ডাকবাংলোর হাতছানি

ডাকবাংলোর হাতছানি

জানতাম না৷ পরে জানলাম…

সামনের ডাকবাংলোর ম্যানেজার অনিরুদ্ধ আমাকে বললেন, যখন এসেছেন, ক’দিন এখানে থেকে যান৷ দেখবেন জায়গাটা আপনার ভালো লাগবে৷

অনিরুদ্ধ ঠিকই বলেছেন৷ এখানকার সব কিছুই ভালো লাগারই মতো৷ বিশেষ করে এই ডাকবাংলো৷ সন্ধে হলেই সামনের পাহাড়টা কিরকম আশ্চর্য লাগত৷ মনে হত, কোনো দুর্গম রহস্যের হাতছানি দিয়ে কে যেন ডাকে!

সামনে অবারিত মাঠ, ওপরে নীল আকাশ৷ মুক্ত বিহঙ্গীর দল আপন মনে খেলা করে…৷

ইজি-চেয়ারের ওপর বসে আজকের সংবাদপত্রটা ওলটাচ্ছিলাম৷ এমন সময় পাশের ঘরের বিনয়বাবু এলেন এবং বিনা ভূমিকায় বললেন, শুনলাম আপনি নাকি বিহার থেকে এসেছেন৷

ঠিকই শুনেছেন৷

বিহারে কোথায় ছিলেন?

ডাকোয়া-কোঠা—

আশ্চর্য মশাই! আমিও তো ওখানে কয়েক বছর ছিলাম৷ মানে রেল-জীবনের কাজের তাগিদে৷ তা জায়গাটা খুব ভালো৷ তবে বাঙালির সংখ্যা খুবই কম৷

হবে হয়তো! তবে আমি গিয়েছিলাম বেড়াতে নয়৷ সাধ করে কেউ ওই গ্রামে বেড়াতে যায় নাকি! গিয়েছিলাম ওখানকার আদিবাসীদের জীবনযাত্রার খবরাখবর নিতে৷ সরকারি কাজ করি কিনা…৷

তা এখানেও কি কাজে এসেছেন নাকি?

না৷ এখানে এসেছি ক’দিন বিশ্রাম নেব বলে৷

হাসলেন বিনয়বাবু৷ তারপর সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে আমাকে দিলেন, নিজেও ধরালেন৷

সন্ধে প্রায় হয়ে এসেছে৷

সামনের পাহাড়টার ওপরে এখান থেকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে একদল লোক হৈ হৈ করতে করতে যাচ্ছে৷ ওদের প্রত্যেকের হাতে মশাল৷ হয়তো কোনো আসন্ন উৎসবের জন্য ওরা তৈরি হচ্ছে৷ পরে জানলাম, ভাদু উৎসব৷ ভাদ্র মাস এলেই এই উৎসব শুরু হয়৷ বিনয়বাবু যাবার আগে বললেন, চলুন না, আজ ওপারটা ঘুরে আসি৷ এখানে এসে তো আপনি দিনরাত খালি বই পড়ছেন, আর কি সব লিখছেন৷ একদণ্ডের জন্যে বেরুতেও তো দেখি না৷

বলেছি তো এখানে এসেছি বিশ্রামের জন্য৷

রাত তখন প্রায় দশটা হবে! রাতের খাবার খেয়ে নিয়ে নিজের ঘরে যাব, সেই সময় আবার বিনয়বাবুর সঙ্গে দেখা৷

তিনি বললেন, আপনি মশাই সত্যিকারের সুখী লোক৷ রাতের খাবার এর মধ্যে খেয়ে নিলেন৷

হ্যাঁ৷ রাতের খাবার আমি দশটার মধ্যেই খাই৷ এটা আমার চিরদিনের অভ্যাস৷

আমার নিজের ঘরে এসে কাগজপত্র নিয়ে কিছু লিখবার চেষ্টা করছিলাম৷ কিন্তু হল না৷ আশ্চর্য! লেখার কাগজগুলি উড়তে লাগল! কালি-কলমও সেই সঙ্গে৷ কি ব্যাপার? কোনো ভোজবাজি নাকি!

ঘরটা বন্ধ করেই রেখেছিলাম৷ হঠাৎ বিনয়বাবু এসে হাজির৷ আমি অবাক হয়ে গেলাম! বললাম, আপনি? একগাল হেসে বিনয়বাবু বললেন, আমার না এলে কি চলে? আমি…

কিন্তু ঘর তো বন্ধ, কি করে এলেন?

এবার বিনয়বাবু বললেন, ঘর বন্ধ তাতে কি? আমি মুক্ত৷ সর্বত্র আমার অবাধ গতি৷

আমার যেন কেমন একটা মনে হল৷ ইনি বিনয়বাবু নয়, অন্য কেউ৷ হয়তো আমাকে ভয় দেখাতে এসেছেন৷

আমি একটু গম্ভীরভাবে বললাম, এবার আমার একটু ব্যক্তিগত কাজ আছে, আপনি দয়া করে যান৷

আপনি যে লিখবেন, আপনার কাগজ, কলম, কালি কই? হাওয়ায় উড়ে গেছে৷ যাকগে…

এই বলে চোখের সামনে কাগজ কলম কালি দিয়ে বললেন, এই নিন৷

আমার তখন সত্যি ভয় ভয় করছিল৷ বিনয়বাবু বললেন, চলি, আর দেখা হবে না৷

আমি বিনয়বাবুকে ধরতে গেলাম৷ আশ্চর্য! কোথায় বিনয়বাবু? তার পরিবর্তে তার পরনের জামাকাপড় পড়ে আছে মাটির উপর৷

তারপর কি হল আমার আর মনে নাই৷…

জানতাম না৷ পরে জানলাম, বিনয়বাবু নামক এক ভদ্রলোক এই ডাকবাংলোয় এসেছিলেন, কিন্তু যেদিন আসেন, তারপরের দিনই মারা যান৷ ওই ঘরটা সেদিন থেকেই বন্ধ ছিল৷ এর আগেও দু’একজন ভদ্রলোক এসে বাস করতে পারেনি৷ বাংলোর ম্যানেজার অনিরুদ্ধবাবু তাঁর ব্যবসার জন্য এ কথা কাউকে বলতেন না৷ কিন্তু ঘরটা বন্ধ করতে বাধ্য হন৷

অনিরুদ্ধবাবু বললেন, বিনয়বাবু নিজেও একজন অধ্যাপক ছিলেন৷ তিনি কিন্তু কারও ক্ষতি করেন না৷ কেন জানি না, আপনাকে তাঁর ভালো লেগেছিল৷ তাই তিনি আপনার সঙ্গে আলাপ করেছিলেন৷—একি আপনি চললেন কোথায়?

আর কোথায়? ‘ফিরে চল আপন ঘরে৷’ এখানকার কাজ আমার ফুরিয়েছে৷

অনিরুদ্ধবাবু বললেন, আবার এদিকে এলে আসবেন৷

আসব৷

এ বলা ছাড়া আমার আর উপায় ছিল না৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *