকোটায় সবেমাত্র উঠেছে, তখনই বিশু চৌধুরী কাঁধে রাইফেল নিয়ে এসে বললেন, ওরে, আমিও তোদের সঙ্গে যাব। যদি ডাকাত-ফাকাত থাকে, ধরে নিয়ে আসব।
নৌকোটা চালাতে লাগল মমতাজ আর সুদীপ নামে দুটি ছেলে, ওরা বিজ্ঞান-চেতনা সমিতির সদস্য।
নৌকোটা এসে থামল জমিদার বাড়ির দোতলার একটি ঘরের জানলার সামনে। জানলাটা আছে ঠিকই। কিন্তু কোনো গ্রিল কিংবা শিক নেই, সেইজন্য—নামা গেল ঘরের মধ্যে।
বিশু চৌধুরী রাইফেলটা বাগিয়ে ধরে বললেন, আমি আগে যাব, তোরা আমার পেছন পেছন আয়।
এই ঘরের মধ্যে ছপছপ করছে জল। তারপর একটা বারান্দা। একতলাটা একেবারে জলে ভরতি, সেই জলে কয়েকটা শোল মাছ ঘোরাফেরা করছে দেখা যায়। একতলার সিঁড়িটাও ভেঙে গেল।
তিনতলায় যাওয়ার সিঁড়িটা অবশ্য আস্ত আছে। সেই দিকে এগোতে-এগোতে মমতাজ গ্রামের মতো সুর করে চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘ঠিক দুককুর বেলা’ ভূতে মারে ঠেলা। ভূতের আছে তিনটে হাত, পাঁচটা চক্ষু মেলা। ‘রক্তিম নামে আর একটি ছেলে বলল,’ তুই এই গল্পটা জানিস? রাম নামে ভূত পালায়, ভূতেই রামের গান গায়।’
হাসাহাসি করতে করতে সবাই উঠতে লাগল ওপরের সিঁড়ি দিয়ে। ভূত দেখার কথা কেউ ভাবেইনি। ভূত নিয়ে তাই হাসাহাসি করছে।
তিনতলায় মস্ত বড়ো ছাদ, দু-দিকে দুটো ঘর।
ভূত তো নেই-ই, ডাকাতদেরও কোনো পাত্তা নেই। হয়তো দিনেরবেলায় তারা এখানে থাকে না। রাত্তিরেই বা থাকবে কেন? রাত্তির বেলাতেই তো তাদের কাজকারবার হয়।
তবে ছাদের ঘর দু-খানা দেখে মনে হল, এখানে মানুষজন এসে থাকে। লুঙ্গি, জামা ঝুলছে তারে। কিছু কিছু খাবারদাবারও রয়েছে। এমনও হতে পারে, যারা এখানে ছিল, দূর থেকে এদের নৌকোটা দেখতে পেয়ে তারা বাড়ির পেছন দিকে কোনো নৌকোয় চড়ে পালিয়ে গেছে।
পালাবে কেন? ডাকাতরা কী এত ভীতু হয়?
ডাকাতরা যদি এই গ্রামেরই মানুষ হয়, তা হলে সুদীপ্তরা তো তাদের দেখেই চিনে ফেলবে। বিশু চৌধুরী সবাইকেই চেনেন।
তিনি এবার মুচকি হেসে বললেন, ডাকাতরা এই গ্রামেরই লোক হলে আমাদের পক্ষে ভালোই। ডাকাতরা কখনো নিজেদের গ্রামে ডাকাতি করে না। দূরে দূরে যায়। সুতরাং, এ গ্রামে কখনো ডাকাতি হবে না।
খানিকবাদে সবাই ফিরে এল। বিশু চৌধুরী সদর্পে খেলার মাঠে সবাইকে জানিয়ে দিলেন, এ বাড়িতে ভূত-প্রেত, ডাকাত-ফাকাত যা ছিল, সবাইকে তিনি রাইফেলের ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছেন।
এই রটনার উত্তরেই যেন পরদিনই সন্ধের পর সেই জমিদার বাড়ির ছাদে দেখা গেল আলোর নাচ। শুধু তাই নয়, তার মধ্যেই দেখা গেল একজন মানুষের মুখ। তার মুখখানা এমনই জ্বলজ্বল করছে যে দূর থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়।
…ছাদের ঘর দু-খানা দেখে মনে হল,এখানে মানুষজন এসে থাকে…
সাধারণ মানুষের মুখ তো এরকম হতে পারে না। তা হলে তো ডাকাতও না। ডাকাতের মুখ অমন জ্বলজ্বল করবে কেন? তবে নিশ্চয়ই ভূত।
আকাশ সুনন্দকে জিজ্ঞেস করলে, ব্যাপারটা কী হচ্ছে বুঝলি তো?
সুনন্দ বলল, বুঝব না কেন? যে-কোনো মানুষের মুখেই ফসফরাস মাখালে ওরকম জ্বলজ্বল করতে পারে। যে-কোনো সমুদ্রেই তো রাত্তির বেলা এরকম ফসফরাসের আলো দেখা যায়।
সুনন্দদের এই কথা অন্য কেউ বিশ্বাস করে না। বিজ্ঞান-চেতনার ছেলেরা ছাড়া আর সবাই এটাকে ভূতের ব্যাপার বলেই ধরে নিয়েছে।
কেউ কেউ আবার গল্প বার করেছে যে, ওই জমিদার বাড়িতে এক সময় এক জমিদার আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিলেন। এখন তাঁকেই দেখা যাচ্ছে এভাবে।
আকাশ সুনন্দকে বলল, চল না। একদিন রাত্তিরেই ওই জায়গাটা আমরা দেখে আসি। ডাকাতের বদলে যদি ভূত হয়, তবে তো কোনো সমস্যাই নেই। ডাকাতরা তবু গুলি ফুলি চালাতে পারে। ভূতেদের তো সে ক্ষমতা নেই। আর ভূতেরা অশরীরী, তারা যতই ভয় দেখাবার চেষ্টা করুক, মানুষকে তারা ছুঁতেই পারে না।
কিন্তু এবারে মা-বাবার ঘোর আপত্তি। কিছুতেই তারা রাত্তিরে যেতে দেবেন না।
বিজ্ঞান-চেতনার ছেলেদেরও রাজি করানো গেল না। সন্ধ্যের পর তারা প্রত্যেকেই কিছু না কিছু কাজে ব্যস্ত থাকে বাড়িতে। একজন বলল, সন্ধ্যের পর নৌকোও পাওয়া যাবে না।
আকাশ পাশের গ্রামের থানায় গিয়ে বলল, আপনারা ব্যাপারটা একটু খোঁজখবর নেবেন না?
পুলিশের দারোগা বললেন আপনাদের গ্রামে চুরি ডাকাতি কিছু হয়েছে? চোর-ডাকাত ধরা আমাদের কাজ। ভূত নিয়ে মাথা ঘামানো আমাদের ডিউটির মধ্যে পড়ে না। ওসব আপনাদের ব্যাপার।
আগুনের পাশাপাশি মানুষের জ্বলজ্বলে মুখ দেখার ব্যাপারটা আরও তিন-চারদিন চলল।
তারপর আর একটা অদ্ভুত কান্ড হল।
ঠিক রাত্তির এগারোটার সময় জমিদার বাড়ির ছাদে দপ করে আগুন জ্বলে ওঠে, তারপর দেখা যায় একজন মানুষের মুখ। এরকম চলে মিনিট পনেরো। তারপর আস্তে আস্তে সব অদৃশ্য হয়ে যায়। শুধু থাকে অন্ধকার।
গ্রাম সুদ্ধু লোক এই দৃশ্য নিজেদের বাড়ির ছাদে উঠে দেখে। কেউই আর তারপর বাইরে বেরোয় না।
এদিনও যথারীতি আগুন জ্বলল, সেই মুখটাও দেখা গেল। কিন্তু মাত্র পাঁচ মিনিট। তারপরেই একটা বিকট আর্তনাদ শোনা গেল। যেন কেউ মৃত্যু যন্ত্রণায় চিৎকার করছে। তখনই নিভে গেল সেই আগুন। মিলিয়ে গেল সেই মুখটা। তারপর সব নি:শব্দ।
কী যে ব্যাপারটা হল ওখানে, তা বোঝা গেল না। বোঝার তো কোনো উপায় নেই।
পরদিন সকালে শোনা গেল, পরমেশ্বর পাল নামে এক ডাক্তারের বাড়ির সামনে একটা লোক এসে অস্বাভাবিক কান্ড করছে, দলে-দলে লোক ছুটে যাচ্ছে সেখানে। ওই লোকটাকে নাকি ভূতে পেয়েছে।
আকাশ আর সুনন্দও তখন চায়ের টেবিলে বসেছিল। কিন্তু খবর শুনে কৌতূহল সামলাতে পারল না। গায়ে জামা চড়িয়ে তারাও চলে এল সেই ডাক্তারের বাড়িতে।
পরমেশ্বর পাল এ গ্রামের একমাত্র পাস-করা ডাক্তার। তাঁর বাড়িতেই চেম্বার। সেখানে তিনি রুগি দেখেন। অত সকালে চেম্বার খোলেনি, একটা লোক এসে মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছে আর চিৎকার করে বলছে, ডাক্তারবাবু, আমাকে বাঁচান। কে এসেছিল, কে এসেছিল, ওরে বাবা রে, বাঁচান, বাঁচান।
সুনন্দ আর আকাশ এসে দেখল, লোকটা তখনও মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছে। এখন শুধু বলে যাচ্ছে, কে, কে, কে, কে, কে?
সুনন্দ তাকে দেখেই বলল, আরে একে তো চিনি। বাজারে মাছ বিক্রি করে। এর নাম মুকুন্দ।
আকাশ বলল, এর যে এত বড়ো চেহারা আর ইয়া গালপাট্টা গোঁফ, তা দেখে মনে হয়, এ পার্ট টাইম ডাকাতিও করতে পারে।
ডাক্তার পরমেশ্বর পাল বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন এই মাত্র। লোকটিকে একটুক্ষণ ওই অবস্থায় দেখে কাছে এসে ধমক দিয়ে বললেন, এই মুকুন্দ ওঠ। ভেতরে চল, তারপর তোর সবকথা শুনব।
মুকুন্দ তখনও চোখ লাল করে বলল, কে, কে, কে, কে, কে?
তার পাশের একজন লোক বলল, স্যার, ও সারারাত এইরকম করে যাচ্ছে।
ডাক্তার পাল একটু ঝুঁকে মুকুন্দের গালে বেশ জোরে একটা চড় কষিয়ে বললেন, ওঠ। মাথা ঠাণ্ডা করে সবকিছু খুলে বল। নইলে তোর কী অসুখ, তা বুঝব কী করে?
সে তখনও ওই একই কথা বলে চলল।
ডাক্তার পাল তাকে আরও দু-খানা চড় কষালেন বেশ জোরে।
মুকুন্দ এবার খানিকটা ধাতস্থ হল। উঠে বসে ঘোলাটে চোখে চারদিকে তাকিয়ে বলল, আমি কোথায়? আমাকে এখানে কে এনেছে।
ডাক্তার বললেন, যেই আনুক না। তাতে কিছু আসে যায় না। তোর কী হয়েছে, তুই মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছিস কেন?
মুকুন্দ বলল, ডাক্তারবাবু, আমাকে বাঁচান। ওখানে কে এসেছিল? আমি কাল অনেকবার রক্তবমি করেছি।
ডাক্তারবাবু বললেন, রক্তবমির ওষুধ আছে। সেরে যাবে। তার আগে বল, ওখানে মানে কোথায়? কোথায় কে এসেছিল?
মুকুন্দ এবার আস্তে আস্তে থেমে থেমে যা বলল তা এরকম:
মুকুন্দ প্রায় তার দলবলের সঙ্গে রাত্তিরে ওই ডুবে-যাওয়া জমিদার বাড়িতে রাত কাটায়। মাঝে মাঝে সে নিজে ছাদে আগুন জ্বালে। আর নিজের মুখে কেমিক্যাল পাউডার মেখে লোককে ভয় দেখায়।
ডাক্তারবাবু বললেন, তোদের যা আসল জীবিকা, তা তো বুঝতেই পারছি। ডাকাতি। তার সঙ্গে এইসব ব্যাপারের সম্পর্ক কী?
