2 of 2

ডবল রোল – উল্লাস মল্লিক

ডবল রোল – উল্লাস মল্লিক

নাড়ু ওঝার সময়টা এখন বেশ যাচ্ছে। মানে, পসার একেবারে জমজমাট। রুগির ঠেলায় নাওয়া—খাওয়ার সময় নেই। হারু ওঝা মরে গিয়ে তর্ক চলছে। ক—দিন আগেও একরত্তি কদর ছিল না তার। যা কিছু নামডাক তখন ওই হারু ওঝার। ভূতে ধরা কেস মানেই হারু ওঝা। এমনও না কি হয়েছে, কল পেয়ে হারু দেখে রুগি ফিট। মানে, হারুকে কল দেওয়া হয়েছে শুনেই ভূত পগার পার। ভূতের ভয় পেলে লোকে তখন ‘রাম—রাম’ না বলে ‘হারু—হারু’ বলত। তাতে কাজও হত বেশি।

এই যখন অবস্থা, লোকে আসবে কেন নাড়ুর কাছে। আসতও না বড়ো একটা। শুধু যে কেসগুলো হারু রেফার করত, সেগুলো পেত নাড়ু। হারু হয়তো বলল ‘আজ আর আমি পেরে উঠব না বাপু, দুটো ব্রহ্মদত্তি আর মামদোর কেস আছে; তোমরা যা বলছ লক্ষণ শুনে তো মনে হচ্ছে মেছো—পেতনি ধরেছে—সামান্য ব্যাপার—তোমরা বরং নাড়ুর কাছে যাও, গিয়ে বলো, আমি পাঠিয়েছি ওই যা করার করে দেবে।’

সে এক দিন গেছে নাড়ুর। না খেতে পেয়ে নিজেই মরে ভূত হবার অবস্থা। মাঝে মাঝে মনে হত, ওঝাগিরি ছেড়ে দিয়ে অন্য প্রফেশনে চলে যাবে; দুটো খেয়ে—পরে বাঁচবে যা হোক।

ঠিক তখনই ভাগ্যের চাকাটা তার বাঁই করে ঘুরে গেল হঠাৎ। দেহ রাখলেন হারু ওঝা। মানুষজন বলা কওয়া করল, ‘এবার ভূতেদের জ্বালায় না দেশান্তরি হতে হয়; বাঁচাবার মতো কেউ তো আর রইল না আমাদের; নাড়ু ওঝার কি আর ক্যালি আছে!’

একদিন হল কী, মিত্তিরদের বড়ো বউটাকে ধরল ভূতে। মিত্তিররা বড়োলোক মানুষ, তারা খরচ—খরচা করে ভিন গাঁ থেকে বাঘা—বাঘা ওঝা আনা করাল। কিন্তু হলে কী হবে—সবকটা ফেল। বউটার একেবারে যায় যায় দশা। শেষে কে একজন যুক্তি দিল, নাড়ুকে ডাকা করানো যাক একবার। হাজার হোক, ঘরের লোক; হারুর সঙ্গে একই গাঁয়ে এতদিনের বাস; বলা যায় না, দু—একটা বিদ্যে শিখেও থাকতে পারে; ফার্স্ট বয়ের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেষি করলে ফেল করা ছেলেরও কিছু উন্নতি হয়।

ডাক পেলেন নাড়ু ওঝা। গিয়ে লক্ষণ দেখে বুঝলেন, আশ—শ্যাওড়া গাছের পেতনি ধরেছে। দাওয়াইটা জানা ছিল তাঁর। সরষে আর শুকনো লঙ্কা বেলকাঠে পুড়িয়ে ধোঁয়া দিলেন খুব কষে। তারপর কৃত্তিবাসী রামায়ণের লঙ্কাকাণ্ড থেকে কিছুটা আওড়াতেই পেতনি হাওয়া।

ব্যস; তারপর থেকে আর রুগির অভাব হয়নি নাড়ুর। সুনাম সুখ্যাতি একেবারে হইহই করে ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে।

