ডক্টর নো (পার্ট ১)

ডক্টর নো

পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি

ঠিক ছ টার সময় শেষ হলুদ রঙের রশ্মি ছড়িয়ে সূর্য ডুব দিল রু মাউন্টেনের পেছনে। বেগুনী রঙের ছায়ার বন্যা নেমে এল রিচমন্ড রোডের ওপর। আর সুন্দর বাগানগুলোর মধ্যে শুরু হল ঝি ঝি পোকার গুঞ্জন ও ব্যাঙের ডাক।

নেপথ্যে এই পোকা-মাকড়ের শব্দ ছাড়া রাস্তাটা একেবারে নিঃশব্দ। এ পাড়ার বড় বড় সব নিঃসঙ্গ বাড়ির মালিকরা পাঁচটার মধ্যেই ঘরে ফিরে এসেছেন। এদের মধ্যে ব্যাংকের ম্যানেজার, কোম্পানীর বড়কর্তা, অথবা উচ্চপদস্থ সরকারী। কর্মচারী। এখন হয়ত তারা স্ত্রীর সঙ্গে গল্পগুজব করছেন, গা ধুচ্ছেন বা পোশাক বদলাচ্ছেন। আর আধঘণ্টার মধ্যেই রাস্তাটা পানীয় অভিলাষীদের ভীড়ে জমজমাট হয়ে উঠবে। কিন্তু আপাতত এই আধমাইল লম্বা বড়-লোকদের রাস্তা। (কিংসটনের ব্যবসায়ী মহলের ভাষায়) একেবারে ফাঁকা, যেন এক খালি রঙ্গমঞ্চ, যেখানে এখুনি অভিনয় শুরু হবে। চারিদিকে জুই ফুলের সুগন্ধ।

রিচমন্ড রোড জ্যামাইকার সর্বশ্রেষ্ঠ রাজপথ। সবচেয়ে উঁচুদরের পাড়া এইটি। এখানকার উচ্চবিত্তেরা সবাই পুরনো ধাচের বাড়িতে বাস করেন। প্রতিটি বাড়ি ঘিরে দু-এক একর জমি, হোপ-এর বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে আনা। সর্বশ্রেষ্ঠ গাছ ও ফুলে সাজানো। কিংসটনের যে অংশটাতে তার অধিবাসীদের সবাইকে যেতে হয় জীবিকা অর্জনের জন্য, তা নোংরা পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এই রাস্তার শেষে শুরু হয়েছে, রাজবাড়ির সীমানা। এ বাড়িতে থাকেন জ্যামাইকা দ্বীপের রাজ্যপাল ও প্রধান সেনাপতি।

মোড়ের পূর্ব কোণে দাঁড়িয়ে ১ নম্বর রিচমন্ড রোডের বাড়ি। একটা বড় দোতলা বাড়ি। রাস্তা থেকে নুড়ি বিছানো পথ চলে গেছে থামওয়ালা প্রবেশ দ্বার পর্যন্ত। এই প্রাসাদটি কিংসটনের সামাজিক জীবনের প্রাণকেন্দ্র-কুইনস ক্লাব। গত পঞ্চাশ বছর ধরে এই ক্লাবের সদস্যপদের জন্য অজস্র দরখাস্ত অগ্রাহ্য হয়ে চলেছে।

এ রকম উদ্ধত প্রাসাদ বোধহয় আধুনিক জ্যামাইকায় আর বেশিদিন থাকবে না। কিন্তু এই গ্রীষ্মপ্রধান দ্বীপে এ ধরনের একটা জায়গা বেশ উপযোগী। ক্লাবটি দক্ষহাতে পরিচালিত হয়, কর্মচারিরা কাজের; আর এখানকার খাদ্যও মদ সমগ্র ক্যারিবিয়ান দ্বীপে অদ্বিতীয়।

দিনের এই সময়ে বছরের অধিকাংশ সন্ধ্যার মত ক্লাবের সামনে সেই চারটি গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই গাড়িতে চারজন ব্রিজ খেলোয়াড় ঠিক চারটার সময় মিলিত হন এবং মধ্যরাত্রি পর্যন্ত উঁচু বাজীর খেলা খেলে যান। বাকের মাথায় পরপর দাঁড়িয়ে আছে ক্যারিবিয়ান প্রতিরক্ষা বিভাগের একজন ব্রিগেডিয়ারের গাড়ি; কিংসটনের একজন বড় ফৌজদারী উকিলের, কিংসটনের বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্কের অধ্যাপকের, আর সবশেষে শানবীম অ্যালপাইন গাড়িটির। মালিক ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর অবসর প্রাপ্ত কম্যান্ডার জন স্ট্রাংওয়েজের; যিনি স্থানীয় আঞ্চলিক কনট্রোল অফিসার অথবা যিনি ব্রিটিশ গুপ্তচর বিভাগের স্থানীয় প্রতিনিধি।

ছ টা পনেরোর ঠিক আগে রিচমন্ড রোডের নীরবতা ভাঙল। তিনজন ভিখারী এগিয়ে গেল গাড়ি চারটের দিকে। তারা চিগ্রো অর্থাৎ চীনের নিগ্রো। ভারি চেহারা তাদের। কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে ঝুঁকে হাতে সাদা লাঠিগুলো ফুটপাথের পাশে ঠুকছিল। প্রথমে লোকটির চোখে নীল চশমা, ডানহাতে একটা টিনের কাপ, বাঁ হাতে লাঠির বাকা দিকটা। দ্বিতীয় লোকটার ডান হাত প্রথম জনের কাঁধে এবং তৃতীয়ের ডান হাত দ্বিতীয়জনের কাঁধে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভিখারীর দু চোখ বোজা। তিনজনের পরনে শতছিন্ন পোশাক ও মাথায় বেস্ব খেলার টুপি। ছায়াচ্ছন্ন ফুটপাথ ধরে এগিয়ে চলেছে, লাঠি ঠোকার মৃদু শব্দ ছাড়া সব নিঃস্তব্ধ।

কিংসটনের ফাঁকা রাস্তায় তারা এক বিরূপ পরিবেশের সৃষ্টি করল। এটাও বড় অদ্ভুত যে এরা সবাই চীনে নিগ্রো।

তাস খেলার ঘরে কম্যান্ডার স্ট্র্যাংওয়েজ-এর রোদেপোড়া হাত সবুজ টেবিলের ওপর থেকে চারটে তাস নিল। এ পিঠটা পড়ল অন্যগুলোর ওপর। একশ অনার্স, তিনি বললেন, আর নিচে নব্বই। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। আমি কুড়ি মিনিটের মধ্যে ফিরে আসছি। এবার তোমার তাস দেবার পালা, বিল। কিছু পানীয়ের অর্ডার দাও। আমি চলে গেলে আমার হাতটা সাজিয়ে দেবার বৃথা চেষ্টা কোর না। আমি ঠিক ধরে ফেলব।

ব্রিগেডিয়ার বিল টেম্পলার হাসলেন। বললেন, তাড়াতাড়ি ফিরে এস। যখন তোমার পার্টনার টাকা লুঠতে শুরু করে, তখনই তোমার চাড় পড়ে খেলাটা ঠাণ্ডা করে দিতে।

ইতিমধ্যেই স্ট্রাংওয়েজ দরজার বাইরে চলে গেছেন। অন্য তিনজন চুপচাপ, বেয়ারা এল। তারা নিজেদের জন্য। পানীয় আর স্ট্র্যাংওয়েজের জন্য হুইস্কি এবং পানির অর্ডার দিলেন।

প্রতিদিন ছ টা পনেরোতে বাগড়া পড়ে অর্থাৎ দ্বিতীয় রাবারের মাঝামাঝি। এই সময়ে তাকে নাকি অফিস গিয়ে একটা ফোন করে আসতে হয়। কিন্তু ট্র্যাংওয়েজ এই চারজন দলের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাই ব্যাপারটা অন্যদের সহ্য করতে হয়। তারা কেউ জানেন না ফোন কাকে করা হয়, কারণ তারা জানেন স্ট্র্যাংওয়েজের কাজকর্ম গোপনীয়। তিনি কখনো কুড়ি মিনিটের বেশি দেরি করেন না, আর এ সময়টার অন্য সকলে যে পানীয় নেবেন, তার দাম তিনিই দেবেন।

পানীয় এল। তারা তিনজনে ঘোড়দৌড়ের আলোচনা শুরু করলেন।

সত্যি বলতে, দিনের এ সময়টা স্ট্র্যাংওয়েজের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। লন্ডনের রিজেন্ট পার্কে তার গুপ্তচর বিভাগের সদর দপ্তরের ছাদে যে শক্তিশালী ট্রান্সমিটারটি বসানো আছে, এই সময়ে তিনি যোগাযোগ স্থাপন করেন। প্রতিদিন সন্ধ্যে সাড়ে ছ টায় তাকে বেতারে দৈনিক স্থানীয় রিপোর্ট পাঠাতে ও নির্দেশ গ্রহণ করতে হয়।

যদি সাড়ে ছ টায় তাকে না পাওয়া যায়, তাহলে সাতটায় আবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। এর নাম নীল সংকেত। সাড়ে সাতটায় লাল সংকেত। এবারেও যদি বেতার যন্ত্র নীরব থাকে, তবে অবস্থা জরুরী হয়ে দাঁড়াবে এবং লন্ডনে তার নিয়ন্ত্রণকারী অফিস, সেকশন থ্রি, তাকে খুঁজবেন কি হয়েছে জানতে। একটা নীল সংকেত পর্যন্ত গুপ্তচরের পক্ষে অসম্মানের, যদি না সে লিখিতভাবে উপযুক্ত কারণ দর্শাতে পারে। সারা পৃথিবীতে লন্ডনের বেতারের জাল অত্যন্ত ব্যাপক।

স্ট্রাংওয়েজকে অবশ্য কখনো নীল সংকেতের অবমাননায় পড়তে হয়নি, লাল তো অনেক দূরের কথা। প্রতি সন্ধ্যা ছ টায় তিনি গাড়িতে চেপে ব্লু-মাউন্টেনের পিচের ছোট পাহাড়গুলোর ভেতর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে মর্গানস হারবারে তার বাড়িতে পৌঁছে, ছ টা পঁচিশে তিনি হলঘর পেরিয়ে পেছনদিকের অফিস ঘরে পৌঁছান।

ততক্ষণে মিস ট্ৰব্লও ভুয়া ফাইলের আলমারির মধ্যে লুকানো বেতারযন্ত্রের সামনে বসে পড়ে। এ মেয়েটি লোকচক্ষে তার সেক্রেটারী হলেও, বৃটিশ বাহিনীর নারী বিভাগের এক চীফ অফিসার ছিল। কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে সে প্রথম বেতার যোগাযোগটা করতে চেষ্টা করে, ১৪ মেগাসাইলস-এ, তার গুপ্ত পরিচয় সংকেত wXN জানিয়ে। স্ট্রাংওয়েজ তার পাশে বসে দ্বিতীয় ইয়ার ফোনজোড়া তুলে নেন। মেরীর সুন্দর হাঁটুর ওপর থাকে একটা শর্টহ্যান্ড প্যাড। ঠিক ছ টা আঠাশে ট্র্যাংওয়েজ বেতার যোগাযোগের ভার নিজের হাতে নিয়ে নেন আর অপেক্ষা করেন ঈথারে সেই আকস্মিক শূন্যতার জন্যে, যার অর্থ লন্ডনের www-র সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে।

পুরো ব্যাপারটা কড়া নিয়মে বাঁধা। আর স্ট্র্যাংওয়েজ-ও যথেষ্ট কড়া নিয়মের মানুষ। তবে দুঃখের বিষয় ধরাবাধা নিয়মের কাজ কর্ম যদি শত্রুরা একবার ধরে ফেলে, তাহলে মারাত্মক দাঁড়ায়।

স্ট্রাংওয়েজ দীর্ঘঋজু দেহের অধিকারী। ডান চোখের ওপর এক কালো পট্টি। সমস্ত চেহারা যে ঈগল পাখির মত। তিনি দ্রুতপদে কুইনস ক্লাবের মেহগনির দরজা ঠেলে রাস্তায় নামলেন।

সন্ধ্যার নির্মল হাওয়া, আর তিনি যে বিচিত্র কৌশলে তিন ইস্কাবনের খেলায় জয়ী হয়েছেন সেই স্মৃতি ছাড়া আর কিছু তিনি ভাবছেন না। দুই সপ্তাহ আগে M অনেকটা উদাসীন ভঙ্গিতে তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন একটা কাজ। কাজটা ভালই চলছে। অনেকটা দৈববলে চীনে সম্প্রদায়ের সঙ্গে এ রহস্যের যোগসূত্র আবিষ্কৃত হওয়ায় বড় সুবিধা হয়েছে। কতকগুলো অদ্ভুত ব্যাপারে আভাস পাওয়া গেছে, নুড়ি বিছানো পথে হাঁটতে হাঁটতে স্ট্র্যাংওয়েজ ভাবলেন, তাহলে তিনি সত্যিই এক আশ্চর্যতম সমাধানে পৌঁছবেন।

নাঃ স্ট্রাংওয়েজ কাঁধ ঝাঁকালেন। সে রকম পরিস্থিতি কখনোই আসবে না। শেষপর্যন্ত হয়ত সমস্ত ব্যাপারটা নেহাৎ জোলো। দেখা যাবে সমস্ত রহস্যটাই বেরিয়েছে ঐ চীনেদের এক অপরূপ কল্পনা থেকে।

একই সঙ্গে সে ঐ তিনজন অন্ধলোকগুলির দিকে লক্ষ্য রাখছিল। তারা লাঠি ঠুকতে ঠুকতে এগিয়ে আসছে। তিনি গাড়িতে পৌঁছবার দু-এক সেকেন্ড আগেই ওরা সামনে দিয়ে বেরিয়ে যাবে। পকেটে তিনি হাত ঢোকালেন, তিনি বুঝে নিশ্চিত হলেন একটা শিলিং, পেনি নয়। আরে, এরা দেখছি সবাই চিগ্রো। আশ্চর্য ব্যাপার। স্ট্র্যাংওয়েজ মুদ্রাটা টিনের কাপে দিল।

সৃষ্টিকর্তা আপনার মঙ্গল করুন হুজুর সামনের লোকটি বলল। আর দু জনও প্রতিধ্বনি করল, সৃষ্টিকর্তা আপনার মঙ্গল করুন।

স্ট্র্যাংওয়েজ এক মুহূর্তের জন্যে অনুভব করলেন যে, ফুটপাথে লাঠি ঠোকার শব্দ থেমে গেছে। সে শেষ লোকটিকে অতিক্রম করামাত্র তারা তিনজনে ঘুরে দাঁড়াল। পেছনের দু জন অল্প সরে এল যাতে গুলি চালাবার রাস্তা পরিষ্কার হয়। সাইলেন্সর লাগান তিনটি রিভলবার বেরিয়ে এল ছেঁড়া কাপড়-চোপড়ের অন্তরালে লুকোনো খাপ থেকে। নিখুঁত ভঙ্গিতে তারা স্ট্রাংওয়েজের মেরুদণ্ডের তিনটি জায়গায় লক্ষ্য স্থির করল–একজন কাঁধের মাঝখানে, অন্যজন পিঠের কেন্দ্রস্থলে ও তৃতীয়জন মেরুদণ্ডের নিম্নতম প্রান্তে।

তিনটি রিভলবারের গর্জন যেন একসঙ্গে বেরুলো, স্ট্র্যাংওয়েজের দেহ সামনের দিকে ছিটকে গেল, যেন কেউ ধাক্কা দিয়েছে পেছন দিক থেকে। ফুটপাথের ওপর তার মৃতদেহটা নিশ্চল পড়ে রইল।

এখন ছ টা-সতের। তীক্ষ্ণ শব্দ তুলে শবাধারবাহী কালো মোটরগাড়ি মোড় ঘুরে এসে দাঁড়াল রিচমন্ড রোডের ওপর। তার ছাদের চার কোণে চারটে কৃষ্ণ পতাকা উড়ছে। গাড়িটা তাদের পাশে থামবার আগে তারা তিনজন স্ট্র্যাংওয়েজের দেহটা তুলে নেবার সময়টুকু কেবল পেল। গাড়ির পেছনের দরজাটা খোলা। ভেতরে ঢাকা খোলা একটা সাধারণ চেহারার কফিন।

তিনজন মিলে দেহটাকে তুলে ফেলল কফিনের মধ্যে। ঢাকা বন্ধ করে গাড়ির দরজা টেনে দেওয়া হল। চিগ্রো তিনজন কফিনের চার কোণে চারটি চেয়ারে বসে পড়ল। সহজ ভঙ্গিতে তাদের সাদা লাঠি পাশে রেখে গায়ের ছেঁড়া জামা কাপড়ের ওপরেই চাপিয়ে নিল কালো রঙের ধূসর আলপাকার কোট।

ড্রাইভারটিও এক চীনে নিগ্রো। সে ভয়ে-ভয়ে পেছন দিকে তাকাল।

চালাও, চালাও। সবচেয়ে বড় চেহারার খুনিটা বলল। তার হাতঘড়ির দিকে তাকাল, ছটা কুড়ি। কাজ সারতে ঠিক তিন মিনিট লেগেছে।

কালো গাড়িটা ডান দিকে মোড় নিল। তারপর ত্রিশ মাইল বেগে রাজপথ ধরে পাহাড়ের দিকে চলতে লাগল। কালো পতাকা উড়ে বিষণ্ণ ভাষায় সকলকে জানাচ্ছে মৃতদেহের কথা। আর তিনজন ভেতরে বসে রয়েছে, বুকের ওপর দু হাতে ক্রশচিহ্ন এঁকে।

wXN ডাকছি www কে WXN ডাকছি www কে…WXN…wXN…wXN…।

মেরী ট্রুব্লাডের মাঝের আঙুলটা প্রেরক যন্ত্রের চাবির ওপর মৃদু আঘাত করছে। বাঁ কব্জি তুলে ছ টা আঠাশ বাজে। স্ট্র্যাংওয়েজ এক মিনিট দেরি করে ফেলেছেন। এবার বোধহয় এক সেকেন্ডের মধ্যেই তার পায়ের আওয়াজ শোনা যাবে। কুণ্ঠিত হাসি হেসে সে বলবে, দুঃখিত মেরী। গাড়িটা স্টার্ট নিচ্ছিল না। কিংবা হাফওয়ে ট্রীর কাছে আমাকে আটকে দিল। মেরী দ্বিতীয় ইয়ারফোন জোড়া নামিয়ে রাখল, তাতে আধ সেকেন্ড সময় বাঁচবে।

WXN ডাকছি www কে। WXN ডাকছি www কে। ঘড়িতে ছ টা ঊনত্রিশ। এবার মেরীর দুশ্চিন্তা হল। আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই লন্ডনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হবে।

বাইরের গুপ্তচরদের কাছ থেকে যে সব বেতার সংকেত আসে তার প্রত্যেকটির ওপর রেডিও সিকিউরিটি কড়া নজর রাখে। যদি স্ট্র্যাংওয়েজের জায়গায় অন্য কেউ সংকেত পাঠায় তাহলে প্রেরক যন্ত্রের চাবির ওপর সামান্য চাপে পার্থক্য হবে। তাতেই ধরা পড়ে যাবে যে সে আসল প্রেরক নন। মেরী নিজের চোখে যন্ত্রটাকে দেখছে কিন্তু কিছু করার নেই।

পাছে কোন এক প্রেরকযন্ত্র শত্রুপক্ষের হাতে পড়ে যায় সেইজন্যেই এই সাবধানতা। আর যদি কোন গুপ্তচর শত্রুপক্ষের হাতে পড়ে তাকে যন্ত্রণা দিয়ে লন্ডনে বার্তা পাঠাতে বাধ্য করা হয় তাহলে তাকে শুধু তার প্রেরণের ভঙ্গির পরিবর্তন করতে হয়। তৎক্ষণাৎ সদর দপ্তর বুঝবে যে সে বন্দী।

লন্ডনের সাড়া পাওয়া গেছে। ঈথারে সহসা এক শূন্যতার সৃষ্টি হল যার অর্থ যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। মেরী। ট্রব্লও হাতঘড়ির দিকে তাকাল সাড়ে ছটা। সর্বনাশ। কিন্তু না, হলঘরে পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে।

www ডাকছি wXN কে…www ডাকছি wXN কে…শুনতে পাচ্ছ? লন্ডন থেকে সংকেত আসছে।

দরজার কাছে পায়ের আওয়াজ। ঠাণ্ডা মাথায় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মেরী সংকেত পাঠাল : শুনতে পাচ্ছি ..পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি..পরিষ্কার…

পেছন দিকে এক বিস্ফোরণের শব্দ। কি যেন তার গোড়ালিতে লাগল। নিচের দিকে দেখল যে দরজার তালাটা এসে লাগল।

মেরী চট করে পেছনে ঘুরে দেখল স্ট্রাংওয়েজ নয়, অন্য একজন লোক। এক নিগ্রো-গায়ের রং হলদে, চোখ দু টো বকা। তার হাতে রিভলবার, তাতে সাইলেন্সর লাগানো।

মেরী চিৎকার করবার জন্য হাঁ করল। লোকটা হাসল, রিভলবারটি তুলে মেয়েটির বা স্তনের চারদিকে তিনবার গুলি চালাল।

চেয়ারে ঢলে পড়ল মেরী। ইয়ার ফোনটা সোনার বরণ চুল থেকে খসে পড়ল মেঝের ওপর। লন্ডনে কনট্রোলারের ডেস্কে একটা ঘণ্টি বেজে জানাল যে WXN-এর কিছু গোলমাল হয়েছে।

খুনী দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। যখন সে ফিরে এল, তার হাতে প্রেস্টোফায়ার লেখা একটা শুকনো জ্বালানির বাক্স ও একটা খালি বড় থলে। বাক্সটা নামিয়ে রেখে মেয়েটাকে হিঁচড়ে ঢোকাল থলের মধ্যে।

ভারি বোঝাটা হলঘরে রেখে এল। ঘরের এক কোণে একটা সিন্দুক খোলা। তার থেকে বার করা সংকেত বইগুলো আর সিন্দুকে যাবতীয় কাগজপত্র ঘরের মাঝখানে ছুঁড়ে দিল। পর্দাগুলো ছিঁড়ে তার ওপর রাখল আর সব কিছুর উপর রাখল গোটাদুয়েক চেয়ার। জ্বালানির বাক্স খুলে সেই স্কুপের ওপর একমুঠো ফেলে আগুন ধরিয়ে দিল।

তারপর হলঘরে গিয়ে একই কায়দায় বিভিন্ন জায়গায় আগুন লাগাল। অগ্নিশিখা ঘরের প্যানেল স্পর্শ করল। লোকটা বাড়ির সামনের দরজা খুলল। ফুলঝোঁপের ভিতর দিয়ে দূরের শবাধারবাহী কালো গাড়িটা দেখা যাচ্ছে।

ঝিঁঝি পোকার গুঞ্জন আর কালো গাড়ির চলন্ত ইঞ্জিনের শব্দ ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই। লোকটা হলঘরে গিয়ে ভারি থলেটা কাঁধে করে বেরিয়ে এল।

দ্রুতপদে সে রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল। কালো গাড়ির পেছনের দিকে থলেটা ঢুকিয়ে দিল। আর অন্য দু জন সেটাকে কফিনের মধ্যে স্ট্র্যাংওয়েজের দেহের ওপর শুইয়ে দিল। লোকটা গাড়িতে উঠে বসল।

বাংলোর ওপরের জানালায় যখন আগুন দেখা গেল, কালো গাড়ি তখন সোজা সরোবরের দিকে যাচ্ছে। সেখানে। ওজনের সাহায্যে কফিনটাকে পঞ্চাশ ফ্যাদম পানির নিচে ডুবিয়ে দেওয়া হবে এবং ব্রিটিশ গুপ্তচর বিভাগের ক্যারিবিয়ান স্টেশনের কর্মীবৃন্দ ও নথিপত্র ধ্বংস করার কাজ শেষ।

.

অস্ত্র নির্বাচন

তিন সপ্তাহ পরে, লন্ডন শহরে মার্চ মাস এল যেন একটা ব্যাটল সাপের মত ঠকঠকিয়ে। পয়লা মার্চ সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শিলাবৃষ্টি ও তীব্র ঝড় শুরু হল। শহরের কাজে যাওয়া লোকেরা তাদের,ওভারকোটের নিম্ন প্রান্ত, পায়ের ওপর আর মুখে এসে লাগছে কনকনে ঠাণ্ডা।

দিনটা বড়ই বিশ্রী। M পর্যন্ত স্বীকার করেছিলেন আবহাওয়াটা বিশ্রী। ভুয়া নম্বর প্লেট লাগানো তার কালো সিলভার বে রোল গাড়ি যখন রিজেন্ট পার্কের বাড়িটা সামনে এসে দাঁড়াল এবং তিনি ফুটপাথে নামতেই বুলেটের মত শিলা এসে চোখে মুখে আঘাত করল। তিনি ড্রাইভারকে বললেন, আজ আর গাড়ির দরকার হবে না। স্মিথ, আমি আজ মাটির তলায় রেলগাড়ি চড়ে বাড়ি ফিরব। এখন গাড়ি চালাবার আবহাওয়া নয়।

ড্রাইভার স্মিথ হেসে বলল, আচ্ছা স্যার ধন্যবাদ। সে দেখল বয়স্ক ঋজু মূর্তিটা বাড়িটাকে উঠল। এ নির্দেশ M এরই উপযুক্ত। অধীনস্থ কর্মচারিদের প্রতি তার পূর্ণদৃষ্টি। স্মিথ গীয়ার বদলে গাড়ি চালাতে চালাতে ভাবল এ ধরনের মানুষ আজকাল নেই।

লিফটে চড়ে M নতলায় উঠলেন। অফিসে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ওভারকোট ও স্কার্ফ খুললেন। বড় একটা নীল রুমালে মুখ মুছলেন। ডেস্কের সামনে বসে তিনি ইন্টারকমের একটা সুইচ টিপে বললেন, আমি এসেছি, মিস মানিপেনী। বেতার সংকেতগুলো পাঠিয়ে দাও। তারপর স্যার জেমস্ মলোনিকে টেলিফোনে ধরে দাও। এখন বোধহয় তিনি হাসপাতালে রাউন্ড দিচ্ছেন। প্রধান কর্মসচিবকে বল যে আমি আধঘণ্টার মধ্যে 007-এর সঙ্গে দেখা করব। স্ট্যাংওয়েজের ফাইলটাও দিয়ো।

M গা এলিয়ে বসলেন। হাত বাড়িয়ে পাইপটা নিয়ে তামাক ভরতে লাগলেন চিন্তিত মনে। তার সেক্রেটারি একতাড়া কাগজ রেখে গেল। বেতার সংকেতের ফাইলের ওপর আধা ডজন অত্যন্ত জরুরী মার্কা কাগজকেও তিনি উপেক্ষা করে গেলেন। তেমন জরুরী হলে কাল রাতেই তাকে জানিয়ে দেওয়া হত।

ইন্টারকমের ওপর হলুদ আলো দপদপিয়ে উঠল। কালো রঙের ফোনটি তুলে, কে, স্যার জেমস্? পাঁচ মিনিট সময়

আপনার জন্যে ছ মিনিট সময়ও হতে পারে। কোন মন্ত্রীকে হেলথ সার্টিফিকেট দিতে হবে নাকি?

আজ সে ব্যাপার নয়। আমি আমার এক কর্মচারি সম্বন্ধে জানতে চাইছি। আপনিই তার চিকিৎসা করছিলেন। বাইরের লাইন বলে তার নাম বলছি না। শুনলাম আপনি নাকি তাকে গতকাল ছেড়ে দিয়েছেন। সে কি আবার কাজ শুরু করতে পারবে?

অভিজ্ঞ চিকিৎসকের গাম্ভীর্য গলায়, দেহের দিক দিয়ে লোকটি সম্পূর্ণ সুস্থ। পা সেরে গেছে, তাকে এখন সুস্থ বলা চলে। একটু থেমে আবার বললেন, তবে একটা কথা, M-এর ওপর যে চাপ পড়েছিল তা এখনো কাটেনি। এখন তাকে একটু হালকা কাজ দিতে পারবেন? আপনার কথা শুনে মনে হয় গত কয়েক বছর ধরেই লোকটির ওপর খুব কাজের চাপ পড়ছে।

M গম্ভীর গলায় বললেন, কাজ করবার জন্যেই তাকে বেতন দেওয়া হয়। সে অক্ষম কি-না সেটা শিগগির বোঝা যাবে। এর আগেও কেউ কেউ ওরকম ভেঙে পড়েছে। সুতরাং খুব বেশি চোট তার লাগেনি। এর আগে আপনার কাছে। যে রোগীদের পাঠানো হয়, যাদের দেখে সন্দেহ হয় যে মাড়াই-এর কলে ফেলা হয়েছিল, তাদের তুলনায় কিছু নয়।

হ্যাঁ, সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে অবশ্য তাই। তবে যন্ত্রণাটা বড় অদ্ভুত জিনিস। যন্ত্রণা মাপা যায় না। প্রসব যন্ত্রণা ও কিডনীর যন্ত্রণা কোন্টা কম আর কোটা বেশি, তা বলা অসম্ভব। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ যে মানবদেহ খুব তাড়াতাড়ি ব্যথার স্মৃতি ভুলে যায়। কিন্তু M ভাবলেন না যে ওর হাত-পা ভাঙেনি বলে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়। বড় ভুল করেছিল, এবং সেজন্য শাস্তি পেয়েছে, ব্যস। তার গুপ্তচরদের ব্যাপার কারো কাছে উপদেশ শুনতে M পছন্দ করে না। M হঠাৎ বলে উঠলেন, স্টাইনক্রোনের নাম শুনেছেন–ডক্টর পিটার স্টাইনক্রোন।

না, কে তিনি।

এক আমেরিকান ডাক্তার। তার লেখা একটা বই আমাদের ওয়াশিংটন অফিসে লাইব্রেরির জন্য পাঠিয়েছে। তাতে তিনি লিখেছেন মানুষের দেহ কতটা চোট সহ্য করতে পারে। একজন সাধারণ মানুষ দেহের কোন কোন অংশ ছাড়াই বাঁচতে পারে। পাছে কাজে লাগে তাই সেই তালিকাটা আমি টুকে রেখেছি। শুনবেন নাকি?

M কোটের পকেট থেকে কাগজটা বার করে হাঁক দিলেন। হ্যালো, স্যার জেমস্। এই যে শুনুন : গল ব্লাডার, পেটের পিলে, দুটো টনসিল, অ্যাপেনডিক্স, দুটো কিডনির একটা, দুটো ফুসফুসের একটা, শরীরের তিন-চার সের রক্তের দেড় সের, যকৃত-এর পাঁচ ভাগের দু ভাগ, প্রায় সবটা পাকস্থলী, ২৩ ফুট নাড়িভুড়ির চার ফুট আর মগজের আর্ধেকটা। অপর প্রান্ত চুপচাপ দেখে প্রশ্ন করলেন, কিছু বলবেন, কিছু বলবেন, স্যার জেমস?

ওদিক থেকে নিরুৎসুক ধ্বনি ভেসে এল, ভাবছি উনি এর সঙ্গে একটা হাত, একটা পা অথবা একজোড়া হাত-পা জুড়ে দেননি কেন। আর আপনি কি বলতে চাইছেন তাও বুঝতে পারলাম না।

কাস্ট হেসে M বললেন, আমি বলতে চাইছি না কিছুই। লোকটি যতটুকু আঘাত পেয়েছে, তা ঐ রকম আঘাতের তুলনায় কিছুই নয়। এ নিয়ে আর তর্কাতর্কি নয়। জ্যামাইকাতে একটি ব্যাপার হয়েছে। ওখানে গেলে ওর বিশ্রাম নেওয়া ছাড়া বিশেষ কিছু করবার থাকবে না। ওখানে আমার এক পুরুষ ও এক নারী কর্মচারি একসঙ্গে পালিয়েছে। উক্ত লোকটি অনুসন্ধানকারী হিসাবে সেখানে কিছুদিন বেড়িয়ে আসতে পারে। কেমন হবে?

খুব ভাল কথা। এমন বিশ্রী দিনে অমন একটা কাজ পেলে আমিও খুশি হতাম। আপনি ভাববেন না, M, যে আপনার ব্যাপারে আমি নাক গলাচ্ছি। কিন্তু মানুষের সাহসের একটা সীমা আছে। আপনি নিশ্চয়ই চান না যে এরা। অল্প বয়সেই ফুীগয়ে যাক। আপনার এই লোকটা সত্যিই দক্ষ। আমি বলতে পারি এর কাছ থেকে আরও অনেক কাজ পাবেন আপনি। কিন্তু আপনি জানেন মর্গ্যান তার বইয়ে সাহস সম্বন্ধে কি মত প্রকাশ করেছেন।

মনে পড়ছে না।

তিনি বললেন, সাহস জিনিসটা মূলধনের মত, খরচ করলে কমে যায়। আপনি তাঁর সঙ্গে একমত। আমি শুধু বলতে চাই, যে, এই লোকটি যুদ্ধের আগে থেকেই খুব বেশি খেটে চলেছে। এখনও সে ফুরিয়ে যায়নি, কিন্তু এরও একটা সীমা আছে।

ঠিক তাই।

 M ঠিক করলেন, এ নিয়ে আর কথা বলা নয়। আজকাল দেখছি সবাই নরম হয়ে পড়ছে। ঐজন্যেই আমি তাকে বাইরে পাঠাচ্ছি। জ্যামাইকাতে ছুটি উপভোগ করে আসুক। ভাববেন না স্যার জেমস, আমি তার ওপর নজর রাখব। ভাল কথা, রাশিয়ান মহিলাটি ওকে কি বিষ দিয়েছিল, জানতে পেরেছেন?

