ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারের এক গ্রামের ক্রিকেট মাঠে খেলার দৃশ্য বাংলাদেশের অতি প্রাচীন খেলার একটির নাম ‘ডাংগুলি’। আমি ডাংগুলিকে বলি ক্রিকেটের আদি পিতা। কেন বলি তা খেলা ব্যাখ্যা করলেই বোঝা যাবে। ডাংগুলিতে একজন ব্যাটসম্যান লম্বা ডান্ডা (ব্যাট) হাতে মাঝখানে দাঁড়ায়। এর নাম ডাং। তার সঙ্গে থাকে ছয় ইঞ্চি লম্বা কাঠি (বল)। কাঠিটাকে বলে গুলি। ডাং আর গুলির খেলার নাম ডাংগুলি। খেলোয়াড় মাটিতে খানিকটা উঁচু করে রাখা গুলিকে ডাং-এর খোঁচায় শূন্যে তুলে সজোরে বাড়ি দিয়ে দূরে পাঠায়। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা ফিল্ডাররা চেষ্টা করে কাঠিটা লুফে নিতে অর্থাৎ ক্যাচ ধরতে। ক্যাচ ধরকে পারলেই ব্যাটসম্যান আউট। ক্রিকেটের সঙ্গে ডাংগুলির অমিল হলো, এখানে কোনো বোলার নেই। যে ব্যাট করে সে-ই বোলার। স্ট্যাম্প আউট বলে কিছু নেই, ক্যাচ আউটই একমাত্র আউট। ভারতবর্ষের ডাংগুলি খেলা দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ব্রিটিশরা ক্রিকেট খেলা শুরু করল—এমন মনে হওয়া মোটেই বিচিত্র নয়।
শৈশবের কথা। দাদার বাড়িতে বেড়াতে গেছি, জুটে পড়েছি ডাংগুলি খেলার দলে। মহাউৎসাহে খেলা চলছে। আমাকে খেলতে দেখে দাদাজানের (মৌলানা আজিমউদ্দিন আহমেদ, মাদ্রাসাশিক্ষক) মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন। গম্ভীর গলায় বললেন, যাবতীয় খেলার পেছনে থাকে ইবলিশ শয়তানের উৎসাহ এবং ইন্ধন। একে বলে শয়তানের ওয়াসওয়াসা। খেলতে গিয়ে খেলোয়াড়েরা অন্য কাজ ভুলে যায়, নামাজের ওয়াক্ত ভুলে যায়, শয়তান এই জিনিসই চায়। কাজেই তোমাকে আর যেন কোনো খেলাধুলায় না দেখি।
আমি বললাম, আচ্ছা।
দাদাজান বললেন, যে খেলে সে যেমন শয়তানের প্রভাবে থাকে, যে দেখে সেও থাকে। খেলা দেখবেও না।
আমি আবারও হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ালাম।
দাদাজানের কথায় মনে হতে পারে ইসলাম ধর্মে খেলাধুলা নিষিদ্ধ। তা মোটেও না। আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভাইস চ্যাঞ্জেলর ড. ইউসুফ আল কারদাভি ফতোয়া দিয়েছেন, বাজি নেই এমন সব শারীরিক এবং মানসিক খেলা ইসলাম ধর্মে বৈধ।
আমাদের নবীজি (দ.) নিজেও হজরত আয়েশা (রা.)-র সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতা করেছেন।
শয়তানের প্রভাবেই হয়তো আমাদের খেলোয়াড়েরা যখন চার-ছয় মারে, আমি চেঁচিয়ে গলা ভেঙে ফেলি। ক্রিকেট বিষয়ে আমার প্রবল উত্তেজনা দেখে একজন পত্রিকার রিপোর্টার আমার ইন্টারভিউ নিতে এলেন এবং ক্রিকেট বিষয়ে নানা প্রশ্ন করলেন। আমি কোনোটারই জবাব দিতে পারলাম না। গুগলি কী বস্তু, বলতে পারলাম না। রিভার্স সুইং কী, তাও জানি না। ক্রিকেট বিষয়ে আমার মূর্খতায় সাংবাদিক হতাশ হলেন, একপর্যায়ে বললেন, আপনি যে ক্রিকেট কিছুই বোঝেন না। এটা কি লিখতে পারি?