রাতে খাওয়া—দাওয়ার পর একটু বিশ্রাম করছিলেন নাড়ু। সারাদিন বড্ড ধকল গেছে। শ্যামপুরে একটা কেস ছিল আজ। জটিল কেস। নচ্ছার একটা স্কন্ধকাটা ধরেছিল বাড়ির কর্তাকে। স্কন্ধকাটা ধরলে বেশ চিন্তার ব্যাপার। স্কন্ধকাটা ভূতের মুণ্ডু থাকে না বলে, নাক—কানের বালাই নেই। তাই লঙ্কা পোড়া বা সর্ষে পোড়ার গন্ধ দিয়ে লাভ হয় না। রামায়ণ পাঠ করলেও ফল মেলে না। কানই নেই তো শুনবে কোথা দিয়ে। এখানে চাই বিছুটি দাওয়াই। মড়ার খুলিতে মন্ত্রপূত গঙ্গাজল নিয়ে রামতুলসী গাছের পাতা দিয়ে ছেটাতেই কাজ হল। দক্ষিণা মিলেছে ভালোই। হুঁকো টানতে—টানতে নাড়ু ভাবছিলেন, এবার বাড়ির চারদিকে উঁচু পাঁচিল তুলতে হবে। চোরের উৎপাত বড়ো বাড়ছে। নাড়ু ওঝা ভূতের যম হলে কী হবে, চোর জব্দ করার মন্ত্র তাঁর জানা নেই।

হঠাৎ জানলার কাছে একটু খুটখাট শব্দ হল যে। নাড়ু সচকিত হলে। চোর—টোর মনে হচ্ছে। কিন্তু তারপরেই গন্ধটা পেলেন। সেই চেনা গন্ধ। মনে একটু সন্দেহ তাঁর। এখানে তো গন্ধ পাবার কথা নয়। ভালো করে একবার নাকটা টানলেন তিনি। হ্যাঁ, নির্ঘাত মনে হচ্ছে। তাঁর এতদিনের অভিজ্ঞতা ভুল হবার নয়। হাতের হুঁকোটা রেখে উঠে দাঁড়ালেন নাড়ু। তিনি হলেন গিয়ে ভূতের জল্লাদ, আর তাঁর ঘরেই কি না ভূত! ব্যাটাকে ধরে কষে শিক্ষা দিতে হবে। তাড়াতাড়ি গিয়ে ব্যাগ থেকে করোটি মালাটা বের করতে গেলেন। কিন্তু আগেই অন্ধকার কোণ থেকে খুব মৃদু গলায় কে যেন বলে উঠল, ‘থাক, থাক, শোনো কথা আছে।’

নাড়ু হুঙ্কার দিলেন, ‘কে তুই?’

‘আরে আমি গো….।’

‘আমিটা কে?’

‘আমি যে হারু ওঝা, গন্ধ শুঁকে তো তোমার বোঝা উচিত ছিল, কিছু মনে কোরো না বাপু, তোমার শিক্ষেদিক্ষের এখনও কিছু খামতি আছে…ভূতের শুধু গন্ধ পেলেই হবে না, কে ভূত তাও ধরে ফেলতে হবে। তুমি বাপু ভূতেশ নন্দীর লেখা ‘গুহ্যক শাস্ত্রের’ ৭ম খণ্ডটা একবার ঝালিয়ে নিয়ো, সব দেওয়া আছে ওখানে।’

মনে মনে একটু লজ্জা পান নাড়ু। বলেন, ‘আসলে অনেকদিন আগে পড়া তো…সব ঠিকঠাক স্মরণে নেই। তা, আপনি হঠাৎ করে আমার কাছে…?’

‘খুব দরকার ছিল বাপু।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলুন না।’ একটু ব্যস্ত গলায় নাড়ু বলে ওঠেন, ‘কী করতে হবে আপনার জন্যে?’

‘এখানে আমি বড়ো অশান্তিতে আছি গো।’

‘কেন কেন; অশান্তি কেন!’