সবে গতকাল জেনেছি? প্রসঙ্গান্তরে আসতে পেরে তিনিও খুশি হলেন। M বুড়ো আজকের আবহাওয়ার মতই বিশ্রী। তিনি এতক্ষণ যা বকবক করে গেলেন, তা M-এর মোটা মাথায় ঢুকল কিনা কে জানে। বার করতে আমাদের তিনমাস লেগেছে। শেষ পর্যন্ত স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের এক তুখোড় ছোকরা বিষটা ধরতে পেরেছে। ঔষধটার নাম ফুগু। জাপানীরা আত্মহত্যা করতে এই বিষ ব্যবহার করে। জাপানী গ্লোব মাছের যৌনাংশে এটা পাওয়া যায়। রাশিয়ানরা সত্যিই এমন সব জিনিস ব্যবহার করে, যার নাম পর্যন্ত কেউ শোনেনি।

এই বিষ ঠিক কুরারী মত কাজ করে স্নায়ুকেন্দ্রকে অসাড় করে দেয়। ফুগু র বৈজ্ঞানিক নাম টেট্রোজটাক্সিন। সাংঘাতিক জিনিস, আর কাজ করে ভীষণ তাড়াতাড়ি। আপনার লোকটির শরীরে যে পরিমাণে বিষ ঢুকেছিল তাতে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাসের পেশীগুলো অবশ হয়ে পড়বার কথা। প্রথমে সে সামনের সব-কিছু দু টো করে দেখতে পায়, তারপর আর চোখ খুলে রাখতে পারে না। এরপর ঢোক গেলা অসম্ভব হয়ে পড়ে। মাথা ঝুঁকে পড়ে সামনের দিকে, আর তুলতে পারে না। মারা পড়ে শ্বাসযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে।

কপাল জোরে বেঁচে গেছে দেখছি।

অতি আশ্চর্য ব্যাপার। এর জন্য তার সঙ্গী ফরাসি লোকটি অনেকখানি দায়ী। তিনি তাকে মাটিতে শুইয়ে ফেলে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যবস্থা করেন। ভাগ্য ভাল যে, সেই ডাক্তারটি দক্ষিণ আমেরিকায় কাজ করছিলেন। তিনি এটাকে, কুরারী বিষের ক্রিয়া দশলাখে সন্দেহ করে সেইমত ব্যবস্থা করেন। এরকম অবস্থায় একজন বাঁচে। ভাল কথা, রাশিয়ান মহিলাটির কি হল?

M সংক্ষেপে বললেন, তিনি মারা গেছেন। আর আপনার রোগীর সম্বন্ধে দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি দেখব যাতে সে সহজ কাজ পায়। নমস্কার?

M ফোন নামিয়ে রাখলেন। বেতার সংকেতের ফাইলটা টেনে নিয়ে চটপট চোখ বুলিয়ে নিলেন। সব কাজ শেষ করে কাগজপত্রের রাশি আউট লেখা বাক্সতে ফেললেন। তার সামনে রইল কেবল চা-রঙের ফোল্ডার। তার ওপর অত্যন্ত গোপনীয় মার্কা লাল তারকা চিহ্ন। ফোল্ডারের মাঝামাঝি বড় বড় অক্ষরে লেখা ও ক্যারিবিয়ান স্টেশন, আর নিচে বাঁকা হরফে ট্র্যাংওয়েজ ও ট্রব্লড স্টেশন।

ইন্টারকমের আলো জ্বলে উঠল। সুইচ টিপে M বললেন, বল।

007 এসেছে স্যার।

ভেতরে পাঠিয়ে দাও। আর অস্ত্র বিভাগের বড়কর্তাকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে দেখা করতে বল।

 M হেলান দিয়ে পাইপের ডগায় একটা জ্বলন্ত কাঠি ধরলেন আর দরজার দিকে তাকালেন সেক্রেটারির জন্য।

জেমস্ বন্ড ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। এগিয়ে ডেস্কের সামনের চেয়ারে M-এর মুখোমুখি বসল।

সুপ্রভাত, 007।

সুপ্রভাত, স্যার।

সবকিছু চুপচাপ, কেবল M-এর পাইপ টানার শব্দ। পেছনে চওড়া জানালার ওপর শিলাবৃষ্টি আছড়ে পড়ছে।

আরোগ্যলাভের পথে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘোরবার সময় বন্ডের ঠিক এই দৃশ্যটা বার বার মনে হত। সে উন্মুখ হয়েছিল এইভাবে M-এর সামনে এসে বসবার জন্য, মনে হবে আবার সে স্বাভাবিক হয়ে গেছে।

ধোয়ার কুয়াশার ভেতর দিয়ে সে ধূর্ত, ধূসর চোখ জোড়ার দিকে তাকাল। চোখ দুটো তাকেই লক্ষ্য করছে। এর আগের কাজে যে গণ্ডগোল হয়েছিল তাই নিয়ে শবব্যবচ্ছেদ হবে? অন্য কোন বিভাগে স্থানান্তরিত করা হবে? নাকি M তার জন্য একটা চমৎকার কাজ জমিয়ে রেখেছেন?

M দেশলাইয়ের বাক্সটা লালচামড়ার ডেস্কে ফেলে এলিয়ে বসলেন।

কেমন লাগছে? ফিরে আসতে পেরে খুশি হয়েছ তো?

 খুব ভাল লাগছে, স্যার। আর শরীরটাও চমৎকার আছে।

তোমার আগের কাজটার সম্পর্কে কিছু ভেবেছ? শুনেছ বোধহয়, এ সম্বন্ধে অনুসন্ধানের আদেশ দিয়েছিলাম আমি। প্রধান কর্মসচিব সম্ভবত তোমার কিছু সাক্ষ্য নিয়েছেন। আর কোন বক্তব্য আছে?

M-এর গলাটা বড় ঠাণ্ডা ও পেশাদারী। বন্ড বুঝতে পারল বিপদ আসছে। না স্যার। একটা গণ্ডগোল বেধেছিল। মহিলাটি যে আমাকে বাগে পেয়েছিলেন, সে জন্য আমিই দায়ী। আমার পক্ষে সেটা উচিত হয়নি।

M কড়া চোখে তাকিয়ে বললেন, ঠিক তাই।তার গলা মসৃণ ও বিপজ্জনক শোনাল। যতদূর মনে পড়ছে তোমার পিস্তলটা আটকে গিয়েছিল। যথাসময়ে বার করতে পারনি। ওটাতে কিছু গোলমাল আছে, 007 তুমি যদি 00 বিভাগে থাকতে চাও তবে ভুল করা চলবে না। তুমি সাধারণ অফিসের কাজে যোগ দেবে?

বন্ড আহত দৃষ্টিতে M-এর দিকে তাকাল। 00 সঙ্কেত হল গুপ্তচর বিভাগের হয়ে নরহত্যা করার লাইসেন্স। এই সঙ্কেতের ক্ষমতায় বন্ড তার মনের মত সব কাজ হাতে পেত–অর্থাৎ বিপজ্জনক কাজ।

না স্যার, সে আমি পারব না।

 তাহলে তোমার অস্ত্র পরিবর্তন করতে হবে। তদন্ত কমিটি এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছেছেন। বুঝলে?

বন্ড অবাধ্য ভঙ্গিতে বলল, এই পিস্তলটায় আমার অভ্যেস হয়ে গেছে স্যার। যা হয়েছে তা যে কোন লোকেরই। হতে পারত। আর যে কোন পিস্তলে।

আমার তা মনে হয় না। তদন্তকারীদেরও নয়। এক মাত্র প্রশ্ন হল যে তুমি অন্য কোন অস্ত্র ব্যবহার করতে পার। ইন্টারকমের দিকে ঝুঁকে M বললেন, আর্মারার মশাই এসেছেন কি? তাকে পাঠিয়ে দাও।

তুমি হয়ত জান না, 007, মেজর বুথরয়েড হলেন সবচেয়ে বড় ক্ষুদ্র অস্ত্র বিশারদ। তা না হলে এখানে তার জায়গা হত না। দেখি তিনি কি বলেন।

দরজা খুলে একজন বেঁটে দোহারা চেহারার মানুষ, মাথায় বালি রঙের চুল এলেন ভেতরে এবং বন্ডের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। বন্ড তাকাল ভদ্রলোককে সে বিশেষ দেখেনি, তবে দূরে দূরে ঐ দুই ধূসর চোখের অপলক দৃষ্টি তার চেনা চেনা লাগল। ভদ্রলোক M-এর দিকে তাকিয়ে বললেন, সুপ্রভাত স্যার।

সুপ্রভাত আর্মারার। আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করবার আছে। সহজ ভঙ্গিতে M বললেন, প্রথমত, ০.২৫ ক্যালিবারের বেরেটা পিস্তল সম্পর্কে আপনার কি ধারণা?

মেয়েদের উপযুক্ত পিস্তল, স্যার।

M ভুরু তুলে বঙ্কিম ভঙ্গিতে বন্ডের দিকে তাকাল। বন্ড একটু হাসল।

সত্যি কেন বলুন তো?

পিস্তলটার জোর (Stopping power) নেই, স্যার। কিন্তু চালানো ভারি সোজা। দেখতে চমৎকার, মেয়েরা খুব পছন্দ করে।

আর যদি সাইলেন্সর লাগানো থাকে?

জোর আরও কমে যাবে স্যার। আর সাইলেন্সার আমি তেমন পছন্দ করি না। বড় ভারি, আর চটপট পিস্তল বার করতে গেলে কাপড়ে চোপড়ে আটকে যায়।

M মিষ্টি করে বললেন, কিছু বলবার আছে, 007?

বন্ড কাঁধ ঝাঁকাল, আমার তা মনে হয় না। গত পনের বছর আমি বেরেটা ০.২৫ ব্যবহার করছি। কখনো গুলি আটকায়নি বা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। একটা পিস্তলের পক্ষে এটা কম কথা নয়। যখন প্রয়োজন হয়েছে আমি বড় অস্ত্রও ব্যবহার করেছি। যেমন লম্বা নলওয়ালা ০.৪৫ কোল্ট রিভলবার। কিন্তু অল্প দূরত্বে লক্ষ্যভেদের সময় আর পোশাকের ভেতর লুকিয়ে রাখবার জন্য বেরেটা আমার মতে সর্বশ্রেষ্ঠ। বন্ড আবার বলল, তবে সাইলেন্সর সম্পর্কে ইনি যা বললেন, তা আমি স্বীকার করছি স্যার। ওটা সত্যিই বড় ঝামেলার ব্যাপার। তবে কোন কোন সময় নিঃশব্দে কাজ সারা দরকার হয়ে পড়ে।

ঐ পিস্তল ব্যবহার করলে তোমার যে কত সুবিধে হয়। তা আমরা জেনে গেছি। M নীরস গলায় বললেন, আর পিস্তল বদলানোটা স্রেফ অভ্যেসের ব্যাপার। কয়েকদিনেই তোমার নতুন পিস্তল রপ্ত হয়ে যাবে। M তার গলায় সহানুভূতির রেশ আনলেন, আমি দুঃখিত, 007। কিন্তু আমি মনস্থির করে ফেলেছি। এবার একটু উঠে দাঁড়াও। আমি চাই যে আমারার তোমার শরীরের গড়ন ভাল করে দেখে নেন।

বন্ড উঠে দাঁড়াল ভদ্রলোকের সামনে। বন্ডের চারপাশে ঘুরে দেখলেন তিনি। তারপর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনার পিস্তলটা দেখতে পারি?

বন্ডের হাত কোটের ভেতর চলে গেল। ছোট করে কাটা নলওয়ালা বেরেটা পিস্তলটা বার করে তার হাতে দিল। বুথরয়েড সেটাকে পরীক্ষা করে দেখলেন, ওজন অনুভব করলেন। তারপর ডেস্কে নামিয়ে রেখে আর পিস্তলের খাপটা?

বন্ড কোট খুলে শ্যাময় চামড়ার খাপ ও বেল্ট বার করল। খাপের মুখটা একবার দেখলেন বুথরয়েড, বোধহয় সেখানে কিছু চিহ্ন আছে কিনা দেখলেন। M-এর দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার মনে হয় এর চেয়ে ভাল জিনিস আমাদের হাতে আছে, স্যার।

বন্ড বসে M-এর দিকে তাকাল, তা আর্মারার আপনি কোন্ অস্ত্র ব্যবহার করতে বলেন?

এবার মেজর বুথয়েডের গলায় বিশেষজ্ঞের মেজাজ, সত্যি বলতে কি স্যার সম্প্রতি আমি প্রতিটি পিস্তল ও রিভলভার পরীক্ষা করার কাজে ব্যস্ত আছি। পঁচিশ গজ দূরের লক্ষ্যবস্তুর দিকে প্রত্যেকটাতে পাঁচ হাজার পাউন্ড গুলি ছুঁড়ে দেখছি। আমার ভাল লেগেছে ৭.৬৫ মিলিমিটার ক্যালিবারের ওয়ালথার পি.পি.কে. পিস্তল। ফলাফলের দিক দিয়ে অবশ্য জাপানী এম-১৪, রাশিয়ান টোকারেভ ও সয়ার এম-৩৮ এই পিস্তলের চেয়ে ভাল করেছে। হাতলটা লম্বা। হওয়ায় 007-এর ধরতে সুবিধে হবে। খুবই জোরদার পিস্তল। অবশ্য বেরেটা ছিল ০.২৫ ক্যালিবারের, যেখানে এর প্রায় ০.৩২, তবু এর চেয়ে হালকা কিছু ব্যবহার করা উচিত নয়। ওয়ালথারের গুলি পৃথিবীর সব জায়গায় পাওয়া যায়। কিন্তু জাপানী আর রাশিয়ান পিস্তলের গুলির এ সুবিধে নেই।

M বণ্ডকে বললেন, কিছু বলবার আছে?

ও পিস্তলটা ভালই স্যার। তবে বেরেটার চেয়ে আকারে বড়। আমি কি করে ওটাকে পরব? আর্মারার কি বলেন?

বার্নস্ মার্টিন ট্রিপল্ড হলস্টার। প্যান্টের বেল্টের নিচে বাঁ দিকে পরলে সবচেয়ে ভাল। খাপটা শক্ত চামড়ার তৈরি। ভেতরে একটা স্প্রিং-এর সাহায্যে পিস্তল ধরে রাখে। এটার থেকে তাড়াতাড়ি পিস্তল বার করা যাবে। এক সেকেন্ডের পাঁচভাগের তিনভাগ সময়ে কুড়ি ফুট দূরের মানুষকে গুলি করা চলে।

তবে তাই হোক। আর এর চেয়ে বড় কোন অস্ত্র নেওয়া দরকার?

সেক্ষেত্রে একটাই অস্ত্র আছে, স্যার, স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন সেন্টিনিয়্যাল এয়ারওয়েট। এটা রিভলভার ০.৩৮ ক্যালিবারের। সাড়ে ছ ইঞ্চি লম্বা আর ওজন মাত্র তের আউন্স। পাঁচটার বেশি গুলি ভরা যায় না। তবে পাঁচটা গুলি একজনকে মারবার পক্ষে যথেষ্ট। এতে ০.৩৮ স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন স্পেশান কাট্রিজ ভরা যায়–আশ্চর্য নির্ভুল গতি এই গুলির।

ঠিক আছে, ঠিক আছে। M চটে বললেন, আমরা বুঝেছি, তাহলে ওয়ালথার আর স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন ঠিক হল। 007-কে একটা করে পাঠিয়ে দেবেন। আর ও-দুটো চালিয়ে অভ্যেস করবার ব্যবস্থাও করে দেবেন। আজ থেকেই। এক সপ্তাহের মধ্যে হাত পাকিয়ে ফেলা দরকার। ঠিক আছে? অনেক ধন্যবাদ, আর্মারার, আর আটকে রাখব না।

ধন্যবাদ, স্যার। মেজর বুথরয়েড তারপর দৃঢ় পদে বেরিয়ে গেলেন। কোন সাড়াশব্দ নেই। জানালার ওপর শিলাবৃষ্টি আঘাত করে চলেছে। M চেয়ার ঘুরিয়ে ধুয়ে যাওয়া জানলার কাঁচের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বন্ড চট করে হাতঘড়ি দেখে নিল। দশটা বাজছে।

তার চোখ পড়ল ডেস্কে রাখা পিস্তল ও খাপটার ওপর। মনে পড়ল পনের বছর কাটিয়েছে বিশ্রী লোহার টুকরোটার। সঙ্গে। মনে পড়ল একটিমাত্র বুলেট তার প্রাণ বাঁচিয়েছে, ও চেহারা দেখিয়েই কাজ হয়েছে, সেই সব দিনের কথা? মনে পড়ল। তখন নরহত্যার জন্য বেরেটা-পিস্তলটা পরিষ্কার করত, তেল মাখাত, একটা একটা করে বুলেট ভরতো, তারপর দেখে নিত সব ঠিক আছে কিনা। পৃথিবীর নানান জায়গায় ও হোটেলে। শেষবারের মত দেখে নিয়ে কোটের নিচে খাপে পুরতো। আয়নার সামনে দেখত দেখা যাচ্ছি কিনা। তারপর বেরিয়ে পড়ত একজনের সঙ্গে দেখা করতে…সেই একজন, যাকে হত্যা করতে হবে। সে সাক্ষাতের ফল হয় জীবন, নয় মৃত্যু। এই অস্ত্র তার কতবার প্রাণরক্ষা করেছে? কত মানুষকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছে।

M তার দিকে ফিরলেন। আমি দুঃখিত, জেমস্, বললেন তিনি, কিন্তু দুঃখিত হবার লক্ষণ দেখা গেল না। আমি জানি লোহার টুকরাটাকে তুমি কত ভালবাস। কিন্তু ওটাকে বিদায় করতেই হবে। কোন অস্ত্র ব্যর্থ হলে আর সুযোগ দিতে নেই। মানুষের ক্ষেত্রে ঐ কথাই খাটে। ডাব-জিরো। বিভাগের অনর্থক ঝুঁকি দিতে চাই না। প্রত্যেকের কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ হাতিয়ার থাকা চাই। বুঝতে পেরেছ? তোমার কাজে পিস্তলের প্রয়োজন বেশি।

বন্ড শুকনো হাসি হাসল, জানি, স্যার। ঠিক আছে তাহলে। আর কথা নয়। তোমার জন্যে খবর আছে। জামাইকার একটা ব্যাপার ঘটেছে। কর্মচারিদের গোলমাল। সেই রকম মনে হচ্ছে। এই বিষয়ে রিপোর্ট পেশ করতে হবে। ওখানে পূর্বের শরীরের উপকার ও অস্ত্রগুলো কচ্ছপ-টচ্ছপের ওপর চালিয়ে দেখতে পারবে। তোমার ছুটির দরকার। নেবে নাকি কাজটা?

বন্ড ভাবল, গত কাজে আমার ব্যর্থতার জন্যই আমাকে এখন কাজ দিচ্ছেন। ভাবছেন বিশ্বাসের মর্যাদা রাখিনি। পরখ করে দেখতে চান। মন্দ কি!

সে বলল, কাজটা সহজ মনে হচ্ছে, স্যার। সম্প্রতি জীবনটা একঘেয়ে হয়ে পড়েছে। এ কাজের যদি প্রয়োজন থাকে…মানে আপনি যদি বলেন, স্যার…।

হ্যাঁ, M বললেন, আমি সেই রকমই বলছি।

.

ছুটির দিনের কাজ

মেঘে মেঘে অন্ধকার ঘনিয়ে এল। M হাত বাড়িয়ে ডেস্কের ওপর সবুজ ঘেরাটোপ লাগান বাতি জ্বাললেন। ঘরের মাঝখানটা দেখল উষ্ণ হলুদ রঙের পুকুরের মত আর ডেস্কের চামড়া রক্তশিখায় জ্বলে উঠল।

M মোটা ফাইলটা কাছে টানলেন। বন্ড এই প্রথম সেটাকে লক্ষ্য করল। সে উল্টানো অক্ষরগুলো পড়ল। ট্র্যাংওয়েজ আবার কি করল? ট্রব্ল্যাড-ই বা কে?

M ডেস্কের একটা বোতাম টিপলেন। প্রধান কর্মসচিবকে ডেকে পাঠাচ্ছি। এ কেসের কিছুটা জানি কিন্তু ও ভদ্রলোক সব খুঁটিনাটি জানেন। ছোট ও বাজে ঘটনা।

প্রধান কর্মসচিব ঘরে ঢুকলেন। পদমর্যাদায় কর্নেল। বয়সে বন্ডের সমান। কিন্তু তার সামনের চুলে অসময়েই পাক। ধরেছে। তার শারীরিক সামর্থ্য ও রসিক মনোবৃত্তিতে বোঝা যায় তার স্নায়ু এখন ভাঙেনি। ইনিই বন্ডের প্রিয়তম বন্ধু।

একটা চেয়ার নিয়ে বসুন চীফ অফ স্টাফ। আমি 007 কে স্ট্র্যাংওয়েজের কেসে লাগিয়েছি। ওখানে নতুন লোককে লাগানোর আগে গোলমাল পরিষ্কার করতে হবে। ইতিমধ্যে 007 ঐ স্টেশনের বড়কর্তা হয়ে কাজ চালাতে পারবে। আপনি কলোনিয়াল অফিস ও গর্ভনরের সঙ্গে কথা বলে নেবেন। আচ্ছা, 007 বোধহয় স্ট্রাংওয়েজকে চিনত, বছর পাঁচেক আগে সেই গুপ্তধনের ব্যাপারে তোমরা কাজ করেছিলে। তার সম্বন্ধে তোমার কি ধারণা?

লোকটি ভাল স্যার। তবে রগচটা। ভেবেছিলাম এতদিনে তাকে অন্য কোথাও দেওয়া হয়েছে। গরমের দেশে পাঁচ বছর বড় বেশি সময়।

আর তার সহকারী, মেরী ঐরাডকে দেখেছ?

না স্যার।

মেয়েটির কাজকর্মের রেকর্ড ভাল। ছবি দেখে সুন্দরী মনে হয়। এটাই বোধহয় গোলমালের কারণ। স্ট্রাংওয়েজের মেয়েদের ওপর ঝোঁক কেমন ছিল?

ঝোঁক থাকতে পারে। কিন্তু কি হয়েছে তাদের, স্যার?

সেটাই খুঁজে বার করতে হবে। তিন সপ্তাহ আগে তারা একই সন্ধ্যায় একসঙ্গে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। এদিকে স্ট্রাংওয়েজের বাংলো পুড়ে শেষ। রেডিও, সংকেত বই, ফাইল-সব কিছু পুড়ে ছাই। মেয়েটির সবকিছু মানে তার পাসপোর্টটি পর্যন্ত ঘরে পড়েছিল। অজস্র নাম না লেখা পাসপোের্ট ছিল তার কাছে। সেই ছিল ঐ দ্বীপের পাসপোর্ট কট্রোল অফিসার। তারা যে কোন প্লেনে পালাতে পারে–ফ্লোরিডায়, দক্ষিণ আমেরিকায় বা কাছাকাছি কোন দ্বীপে। পুলিশ সব যাত্রী তালিকা পরীক্ষা করে দেখেছে। এখনও পাওয়া যায়নি। হয়ত মেয়েটা চুলের রঙ বদলেছে। ওসব বিমানবন্দরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা তেমন কড়া নয়। তাই না চীফ অফ স্টাফ

ঠিকই বলেছেন স্যার। তবে ঐ সর্বশেষ বেতার যোগাযোগের ঘটনাটা আমি এখনও বুঝে উঠতে পারছি না। বন্ডের দিকে ঘুরে, ব্যাপার হল, সেদিন জ্যামাইকায় রাত সাড়ে ছ টায় ওরা যথারীতি যোগাযোগ স্থাপন করে। রেডিও সিকিউরিটির ধারণা ঐ মেয়েটিই আমাদের পাঠানো WWW. সংকেতে সাড়া দেয় এবং পরক্ষণেই থেকে যায়। আমরা। আবার সংযোগের চেষ্টা করি, কিন্তু না। তারপর নীল ডাকে, লাল ডাকেও তাদের সাড়া পাওয়া যায়নি। ঐ পর্যন্তই।

পরের দিন সেকশন থ্রি ওয়াশিংটন থেকে ২৫৮ কে ওখানে পাঠাবার ব্যবস্থা করে। ততক্ষণে পুলিশ এসে গেছে, আর রাজ্যপাল মশাই এই ঘটনা সমস্ত চেপে দেওয়ার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছেন। তার কাছে ব্যাপারটা পানির মত পরিষ্কার। ফ্রাংওয়েজ এর আগেও নারীঘটিত ব্যাপারে পড়েছেন। ও জায়গাটা সত্যি বড় বাজে। কেচ্ছা আর ছোরার লড়াই ছাড়া আর কোন কিছু তাদের মাথায় ঢোকে না। ২৫৮ এক সপ্তাহ সেখানে থেকেও ছিটে-ফোঁটা বিরুদ্ধ প্রমাণ জোগাড় করতে পারল না। সে সেই মত রিপোর্ট পাঠায় ও আমরা ওয়াশিংটনে ফেরত পাঠাই তাকে। তারপর থেকে পুলিশ খোঁজাখুঁজি করছে কিন্তু কিছু করতে পারছে না।

প্রধান কর্মসচিব একটু থেমে ক্ষমাপ্রার্থনার ভঙ্গিতে M-এর দিকে তাকিয়ে, আমি জানি স্যার, যে আপনিও রাজ্যপালের সঙ্গে একমত। দুই প্রেমিকের পলায়ন পর্বের সঙ্গে এই ঘটনার কোন মিল নেই। আর ক্লাবে স্ট্রাংওয়েজের বন্ধুরা বলছেন যে তিনি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিলেন। বেতার যোগাযোগের সময় হতেই তিনি প্রতিদিনের মত খেলা রেখে উঠে যান। ছ টা পনেরোর সময় ক্লাব থেকে বেরিয়ে যান। তারপর আর তাকে দেখা যায়নি। তাঁর গাড়ি পর্যন্ত ক্লাবের সামনে পড়ে আছে। এখন, সত্যিই যদি তিনি মেয়েটিকে নিয়ে পালান, তাহলে ব্রিজ খেলার সঙ্গীদের হাঁ করে বসিয়ে রাখবেন কেন? সকালে অথবা বেতারের রিপোর্ট পাঠিয়ে দিয়ে, বা সব গুছিয়ে গভীর রাত্রে পালাতে পারতেন। কিছুই বুঝতে পারছি না।

M মোটা গলায় বললেন, ইয়েতে, মানে প্রেমে পড়লে লোকেরা গাধার মত কাজ করে। এছাড়া আর কি হতে পারে? কোন গণ্ডগোলের চিহ্নমাত্র নেই। খুব শান্তশিষ্ট জায়গা। প্রতিমাসে খুচরো ঘটনার বেশি কিছুই হয় না–এই ধরো এক দুটো কম্যুনিস্ট কিউবা থেকে পালিয়ে এসে দ্বীপে ঢুকতে চেষ্টা করছে, কিংবা ইংরেজ গুণ্ডারা গা ঢাকা দেবার চেষ্টা করছে। 007 ওখান থেকে আসবার পর স্ট্র্যাংওয়েজের হাতে বড় কোন কাজ এসেছে বলে মনে হয় না। যা শুনলে, তা থেকে কি মনে হয় তোমার, 007?

বন্ড বলল, স্ট্র্যাংওয়েজের ওভাবে পালানোর কোন কারণ দেখছি না স্যার। হয়তো মেয়েটার সঙ্গে একটু বেশি ঘনিষ্ট হয়েছিল কিন্তু সে কখনই এটা বেঈমানী করবে না। বড়জোর সে আর সেই মেয়েটি পদত্যাগ পত্র পেশ করত কিন্তু এভাবে আমাদের ঝুলিয়ে রাখবে বলে আমরা বিশ্বাস হচ্ছে না। আর মেয়েটির সম্বন্ধে যা শুনলাম তাতে মনে হয় আমাদের নৌবাহিনীর প্রধান অফিসারদের মাথা সহজে বিগড়োয় না।

ধন্যবাদ, 007, এসব কথা আমার মাথাতেই এসেছে। ঘটনাটার দ্বিতীয় কোন কারণ তোমার মাথায় আসছে কি?

M গা এলিয়ে হাতে পাইপ নিয়ে তামাক ভরতে লাগলেন। বন্ডকে একটা কাজের মত কিছু দেওয়া দরকার যাতে তার বিশ্রাম জড়িত থাকবে। সেজন্যেই তিনি তাকে জ্যামাইকা পাঠাতে চাইছেন। দেশলাইয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে, বলো?

বন্ড বলল, প্রথমত স্যার, দেখা যাক যে স্ট্র্যাংওয়েজ শেষ কোন কাজে হাত দিয়েছিল। সে কি কোন রিপোর্ট পাঠিয়েছিল বা সেকশন থ্রি তাকে কোন বিষয়ে খোঁজখবর করতে বলেছিল? গত কয়েক মাসে তেমন কোন ঘটনা ঘটেছে কি?

তেমন কিছু নয়। M প্রধান কর্মসচিবকে বললেন, ঠিক কিনা?

 ঠিকই বলেছেন স্যার। কেবল ঐ পাখিগুলো নিয়ে বাজে ব্যাপারটা।

অঃ ঐটে। কোন এক চিড়িয়াখানা থেকে নাকি বাজে ঝামেলা এসেছিল। কলোনিয়াল অফিস আবার ব্যাপারটা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন। সপ্তাহ দুয়েক আগে, তাই না?

তাই স্যার। তবে চিড়িয়াখানা নয়। আমেরিকার এক সমিতি, নাম অভোবন সোসাইটি। তাদের কাজ দুষ্প্রাপ্য পাখিরা যাতে অবলুপ্ত হয়ে না যায় তার ব্যবস্থা করা। মনে হয় আমেরিকায় ঐ পাখিওয়ালাদের যথেষ্ঠ ক্ষমতা আছে। তারা নাকি কয়েকটা পাখির বাসার ক্ষতি হবে বলে পশ্চিম উপকূলের এক পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার জায়গা পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছিলেন আমেরিকান সরকারকে।

M নাকে একটা আওয়াজ বার করেন। হুপিং ক্রেন বলে এক হতচ্ছাড়া পাখি। কাগজে পড়েছি।

 বন্ড তবু বলল, এ বিষয়ে কিছু জানাতে পারেন স্যার? অভোবন সোসাইটি কি চাইছিল আমাদের কাছে?

 M স্ট্র্যাংওয়েজের ফাইলটা প্রধান কর্মসচিবকে দিয়ে, আপনিই বলে দিন, চীফ অফ ষ্টাফ। ওতে সব আছে।

প্রধান কর্মসচিব বন্ডের দিকে তাকিয়ে বলল, রোজেন্ট শুনবিল নামে একরকম পাখি আছে। এখানে তার রঙিন ছবিটা গোলাপী রঙের বকের মত দেখতে। বিশ্রী চ্যাপটা ঠোঁট দিয়ে কাদা খুঁড়ে খাবার বার করে। ফ্লোরিডা ও তার আশেপাশে এদের দেখা যেত। হঠাৎ খবর পাওয়া গেল যে জ্যামাইকা ও কিউবার মাঝামাঝি ক্র্যাব কী নামক একটা দ্বীপে এই পাখিদের একটা বসতি আছে। ওটা ব্রিটিশ এলাকার মধ্যে-জ্যামাইকার অঞ্চল। এর আগে এটা গুয়ানো দ্বীপ ছিল। যখন ঐ পাখিদের সন্ধান পাওয়া গেল, অডোবন সোসাইটির লোকেরা সেখানে গিয়ে দ্বীপের একাংশের লীজ নিয়ে পাখিদের সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। সেখানে দু জন ওয়ার্ডেনকে রেখে আসেন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এবং দ্বীপের ওপর দিয়ে যাবে কোন উড়োজাহাজ উড়ে গিয়ে পাখিদের বিরক্ত না করে তার ব্যবস্থাও করেন।

ক্রমশ পাখিদের সংখ্যা বেড়ে ওঠে। ঐ দ্বীপে পাঁচ হাজার শুনবিল আছে। তারপর যুদ্ধ বাধল। গুয়ানোর দাম বেড়ে গেল। এক বুদ্ধিমান দ্বীপটিকে কিনে আবার গুয়ানোর ব্যবসা করার মতলব করলেন। পাঁচ হাজার পাউন্ডে দ্বীপ কেনেন কিন্তু শর্ত রইল যে ঐ পাখিদের কোনরকম বিরক্ত করবেন না। তখন ১৯৪৩ সাল। ভদ্রলোক কিছুদিন আগে পর্যন্তও যথেষ্ট লাভ করছিলেন। হঠাৎ গুয়ানোর দাম কমায় তাঁর ব্যবসায় অবস্থা ভাল যাচ্ছে না।

কে এই ভদ্রলোক।

 একজন চীনে, কিংবা সঠিক বলতে গেলে আধা চীনে আধা জার্মান। বিদঘুঁটে নাম ভদ্রলোকের, ডক্টর জুলিয়ান নো।

নো? ইয়েস-এর উল্টো?

হ্যাঁ।

তার সম্বন্ধে কি জানা যায়?

 কিছুই না। তিনি গোপনীয়তা পছন্দ করেন। জ্যামাইকান সরকারের থেকে দ্বীপটা কেনার পর তাঁকে আর দেখা যায়নি। বহির্জগতের সঙ্গে ঐ দ্বীপের কোন যোগাযোগ তিনি রাখতে চান না, যাতে কোন লোক ওয়ানে পাখিদের বিরক্ত না করেন। এতে আমাদের আপত্তি করার কিছুই নেই।

তা, সবই ঠিকঠাক চলছিল। হঠাৎ গত বড়দিনের আগে অডোেবন সোসাইটির ওয়ার্ডেনদের একজন, বারবাডোজ দ্বীপের শক্তপোক্ত মানুষ, নৌকায় চেপে জ্যামাইকার উত্তর উপকূলে এসে পৌঁছায়। তখন তার শেষ অবস্থা। মরবার আগে সে অদ্ভুত এক গল্প করে। এক আগুনমুখো ড্রাগন নাকি তাদের কুটির আক্রমণ করে। ড্রাগন তার সঙ্গীকে পুড়িয়ে মারে এবং কুটির জ্বালিয়ে দেয়। তারপর গর্জন করতে করতে শুনবিল পাখিদের বাসাগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঝলকে ঝলকে আগুন ছড়িয়ে পাখিদেরকে কোথায় ভাগিয়ে দিল সৃষ্টিকর্তাই জানেন। সে নিজেও খুব পুড়ে গিয়েছিল। কিন্তু কোনমতে পালিয়ে সারারাত একটা নৌকা চালিয়ে জ্যামাইকায় পৌঁছোয়।

ব্যস ঐ পর্যন্ত। অভোবন সোসাইটিকে অবশ্য নিয়মমাফিক রিপোর্ট পাঠানো হয়েছিল। তাদের দুই বড় কর্তা মায়ামি থেকে বীচক্র্যাফট বিমানে চড়ে পরিদর্শনে আসেন। দ্বীপে একটা বিমান অবতরণ ক্ষেত্র আছে। কারণ চীনে ভদ্রলোকের মালপত্র আনবার জন্য এক গ্রুম্যান অ্যামফিবিয়ান বিমান আছে।

M তেতো গলায় বললেন, এইসব লোকেদের দেখছি পাখিদের পেছনে ওড়াবার মত যথেষ্ট টাকা আছে।

বন্ড এবং প্রধান কর্মসচিব পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসল। গত কয়েক বছর ধরে ক্যারিবিয়ান স্টেশনের জন্য একটি অস্টার বিমান কেনবার কথা অর্থদপ্তরের ডিপার্টমেন্টকে বলে আসছেন।

প্রধান কর্মসচিব বললেন, বীচক্র্যাট বিমানটি মাটিতে নামবার সময় ভেঙে পড়ে এবং আরোহী দু জন মারা যান। এতে ঐ পাখিওয়ালারা আরো ক্ষেপে যান। তারা আমেরিকার ট্রেনিং স্কোয়াড্রন থেকে একটা কর্ভেট পাঠায় ডক্টর নো র সঙ্গে কথা বলে আসবার জন্য। এর থেকে বোঝা যায় ঐ সমিতির ক্ষমতা কি বিরাট। কর্ভেটের ক্যাপ্টেনকে ডক্টর নো খুব ভদ্রতার সঙ্গে অভ্যর্থনা জানান। কিন্তু গুয়ানো কারখানার ধারে কাছে তাকে যেতে দেওয়া হয়নি। তাকে নিয়ে প্লেনটার ধ্বংসাবশেষ দেখানো হয়। প্লেনটা চুরমার হয়ে গিয়েছিল তবে সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়েনি। আরোহী দু জনের মৃতদেহ সুদৃশ্য কফিনে পুরে সসম্মানে প্রত্যর্পণ করা হয়। ক্রাপ্টেন ডক্টর নো-র ভদ্রতায় খুবই মুগ্ধ হয়েছিলেন।

ওয়ার্ডেনদের কুটির দেখতে চাইলে তাকে নিয়ে গিয়ে ধ্বংসাবশেষ দেখানো হয়। ডক্টর নো-র মতে গরম ও নির্জনতার জন্য তোক দু জন ক্ষেপে গিয়েছিল। অথবা একজন ক্ষেপে অন্যজনকে কুটিরে বন্ধ করে আগুন লাগিয়ে দেয়। গত দশবছর ধরে যে ভয়ংকর পাণ্ডববর্জিত জলাভূমিতে তাদের বাস করতে হয়েছে এটা খুবই কষ্টকর ব্যাপার। তাঁকে সসম্মানে জাহাজে পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া হয় এবং তিনি বিদায় নেন।

প্রধান কর্মসচিব দু হাত প্রসারিত করে বললেন, এই পর্যন্তই জানা গেছে। তবে ক্যাপ্টেন জানান যে তিনি মাত্র কয়েকটা রোজেন্ট শুনবিল দেখতে পেয়েছেন। তাঁর রিপোর্ট পেয়ে তাঁদের ঐ হতচ্ছাড়া পাখিগুলোর উধাও হয়ে যাওয়াটাই অভোবন সোসাইটিকে সবচেয়ে বেশি ক্ষেপিয়ে তোলে। তখন থেকে তারা আমাদের খুঁচিয়ে চলেছেন। এই বিষয়ে পুরোদস্তর একটা অনুসন্ধান করবার জন্য। এইভাবেই এই বাজে ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত স্ট্রাংওয়েজের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়।

M ব্যাজার মুখে বন্ডের দিকে তাকালেন বুঝলে তো 007, আমি কি বলতে চাইছিলাম? এসব ঐ বুড়িদের সমিতির আজগুবি কল্পনাবিলাস ছাড়া কিছু নয়। লোকেরা নানারকম জিনিষ সংরক্ষণ করতে চায়-গির্জা, পুরনো বাড়ি, ক্ষয়ে আসা ছবি, পাখি ইত্যাদি। আর এসব নিয়ে হৈ-চৈও বড় কম হয় না। মুশকিল হচ্ছে, যে লোকগুলোর মাথায় এই সংরক্ষণের ব্যাপারটা এমন ঢুকে যায়, যে রাজনৈতিক মহল পর্যন্ত তারা ছোটাছুটি শুরু করে। আর টাকার অভাব তাদের কখনও হয় না। জানি না কোত্থেকে পায় এত টাকা। আর সব বুড়িদের কাছ থেকেই বোধহয়। আর তারপর এমন এক সময় আসে, যখন এদের চেঁচামেচি বন্ধ করা সত্যিই দরকার হয়ে পড়। ঠিক এই কেসটার মত। কাজটা সোজা আমার ওপর এনে ফেলা হয়েছে, তার কারণ এটা ব্রিটিশ এলাকা। আবার একই সঙ্গে ওটা একজনের নিজস্ব সম্পত্তি। সোজাসুজি নাক গলাতে কেউ চাইছে না। তাহলে আমি করবটা কি? ঐ দ্বীপের একটা সাবমেরিন পাঠাব? কি জন্য? একদল লাল বকের কি হয়েছে তা জানবার জন্য? M নাসিকাধ্বনি করলেন, যাইহোক, তুমি স্ট্রাংওয়েজের শেষ কাজটার কথা জানতে চাইছিলে। সব জানতে পেয়েছে। কড়াগলায় বললেন, কোন প্রশ্ন আছে? আমার হাতে এখন অনেক কাজ।

বন্ড হেসে ফেলল, সামলাতে পারল না। M-এর হঠাৎ-হঠাৎ রেগে যাওয়াটা ভারি মজার। আর তিনি সবচেয়ে চটে যান, যখন চোখের সামনে গুপ্তচর বিভাগের সময়, শক্তি ও অর্থ খামোখা নষ্ট হতে বসে। উঠে দাঁড়িয়ে মৃদুগলায় বলল, ফাইলটা নিতে পারি, স্যার? মনে হচ্ছে ঐ পাখিদের জন্য চারজন লোক মারা গেছে। মারা গেছে হয়ত আরো দু জন ট্র্যাংওয়েজ ও ট্ৰব্লাড। হয়ত কথাটা খুব হাস্যকর শোনাচ্ছে, কিন্তু এছাড়া আর কোন এগোবার রাস্তা নেই।

নিয়ে যাও, নিয়ে যাও, অধীরভাবে বললেন M, তাড়াতাড়ি ছুটিটা শেষ করে নাও। তুমি হয়ত লক্ষ্য করনি, পৃথিবীর বাকি অংশটাকে অনেক ঝামেলা বেধে আছে।

বন্ড হাত বাড়িয়ে ফাইলটা তুলে নিল। তার বেরেটা পিস্তল ও খাপের দিকে হাত বাড়াল। না, তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলে উঠলেন M, ওটা এখানেই থাক। আর মনে রেখ, পরের বার যখন তোমার সঙ্গে দেখা হবে, তখন দেখতে চাই যে নতুন দুটো অস্ত্রই তোমার রপ্ত হয়ে গেছে।

বন্ড M-এর দিকে তাকাল লোকটির ওপর তার ঘৃণা হল। এবং এও বুঝল M কেন তার সঙ্গে এত শক্ত ও নিচ ব্যবহার করলেন। গতবার সে মরতে মরতে বেঁচেছে, এর ওপর আবার সে এই জঘন্য আবহাওয়া থেকে বেড়াতে চলেছে। একদিক দিয়ে বন্ডকে ছোট করবার জন্যেই তাকে এই সহজ কাজে পাঠালেন।

বন্ড রেগে বলল, চেষ্টা করব স্যার। সে চলে গেল।

.

অভ্যর্থনা

আটষট্টি টন ওজনের বিশাল সুপার কনস্টেলেশন বিমান উড়ে চলেছে সবুজ ও খয়েরী ছককাটা কিউবার ওপর দিয়ে। এবার আস্তে আস্তে নিচে নামছে, জ্যামাইকা আর মাত্র একশ মাইল দূরে।

বন্ড দেখতে পেল সবুজ রঙের কচ্ছপের পিঠের মত বিরাট দ্বীপটা দিগন্তে ক্রমশ রূপ নিল। নিচে সমুদ্রের পানি। কিউবা ডীপ অঞ্চলের ঘন নীল রঙ থেকে আকাশী, তারপর সাদা হয়ে এল। অস্তগামী সূর্য আঁকাবাঁকা নদীগুলোর পানিতে অজস্র সোনালি রং ছড়িয়ে দিল। রেড ইন্ডিয়ানরা এই দ্বীপের নাম দিয়েছিল সাইমাকা –অর্থাৎ পাহাড়-নদীর দ্বীপ। জ্যামাইকা পৃথিবীর উর্বরতম দ্বীপের মধ্যে অন্যতম।

পর্বতের অপরদিক গাঢ় বেগুনী ছায়ায় ঢেকে গেছে। পোর্ট রয়্যাল লাইটহাউসের দপদপে আলোর রেশ লেগে আছে। কিন্তু এখনও ম্লান। আস্তে আস্তে বিশাল বিমানটি ফিরে এল জমির দিকে। তারপর প্লেন চলে এল ব্লু-মাউন্টেনস এর চুড়োর নিচে। নেমে এল উত্তর দক্ষিণে প্রসারিত একমাত্র রানওয়েটার দিকে। এক ঝলকের জন্য একটি রাস্তা দেখা গেল ও এক ঝক টেলিফোনের তার। পরপর দুটো নরম ঝাঁকুনি দিয়ে প্লেন সঠিক জায়গায় নেমে এল। প্রপেলার এভাবে সগর্জনে উল্টোদিকে ঘুরতে শুরু করল, প্লেনটা ধীরগতিতে এয়ারপোর্টের সাদা নিচু বাড়িতে এগিয়ে গেল।

প্লেন থেকে নেমে স্বাস্থ্য ও ইমিগ্রেশন দপ্তরের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে গরম দেশের উষ্ণ হাওয়া বন্ড বুঝতে পারল।

বন্ডের পাসপোর্টে লেখা ছিল সে একজন, আমদানি রপ্তানি ব্যবসায়ী।

 কোন কোম্পানির, স্যার?

ইউনিভার্সাল এক্সপোর্ট।

এখানে ব্যবসা না ফুর্তি করতে এসেছেন?

ফুর্তি করতে।

আশা করি আপনার সময় ভাল কাটবে, স্যার। নিগ্রো ইমিগ্রেসন অফিসার বন্ডের পাসপোর্ট ফেরত দিল।

ধন্যবাদ।

কাস্টমস্ ঘরের বাইরে এসে বন্ড দেখল বাদামী চামড়ার লোকটি দাঁড়িয়ে আছে। পাঁচ বছর আগে বন্ড তাকে যে পোশাকে দেখেছিল সম্ভবত সেই পোশাকই সে পরে আছে।

কোয়ারেল।

কেম্যান দ্বীপের লোকটি চওড়া হাসি হেসে তাকে প্রাচীন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ভঙ্গিতে সেলাম দিয়ে আনন্দ সুরে জিজ্ঞাসা করল কেমন আছেন, ক্যাপ্টেন?

বন্ড বলল, খুব ভাল আছি। একটু দাঁড়াও। আমার মালপত্র বাইরে, আসুক।

 নিশ্চয়ই হুজুর।

উপকূলবাসী অধিকাংশ লোকের মত কাস্টমস্ অফিসার কোয়ারেলকে চিনতেন। তিনি বন্ডের ব্যাগ না খুলেই তাতে চকের দাগ দিয়ে ছেড়ে দিলেন। বন্ড বেড়ার বাইরে এসে কোয়ারেলকে দেখে স্নেহের সুরে বলল, তুমি বদলাওনি কোয়ারেল। তোমার কচ্ছপ শিকার কেমন চলছে?

মন্দ নয় হুজুর, আবার তেমন ভালও নয়। বন্ডের দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে, আপনার কি অসুখ করেছিল?

 সত্যে বলতে কি, অসুখই হয়েছিল আমার। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহ তো আমি ভালই আছি। ওকথা বললে কেন?

 কিছু মনে করবেন না হুজুর। আপনার মুখে কয়েকটা যন্ত্রণার রেখা দেখতে পাচ্ছি। আগে এগুলো ছিল না।

যাকগে, সে কথা। তবে তোমার সঙ্গে শরীরচর্চা করা দরকার। আমার যতটা সুস্থ থাকা উচিত, ততটা সুস্থ আমি নই।

নিশ্চয়ই হুজুর।

তারা বহির্দ্বারের কাছাকাছি আসতেই একটা প্রেস ক্যামেরার ফ্ল্যাশগানের তীব্র শব্দ ও আলোর ঝলকানি। জ্যামাইকান পোশাক পরা একটি মেয়ে (চীনে) তার স্পীডগ্রাফিক ক্যামেরা নামাচ্ছে। তাদের সামনে এসে বলল, ধন্যবাদ, ভদ্রমহোদয়গণ। আমি দৈনিক গ্রীনার থেকে আসছি। একটা তালিকা দেখে সে বলল, আপনি মিঃ বন্ড, তাই না? তা আপনি আমাদের দ্বীপে কতদিন থাকবেন, মিঃ বন্ড?

প্রথম পদক্ষেপেই একটা বাজে ব্যাপার। তাই বন্ড বলল, অল্পদিন থাকব। আর আমার মনে হয় প্লেনের ভেতর আমার চেয়ে অনেক উঁচুদরের লোক তুমি খুঁজে পাবে।

না মিঃ বন্ড, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। আপনাকে খুব সম্ভ্রান্ত লোক বলে মনে হচ্ছে। কোন হোটেলে উঠছেন আপনি?

মার্টন ব্যাংক? বলে বন্ড সামনে এগোল।

 ধন্যবাদ, মিঃ বন্ড, আশা করি এখানে আনন্দেই…

তারা বাইরে এসে বন্ড কোয়ারেলকে বলল, এর আগে মেয়েটিকে কি এয়ারপোর্টে দেখেছ?

মনে হয় না দেখেছি কখন, তবে ঐ গ্রীনার কাগজওয়ালাদের অনেক মেয়ে আছে যারা ফটো তোলে।

বন্ড কেমন যেন অজানা কারণেই চিন্তিত হল। তার ছবি খবরের কাগজে কোন প্রয়োজন নেই।

তারা গাড়ির কাছে গেল। গাড়িটা কালো রঙের সানবীম অ্যালপাইন। বন্ড গাড়ির নম্বরটা দেখে বুঝল গাড়িটা ট্র্যাংওয়েজের। ব্যাপার কি? কোয়ারেলকে সে বলল, এটা কোত্থেকে জোটালে?

আমাকে এ-ডি-সি ((ADC-রাজ্যপালের পার্শ্বচর) সাহেব নিতে বললেন। কেন, গাড়িটা বুঝি আপনার পছন্দ হচ্ছে।?

না, সে কিছু না। ঠিক আছে। চল এখন?

বন্ড পেছনের সীটে গিয়ে বসল। তার আগেই ভাবা উচিত ছিল যে এই গাড়িটাই তার দিকে স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেবে যে সে জ্যামাইকাতে এসেছে কেন, কি সে করতে চায়।

দুধারে ফনীমনসা গাছের সারি–দূরে কিংসটনের আলো দেখা যাচ্ছে। অন্য কিছু ব্যাপার না থাকলে বন্ড এই সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য ভাল করে উপভোগ করতে পারত। বন্ড ভাবছিল তার এখন কি করা উচিত আর কি কি তার করা উচিত ছিল না।

সে যা করেছিল তা হল এই যে, সে গভর্নরকে কলোনিয়াল অফিসের মাধ্যমে একটা সাংকেতিক বার্তা পাঠিয়েছিল। এতে সে বলেছিল যে এ-ডি-সি যেন কোয়ারেলকে কেম্যান দ্বীপের থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য আনিয়ে নেয় এবং সপ্তাহে দশ পাউন্ড বেতন দেয়। কোয়ারেলের সঙ্গে আগে জ্যামাইকায় কাজ করেছিল, লোকটি কাজকর্মে তুলনাহীন। কেম্যান দ্বীপের সব কিছুই তার জানা। কালো লোকেদের জীবনের নিচের তলায় এর অবাধ প্রবেশ। বন্ড জানত স্ত্রাংওয়েজের ব্যাপারে এগুতে হলে তার সাহায্যের বিশেষ প্রয়োজন।

বন্ড চেয়েছিল ব্লু-হিল হোটেলের একটা ছোট ঘর নিজের জন্য। আর একটা গাড়ি সেটা কোয়ারেল যেন চালিয়ে এয়ারপোর্টে নিয়ে যায়। এসবের অনেক কিছুই তার করা উচিত হয়নি। তাহলে সে অন্য গাড়ি নেবার কথা ভাবতে পারত।

এখন তার এখানে আসাটা আর গোপন রইল না। গ্রীনার –এ যদি তার আসার কথাটা চাপা হত এর চাইতে খারাপ কিছুই হত না। কোন একটা অনুসন্ধানের ব্যাপারে প্রথম ভুলটাই শেষ পর্যন্ত মারাত্মক হয়ে দাঁড়ায়। আর শত্রুরা সেই ভুলের সুযোগ নেয়। কিন্তু এখানে শত্রু কোথায়? সে কি বেশি সাবধান হচ্ছে না?

হঠাৎ কি ভেবে সে সীটের ওপর ঘুরে বসল। একশ গজ দূরে একটা গাড়ির আলো। বন্ড ঘুরে বলল, কোয়ারেল, প্যালিসাডোগ-এর শেষে, যেখানে বা দিকে রাস্তাটা ভাগ হয়ে গেছে কিংসটনের দিকে, আর ডান দিকে গেছে মরান্ট এর দিকে, তুমি সেখানে গিয়ে আর সেখানেই চট করে মরান্টের দিকে গাড়ি মোড় নিয়ে থামাবে আর আলো নিবিয়ে অপেক্ষা করবে। ঠিক আছে? এবারে দারুণ জোরে গাড়ি চালাও।

কোয়ারেল খুশির সুরে বলল, ঠিক আছে ক্যাপ্টেন।

পাঁচশো গজ গেলেই মোড় এসে যাবে। বন্ড পেছনে তাকাল, গাড়িটার কোন পাত্তা নেই। এবারে সাইনপোস্ট এসে গেল। কোয়ারেল ঐ দ্রুত চলার মধ্যেই গাড়িটা ঘুরিয়ে নিল। রাস্তার পাশে এসে গাড়িটা থামিয়ে আলো নিবিয়ে দিল। বন্ড একটু অপেক্ষা করার পরই শোনা গেল সেই বড় গাড়িটার দ্রুতগতির গর্জন। আলো এসে ঝলকানি দিল, তাদের। খুঁজছে আলোটা। তারপর চলে গেল কিংসটনের দিকে। বন্ড ওরই মধ্যে দেখে নিল গাড়িটা আমেরিকার বড় ট্যাকসির মত। গাড়িতে ড্রাইভার ছাড়া অন্য কেউ ছিল না। তারপরেই আর দেখা গেল না গাড়িটাকে।

দশ মিনিট পর বন্ড কোয়ারেলকে বলল গাড়িটাকে কিংসটনের দিকে নিয়ে যেতে। মনে হয় আমাদের খুঁজছিল গাড়িটা। একটু চোখ খোলা রেখ, ওকে বোকা বানিয়েছি বুঝতে পেরে সে আমাদের জন্য কোথায়ও ওৎ পেতে থাকতে পারে।

হা ক্যাপ্টেন ঠিকই বলেছেন।

এবারে তারা কিংসটনের গাড়ির স্রোতের মধ্যে বাস, মোটরগাড়ি, ঘোড়ায় টানা গাড়ি, বড় বড় ঝুড়ি নিয়ে গাধার দল, তাছাড়া নানারকমের ঠেলাগাড়ি, পেছনে অনেক গাড়ি, তাদের মধ্যে যে কোনটাই সেই আমেরিকান ট্যাকসি হতে পারে। সোয়া এক ঘণ্টা তারা ঐভাবে চলল–হ্যাফওয়ে ট্রি পর্যন্ত। তারপর গেল জংশন রোডের দিকে। তারপরই দেখা গেল একটা নিয়ম আলোয় আঁকা সবুজ তালগাছের ছবি, তার তলাতেই লেখা রু হিলস্ শ্রেষ্ঠ হোটেল বলতে এটাই। তারা হোটেলে ঢুকে গেল।

উপরের দিকে একশ গজ দূরে কালো ট্যাকসিটার ড্রাইভার অন্য সব গাড়িকে সাবধান করে বাঁ দিকে মোড় ঘুরল। তারপর একেবারে ঘুরিয়ে দিল কিংসটনের দিকে গাড়িটাকে।

ব্লু হিলস্ হোটেলটা পুরোনো আমলের, বেশ আরামেই থাকা যায় এখানে। বন্ডকে হোটেলের লোকেরা সবাই ভক্তিভরে অভ্যর্থনা করল কারণ ওর ঘরটা রিজার্ভ করেছিল রাজবাড়ি থেকে। তার ঘরটা ছিল বারান্দা সমেত এক কোণে। বারান্দা থেকে দেখা যায় দূরের বন্দরের দৃশ্য। খুশি হয়ে সে পোশাক ছেড়ে শাওয়ারের নিচে দাঁড়াল। পাঁচ মিনিট ধরে পরিষ্কার হল। তারপর আইল্যান্ডের ছোট প্যান্ট পরে নিল। সব জিনিস গুছিয়ে ওয়েটারকে ডাকল।

বন্ড বড় একটা গ্লাসে জিন আর টনিক আনতে বলল, সঙ্গে পুরো একটা লেবুর রস। লেবুর রস বের করে গ্লাসের প্রায় সবটাই ভরিয়ে ফেলল বরফ টুকরো দিয়ে। তারপর টনিক ঢেলে দিল। পানীয়টা নিয়ে সে বারান্দায় গেল। ভাবল হেড কোয়ার্টার থেকে দূরে থাকার আনন্দ আছে। তার মন বলছে যে এবারের কাজটা বেশ শক্ত গোছের হবে।

রাস্তাটা যেখানে সমুদ্র থেকে বেঁকে অন্যদিকে গেছে সেখানে উজ্জ্বল সোনালি রঙের নিয়ন আলোয় একটি স্পেন দেশের প্রাচীন জাহাজ আঁকা। তার উপর সবুজ আলোয় লেখা–দি জয় বোট। তারা মোটর গাড়ি রাখবার জায়গায় এল। গাড়ি থামানোর পর কোয়ারেলের পেছন পেছন বন্ড গেটের ভিতর দিয়ে এল। সেখানে একটা ছোট তাল বাগান। তারপরেই সমুদ্রের ধার। তালগাছের তলায় প্রচুর টেবিল পাতা রয়েছে। ঠিক মাঝখানে নাচের জায়গা, তার এক কোণে তিনজন ক্যালিপসো নাচছে।

অর্ধেক টেবিলে লোক, অধিকাংশই কালো। কয়েকজন আমেরিকান আর ইংরেজ নাবিক তাদের মেয়েদের নিয়ে বসে আছে। দারুণ মোটা একজন নিগ্রো সাদা ডিনার জ্যাকেট পরে বসেছিল। সে এসে সামনে দাঁড়াল।

এই যে মিস্টার কিউ, বহুদিন দেখা সাক্ষাৎ নেই। দু জনের জন্য ভাল টেবিল চাই?

ঠিক বলেছ অক্টোপাস ভায়া, গান বাজনার চাইতে রান্নাঘরের কাছাকাছি হলেই ভাল হয়।

বড় চেহারার লোকটি তাদের সমুদ্রের দিকে একটা শান্ত পরিবেশে তাল গাছের তলায় বসিয়ে দিল। তালগাছটা একেবারে রেস্তোরাঁর বাড়ির ভিত থেকে বেরিয়েছে। কিছু পানীয় চাই কি?

বন্ড চাইল তার প্রিয় জিন এবং টনিক, সঙ্গে একটা লেবু, আর কোয়ারেল নিল একটা রেড স্ট্রাইপ বীয়ার। আর বলল, বড় চিংড়ির একটা রান্না, ঝলসানো স্টেক আর ওখানকার কিছু সবজি। পানীয় এল।

কোয়ারেল বলল, ঐ অক্টোপাস ভায়া আমার বন্ধু। লোকটা বড় ভাল। প্রিন্সটনে কি সব হচ্ছে তার সব খবরাখবর ওর জানা। আমাদের দুজনের একটা নৌকা ছিল একসময়ে। তারপর একদিন সে ক্র্যাবৃ-কীতে বুঝি হাঁসের ডিম সংগ্রহ করতে গেল। সে সাঁতরিয়ে একটা পাথরের দিকে গেছে আরো ডিম পাবার আশায়। এমন সময় বিরাট একটা অক্টোপাস তাকে আক্রমণ করে। ঐ অক্টোপাসটা ছিল বিরাট। অক্টোপাস ভায়ার সঙ্গে এই জন্তুটার মোলাকাত হওয়াতে তাকে বেশ কষ্ট পেতে হয়। নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার সময় একটা ফুসফুস ফেসে যায়। সেই থেকে তার ওসব কাজে যাবার সাহস হয় না। নৌকার অর্ধেক অংশ বেচে আমাকে দিয়ে সে কিংসটনে চলে যায়। সে যুদ্ধের আগের কথা। এখন ও হচ্ছে বড়লোক আর আমি এখন মাছ ধরেই চলেছি।

বন্ড বলল, ক্র্যাব-কী জায়গাটা কেমন?

কোয়ারেল তার দিকে ধারাল দৃষ্টিতে তাকাল। জায়গাটা এখন দারুণ অলক্ষুণে, ক্যাপ্টেন। এক চীনে ভদ্রলোক যুদ্ধের সময় জায়গাটা কিনে নেয়, তারপর লোকজন নিয়ে এসে পাখির নোংরা খুঁড়তে শুরু করে। কাউকে ঐ জায়গায় যেতে দেয় না, নামতেও দেয় না।

কেন?

লোকটার অনেক পাহারাদার। বন্দুক, মেশিনগান রাডার এমনকি বিমানও আছে। আমার কিছু বন্ধু ঐ জায়গায় গিয়ে আর ফেরেনি। ঐ চীনেটা কাউকে ওখানে যেতে দেয় না, এটাই হচ্ছে আসল কথা। জায়গাটাতে আমার দারুণ ভয়, ক্যাপ্টেন।

বন্ড চিন্তিতভাবে বলল, তাই নাকি, তাই নাকি? খাবার এল। তারা আবার এক পাত্র করে মদ খেয়ে খাবারে মন দিল। খেতে খেতে বন্ড স্ট্র্যাংওয়েজ-এর সম্পর্কে মোটামুটি সংক্ষেপে সব বলল। কোয়ারেল মন দিয়ে সব শুনল। ক্র্যাব-কীর পাখিদের সম্বন্ধে তার জানবার আগ্রহ বেশি দেখা গেল। বিমান ভাঙা সবই সে-আগ্রহের সঙ্গে শুনল। একটু সামনের দিকে ঝুঁকে বেশ আস্তে আস্তে বলল সে, ক্যাপ্টেন, আমি জানি না ওখানে পাখি ছিল, কি মৌমাছি ছিল, কি প্রজাপতি ছিল। ক্র্যাব-কীতে কম্যান্ডার সাহেব নাক গলাতে গিয়েছিলেন বলেই ওকে ওরা খতম করেছে, আমি সর্বস্ব বাজী রেখে বলতে পারি। ওকে আর ওঁর মেয়ে বন্ধুকে দু জনকে ওরাই শেষ করেছে।

বন্ড খুব নিবিষ্টভাবে তাকিয়ে বলল, তুমি এত নিশ্চিত হলে কি করে?

 ঐ চীনে ম্যানটা একা থাকতে ভালবাসে–কেউ তাকে বিরক্ত করুক তা সে চায় না। ও জায়গায় যাতে কেউ না যেতে চায় সেজন্য আমার বন্ধুদের খুন করেছে। লোকটার দারুণ ক্ষমতা, ওখানে যে যাবে ও তাকেই মারবে।

কেন?

 ঠিক কারণটা জানি না ক্যাপ্টেন। দুনিয়ার হরেক রকম লোক হরেক রকম জিনিস চায়–আর যে তার জন্য বেশি চেষ্টা করে সে তা পায়।

বন্ড একটা আলো দেখে চট করে মাথা ঘোরাল। সেই চীনে মেয়েটি এখন খুব আঁটসাঁট পোশাক পরেছে। একটা কালো সাটিনের পোশাক। তার হাতে একটা লাইকা ক্যামেরা।

বন্ড বলল, মেয়েটাকে ধর।

দু পা এগিয়ে কোয়ারেল তার সামনাসামনি হয়ে হাত বাড়িয়ে দিল। মেয়েটি হেসে লাইকা থেকে হাত সারিয়ে কোয়ারেলের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করল। সঙ্গে সঙ্গে কোয়ারেল ঐ অবস্থাতেই ঘুরে মেয়েটির পেছন দিকে চলে গেল ব্যালে নাচের ভঙ্গিতে। এখন মেয়েটির হাত তার পেছনে, নিতান্তই বেকায়দায়।

মেয়েটি বলল, ওরকম কোরো না, আমার লাগছে।

কোয়ারেল বলল, আমার হুজুরের ইচ্ছে তুমি আমাদের সঙ্গে কিছু পান কর।

 বন্ড সেই সুন্দর, রাগে আগুন মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, এখানে তুমি কি করছ? আবার আমার ছবি তুলছ কেন?

আমি রাত্রিতে যে সব জায়গা সরগরম হয়, সে সব জায়গার ছবি তুলছি। তোমার প্রথম ছবিটা তুলেছিলাম সেটা ওঠেনি। তোমার ঐ লোকটিকে এখান থেকে যেতে বল।

তুমি গ্রীনার-এ কাজ কর? নাম কি তোমার?

 বলব না।

 বন্ড কোয়ারেলের দিকে তাকিয়ে ভুরু কোঁচকালো।

কোয়ারেলের চোখ ছোট হয়ে এল। মেয়েটার পেছনে তার হাতটাকে সে আস্তে ঘোরাল। একটা ঈল মাছের মত মেয়েটা ছটফট করতে লাগল। কোয়ারেল তবু পেঁচিয়েই চলে। হঠাৎ মেয়েটি জোরে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, উঃ বলছি। অ্যানাবেল চুং।

বন্ড কোয়ারেলকে বলল, অক্টোপাস ভায়াকে একবার খবর দাও।

কোয়ারেল একটা কাঁটা তুলে নিয়ে একটা গ্লাসের গায়ে ঠং করে আওয়াজ করতে বড় নিগ্রোটা এল।

বন্ড তার দিকে তাকিয়ে বলল, মেয়েটিকে এর আগে কখনো দেখেছেন নাকি?

 হ্যাঁ, দেখেছি। ও মাঝে মাঝে এদিকে আসে। মেয়েটি কি বিরক্ত করছে নাকি? ওকে কি চলে যেতে বলব?

না, আমরা ওকে পছন্দ করেছি। ও আমার একটা ছবি তুলতে চায়, কিন্তু মেয়েটি কেমন ছবি তোলে জানি না। ওকে টাকা দেবার আগে জানা দরকার অ্যানাবেল চুং গ্রীনার এ কাজ করে কিনা। একটিবার টেলিফোন করুন না, যদিও সত্যিই কাজ করে তাহলে হয়ত ভালই ছবি তোলে।

লোকটা বলল, নিশ্চয়ই কর্তা। বলে চলে গেল।

 বন্ড মেয়েটিকে বলল, তুমি ঐ লোকটিকে কেন বললে না তোমাকে রক্ষা করতে? বন্ড আবার বলল, তোমাকে এরকম চাপ দেবার জন্যে দুঃখিত। কিন্তু লন্ডনের এক্সপোর্ট বলে দিয়েছে কিংসটন বহু চোর জোচ্চোরের আড়া। তুমি ওসবের কিছু না জান, কিন্তু তুমি আমার ছবি নিতে চাও কেন?

আমি তো আগেই বলেছি আমার চাকরিই ঐ।

অক্টোপাস ভায়া এসে বলল, না, মিথ্যে নয়-অ্যানাবেল চুং ওদেরই একজন। ফ্রীল্যান্সে কাজ করে থাকে, বলল ও খুব ভাল ছবি তোলে। ওর সঙ্গে তোমার জমবে। অক্টোপাস ভায়ার কোন কথা বিশ্বাস হল না, হু, ছবি তোলে না ছাই। বিছানাতেই তোমাকে বেশি মানায়।

বন্ড বলল, ধন্যবাদ। নিগ্রোটি চলে গেল। বন্ড মেয়েটিকে বলল, ফ্রি ল্যান্স, হু! কিন্তু তাতে তো বোঝা গেল না। আমার ছবি কে চায়? বল এবারে ঠিক কথা।

না। মেয়েটি বিরক্তির স্বরে বলল।

বেশ তো। কোয়ারেল, চালাও তোমার ওষুধ।

কোয়ারেলের ডান দিকের কাঁধ আস্তে আস্তে নামাতে লাগল তাতে মেয়েটির হাতে আরো চাপ পড়তে লাগল। মেয়েটি হঠাৎ কোয়ারেলের চোখে থুথু ফেলল। কিন্তু কোয়ারেল আরো জোরে হাতটা মোচড়াতে লাগল। মেয়েটি চীনে ভাষায় কি সব বলে টেবিলের তলায় পা দিয়ে লাথি মারতে লাগল।

বন্ড বলল, বল না, তোমার কোন ভয় নেই। তারপর তোমার সঙ্গে ভাব করে আমরা একসঙ্গে শরবত-টরবত খাব না হয়। বন্ডের দুর্ভাবনা হচ্ছিল। মেয়েটির হাত প্রায় ভাঙার কাছাকাছি। এই! হঠাৎ মেয়েটির বা হাত উঠে গেল কোয়ারেলের মুখের ওপর। বন্ড এত তাড়াতাড়ি থামাতে পারল না। কি রকম একটা আলো দেখা গেল আর প্রচন্ড এক বিস্ফোরণের আওয়াজ শোনা গেল। বন্ড তার হাত টেনে নামাল। কোয়ারেলের গাল থেকে রক্ত ঝরছে। টেবিলের ওপর গ্লাস আর ধাতুর ধাক্কা লাগার আওয়াজ–মেয়েটি ফ্ল্যাশ বাল্বটি কোয়ারেলের মুখে ফাটিয়েছে। কোয়ারেল রক্ত দেখে আনন্দিত স্বরে বলল, চমৎকার। এ মেয়েটির কাছ থেকে এভাবে কিছু খবর পাওয়া যাবে না–দারুণ শক্ত মেয়ে। ওর হাত কি ভেঙে দেব?

কি সর্বনাশ, না! একে যেতে দাও। বন্ড মেয়েটির হাত ছেড়ে দিল। বন্ড বুঝতে পারল ঐ দলের পেছনে যিনিই থাকুন না কেন তিনি তার দলকে বেশ কঠিন শাসনে রাখেন।

মেয়েটি চট করে উঠে দাঁড়াল। তারপর টেবিল থেকে পিছিয়ে গেল খানিক, প্রচণ্ডাগের সঙ্গে ফিসফিসিয়ে বলল, সে তোদের শেষ করবে–খচ্চরের দল। তারপর সে ক্যামেরা দোলাতে দোলাতে অদৃশ্য হয়ে গেল।

.

ঘটনা তথ্য

পরের দিন বন্ড যখন বারান্দায় বসে খুব ভালভাবে ব্রেকফাস্ট খাচ্ছিল আর দেখছিল পাঁচ মাইল দূরের কিংসটনকে, তখনো তার মাথায় ঘুরছে কথাগুলো, সে তোদের শেষ করবে–খচ্চরের দল। …সে তোদের…

এখন বন্ড নিশ্চিত স্ট্র্যাংওয়েজ আর মেয়েটিকে খুনই করা হয়েছে। কেউ তাদের কার্যকলাপ সম্বন্ধে আর বেশি কিছু জানতে না পারে সেজন্যেই তাদের খুন করে তাদের ঐ বিষয়ের সমস্ত লেখা নষ্ট করে দিয়েছে। ঐ একই লোক হয় জানত, নয়ত সন্দেহ করেছিল যে গুপ্তচর বিভাগ এ ব্যাপারে খোঁজ খবর করবে। সে জানতে পেরেছে বন্ডকে এই কাজের ভার দেওয়া হয়েছে। তাই বন্ডের ছবি আর হোটেলের নাম জানা তাদের প্রয়োজন আছে।

বন্ড ভাবল এই চুং মেয়েটিকে যা করা হয়েছে তা শুনলে সে কি ভাববে? সে ধরে নেবে বন্ড কোন এক ব্যাপারে লিপ্ত আছে। হতে পারে খুন হবার আগে স্ত্রাংওয়েজ লন্ডনে একটি প্রাথমিক রিপোর্ট পাঠিয়েছিল কিংবা সে হয়ত বন্ড এবং কোয়ারেলের জীবন শেষ করবে।

বন্ড পাঁচ বছর পর প্রথম রয়্যাল ব্র্যান্ড সিগারেট ধরাল। ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে বন্ড শক্রর কথা ভাবতে লাগল। কিন্তু শত্রুটা কে?

মাত্র একজনই হতে পারে। কিন্তু তেমন কিছু এখন তার বিরুদ্ধে পাওয়া যায়নি। ডক্টর জুলিয়ান নো, সেই জার্মান চাইনিজ, যিনি ক্র্যাব-কীর মালিক, যিনি গুয়ানো বেচে লাল হয়েছেন। এর বিরুদ্ধে কোন কিছুই পাওয়া যায় না। রেজিয়েণ্ট শুনবিলের ব্যাপার। আর অভোবন সোসাইটির সঙ্গে গোলমালে কিছু ভাবা যায়নি–M যাকে বলেছিলেন, কতকগুলো লালমুখো বক নিয়ে বুড়িদের হৈ-চৈ। ঐ বকের ব্যাপারে চারজন মারা পড়েছে। আর তার চেয়েও বড় কথা হল, কোয়ারেল ডক্টর নো এবং ঐ দ্বীপকে দারুণ ভয় পায়। ব্যাপারটা বড়ই অদ্ভুত। সে সহজে কোন ব্যাপারে ঘাবড়ায় না। আর তাছাড়া ডক্টর নো র এই গোপনীয়তার ব্যাপারে এত পাগলামিই-বা কেন? গুয়ানো হচ্ছে পাখির মল। কার ঐ নোংরার প্রয়োজন? কতই বা তার দাম? বন্ডের সঙ্গে গভর্নর-এর দশটায় দেখা করার কথা। ওখানে। হাজিরা দিয়ে কলোনিয়াল সেক্রেটারিকে পাকড়াও করে এ ব্যাপারে যতখানি সম্ভব জানতে হবে।

দরজায় দু বার টোকা পড়ল। বন্ড উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল। কোয়ারেল এসেছে–তার বা গালে জলদস্যুদের কায়দায় প্লাস্টার করা। গুডমর্নিং ক্যাপটেন, আপনি বলেছিলেন সাড়ে-আটটায়…

হ্যাঁ, বেশ ভাল হয়েছে। আজ আমাদের অনেক কাজ। সকালের খাওয়া-দাওয়া ঠিকমত হয়েছে?

 হ্যাঁ, বেশ খাসা খেয়েছি–লবাণাক্ত মাছের সঙ্গে রাম।

 সর্বনাশ সকালেই রাম?

বড় আরাম দেয়।

বন্ড বলল, এখন আমি দিনের বেশির ভাগ সময়ই রাজবাড়িতে কাটাব। জ্যামাইকা ইনস্টিটিউটে কিছু সময় থাকতে পারি। কাল সকালের আগে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হচ্ছে না। কিন্তু শহরে তোমার কিছু কাজ করবার আছে। আপত্তি নেই তো?

না, ক্যাপ্টেন, আপনি যা বলবেন।

প্রথম কথা হল, আমাদের ঐ গাড়িটাকে আর ব্যবহার করতে চাই না, ওটা চেনা গাড়ি। এটাকে বাতিল করে অন্য একটা গাড়ি ভাড়া করতে হবে। সেলুন গাড়ি চাই–একমাসের জন্য। ঠিক আছে। তারপর ঐ পানির ধারে খুঁজে দেখ আমাদের দু জনের মত চেহারার কাছাকাছি কোন লোক পাওয়া যায় কিনা। তাদের একজনের গাড়ি চালাতে জানা চাই। ওদের জন্যে আমাদের মত পোশাকও কিনে দিও আর টুপিটা ও আমাদের মত হবে। তার একটা গাড়ি মন্টেগোতে নিয়ে যাবে সকালে-স্প্যানিশ টাউনের ভেতর দিয়ে, অকো রিয়স রোড দিয়ে। সেখানে লেভির গেরাজের গাড়ি রাখতে হবে। লেভিকে বলে দিও যে একটা গাড়ি সেখানে যাবে। ঠিক আছে?

কোয়ারেল হেসে বলল, কাউকে ফলো করতে চান নাকি?

হ্যাঁ। তারা এজন্য প্রত্যেকে দশ পাউন্ড করে পাবে। তাদের বল যে আমি একজন বড়লোক আমেরিকান আর আমি আমার গাড়ি মন্টেগোতে নিয়ে যেতে চাই খুব দ্র চেহারার দু জন লোককে দিয়ে। তাদের এমনভাবে বুঝবে যেন আমার মাথাটা একটু খারাপ। তারা যেন সকাল ছ টায় এসে উপস্থিত হয়। তুমিও আসবে, অন্য গাড়িতে। এসে ওদের ভাল মত দেখে শুনে ঠিকঠাক করে পাঠিয়ে দেবে-ঠিক আছে?

ঠিক আছে ক্যাপ্টেন।

 আচ্ছা, আমরা আগে যে বাড়িতে ছিলাম নর্থ শোর এ সেবার, মর্গ্যান হারবারে, বো ডেজার্ট যার নাম, ওটা কি ভাড়া পাওয়া যেতে পারে?

জানি না ক্যাপ্টেন। জায়গাটা টুরিস্টদের যাতায়াতের পথের বাইরে, তাই ভাড়াটা বেশিই নেয়।

তা নিক। তুমি গ্ৰেহ্যাম অ্যাসোসিয়েটস্ এর কাছে গিয়ে জায়গাটা মাসখানেকের জন্য ভাড়া নেবার চেষ্টা কর। ওটা না পেলে ওর কাছাকাছি একটা বাংলো বাড়ি চাই। খরচের কথা ভেব না। ভাড়া দিও, চাবি নিয়ে নিও এবং আমি ধনী আমেরিকান নাম মিস্টার জেমস্। আরো কিছু জানতে চাইলে তা টেলিফোনে বলতে পারি। বন্ড পকেট থেকে একতাড়া নোট বার করে কোয়ারেলকে দিয়ে বলল, এতে দুশো পাউন্ড আছে। যদি আরো লাগে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করো।

ধন্যবাদ ক্যাপ্টেন। কোয়ারেল অতগুলো টাকা নিয়ে তার নীল শার্টের ভেতরের পকেটে রাখল এবং সব বোতাম আটকে দিল, আর কিছু বলবেন হুজুর?

না আর কিছু নয়, তবে দেখ কেউ যেন তোমাকে অনুসরণ না করে। গাড়িটা অন্য জায়গায় রেখে হেঁটে এসব জায়গায় যাবে। কাছাকাছি চীনেদের কাউকে দেখতে পেলে তাদের ভাল করে লক্ষ্য করবে। কাল সকালে সোয়া ছটায় তুমি আমার কাছে আসছ, আর আমরা নর্থ কোস্ট-এ যাচ্ছি। ওখানে কিছুদিন আমাদের ডেরা বাঁধতে হবে।

ঠিক আছে ক্যাপ্টেন। বলে চলে গেল।

আধঘণ্টা পর বন্ড একটা ট্যাক্সি নিয়ে রাজবাড়ির দিকে চলল। ঠাণ্ডা ঘরে যে গভর্নরের খাতা থাকে তাতে সে সই করল না। তারপর গভর্নরের দেহরক্ষী এসে তাকে নিয়ে চলল গভর্নরের কাজ করবার ঘরে। দোতলায়।

ঘরটা বেশ বড়, ঠাণ্ডা, আর চুরুটের গন্ধে ম-ম করছে। অ্যাকটিং গভর্নর একটা মেহগিনি কাঠের ডেক্সের পেছনে বসেছেন। ডেস্কের ওপর গ্লীনার। টাইমস উইকলি, আর একপাত্র হিবিসকাস ফুল। তার হাত ডেস্কের ওপর। বয়স ষাটের কাছাকাছি। মুখখানা লালচে আর বেশ মেজাজী। ভদ্রলোক বললেন, অভিবাদন-মিস্টার–কি যেন, ভুলে যাচ্ছি ও বন্ড। বসুন

বন্ড একটা চেয়ার নিয়ে গভর্নরের সামনে বসে, অভিবাদন জানান। তার এক বন্ধু আগেই বলেছিল কলোনিয়াল অফিসে তাকে বেশ ঠাণ্ডাভাবে অভ্যর্থনা করা হবে। বলেছিল, ভদ্রলোকের চাকরির মেয়াদ আর বেশিদিন নেই। এর আগে যিনি ছিলেন, সেই স্যার হিউ ফুটের যখন পদোন্নতি ঘটল তখন তাকে নিয়োগ করা হয়েছে। অন্য একজন গর্ভনর এলেই তাঁর কাজ খতম। এর এখন একমাত্র আশা রিটায়ার করবার পর লন্ডনে কোন ব্যাংকে বা কোথাও একটা ডিরেক্টর হয়ে থাকা। জ্যামাইকার কোন গোলমালের মধ্যেই তিনি যান না। তিনি স্ট্রাংওয়েজ-এর ব্যাপারটা নিয়ে যাতে অনুসন্ধান না হয় সে চেষ্টা করেছিলেন। এ ব্যাপারে আপনার আগ্রহ ঠিক পছন্দ হবে না।

গভর্নর গলা খাকারি দিয়ে বললেন, আপনি কি আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে চাইছিলেন?

কেবলমাত্র হাজিরা দেবার জন্যে। স্ট্র্যাংওয়েজের কেস নিয়ে আমি এখানে এসেছি। আমার বিশ্বাস আপনি সেক্রেটারি অফ স্টেট-এর কাছ থেকে সংকেতবার্তা পেয়েছেন।

সংকেত বার্তাটা আমার মনে আছে। আমি আপনার জন্যে কি সাহায্য করতে পারি বলুন তো। ওর সম্পর্কে আমাদের সবকিছু জানা তাই কোন গুরুত্ব নেই।

কথাটা একটু বুঝিয়ে বলবেন?

গভর্নর একটু অমোলায়েম সুরে বললেন, মেয়েটির প্রতি স্ট্র্যাংওয়েজ একটু বেশি মাত্রায় বোকার মত কাজ করেছিল। আপনার দলের কেউ কেউ মেয়েদের সঙ্গে না মিশে থাকতে পারে না। লোকটিকে এর আগেও এই সব মহিলাঘটিত ব্যাপার থেকে উদ্ধার করতে হয়েছে। এরকম করলে কলোনির মঙ্গল হয় না বুঝলেন কিনা মিস্টার কি যেন বলে…ও হ্যাঁ বন্ড। আশা করি আপনাদের তরফ থেকে অতঃপর একটু ভাল জাতের লোককে পাঠাবেন, অবশ্য যদি…। ভদ্রলোক বেশ ঠাণ্ডাভাবে বললেন, অবশ্য যদি এখানে রীজিওন্যাল কন্ট্রোল ম্যান-এর প্রয়োজন থাকে। আমার তো পুলিশের ওপর পুরো আস্থা আছে।

বন্ড বলল, আমি আপনাদের মতামত রিপোর্টে পাঠাব। আমি আশা করি আমার কর্তা এ ব্যাপার নিয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এবং সেক্রেটারি অফ স্টেটের সঙ্গে আলোচনা করবেন। স্বভাবতঃই আপনি যদি এ ব্যাপারে দায়িত্ব নিতে চান তাহলে তো ভালই হয়। জ্যামাইকার পুলিশবাহিনী, আমার মতে, তারা কাজে বেশ পটু।

গভর্নর বন্ডের দিকে একটু সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, এই কথাবার্তা যা বলছি তা নিজেদের মধ্যেই বলছি, মিস্টার বন্ড। ইতিমধ্যে আপনি কি আমার লোকেদের মধ্যে কারুর সঙ্গে দেখা করতে চান?

আমি একবার কলোনিয়াল সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলতে চাই। সত্যি? কেন তা আমাকে বলবেন কি?

ক্র্যাব-কীতে কিছু গোলমাল হয়েছে। পাখিদের থাকবার জায়গাটা নিয়ে। কলোনিয়াল অফিস থেকে ব্যাপারটা আমাদের কাছে পাঠিয়েছে অনুসন্ধানের জন্য। আমার কর্তা এ ব্যাপারে খোঁজখবর করতে বলেছেন।

গভর্নর বললেন, অবশ্য, অবশ্য। আমি মিস্টার প্লেডেল স্মিথকে এখুনি আপনার সঙ্গে দেখা করতে বলছি। ওর সমাধান বোধহয় আপনা আপনিই হয়ে যাবে? তবে আমার মনে হয় ঐ কেসটা আবার ঘাড়ে চাপবে শীগগিরই।

তিনি বেল বাজালে দেহরক্ষী এলে বললেন, এই ভদ্রলোক কলোনিয়াল সেক্রেটারির সঙ্গে দেখা করতে চান। তার কাছে একে নিয়ে যাও, বুঝেছ? আমি মিস্টার প্লেডেল স্মিথকে টেলিফোনে বলে দিচ্ছি যাতে তিনি অবশ্য দেখা করেন। তিনি দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন বন্ডের দিকে, বিদায় মিস্টার বন্ড। আমার ভাল লাগছে এটা ভেবে যে আমার সম্পূর্ণ একমত। ক্র্যাব-কী! সেখানে আমি কখনো যাইনি, তবে একবার গেলে মন্দ হয় না।

বন্ড করমর্দন করল। আমিও তাই ভাবছিলাম, চলি।

গভর্নর বললেন, আচ্ছা আসুন। বড় বেরিয়ে যেতে সে টেলিফোন হাতে নিয়ে কতকগুলো কথা কলোনিয়াল সেক্রেটারিকে বলে দিলেন।

কলোনিয়াল সেক্রেটারির খুব বেশি বয়স নয়, এলোমলো চুল, উজ্জ্বল মানুষের মত চোখ। পাইপ খাবার ব্যাপারে উনি বেশ দুর্বল প্রায়ই এটা করছেন আর পকেট চাপড়ে দেখছেন দেশলাই ঠিক আছে কি না। বন্ডের সামনে দশ মিনিটের মধ্যে তিনবার এরকম করাতে বন্ড ভাবল কে জানে ভদ্রলোকের বোধহয় এই কাণ্ডের পর তামাক টানাই হয় না।

প্লেডেল স্মিথ ঘরের এপাশ থেকে ওপাশ পায়চারী করতে লাগলেন, বন্ড…বন্ড…বন্ড নামটা যেন চেনা চেনা…ঠিকই তো। চার…না, পাঁচ বছর আগেকার কথা। একটা ফাইলে দেখছিলাম, অসাধারণ কাজ হয়েছিল। সে রকম আর। একটা কাণ্ড এখানে করলে আমি খুশি হই। তবু জায়গাটায় একটু বেশি হৈহুল্লোড় হয়। আমি বলছি কি জানেন। ওদের নিজেদের মধ্যেই এই বর্ণ সমস্যা দারুণ দারুণ। একজন কালা অন্যজন ধলা। একজন সোজা চুলওলা আর একজন। কোঁকড়া চুলওলা, আমি আর আমার রাঁধুনির মধ্যে যা তফাত। তবে…।

একটা তামাক পাত্র থেকে তামাক নিলেন। পাত্রটার ওপর কেমব্রিজের কিংস কলেজের চিহ্ন। তামাক পাইপে ভরে বললেন, যাকগে ওসব কথা। আপনি বরং এবারে আপনার কথা বলুন। আপনার সমস্যাটা কি? যদি সাহায্যের কিছু প্রয়োজন হয় আমি রাজি। –বলে ট্রের ওপর একগাদা কাগজপত্র আর ফাইল দেখালেন।

বন্ড তার দিকে তাকিয়ে হাসল। এই ভদ্রলোককেই তার চাই। বন্ড বলল, কথাটা হল এই যে আমি ট্র্যাংওয়েজ এর ব্যাপারে এখানে এসেছি। আপনি কেমন করে আমার অন্য কেসটা সম্পর্কে জানতে পারলেন? আপনি বললেন আপনি ফাইলটা হঠাৎ দেখেছেন। সব ব্যাপারটা বলবেন? কেউ কি ফাইলটা চেয়েছিল? আমার এ ব্যাপারে কৌতূহল হচ্ছে, এই পর্যন্ত।

সেক্রেটারি বললেন, ও এই ব্যাপার! বন্ড হেসে আবার বলল, নানারকম লোকই দেখছি এ শহরে আমার সম্পর্কে জানতে চায়। আপনি ক্র্যাব-কী সম্বন্ধে যা জানেন আর ঐ চীনে লোকটির সম্পর্কেও যার নাম ডক্টর নো, এছাড়া। গুয়ানোর সম্পর্কে আপনি যা জানেন, যদি কিছু খবর পাই তাতে আমার সাহায্য হবে।

প্লেডেল স্মিথ বললেন, আমি গুয়ানোর ব্যাপারে অনেকটাই জানি। কলোনিয়াল অফিসে যোগ দেবার আগেই আমার এ বিষয়ে আগ্রহ ছিল। প্রথম আমি ব্যাপারটা জানি পেরুতে। ঐ সব ব্যবসা যারা করে তাদের সঙ্গে আমার নানারকম-সম্পর্ক ছিল। কোম্পানীটির নাম হল কম্পানিয়া আমিনিস্ত্রাদরা দেল গুয়ানো। ভারি চমৎকার লোক ওরা। এবার পাইপটা বেশ ধরেছে। এর পরের ঘটনা বলা খুবই সোজা। ফাইলেই সব আছে। তিনি ঘণ্টা বাজাতেই বন্ডের পেছনের দরজা খুলে গেল। মিশ তারো, ক্র্যাব-কী সম্পর্কে যে সব ফাইল আছে নিয়ে এসো। ঐ জায়গাটা বিক্রি সম্পর্কে একটা ফাইল আছে আর একটা আছে গত বড়দিনের আগে ঐ দ্বীপ থেকে একজন ওয়ার্ডেন আসবার পর যে ফাইলটা খোলা হয়েছিল। মিস লংফেলল জানে সে সব কোথায় আছে।

আচ্ছা তারপর দরজা বন্ধ করার শব্দ হল।

প্লেডেল স্মিথ বললেন, হ্যাঁ যা বলছিলাম। গুয়ানোর ব্যাপারটা…। বন্ড বিরক্ত হবার জন্য প্রস্তুত হল। আপনি তো জানেন গুয়ানো হল পাখির নোংরা। দু রকম পাখি থেকে পাওয়া যায়, মাস্কও বুবি, আর এক হল গুয়ানে। ক্র্যাব কীতে কেবল গুয়ানে পাখিরই বসবাস। এদের অন্য নাম হচ্ছে গ্রীন করমোর্যান্ড। গুয়ানে পাখি আসলে একটা যন্ত্র এই যন্ত্র মাছ থেকে তৈরি করে গুয়ানো। এই পাখি বেশির ভাগ খায় আনচোভি মাছ। এরা যে কত মাছ খায় তার জানবার জন্য এদের পেট কেটে দেখা গেছে এক-একটার পেটে সত্তরটা পর্যন্ত আনচোভি মাছ। পেরুর লোকেরা বছরে খায় চার হাজার টন মাছ, আর পেরুর পাখিরা খায় পাঁচ লক্ষ টন।

বন্ড তার ঠোঁট বাঁকাল, সে যে এ ব্যাপারে দারুণ আগ্রহান্বিত সেটা দেখানোই তার উদ্দেশ্য। সত্যি?

 কলোনিয়াল সেক্রেটারি বললেন, প্রতিদিন এই সব পাখিরা এক একটিতে প্রায় এক মলদ্যপি মাছ খায় আর প্রত্যেকে এক আউন্স করে গুয়ানো তৈরি করে।

বন্ড বাধা দিয়ে বলল, তারা সমুদ্রে করে না কেন?

তা তো জানি না। যে কোন কারণেই হোক না কেন, তারা মাটিতে করে এবং বাইবেলের জন্মের আগে থেকে করে আসছে। তার মানে হল পাখির নোংরার এক বিরাট বিশাল পাহাড়। কোটি কোটি টন-পেসকার বা অন্য গুয়ানেরাতে জমে ছিল। তারপর ১৮৫০ সালে কে যেন আবিষ্কার করল যে পৃথিবীর মধ্যে এই হল গিয়ে সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক সার। তারপর এল জাহাজ। জাহাজে করে তুলে নিতে লাগল-কুড়ি বছরেরও বেশি সময় ধরে। পেরুতে এই সময়টাকে বলে হুল্লোড়ের সময়। ঝগড়া-ঝাটি, মারামারি আরো কত কি। বহু লোক ঐ করে বড়লোক হয়ে গেল।

বন্ড জিজ্ঞেস করল, তার সঙ্গে ক্র্যাব-কীর সম্পর্কটা কি?

উত্তরের দিকে ঐটেই একমাত্র গুয়ানোর। এটাতেও কাজ চলেছিল। কিন্তু এই নোংরার মধ্যে নাইট্রেটের ভাগ কম ছিল। হামবোল্ড স্রোতের কাছে পানি যত ভাল, এখানকার পানি ততটা নয়। ফলে মাছেদের শরীরে কেমিক্যাল এর ভাগ কম। ফলে গুয়ানোও খুব ভাল না এখানকার। কিন্তু পরে ক্র্যাব-কী এবং অন্যান্য খারাপ গুয়ানোর গাদাগুলি প্রত্যেকটি আর চালানো হয়নি–জার্মানরা নকল সার তৈরি করবার পর থেকেই।

ইতিমধ্যে পেরু বুঝতে পেরেছে যে তাদের ঐ গুয়ানোরা যত তাড়াতাড়ি ফুরিয়েছে তাতে তাদের বিরাট ক্ষতি হয়েছে। তাই ওগুলো রক্ষা করবার জন্য নানারকম নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা শুরু করে। তারপর আস্তে আস্তে আবার গুয়ানোরার স্তূপ গড়ে ওঠে। তখন দেখা গেল জার্মানরা যে সার বানিয়েছিল মা মাটিতে খারাপ করে দেয়। আর এখানেই গুয়ানোর শ্রেষ্ঠত্ব, আবার গুয়ানোর দাম বেড়ে ওঠে এবং আবার ব্যবসা দাঁড়িয়ে যায়। ফলে ক্র্যাব-কীর গুয়ানোর ওপর আবার নজর পড়ে।

আচ্ছা।

প্লেডেল স্মিথ বললেন, হ্যাঁ, তারপর তার পকেটের ওপর হাত দিয়ে দেখে নিলেন দেশলাই ঠিক আছে কি না। ডেস্কের ওপর থেকে দেশলাইটা তুলে কানের কাছে বাজালেন এবং আবার শুরু করলেন পাইপে তামাক ভরা। বললেন, যুদ্ধের আগে এই দারুণ চালাক শয়তান চীনেটা ঠিক বুঝেছিল ক্র্যাব-কীতে যে গুয়ানো পাওয়া যায় তার একদিন দাম হবে। এখন প্রতি টনের দাম এদিকে পঞ্চাশ ডলার করে। ও আমাদের কাছে ঐ দ্বীপটা কিনে নেয় দশ হাজার পাউন্ড দিয়ে। তারপর থেকে কাজ চলছে। আর এর মধ্যে প্রচুর লাভ করেছে মনে হয়। ও জাহাজে করে ইউরোপে মাল পাঠায়।

কুলিদের বোধহয় খাঁটিয়ে মারে। আর কুলিদের কত কম বেতন দিলে অত লাভ করা সম্ভব তা সৃষ্টিকর্তাই জানেন। গত বছরে আন্তর্বেপ-এ গুয়ানো বেচেছিল প্রতি টন আটত্রিশ থেকে চল্লিশ ডলারে। কুলিদের জোর করিয়ে খাঁটিয়ে নেয় এবং কেউ কখনো ঐ দ্বীপ থেকে কোথাও যায় না, যেন ওটা একটা দুর্গ। আমি সব অদ্ভুত গুজব শুনেছি, ওটা তার দ্বীপ–তার ওখানে যা খুশি তাই করবার অধিকার আছে।

বন্ড বলল, আপনার কি মনে হয় জায়গাটা এতই দাম? এর দাম কত হতে পারে বলে আপনার ধারণা?

প্লেডেল স্মিথ বললেন, গুয়ানে পাখি হচ্ছে পৃথিবীর সেরা দামের পাখি। এক জোড়া গুয়ানে প্রতি বছর দু-ডলারের মত গুয়ানো তৈরি করে–আর এজন্য মালিককে একটি পয়সাও খরচ করতে হয় না। প্রতিটি স্ত্রী গুয়ানে গড়ে তিনটি করে ডিম পাড়ে বছরে দু বার। আর প্রতিবার তার মধ্যে দুটো বাচ্চা হয়। ধরা যাক এক জোড়ার দাম পনেরো ডলার আর ক্র্যাব-কীতে লাখ খানেক পাখি আছে। বেশ বড় সম্পত্তিই বলা যায়। প্লেডেল স্মিথ ঘণ্টা বাজালেন, আহা! ঐ ফাইলটাতেই তো সব আছে–সেটার হল কি?

বন্ডের পেছনের দরজা খুলল, ফাইলগুলোকে এখনো দিলে না, বলি ব্যাপার কি, মিস তারো?

 নরম গলায় মেয়েটি বলল, আমরা দুঃখিত স্যার, ফাইলগুলো কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।

কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না মানে? এর আগে কে ঐ ফাইল চেয়েছিল?

 কম্যান্ডার স্ট্র্যাংওয়েজ, স্যার।

আমার স্পষ্ট মনে আছে ফাইলগুলো ফেরত এসেছিল এই ঘরে। তারপর সেগুলোর কি হল?

বলতে পারি না স্যার। মলাটগুলো আছে কিন্তু ভেতরে কিছু নেই। বন্ড একবার ঘুরে মেয়েটিকে দেখে আবার ঠিক হয়ে বসল। সে জানত ফাইলগুলো কোথায় আছে। এখন সে স্পষ্ট বুঝতে পারল তার সম্পর্কের পুরনো ফাইলটা কেন সেক্রেটারির টেবিলের ওপর ছিল। সে বুঝল তার এখানে আসবার কথা। জেমস বন্ড নামটা। কিভাবে এখানে বিশেষ জায়গায় পৌঁছে গেছে। ডক্টর নো যেমন–মিস অ্যানাবেল চুং যেমন–তেমনি লাজুক নম্র খাঁটিয়ে চেহারার এই শিং এর ফ্রেম-এর চশমা পরা মেয়েটিও তাই–চীনে।

.

শত্রুর সন্ধান

 কলোনিয়াল সেক্রেটারি বন্ডকে লাঞ্চ খাওয়ালেন কুইনস্ ক্লাব-এ। তারা মেহগনির প্যানেল দেওয়া ভোজঘরের একটি কোণে বসে জ্যামাইক নিয়ে গল্পগুজব করলেন। কফি যখন এল সেই সময়ের মধ্যে প্লেডেল স্মিথ পৃথিবী যাকে জানে একটি শান্তিময় জায়গা বলে, সেই অঞ্চলের অনেক গভীরে তলিয়ে গেছেন কথায় কথায়।

পাইপ নিয়ে কায়দা করতে করতে তিনি বললেন, ব্যাপারটা হল এই-জ্যামাইক্যানরা মোটামুটি অলস, দয়ালু এবং এদের পাপপুণ্য সবই ছোট ছেলেমেয়েদের মত। একজন জ্যামাইকান খুব সমৃদ্ধ দ্বীপে থাকে। কিন্তু নিজে কখনো ধনী হয় না। প্রথমত সে ধনী হবার কায়দা জানে না। দ্বিতীয়ত সে অত্যন্ত অলস। ইংরেজরা আসে-যায়, আর কিছু হাতিয়ে নিয়ে সরে পড়ে।

সবচেয়ে বেশি মারে ইহুদীরা। তারা বৃটিশদের সঙ্গে এসে আর যায়নি। কিন্তু তারা আবার খুব জাকজমক পছন্দ করে। তারা বাড়ি তৈরি করতে দারুণ খরচ করে। পার্টি দেয়। নাচের ব্যবস্থা করে। তাদের ব্যবসা রাম ও তামাক। তারা এদিকে বড় বড় বৃটিশ ব্যবসাদারের প্রতিনিধিত্ব করে। তারপরের লাইনে আছে সিরীয়ানরা। খুব বড়লোক কিন্তু ব্যবসায় বড় কাঁচা।

ভারতবর্ষের লোকেরাও এখানে ব্যবসা করে বিশেষ করে ঝকমকে জিনিসের কারবার এদের। তারা দলে ভারি নয়। এছাড়া আছে চীনেরা। শক্ত সমর্থ বেশ গুছিয়ে কারবার করতে পারে। আর এরাই জ্যামাইকার সবচেয়ে শক্তিশালী সম্প্রদায়। এদের বেকারী আছে, লন্ড্রী আছে আর ভাল খাবারের দোকানগুলো। তারা অন্য জাতের সঙ্গে আত্মীয়তা করে না। অবশ্য কখনোই যে তারা কালো মেয়েদের সঙ্গে মেশে না এমন বললে ভুল হবে। কারণ সারা কিংসটন জুড়ে তার প্রমাণ দেখতে পাবেন। আমি নিগ্রোদের কথা বলছি। তারা নিগ্রোদের নিচু জাত বলে মনে করে চীনেদের কাছে তারা নিচু জাত।

বন্ড বলল, আপনার সেক্রেটারি বোধহয় ওদেরই একজন। হ্যাঁ। মেয়েটার বুদ্ধি আছে আর চটপটে। মাস ছয়েক হল এ কাজে যোগ দিয়েছে।

বন্ড বলল, ওকে দেখে তো চালাকই মনে হয়। তা, এদের সংগঠন কেমন? নিগ্রো সমাজের কোন প্রধান ব্যক্তি আছেন নাকি?

এখনও এমন কেউ নেই, তবে হতে কতক্ষণ? তখন তারা একটা গুরুত্বপূর্ণ দলে পরিণত হবে। ভাল কথা, এবার আমাকে পালাতে হচ্ছে। ঐ ফাইলগুলোর সম্বন্ধে কোন আইন কানুনের ঝামেলা আছে কিনা জানতে হবে। আমার স্পষ্ট মনে পড়ছে… থামলেন তিনি।

বললেন, যাই হোক, আসলে আমি আপনাকে ক্র্যাব-কী এবং ঐ ডাক্তার ভদ্রলোক সম্পর্কে বিশেষ কিছু খবর দিতে পারলাম না। গোটা দুয়েক যুদ্ধের খবর আর সর্বশেষে যে অর্ডিন্যান্স সার্ভে হয়েছিল তার একটা কপি। পাণ্ডব বর্জিত যাচ্ছেতাই জায়গা। আপনি জ্যামাইকা ইনস্টিটিউটে যাচ্ছেন তো? চলুন ওখানকার মানচিত্র বিভাগের অধিকর্তার সঙ্গে আপনার আলাপ করিয়ে দিই।

পরবর্তী একঘণ্টা বন্ড লাইব্রেরির একটা কোণে বসে ক্র্যাব-কীর অর্ডিন্যান্স সার্ভের ম্যাপটি পর্যবেক্ষণ করে একটা খসড়া তৈরি করল। দ্বীপটির বিস্তৃতি প্রায় পঞ্চাশ বর্গমাইল। পূর্বদিকে দ্বীপটির বারোআনা জুড়ে কেবল জলাভূমি আর একটা গভীর জলাশয়। জলাশয়টি থেকে একটা নদী এঁকে বেঁকে নেমে গেছে সমুদ্রের দিকে। পশ্চিমদিকের দ্বীপটি পাঁচশ ফুট উঁচু পাহাড়ের রূপ নিয়েছে। এই পাহাড়টি চিহ্নিত করে ম্যাপে লেখা আছে- গুয়ানোর স্তূপ। কোনরকম হাঁটাপথের চিহ্নমাত্র নেই। রিলিফ ম্যাপে দ্বীপটাকে একটা ভাসমান উঁচর মত দেখাচ্ছে। ম্যাপ দেখে বোঝা গেল ক্র্যাব কীর চারিদিকে অগভীর পানি, কেবল পশ্চিম দিক ছাড়া। সেদিকের সবচেয়ে কম গভীরতা হল পাঁচশ ফ্যাদম। তার ঠিক পরেই কিউবা দ্বীপ-এর অতলস্পর্শী গভীরতা।

হঠাৎ ভীষণ ক্লান্তি লাগছে। মাত্র চারটে বাজে–কিংসটনের উত্তাপ তার সর্বাঙ্গ ঝলসে দিচ্ছে। বন্ড ইনস্টিটিউট থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে ফিরে চলল। আজ সারাদিন ভালোই কাজ হয়েছে। আজ রাতটা কোনরকমে কাটিয়ে কাল ভোরেই পালাতে হবে।

রিসেপশান ডেস্কের কাছে গিয়ে বন্ড জানতে চাইল কোয়ারেলের কাছ থেকে কোন সংবাদ আছে কিনা।

কোন খবর নেই স্যার, তবে রাজবাড়ি থেকে একঝুড়ি ফল এসেছে। মধ্যাহ্নভোজের ঠিক পরেই।

লোকটি দেখতে কেমন?

 একজন কালো আদমী স্যার। বলল যে সে এ.ডি.সি-র অফিস থেকে আসছে।

ধন্যবাদ। বন্ড ঘরের চাবিটা নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেল। তার হাত চলে গেল কোটের পকেটে পিস্তলের ওপর। পা টিপে এগিয়ে গেল দরজার দিকে।

বন্ড ভেতরে গিয়ে দরজাটার তালা বন্ধ করল। তার ড্রেসিং টেবিলে রাখা আছে একটি বিরাট সুন্দর ফলের ঝুড়ি। তার মধ্যে সাজানো কমলালেবু, বাতাবিলেবু, সিঁদুরে কলা, আতা, আপেল, এমন কি গোটা দুয়েক তাজা পীচ ফল। ঝুড়ির হাতলে রিবনে বাধা একটি সাদা খাম। সেটা খুলে বন্ড দেখল–রাজ্যপালের আন্তরিক শুভেচ্ছাসহ।

বন্ডের নাক দিয়ে একটা আওয়াজ বেরোল। একবার ঝুড়ির গায়ে কান লাগিয়ে শুনল। তারপর হাতল ধরে ঝুড়িটাকে মেঝেতে উপুড় করে দিল। ফলগুলো লাফিয়ে গড়িয়ে, ছড়িয়ে পড়ল। তবু একটা সম্ভাবনা থেকে গেল। প্রথমে পীচ ফলটি তুলে নেওয়াই স্বাভাবিক। বন্ড তারই একটা নিয়ে বাথরুমে ওয়াশ বেসিনে সেটিকে রেখে আবার শোবার ঘরে ফিরে এল।

আলমারির তালা পরীক্ষা করার পর সে সেটা খুলল। সুটকেসটা বার করে সে এসে দাঁড়াল ঘরের মাঝখানে। চাবি লাগানোর জায়গাতে সে পাউডার লাগিয়ে রেখেছিল। পাউডারগুলো জায়গায় জায়গায় উঠে গেছে এবং চারপাশে অস্পষ্ট আঁচড়ের দাগ। যে লোকটি তার ঘরে অনুসন্ধান কার্য চালিয়েছে তাকে সাবধানী বলা চলে না।

সুটকেসের ডালা খুলে বন্ড তার যন্ত্রপাতির বাক্স থেকে ম্যাগনিফাইং গ্লাসের ঠুলি বার করল। তারপর বাথরুমে গিয়ে দাড়ি কামাবার আয়নার সামনের আলোটা জ্বালাল। ঠুলি চোখে লাগিয়ে নিয়ে ওয়াশ বেসিন থেকে পীচ ফলটি নিয়ে আস্তে আস্তে চোখের সামনে যোরাতে লাগল।

ঘোরানো বন্ধ করল বন্ড। সে ফলের গায়ে একটা খুব ছোট ছিদ্র দেখতে পেল। ছিদ্রটার ধারগুলো ঈষৎ বাদামি। ফলের গায়ে খাজের মধ্যে একটা এমন লুকিয়ে ছিল, যে ম্যাগনিফাইং গ্লাসের সাহায্য ছাড়া খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। বন্ড সাবধানে ফলটিকে ওয়াশ বেসিনে নামিয়ে রাখল। বিষাক্ত ফল!

তাহলে যুদ্ধ বেধেই গেল। বেশ, বেশ! আনন্দের কথা। বন্ড অনুভব করল তার তলপেটের পেশী হঠাৎ কেমন শক্ত হয়ে গেল। তাহলে তার অনুভূতি এবং যুক্তি ঠিক পথেই চলেছে। স্ট্র্যাংওয়েজ আর মেয়েটাকে খুন করা হয়েছে কারণ, তারা সঠিক পথেই চলতে শুরু করেছিল। সে যে রু-হিল হোটেলে উঠেছে সে খবর তারা পেয়েছে। তাকে লক্ষ্য করে প্রথম গোলাটা ছোঁড়া হল। পরের গুলোও আসছে। কিন্তু ট্রিগারের উপর আঙুলটা কার? কে তাকে এমন সুন্দর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে? বন্ড বিনা দ্বিধায় স্থির করল যে গোলা আসছে অনেক দূর থেকে, ক্র্যাব-কী থেকে। এবং গোলন্দাজটি হলের স্বয়ং ডক্টর নো।

বন্ড শোবার ঘরে ফিরে গেল। এক একটা করে সবকটা ফল বাথরুমে নিয়ে গিয়ে ম্যাগনিফাইং গ্লাসের সাহায্যে পরীক্ষা করল। চুঁচ ফোঁটানোর দাগ ছিল প্রত্যেকটার বোটার কাছে বা কোন একটা খাজের ভেতর লুকানো। বন্ড নিচে ফোন করে একটা কার্ডবোর্ডের বাক্স, কিছু কাগজ আর দড়ি চেয়ে পাঠাল। সবকটা ফল সযত্নে বাক্সটায় বেঁধে ফেলে টেলিফোনে রাজবাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করে কলোনিয়াল সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলতে চাইল।

কে? প্লেডেল স্মিথ? জেমস বন্ড কথা বলছি। একটু মুশকিলে পড়েছি। কিংসটনে কি কোন পেশাদার কেমিক্যাল অ্যানোলিস্ট আছেন? ঠিক আছে। আমার কিছু জিনিস পরীক্ষা করতে চাই। আমি যদি তোমার কাছে বাক্সটা পাঠিয়ে দিই তুমি কি সেটা সেই ভদ্রলোককে পৌঁছে দিতে পারবে? এ ব্যাপারে আমার নাম উল্লেখ না হয় বুঝেছ তো? তার রিপোর্ট পেলে আমাকে টেলিগ্রাম করে জানিয়ে দিও। সামনের সপ্তাহটা আমি মর্গান হারবারের বো-ডেজার্টে থাকব। পরে দেখা হলে সব বলব। অবশ্য অ্যানালিস্টের রিপোর্টটা দেখলে তুমি কিছুটা আন্দাজ করতে পারবে। আমার ভাগ্য ভাল, আজ সকালে তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। বিদায়।

পার্সেলটার ওপর ঠিকানা লিখে বন্ড নিচে নেমে গেল। একটা ট্যাক্সী ড্রাইভারকে টাকা দিয়ে বলল রাজবাড়িতে এটাকে পৌঁছে দিতে। ছ টা বাজে। ঘরে ফিরে এসে সে শাওয়ারে গোসল করল। জামাকাপড় বদলে রাত্রের প্রথম পানীয়টি আনাল। গ্লাসটা হাতে নিয়ে বারান্দায় যাবে এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল। কোয়ারে ফোন করছে।

সব ঠিক করে ফেলেছি, ক্যাপ্টেন।

সব কিছু বহুৎ আচ্ছা। বাড়িটা পেয়েছ?

 সব হয়ে গেছে। যথাসময়ে দেখা হবে, ক্যাপ্টেন।

চমৎকার। বন্ড বলল, কোয়ারেলের কর্মদক্ষতা আর সতর্কতায় সে খুশি হল।

বন্ড ভাবছিল, ওটা শহরে এসে পৌঁছলেই আলোগুলো জ্বলবে। ঠিক তাই হল। মাথার ওপরে প্লেনের গর্জন শোনা গেল। বিমানটাকে দেখা গেল–একটা সুপার কনস্টেলেশন। গতরাত্রে এইরকম একটা বিমানেই বন্ড ছিল। বন্ড দেখল প্লেনটা কেমন সমুদ্রের ওপর বিরাট চক্কর মেরে প্যালিসাডোর্স এয়ারপোর্টের দিকে ঘুরল। মাত্র চব্বিশ ঘণ্টায় কতদূর চলে এসেছে সে।

সে কি M কে জানাবে এই অবস্থা পরিবর্তনের কথা? নাকি গভর্নরের কাছে একটা রিপোর্ট পাঠাবে? কি খবর পাঠাবে? যে ডক্টর নো তাকে বিষাক্ত ফল পাঠিয়েছে। কিন্তু ফলগুলো সত্যিই বিষাক্ত কিনা, এমন কি ওগুলো সত্যিই ডক্টর নো-র কাছ থেকে এসেছে সে সম্বন্ধেও সে নিঃসন্দেহ নয়।

এ রকম একটা সংকেত বার্তা পেলে M-এর মুখের অবস্থা যে কেমন হবে বন্ড তা মনশ্চক্ষে দেখতে পেল। যে তিনি বলছেন, চীফ অফ স্টাফ 007 ক্ষেপে গিয়েছে। বলে কিনা তাকে কে একটা বিষাক্ত কলা খাইয়ে গেছে। ওকে বরং ফেরত আসতে বল?

বন্ড আপন মনে হাসল। না, সে যতক্ষণ না হাতে আরও প্রমাণ পায় ততক্ষণ অপেক্ষা করবে। তবে কোন বিপদ সংকেত পাঠাবার আগেই যদি সে একটা মারাত্মক বিপদে পড়ে যায়, তাহলেই হয়েছে।

বন্ড তার প্ল্যানটা খুঁটিয়ে বিচার করে দেখল। তারপর নিচে নেমে আধখালি ভোজঘরে নৈশভোজ সেরে এল। নটা। বাজার আগেই ঘরে এসে সকালে বেরোবার জন্য মালপত্র ঘুছিয়ে রাখল। টেলিফোনে ব্যবস্থা করল যাতে সকাল সাড়ে পাঁচটায় ডেকে দেওয়া হয় তাকে। এত গরম, বন্ড দরজা-জানলা বন্ধ করল, উপায় নেই। জামাকাপড় খুলে চাদরের তলায় ঢুকে পড়ল। বালিশের তলায় রইল ওয়ালথার PPK. পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঘুম এসে গেল।

রাত তিনটেয় বন্ডের ঘুম ভেঙে গেল। সময়টা বুঝল ঘড়িটা দেখে। নিস্তব্ধ ঘর। সে কান খাড়া করে শোনবার চেষ্টা করল। ঘরের বাইরেটাও মৃত্যুর মত নিঃশব্দ। কেন ঘুম ভাঙল তার? বন্ড আস্তে-আস্তে খাট থেকে উঠতে গেল।

থেমে গেল সে। একজন মানুষের পক্ষে যতটা স্থির হওয়া সম্ভব, ঠিক ততটা স্থির হয়ে গেল, তার ডান পায়ের গোড়ালির ওপর কি যেন নড়ছে। সেটা পা বেয়ে উঠতে লাগল। দেখল খুব বড় একটা পোকা। অন্তত পাঁচ ছয় ইঞ্চি লম্বা পায়ের ওপর কয়েক ডজন ছোট-ছোট পায়ের স্পর্শ পেল। জিনিসটা কি?

তার মাথার প্রতিটি চুল খাড়া হয়ে উঠেছে। শব্দটা সে বিশ্লেষণ করে দেখল। কিছুতেই হতে পারে না। কিন্তু হ্যাঁ, সত্যিই তো চুলগুলো খাড়া হয়ে উঠল! বন্ড অনুভব করল ঠাণ্ডা হাওয়া এসে লাগছে তার চাদিতে। তাজ্জব ব্যাপার!

গায়ের উপরের প্রাণীটা এবার নড়ল। বন্ড বুঝল সে ভীষণ ভয় পেয়েছে, আতঙ্কিত হয়েছে, তার অনুভূতি মস্তিষ্ককে জানান-দেবার আগেই তার শরীরকে জানিয়ে দিয়েছে যে বহু পদবিশিষ্ট প্রাণী চলাফেরা করছে।

বন্ড স্থির হয়ে রইল। সে একবার জাদুঘরে স্পিরিটের বোতলে, গ্রীষ্মপ্রধান দেশের বিছে দেখেছিল। চ্যাপটা, হালকা বাদামি রঙের আর পাঁচ-ছ ইঞ্চি লম্বা-এটার মত লম্বা হবে। ভোতা মাথাটার দু দিকে বাঁকা, বিষাক্ত নখর। বোতলে লেখা ছিল যে এর বিষ ধমনীতে প্রবেশ করলে মৃত্যু অনিবার্য।

সে কি সহ্য করতে পারবে? যদি ওখানে একটা কামড় বসায়।

প্রাণীটা আবার চলতে শুরু করল। এবার চুলের অরণ্যে ঢুকছে, চুল সরিয়ে রাস্তা করে নিচ্ছে। জায়গাটা কি ওর পছন্দ হয়ে যাবে? ঘুমিয়ে পড়বে, না তো? কেমন করে ঘুমোয় এরা কুকড়ে না হাত-পা ছড়িয়ে? এবার এসে পড়েছে মাথায়। বালিশে নেমে পড়বে না, এই উষ্ণ অরণ্যেই থেকে যেতে চাইবে? পোকাটা থেমে পড়ল। বেয়রা! বেরিয়ে যা! বন্ডের প্রতিটি স্নায়ু পোকাটার প্রতি চিৎকার করে উঠল।

পোকাটা নড়ল, আস্তে তার চুল-পার হয়ে বালিশে নেমে পড়ল।

বন্ড এক সেকেন্ড অপেক্ষা করল। তারপর বিছানার চাদরে অসংখ্য পায়ের আঁচড়ানোর শব্দ পেল।

সমস্ত ঘর কাঁপিয়ে বন্ড বিছানা থেকে মেঝেতে ছিটকে পড়ল। পরক্ষণেই উঠে দাঁড়াল। দরজার কাছে গিয়ে আলোটা জ্বালাল। হাত পা অসম্ভব কাঁপছে। টলতে টলতে গিয়ে দাঁড়াল বিছানার পাশে। একটা বিশাল কাঁকড়া বিছে…ড়ি মেরে চলেছে বালিশের ধার বেয়ে।

বন্ড একটু অপেক্ষা করল, যতক্ষণ না তার মাথা ঠাণ্ডা হয়। তারপর আস্তে করে বালিশটা তুলে নিল। ঘরের মাঝখানে নিয়ে ফেলল সেটাকে। বিছেটা বালিশের তলা থেকে বেরিয়ে এসে চটপট কার্পেট বেয়ে পা চালাল। এখন যেন বন্ডের তেমন উৎসাহ নেই। সে চারদিকে চেয়ে দেখল, কি দিয়ে মারা যায় এটাকে। ধীরে-সুস্থে একপাটি জুতা হাতে নিয়ে ফিরে এল। বিপদ কেটে গেছে। সে ভাবছে বিছে-টা বিছানায় এল কি করে। জুতার পাটিটা সজোরে নামিয়ে আনল পোকাটার ওপর। বিছের শক্ত পা ফেটে যাওয়ার আওয়াজ পেল সে।

বন্ড জুতাটাকে তুলে নিল।

বিছে-টা যন্ত্রণায় ছটফট করছে-পাঁচ ইঞ্চি লম্বা ধূসর বাদামী চকচকে এক মৃত্যুদূত। বন্ড আবার আঘাত করল। এবার পোকটা ফেটে গিয়ে এক গাদা হলুদে রস বেরোল।

বন্ড জুতাটাকে ফেলে দিয়ে এক ছুটে বাথরুমে গিয়ে ঢুকল। তার ভয়ানক বমি পাচ্ছে।

.

নৈশ অভিযান

 ভাল কথা, কোয়ারেল– ব্রাউন বহুবার লেখা একটা বাসকে পাশ কাটাতে কাটাতে বন্ড জিজ্ঞেস করল, বিছেদের সম্বন্ধে তোমার কতদূর জানা আছে?

বিছে, ক্যাপ্টেন কোয়ারেল আড়চোখে পাশের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটার তাৎপর্য আন্দাজ করতে চেষ্টা করল। কিন্তু বন্ডের মুখের ভাব সাধারণ। তা জ্যামাইকাতে কিছু খারাপ জাতের বিছে আছে। তিন থেকে পাঁচ ইঞ্চি লম্বা। মানুষ খতম করতে পারে। কিংসটনের সব পুরনো বাড়িতে ওদের আস্তানা। ওরা পচা কাঠ আর ছাতা ধরা জায়গা খুব ভালবাসে। ওরা নিশাচর। কেন, ক্যাপ্টেন আপনি একটাকে দেখেছেন নাকি?

বন্ড প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল। ফলগুলোর কথাও কোয়ারেলকে বলেনি সে। কোয়ারেল শক্ত মানুষ, কিন্তু তার মনে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়ার মানে হয় না। একটা আধুনিক বাড়িতে কি এদের পাওয়া যেতে পারে? ধর জুতা বা ড্রয়ার বা বিছানার মধ্যে?

না। নিশ্চিত কণ্ঠে বলল কোয়ারেল। যদি না তাদের ইচ্ছে করে এনে রেখে দেওয়া হয়। এরা খোলা জায়গায় মোটেই আসতে চায় না।

তাই নাকি বন্ড প্রসঙ্গে বদলাল, ভাল কথা, সেই লোকটি দুটি সানবীম নিয়ে রওনা হয়ে গিয়েছে তো?

নিশ্চয়ই, ক্যাপ্টেন। কাজটা পেয়ে ওরা ভারি খুশি। আর ওরা সত্যি অনেকটা আমাদের মত দেখতে। কোয়ারেল আড়চোখে বন্ডের দিকে তাকিয়ে দ্বিধার সঙ্গে বলল, আমার মনে হয় ওরা বিশেষ সুবিধের লোক নয়। আমার মত দেখতে লোকটা ভিখিরী। আর যে লোকটা আপনার মত দেখতে সে ব্যাটা বেটশীর জোগাড় করা এক অকর্মা সাদা আদমী।

বেটশী কে?

মেয়েটা এ শহরে বাজে এক স্বৈরিনী ব্যবসা চালায়। কোয়ারেল গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে থুথু ফেলে। ঐ সাদা লোকটা হিসেব পত্র দেখে।

বন্ড হেসে বলল, আরে, লোকটা গাড়ি চালাতে জানলেই হল। ওরা ঠিকমত মন্টেগোতে পৌঁছলেই হল।

সে বিষয়ে চিন্তা করবেন না। ঠিকমত না পৌঁছলে পুলিশকে খবর দেব যে ওরা দুজন গাড়িটা চুরি করেছে।

কোয়ারেল বন্ডের চিন্তাস্রোতে বাধা দিয়ে বলল, মাপ করবেন ক্যাপ্টেন। অনেক মাথা ঘামিয়েও আপনার মতলব আমি কিছুই বুঝতে পারিনি।

আমি নিজেও বুঝতে পারছি না কোয়ারেল। তুমি তো জানই কমান্ডার স্ট্র্যাংওয়েজ ও তার সেক্রেটারি নিরুদ্দেশ হওয়ায় আমাকে এখানে আসতে হয়েছে। আমার ধারণা তাদের খুন করা হয়েছে।

তাই নাকি? কে তাদের খুন করেছে বলে আপনার মনে হয়? আমার তো মনে হয় ডঃ নো এ ব্যাপারে আমি তোমার সঙ্গে একমত। আমার মতে হত্যাকারী হচ্ছে ডক্টর নো, ক্র্যাব-কীর সেই চীনেটা। ঐ পাখিদের ব্যাপারে ডক্টর নো-র কাজে স্ট্র্যাংওয়েজ নাক গলিয়েছিল। মনে রেখো, সব কিছু আমার আন্দাজ ছাড়া কিছু নয়। তবে গত চব্বিশ ঘণ্টায় কয়েকটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। এর জন্যই সানবীম গাড়িটাকে আমি মন্টেগো পাঠিয়েছি। শত্রুকে বিপথে চালিত করবার জন্য।

আর তারপর।

প্রথমত আমার শরীরটাকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তুলতে চাই–গতবার তুমি আমাকে যেমন ব্যায়াম করিয়েছিলে।

নিশ্চয়ই ক্যাপ্টেন। আবার সে রকম করা যাবে।

আর তারপর ভাবছি তুমি আর আমি মিলে ক্র্যাব-কী দ্বীপটা একবার ঘুরে আসব।

কোয়ারেল শিস্ দিল। শিসের সুরটা নিচে নেমে থেমে গেল।

শুধু একবার দেখে আসা। ডক্টর নো-র বিশেষ কাছে ঘেঁষবার দরকার নেই। পাখিদের আড্ডাটা আমি একবার দেখতে চাই। আর ওয়ার্ডেনদের তাবুটায় আসলে কি হয়েছিল। যদি কিছু গণ্ডগোল দেখি পালিয়ে আসব। একটা বড় গোছের অনুসন্ধান চালাবার জন্যে হাতে কিছু প্রমাণ থাকা চাই। তোমার কি মনে হয়?

কোয়ারেল হিপ পকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে ধরাল। ক্যাপ্টেন, আমার মতে লুকিয়ে চুরিয়ে ঐ দ্বীপে যাওয়াটা নিছক পাগলামি। শুধু একটা কথা ক্যাপ্টেন, কে ম্যানস দ্বীপে আমার ছোট একটা পরিবার আছে। ঐ দ্বীপে রওনা হবার আগে আমার একটা জীবন বীমা করিয়ে দিতে পারবেন কি?

নিশ্চয়ই, কোয়ারেল। কালকেই আমি পোর্ট মারিয়াতে গিয়ে তার ব্যবস্থা করে ফেলব। বেশ বড় বীমা। এই ধর পাঁচ হাজার পাউন্ড। এবার বল আমরা কিসে চড়ে ঐ দ্বীপে যাব। নৌকায়?

হা ক্যাপ্টেন। শান্ত সমুদ্র আর একটু মৃদু হওয়া চাই। আর অন্ধকার রাত্রি। এখনি ঠিক সময়। দ্বীপের কোথায় নামবেন, ক্যাপ্টেন

দক্ষিণ উপকূলে, নদীর মোহনার কাছাকাছি। তারপর আমরা নদীর গতিপথ বেয়ে জলাশয়টার দিকে যাব। আমার বিশ্বাস ঐখানেই ওয়ার্ডেনদের তাবুটা ছিল, যাতে তারা মিষ্টি পানি পায় আর সমুদ্রে ধরতে পারে।

কোয়ারেল ঘোৎ করে আওয়াজ করল। বলল, কতক্ষণ থাকব ওখানে, ক্যাপ্টেন? পাউরুটি, পনির, নোনা শুয়োরের মাংস সঙ্গে নিতে হবে। তামাক নেওয়া চলবে না–ধোয়া আর আগুন অনেক দূর থেকে দেখা যায়। জায়গাটা কিন্তু। বড় বিশ্রী, জলাভূমি আর ঝোঁপঝাড়।

বউ বলল, দিন তিনেকের জন্য যাওয়াই ভাল। কারণ দুর্যোগের জন্য দু এক রাত্রি আটকে যেতে পারি। গোটা দুয়েক ভাল শিকারী ছুরি নিতে হবে। আমি একটা রিভলবার সঙ্গে নেব। কিছু বলা যায় না।

সত্যিই তাই, কোয়ালের জোরের সঙ্গে বলল। তারপর সে চুপ করে বসে-বসে কি যেন ভাবতে লাগল। পোর্ট মারিয়া পৌঁছানো পর্যন্ত তার দিক থেকে আর কোন শব্দ শোনা গেল না।

ছোট শহরটার ভেতর দিয়ে চলল তারা। অন্তরীপটা চক্কর দিয়ে তারা মর্গা হারবারে ঢুকল। ছোট রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে অজস্র স্মৃতি বন্ডের মনে ভীড় জমাতে লাগল। আঁখের ক্ষেতের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে নির্জন স্পেনদেশীয় পুরনো জাহাজের মত বোডেজার্ট প্ল্যানটেশানের বিরাট বাড়িটার ধ্বংসাবশেষ দেখতে পেল সে।

বাংলোর গেটে পৌঁছাল তারা। কোয়ারেল নেমে গেট খুলল। বন্ড গাড়িটা ঢুকিয়ে নিয়ে গিয়ে রাখল সাদা একতলা বাড়িটার একগজ পিছনে। বাড়ির পাশ দিয়ে লন বেয়ে গিয়ে সমুদ্রের ধারে দাঁড়াল। হ্যাঁ, এই সেই বিশাল, গভীর নিঃশব্দ পানির রাশি–এই পথ বেয়ে সাবমেরিনে চড়ে সে সারপ্রাইজ দ্বীপে গিয়েছিল। এখন মাঝে মাঝে সেই সব স্মৃতি দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে তার কাছে ফিরে আসে। বন্ড সেদিকে তাকিরে সলিটেয়ার-এর কথা ভাবছিল, যে মেয়েটাকে সে ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত অবস্থায় এই সমুদ্র থেকে তুলে এনেছিল। এই লনটা পেরিয়ে তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ভেতরে। কেমন আছে এখন মেয়েটি? কোথায় আছে? স্মৃতির রেশগুলোকে মন থেকে তাড়িয়ে বন্ড রুক্ষভাবে ঘুরে বাড়িটার দিকে চলল!

