ডলার
বাসু আর আমি একসঙ্গে পড়তাম বিরাটি মহাজাতি নগর ইস্কুলে। আমি যখন ক্লাস ফাইভে, বাসু সিক্স-এ। পরের বছর বাসু সিক্স-এই থেকে গেল বলে আমরা সহপাঠী হলাম। ক্লাস সেভেনে ও আবার রয়ে গেল। ক্লাস সেভেনে মনে আছে, তারাপদবাবু স্যার ঝাড়া পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে সিন্ধুসভ্যতা পড়ালেন। নগর নির্মাণ, বৈদেশিক বাণিজ্য, সিলমোহর, শিল্প সামগ্রী, পয়ঃপ্রণালী, স্নানাগার—সব পড়ানো হয়ে গেলে তারাপদবাবু বললেন, এবার বলো কার মনে কী প্রশ্ন আছে। বাসু উঠে দাঁড়াল। বলল, স্যার, কিছুদিন আগেই যে বললেন, আগেকার যুগের মানুষেরা খুব নোংরা ছিল, কাঁচা কাঁচা মাংস খেত, ওরা আবার স্নানও করত? সাবান মেখে স্নান করত স্যার? ওই স্নানাগারের জল সাবান-সাবান হয়ে যেত? তারাপদবাবু প্রশ্নটা শুনে কিছুক্ষণ হাঁ করে ছিলেন। বোধহয় ভাবছিলেন—এই পঁয়চাল্লিশটা মিনিট ধরে কী করলাম আমি? তারপর লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন।
ওই স্নানাগারের কথা মনে হয় এই পুকুরে স্নান করতে করতে। বিরাটির মহাজাতি নগর কলোনির ভিতরের এই পুকুরটাকে আমি বলি পদ্মপুকুর। এখন যদিও পদ্মটদ্ম নেই, কচুরিপানা আছে কিছু, আমরা এই পুকুরেই স্নান করি ফাঁক পেলেই। ছোটবেলায় রোজই করতাম, আমাদের বাড়িতে টিউকল আছে, মিউনিসিপ্যালিটির ট্যাপওয়াটারও আছে, তবুও পুকুরের নেশাটা ছাড়তে পারিনি। রবিবার দিনটায় পুকুরে আসা চাই। বেলা বারোটা নাগাদ স্নান করতে আসি, আর বাসুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। স্নান করতে আসবার সময় বাসুর কাছে একটা বালতি থাকে। ওই বালতিতে থাকে কাপড়চোপড়। বাসু পুকুরের সিঁড়িতে থুপিয়ে গুপিয়ে জামাকাপড় কাচে। যেগুলো কাচে তার একটাও ওর নয়। সব ভাল ভাল জামা-প্যান্ট। দামি। বাসু নিজে ফুলপ্যান্ট পরে না। পাজামা আর গেঞ্জিতেই দেখা যায় ওকে, মাঝে মাঝে হাওয়াইশার্ট। বাসু জামাপ্যান্ট কাচতে কাচতে রিলে করে—এটা বড়দার প্যান্ট। টেরিকটন। গোয়ালিয়র। দুটো প্লেট। এটা মেজদার। জিন্স। নিউপোর্ট। বহুত নোংরা করেছে। শালা, আগে দিতে পারোনি? এটা ছোটভাইয়ের। সাদা জামা সাদা প্যান্ট। এয়ারপোর্টের চাকরি। হেভি ফাট, লাটের বাট, উইলস ফোঁকে, গগলস চোখে।
বাসুর ছোটভাইটা এয়ারপোর্টের পোর্টার। মালপত্র টানাটানি করে। ফরেনারদের কাছ থেকে টিপস পায়। বাসু জামাপ্যান্ট কাচার আগে একটু পকেট-টকেট দেখে নেয়। কখনও পেয়ে যায় সিগারেটের প্যাকেট, তাতে একটা-দুটো সিগারেট অবশিষ্ট, কখনও পেয়ে যায় একটা আধুলি কিংবা এক টাকা দু’টাকার কয়েন। পেয়ে গেলেই গান গায়। ওলে ওলে, কিংবা মেহবুবা মেহবুবা। একদিন পেয়েছিল একটা কনডোম। ওটা ছিল ওর সেজদার। বাসুর সেজদা গাড়ির ড্রাইভার। আমি বললাম, কীরে বাসু? কী ব্যাপার? বাসু