‘মনুষ্য জন্মের কর্মফল।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হারু বলে, ‘তুমি তো ভালোই জানো, মানুষ থাকতে বিস্তর ভূতকে জব্দ করেছি আমি, এই গোটা তল্লাটে একেবারে ভূতের মহামারি লাগিয়ে দিয়েছিলুম, এখন সেই রাগে সব ব্যাটা আমার ওপর শোধ তুলছে, একেবারে তিষ্ঠোতে দিচ্ছে না আমায়…।’

খুব অবাক হয়ে নাড়ু বলেন, ‘সে আবার কেমন কথা।’

‘তবে আর বলছি কী।’ হারু বলে, ‘ঘুরতে ফিরতে অত্যেচার। কেউ হয়তো খুলিতে খটাং করে একটা গাঁট্টা মেরে গেল, কেউ হয়তো হাঁটু থেকে একটা ঠ্যাঙ খুলে নিয়ে দিল ছুট, এই তো দ্যাখো না, আজ সন্ধেবেলা, তালগাছে বসে একা—একা হাওয়া খাচ্ছিলুম, অমনি একদল চ্যাংড়া ভূত পেছন থেকে আমার মুণ্ডুটা হ্যাঁচকা টানে খুলে নিয়ে ফুটবল খেলতে লাগল। দ্যাখো, খুলিতে ক—জায়গায় চিড় খেয়ে গেছে…দ্যাখো, দ্যাখো, হাত বুলিয়ে দ্যাখো…।’

নাড়ু বলেন, ‘থাক, থাক, বুঝতে পেরেছি।’

‘ছোকরাগুলোর বাপ—মার কাছে নালিশ করলুম, কোনো লাভ হল না; বরং হিহি করে হাসতে লাগল; বুঝলুম তাদের আশকারাতেই করছে এসব…। এখন তুমি বাপু আমাকে একটু আশ্রয় দাও…।’

‘আমি!’ খুব অবাক গলায় বলেন নাড়ু।

‘হ্যাঁ; তোমার এখন বেশ নামডাক; তোমার নামে আমাদের ওখানে বেশ ভয়ও পায় সবাই; তোমার কাছে থাকলে কেউ আর জ্বালাতনের সাহস পাবে না। এই দ্যাখো না, আসছি যখন, একদল ফেউয়ের মতো পেছনে লেগেছিল; কিন্তু যেই তোমার বাড়ির দিকে এলুম। অমনি সবার সেকী দৌড়…। আমি বাপু তোমার এখানেই থাকব, তুমি না কোরো না, তোমার কাজকম্মও করে দেব’খন।’

নাড়ু বলেন, ‘কাজকম্মটা কথা নয়; আপনি হলেন গিয়ে গুরুদেব মানুষ, মানে, ইয়ে আর কী গুরুদেব ভূত আপনি থাকবেন—এ তো ভাগ্যের কথা, থাকুন যতদিন খুশি।’

হারু বলে, ‘আশীর্বাদ করি বাবা, অনেক বড়ো হও, আমাকেও ছাপিয়ে যাও; তোমার নামের আমার জাতভাইয়ের যেন দাঁতকপাটি যায়।’

অভাবের দরুন বয়েসকালে সংসার—ধর্ম করা হয়নি নাড়ুর। যখন সুদিন ফিরেছে, তখন বয়েস গড়িয়ে গেছে অনেকটা। তাই বিয়ে—শাদির চিন্তা আর মাথায় আনেননি। একাই থাকেন। তা একা একলা মানুষের সংসার যেমন হয়, তাঁরটাও তেমন। একটু ছিরি—ছাঁদের অভাব। বাড়ির চারপাশে আগাছার জঙ্গল, ঘরের মেঝেতে একপুরু ধুলো, বিছানা লণ্ডভণ্ড, মশারি হয়তো টাঙানোই আছে সারাদিন। কয়েকদিন পর দেখা গেল, বাড়ির শ্রী ফিরছে যেন। আগাছা সাফ, টানটান বিছানা, তকতক করছে ঘরের মেঝে, সিলিং—এ এতটুকু ঝুলময়লা নেই।