আমি বললাম, অবশ্যই লিখতে পারো।
সাংবাদিক বললেন, কিছু না বোঝেও ক্রিকেট কেন পছন্দ করেন, তা কি ব্যাখ্যা করবেন?
আমি বললাম, ক্রিকেট পছন্দ করি কারণ আমি একজন গল্পকার, ফিকশন রাইটার।
স্যার, বুঝিয়ে বলুন।
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, ক্রিকেটে এক ওভারে ছয়টি করে বল করা হয়। বল করা মাত্র গল্প শুরু হয়। নানান সম্ভাবনার গল্প। ব্যাটসম্যান আউট হওয়ার সম্ভাবনা, ছক্কা মারার সম্ভাবনা, শূন্য পাওয়ার সম্ভাবনা। ছয়টা বল হলো ছয়টি সম্ভাবনা গল্পের সংকলন। এখন বুঝেছ?
সাংবাদিক হ্যাঁ-না কিছুই বললেন না। আমি বললাম, সারা পৃথিবীতে কবিদের একটা বড় অংশ ক্রিকেট পছন্দ করেন। কেন করেন, জানো? কবিদের কাজ হচ্ছে ছন্দ নিয়ে। ক্রিকেট ছন্দময় খেলা বলেই কবিদের পছন্দের খেলা।
ক্রিকেটপাগল কবি নির্মলেন্দু গুণের ক্রিকেট আবহে লেখা একটি কবিতা পড়লে কেমন হয়?
শব্দের স্পিনার
গ্যারি সোবার্স, চন্দ্র-প্রসন্ন-বেদী ও আবদুল কাদিরের মতোন
আমি শব্দকে স্পিন করি। তাদের কাছেই আমি শিখিয়াছি এই
ঘূর্ণিবলের জাদু। আপেলের মতো লাল বলটিকে ট্রাউজারে ঘষে
ঘষে, তাতে কপালের ঘাম মাখিয়ে আবদুল কাদির যে রকম
নৃত্যের ভঙ্গিতে এসে স্ট্যাম্প লক্ষ্য করে তার বলটিকে ছোঁড়ে,
আমিও তেমন প্রতিটি শব্দের কানে মন্ত্র পাঠ করি, তারপর
‘যাও পাখি’ বলে তারে ভালোবেসে তোমার উদ্দেশে ছুঁড়ে দেই।
আদি ক্রিকেটে মুখ ভর্তিদাড়ির একটা ব্যাপার ছিল। হাস্যকর লাগছে? কথা সত্যি! ক্রিকেট খেলার যেকোনো প্রাচীন ছবিতে দেখা যাবে মুখভর্তি দাড়ি নিয়ে ব্রিটিশ লর্ডরা ক্রিকেট খেলছেন। বঙ্গদেশে ক্রিকেটের সূচনা করেন সত্যজিৎ রায়ের দাদা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, তাঁর ভাই এবং বন্ধুরা। কাকতালীয় হলেও সত্যি, তাঁদেরও মুখভর্তি দাড়ি ছিল।
দাড়ি ট্র্যাডিশন কিছুটা হলেও আমাদের ক্রিকেট টিমেও আছে। আমাদের একজন ক্রিকেটারের মুখ ভর্তি দাড়ি (সোহরাওয়ার্দী শুভ)।
আজ আয়ারল্যান্ডকে বাংলাধোলাই দেওয়া হবে। আসুন, সেই প্রস্তুতি নিই। আমরা তো খেলব না, গলা ফাটিয়ে চেঁচাব। গার্গল করে গলা পরিষ্কার করা দরকার না?
রয়েল বেঙ্গল টাইগার খানিকটা ঝিমুনির মধ্যে আছে। তাকে জাগাতে হবে। তার বিকট হালুমধ্বনি শোনার অপেক্ষা।
পাদটীকা: পাক-ভারত উপমহাদেশে প্রথম ক্রিকেট খেলা হয় বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ গ্রামের এক ঈদগাঁ মাঠে। গ্রামের নাম মশুয়া। ক্রিকেট খেলার আয়োজন করেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এবং তাঁর ভাইয়েরা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১১