এখন সাড়ে আটটা। বন্ড তার অল্প কয়েকটা জিনিস গুছিয়ে নিয়ে হাফ-প্যান্ট আর চটি পরে নিল। তারপর কফি আর বেকন ভাজার চমৎকার গন্ধ পেল সে। প্রাতঃরাশ খেতে খেতে তার দৈনিক ব্যায়ামের রুটিন ঠিক করে ফেলল, সকাল সাতটায় ওঠা, সিকি মাইল সাঁতার, প্রাতঃরাশ, একঘণ্টা সূর্যস্নান, একমাইল দৌড়, আবার সাঁতার, মধ্যাহ্নভোেজ, ঘুম, সূর্যস্নান, একমাইল সাঁতার, গমর পানিতে গোসল ও মালিশ, নৈশভোজ এবং নটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়া।

প্রাতঃরাশের পর, তার রুটিন মাফিক শরীরচর্চা শুরু করল। পরের সপ্তাহটা একটানা পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে কাটল। ব্যতিক্রম ঘটাল কেবল দৈনিক গ্রীনার-এর একটা সংক্ষিপ্ত সংবাদ ও প্লেডেল স্মিথ–এর কাছ থেকে একটা টেলিগ্রাম। গ্লীনার জানাচ্ছে যে H. 2473 নম্বরের একটা সানবীম আলপাইন গাড়ি ভয়ংকর দুর্ঘটনায় পড়েছে। কিংসটন থেকে মন্টেগো যাবার পথে ডেভিলস্ রেসকোর্স নামক একটি আঁকাবাঁকা রাস্তায় অজ্ঞাত পরিচয় লরী বাঁকের মাথায় সানবীমটির ওপর এসে পড়ে। দুটি গাড়িই রাস্তা থেকে ছিটকে পাশের উপত্যকায় পড়ে যায়। সানবীমটির দুজন আরোহী, হারবার স্ট্রীট-এর বেন গীবনস ও জোসিয়া স্মিথ নিহত হয়েছেন। লরী ড্রাইভার এর খোঁজ চলছে। জনৈক মিঃ বন্ড, একজন ইংরেজ টুরিস্ট, এদেরকে গাড়িটি ধার দিয়েছিলেন। তাঁকে নিকটবর্তী পুলিশ স্টেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করা হচ্ছে।

বন্ড গ্রীনারের সেই সংখ্যাটা পুড়িয়ে ফেলল, এটা দেখলে কোয়ারেলের মন খারাপ হবে।

রওনা হবার ঠিক আগের দিন প্লেডেল স্মিথ-এর কাছ থেকে টেলিগ্রামটা এল। তাতে লেখা ছিল, প্রতিটি ফলের মধ্যে যে পরিমাণ পটাশিয়াম সায়ানাইড ছিল, এক একটা ঘোড়া মারবার পক্ষে তা যথেষ্ঠ। মনে হয় তোমার অন্য দোকান থেকে ফল কেনা উচিত। শুভেচ্ছা সহ–প্লেডেল স্মিথ।

টেলিগ্রামটিকে বন্ড পুড়িয়ে ফেলল।

কোয়ারেল একটা নৌকা ভাড়া করে তিনদিন ধরে তা চালানো রপ্ত করল। নৌকায় আছে দুজন দাড়ি বসবার জায়গা, দুটো দাঁড়, ক্যানভাসে তৈরি একটা ময়লা পাল।

সাত কি আট ঘণ্টা ক্যাপ্টেন। তারপর পাল নামিয়ে আমরা দাঁড় বাইব। রেডারের পক্ষে আমাদের ধরা তাহলে আরও শক্ত হবে।

সন্ধ্যা হল। বন্ড খুশি হল, যাক শেষ পর্যন্ত এগোতে পেরেছে। তার নিয়মিত ব্যায়াম থেকে সে মাত্র একবার বেরিয়েছিল, জিনিসপত্র কিনতে। আর কোয়ারেলের জীবন বীমা করাতে। সে স্বীকার করেছিল যে এই অ্যাডভেঞ্চারে বেশ উত্তেজনা আছে। এতে সব উপাদান আছে দৈহিক পরিশ্রম, রহস্য আর একজন নির্দয় শত্রু। তার সঙ্গীটিও চমৎকার। M বলেছিলেন সূর্যের আলোয় ছুটি উপভোগ করতে। তার মুখের মত জবাব হবে এটা।

জ্বলন্ত সূর্য সুন্দরভাবে অবলুপ্তির পথে চলেছে।

বন্ড তার শোবার ঘরে গিয়ে দুটো পিস্তল বার করল। বেরেটার মত কোনটাই নয়। কিন্তু এই দুটো পিস্তল নাকি বেরেটার চেয়ে ভাল। কোনটাকে সে সঙ্গে নেবে? শেষ পর্যন্ত বেশি ভারি স্মিথ অ্যান্ড ওয়েগন-টাকেই নিতে হল। ক্র্যাবে-কী-তে গুলি যদি চালাতেই হয় তাহলে তা দূর থেকে চালানোরই সম্ভাবনা। ওয়ালথার এর চাইতে এটার গুলি আরো পঁচিশ গজ বেশি ছোটে। বন্ড বেল্টের সঙ্গে পিস্তলের খাপটাকে ঝুলিয়ে নিল। পকেটে গুলি নিল কুড়িটা।

বন্ড বরফের বাক্স থেকে এক পাইট ক্যানাডিয়ান ক্লাব হুইস্কি আর কিছু বরফ ও সোডা ওয়াটার সঙ্গে নিয়ে বাগানে গিয়ে বসে সূর্যের শেষ রক্তরেখা দেখতে লাগল।

সমুদ্রের তীর থেকে কোয়ারেন্স এসে বলল, সময় হল ক্যাপ্টেন।

বন্ড পানীয় শেষ করে কেম্যান দ্বীপের লোকটির সঙ্গে নৌকার দিকে গেল। দু জন নৌকার দু প্রান্তে বসল। গোটানো পালটা পেছনে রইল। বন্ড বৈঠা নিয়ে নৌকা ছেড়ে দিল। দুজন মিলে সহজেই নৌকা চালাতে লাগল। এখন অন্ধকার। তারা চট করে ডাঙা ছেড়ে সমুদ্রে এসে পড়েছে।

বন্ডের কাজ এখন কেবল চালিয়ে যাওয়া। কোয়ারেল হাল ধরে আছে। বার বার বন্ডের বৈঠা পাথরের সঙ্গে ঠুকে যেতে লাগল। অনেকটা তলায় নীল রঙের বালি দেখা গেল। আর তারা এসে পড়ল গভীর সমুদ্রের ভারি পানিতে।

কোয়ারেল বলল, ঠিক আছে ক্যাপ্টেন। বন্ড বৈঠা তুলে বসল আর কোয়ারেল পাল টাঙাল। গতির ফলে ঠাণ্ডা হাওয়া এসে মুখে লাগছে। আরও বেশি ঠাণ্ডা লাগবে এরপর। বন্ড হাত গুটিয়ে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বসল।

নৌকার কাঠ বন্ডের পিঠে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে। সে বুঝল রাত্রিটা বড় কষ্টে কাটবে।

অন্ধকারে বন্ড পৃথিবীর কিনারা দেখতে পেল। কুয়াশার একটা স্তর, তার পরেই তারাদের রাজত্ব। কতগুলো তারা? তারাগুলোর আলোতে সমুদ্রটাকে একটা রাস্তার মত দেখাচ্ছে। বারটার সময় অর্ধেক পথ পেরিয়ে যাবে তারা। তখন বন্ডের নৌকা বাইবার পালা।

একটা ঠং করে আওয়াজ হতে বন্ডের ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘড়িতে তখন বারটা বেজে পনের মিনিট। বন্ড বলল, আমি দুঃখিত কোয়ারেল, আগে জাগাওনি কেন?

তাতে কি হয়েছে? আপনার তো ঘুমোনো দরকার।

জায়গা বদল করল তারা। বন্ড হাল ধরল। বন্ড এমনভাবে নৌকাটাকে ঘুরিয়ে নিল যে, কোয়ারেলের ঘুমন্ত মাথার ওপর রইল ধ্রুব তারাটি।

 রাত্রির রূপ একই রকম রইল–কেবল অন্ধকার আরও ঘন হল। আরো যেন শূন্য মনে হল। বৈঠাতে ফসফরাস লেগে গিয়ে ঝরে পড়তে লাগল হীরে মুক্তার মত। একঝাক উড়ন্ত মাছ নৌকাটির সামনে থেকে পানি ভেদ করে উঠে পড়ল, তারপর ফাটা বোমার টুকরোর মত ছড়িয়ে পড়ল। নৌকার পাশে পাশে কয়েকটা উড়তে লাগল কিছুক্ষণ। বোটের শতশত ফ্যাদাম নিচে কত কিছুই হচ্ছে হয়ত। বড় বড় মাছ-হাঙর, ব্যারাকুড়া, টারপন, সেলফিন, হাজার হাজার ম্যাকারেল, কিংফিশ, বনিটো, আর তলায় জেলির মত নরম, কাঁটাহীন অজানা সব মাছ যাদের কখনো দেখা যায় না।

যদি হঠাৎ একটা বড় ঢেউ এসে নৌকাটা ডুবিয়ে দেয়? তারা কতক্ষণ বেঁচে থাকতে পারবে? চারটে বাজল, কোয়ারেল জেগে উঠে দিকে তাকিয়ে বলল, মাটির গন্ধ পাচ্ছি হুজুর। একটু পরেই সামনে অন্ধকারটা যেন আরো জমাট মনে হল। তাদের পেছনে এবার মাইল দুয়েক দূরের দ্বীপটাকে স্পষ্ট দেখা গেল। কানে ভেসে এল ভেঙে পড়া ঢেউ-এর ক্ষীণ আওয়াজ।

আবার তারা জায়গা বদল করল। কোয়ারেল পাল নামিয়ে দিল, আর দু জনেই বৈঠা ধরল। আর একমাইল তারা ঢেউয়ের আড়ালে যেতে পারবে। শেষ মাইলটা অবশ্য তাড়াতাড়ি যেতে হবে। ভোর হতে দেরি নেই।

এবার সেও মাটির গন্ধ পেল। বিশেষ কোন গন্ধ নয়, তবে ঘন্টার পর ঘণ্টা সমুদ্রের ওপর থাকার পর একটা নতুন গন্ধ লাগল নাকে। ঢেউগুলো ক্রমশ রুক্ষ হয়ে উঠছে। কোয়ারেল বলল, এইবার হুজুর। এখন মনে হচ্ছে নৌকাটা আর যেন এগোচ্ছে না। বন্ডের কাঁধ দারুণ ব্যথা করছে। তার হাত প্রায় অবশ। বৈঠাটা যেন সিসে দিয়ে তৈরি।

সাংঘাতিক অবস্থা। কিন্তু তবু তারা কোনক্রমে এগোল। পাথরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে তারা একটা ঢোকবার রাস্তা খুঁজল। একশ গজ দূরে বালিগুলোকে দুভাগ করে দিয়ে একটা স্রোতরেখা দ্বীপের দিকে গেছে। নদী। তাহলে ঠিক জায়গাতেই তারা এসেছে। কোয়ারেল হালের সাহায্যে নৌকো নিল পাথুরে জায়গার দিকে, যেখানে তটভূমি শেষ হয়েছে।

এবারে তাড়াতাড়ি হাত চালানোর পালা। তারা নৌকাটিকে আরও কুড়িগজ টেনে নিয়ে গেল গুল্মঝোঁপের মধ্যে। নৌকাটাকে সমুদ্রের শুকনো লতাপাতা আর ভেসে আসা কাঠের টুকরো দিয়ে ঢেকে ফেলল। তারপর তালপাতার ঝাটা দিয়ে বালির ওপরকার সব চিহ্ন মুছে দিল।

এখনও আকাশ পরিষ্কার হয়নি। পাঁচটা বাজে। কোয়ারেল পাথরের ফাঁকে আর বন্ড একটা জায়গায় শুকনো বালি খুড়ে শোবার জায়গা করল। কাছেই কয়েকটা তপস্বী কাঁকড়া ঘুরছে। কতরকম পোকামাকড় যে তার গায়ের গন্ধ পেয়ে আসতে পারে তা একবারও ভাবল না। সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ল সে।

.

অপরূপা ঊর্বশী

বন্ডের ঘুম ভাঙল। বালির ছোঁয়ায় তার মনে পড়ল যে সে কোথায় এসেছে। দশটা বাজে। সূর্যের উষ্ণ আলো আসছে সামুদ্রিক আঙুরের মোটা পাতার ভেতর দিয়ে। সামনে দিয়ে একটা বড় ছায়া মত সরে গেল। কোয়ারেল না কি? বন্ড তার মাথা সরিয়ে বাইরেটা দেখে। তার হৃদপিণ্ড মুহূর্তের জন্য বন্ধ হয়েই জোরে ধক্ আওয়াজ করতে লাগল।

একটি অনাবৃত মেয়ে, তার দিকে পেছন ফেরা। সম্পূর্ণ নগ্ন নয়। কোমরে চওড়া একটা চামড়ার কোমর বন্ধ, তার ডান দিকে ঝুলছে একটা শিকারী ছুরি-চামড়ার খাপে মোড়া। মেয়েটি তার থেকে পাঁচ গজ দূরে দাঁড়িয়ে নিজের হাতে কি যেন দেখছে। প্রাচীন ভাস্কর্যের নগ্ন নারীমূর্তির মত দাঁড়িয়ে-শরীরের ভার তার ডান পায়ে আর বাঁ পায়ের হাঁটুটা ভেতরের দিকে একটু বেঁকে রয়েছে।

ভারি সুন্দর পেছনের দিকটা। গায়ের রঙ হালকা কফি রঙের মত, আর পায়ের গোছাটা মেটে রঙের সার্টিনের মত। শিরদাঁড়ার গভীর খাঁজ দেখে শরীরের অসাধারণ শক্তি বোঝা যায়। নিতম্বদেশ অনেকটা কম বয়সী ছেলেদের মত নিটোল।

ধূসর সোনালি ভিজে চুল ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে। কপালের ওপর তোলা পানির নিচের মুখোস। সবুজ রবার দিয়ে চুলগুলো পেছন দিকে বাঁধা। পেছন দিকে থেকে বত্তিচেলি ভেনাসের মত দেখাচ্ছে।

এখানে মেয়েটি এল কি করে? করছেটা কি? বেলাভূমিটা একবার চোখ বুলিয়ে নিল বন্ড। শুধু বালির ওপর বেগুনী রঙের কি সব রয়েছে, তাছাড়া কোথাও কিছু নেই। বন্ডের মনে হল সেগুলো ঝিনুক কিংবা শামুক। বাঁ দিকে তাকাল বন্ড। কুড়ি গজ দূরে দ্বীপের পাহাড় শুরু হয়েছে। হ্যাঁ, লতাগুলোর মধ্যে লুকিয়ে রাখা আছে একটা নৌকা। নৌকোটা নিশ্চয়ই হালকা, নইলে মেয়েটির পক্ষে সেটাকে এতদূর টেনে আনা সম্ভব হত না। একজোড়া পায়ের ছাপ চলে গিয়েছে। শিলা থেকে পানির দিকে, আবার পানি থেকে ঠিক যেখানে মেয়েটি দাঁড়িয়ে। মেয়েটি কি এখানেই থাকে না জ্যামাইকা থেকে নৌকা বেয়ে এসেছে? কি করছে মেয়েটা?

যেন বন্ডের প্রশ্নেরই জবাবে মেয়েটি কি যেন ছুঁড়ে ফেলল ডাত হাত দিয়ে, আর কয়েকটা ঝিনুক ছড়িয়ে পড়ল বালিতে। সেগুলো গভীর বেগুনী রঙের। মেয়েটা আস্তে আস্তে শিস দিল। গানটির নাম মারিয়ন। কেবল জ্যামাইকাতে নয় তার বাইরেও গানটি জনপ্রিয়।

হঠাৎ মেয়েটি গান বন্ধ করল। বন্ড হেসে শিস দিয়ে গানটাকে সম্পূর্ণ করবার চেষ্টা করল।

মেয়েটার দুটো হাত বুকের ওপর চলে এল। মেয়েটা শুনছে। তার মুখ এখনো এলোচুলের আড়ালে।

একটু দ্বিধার সঙ্গে সে আবার গান ধরল। চকিতে বন্ডের দিকে মেয়েটি ফিরে দাঁড়াল। এবারে একটা হাত নিচের দিকে, অন্যটি মুখের ওপর ঠিক চোখের নিচে। ভীতিবিহ্বল কণ্ঠে সে বলল, কে?

সামুদ্রিক আঙুরলতা সরিয়ে বন্ড বেরিয়ে এল। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, আমি আর একজন অনুপ্রবেশকারী। ভয় পাবার কিছু নেই।

মেয়েটা মুখ থেকে হাত নামিয়ে কোমর বন্ধের ছুরির হাতলের ওপর রাখল। মুখটা ভারি সুন্দর। গভীর নীল চোখ, চওড়া ঠোঁট, থুতনির রেখা কঠোর। স্বাধীনচেতা মেয়েদের মত মুখ। তার নাকটা থ্যাবড়ানো। মুষ্টিযোদ্ধার নাকের মত। এত সুন্দর মেয়েটাকে কে এমন করে মারল?

মেয়েটি বলল, আপনি কে? এখানে কি করছেন? সুরে জ্যামাইকার টান।

আমি একজন ইংরেজ। পাখি সম্বন্ধে আগ্রহ আছে আমার।

 মেয়েটি বলল, ও, কতক্ষণ ধরে আমাকে লক্ষ্য করছেন আপনি? এখানে এলেন কেমন করে?

 দশ মিনিটের মত হবে। কিন্তু এবার তুমি যদি না বল তুমি কে তাহলে আমি আর একটা কথা বলব না।

আমি তেমন কেউ নই। জ্যামাইকায় থাকি, ঝিনুক কুড়োই।

আমি একটা নৌকায় এসেছি, আর তুমিও বোধহয়।

হ্যাঁ। আপনার নৌকাটা কোথায়?

 আমার এক বন্ধু আছে। দুজনে মিলে সেটা গুল্মের ভেতর রেখেছি।

 কিন্তু বালিতে তো কোন নৌকার চিহ্ন নেই?

আমরা সাবধানে কাজ করেছি। তোমারও সাবধানী হওয়া উচিত ছিল। নৌকায় পাল কি তুলে এসেছ না কি? নিশ্চয়ই, বরাবর তো তাই করি।

তাহলে তারা জেনে গেছে তুমি এখানে এসেছ। তাদের কাছে রেডার আছে।

এখনো ধরতে পারেনি। আপনার নাম কি?

বন্ড। জেমস বন্ড, আর তোমার নাম?

রাইডার।

রাইডার তো পদবী। নামটা কি?

হানিচাইল।

বন্ড হাসল।

হাসবার কি হল?

কিছু না। হানিচাইল রাইডার। সুন্দর নাম।

লোকে আমাকে হানি বলে ডাকে।

 তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে আনন্দিত হলাম।

পরিমার্জিত কথাটা শুনে মেয়েটির মনে পড়ল যে সে বিবস্ত্রা। লজ্জায় লাল হয়ে, আমি পোশাক পরে আসি। আমি গেলে কিন্তু একটি ঝিনুকও নেবেন না।

কোন চিন্তা কোর না। আমি পাহারা দিচ্ছি।

সৈকত ধরে কয়েক পা এগিয়ে বন্ড একটা ঝিনুক কুড়িয়ে নিল। জীবন্ত ঝিনুক-দুটি অংশ এঁটে বন্ধ রয়েছে। গোলাপী রঙ। কজার দু ধারে সরু শুড় বেরিয়ে আছে।

ঝিনুকগুলোর দিকে তাকিয়ে বন্ড ভাবল, মেয়েটি কি সত্যিই ঝিনুক সংগ্রহ করতে এসেছে? জায়গাটা মারাত্মক, মেয়েটি একা। আবার বলছিল, এখনো তো ধরেনি। মেয়েটির রাণীর মত ব্যবহার আর আক্রমণের কায়দা বড় সুন্দর। থাকে কোথায় মেয়েটি তার বাবা মা কে? কেমন যেন অবহেলিত মেয়েটি।

বন্ড মেয়েটির পায়ের আওয়াজে ফিরে তাকাল। ওর পোশাক শতছিন্ন বিবর্ণ। হাতা ছেঁড়া বাদামি রঙের শার্ট আর হাঁটু পর্যন্ত নামা ছেঁড়া, জোড়া তালি দেওয়া একটা স্কার্ট। একটা ক্যানভ্যাসের ব্যাগ তার কাঁধে ঝোলানো।

মেয়েটি এসেই বালির ওপর বসে ঝিনুক কুড়িয়ে ব্যাগে ভরতে লাগল।

বন্ড বলল, এ ঝিনুক কি তেমন পাওয়া যায় না?

আপনি যদি প্রতিজ্ঞা করেন কাউকে বলবেন না, তাহলে বলতে পারি।

প্রতিজ্ঞা করলাম।

বেশ, তাহলে বলি : এই ঝিনুকগুলো সহজে পাওয়া যায় না, আর বেশ দামী। এইরকম এক একটা ঝিনুক পাঁচ। ডলারে বিক্রি হয় মায়ামিতে। সেখানেই, আমি এগুলো বেচি। এদের বলে ভেনাস এলিগানস্। বা দ্য এলিগ্যান্ট– ভেনাস। আজ সকালে আমি ওদের আড্ডা আবিষ্কার করেছি। অবশ্য আপনি সে জায়গা খুঁজে পাবেন না। অনেক। গভীরে লুকানো আছে, আর আজই সবচেয়ে ভালগুলো তুলে নেব।

বন্ড বলল, আমি প্রতিজ্ঞা করছি একটাও চুরি করব না। সৃষ্টিকর্তার দিব্যি।

 আর আপনার পাখিগুলো কি জাতের? তারা কি দুষ্প্রাপ্য! এসব না জানলে আমিও আর কিছু বলব না।

পাখিগুলোর নাম রোজেন্ট শুনবিল, চ্যাপ্টা ঠোঁটওয়ালা গোলাপী সারসের মত দেখতে। দেখেছ নাকি?

ও ঐগুলো? এখানে হাজার হাজার ঐ পাখি ছিল। এখন সব ভয় পেয়ে পালিয়ে গেছে। মেয়েটি বালির ওপর। বসল, যেন এই লোকটাকে ভয় পাবার কিছুই নেই।

বন্ড বসল একগজ দূর আধশোয়া অবস্থায়, একটা কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে। বন্ড সহজভাবে বলল, সত্যি! কি হয়েছিল? কে ভয় দেখাল তাদের?

এখানকার লোকেরাই ভয় দেখিয়েছে। একটা চীনেম্যান এখানে আছে। তার আবার ড্রাগন আছে। সেই ড্রাগনটিকে পাখির পেছনে লাগিয়েছিল। ভয়ে তারা পালিয়েছে আর তাদের বাসাগুলো জ্বালিয়ে দিয়েছে এই ড্রাগনটা। দুজন লোক পাখিগুলোর সঙ্গে থাকত। তারা পালিয়েছে, না হয় মারা গেছে না হয় অন্য কিছু হয়েছে।

এই ড্রাগনটা কেমন দেখতে তুমি দেখেছ ওটাকে?

হ্যাঁ, দেখেছি। আমি গত প্রায় একবছর ধরে এখানে আসছি, ঝিনুকের খোঁজে। মাত্র এক মাস আগে আমি ওগুলোর খোঁজ পেয়েছি। তবে অন্যান্য ভাল জাতের ঝিনুকও আমি পেয়েছি। বড়দিনের কিছু আগে আমি নদী গর্ভটা খুঁজে দেখব বলে নদী বেয়ে অনেকটা উঠে গেলাম যেখানে পাখিদের দুই রক্ষকের তাবু ছিল। দেখলাম তাবুটা পুড়ে গেছে। অনেক রাত হয়েছিল বলে আমি বাকি রাতটা ওখানেই কাটাব ভাবলাম। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল, দেখি ড্রাগনটা আসছে। আমার চেয়ে অল্প দূরে দাঁড়িয়ে, বিরাট দুটো জ্বলন্ত চোখ আর লম্বা নাক। কেমন ছোট ছোট একজোড়া পাখা আর উঁচলো ল্যাজ। সমস্ত গায়ের রংটা কালো আর সোনালি মেশানো।

বন্ডের মুখের ভাব দেখে মেয়েটা জ কোঁচকালো, সেদিন পূর্ণিমা ছিল। আমি ওটাকে স্পষ্ট দেখেছি। কেমন একটা গর্জনের মত আওয়াজ করতে করতে আমার পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। একঝাক পাখি তার সামনে পড়তেই হঠাৎ তার মুখ দিয়ে অনেকখানি আগুন বেরিয়ে এল। অনেকগুলো পাখি পুড়ে গেল। যে সব গাছে তারা বাসা বেঁধেছিল, তাতেও আগুন ধরে গেল। কি বীভৎস ব্যাপার, আমি জীবনে দেখেনি।

বুঝতে পারছি আপনার বিশ্বাস হল না। আপনি যে শহরের লোক। আপনারা তো কিছুই বিশ্বাস করেন না।

দেখ হানি, ড্রাগন বলে পৃথিবীতে কোন জিনিস নেই। তুমি যেটাকে দেখেছিলে সেটা অনেকটা ড্রাগনের মত দেখতে। বুঝতে পারছি না বস্তুটি কি হতে পারে।

আপনি কি করে জানলেন ড্রাগন বলে কিছু নেই? দ্বীপের এদিকে কেউ থাকে না। একটা ড্রাগন তো এখানে থেকেও যেতে পারে। আর জন্তু-জানোয়ার সম্বন্ধে আপনি কতদূর জানেন মশাই? ছোটবেলা থেকে আমি সাপ আর পোকামাকড়দের সঙ্গে বাস করি। একলা। আপনি কি দেখেছেন একটা শিকারী মাকড়সা প্রেম করবার পর তার স্বামীকে খেয়ে ফেলে? বেজীর নাচ বা অক্টোপাসের নাচ দেখেছেন কখনো? একটা হামিং বার্ড-এর জিভ কতটা লম্বা হয় জানা আছে আপনার? কোনদিন সাপ পুষেছেন, যার গলায় একটা ঘন্টা বাধা থাকবে আর সেইটে বাজিয়ে রোজ সে আপনার ঘুম ভাঙাবে? কখন কাঁকড়া বিছের সানস্ট্রোক হতে দেখেছেন? দেখেছেন তখন তারা নিজের গায়ে হুল ফুটিয়ে আত্মহত্যা করে? জানেন আপনি এক ধরনের কাক এক মাইল দূর থেকে একটা মরা টিকটিকির গন্ধ পায়? হতাশ ভাবে বলল, উঃ, আপনি ঠিক ঐ আর সব শহুরে লোকগুলোর মত।

বন্ড বলল, দেখ হানি, তুমি তো সবই জানো। শহরে থাকা ছাড়া আমার কোন উপায় নেই। এইসব বিষয়ে আমি খুবই আগ্রহী। কিন্তু আমার জানা আছে, যেমন…। তোমার আগের অভিযানগুলোর চেয়ে এবারের আসাটা নিয়ে ঐ চীনে ভদ্রলোক অনেক বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। এবার তিনি চেষ্টা করবেন যাতে তুমি এই দ্বীপের থেকে আর ফিরে যেতে না পার। আর আমিও যাতে ফিরে যেতে না পারি।

মেয়েটি আগ্রহের সুরে, তাই নাকি? কিন্তু কেন? দিনের বেলাটা লুকিয়ে রাত্তিরে পালিয়ে গেলেই হল। সে একবার আমার পেছনে একটি কুকুর লেলিয়ে দিয়েছিল আর একবার প্লেন পর্যন্ত পাঠিয়েছিল। কিন্তু এখনও আমাকে ধরতে। পারেনি। তবে কি সে আসলে আপনাকে ধরতে চাইছে?

বন্ড বলল, তা বলতে পার, ব্যাপারটা সেই রকমই মনে হচ্ছে। মনে হয় চীনেটা আগে থেকেই জানত যে আমরা আসব। তোমার নৌকার পাল দেখে ভেবেছে ওটাই আমাদের নৌকা। আমি বরং আমার বন্ধুকে ডাকি, ওকে তোমার ভাল লাগবে। কেম্যান দ্বীপের লোক, নাম কোয়ারেল।

মেয়েটা বলল, দেখুন, আমি দুঃখিত যে…আমি তো এর কিছু জানতাম না।

বন্ড আশ্বাসের সুরে বলল, অবশ্যই তোমার পক্ষে এ সব জানা সম্ভব ছিল না। আমার মনে হয় না সে একটা ঝিনুক কুড়ানো মেয়েকে নিয়ে মাথা ঘামাত। কিন্তু আমার সম্বন্ধে লোকটির মনোভাব আলাদা। এখন সে তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করে আমাকে আটকে ফেলবে এবং তোমাকেও। দেখা যাক কোয়ারেল কি বলে? তুমি এখানেই থেকো।

বন্ড পাথুরে জায়গাটা চারদিক খুঁজে দেখল। তাকে খুঁজে বার করতে বন্ডের পুরো পাঁচ মিনিট সময় লাগল। দুটো বড় পাথরের খাঁজের মধ্যে সে শুয়েছিল। বন্ড আস্তে শিস্ দিল। বন্ডকে দেখতে পেয়ে কোয়ারেল চটপট উঠে দাঁড়াল। সুপ্রভাত ক্যাপটেন। খুব গভীরভাবে ঘুমুচ্ছিলাম।

স্বপ্নে সেই চীনে মেয়েটা আমার কাছে এসেছিল।

বন্ড হেসে বলল, আমার কাছে আর একজন এসেছে। বন্ড তাকে হানিচাইল, তার ঝিনুক, আর তাদের বিপদের কথা সব বলল, এখন এগারোটা বাজে, আমাদের নতুন একটা প্ল্যান তৈরি করতে হবে।

এই মেয়েটাকে পানির মধ্যে ফেলে দেবার মতলব নেই তো আপনার? আমাদের অভিযানে ওর জন্য কোন অসুবিধা হবে না বলেই…। হঠাৎ সে থেমে গেল। একটা হাত তুলে বন্ডকে চুপ করে থাকতে বলে সে খুব মন দিয়ে কি যেন শুনতে লাগল।

বন্ড নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুনল। অনেক দুরে পুব দিকে অস্পষ্ট ঘড় ঘড় আওয়াজ।

কোয়ারেল এক লাফে উঠে দাঁড়াল, শিগগির ক্যাপ্টেন, তারা আসছে।

.