নির্বিকার। ও মোড়কটা ছিঁড়ে জল ভরতে লাগল। আমরা ক’জন পুকুরে ছিলাম। আমরা কয়েকজন বন্ধু। আমরা স্নান করি, টুকটাক গেঞ্জি জাঙিয়া কাচি আর গল্পগুজব করি। আমরা ঘাটে থাকলে মেয়েরা আসে না। প্রসূন বললে, কীরে বাসু, তোর সেজদা তো বিয়ে করেনি, পকেটে এসব কেন? বাসু ওতে জল ভরে গিঁট দিল। বাদল বলল, তুই জলই ভরে যা, দাদারা আসল জিনিস ভরুক। বাসু হঠাৎই এক হাতে জল ভরা কনডোম নিয়ে কেমন উদাস দার্শনিক হয়ে যায়। আমাদের দিকে তাকিয়ে বলে, সেজদা সেজদা, আমি ভাবছি তুই কবে ব্রেক ফেল করে দিবি তখন আমাদের ফ্যামিলিতে কেলো হয়ে যাবে। হে পুলিশ, তুমি ঠিক মতো সিগন্যাল দিয়ো। তারপরই আবার বালতিতে হাত ঢোকাল। কে পুলিশ, আকাশে? ভগবান?
একদিন আমরা স্নান করতে এসেছি, প্রদীপ, বাদল, প্রসূন সবাই আছে ঘাটে, বাসু কাপড়জামা কাচছে, আর, রিলে করছে। এই যে শালা মেজদার প্যান্ট, সিংগেল পকেট, সাইড পকেট, বিস্কুট কালার, ছোপছোপ দাগ, ভাল কামায়, তবু শালা মাক্ষীচুষ। পায়ের কাছটায় ফাটা, তবু শালা বলবে বাসুই ফাটিয়েছে। এবার বেশি যদি ডিংনেয়, এইসা দেব না, পাছা ফাটিয়ে দেব। আমার নাম বাসু— বলতে বলতে প্যান্টের পা ধরে পাছার দিকটা শানে আছড়াচ্ছে।
প্রদীপ বলল, এত আছাড় মারছিস কেন রে বাসু, ফেঁসে যাবে তো! বাসু বলল—মেজদাকে কেমন প্যাঁদাচ্ছি দেখ না। তারপর বাসু প্যান্টটাকে খুব চিপল, চিপবার সময় প্যান্টকে পাক খাওয়াতে হয়। বসু দাতে ঠোট চেপে প্যান্টটাকে পাক খাওয়ানোর সময় বলছিল, দেখে লে, হিম্মত আছে, মায়ের দুধ খেয়ে বড় হয়েছি। তারপর আর একটা বালতিতে ছুড়ে দিয়ে বলল— ফোট বে।
এর পরেরটা ছোটভাইয়ের। সাদা প্যান্ট। পকেটে হাত ঢুকিয়েই বাসুর মুখে হাসি। পকেট থেকে বার করে আনল হাত, ভাঁজকরা জিনিসটা ওর হাতের মুঠোয়। বলল—মার দিয়া। মুঠোটা খুলল। কাগজটা দেখে মন খারাপ হয়ে হেল বাসুর। যা শালা, এটা তো টাকা নয়… ! বাসুর কাছ থেকে ওটা চেয়ে নিয়ে আমি দেখি। আমি বলি, টাকা নয়, টাকার বাপ। ডলার। এটা একটা দশ ডলারের নোট।
ওমনি প্রদীপ, বাদল সবাই বলে উঠল, দেখি দেখি…! লোভীর মতো সবাই দেখতে লাগল ডলারটা। বাদল ওটাতে হাত বুলোল। প্রদীপ বলল, বাসু, তুই বড়লোক হয়ে গেলি রে। দশ ডলারের দাম কত জানিস? বাসু জানে না। চেয়ে আছে। আমি বলি, চারশো বিশ। চারশো বিশ শুনে বাসু হাসে। ভাবে কোনও মজা। বাদল বললে—এটা আমায় দিয়ে দে বাসু, তোকে তিনশো টাকা দেব। প্রসূন বলল—নারে বাসু, এর এখন দাম চারশো কুড়ি কি পঁচিশ টাকা। তিনশো টাকায় দিতে যাবি কেন। না রে বাদল, বাসুকে ঠকাসনা। বাদল বলল—বাসু যেখানে ভাঙাতে যাবে তারাই ঠকিয়ে দেবে, তারচে, আমিই যদি…
প্রসূন বলল, বাঃ! কী সুন্দর যুক্তি! প্রসূন বলল—আমায় দিস বাসু, আমি তো ব্যাংকে কাজ করি, তোকে ভাঙিয়ে দেব, তোকে কোথাও যেতে হবেনা। তার আগে ঠিক করতে হবে তোকে, ডলারটা কি তোর ছোটভাইকেই ফেরত দিবি? এটা তো ওরই পকেটে পেয়েছিস।
