ডাক
একটা হইচই এর শব্দে আটটা নাগাদ ঘুমটা ভেঙে গেল গণেশের। বিরক্তিতে মুখ বিকৃত করে উঠে বসল খাটের ওপর। কাল রাতে পালা শেষ হতে দুটো বেজেছে। তারপর মেক-আপ তুলে শুতে-শুতে প্রায় ভোর।
পালা থাকলে বেলা দশটার আগে ওঠে না গণেশ। কাজেই অসময়ে ঘুম ভেঙে মুখে কয়েকটা কাঁচা খিস্তি এল তার। খিস্তি দিয়ে মন ঠান্ডা হলে দেখতে গেল হইচইটা কীসের! ব্যাপার শুনে গায়ের রোম খাড়া হওয়ার জোগাড়। কাল রাতে নাকি নসু পাগলার বাবা বিপিন খুড়োকে নিশিতে ডেকেছে। মাঝরাতে খুড়ো নসুর গলায় ‘বাবা’ ‘বাবা’ ডাক শুনে দরজার শিকল খুলে বেরিয়ে পড়ছিল প্ৰায়। আচমকা খুড়ি টের পেয়ে আটকায় খুড়োকে। নসুটা প্রায় দিনই বাড়ি ফেরে না। রেললাইনের ধারে শ্মশানকালীতলায় পড়ে থাকে। খুড়োর ভারী চিন্তা ওকে নিয়ে। কাল রাতেও অনেক দেরিতে বাড়ি ফিরেছে। তার আগেই খুড়ো আফিম খেয়ে ঘুমিয়েছে। তাই খুড়ি জানলেও খুড়ো জানে না কখন নসু ফিরেছে। শেষ রাতের দিকে ‘বাবা’ ডাক কানে আসায় ভেবেছিল নসু ফিরেছে বুঝি। এদিকে নসু তখন নিজের ঘরে ঘুমে বিভোর। খুড়ি না আটকালে যে কী হত কে জানে! বিপিন খুড়ো দাওয়ায় বসে এখনও শিউরে শিউরে উঠছে। পিছনে বসে নসু আর নসুর মা।
অনেক লোক ঘিরে রয়েছে ওদের। হাই তুলতে তুলতে ওদের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো গণেশ। নানাধরনের কথাবার্তার মাঝে গলা তুলল সে, “তা হ্যাঁ রে নসু, তুই না তন্ত্রসাধনা করিস? বাঘের ঘরেই ঘোগের বাসা?”
নসু বিরক্তমুখে বলল, “থামো তো গণশাদা। বাবা কী শুনতে কী শুনেছে তার ঠিক নেই। এমনি তো কানে শোনে না। আর আমার সাধনা নিয়ে কিছু বলবে না বলে দিলাম। ভালো হবে না কিন্তু।”
গণেশ দাঁত বের করে হাসল। তারপর পেছন চুলকাতে চুলকাতে বলল, “দিনদিন চেহারাটা যা বানাচ্ছিস, তন্ত্র তোর যন্ত্র পালটে দিল না তো রে?” একটু মেয়েলি চেহারার নসুকে গণেশের কাছে অপ্রস্তুত হতে দেখে গ্রামের লোকরা ভারী আমোদ পেল। মুখ লাল করে দুমদাম পা ফেলে বেরিয়ে গেল নসু। নসুর যাওয়ার পথের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে আবার মুখ খুলল গণেশ। গ্রামের লোকেদের উদ্দেশ্য করে বলে উঠল- “এ তো বড়ো চিন্তার কথা হল। ক’দিন আগে সতু মাষ্টারের মেয়েটাকে নিশিতে ডাকল। নেহাৎ কপালজোরে বেঁচেছে। আবার এই। এর কোনও প্রতিকার করা দরকার তো না কি?”
গণেশের কথায় সায় দিয়ে উঠল উপস্থিত লোকজন। দিন কয়েক আগে গ্রামের স্কুলের সতু মাষ্টারের মেয়ে ক্ষেন্তি রাতের বেলা ওর নাম ধরে ডাক শুনে বেরিয়ে গিয়েছিল ঘর থেকে। ওর বুড়ি ঠাকুমা রাতে পেচ্ছাপ পেলে দাওয়ার কোণে রাখা মাটির হাঁড়িতে করত। বেরোবার সময় ক্ষেন্তির পায়ে লেগে হাঁড়ি উলটে ওর গায়ে ময়লা জল লেগে যায়। শিকার অপবিত্র হয়ে যাওয়ার ফলেই হয়তো ক্ষেস্তি বেঁচে যায়। মাঝরাতে হুঁশ ফিরে নিজেকে ঘরের বাইরে দেখে ভয়ে কেঁদে ওঠে সে। তখন জানাজানি হয় সব ঘটনা। সেই থেকে গ্রামে একটা উদ্বেগ কাজ করছিল মানুষের মধ্যে। তার উপর আবার গতরাতে বিপিন খুড়োর ঘটনা। ঠিক হল, পাশের গ্রামের পীর বাবার দরগায় যাওয়া হবে এর প্রতিবিধান চেয়ে।
.
বাইরে একটানা ঝিঝিঁর ডাক শুনতে-শুনতে ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে ঝর্ণার। সারাদিনের কাজকর্ম সেরে রাতের বেলায় গা ধুয়ে এসে বসলেই শরীরটা ছেড়ে দেয়। বয়স তো বাড়ছে। নয় নয় করেও দুই কুড়ি দশ হল। দুগ্গা পুজোর সপ্তমীতে জন্ম ঝর্ণার। বাবা তাই ওকে দুগ্গা মা বলেই ডাকত। মা বলত, মেয়ে আমার বড়ো ভাগ্যমানি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঝর্ণা। মা-বাবা ভাগ্যিস বেঁচে নেই! তাই তাদের ভাগ্যমানি মেয়ের এমন ভাগ্য দেখে যেতে হল না। বিয়ের পর ঝর্ণার বর মৃণাল তাকে সুখেই রেখেছিল। গ্রামের বউ ঝিদের ঈর্ষার কারণ ছিল তাদের ভাব ভালোবাসা। ষোলো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে ঝর্ণার। এত বছরের সংসারে একদিনের তরেও মতের অমিল হয়নি তাদের। মাঝে একমাত্র মেয়েকে বড়ো করা, ভালো বিয়ে দেওয়া অব্দি ঝর্ণা একটু ব্যস্ত ছিল। আবার গত পাঁচ বছর ধরে মৃণাল ছাড়া তার জীবনে আর কিছু নেই। মেয়ের বিয়ে হয়েছে ভালো ঘরে, ভালো বরে। তবে তারা গরীব বাবা মায়ের ঘরে তাদের বউকে পাঠায় না। তা হোক, মেয়েটা যে ভালো আছে, তাতেই ঝর্ণা আর মৃণাল খুশি। সবই ঠিক চলছিল। কিন্তু কী যে হল, তিন বছর আগে হঠাৎ মৃণাল ঘরের মধ্যেই পড়ে গেল। পড়েই অজ্ঞান। তারপর ডাক্তার হাসপাতাল। ব্রেন স্টোক না কী যেন বলল ডাক্তার। সেই যে পড়ল লোকটা, সেই থেকে বিছানাসই হয়ে রইল। মুখে কথাটি নেই, না নড়ন, না চড়ন। জড়পদার্থের মতো পড়ে আছে। পেচ্ছাপ পায়খানা নিঃসাড়ে হয়ে যায়। ভাত তরকারি লেই করে চামচে দিয়ে মুখে দিলে কোনওমতে গিলতে পারে। শুধু বড়ো বড়ো চোখদুটো ঘুরে ফিরে ঝর্ণাকে দেখে
আধো তন্দ্ৰায় আকাশ পাতাল ভাবছিল ঝর্ণা। হঠাৎ টিনের চালে দমাস করে একটা শব্দ হতেই চটকা ভেঙে গেল। উফ, আবার একটা ডাব পড়ল। এ বছর আর একটাও নারকেল পাওয়া যাবে না মনে হচ্ছে। প্রতি বছর শীতে গ্রামের লোকের কাছে নারকেল বিক্রি করে বেশ দু-পয়সা হয় ঝর্ণার। এবার এত ডাব পড়ে যাচ্ছে, কী জানি কী হবে! কোনওমতে নিজের শরীরটা টেনে তোলে সে। ডাবটা এখনই না নিয়ে এলে পাড়ার ভেঁপো ছোঁড়াগুলো রাতের বেলা নিয়ে পালাবে। যদিও গ্রামে ডাবের তেমন চাহিদা নেই, বিক্রি করলে কেউ নেবে না, অথচ চুরি করতে ছাড়বে না। উঠে দাঁড়িয়ে খাটের দিকে নজর গেল ঝর্ণার। মৃণাল ঘুমোচ্ছে। মুখটা হাঁ হয়ে আছে আর সেই হাঁ-মুখ থেকে লালা গড়িয়ে এসেছে গাল বেয়ে কানের দিকে। পরনের শাড়ির আঁচলটা দিয়ে মৃণালের গালটা মোছাতে মোছাতে চোখে জল এল ঝর্ণার। নিজের চোখের জলও মুছে নিল আঁচল দিয়ে। তারপর দরজার শিকল নামিয়ে বাইরে পা বাড়াল।