অল্পের জন্য বেঁচে যাওয়া

দশ মিনিট পরে উপসাগরটাকে দেখাচ্ছিল ফাঁকা এবং পরিষ্কার আয়নার মত স্থির। পানির বুকে ছোট ছোট ঢেউগুলো অলসভাবে পাক খাচ্ছিল। ফেলে দেওয়া ঝিনুকের স্তূপটা অপসারিত হয়েছে, বালির ওপর পায়ের ছাপও আর নেই। গাছের ডাল কেটে কোয়ারেল সৈকতটাকে ঝাট দিয়েছে। মেয়েটির নৌকা আরো ভেতরে পাথরের মধ্যে টেনে নিয়ে গিয়ে সামুদ্রিক লতাপাতা দিয়ে ঢাকা হয়েছে।

কোয়ারেল উঁচু পাথুরে জায়গাটায় ফিরে গেল। বন্ড আর মেয়েটা উপুড় হয়ে শুয়ে রইল কয়েক ফুটের ব্যবধানে। সামুদ্রিক ঝোঁপটার আড়ালে। তারা দুজনে চুপ করে তাকিয়ে রইল নদীর বাঁকটার দিকে, যেটা ঘুরে শত্রুদের বোটটাকে আসতে হবে।

জোড়া ডিজেলের ইঞ্জিনের আওয়াজ শুনে বন্ড অনুমান করল যে তটরেখার প্রতিটি খাঁজ ওরা খুঁজে দেখতে দেখতে আসছে। বোধহয় একটা বড় কেবিন ক্রুজার। কতজন ওটাতে থাকতে পারে? অনুসন্ধানের পরিচালনাই বা করছে কে? ডক্টর নো? মনে হয় না।

পশ্চিম দিকে এক ঝাঁক পাখি দেখা গেল। দ্বীপের অপর প্রান্তে যে গুয়ানে পাখিদের বসবাস আছে তার এই প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেল সে। পাখিগুলো ডানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে পানির মধ্যে ডুব দিল। পানটাকে ভেদ করল একঝাঁক গুলির মত। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পশ্চিম দিগন্তে নতুন এক ঝাঁক পাখি দেখা গেল। তারপর আরেক ঝক, আবার এক ঝাক সবটা মিলিয়ে যেন একটা দীর্ঘ সারি। তারপর কয়েক একর সমুদ্র জুড়ে ডুব দিল। চেঁচামেচি মারামারি করে তারা পানির নিচে পাখা ডুবিয়ে আনচোভি মাছ খেতে লাগল। যেন একদল পিরানহা মাছ খাচ্ছে একটা ডোবা ঘোড়াকে।

মেয়েটা বন্ডকে আস্তে একটু ধাক্কা দিল। ঐ দেখুন, চীনে লোকটার মুরগীগুলো খাবার খাচ্ছে।

বন্ড দেখল অনুসন্ধানের জন্য লোক এসে পড়াতেও মেয়েটাকে তেমন উদ্বিগ্ন মনে হল না। তার কাছে এটা একটা লুকোচুরি খেলা ছাড়া কিছু নয়।

ডিজেল দুটোর ধকধক আওয়াজ আরও স্পষ্ট হল। বোটটার উঁচলল অগ্রভাগ দেখা দিল। তারপর দশ গজ পালিশ করা নির্জন ডেক, কাঁচের ওয়াইনড় শীল্ড সাইরেন ও ভোলা রেডিওর মাস্তুল লাগানো একটা নিচু কেবিন। স্ট্রিয়ারিং হুইলের পেছনে বসা লোকটিকে এক মুহূর্তের জন্য দেখা গেল। বন্ড চিনল, ব্রিটিশ মোটর টপেডো বোট। গত যুদ্ধের উদ্ধৃত্ত মাল।

বোটের পিছনে দাঁড়িয়ে লোক দুটি হলদে চামড়ার নিগ্রো। পরনে খাকি হাফপ্যান্ট ও শার্ট, কোমরে চওড়ার বেল্ট। মাথায় খড়ের তৈরি বেসবল খেলবার টুপি। পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিল তারা। একজনের হাতে লম্বা তার লাগানো লাউডস্পীকার, আর অন্য জনের সামনে ত্রিপদের ওপর বসানো একটা মেশিনগান।

প্রথম লোকটি লাউডস্পীকার নামাল। একটা বাইনোকুলার তুলে সমস্ত বেলাভূমিটা খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। তাদের মৃদু কথাবার্তার শব্দ শোনা গেল।

বাইনোকুলারের একজোড়া চোখ পাথুরে জমি থেকে সমস্ত বালিটার ওপর দিয়ে ঘুরে গেল। এবার তাদের কথাবার্তা এক পর্দা উঁচুতে উঠল। লোকটি মেশিনগানওয়ালাকে দূরবীন দিল। সে চট করে একবার দেখে নিয়ে দূরবীন ফেরত দিল। পর্যবেক্ষকটি চালককে চেঁচিয়ে কিছু নির্দেশ দিল। কেবিন ক্রুজারটি থেমে গিয়ে অল্প পিছিয়ে এল। এবার বোটটা বন্ড আর মেয়েটির ঠিক সামনে। গভীর পানিতে ভাসছে। পর্যবেক্ষক আবার দূরবীন তুলে তাকাল পাথরগুলোর দিকে, যার ফাঁকে মেয়েটার নৌকোটা লুকিয়ে রাখা হয়েছে। মেশিনগানওয়ালা আরেকবার দূরবীনটা নিয়ে সেদিকটা দেখে নিল, ওদের মধ্যে কি কথাবার্তা হল এবং নিশ্চিতভাবে ঘাড় নাড়ল।

বন্ড ভাবল হয়ে গেল আমাদের। লোকদুটো যথেষ্ট ওস্তাদ। এবার প্রথম লোকটা লাউডস্পীকার মুখের কাছে তুলে গর্জে উঠল। তার গলা, ঠিক আছে, বন্ধুগণ, সোজা বেরিয়ে এসো। আমরা গুলি চালাচ্ছি না।

শিক্ষিত লোকের গলা–কথায় একটু আমেরিকান টান। শোন বন্ধুগণ, একটু চটপট কর। আমরা দেখতে পেয়েছি কোনপথে তোমরা তীরে উঠেছে। তোমাদের নৌকাটাকে দেখেছি আমরা। ধীরে সুস্থে হাত দুটো মাথার ওপর তুলে বেরিয়ে এসো। তোমাদের কোন ক্ষতি হবে না।

বন্ড মেয়েটার শার্টের হাতা ধরে টানল। ফিসফিসিয়ে বলল, কাছে সরে এসো, তাতে গুলি লাগার সম্ভাবনা কম।

বন্ড অনুভব করল মেয়েটার উষ্ণ শরীর। বালি খুঁড়ে ঢোকবার চেষ্টা কর। যতটা ঢুকতে পার ততটাই লাভ।

আবার লাউডস্পীকারের শব্দ, ঠিক আছে দোস্ত। তাহলে দেখ এ জিনিসটাকে শোভাবর্ধনের জন্য আনা হয়নি। ভেসে এল স্পনডাউ মেশিনগানের তীব্র কটকট শব্দ। যেটা বন্ড শেষবার শুনেছিল আর্ডেনস-এর রণক্ষেত্র জার্মান শিবির থেকে। অনেকটা মাথার ওপর দিয়ে গুলি বেরিয়ে গেল। তারপর সব নিস্তব্ধ।

বন্ড দেখতে পেল পাখির ঝাঁক আকাশে উঠল। গোলন্দাজটি মেশিনগানের নলে হাত দিয়ে দেখছে গরম হল কিনা। দু জনে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে আবার লাউডস্পীকার তুলে নিল।

ঠিক আছে দোস্ত। তোমাদের সতর্ক করেছিলাম, এবার মর।

বন্ড লক্ষ্য করল নলটা এবার নিচের দিকে নামল। পাথরের খাঁজে লুকানো নৌকাটার ওপর গুলি চলবে। বন্ড মৃদুকণ্ঠে মেয়েটিকে বলল, ঘাবড়িও না হানি। মাথা নিচু করে থাক। অল্পক্ষণের ব্যাপার। মেয়েটা বন্ডের হাত চেপে ধরল। বন্ড ডানদিকে ঘেষে মেয়েটার মাথা আড়াল করে নিজের মাথাটা বালির মধ্যে ডুবিয়ে দিল।

এবার গুলির আওয়াজ এল ভীষণ জোরে। শিসকেটে ঠিকরে যেতে লাগল বুলেটগুলো। আর সব কিছুর পেছনে শোনা যাচ্ছে মেশিনগানের কটাকট শব্দ।

বন্ড ভাবল, এবার আমাদের দিকে গুলি আসবে। মেয়েটা তাকে আঁকড়ে ধরে রয়েছে, সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপছে। বন্ড হাত বাড়িয়ে তাকে আরও কাছে টানল।

আবার গুলি বৃষ্টি শুরু হল। তটরেখা অতিক্রম করে শিস কেটে ছুটে আসতে লাগল ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি। তাদের মাথার ওপরের ঝোঁপটা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে তাদের সর্বাঙ্গ ঢেকে দিল। ঠাণ্ডা হাওয়ার গন্ধ পেল বন্ড, অর্থাৎ তারা এখন খোলা জায়গায় শুয়ে। আর মিনিট খানেকের মধ্যে গুলি বর্ষণ থেমে গেল।

লাউডস্পীকারের চিৎকার শোনা গেল, আচ্ছা দোস্ত। এখন যদি শোনবার মত অবস্থা থাকে, তবে শোন যে, আমরা অল্পক্ষণের মধ্যেই মৃতদেহগুলো কুড়িয়ে নিতে আসছি। কুকুরগুলোও সঙ্গে থাকবে। আপাতত বিদায়।

ঝরাপাতার ভেতর দিয়ে বড় দেখল ডিজেলের মৃদু গর্জন করতে করতে বোটটি পশ্চিম দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

বন্ড সাবধানে মাথা তুলল। শান্ত উপসাগর। সে মেয়েটাকে টেনে তুলল। মেয়েটি ভীতি বিহ্বল কণ্ঠে বলল, কি ভয়ানক! ওরা কেন এমন করল? আমরা মারা পড়তাম একটুর জন্য।

বন্ড ভাবল এই মেয়েটার জগৎ বড় ছোট, চন্দ্র, সূর্য, ঋতুচক্রের গণ্ডীতে আবদ্ধ। বিপুল ক্ষমতা আর বিপুল অর্থের জন্য উঁচু সমাজের লোকেদের লড়াইয়ের খবর এর জানা নেই।

সব ঠিক আছে হানি। ওরা একদল খারাপ লোক। আমাদের ভয় পায় ওরা। ওদের আমরা ঠিকই জব্দ করতে পারব। আর তুমি সাহসের পরিচয় দিয়েছ। এবার এসো, কোয়ারেলকে খুঁজি, তাছাড়া এবার কিছু খাওয়া দরকার। এইরকম অভিযানে তুমি কি খাও?।

তারা সৈকত বেয়ে পাথুরে জমিটার দিকে চলল। মেয়েটা নিচু গলায় বলল, এখানে অজস্র খাবার আছে। বিশেষ করে সী আৰ্চ্চিন, বুনো কলা ইত্যাদি। এখানে আসবার আগে আমি দু দিন ধরে কেবল খাই আর ঘুমাই। তাই এখানে এসে বিশেষ কিছু প্রয়োজন হয় না।

সামনে কোয়ারেলকে দেখে বন্ড মেয়েটার কাঁধ থেকে হাত নামাল। ততক্ষণে দু জনে পৌঁছে গেছে সেখানে। দেখা গেল মেয়েটার নৌকা বুলেটের আঘাতে প্রায় দু টুকরো হয়ে গেছে। মেয়েটা হতাশ হয়ে বলল, আমার নৌকা। আমি এখন ফিরব কিসে?

চিন্তার কিছু নেই, মিস, নৌকা হারানোর শোকটা বন্ডের চেয়ে কোয়ারেল বেশি বুঝতে পারল। ক্যাপ্টেন তোমাকে একটা কিনে দেবে। আর ফেরবার সময় তুমি আমাদের নৌকায় যেতে পারবে। ঐ ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে আমাদের নৌকাটা ঠিক আছে। কোয়ারেল বন্ডের মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ দেখতে পেল। বলল, ক্যাপ্টেন, দেখলেন তো লোকগুলো কেমন? ভীষণ শক্ত মানুষ ওরা, আর কাজ জানে। ঐ কুকুরগুলো পুলিশের কুকুর–নাম পিনশার। বিরাট জানোয়ার। আমার এক বন্ধু বলেছিল এদের কাছে নাকি কুড়িটারও বেশি ঐ জাতের কুকুর আছে। আমাদের চটপট মতলব ভাজতে হবে।

ঠিক আছে কোয়ারেল। কিন্তু আগে কিছু খেতে হবে। আর এই দ্বীপটাকে ভালভাবে দেখবার আগে আমাকে কিছুতেই ভয় দেখিয়ে তাড়াতে পারবে না। হানি আমাদের সঙ্গেই থাকবে। তোমার কোন অসুবিধা হবে না তো হানি? তারপর আমরা একসাথে ফিরব।

মেয়েটি দ্বিধার সঙ্গে তার দিকে তাকাল, এছাড়া অন্য কোন উপায়ও তো দেখছি না। মানে, তোমাদের অসুবিধা হলে আমার ভালই লাগবে। কিন্তু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে তো? পাখিগুলো দেখে নিতে তোমার কত সময় লাগবে?

বন্ড বলল, বেশিক্ষণ নয়। আমি দেখতে চাই তাদের কি হয়েছে আর কেন হয়েছে। তারপরেই আমরা পালাব। বারটা। তুমি এখানেই অপেক্ষা কর। গোসলটা করে নিতে পার। ঘুরে বেড়িয়ে বালিতে পায়ের ছাপ ফেল না। এসো কোয়ারেল, আমরা বরং নৌকাটাকে আরো ভালভাবে লুকিয়ে রাখি।

সব কাজ শেষ করতে তাদের একটা বেজে গেল। বন্ড আর কোয়ারেল নৌকাটাকে বালি আর পাথর দিয়ে ভর্তি করে ঝোঁপের মধ্যে অগভীর পানিতে ডুবিয়ে দিল। তাদের পায়ের ছাপ সব মুছে দিল। সঙ্গে আনা খাবারের কিছুটা খেয়ে নিল তারা। মেয়েটা অল্প কিছু খেল। তারপর তারা পাথর ডিঙিয়ে নদীগর্ভের অগভীর পানিতে গিয়ে পড়ল। পানির ভেতর দিয়ে হাঁটতে লাগল সমুদ্রতীর থেকে তিনশ গজ দূরে নদীর উৎসের দিকে।

ভীষণ গরম। উত্তর পূর্বদিক থেকে একটা রুক্ষ হাওয়া বইছে। কোয়ারেল বলল এটা গুয়ানেরার পক্ষে অতি প্রয়োজনীয়, সারা বছর ধরেই এই হাওয়াটা নাকি বয়।

নদীর মুখে খানিকটা বালিভর্তি জায়গা। তারপরেই একটা লম্বা, গভীর, নিস্তরঙ্গ জলাশয়। কাপড় না খুললে তারা ভিজে যাবে। বন্ড বলল, হানি, এ সময়ে লজ্জা করলে চলবে না। আমরা কেবল শার্ট পরে থাকব সূর্যের তাপের জন্য। আমাদের পিছু পিছু এসো।

মেয়েটির জবাবের অপেক্ষায় না থেকে পুরুষ দু জন তাদের প্যান্ট খুলে পিঠের ন্যাপস্যাকে পুরল।

পানি কেটে চলল তারা। প্রথমে কোয়ারেল, তারপর বন্ড ও সবশেষে মেয়েটি। বন্ডের কোমর পর্যন্ত পানি। একটা বড় রূপালি মাছ পানি থেকে লাফিয়ে উঠেই আবার ডুব দিল। অন্যান্য মাছ এদিক ওদিক ছিটিয়ে পড়তে লাগল। টারপন মাছ। বলল কোয়ারেল।

নদী ক্রমশ ছোট হয়ে এল। দুদিকের ঝোঁপঝাড় পরস্পরকে স্পর্শ করল। কিছুক্ষণের জন্য তারা যেন একটা সুড়ঙ্গ দিয়ে চলল। তারপর আবার নদীটা চওড়া হয়ে একটা গভীর আঁকাবাঁকা প্রণালীতে রূপ নিয়েছে। নদীগর্ভ কাদায় ভর্তি, প্রতি পদক্ষেপে তাদের পা বসে যেতে লাগল। বার বার তাদের থেমে পড়ে পা থেকে জোক ছাড়াতে হচ্ছে। বন্ডের। ঠাণ্ডা, শান্ত ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে হাঁটতে ভাল লাগল। দেখতে দেখতে অনেকটা দূরে এসে পড়ল তারা। এবার মার্শ গ্যাসের পচা ডিমের মত গন্ধ পাওয়া গেল। গাছপালার সংখ্যা কমে আসছে। নদী অনেক চওড়া হয়ে গেছে, পানি আরো অগভীর আর নদী গর্ভ আরো শক্ত। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা বাঁক ঘুরে খোলা জায়গায় পৌঁছল। হানি বলল, এবার সাবধান হওয়া দরকার। আর এক মাইল এই রকম চলেছে, নদী সরু হয়ে মিশেছে বড় দীঘিটার সঙ্গে। তারই কাছে পাখিওয়ালা দুজন থাকত।

নদীর দু ধারে গাছের সারি। তারই ছায়ায় দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকাল তারা। নদীটা এঁকেবেঁকে দ্বীপের কেন্দ্রস্থলের দিকে চলে গেছে। দু ধারের নিচু বাঁশঝাড় আর সামুদ্রিক আঙুর গাছ তাদের অর্ধেকের বেশি আচ্ছাদন দিতে পারবে না। পশ্চিম কূল থেকে জমিটা প্রথমে আস্তে আস্তে, তারপর খাড়া উঠে গিয়ে দু মাইল দূরে একটা পাউরুটির আকার ধারণ করেছে। ঐটাই গুয়েনারা। পাউরুটির চুড়োটা সাদা, যেন বরফ জমেছে। সেখান থেকে গুড়ো গুয়ানোর ধোঁয়া উঠছে। বন্ড দেখল সাদা চুড়োর সামনে কালো ফুটকির মত কয়েকটি পাখি। তারা নামছে, উঠছে যেন একদল মৌমাছি মৌচাক ঘিরে উড়ছে। পাহাড়টার পাদদেশে কয়েকটি কুটির আর একটা কাঁচা রাস্তা। বোধহয় গুয়ানো বয়ে আনার জন্য।

বন্ড দাঁড়িয়ে দেখল দূরে পাখির নোংরার চকচকে পাহাড়টাকে। এই তাহলে ডক্টর নোর রাজত্ব। বন্ডের মনে হল পাণ্ডব বর্জিত জায়গা।

বন্ড পূর্বদিকে তাকাল। সেখানকার জলাভূমির ঝোঁপঝাড়গুলো আশ্রয় নেওয়ার পক্ষে আরও ভাল।

কোয়ারেলের ডাকে বন্ডের চিন্তা স্রোত বন্ধ হল। তারা আসছে, ক্যাপ্টেন।

কোয়ারেলের দৃষ্টি অনুসরণ করে বন্ড দেখল দূরের কুটিরগুলো থেকে একটা বড় লরী বেড়িয়ে আসছে। বন্ডের চোখ লরীটাকে অনুসরণ করল যতক্ষণ না সেটা নদীর অপর প্রান্তে ঝোঁপের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। বাতাসে ভেসে এল কুকুরের ডাক।

কোয়ারেল বলল, ওরা স্রোত বেয়ে আসবে, ক্যাপ্টেন। ওরা জানে যে আমরা যদি বেঁচে থাকি তবে নদীর উৎসের দিকে ছাড়া যাওয়ার রাস্তা নেই। খুব সম্ভবত বোটটা একটা ডিঙি নিয়ে নদী বেয়ে আসবে। তারপর কুকুর আর লোজন নামবে তার থেকে।

হানি বলল, আমাকে খোঁজবার সময়ওতো ওরা ঠিক তাই করে। এতে ভয়ের কিছু নেই। একটা বাঁশের নল কেটে নিতে হবে। ওরা কাছাকাছি এসে পড়লে পানির তলায় ডুবে ঐ নলের সাহায্যে নিঃশ্বাস নেবে, যতক্ষণ না ওরা চলে যায়।

বন্ড কোয়ারেলের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, তুমি বরং নলগুলো জোগাড় কর, আর আমি একটা ঘন ঝোঁপ খুঁজে বার করি।

কোয়ারেল অনিশ্চিতভাবে মাথা নাড়ল। স্রোত ঠেলে এগিয়ে গেল বাশবনের দিকে। এ পর্যন্ত বড় মেয়েটার ওপর থেকে চোখ সরিয়ে রেখেছিল। এবার মেয়েটি বলল, আমার দিকে না তাকানোর জন্য তোমাকে অত সাবধান হতে হবে না। তুমি নিজেই তো বললে, এরকম সময় ওসব কথা মনে আনতে নেই।

বন্ড ঘুরে তার দিকে তাকাল। মেয়েটার ছেঁড়া শার্ট নেমে এসেছে পানি পর্যন্ত। তার নিচে অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। তার সাদা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। সুন্দর মুখটা তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

বন্ড যা চাইছিল তা পেয়ে গেল। ঘন, গভীর ঝোঁপঝাড়ের দেওয়ালের মধ্যে একটা ফাটল। একটুও পানি ভাঙে না যেন, বলে সে পানি কেটে ভেতরে ঢুকে গেল মাথা নিচু করে। প্রণালীটা দশ গজ লম্বা। তাদের পায়ের তলার কাদা আরো নরম, আরো গম্ভীর হতে লাগল। তারপর একটা শক্ত শেকড়ের দেওয়াল উঠে গেছে। তারা আর যেতে পারল না।

মেয়েটি কাঁপা গলায় বলল, এবার আসল লুকোচুরির খেলা।

হ্যাঁ ঠিক বলেছ। বন্ড নিজের রিভলভারটির সম্বন্ধে ভাবছিল। এতক্ষণ পানিতে ভিজবার পর এটা থেকে গুলি বেরোবে কিনা। এটা দিয়ে কটা কুকুর আর ক জন লোক ঘায়েল করতে পারবে সে। মেয়েটার সঙ্গে দেখা হয়ে বড় বাজে ব্যাপার হল। যুদ্ধের সময় একটা মেয়ে থাকা মানেই শত্রুর সামনে বাড়তি লক্ষ্যবস্তু এনে দেওয়া, যেটাকে সারাক্ষণ আড়াল করতে হবে।

বন্ডের পানি তেষ্টা পেয়েছে। সে একটু পানি তুলে নিয়ে চেখে দেখল মাটির গন্ধ মেশানো লবণাক্ত পানি। মন্দ নয়, আরেকটু খেল। মেয়েটা বাধা দিল, বেশি পানি খেও না, কুলকুচি করে ফেল, নইলে জ্বর এসে যাবে।

নদীর মধ্যে কোন এক জায়গা থেকে কোয়ারেল শিস দিল। বন্ড তার জবাব দিয়ে পানি কেটে সেদিকে এগিয়ে গেল। ঝোঁপের যে সব শেকড়ে তাদের গায়ের ঘষা লেগে থাকতে পারে, কোয়ারেল সেগুলোকে ধুয়ে দিল। আমাদের গায়ের গন্ধ ধুয়ে দিচ্ছি। এক মুঠো বাঁশের টুকরো বার করে কেটে ঠিক করল। বন্ড তার রিভলভার ও বাড়তি কার্তুজগুলো ঠিকঠাক করে নিল। স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে রইল যাতে পানি আর ঘোলা না হয়।

কুকুরের ডাক কানে যেতে তারা স্বস্তিই পেল।

.

ড্রাগনের পায়ের ছাপ

অনুসন্ধানকারী দলটি দ্রুত নদী বেয়ে এগিয়ে আসছে। দু জন লোক, পরনে সাঁতারের হাফপ্যান্ট ও পায়ে উঁচু গামবুট। কুকুরগুলোর সঙ্গে তাল রেখে চলতে তাদের প্রায় দৌড়তে হচ্ছিল। বিশালকায় দুই চীনে নিগ্রো, তাদের কাঁধের সঙ্গে বেল্ট দিয়ে বাধা পিস্তলের খাপ এসে পড়েছে ঘর্মাক্ত, অনাবৃত বুকের ওপর। তাদের সামনে একপাল বিরাট বিরাট ডোবারম্যান পিশার কুকুর উত্তেজিতভাবে ডাকতে ডাকতে সাঁতার কেটে এগোচ্ছে। তারা গন্ধ পেয়েছে, বন্ডদের পাগলের মত খুঁজছে।

একশালা কুমীরের গন্ধ পেয়েছে বোধহয়। সামনের লোকটা গোলমালের মধ্যে চিৎকার করে বলল। অন্য লোকটা উত্তেজিতভাবে চেঁচিয়ে বলল, আমার মনে হয় ঐ শালা ইংরেজটার গন্ধ। বাজি রেখে বলতে পারি ঐ শালা ঝোঁপের মধ্যে লুকিয়ে আছে। দেখিস শালা যেন আড়াল থেকে গুলি না করে। লোকটা খাপ থেকে অস্ত্র বার করে বগলের তলায় রাখল।

এবার তারা ঝোঁপঝাড়ের সুড়ঙ্গে ঢুকল। সামনের লোকটা এসে পড়ল সেই ফাটলটার কাছে। একটা কুকুরকে কলার ধরে সে ফাটলের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। কুকুরটা একটা ব্যগ্র চাপা গর্জন করে ছপছপিয়ে এগিয়ে এল। লোকটা চোখ কুঁচকে দেখতে লাগল প্রণালীর দু-ধারের গাছের শেকড়ের গায়ে কোন আঁচড়ের দাগ আছে কিনা।

কুকুর এবং লোকটা প্রণালীর শেষ প্রান্তে পৌঁছল। সেখানে পানিটা চারদিকে আটকে গিয়ে একটা ছোট জলাশয়ের সৃষ্টি করেছে। লোকটা বিরক্তভাবে চারদিকে দেখে কুকুরটার কলার ধরে টানতে টানতে ফিরে চলল। মোটেই কুকুরটা যেতে চাইছে না। লোকটা চাবুক দিয়ে সজোরে পানির ওপর আঘাত করল।

দ্বিতীয় লোকটা ফাটলের মুখে অপেক্ষা করছিল। তারপর তারা আবার স্রোত বেয়ে এগিয়ে চলল, সামনে চলল কুকুরের দল।

পাঁচ মিনিট পরে ঝোঁপের মধ্যে সেই ছোট্ট জলাশয়টায় কোন স্পন্দন দেখা গেল না। তারপর এক কোণে, শেকড়বাকড়ের ভেতর থেকে জেগে উঠল পেরিস্কোপের মত একটা বাঁশের নল। তারপর ভেসে উঠল বন্ডের মুখ। সমস্ত কপালের ওপর ভেজা চুল লেপটে রয়েছে, যেন এক ভেসে ওঠা মৃতদেহের মুখ। পানির তলায় তার ডানহাতে রিভলবার তৈরি।

খুব মন দিয়ে শুনতে লাগল সে, চারদিক নিস্তব্ধ। কিন্তু নদীর দিক থেকে ভেসে আসা মৃদু শব্দটা কিসের? কেউ কি খুব আস্তে পানি কেটে চলেছে? বন্ড হাত বাড়িয়ে তার দু দিকে শেকড়ের তলায় শুয়ে থাকা শরীর দুটোকে স্পর্শ করল। মুখ দুটো পানির ওপর ভেসে উঠতেই বন্ড ঠোঁটে আঙুল রাখল। কিন্তু ততক্ষণে কোয়ারেল সশব্দে কেশে উঠে থুতু ফেলেছে। সব চুপচাপ। তারপর আবার সেই মৃদু শব্দটা শোনা গেল। কে যেন আসছে ছোট প্রণালীটা বেয়ে। বাঁশের নলগুলো আবার তিনটি মুখে ঢুকে পড়ল এবং মাথাগুলো আস্তে আস্তে পানির তলায় ডুবে গেল।

পানির তলায় কাদার ওপর মাথা রেখে বন্ড বাঁ হাতে তার নাক টিপে ধরে আছে আর ঠোঁট দিয়ে চেপে আছে নলটিকে। সেবার তাদের খুঁজে পায়নি। এবারেও কি তারা বেঁচে যেতে পারবে? অনুসন্ধানকারীটি যদি এই ঘোলা গাঢ় খয়েরী ছোপ দেখতে পায়, তবে কি সে পানির মধ্যে গুলি বা ছোরা চালাবে? কি রকম অস্ত্র থামবে তার হাতে? বন্ড ঠিক করল এবার সে ঝুঁকি নেবে না। তার কাছাকাছি পানির মধ্যে নড়াচড়ার লক্ষণ পেলেই সে উঠে গুলি চালাবে। দেখা যাক কি হয়।

শুয়ে শুয়ে বন্ড তার প্রতিটি ইন্দ্রিয়কে সজাগ করে তুলল। কি অসহ্য। আর তার চেয়েও বেশি পাগল করে তুলেছে। চিংড়ি মাছের মৃদু ঠোকর। তবে মেয়েটার মাথা থেকে এ বুদ্ধিটা ভালই বেরিয়েছে।

হঠাৎ বন্ড সিটিয়ে গেল। একটা রবারের বুট তার পায়ের ওপর এসে পড়ল এবং পরক্ষণেই সরে গেল। লোকটা কি তার পা-কে একটা গাছের ডাল ভেবেছে। সে ঝুঁকি নিতে চাইল না। মুখ থেকে বাশের নলটা ফেলে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল।

বন্ড এক পলকের জন্য দেখতে পেল তার মাথার ঠিক ওপরে একটা বিশাল শরীর এবং একটা ছুটে আসা রাইফেলের কুঁদো। সে মাথা বাঁচাবার জন্য বাঁ হাত তুলে ধরল। হাতে এসে লাগল একটা জোর আঘাত। একই সঙ্গে বন্ডের রিভলভারের নল লোকটার ডানদিকের বুক স্পর্শ করল, ট্রিগার টানল সে।

লোকটার শরীরের বিরুদ্ধে রিভলভারের বিস্ফোরণের ধাক্কায় বন্ডের কব্জি প্রায় ভেঙে গেল। কিন্তু লোকটাও সঙ্গে সঙ্গে কাটা কলাগাছের মত পানির ভিতর ছিটকে পড়ল। ডুবে যাবার আগে বন্ড দেখতে পেল তার শরীরের একপাশে বিরাট গহ্বরের সৃষ্টি হয়েছে। গামবুট পরা পা জোড়া একবার সজোরে নড়ে উঠল আর পানির ওপর ভেসে উঠল একটা মুখ–চীনে নিগ্রোর মুখ। চোখদুটো উল্টে গেছে। নির্বাক বিস্ফারিত মুখ গহ্বর থেকে পানি বেরিয়ে আসছে। তারপর আবার মাথাটা ডুবে গেল। আর কিছুই দেখা গেল না, রইল শুধু কাদামাখা অনেকটা ফেনা আর পানির ওপর রক্তের ছোপ।

বন্ড নিজেকে একবার ঝুঁকিয়ে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। কোয়ারেল আর মেয়েটা তার পাশে দাঁড়িয়ে। তাদের শরীর থেকে অজস্রধারে পানি ঝরে পড়ছে। কোয়ারেলের মুখে হাসি কিন্তু মেয়েটা মুখে হাত চেপে আতংকভরা চোখে তাকিয়ে আছে রক্তরাঙা পানির দিকে।

বন্ড বলল, আমি দুঃখিত, হানি। এটা করা ছাড়া উপায় ছিল না। লোকটা আমাদের গায়ের ওপর এসে পড়েছিল।

এসো, যাওয়া যাক। ঝোঁপঝাড়ের সুড়ঙ্গ পেরিয়ে খোলা নদীতে পৌঁছানোর আগে তারা থামল না।

বন্ড ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সেটা তিনটে বেজে বন্ধ হয়ে গেছে। এখন বোধহয় চারটে। সহসা বন্ড ক্লান্তি অনুভব করল। সে একটু গোলমাল করে ফেলেছে। গুলির আওয়াজ অন্য লোকগুলো না শুনে থাকলেও তার অনুপস্থিতি ধরা পড়বে সবাই একত্র হলেই। তারা কি সঙ্গে সঙ্গে নিরুদ্দিষ্টের খোঁজে ফিরে আসবে? না, লোকটির অনুপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হতেই অন্ধকার ঘনিয়ে আসবে। পরদিন সকালে তারা আসবে। কুকুরগুলো সহজেই খুঁজে পাবে মৃতদেহটাকে আর তারপর কি হবে? মেয়েটা বন্ডের জামার হাত ধরে টানল। রাগের সঙ্গে বলল, এবার আমাকে বলতেই হবে এসব কি হচ্ছে? কেন তোমরা সবাই সবাইকে খুন করতে চাইছ? আর তুমিই বা কে? রিভলভার নিয়ে কেউ পাখির খোঁজে আসে না।

বন্ড বলল, আমি দুঃখিত, হানি। আজ সন্ধ্যায় ক্যাম্পে তোমাকে সবকিছু বলব। তোমার নেহাৎ দুর্ভাগ্য যে আমাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছ। এই লোকগুলোর সঙ্গে আমার যুদ্ধ চলছে। তবে আর কাউকে আহত না করে এই দ্বীপ থেকে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আমার অন্য কোন ইচ্ছে নেই। আবার সোজা পথ ধরে এই দ্বীপে সার মত তথ্য আমার হাতে এসে গেছে।

তার মানে তুমি পুলিশম্যান নাকি? তুমি কি এই চীনেটাকে জেলে পুরতে চেষ্টা করছ?

অনেকটা তাই। তুমি ন্যায়ের দিকেই আছ। এবার তুমি একটা কাজের কথা বল। পাখিওয়ালাদের তাঁবুটা এখান থেকে কতদূর?

এক ঘণ্টার রাস্তা।

 লুকোবার পক্ষে জায়গাটা কেমন? সেখানে কি আমাদের সহজে খুঁজে পাওয়া সম্ভব?

