ডরিয়ান গ্রে-র ছবি
সকালে চায়ের সঙ্গে খবরের কাগজের পাঁজা দিয়ে ঘুম ভাঙায় তমা। সরকারসাহেব যে খুব রাত করে শুতে যান এমন নয়, কিন্তু তাঁর ঘুমটি একটু বেশি। লোকে বলে, বেশি ঘুম ‘সুখী’ মানুষের লক্ষণ। তা সরকারসাহেব নিজেও জানেন যে, তিনি বিলক্ষণ সুখী মানুষ। এই বাজারেও মাইনের মোটা চেকটা ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে, তা থেকে সামান্যই তোলেন। সংসার তো চলেই উপরির টাকাতে, তা ছাড়া যাবতীয় ফুটানিও চলে তা থেকে। তিনি ইচ্ছে করলেই তা পূরিত হয়ে যায়। তাঁর হাতে এতই ক্ষমতা যে, তাঁর কলমখানির একটি সই এবং তাঁর চেয়ারটির বিনিময়ে বছরে লক্ষ লক্ষ টাকা উপরি তাঁর।
এক বিশ্বস্ত বন্ধুকে ধরে আমড়াতলার এক উকিলের মাধ্যমে স্ত্রী তমা এবং বড়োছেলে সুখময়ের নামে ইনকাম ট্যাক্সের ফাইল করে নিয়েছেন। তাঁর এক ভ্যাগাবণ্ড এবং জামাইবাবু-নির্ভর শালা রামজীবনের নামেও ফাইল করে নিয়েছেন। গালুডির বাড়ি, নরেন্দ্রপুরে বাগানবাড়ি, শেয়ার এবং অন্যান্য ইনভেস্টমেন্ট তো আছেই। ওঁদের তিন জনের মিলিয়ে প্রায় দেড় কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি হয়েছে, অত খরচ করার পরও। তাজবেঙ্গল, গ্র্যাণ্ড, হিন্দুস্থান ইন্টারন্যাশনাল তো ছিলই, নতুন-হওয়া মেইনল্যাণ্ড চায়না, হায়াত, আই টি সি-র সোনার বাংলা এবং আরও কত হোটেল-রেস্তরাঁতে তাঁর অ্যাকাউন্ট।
সব মেয়ে একরকম কি না, জানেন না সরকারসাহেব, কিন্তু তাঁর স্ত্রী তমা পাঁচ-শো কী হাজারের বাণ্ডিল পেলেই খুশি। তার মুখ আনন্দে একেবারে ডগমগ করে। সরকারসাহেবের যদি কোনো রক্ষিতাও থাকত, তাতেও বোধ হয় তমার কোনো আপত্তি থাকত না। তবে সরকারসাহেবের অন্য কোনো দোষ নেই। ঘুস খাওয়া যদি দোষের মধ্যে গণ্য হয় তবে ওই একমাত্র দোষ। তবে সরকারসাহেব জানেন যে, গুণের মধ্যেও তাঁর ওই একটিই গুণ—ঘুস খাওয়া। খাবার খাওয়া, সিগারেট খাওয়া, মদ খাওয়াও তিনি সহজে ছাড়তে পারেন, কিন্তু ঘুস খাওয়া ছাড়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। ঘুসই তাঁর স্টেপল ফুড।
মাঝে মাঝে একথা মনে হয় না, তা নয়, মানে, ধরা পড়ার কথা। আজকাল মানুষ বড়ো ট্যাঁটোন হয়ে গেছে। এই তো সেদিন ধরসাহেবকে এক সাপ্লায়ার ফাঁসিয়ে দিল। এফিডেভিট ফাইল করে দিয়েছে ভিজিলেন্স কমিশনে। এনকোয়ারি আরম্ভ হবে শিগগিরি। এখন কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, কে বলতে পারে! তবে সরকারসাহেবরা সবাই মিলে এককাট্টা হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, ওই সাপ্লায়ারকে টাইট করে ছেড়ে দেবেন। ওঁদের সরকারি দফতরে তাকে আর এ-জন্মের মতো করে খেতে হবে না।
মুশকিল হয়েছে কিছুদিন হল, নতুন-আসা চেয়ারম্যানকে নিয়ে। সে-লোকটা হান্ড্রেড পার্সেন্ট অনেস্ট তো বটেই, তার ওপর অন্য দশটা সরকারি অনেস্ট অফিসারের মতো নিজের চাকরি বাঁচিয়ে ‘সততা’ ধুয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না-নিয়ে চাকরিজীবন মানে-মানে পার করে, পেনশন নিয়েই অবসরের বৈতরণী পার করার মতো মিনমিনে লোক তিনি নন। ডিসঅনেস্টিকে শিকড়সুদ্ধু উপড়ে ফেলতে চান। ইডিয়ট। দেশ চলছে এক দিকে, একভাবে, আর উনি চলছেন স্রোতের বিপরীতে। লোকটা জানে না যে, বাবারও বাবা থাকে। সেক্রেটারি এবং মিনিস্টারকে সরকারসাহেবরা কিনে রেখেছেন। এই ভান-ভন্ডামির দিনে, এই আপাদমস্তক অসাধুতার দিনে নতুন চেয়ারম্যানের আয়ু ঘনিয়ে আসবে শিগগির। সরকারসাহেবরা তো বিনি পয়সাতে চেয়ারগুলো পাননি। রীতিমতো নিলামে চড়ানো হয় আজকাল সরকারের বিশেষ বিশেষ দফতরের সব চেয়ার। ওঁরা তো খয়রাতি করবার জন্যে চড়া দামে চেয়ার কেনেননি। ইনভেস্টমেন্ট হিসেবে কিনেছেন। ইনভেস্টমেন্ট-এর রিটার্ন তো পেতে হবে, নইলে ইনভেস্টমেন্ট করে লাভ কী?