মুকুন্দ বলল, ঠিক কোনো সম্পর্ক নেই ডাক্তারবাবু। মানুষকে ভয় দেখালে আমার বেশ আনন্দ হয়।
ডাক্তারবাবু বললেন, বুঝলাম। এবার বাকিটা বল। কাল কী হল?
মুকুন্দ ভাঙা ভাঙা ভাবে, মাঝে মাঝে থেমে থেমে বলতে লাগল, কাল আমার শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছিল। জ্বর-জ্বর ভাব। ঘুমও আসছিল। তাই ভাবলাম, আজ আর ওই খেলা খেলব না। আমার সঙ্গীসাথিরা কেউ নেই, তারা গেছে অন্য একটা গ্রামে। আমার শরীর খারাপ ছিল বলে তাদের সঙ্গে যাইনি। সকাল-সকাল শুয়ে পড়লাম ছাদের একটা ঘরে। ঘুমও এসে গিয়েছিল। হঠাৎ কেন যেন ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে তাকিয়ে দেখি, ছাদে আগুন জ্বলছে, তার মধ্যে একটা মুখও দেখা যাচ্ছে। আমি ছাড়া আর কেউ নেই, তবে কে আগুন জ্বালল? ওটা কার মুখ? একবার সেই মুখটা আমার দিকে ফিরে তাকাল। ওরে বাবারে, সে কী ভয়ংকর তার চাহনি। ডাক্তারবাবু, ও কে? ও কে? কে? আমি একটা চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেলাম। তারপর আমি অনেকবার বমি করেছি, আমার বুকটা ধড়ফড় ধড়ফড় করছে। দোহাই ডাক্তারবাবু, আমাকে বাঁচান। এমনি করলে আমি এক্ষুনি মরে যাব।
মুকুন্দ আবার সেই রকম চ্যাঁচামেচি শুরু করতেই ডাক্তারবাবু তাকে একটা ইঞ্জেকশান দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন।
এবার আর কারুর সন্দেহ রইল না যে ও বাড়িতে ভূত আছে। মুকুন্দ যে খেলা দেখাত, আসল ভূত এসে তার চেয়েও ভালো খেলা দেখিয়ে দিল।
মুকুন্দকে ডাক্তারবাবু সুস্থ করে তুললেন। তারপর সে বিশু চৌধুরী, আর অন্যান্যদের সামনে কান মুলে ঘোষণা করল, সে ডাকাতদের দলে ছিল ঠিকই, কিন্তু জীবনে আর সে কখনো ওই দলে যাবে না। ডাকাতি ছেড়ে সে আবার শুধু মাছ ধরবে।
ডাকাত দলের অন্যদের কী হল কে জানে। তারাও আর ভূতের ভয়ে কেউ ও বাড়িতে যায় না।
ছুটি ফুরোতে আকাশ চলে এল কলকাতা। সুনন্দও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে খড়্গপুরে এসে ভরতি হল।
কিন্তু তার মনে একটা খটকা রয়ে গেল। কিন্তু ভূতের ব্যাপারটা তাদের গ্রামের মানুষ মেনে নিলেও সে এখনও বিশ্বাস করতে পারে না।
এমনকী হতে পারে যে মুকুন্দ সবটাই বানিয়ে বলেছে? সে নিজে ভূত সাজার খেলা দেখাত। সেটা এমন কিছু ভয়ের ছিল না। কিন্তু এই গল্পটাই বেশি ভয়ের, এটাই আসল ভূতের গল্প। হয়তো ডাকাতি করা ছেড়ে দেবে বলেই মুকুন্দ ওই গল্প বানিয়েছে, যাতে অন্য ডাকাতরাও তাকে অবিশ্বাস না করে।
মোট কথা এরপর থেকে সেই জমিদার বাড়িতে আর কোনো রাতেই ছাদে আগুন জ্বলেনি, কোনো মুখও দেখা যায় না। সুনন্দদের গ্রামে ডাকাতিও হয় না।