আরও অবাক—অবাক কাণ্ড ঘটল তারপর। নাড়ু জাবদাপাতায় দত্তদের বাড়ি গেছেন কলে। গিয়ে দেখেন, ব্যাগটাই আনা হয়নি। অথচ ব্যাগেই আছে ভূত তাড়ানোর সাজসজ্জা, অস্ত্রশস্ত্র, জড়িবুটি। কী হবে এখন? আবার তাহলে বাড়ি যেতে হয় নাড়ুকে। সে তো অনেকটা পথ। এদিকে দত্তদের ছোটোমেয়ে, যাকে ভূতে ধরেছে, তার খুব করুণ দশা। কী যেন একটু চিন্তা করলেন নাড়ু। তারপর একা একা দত্তবাড়ির ছাদে উঠে গেলেন। নেমে এলেন একটু পরেই; হাতে সেই ব্যাগ।

আর একদিন টগরপুরে চাটুজ্জেদের বাড়ি যাচ্ছেন কলে। পথে মস্ত কালা—নদী। বর্ষার দিন, টইটম্বুর জল। একমাত্র বাঁশের সাঁকোটা ভেঙে গেছে আগের দিন রাতে। হঠাৎ দেখা গেল, নাড়ু হাজির। জামাকাপড় একেবারে খটখটে শুকনো। সবার প্রশ্ন, ‘কী করে এলেন ওঝা মশাই, আমরা তো আপনার আশা একরকম ছেড়েই দিয়েছিলুম…।’

কিছু বললেন না… নাড়ু। মুচকি হাসলেন শুধু।

এসব কাহিনি যত ছড়িয়ে পড়তে লাগল, তত নামযশ বাড়লে নাড়ু ওঝার। কিন্তু দিনে দিনে তাঁরও বয়েস হল। এখন কলে যাবার মতো শরীরে তাকত নেই। রুগি মাফ চেয়ে ফিরিয়ে দেন।

একদিন হঠাৎ হারু ওঝার ভূত বলল, ‘এটা কি ঠিক কাজ হচ্ছে?’

নাড়ু অবাক হয়ে বললেন, ‘কীসের কী কাজ?’

‘এই যে, লক্ষ্মীকে ফিরিয়ে দিচ্ছ; ভূতে ধরা মানুষ হল গিয়ে তোমার লক্ষ্মী।’

নাড়ু বলেন, ‘তা শরীরে আর না কুলোলে কী করি বলুন…?’

‘যদি কিছু মনে না করো, তো একটা কথা বলি।’

‘বলুন, বলুন, কী কথা।’

‘বলি কী, ভূত তাড়ানোর প্যাঁচ—পয়জার সবই তো আমার জানা; মন্ত্রটন্ত্রও দিব্যি স্মরণে আছে এখনও। তাই বলি কী, তোমার চেহারা ধারণ করে কাজটা তো আমিই করে দিতে পারি। তোমার দুটো পয়সা হয়, আর পাঁচটা লোকের উপকারও হয়।’

একটু ভেবে নাড়ু বলেন, ‘তা বলছেন যখন, আর আপত্তি করি কেন!’

তারপর থেকে দেখা গেল, নাড়ু ওঝা কাউকে ফেরাচ্ছেন না। ডাক দিলেই হাজির কিছুক্ষণের মধ্যে। আর বুড়ো বয়েসে কাজকর্মের ওস্তাদি যেন আরও বেড়েছে। মানুষটা ঝড়ের গতিতে হাজির হয়, চোখের পলকে কাজ সাঙ্গ করে ফেলে। কেমন যেন পলকা—পলকা ছায়া—ছায়া ভাব শরীরে।

লোকে বলাবলি করে, ‘ভূত ঘেঁটে—ঘেঁটে মানুষটাও যেন ভূত হয়ে গেছে।’ বলে আর কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম ঠুকে নেয় একটা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *