ডাকবাংলো
পশ্চিমের ছোটো শহর। বিশুদ্ধ জলবায়ুর জন্যে বিখ্যাত। কিছুদিন এখানেই ডেরা পেতেছি।
শহরের চারিপাশে নদী, পাহাড়, প্রান্তর ও অরণ্য প্রভৃতি কিছুরই অভাব নেই। একদিকে শহরের সুখ-সুবিধা, আর একদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। কাজেই জায়গাটি হয়ে উঠেছিল লোভনীয়।
পশ্চিমদিকে প্রান্তর। তার ওপর দিয়ে মাইল খানেক গেলেই পাওয়া যায় দূরবিস্তারী অরণ্য। এর-ওর মুখে শোনা গেল, বনের ভিতরে মাইল দুই অগ্রসর হলেই একটি বড়ো জলাশয়ের ধারে গিয়ে পড়া যায়। সেখানে নাকি জলক্রীড়া করতে আসে বালিহাঁস ও আরও কোনো কোনো জাতের রসনারোচক পাখি।
বালিহাঁসের মাংসে ভেন্ডালু বানালে বড়োই সুস্বাদু হয়। একে শীতকাল, তায় বুনে আছে গাছের ছায়া। সুতরাং রোদের তাপে বিশেষ কষ্ট হবে না বুঝে একদিন দুপুর বেলাতেই পাখিমারা বন্দুক নিয়ে বেরিয়ে পড়লুম।
এখানকার বাসিন্দাদের মাইল সম্বন্ধে ধারণা হচ্ছে বিদেশিদের পক্ষে বিপদজনক। জলাশয়ের দূরত্ব শুনেছিলুম মাত্র দুই মাইল; কিন্তু অন্তত ছয় মাইল পথ পার হয়ে তবেই জলাশয়ের নাগাল পাওয়া গেল।
কেবল জলাশয় নয়, প্রথম দৃষ্টিতেই এক ঝাঁক বুনো হাঁসও দেখতে পেলুম এবং তাগ করে বন্দুকও ছুড়লুম, কিন্তু তারা অনায়াসেই ছররা বৃষ্টিকে এড়িয়ে আকাশে বন্দুকের সীমানার বাইরে গিয়ে চক্র দিয়ে উড়তে লাগল। আমি বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম। হাঁসের একটা পালকও সংগ্রহ করতে পারলুম না।
আমি নাছোড়বান্দা শিকারি। রাত্রে ভেন্ডালু খাওয়ার জন্যে বদ্ধপরিকর। সুতরাং বহুক্ষণ ধরে চলল বুনো হাঁসের পিছনে ছুটোছুটি। কিন্তু হা হতোহস্মি, আজ ঘুম থেকে উঠে অজান্তে নিশ্চয়ই কারুর অপয়া মুখ দেখে ফেলেছি! শেষ পর্যন্ত একটা হাঁসও আমার ভেন্ডালুর উপকরণে পরিণত হতে রাজি হল না।
বৈকাল। সূর্য হেলেছে পশ্চিমে। অরণ্যে বেলাশেষের অন্ধকার নামে তাড়াতাড়ি। এইবেলা বাড়িমুখো না হলে বিপদের সম্ভাবনা। চটপট পা চালিয়ে দিলুম। কিন্তু আধ ঘণ্টা ঘোরাঘুরির পরেই আবিষ্কার করলুম একটি প্রাণ-জল-করা প্রাঞ্জল সত্য!
আমি পথ হারিয়েছি!