বাসুর কপালে রেখা ফুটল। যেন চিন্তায় পড়ল হঠাৎ। ও যখন এক টাকা-দু’টাকা পায়,কী খুশি। চারশো কুড়ি শুনে ও ততটা আনন্দিত হচ্ছে না যেন। ও বোধ হয় অনেকটা স্বগতোক্তির মতোই বলল—হেবি চিন্তার ব্যাপার হয়ে গেল। বাসু ডলারটা অন্য একটা কাগজে মুড়ে পা-জামার গোঁজে ভরে রাখল। ওর স্যান্ডো গেঞ্জির কলার নেই, নইলে এইসময় ও কলার ওঠাত। বাসুর আবার কাজে মন। হলই বা দশ ডলারের মালিক, কাজ তো করতেই হবে।
বাসুর ওই ছোটভাই এয়ারপোর্টের পোর্টার হবার সুবাদে বিদেশিদের কাছ থেকে বকশিশ পায়। কোনও সাহেব পকেটে খুচরো না থাকায় একটা দশ ডলারই দিয়ে দিয়েছিল। অবশ্য দশ ডলার ওদের কাছে তেমন কিছু নয়। কিন্তু বাসু ওই অজানা সাহেবকে ভগবান ভাবছে।
বাসু এর পর থেকে কাপড় কাচার সময় ছোটভাইয়ের দামি প্যান্টটা খুব ভাল করে দেখে নিত, যদি আর একটা ডলার পাওয়া যায়।
আমরা মাঝে মাঝে বলতাম, কী রে বাসু, ডলারটা ভাঙালি? বাসু বলল—না, রয়েছে।
ভাঙাসনি কেন?
টাকার দাম দিনের দিন কমছে, ডলারের দাম দিনের দিন বাড়ছে।
কে বলল তোকে?
ছোড়দা ওর বন্ধুকে বলছিল, আমি শুনে ফেলেছি।
কী বলছিল?
বলছিল ওর অনেক ডলার জমে গেছে, তখন ওর বন্ধু বলেছিল, এখন হার্গিস ভাঙাস না। টাকার দাম কমছে।
বাসু ডলারের মালিক হলেও ওর জীবনযাত্রার কোনও পরিবর্তন হয়নি। একইভাবে জ্যামাপ্যান্ট কাচে, একইভাবে রিলে করতে থাকে। তবে আজকাল রিলের ফাকে ফাকে বলে, এবার এইসান একখানা ড্রেস বানাব না, সব দাদারা হাঁ করে চেয়ে থাকবে। ঘিয়ে জামা, কালো প্যান্ট, ডবল পকেট, পকেটে কভার, কভারে বোতাম। যা দেখাবে না আমায়, হেভি, মডার্ন টেলার্স-এর পঞ্চাকে দিয়ে বানাব। এ ছাড়া আর কোনও পরিবর্তন নেই। ওর ছোটভাই, যে আজকাল ডলার কামাচ্ছে, তারও দেখা যাচ্ছে পায়ের স্টেপিং চেঞ্জ হয়ে গেছে। আগে ও বিভূতিস্যারের সামনে বা উকিলবাবুর সামনে সিগারেট খেত না, আজকাল ওসব পরোয়া করে না। আর সব চে’ চেঞ্জ হয়েছে আমাদের দামুদার। দামুদা ওর বাড়ির সামনে পেতলের নেমপ্লেট লাগিয়েছে—দামোদর গুছাইত, এক্সপোর্টার। মারুতি কিনেছে, পিছনের কাছে আলো চিড়িকবিরিক করে। কোল্ড ড্রিংক্স আর আইসক্রিম খেয়ে খেয়ে ওর ছেলেমেয়ের প্রায়ই গলাব্যথা হয়। ওর বউ আজকাল চার্নক সিটিতে বাজার করতে যায়। ও বিদেশে পাঠায় শুকনো ঝাউপাতা, অশ্বথপাতা, কুরচি ফল, কাশফুল এইসব। এসব দিয়ে নাকি ইনটেরিয়ার ডেকরেশন হয়। ও মাঝেমধ্যে মদটদ খেলে, জোরে-জোরেই বলে, কমুক, টাকার দাম আরও কমে যাক। ডলারের দর বাড়ার প্রতীক্ষায় থাকে। বাসুও কি তাই? বাসুও কি ডলারের আরও দাম বাড়ার প্রতীক্ষায় আছে? নইলে ওটা ভাঙিয়ে নিচ্ছে না কেন? আমরা তো দেখছি ওর জামাপ্যান্টের কী অভাব!