*****
মাঝরাত। হনহন করে গ্রামের রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে এক ব্যক্তি। তার নগ্ন শরীরে উত্তুরে হাওয়া মাঝে মাঝে কাঁপুনি ধরিয়ে যাচ্ছে। বিড়বিড় করে নিজের মনে কী যেন বলে চলেছে সে। দু-হাতে কিছু একটা আঁকড়ে ধরে প্রায় ছুটে চলেছে সে। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর সে থমকে দাঁড়ায় একটা বাড়ির সামনে। এতক্ষণ ধরে যা বলছিল, সেটাই একটু উচ্চস্বরে বলতে বলতে এগিয়ে গেল সে। তারপর আস্তে আস্তে দাওয়ায় উঠে মিহি গলায় ডাকল ‘গণেশ’’গণেশ’। কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। তারপর খুলে গেল ঘরের দরজা। বেরিয়ে এল গণেশ। ঘুমের মধ্যে হাঁটছে যেন। গণেশ বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সেই ব্যক্তি হাঁটা শুরু করল। মন্ত্রমুগ্ধের মতো গণেশ এগিয়ে চলল তার পিছন পিছন। গ্রাম ছেড়ে একটু এগিয়েই রেললাইন। তার পাশেই শ্মশানকালীর মন্দির। তার কাছাকাছি এসে টলতে থাকা গণেশের সামনে গিয়ে কিছু দুর্বোধ্য মন্ত্র পড়তে পড়তে হাতে-ধরা বস্তুটি বাড়িয়ে ধরল সে। বস্তুটি একটা ডাব ছাড়া আর কিছুই না। গণেশ মাটিতে পড়ে যেতেই হাতের ডাবটার উপর দিকে ঢাকনা চাপা দিল নসু। নে, এবার দেখ। নসুর পিছনে লাগা! আজ নয়, অনেকদিন থেকে নসুর পিছনে লেগে আছে গণেশ
লোকের কাছে নসুকে নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করে মজা পেত গণেশ। গ্রামে নসু পাগলা নামটা চালু করার পিছনেও গণেশ। যাত্রাপালায় নায়কের রোল করে ধরাকে সরা জ্ঞান করত ও। একদিন মুখে বিচিত্র মেকআপ করে রাতের বেলা নসুর ঘাড়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়েছিল গণেশ। সেদিন নসু মরেই যেত ভয়ে। শ্মশানকালীতলায় রাতে তান্ত্রিকরা আসে। ওদের পুজোর জোগাড়ে সাহায্য করলে দু-ছিলিম গাঁজা জোটে নসুর। তাই নিয়ে কম ব্যঙ্গ করেনি গণেশ। তার উপর প্রায়ই সবার সামনে অপমান। নসু তান্ত্রিক বাবার কাছে আর্জি জানিয়েছিল তাকে নিশির ডাকের মন্ত্র শিখিয়ে দিতে। জীবনে মাত্র একবারই কারো প্রাণ নিতে ব্যবহার করতে পারবে এই মন্ত্র, এই শর্তে বাবা তাকে শিখিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এর জন্য তাকে আরও দুবার এর প্রয়োগ করতে হয়েছে। একবার সতু মাষ্টারের মেয়ের ওপর। সেবার সে দেখতে চেয়েছিল সত্যিই কাজ হয় কিনা। আর দ্বিতীয়বার তার নিজের বাবার উপর। যাতে নসুর ওপর গ্রামের লোকদের সন্দেহ না পড়ে। আর যাই করুক, নসু নিশ্চয়ই নিজের বাবাকে মারতে চাইবে না! দু-বারের একবারও নসু ডাবের কাটা মুখের ঢাকনা খোলেনি। তাই দু-জনই বেঁচে গেছে। নিশ্চিত হয়েই আজ বেরিয়েছিল সে। আর কার্যসিদ্ধি!
প্রতিশোধের আনন্দে পালাতে ভুলে গেল নসু। আর তখনই… শয়ে শয়ে গ্রামবাসী এসে হাজির হল সেখানে। সবার হাতেই জ্বলছে মশাল। রে রে করে তেড়ে এসে নগ্ন নসুকে টেনে নিল উন্মত্ত জনতা। তার হাত থেকে ডাবটা পড়ে যাওয়ার মুহূর্তেই সেটা লুফে নিল… ঝর্ণা। ডাবটা হাতে নিয়েই জনতার হাতে মার খেতে থাকা নসুকে পিছনে ফেলে দৌড়ল ঝর্ণা। আজ ডাব আনতে গিয়ে নসুকে দেখে ফেলেছিল সে। প্রথমে ভেবেছিল, ডাব চুরি করতে এসেছে নসু। তারপর অন্ধকারে নগ্ন নসুকে দেখে ঝটকা খেয়েছিল সে। ছোটোবেলায় মায়ের মুখে শোনা নিশির গল্প মনে পড়ে গিয়েছিল। নিশি কোনও প্রেতাত্মা নয়, আসলে তন্ত্র জানা মানুষ। একটা ডাবের মুখ কেটে সেই কাটা অংশ দিয়ে ডাবের মুখটা চাপা দিয়ে কোনও মানুষের নাম ধরে ডাকে নিশি। সেই লোকটি একবার ডাকে সাড়া দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলে মন্ত্র পড়ে তার আত্মাকে ওই ডাবের মধ্যে ভরে মুখ আটকে দেয় সে। তাতে লোকটির আত্মা সারা জীবনের মতো বাঁধা পড়ে যায় ওই ডাবের ভিতর। লোকটি মরে গেলেও তার আত্মাকে নিজের চাকর বানিয়ে রাখতে পারে নিশিরূপী তান্ত্রিক।
আবার ওই ডাবের জল কোনও মুমূর্ষুকে খাইয়ে দিলে সে নতুন জীবন ফিরে পায়। তবে এসবই করতে হয় নগ্ন দেহে। নসুকে দেখে এইসব মনে পড়ে গিয়েছিল ঝর্ণার। নসুর পিছু নিয়েছিল সে। সব দেখেছিল লুকিয়ে লুকিয়ে। মনের মধ্যে নতুন করে আশা বাসা বাঁধছিল। তারপর দৌড়ে গিয়ে গ্রামবাসীদের জড়ো করা তো সামান্য ব্যাপার।
দু-হাতে ডাবটা আঁকড়ে ছুটছিল ঝর্ণা। ছুটছে আর একটা একটা করে খুলে ফেলছে পরনের কাপড়। লজ্জা তো বরাবরই ভেসে গেছে ভালোবাসার জোয়ারে। নগ্ন অবস্থায় নিঃশব্দ অন্ধকারের বুক চিরে ছুটে চলেছে ঝর্ণা। এখনই যে মৃণালের কাছে পৌঁছতে হবে তাকে।