সেদিন চেয়ারম্যান তাঁদের মিটিং-এ বলেছিলেন, ইফ ইউ ডোন্ট হ্যাভ ফিয়ার অফ গড, ইউ মাস্ট হ্যাভ ফিয়ার অফ দ্য চেয়ারম্যান, ইফ ইউ ওয়ান্ট টু সারভাইভ। আই উইল নট টলারেট ডিসঅনেস্টি অফ এনি কাইণ্ড ইন মাই ডিপার্টমেন্ট।
ইডিয়ট শালা! কোন দেশে বাস করছে জানে না।
চায়ে চুমুক দিয়ে, প্রথম কাগজটা খুললেন আধশোয়া হয়ে বসে। প্রথম পাতাতেই একটি খবর : ‘ঘুস’। লাল-রঙা লেডিজ শাল গায়ে দেওয়া চশমাচোখে এক ভদ্রলোকের ছবি বেরিয়েছে প্রথম পাতায়। পুলিশের গাড়িতে তাঁকে তোলা হচ্ছে। ভদ্রলোক লজ্জায় অধোবদন হয়ে আছেন। খুনিরা এই সময়ে মুখে চাপা দেয়—বোকা মানুষটা তা করেননি। মুখের মধ্যে অনুশোচনা। সম্ভবত অনুশোচনাটা ঘুস নেওয়ার কারণে নয়, ধরা পড়ারই জন্যে। চুরিবিদ্যা বড়ো বিদ্যা যদি না পড়ো ধরা। ভদ্রলোক নাকি অনেকদিন ধরে একজন কনট্রাক্টরের কাছ থেকে ঘুস নিচ্ছিলেন—সবসুদ্ধু মিলিয়ে নাকি লাখ খানেক টাকা নিয়েছেন—কে জানে! হাতেনাতে ধরা পড়ার সময়ে কত নিচ্ছিলেন—হয়তো পাঁচ-দশ হাজারই হবে। ধরা পড়ে নাকি বলেছেন, অভাবই এই ঘুস নেওয়ার কারণ। মুখটা দেখে মনে হয় ইউনিয়নবাজিও করেন। ডুবে ডুবে জল-খাওয়া লোক।
হঠাৎ একটা হেঁচকি উঠল সরকারসাহেবের। তিনি তো লাখ-দু-লাখের কমে কথাই বলেন না। আর অভাব? কোনো অভাবই তো তাঁর নেই। যদি বরাত দোষে কখনো ধরা পড়েন, তখন কী হবে? মান-ইজ্জত, স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি নিয়েই তো টান পড়তে পারে। কোনো খচ্চর পার্টি তো তাঁকেও মিসলিড করে পুলিশ কি ভিজিলেন্সকে বলে এমন করে ফাঁসিয়ে দিতে পারে যেকোনো দিন। কার কপালে কী আছে কে বলতে পারে!
তমা ছোটু-বেয়ারাকে দিয়ে আর এককাপ চা পাঠাল। কিন্তু হেঁচকিটা যাচ্ছে না কিছুতেই। প্রথম কাপ চা-ই পড়ে আছে এখনও। সরকারসাহেব বললেন, লে যাও।
তমা এসে বলল, কী হয়েছে?
না, কিছু না। সরকারসাহেব বললেন।
২
এয়ার-কণ্ডিশানারটা ঝিরঝির শব্দ করছিল। সরকারসাহেবের বিরাট চেয়ারে গানেরিওয়ালা বসেছিল।
গানেরিওয়ালা বলল, আজ ক্যা হো গ্যয়া সরকারসাহেব। মুড অফ দেখতা হুঁ। ম্যায় তো পুরাই লেকর আয়া। পুরাই হ্যায় ইস ব্রিফকেসমেঁ, পাঁচ-শো কি নোট।
সরকারসাহেব বললেন, নো, নো, নট হিয়ার।
তো? আজ হুয়া ক্যা?
বহুত কুছ হোনে শকতা। ডিড ইউ সি টুডেজ পেপার?
ক্যা পেপার? ম্যায় টিভি দেখতা হুঁ, পেপার-উপার নেহি পড়া।
সরকারসাহেব বললেন, নেহি পড়া?
নেহি তো।
শুনো ভাই গানেরিওয়ালা। তুম ই লে কর চলা যাও আভি।
তো? বাদমে আয়েগা?
নেহি, হিঁয়া নেহি।
তো কাঁহা? ক্লাবমেঁ আওবেগা রাত মেঁ?
নো, নো ক্লাবেও নয়। ওখানেও যে পুলিশের লোক….
হাঁ। কী যে বোলেন সোরকারসাহাব। পুলিশরা বুঝি সোব ধোওয়া তুলসীপাতা হচ্ছে?
তা জানি না বাবা। কপাল যখন খারাপ হয়….
প্রবাদের পরের অংশটুকু আর বললেন না।
তার পর বললেন, গাঁড়ে হনুমান হয়ে যাবে গানেরিওয়ালা। ভগবান যখন বিরূপ হন তখন বাঁচাবে কে?
এ তো মহা গোলমেলে কোথা বোলছেন আজকে আপনি। আমার অর্ডারটি কিন্তু কাল সকালেই চাই। সব রেডিই আছে—শুধু আপনার সইটার অপেক্ষা।
শোনো গানেরিওয়াল, আমি যখন অফিস থেকে বেরিয়ে প্রিটোরিয়া স্ট্রিটের মোড়ে পৌঁছোব, তখন তুমি আমার গাড়ির সামনে পড়বে, তার পর যেন আমাকে হঠাৎ-ই দেখেছ, এমনভাবে বলবে, আরে সরকারসাহেব। আমাকে একটু নামিয়ে দেবেন পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে?
আমি বলব, আসুন। তুমি এসে পেছনের সিটে আমার পাশে বসবে। তার পর তোমার ব্রিফকেসটা গাড়ির সিটের নীচে রেখে দিয়ে নামবার সময় খালি হাতে নেমে যাবে। ড্রাইভার বাড়ি চলে গেলে চাকরেরাও সব কোয়ার্টারে চলে গেলে আমি নিজে গিয়ে নিয়ে আসব।
সিম্পল ব্যাপারটাকে এত কমপ্লিকেটেড করতেছেন যে কেন!
যা বলছি, তাই করো।
তার পর বললেন, আমার গাড়িটা চেনো তো? সাদা অ্যাম্বাসাডার—মাথায় লালবাতি—পেছনে ও সামনে গভর্নমেন্ট অফ ইণ্ডিয়া লেখা।
জানি, জানি সাব।
নাম্বার জানো?
নাম্বার জানার দরকার নেই, ড্রাইভারকে আমি চিনি।
চেনো?
না-চিনলে হবে? সারথিকে না চিনলে ভোগোয়ানকে চিনব কী করে? আপনি কোথায় যান, কোখোন খান, কার কার সঙ্গে উঠেন-বোসেন, সব খবর আমাকে রাখতে হয় স্যার।
হাউ ডেণ্ডারাস।
উত্তেজনাতে ডেঞ্জারাস শব্দটা ডেণ্ডারাস করে উচ্চারণ করলেন সরকারসাহেব।
তারপরই বিরক্তির গলাতে বললেন, তুমিই তো আমাকে ফাঁসাতে পারো যেকোনো দিন।
গানেরিওয়ালা হেসে বলল, তোবে যে, আমিও ফাঁসব। আপনি স্যার বেগড়বাই করলে কোনোদিন ফাঁসাতেও পারি। আমরা বিজনেসম্যান—আমাদের কাজ চাই—বাই হুক অর বাই ক্রুক। পথে যে বাধা হোবে তাকেই আমরা সরিয়ে দেব।
চেয়ারম্যান?
তারও বন্দোবস্ত হচ্ছে। বড্ড বাড়াবাড়ি করছে লোকটা। ইডিয়ট হচ্ছে শালা মিস্টার অনেস্ট।
তাহলে যাও এবারে।
ঠিক আছে। কিন্তু আপনি ক-টার সময়ে প্রিটোরিয়া স্ট্রিটের মোড়ে আসবেন?
সাড়ে-পাঁচটা।
ঠিক আছে। সাড়ে-পাঁচটায় দেখা হোবে।
৩
গানেরিওয়ালা তো চলে গেল, কিন্তু সরকারসাহেবের বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। এত বছর যেরকম ডোন্ট কেয়ার করে করেছেন, ধরা পড়ার ভয় কোনোভাবেই যখন তাঁর মনে আসেনি, এমন সুখেই এবং সম্মানেই কেটে যাবে নিরবধিকাল যখন ধরেই নিয়েছিলেন, তখন সকালবেলার কাগজে দেখা লাল লেডিজ-শাল গায়ে বেচারি ভদ্রলোকের অধোবদন ছবিটি তাঁকে বড়োই ভীত করে তুলেছে। মান আর অসম্মানের মধ্যে একচুল ফাঁক। পর্দাটা কোনোক্রমে উঠে গেলেই সারাপৃথিবী ছ্যা: ছ্যা: করে উঠবে, এমনকী ঘুসের টাকাতেই যাঁদের জন্যে এতকিছু করে এলেন, সেই তারাও ছ্যা-ছ্যা করবে, ভাবখানা এমন, যেন তাঁরা ঘুণাক্ষরেও জানতেন না, টাকাপয়সার উৎস। এই পৃথিবী নিমকহারাম। তেমন দুর্দৈব এলে তাঁর পাশে কাকপক্ষীও থাকবে না। মাথা নীচু করে পুলিশের গাড়িতে উঠতে হবে। ভাবলেই হৃৎকম্প উঠছে। কপাল যখন খারাপ হয়….। গাঁড়ে হনুমান।
গানেরিওয়ালা ঠিক সময়ে পাকা অভিনেতার মতো, যেন তাঁকে হঠাৎই দেখতে পেয়েছে, এমনিভাবে রাস্তা পেরোতে গিয়ে সরকারসাব, স্যার বলে চেঁচিয়ে উঠল।
তাকে গাড়িতে তুলে সরকারসাহেব ড্রাইভারকে শুনিয়ে বললেন, তোমার গাড়ি কী হল?
আর বলবেন না স্যার। হায়দরাবাদ থেকে সাডুভাই এসেছে, সে নিয়ে গেল এই এখুনি—আগে বললেও না হয়, গাড়ি ভাড়া করে নিতুম—কিন্তু সে-সময় পেলাম কই? অথচ নাগবেকার সাহেবের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে সাড়ে পাঁচটাতে, এখুনি না-বেরোলেই নয়—অন্য গাড়িগুলোও সব বেরিয়ে গেছে। ট্যাক্সি ধরবার জন্যে ছুটোছুটি করছি, কিন্তু শালার ট্যাক্সিদেরও যে কী হল!
তা সাডুভাইকে গাড়িটা কি না দিলেই হতনা?
কী যে, বোলেন স্যার। সারি দুনিয়া ইক তরফ আর জরুকি ভাই ইক তরফ। ইভি তো জরুকি বহিন কি হাজব্যাণ্ড-ই না হচ্ছে। তা ছাড়া, হায়দরাবাদে গেলে আমার জন্যে ওনেক করেভি।
পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে যখন সরকারসাহেবের গাড়ি পৌঁছোল, তখন কথামতো গানেরিওয়ালা নেমে গেল ব্রিফকেসটা পেছনের সিটের নীচে রেখে, চলে সাব, থ্যাঙ্ক ইউ বলে।
গানেরিওয়ালা ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার পর এবং গাড়িটা মিনিট তিনেক যাওয়ার পর যেন হঠাৎই চোখে পড়ল এমনভাবে সরকারসাহেব স্বগতাক্তি করলেন, দেখেছ যতীন, ব্রিফকেসটাই ফেলে গেল।
কী করবেন স্যার?