একদিন দেখি বাসু চুপচাপ বসে আছে রেল স্টেশনে। সেই নোংরা পাজামা, গায়ে একটা ছেঁড়া গেঞ্জি। আমি ওর পিঠে হাত দি, বলি কী করছিস রে বাসু, এখানে একা একা? বাসু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর গেঞ্জিটা উঠিয়ে নিয়ে চোখে ছোঁয়াল। বুঝলাম দুঃখ হয়েছে। বললাম, কী রে, তোর ডলারটা হারিয়ে গেল নাকি? আমি তো জানি, বাসুর ইদানীংকার সব সুখস্বপ্ন ওই ডলারটাকে ঘিরে। বাসু ডলারের কোনও প্রসঙ্গ না তুলেই বলল—আমায় কেউ ভালবাসে না। আমি বললাম—কেন, আমরা তো বাসি। আমি? ও বলল, তোমরা তো আমায় মুরগি করো। আমি জানি, আমায় নিয়ে মজা করো। হঠাৎ অবাক হয়ে যাই আমি। এই বোধ ওর এল কোত্থেকে? আমি বলি, কে বলেছে তোকে নিয়ে আমরা মজা করি? বাসু বলল, পার্বতী বলেছে—পার্বতী। আমি বলি, পার্বতী কে? বাসু একটু ঝাঁঝিয়ে উঠে বলে, পার্বতীকে চিনিস না? আমাদের বাড়িতে থাকে, কাজ করে, আমার সেজদা ওর জন্যই তো ক্যাপ কেনে। মনে নেই, একদিন পকেটে পেয়ে গেছিলাম…।
ও চুপ করল। আমিও। এরপর কী কথা বলি? মাইকে ঘোষণা করল ডাউন ট্রেন চল্লিশ মিনিট লেট। স্টেশনে তো থাকতেই হবে, উপায় নেই।
বাসু বলল, লাইফটা মাইরি এক্কেবারে ভিততাল হয়ে গেল। একদিন শালা সুইসাইড করব, আর চিঠিতে লিখে যাব আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী…
কে দায়ী?
সব্বাই।
সব্বাই মানে? আমিও?
না, তুই কেন দায়ী হতে যাবি?
তবে যে বললি সবাই—
সবাই মানে আমাদের বাড়ির সবাই। ফ্যামিলির। এইস্যা একখানা চিঠি লিখে যাব না…
তোর কী দুঃখ রে বাসু?