অচেনা গভীর বনে সন্ধ্যার মুখে পথ হারানো যে কী ভয়ানক ব্যাপার, ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ তা বুঝতে পারবেন না। অন্ধকার হওয়ার আগেই এক জায়গায় এক জোড়া ভাল্লুকের দেখা পেয়ে আসন্ন বিপদের গুরুত্বটা আরও ভালো করে হৃদয়ঙ্গম করতে পারলুম। ভাল্লুকের ওপরওয়ালা হতে পারে বনে এমন বদমেজাজি জানোয়ারও যে আছে সে বিষয়েও সন্দেহ নেই। আমার সম্বল তো একটা পাখিমারা বন্দুক মাত্র। ব্যস্ত হয়ে বহুক্ষণ ধরে দিকে-দিকে ছুটোছুটি করবার পর অবশেষে মনে পড়ল আমি এসেছি যখন পূর্বদিক থেকে, তখন পূর্বদিক ছাড়া আর কোনোদিকেই আমার যাওয়া উচিত নয়।
পূর্বদিকে মাইল খানেক পদচালনা করবার পরে শহরে সন্ধান পেলুম না বটে, কিন্তু একটি রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালুম। সেখানে ধুলোর ওপরে গাড়ির চাকার দাগ দেখে বোঝা গেল, এ পথে যখন যানবাহনের চলাচল আছে তখন লোকালয় পাওয়া যেতে পরে অনতিদূরেই।
আরও খানিক এগুবার পরেই পথের ধারে চোখে পড়ল একখানা ছোটো একতলা বাড়ি। বাড়ির গড়ন দেখেই বুঝতে দেরি লাগল না যে, সেখানা হচ্ছে ডাকবাংলো। বন্য নির্জনতার মধ্যে অন্তত মাথা গোঁজবার একটা আস্তানা পেয়ে আশ্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচালুম।
পশ্চিমের আকাশে রক্তগঙ্গা বইয়ে সূর্য তখন পাটে বসেছে। পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে বাসামুখো হয়েছে। এরই মধ্যে দূরে দেখা যাচ্ছে কুয়াশার পাতলা পর্দা। বনের নীচের দিকটা ক্রমেই ছায়ায় অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
কোথাও জনমানবের সাড়া নেই বটে, কিন্তু সন্ধ্যার অন্ধকার জমজমাট হবার আগেই ডাকবাংলোর কাছে এসে নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে হল।
তখন অবসন্ন, পা আর চলতে চাইছিল না; ক্ষুধা-তৃষ্ণায় শরীর কাতর, কাপড়চোপড় কাঁটা-জঙ্গলে ছিন্নভিন্ন। দেহের নানা জায়গাই ক্ষতবিক্ষত এবং পিঠের বন্দুকটাকে মনে হচ্ছিল তিনগুণ বেশি ভারী। আপাতত বাংলোয় আশ্রয় নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
পায়ে পায়ে বাংলোর দিকে এগুতে এগুতে দেখলুম, বারান্দার রেলিং ধরে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছে খানসামার উর্দি পরা একটা মূর্তি। নিশ্চয়ই বাংলোর জিম্মাদার।
আরও কাছে এসে মূর্তিটাকে ভালো করে দেখবার সুযোগ পেলুম। লোকটা তালবুড়ো। বয়স ঠিক মতো ধরবার উপায় নেই— আশিও হতে পারে, নব্বই হওয়াও অসম্ভব নয়। মুখের চামড়ায় ভাঁজের-পর-ভাঁজ, গলার কাছে মাংস ঝলঝল করছে এবং গায়ের ত্বকও চুপসে কুঁকড়ে গিয়েছে। দেহখানা ছিলা-পরানো ধনুকের মতো বাঁকা। হেঁট হয়ে নিজের মনেই সে যেন বিড়বিড় করে বকছিল।
আমি কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে শুনলুম, ‘ওহে বাপু, তুমি কি এখানকারই খানসামা?’
সে কোনো জবাব দিলে না। দুই হাতে বারান্দায় ভর দিয়ে নিজের বাঁকা দেহখানা সোজা করে তুলে আমার মুখের ওপরে দৃষ্টিপাত করলে। আমি চমকে উঠলুম। কোনো থুত্থুড়ো বুড়োর চক্ষেই আমি এমন তেজি ও তীব্র দৃষ্টি দেখিনি।
বললুম, ‘আজ আমি এই বাংলোতেই থাকব, তুমি সব ব্যবস্থা করে দাও।’
তবু সে জবাব দিলে না। তার হাতে একগাছা লাঠি ছিল। সেই লাঠিটা মাটির উপরে সশব্দে ঠকঠকিয়ে সে ঠুক ঠুক করে বাংলোর ভিতরে চলে গেল— আমিও তার পিছু পিছু। তারপর সে ঠকাং করে একটা ঘরের শিকল খুলে দিয়ে বিনাবাক্যব্যয়ে সরে পড়ল চোখের আড়ালে।
ভাবলুম, লোকটা বোবা নাকি?
আর একটা ব্যাপারও লক্ষ করলুম। লোকটার জামাকাপড় ভিজে সপ সপ করছে। এখানকার এই পাহাড়ে-শীতের শেষবেলার বুড়ো স্নান করেছে? কিন্তু উর্দি পরে কেউ কি স্নান করে? তবে কি দৈবগতিকে বুড়োর উর্দি ভিজে গিয়েছে? সেইজন্যেই দারুণ শীতে সে কথা কইতে পারছিল না? কিন্তু তার হাবেভাবে শীতকাতরতার কোনো লক্ষণই তো দেখলুম না! আশ্চর্য!