কী আর করব? আমাকে যদি বাড়িতে ফোন করে, তাহলে এসে নিয়ে যেতে পারবে নইলে কাল অফিস থেকে নেবে। এরমধ্যে জরুরি জিনিস চাবিটাবি আছে কি না, সে তো সে-ই জানবে। বাড়ি ফেরার আগে তো আর যোগাযোগ করা যাবে না।
যতীন মন্ডল জানে যে, গানেরিওয়ালা সাহেবের মোবাইল নম্বর সরকার সাহেবের জানা। কারণ বহু বার তিনি গাড়ি থেকে যে কথা বলেছেন তা শুনেছে যতীন। কিন্তু যতীন সব জেনেও চুপ করে থাকল। তার পর বলল, ভারি ভুলোমনের লোক তো।
কাল অফিসে বেরুবার আগে মনে কোরো তো যতীন ওর ব্রিফকেসটার কথা। ভুলে না যাই নিতে।
হ্যাঁ স্যার। মনে করিয়ে দেব।
প্ল্যানটা যে বদলালেন তার কারণ ছিল। গ্যারাজ থেকে এই ব্রিফকেস রাতের বেলা উদ্ধার করাটা অনেক বেশি বিপজ্জনক হত। সরকারি আবাসনের ফ্ল্যাট—সিকিউরিটির লোক আছে, নাইট ওয়াচম্যান আছে, অন্য ফ্ল্যাটের চাকরবাকর ড্রাইভাররা তো আছেই, তার ওপরে আছে সহকর্মীরা। এই ভালো হল।
ফ্ল্যাটে পৌঁছোতেই ছোটু বলল, মেমসাহেব রিনিদিদির সঙ্গে ছবি দেখতে গেছেন।
রিনিদিদিমণি মানে তাঁর ছোটোশালি। একসময়ে একটু ছুক-ছুকও করেছিলেন। এখন একটা হামবাগ-এর সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় সম্পর্কর মাধুর্য একটু নষ্ট হয়েছে।
কী ছবি?
তা তো জানি না স্যার। কী বলছিলেন, শুভ মহরত না কী যেন!
অ।
চা খাবেন?
না। আমার মাথাটা একটু ধরেছে। ঘর অন্ধকার করে আমি শুয়ে থাকব কিছুক্ষণ। বিরক্ত কোরো না আমাকে।
জি সাব।
বলে ছোটু ব্রিফকেস দুটো ঘরে পৌঁছে দিয়ে গেল। বলল, একঠো গ্যয়া থা, দোঠো হো গ্যয়া।
হ্যাঁ। অন্য লোকে ভুল করে গাড়িতে রেখে নেমে গেছে। কাল অফিস যাওয়ার সময়ে মনে করে দিয়ে দিবি। মাধোকে জিজ্ঞেস করে আয়, কী রান্না করেছে।
চিলি চিকেন, ফ্রায়েড রাইস আর নুডল স্যুপ। মেমসাব এই অর্ডার দিয়ে গেছেন। রিনিদিদিও খেয়ে যাবেন। আজ থাকতেও পারেন। জামাইবাবু মুম্বাই গেছেন তো।
থাম তো তুই। এত ফিরিস্তি দিয়ে আমার দরকার নেই। আমি দরজা বন্ধ করে শোব। আটটার সময়ে তুলে দিবি এককাপ কফি দিয়ে। আমি লক করে শুচ্ছি। ফোন এলে বলবি আটটার পরে করতে, যে-ই করুক।
ঘরের দরজাটা বন্ধ করার আগে ছোটু পায়জামা পাঞ্জাবি দিয়ে গেল, স্যুট তুলে রাখল। এখন শীতকাল। স্নান করবেন না, তবে হাত-মুখ ধোবেন। ছোটু চলে গেলে, বাথরুমে গেলেন সরকারসাহেব। তার আগে গানেরিওয়ালের ব্রিফকেস থেকে পাঁচ-শোর বাণ্ডিলগুলোসেফ-এ তুলে রাখলেন। এই সেফ-এর ডুপ্লিকেট চাবি তমার কাছেও নেই। এ তাঁরই একার সাম্রাজ্য।
বাথরুমে ঢুকে মস্ত চওড়া আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে-চোখে জল দিলেন। তার পর মুখ মোছার জন্যে হ্যাণ্ড-টাওয়েলটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে আয়নার দিকে ফিরে তাকাতেই হঠাৎ চমকে উঠলেন। এ কে দাঁড়িয়ে আছে আয়নার সামনে? এ তো তিনি নন। এ যে সেই লাল লেডিজ শাল-পরা, রোগাসোগা চশমা-পরা তীক্ষ্ণনাসা মানুষটা, যাঁর ছবি দেখেছেন আজ সকালে। তফাতের মধ্যে, সে-মানুষটার মুখে একটা অসহায়তা ছিল, মানুষটা ঘুস খেয়েছিলেন অভাবের তাড়নায়, আর সরকারসাহেব ঘুস খান অভ্যেসে। কিন্তু মুখটা অবিকল সেই মানুষটির মুখ। স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে রইলেন আয়নার দিকে সরকারসাহেব। বিশ্বাস করতে পারছিলেন না নিজের চোখ দুটিকেই। আশ্চর্য। আয়নাতে এ কার ছবি?