বাসু হঠাৎই গলাটা একটু উঁচিয়ে বলতে লাগল—আমায় মাইরি সবাই যা ভাগ যা ভাগ করে। আজ বড়দার ঘরে লোকজন এল, মিষ্টি এনে দিতেই বাড়ি থেকে বার করে দিল আমাকে। মেজদাও বহুত হারামি। আমাকে মাছ দেয় না। আমার হপ্তায় চার দিন বড়দার ঘরে আর তিন দিন মেজদার ঘরে খাবার কথা। মেজদা হল এক নম্বরের মক্ষীচুষ। এমনিতেই হপ্তায় এক দিন কম, তা বাদে ওর ঘরে খাবার পালা থাকলেই মেজদা ফ্যামিলি নিয়ে ফুটে যায়। শ্বশুরবাড়ি যায়, কিংবা হোটেলে খায়। আমি তখন বড়দার ঘরে খেতে যাই, বড়বউদি বলে—আজকে তো আমাদের নয়। আমি বলি, মেজদারা তো সব ফুটে গেছে। বউদি তখন একটা-দুটো রুটি তবু দিত, কাল দেয়নি। চুমমেরে বসে ছিলাম, তখন পার্বতী সব্বাইকে লুকিয়ে একবাটি ডাল ভাত কচুবনে রেখে এসে আমাকে বলেছিল—তাড়াতাড়ি যাও, কাক এসে পড়বে। ওই পার্বতী, আমার কেউ নয়, খেতে দিল, অথচ মায়ের পেটের ভাইরা সব বেইমানি করছে। আমি শালা সব পুড়িয়ে দেব। পুরো সংসার জ্বালিয়ে দেব। তারপর আমি নিজে পুড়ে মরব, নইলে পুলিশ আমাকে ধরে খুব প্যাঁদাবে। জ্বালিয়ে দেব শালা, একটি একটু করে পেট্রোল জমাচ্ছি, কাউকে বলিস না।
পেট্রোল জমাচ্ছিস?
জমাচ্ছি তো!
কোত্থেকে পেট্রোল জমাচ্ছিস?
সেজদার ঝাড়া মাল আমি ঝাড়ছি।
বাসু ব্যাপারটা আর একটু ব্যাখ্যা করলে আমি বুঝতে পারলাম যে বাসুর যে দাদা গাড়ি চালায়, মানে সেজদা, সে অনেক সময় গাড়িটা বাড়িতে নিয়ে আসে খাবার সময়। আসলে গাড়িটা তো ওর নয়, জেসপ কোম্পানির গাড়ি। আবার জেসপ কোম্পানির নিজস্ব গাড়িও নয়। জেসপ কোম্পানিতে গাড়ি ভাড়া খাটায় কমরেড বিকাশ সাহা, বাসুর সেজদা সেই গাড়িটাই চালায়। তেল খরচ কোম্পানির। মাইনেটা দেয় বিকাশ সাহা। বাড়িতে যখন গাড়িটা নিয়ে আসে, দুপুরের খাবার সময়, বাসুর সেজদা পেট্রোলের ট্যাংকিতে রবারের পাইপ ঢুকিয়ে টেনে কিছুটা তেল বার করে একটা পলিথিনে জমা করে। জাকিকেন ফুল হয়ে গেলে বেচে দেয়। পেট্রোলের দাম বাড়লে সেজদার খুব ভাল লাগে। খুব খুশি হয়। যেদিন কাগজে ছাপে পেট্রোলের দাম বাড়ল, সেদিন লাড্ডু নিয়ে আসে। আর বাসু একটা ছোট জারিকেন জোগাড় করেছে। সেজদার বড় জারিকেন থেকে বাসু পেট্রোল ঝেড়ে ছোট জারিকেনে জমা করে।
মাইরি, একদিন দেখে নিস, খবরকাগজে আমার নাম বেরোবে—পুরো দত্তবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে বাসুর আত্মহত্যা। আমার মাইরি একটাও ভাল ছবি নেই। কাগজে তো ছবিও ছাপায়। একটা ছবি ভাল করে উঠিয়ে রাখব নাকি স্টুডিওতে গিয়ে? আমি বলি, সেই ছবি রাখবি কোথায়? পুরো বাড়িটা তো পুড়ে যাবে, ছবিটাও। বাসু তখন বলে, ছবিটা যদি তোদের কারুর কাছে রেখে যাই?
আমি বলি, বাসু, বাড়িটা পুড়িয়ে দেবার আগে ডলারটা ভাঙা, আমাদের খাইয়ে দিয়ে যা…
বাসু বলে, তুই ভাবছিস বাসু ইয়ার্কি করছে। হার্গিস নয় আমার পাঁচ লিটারের জারিকেন প্রায় ভরে এসেছে। ওটা দিয়ে পুরো বাড়ি পুড়িয়ে দিতে পারি। কেন পোড়াচ্ছি না, জানিস! কাউকে বলিস না, পার্বতী দেশে গেলে তবে বাড়িটা পোড়াব। নইলে যে পার্বতীও পুড়ে যাবে। ও বেচারী কী দোষ করেছে বল…।
ট্রেন এসে গেল। আমি উঠে পড়ি।
এরপর আমাকে একটা ট্রেনিং-এর জন্য অফিস দিল্লি পাঠায়। তিন মাসের ট্রেনিং শেষ করে আমি ফিরে আসি। দমদম লীলা সিনেমা হলের সামনে বাসুর সঙ্গে দেখা। বাসুর পরনে স্বপ্নের পোশাক। ঘিয়ে জামা, কালো প্যান্ট, ডবল পকেট, পকেটে কভার, কভারে বোতাম। দু’হাত দু’পকেটে পুরে হিরো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাসু।
আমি বাসুকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ি। বলি, কীরে বাসু, ডলারটা ভাঙালি বুঝি?
হ্যাঁগো, ভাঙিয়ে ফেললাম।
তারপর জামাপ্যান্ট বানালি? কত পড়ল?
এ জামাপ্যান্ট ডলারের নয়। সেজদা দিল।
সেজদা মানে ড্রাইভার দাদা?
ইয়েস।
ও বুঝেছি, সেজদা দিল মানে সেজদার ঝাড়া পেট্রোল ঝেড়ে দিয়েছিস বুঝি?
নো।
তবে?
সেজদার ঝাড়া মাল থেকে আমি ঝাড়তাম, আমার ঝাড়া মাল ঝাড়তে এসেছিল পার্বতী। আমি জারিকেনটা রাখতাম আমাদের ছাগলের ঘরটায়। আমার মা ছাগল পুষত না, সেই ঘরটা এখনও আছে। আমি রাত্তিরবেলায় ছাতে বসে বসে বিড়ি খাচ্ছি আর এরোপ্লেন দেখছি, এমন সময় শুনি খড়খড় শব্দ। পাতা মাড়ানোর আওয়াজ। দেখি একজন আমগাছটার তলা দিয়ে ছাগলের ঘরে যাচ্ছে। আমি তো সঙ্গে সঙ্গে গেলাম। একেবারে হাতেনাতে ধরে ফেললাম পার্বতীকে।
সে কী রে? চোরের উপর বাটপাড়ি? পার্বতী আবার পেট্রোল ঝাড়তে গেল কেন?
নিজের গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন দেবে বলে। আমি বললাম—এ কী করছিস পার্বতী, বোকা কোথাকার, এত দামি পেট্রোল, দিন কে দিন দাম বাড়ছে, এসব নষ্ট করতে আছে? তখন পার্বতী কেঁদে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল—আমি পেগন্যান্ট হয়ে গেছি…।
কে করল, তুই?
এক চড় মারব। বাসু খুব রেগে গিয়ে আমায় বলল, সেজদার কাজ। সেজদা।
তারপর?
তারপর আমি স্ট্রেট সেজদাকে বললাম ওই রাত্তিরে। সেজদা আমাকে থাবড়া মারল। আমি বললাম, বলেই ফেললাম ওর প্যান্টের পকেটে কী পেয়েছিলাম। তা বাদে আমি ছাগলের ঘরে দু’দিন কী দেখেছিলাম। তারপর বড়দা মেজদা বলল, বাসু ফ্যামিলির প্রেস্টিজ বাঁচিয়েছে। যদি মেয়েটা কিছু করে বসত, সবাইকেই পুলিশে ধরত। বড়দা বলল, বাসু, তুই খুব ভাল কাজ করেছিস। কী চাস বল? আমি বললাম, কালো প্যান্ট, ঘিয়ে জামা, ডবল পকেট, পকেটে কভার, কভারে বোতাম….। সেজদাই কিনে দিল।
তারপর বাসু পকেটের কভার উঠিয়ে দুটো সিনেমার টিকিট বার করল। দিল তো পাগল হ্যায়। আমি আর পার্বতী। আমি বললাম , পার্বতী কই? বসু বলল, ওয়েট করছি। ও তো এখন আর আমাদের বাড়িতে নেই, অন্য বাড়িতে। ওকে তাড়িয়ে দিয়েছে।
আর ডলারটা?
ডলারের দামটা আরও বাড়ত, কিন্তু ধরে রাখা গেল না, ভৌমিক ডাক্তারের মাতৃমঙ্গল নার্সিংহোমে ওটা কাজে লেগে গেল। হা হা।
কথাসাহিত্য, ১৯৯৮