একটা ঘরের ভিতরে গিয়ে দাঁড়ালুম। সে ঘর ব্যবহারের অযোগ্য। অন্তত মাসাধিক কালের সঞ্চিত ধুলো ঘরের আসবাবপত্তরের ও মেঝের ওপরে পুরু হয়ে জমে আছে।
জানি এইসব বন্য ডাকবাংলোয় অতিথিদের জনতা ভেঙে পড়ে না, কিন্তু সরকার মাহিনা দিয়ে খানসামা পুষেছেন কেন?
ক্রুদ্ধ স্বরে ডাকলুম, ‘খানসামা! খানসামা!’
পাঁচ-সাতবার ডাকাডাকির পরেও কোনো জবাব পাওয়া গেল না। আমার সব বন্দোবস্ত করবার জন্যে বুড়ো নিশ্চয়ই বাইরে বেরিয়ে পড়েছে। কিন্তু মনে হল কোথায়, কে যেন মাটির ওপরে লাঠি ঠকঠকিয়ে বেড়িয়ে বেড়াচ্ছে। হয়তো বাংলোর ভিতরে আর কোনো ষষ্টিধারী লোকও আছে কিংবা খানসামাটা হয়তো কেবল বোবা নয়, কানেও শোনে না!
নাচার ভাবে পশ্চিমদিকের জানলাটা খুলে দিলুম।
আলোক-সম্রাট সূর্যদেব অবসর গ্রহণ করেছেন বটে, কিন্তু বনবাসী জীবদের কাছে জ্যোৎস্নার আশীর্বাদ বর্ষণ করবার জন্যে প্রতিপদের চাঁদ আর একটু পরেই আত্মপ্রকাশ করবেন।
দিনের পাখিরা বাসায় ফিরে গিয়েছে। ছায়ামলিন আকাশের গায়ে একে একে দেখা দিতে শুরু করেছে প্যাঁচা ও বাদুড়।
খানিক তফাতে আবছায়ার ভিতর দিয়ে জঙ্গলের আরও ঘন অন্ধকারের মধ্যে গা ঢাকা দিলে বোধ হয় একদল হায়েনাই।
বনস্পতিদের আর্তনাদের মতো মর্মরধ্বনি ছাড়া কোথাও আর কোনো শব্দ নেই। এ যেন অ-মানুষের দেশ।
বাংলোর হাতার ভিতরেই রয়েছে একটা ইঁদারা।
জলাভাবে গলা তখন শুকিয়ে কাঠ হয়েছিল, ইঁদারা দেখেই তৃষ্ণা যেন দ্বিগুণ হয়ে উঠল। অনুপস্থিত খানসামার মুখাপেক্ষা না-করে নিজেই ঘর থেকে বেরিয়ে সাগ্রহে ছুটে গেলুম ইঁদারার কাছে।
ইঁদারার পাশেই ছিল দড়ি-বাঁধা বালতি। বালতিটা তুলে নিয়ে ইঁদারার গহ্বরে দৃষ্টিপাত করলুম— এবং সঙ্গে-সঙ্গে দারুণ আতঙ্কে বিদ্যুৎ-স্তম্ভিতের মতো দাঁড়িয়ে পড়লুম।
কোথাও কেউ নেই, নিজের দেহের কোনো জায়গাতেও কারুর স্পর্শ অনুভব করলুম না; কিন্তু চুম্বক যেমন অদৃশ্য আকর্ষণে লোহাকে টেনে নেয়, ঠিক সেইভাবেই কোনো অদৃশ্য শক্তি যেন আমাকে হঠাৎ ইঁদারার ভিতরে সজোরে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করলে!
হতভম্বের মতো চারিদিকে ফিরে-ফিরে তাকাতে লাগলুম। না, সামনে-পিছনে, বাঁয়ে-ডাইনে কেউ কোথাও নেই! তবে? আমার মনের ভ্রম?
আবার ইঁদারার ভিতরে উঁকি মারলুম এবং আবার সেই অসম্ভব, ভয়াবহ আকর্ষণ! এবারে রীতিমতো জোর করে সেই অদৃশ্য শক্তির আকর্ষণ থেকে নিজেকে ছিনিয়ে নিতে হল!
সারাদিন রোদে রোদে ঘুরে ঘুরে আমার মাথা কি বিগড়ে গেছে— আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি?
আর ইঁদারার কাছে দাঁড়াতে ভরসা হল না। তৃষ্ণার কথা ভুলে দ্রুতপদে সোজা বাংলোর ভিতরে ফিরে এলুম— মনের ভুলে কে পাতালে প্রবেশ করতে চায়?
বাহিরটা ঝাপসা হয়ে এসেছে, ঘরের ভিতরে ঘন হয়ে উঠছে অন্ধকার।
কী মুশকিল, এখনও বুড়োর দেখা নেই, আর যে আলো না জ্বালালে চলে না!
আচমকা বাহির থেকে একটা কুকুর তারস্বরে চিৎকার করে উঠল। সে যে কী মর্মন্তুদ অথচ বীভৎস চিৎকার— ভাষায় তা বুঝানো যাবে না!
জানালার কাছে গিয়ে দেখি, ইঁদারার উঁচু পাড়ের ওপরে একটা কুকুরের অস্পষ্ট মূর্তি। আকাশের দিকে মুখ তুলে সে এমন একটানা আর্তনাদ করছিল যে কেঁপে-কেঁপে উঠছিল যেন চারিদিক! সেই বিশ্রী ক্রন্দনের অপার্থিবতায় আমার বুকটা কী এক অমঙ্গলের আশঙ্কায় ছাঁৎ-ছাঁৎ করতে লাগল।
এমন সময়ে দড়াম করে ঘরের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল— ছুটে গিয়ে দরজা ধরে অনেক টানাটানি করলুম, কিন্তু কিছুতেই খুলতে পারলুম না।
মহাক্রুদ্ধ হয়ে চিৎকার করে বললুম, ‘কে দরজা বন্ধ করেছ— শিগগির খুলে দাও, আমার সঙ্গে চালাকি করো না, আমার কাছে বন্দুক আছে!’
কিন্তু দরজা খুলল না।
আচম্বিতে ঘরের ভিতরে যেন তুষারবৃষ্টি শুরু হল— হাড়ে-হাড়ে জাগল কাঁপুনি! এসব কী? আজ কি এখানে সম্ভব ও অসম্ভবের ব্যবধান ঘুচে গিয়েছে?
এইবারে ভয় যে পেলুম, তা অস্বীকার করতে পারব না। ঘর তখন অন্ধকার, একটুখানি আলোর আভাস ছিল কেবল জানালার কাছে। শিউরোতে-শিউরোতে পায়ে-পায়ে জানালার দিকে এগিয়ে গেলুম। বাইরে কুকুরটা তখনও পরিত্রাহি চিৎকার করছে।
সহসা ঘরের এক কোণ থেকে খনখনে গলায় কে খিলখিল করে হেসে উঠল এবং তারপরেই শুনলুম মাটির ওপরে লাঠি ঠকঠকিয়ে কে যেন এগিয়ে আসছে, আমার দিকেই!
ভাগ্যে বাংলোর জানালা ছিল গরাদহীন, মারলুম আমি বাইরে লাফ!
সঙ্গে-সঙ্গে ইঁদারার পাড়ের ওপর থেকে কুকুরের ঝাপসা মূর্তিটার নীচের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার দিকে আসতে লাগল। তার দুই চক্ষু জ্বলছে দুটো আগুনের গুলি এবং তার কণ্ঠে জাগছে তেমনি ক্ষুধিত, আর্ত চিৎকার!
দিগ্বদিক জ্ঞান হারিয়ে বনপথের ওপর দিয়ে আমি প্রাণপণে ছুটতে লাগলুম।
পরে শহরের এক পশ্চিমা বিশেষজ্ঞের মুখে শোনা গেল মাস কয়েক আগে ওই ডাকবাংলোর খানসামা দৈব-দুর্বিপাকে ইঁদারার জলে পড়ে যায় এবং সঙ্গে-সঙ্গে তার প্রভুভক্ত কুকুরটাও জলে ঝাঁপ দেয়। তাদের কেউ বাঁচেনি। সেই থেকে ওই ডাকবাংলোর বদনাম হয়েছে। ওখানে ভয়ে আর কেউ বাস করে না।
কিন্তু এসব হচ্ছে বাজে কথা। আমার বিশ্বাস, ডাকবাংলোর খানসামাটা উন্মাদগ্রস্থ এবং ইঁদারার অদৃশ্য আকর্ষণ, ঘরের ভিতরে তুষারবৃষ্টি ও কুকুরের চোখের আগুন— এসব হচ্ছে আমার ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণাকাতর এবং রৌদ্র ও পথভ্রমে শ্রান্ত দেহের জন্যে মনোবিকারের প্রতিক্রিয়া মাত্র।
তবে আমার ধারণাটা সত্য কিনা পরীক্ষা করবার জন্যে আর কোনোদিন ঘটনাস্থলে যাওয়া হয়নি বটে।