সে চেষ্টা করলে তাদের বড় দীঘি বা নদীর ওপর দিয়ে আসতে হবে। ড্রাগনটা কিন্তু পানির ওপর দিয়ে চলতে পারে।

তা বেশ তো, আশা করি আজ তার ল্যাজে ফোঁড়া বা আর কিছু হয়েছে।

আচ্ছা, সবজান্তা মশাই। দেখা যাবে।

কোয়ারেল ছপছপিয়ে ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে এল, তার হাতে রাইফেল। বলল, আরেকটা বন্দুক থাকলে ক্ষতি নেই। ক্যাপ্টেন, মনে হয় এটা কাজে লাগবে।

বন্ড বন্দুকটা হাতে নিল। আমেরিকান সৈন্যবাহিনীর রেমিংটন কারবাইন, ৩০০; এ লোকগুলো উপযুক্ত অস্ত্রই ব্যবহার করে। সে বন্দুকটা ফিরিয়ে দিল।

বন্ডের চিন্তার যেন প্রতিধ্বনি শোনা গেল কোয়ারেলের কথায়। বলল, লোকগুলো চালাক আছে, ক্যাপ্টেন। এই লোকটা অন্যদের পেছন পেছন লুকিয়ে আসছিল, যাতে কুকুর চলে যাবার পর আমরা ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরোলেই ধরে ফেলতে পারে। মহা ধাড়ীবাজ ঐ ডাক্তার লোকটা।

যা তিনি যে এক আশ্চর্য মানুষ সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এবার রওনা হওয়া যাক। হানি বলছে ক্যাম্পটা এখান থেকে একঘন্টার রাস্তা। নদীর বাঁ দিক ঘেষে যাওয়াই ভাল, যাতে আমরা পাহাড়ের আড়ালে থাকি। ওরা নিশ্চয়ই দূরবীনে নদীর ওপর নজর রাখছে। বন্ড হাতের রিভলবার কোয়ারেলকে দিল এবং সে সেটাকে পিঠের ভেজা ব্যাগে ভরে চলতে শুরু করল।

নদীর পশ্চিম উপকূলে তারা বাঁশঝাড় আর ঝোঁপের ছায়া পাচ্ছিল ঠিকই কিন্তু গা ঝলসে দেওয়া গরম হাওয়ায় ছিল দুর্দান্ত ঝাঁপটা। সূর্যের চোখ ধাঁধানো আলোয় বন্ডের চোখ টকটকে লাল হয়েছে আর হাতে যেখানে রিভলভারের ধাক্কা লেগেছিল সেখানে অসহ্য যন্ত্রণা। সে ভাবছিল কতক্ষণে ঘুমানো সম্ভব হবে।

আর মেয়েটা। সে তো রাতে একেবারেই ঘুমোয়নি। বন্ড আর কোয়ারেলকে সারারাত ধরে পাহারা দিতে হবে। আবার আগামীকাল রওনা হতে হবে ঝোঁপঝাড় ভেদ করে দ্বীপের সেই পূর্বপ্রান্তে নৌকাটার দিকে। তারপর আবার রাত্রিবেলা প্রত্যাবর্তনের পালা। সে হেঁটে চলল আর মনে পড়ল M এর সূর্যের আলোয় ছুটি উপভোগ করবার মন্তব্যটা।

হঠাৎ কোয়ারেল থেকে গেল। তার চোখের দৃষ্টি কুকুরের মত সামনের জলাভূমির ওপর স্থির নিবদ্ধ। সামনের কাদার ওপর দুটো গভীর সমান্তরাল দাগ। তাদের মাঝামাঝি আরেকটা অস্পষ্ট দাগ দেখা যাচ্ছে। পায়ের দাগ। কিছু একটা নেমে এসেছিল পাহাড়ের দিক থেকে…জলাভূমি পেরিয়ে চলে গিয়েছিল দীঘির দিকে।

মেয়েটি বলল, ড্রাগনটা গিয়েছিল ঐখান দিয়ে।

কোয়ারেল বিস্ফারিত চোখে তার দিকে তাকাল।

 বন্ড পদচিহ্ন ধরে কিছুটা এগিয়ে গেল। ছাপের বাইরের দিকটা যথেষ্ট মসৃণ ও ভেতরদিক বাঁকানো। গাড়ির চাকায় এরকম দাগ হতেও পারে, কিন্তু দাগগুলো খুব বড়–চওড়ায় অন্তত দু ফুট। মাঝখানের দাগটা একই আকৃতির, তবে মাত্র তিন ইঞ্চি চওড়া, মোটরের চাকার দাগের মতই। বেশ টাটকা ছাপ। একেবারে সরলরেখায় সামনের দিকে চলে গেছে, আর পথে যে সব ঝোঁপ ছিল সেগুলো এমন পিষে গেছে, যেন একটা ট্যাংক গড়িয়ে গিয়েছে।

বস্তু বুঝতে পারল না কি ধরনের গাড়ির চাকা এ রকম দাগ সৃষ্টি করতে পারে। অবশ্য যদি সেটা আদৌ গাড়ি হয়ে থাকে। মেয়েটা কনুইয়ের ধাক্কা দিয়ে বলল, বলেছিলাম না। তখন সে কেবল চিন্তিতভাবে বলল, দেখ হানি, এটা যদিও ড্রাগন না, তবে এমন কোন জিনিস যা আগে কখনও আমি জীবনে দেখিনি।

আরেকটু এগিয়ে মেয়েটা জামার হাত ধরে টেনে চাপা গলায় বলল, ঐ দ্যাখ। যে পথ দিয়ে পদচিহ্নটা চলে গেছে, তারই পাশের একটা ঝোঁপের দিকে আঙুল দেখাল সে। ঝোঁপটা পুড়ে কালো হয়ে গেছে, একটাও পাতা নেই। মাঝখানে একটা পাখির বাসার দগ্ধাবশেষ দেখা যাচ্ছে। সে ওটার ওপর নিঃশ্বাস ফেলেছিল।

বন্ড ঝোঁপটার কাছে এগিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করল। সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ঠিক এই ঝোঁপটাকে পোড়ানো হল। কেন? অদ্ভুত ব্যাপার।

পায়ের ছাপটা ঘুরে দীঘির দিকে এগিয়ে গেছে। তারপর অদৃশ্য হয়ে গেছে দীঘির পানিতে। বন্ড চাইছিল চিহ্নগুলোকে আরো অনুসরণ করতে। কিন্তু লতাপাতার আড়াল থেকে বেরোল চলবে না। তারা হেঁটে চলল।

পাউরুটির মত গুয়ানোর পাহাড়টার পেছনে দিনটা প্রায় শেষ হয়ে আসছে। এমন সময় মেয়েটা ঝোঁপের ফাঁক দিয়ে আঙ্গুল তুলে দেখাল। বন্ড দেখল একটা লম্বা বালুচর নেমে গেছে দীঘির পানিতে। তার মেরুদণ্ড বেয়ে ঘন সামুদ্রিক আঙ্গুরের ঝোঁপ আর মাঝখানে অর্থাৎ দীঘি থেকে প্রায় একশ গজ দূরে একটা খড়ের কুটিরের ধ্বংসাবশেষ। রাত কাটানোর পক্ষে বেশ আকর্ষণীয় জায়গাটা। দু দিক পানির গণ্ডি দিয়ে সুরক্ষিত।

গরম হাওয়াটা থেকে গেছে। দীঘির নরম পানি যেন আহ্বান জানাচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দুর্গন্ধে ভরা নদী আর জলাভূমির কাদা ঠেলে হাঁটবার পর গায়ের নোংরা শার্ট খুলে, সর্বাঙ্গ ধুয়ে নিয়ে শুকনো কঠিন বালির ওপর একবার শুয়ে পড়তে পারলে কি স্বর্গীয় আনন্দই না পাব। তারা পৌঁছল বালুচরটা যেখানে শুরু হয়েছে, তারপর একটা সরু পথ বেয়ে চলতে লাগল। সেই খড় পাতার কুঁড়ে ঘরটার ধ্বংসাবশেষ যেখানে তারা সেখানে পৌঁছল। রহস্যময় বিরাট পদচিহ্নগুলো পানি থেকে উঠে এসে খোলা জায়গাটা ও আশেপাশের ঝোঁপের ওপর দিয়ে এমনভাবে চলে গেছে, বোঝা যায় বস্তুটি সেই জায়গাটি ছারখার করে দিয়ে গেছে।

প্রবালের চাঙড়া দিয়ে তৈরি একটা চুলা ভেঙে পড়ে আছে। কয়েকটা বাসনপত্র ও খালি টিন ছড়ানো। ধ্বংসস্তূপ হাতড়ে কোয়ারেল শুয়োরের মাংস আর বরবটির দানার দুটো টিন আবিষ্কার করল। মেয়েটা পেল একটা কোঁচকানো ঘুমোবার থলে আর বন্ড খুঁজে পেল একটা চামড়ার মানিব্যাগ। তার মধ্যে পাঁচটা এক ডলারের নোট, তিনটে জ্যামাইকান পাউন্ড আর কিছু খুচরো পয়সা। ওয়ার্ডেন দু জন নিশ্চয়ই তাড়াহুড়ো করে পালিয়েছে।

জায়গাটা ছেড়ে আরেকটু এগিয়ে একটা উন্মুক্ত বালুময় জায়গায় পৌঁছাল তারা তিনজন। ঝোঁপের ভেতর দিয়ে তারা পানির ওপারে পাহাড়ের গায়ে আলো চিকমিক্‌ করতে দেখল।

বন্ড বলল, যতক্ষণ না আলো জ্বালাই ততক্ষণ আমরা নিশ্চিন্ত। প্রথমেই ভাল করে গোসল করতে হবে। হানি, তুমি এদিকটায় থাক, আমরা বালুচরের অন্যদিকে যাই। আধঘণ্টা পরে নৈশভোজের সময় আবার দেখা হবে।

মেয়েটা হাসল, তোমরা জামাকাপড় পরবে না, নাকি?

নিশ্চয়ই, বন্ড বলল, এবার প্যান্ট পরতে হয়। কোয়ারেল বললে, ক্যাপ্টেন, আলো থাকতে থাকতে আমি টিনগুলো খুলে ফেলি আর রাত্রের সব ব্যবস্থা করে নিই। পিঠের ব্যাগ খুলে, এই নিন আপনার প্যান্ট আর রিভলবার। রুটিগুলো দেখে ভাল মনে হচ্ছে না, তবে ভেজার বেশি কিছু হয়নি। খেতে ভালই লাগবে আর ভোরের আগে শুকিয়ে যাবে বোধহয়। টিনের খাবারগুলো এখন খেয়ে নিই। শুয়োরের মাংস আর পনীরটা কালকের জন্য রেখে দিই। কারণ কাল অনেকটা হাঁটতে হবে।

বন্ড বলল, ঠিক আছে, কোয়ারেল। খাবারের ব্যাপারটা তোমার ওপরেই ছেড়ে দিচ্ছি। তার অস্ত্র ও ভেজা প্যান্ট নিয়ে যে পথে এসেছিল সে পথেই ফিরে অগভীর পানিতে নেমে গেল। একটা শুকনো কঠিন বালির জায়গা খুঁজে বার করল। তারপর শার্ট খুলে পানির মধ্যে শুয়ে পড়ল। সে এক মুঠো বালি খুঁজে বার করে সাবানের মত গায়ে ঘষল। তারপর সেই নিঃসঙ্গ নীরবতায় আরামে শুয়ে রইল।

ক্রমশ কতকগুলো ফ্যাকাশে তারা দেখা গেল। এই তারাগুলো দেখেই তারা গতরাত্রে এই দ্বীপে এসেছিল। সে যেন এক বছর আগেকার কথা। অভিযান বটে একটা! কিন্তু পরিশ্রমটা অন্তত সার্থক হয়েছে। তার কাছে এখন অনেক প্রমাণ, অনেক সাক্ষী, যার ওপর নির্ভর করে সে গভর্নরের কাছে গিয়ে ডক্টর নোর কীর্তিকলাপ সম্পর্কে একটা রীতিমত অনুসন্ধানের দাবী করতে পারে।

কয়েকজন লোকের ওপর কেউ অত সহজে মেশিনগান চালায় না। অনুপ্রবেশকারীদের ওপরেও নয়। সোসাইটির ভাড়া নেওয়া জায়গায় অনুপ্রবেশ করেছে। তাদের সম্পত্তি নষ্ট করেছে আর সম্ভবত একজন ওয়ার্ডেনকে খুনও করেছে। এ বিষয়েও অনুসন্ধান প্রয়োজন যখন সে একটা ডেপরে এবং একদল নৌসেনা সঙ্গে নিয়ে সোজা রাস্তায় এ দ্বীপে এসে হাজির হবে, তখন কি উত্তর খুঁজে পেতে পারে সে? ডক্টর নোর এই বিচিত্র হেয়ালির অর্থ কি? কি লুকোচ্ছেন তিনি? কিসের ভয় তাঁর? গোপনীয়তা কি তার কাছে এতই আবশ্যক যে তার জন্য তিনি খুনের পর খুন করে যাবেন? কে এই ডক্টর নো?

বন্ড তার ডান দিকে পানির মধ্যে ছপছপ আওয়াজ শুনতে পেল। মেয়েটার কথা ভাবল সে। কে এই হানিচাইল রাইডার? বন্ড ভাবল এ খবরটা অন্তত আজ রাত শেষ হবার আগেই তাকে জানাতে হবে। স্যাঁতসেঁতে প্যান্টটা পরে নিল বন্ড। বালির ওপর বসে রিভলবারটা খুলল। স্পর্শের সাহায্যে প্রতিটি অংশ এবং প্রতিটি গুলি শার্ট দিয়ে মুছে শুকনো করল। তারপর অংশগুলো জুড়ে ফেলল। গুলি ভরে সেটাকে কোমরবন্ধনীর তলায় খাপের ভেতর খুঁজে দিল। আবার খোলা জায়গায় ফিরে এল।

অন্ধকারে হানি এসে তাকে তার পাশে টেনে বসাল। বলল, এসো, ভীষণ খিদে পেয়েছে আমাদের। একটা বাসন ধুয়ে মুছে আমি তার মধ্যে বরবটির দানাগুলি ঢেলেছি, প্রত্যেকের জন্য দু মুঠো বরবটি আর একটা করে ক্রিকেট বলের মত পাউরুটি আছে। ভেব না যে তোমাদের খাবার খেতে আমার খারাপ লাগছে, কারণ তোমরা না থাকলে যা করতে হত তার চেয়ে অনেক বেশি খাঁটিয়ে নিচ্ছ তোমরা, নাও, হাত বাড়াও।

মেয়েটার পাকামি শুনে বন্ড হেসে ফেলল। বন্ড ভাবল মাথাটা সরু দেখাচ্ছে এই চুল শুকিয়ে নিয়ে আচড়ালে কেমন লাগবে? তার অপরূপ সোনালি গায়ে পরিষ্কার কাপড় উঠলে কেমন দেখাবে? মেয়েটা ভাঙা নাকটাকে ঠিক করে নেয়নি কেন? ছোট্ট একটা অস্ত্রোপচার লাগবে। তারপর সে জ্যামাইকার শ্রেষ্ঠা সুন্দরী হবে।

তাদের কাঁধে কাঁধে ছোঁয়া লাগল। বন্ড হাত বাড়িয়ে মেয়েটার কোলের ওপর চিৎ করে রাখল। সে হাতটা তুলে একরাশ ঠাণ্ডা বরবটির দানা তার হাতে ঢেলে দিল।

হঠাৎ সে মেয়েটার শরীরের অদ্ভুত জান্তব গন্ধ পেল। গন্ধটা এমন মাদকতাময় যে তার দেহ মেয়েটার দিকে সরে গেল।

মেয়েটা হাসল লজ্জা, পরিতৃপ্তি আর স্নেহের হাসি। মা-মা গলায় বলল, নাও, ধর। তারপর ভর্তি হাতটা তুলে নিয়ে বন্ডকে ফিরিয়ে দিল।

.

অজানা অরণ্যের গভীরে

 রাত আটটা হবে, বন্ড ভাবল। ব্যাঙের একটানা ডাক ছাড়া সব চুপচাপ। দূরে, ভোলা জায়গায় এককোণে সে কোয়ারেলের শরীর দেখতে পেল। মৃদু ধাতব খুটখাট শব্দ শোনা যাচ্ছে। কোয়ারেল তার রেমিংটন রাইফেল খুলে পরিষ্কার করছে।

ঝোঁপের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে দূরের গুয়ানেরা-র হলদে আলোগুলো দীঘির কালো পানির ওপর বর্ণোজ্জ্বল রেখার সৃষ্টি করেছে। বেশ ঠাণ্ডা, বন্ডের জামাকাপড় গায়েই শুকিয়েছে। তিন মুঠো খাবারে তার পেট বেশ ভরে গেছে। দিব্যি আরাম ও স্বস্তি অনুভব করছে সে। ঘুম পাচ্ছে। কাল অনেকটা পথ যেতে হবে। হঠাৎ যেন জীবনটাকে সহজ এবং সুন্দর মনে হচ্ছে।

মেয়েটা তার পাশে ঘুমের থলির মধ্যে শুয়েছিল চিৎ হয়ে, দু হাতের ওপর মাথার ভর দিয়ে। তাকিয়েছিল তারায় ভরা চন্দ্রাতপটার দিকে। বন্ড কেবল তার সাদা মুখটা আবছা দেখতে পাচ্ছিল। মেয়েটা বলল, জেমস্ তুমি বলেছিলে যে, সব ব্যাপারটা আমাকে বুঝিয়ে বলবে। যতক্ষণ না বলবে আমি ঘুমব না।

বন্ড হেসে বলল, বলব, তবে যদি তুমিও সব বল। আমি তোমার সম্বন্ধে সব কিছু জানতে চাই।

আমার আপত্তি নেই। গোপন করবার মত আমার কিছুই নেই। কিন্তু আগে তুমি বলবে।

বেশ। আমি এক ধরনের পুলিশম্যান। পৃথিবীর কোথাও যদি এমন গোলমাল ঘটে যা নিয়ে মাথা ঘামানোর কেউ নেই, তাহলে সেখানে আমাকে পাঠানো হয়। তা, অল্প কিছুদিন আগে এখানকার রাজ্যপালের একজন কর্মচারি, স্ত্রাংওয়েজ আমার বন্ধু, হঠাৎ নিরুদ্দেশ হলেন। তার সুন্দরী সেক্রেটারিকেও পাওয়া গেল না। অধিকাংশ লোক ভাবল তারা দু জনে পালিয়েছে। কিন্তু আমার তা মনে হয় না। আমি…

বন্ড সহজ ভাষায় পুরো গল্পটা তাকে বলল, শেষে বলল, তাহলে বুঝতে পার, হানি যে, এখন আমাদের তিনজনের সামনে কাল রাত্রে জ্যামাইকা ফিরে যাওয়া ছাড়া কোন সমস্যা নেই। তারপর রাজ্যপাল মশাই আমাদের কথা শুনবেন। অনুসন্ধানের জন্য সৈন্য পাঠাবেন। মনে হয় চীনেম্যানটির জেল হবে। উনি তা জানেন, আর সেই জন্যেই আমাকে আটকাবার চেষ্টা করছেন। ব্যস, এবার তোমার পালা।

মেয়েটা বলল, তোমার জীবনে দেখি অনেক উত্তেজনা আছে। তোমার বৌ নিশ্চয়ই এই বাইরে থাকাটা পছন্দ করে না। তুমি আহত হতে পার ভেবে তার দুশ্চিন্তা হয় না?

আমি বিয়ে করিনি। আমার জীবনবীমা ছাড়া আমার সুস্থতা সম্পর্কে চিন্তা করবার কেউ নেই।

তোমার বোধহয় অনেক মেয়ে বন্ধু আছে?

স্থায়ী কেউ নেই।

 আচ্ছা।

কোয়ারেল তাদের সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, ক্যাপ্টেন, আপনার আপত্তি না থাকলে প্রথম রাতটা আমি পাহারা দিই। বালুচরের ওদিকের কোণে বসে থাকব। মাঝ রাত্তিরে এসে আপনাকে ডাকব। আপনি না হয় পাঁচটা পর্যন্ত পাহারা দেবেন। আর তারপরেই আমরা রওনা হব। আলো ফোটবার আগেই এ জায়গা থেকে বেশ কিছু দূরে চলে যেতে হবে।

আমার আপত্তি নেই। তেমন কিছু দেখলে আমাকে জানিয়ে দিও। বন্দুক ঠিক আছে তো?

চমৎকার আছে। ভাল করে ঘুমোও মিস্ কিছুটা দ্ব্যর্থক ভাবেই বলল, তারপর চলে গেল।

কোয়ারেলকে আমার ভাল লাগছে, মেয়েটি বলল, তুমি কি সত্যিই আমার সম্বন্ধে জানতে চাও?

 নিশ্চয়ই জানতে চাই। কিছু বাদ দিয়ে বল না যেন।

বাদ দেওয়ার কিছু নেই। আমার পুরো জীবন কাহিনী একটা পোস্টকার্ডের পেছনে লেখা যায়। প্রথমত আমি কখনো জ্যামাইকার বাইরে পা বাড়াইনি। জন্মাবধি আমি থাকি জ্যামাইকার উত্তর উপকূলে, মর্গানুস হার্বারের কাছে বো ডেজার্ট নামে একটা জায়গায়।

বন্ড হাসল, আশ্চর্য ব্যাপার, আমিও তো আপাতত ওখানেই আছি। তোমাকে তো ওদিকে দেখিনি। তুমি পানির মগডালে বাস কর নাকি?

ও। তুমি বোধহয় সমুদ্রের ধারের বাড়িটা নিয়েছ। আমি থাকি বড় বাড়িটাতে।

 কিন্তু ওটার তো আর কিছুই নেই। আখের ক্ষেতের মাঝে স্রেফ একটা ধ্বংসস্তূপ।

আমি থাকি বাড়িটার মাটির তলায় ভাড়ার ঘরে। আমার বয়স যখন পাঁচ বছর তখন থেকে আমি ঐ ঘরে আছি। বাড়িটায় যখন আগুন লাগে তখন আমার বাবা-মা পুড়ে মারা যান। তাদের সম্বন্ধে আমার কিছু মনে নেই। প্রথমদিকে আমি ওখানে আমার নিগ্রো ধাইমার কাছে থামতাম। আমার পনের বছর বয়সে ধাইমা মারা যান। গত পাঁচ বছর আমি একাই থাকি।

হে সৃষ্টিকর্তা। কিন্তু তোমাকে দেখাশোনা করবার মত কি কেউ ছিল না? তোমার বাবা মা কি কিছু টাকা পয়সা রেখে যায়নি?

একটা পয়সাও না। জান, আমরা, মানে রাইডার-রা, জ্যামাইকার সবচেয়ে পুরনো পরিবারগুলোর অন্যতম। রাইডার পরিবারের আদিপুরুষ রাজা চার্লস-এর মৃত্যুদণ্ডের সই করেছিলেন আর সেই খাতিরেই তিনি ক্রমওয়েলের কাছ থেকে এই বো ডেজার্টের জমিটা পান। তিনিই এই বড় বাড়ি তৈরি করেন। তারপর থেকে আমাদের পরিবার মাঝে সাঝে এখানে বসবাস করত।

কিন্তু তারপর চিনির দাম পড়ে গেল। বোধহয় তখন থেকেই কষ্টেসৃষ্টে ব্যবসা চলছিল। আমার বাবার হাতে যখন সম্পত্তি আসে, তখন চারিদিকে দেনা ছাড়া আর কিছু ছিল না। তাই বাবা মারা যেতে সব সম্পত্তি বিক্রি হয়ে যায়। আমি তখন খুব ছোট। আমার ধাইমা খুব ভাল লোক ছিল। পাদরী ও উকিলেরা চাইছিল কেউ যেন আমাকে পুষ্যি নেয়। কিন্তু ধাইমা ঘরের যে সব আসবাবপত্র পুড়ে যায়নি সেগুলো এক করে আমাকে নিয়ে ঐ ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থাকতে লাগল। কিছুদিন কেটে যাবার পর আর কেউ আমাদের ঘাটাতে আসেনি।

ধাইমা সেলাই করত, গ্রামের লোকেদের কাপড় কেচে দিত, আর কলাগাছ ইত্যাদির একটা বাগান ছিল। তার ওপর আমাদের পুরনো বাড়ি ঘেষে একটা রুটি গাছ ছিল। বাড়ির চারপাশে ছিল অজস্র আখ, নদীতে মাছ ধরবার ব্যবস্থা করা হল, যাতে আমরা রোজ মাছ পাই। সুতরাং সব আবার ঠিক হয়ে গেল। খাওয়া দাওয়ার কোন কোন অভাব হল না আমাদের। জ্যামাইকার লোকে যা খায় আমরাও তাই খেতাম।

কি জানি কি করে ধাইমা আমাকে লিখতে পড়তে শেখাল। আগুনের হাত থেকে একগাদা পুরনো বই বেঁচে গিয়েছিল। তার মধ্যে একটা এসাইক্লোপিডিয়া। আট বছর বয়সে আমি সেই বিশ্বকোষটা পড়তে শুরু করি। এর মধ্যে আমি A থেকে T পর্যন্ত পড়ে ফেলেছি। আমি বলতে পারি, অনেক বিষয়ে তোমার থেকে আমার বেশি জানা। আছে।

আমারও তাই মনে হয়। বন্ড অন্যমনে কল্পনা করছিল সেই বিচিত্র দৃশ্যটা–একটা রুক্ষচুলওয়ালা বাচ্চা মেয়ে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বক্ক্ করতে করতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর তার ওপর নজর রাখছে এক কড়ামেজাজের নিগ্রো বুড়ি আর মাঝে মাঝে মেয়েটাকে ডাকছে পড়াশুনা করবার জন্য। যদিও বুড়ি নিজেও জানে না বইয়ে কি হিজিবিজি লেখা আছে। বন্ড বলল, তোমার ধাইমা নিশ্চয়ই এক চমৎকার মানুষ ছিলেন।

অতি চমৎকার মানুষ। সহজ ভাষায় মেয়েটি বলল, ও যখন মারা যায়, ভেবেছিলাম আমিও মরে যাব। সব যেন ফুরিয়ে গেল। তার আগে পর্যন্ত আমি একটা বাচ্চার মত ছিলাম। হঠাৎ আমাকে বড় হয়ে উঠে নিজের সবকিছু করে নিতে হল। পুরুষেরা চেষ্টা করল আমাকে ধরতে এবং ক্ষতি করতে। তারা আমার সঙ্গে প্রেম করতে চায়। তখন আমি দেখতে খুব সুন্দর ছিলাম।

বন্ড গম্ভীরভাবে বলল, আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েদের মধ্যে তুমি একজন।

এই নাক নিয়ে বোকার মত কথা বল না।

তুমি ঠিক বুঝতে পারছ না। বন্ড মেয়েটাকে বিশ্বাস করাবার মত কথা খুঁজতে লাগল, অবশ্যই দেখা যাচ্ছে তোমার নাকটা ভাঙা। কিন্তু আজ সারাদিনের আমার তা চোখেই পড়েনি। একজন লোকের দিকে তাকালে প্রথমেই চোখ পড়ে তার চোখের ওপর বা ঠোঁটের ওপর। কারণ ঐ দুই জায়গাতেই থাকে মুখের যাবতীয় অভিব্যক্তি। একটা ভাঙা নাক কোনভাবেই এক বাকা কানের চেয়ে বড় ব্যাপার নয়। নাক কান হচ্ছে মুখটাকে সাজানো গোছানোর জন্য। কারো নাক-কান হয়ত অন্যদের চেয়ে সুন্দর। কিন্তু তা বলে মুখের অন্যান্য অংশের মত গুরুত্বপূর্ণ নয়। তোমার নাকটা যদি তোমার আর সব কিছুর মত সুন্দর হত, তাহলে তুমি জ্যামাইকার সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে হতে পারতে।

সত্যি বলছ? মেয়েটার গলায় উত্তেজনার আভাস, তোমার কি মনে হয় আমি আবার সুন্দর হতে পারব? আমি জানি আমার শরীরের কিছু-কিছু অংশ ঠিকই আছে। কিন্তু আয়নার দিকে তাকালে আমার ভাঙা নাকটা ছাড়া কিছুই দেখতে পাই না। আমি জানি অন্য যে সব লোকেদের শরীরে বিকৃতি থাকে, তাদের ঠিক এইরকম মনে হয়।

বন্ড অধৈর্যভাবে বলল, তোমার মোটেই কোন বিকৃতি নেই। আজেবাজে কথা বলো না। আর তাছাড়া ছোট্ট একটা অস্ত্রোপচার করে এটাকে ঠিক করে নেওয়া যায়। একবার আমেরিকা যেতে পারলে এক সপ্তাহের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে।

মেয়েটা রেগে বলল, সেটা কি করে করব শুনি? আমার মাটির তলার ঘরে একটা পাথরের নিচে মোটে পনেরো পাউন্ড লুকানো আছে। আর আছে তিনটে স্কার্ট, তিনটে শার্ট, একটা ছোরা আর একটা মাছ ধরবার জাল। ঐ অপারেশনের কথা আমার সব জানা আছে। পোর্ট মারিয়া-র ডাক্তারবাবু আমার জন্য খোঁজখবর নিয়েছিলেন। খুব ভাল লোক তিনি। আমেরিকায় চিঠি লিখেছিলেন। জান, পুরো অপারেশনটা করাতে, হাসপাতালে আর যাতায়াতের খরচ ইত্যাদি নিয়ে, প্রায় পাঁচশ পাউন্ড লাগে? হতাশ গলায় বললে সে, আমি কোত্থেকে অত টাকা পাব বল?

বন্ড ইতিমধ্যেই ঠিক করে ফেলেছিল এ ব্যাপারে কি করা যেতে পারে। আপাতত সে নরমভাবে বলল, আমার ধারণা, উপায় একটা হয়ে যাবে। কিন্তু যাই হোক, তোমার গল্পটা চালিয়ে যাও। ভারি অদ্ভুত গল্প। আমারটার চেয়ে অনেক বেশি বিচিত্র। তোমার ধাই-মা মারা যাওয়া পর্যন্ত বলেছিলে। তারপর কি হল?

মেয়েটা আবার বলতে লাগল, তুমিই তো বার বার থামিয়ে দিচ্ছ আমাকে। আর যা বোঝে না তা নিয়ে কথা বলতে যেও না। সবাই বোধহয় বলে যে তুমি দেখতে যুবা সুন্দর, বোধহয় তুমি যে মেয়ের দিকে হাত বাড়াও তাকেও পাও। জেনে রাখ, যদি তুমি ট্যারা, গন্নাকাটা বা আর কিছু হতে, কেউ তোমার দিকে ফিরে তাকাত না। সত্যি বলতে কি, মেয়েটার গলায় হাসির রেশ, আমার ইচ্ছে হচ্ছে বাড়ি ফিরে যাবার পর আমাদের গ্রামের ডাইনীকে দিয়ে এমন এক মন্ত্র পড়াব তোমার ওপর, যাতে তোমার ঐরকম একটা কিছু হয়ে যায়। তারপর অনেকটা অপ্রাসঙ্গিকভাবে জুড়ে দিল, তাহলে আমাদের দুজনকে অনেকটা একরকম দেখাবে।

বন্ড হাত বাড়িয়ে তাকে স্পর্শ করল। বলল, আমার অবশ্য আলাদা মতলব আছে। কিন্তু আগে তুমি তোমার গল্প শেষ কর।

বেশ। মেয়েটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এবার একটু পিছিয়ে যাওয়া দরকার। আখের ক্ষেতেই ঐ অঞ্চলের যাবতীয় সম্পত্তি, আর পুরনো বাড়িটা হচ্ছে তাদের ঠিক মাঝখানে। তা, বছরে দুবার আখ কেটে মাড়াইয়ের কলে নিয়ে যাওয়া হয়। সে সময়ে ক্ষেতের সব জন্তুজানোয়ার আর পোকামাকড়দের বাসা ভেঙ্গে যায়। তাদের অনেকে মরে যায় আর অন্যেরা ভয়ের চোটে পালায়। পালিয়ে এসে ঢোকে পুরনো বাড়িটার আনাচে কানাচে।

এদের মধ্যে ছিল বেজী, সাপ, বিছে। আরো অনেক কিছু। আমার ধাই-মা এদের খুব ভয় পেত। আমি কিন্তু মাটির তলায় গোটা দুয়েক ঘরে ওদের জন্য বাসা মত বানিয়ে দিলাম। ওরা হয়ত বুঝতে পারল যে আমি ওদের যত্ন করছি। আর ওদের বন্ধু বান্ধবদের খবর জানাল। কারণ তারপর তারা দল বেঁধে এসে ঢুকতে লাগল সেই ঘর দুটোতে। যতদিন আখ বড় হচ্ছে, তারা সেখানেই বসবাস করত। আখ বড় হলেই আবার সদলবলে মাঠে ফিরে যেত।

যতদিন তারা আমাদের সঙ্গে থাকত, আমার বেঁচে যাওয়া খাবার ওদের খাওয়াতাম। তারাও বেশ ভাল ব্যবহার করত, কেবল একটু বুনো গন্ধ বার করতে আর মাঝে সাজে নিজেদের মধ্যে মারামারি করত। কিন্তু তারা আর তাদের বাচ্চারা আমার বেশ পোষ মেনে গিয়েছিল। আমি যা বলতাম তাই করত। তারপর অবশ্য আখকাটা লোকগুলো ব্যাপারটা জেনে গেল। গলায় সাপ জড়িয়ে ঘুরে বেড়াতেও আমাকে দেখেছিল তারা। তাতে ভয় পেয়ে ওরা আমাকে ডাইনী বলে ধরে নিল। আর আমাদের ধারে কাছে ঘেঁষত না। একটু থেমে মেয়েটা আবার বলল, এইভাবেই আমি জানোয়ার আর পোকামাকড়দের বিসয়ে এত কিছু জেনেছি। বন্ডের দিকে তাকিয়ে বলল, এদের সম্পর্কে কিছু না জেনে তুমি খুব ভুল করেছ।

সত্যিই তাই, বন্ড বলল, ওরা বোধহয় মানুষজনের চেয়ে অনেক ভাল আর অনেক মজার।

মেয়েটা চিন্তিতভাবে বলল, তা জানি না, লোকজনের সঙ্গে আমার তেমন আলাপ নেই। যে ক জনকে আমি চিনি তারা খুবই খারাপ লোক। তবে আমার মনে হয় ভাল লোকও আছে। একটু থামল, আসলে আমি ঐ জন্তু জানোয়ারদের মত মানুষদেরকে পছন্দ করবার কথা কোনদিন ভাবিনি। অবশ্য ধাইমাকে ছাড়া। যতক্ষণ না… বলে সে লাজুক হেসে থেমে গেল।

যাই হোক। আমার পনের বছর বয়স পর্যন্ত আমার সুখেই ছিলাম। তারপর ধাইমা মারা গেলে অবস্থাটা জটিল হয়ে গেল। ম্যাডার বলে একটা লোক ছিল। সাংঘাতিক মানুষ। সে ক্ষেতের মালিকদের ওভারশিয়ার হিসেবে কাজ করে। প্রায়ই আমাকে দেখতে আসত। সে চাইত আমি পোর্ট মারিয়া-র কাছে তার বাড়িতে গিয়ে থাকি। আমি তাকে ঘেন্না করতাম। ক্ষেতের মধ্যে তার ঘোড়ার শব্দ পেলেই লুকিয়ে পড়তাম। একদিন রাত্রে সে পায়ে হেঁটে এল। আমি কিছুই শুনতে পাইনি। সে তখন মাতাল। মাটির তলায় ঘরটাতে সে আমার সঙ্গে ধ্বস্তাধ্বস্তি শুরু করল। সে যা চাইছিল আমি তা করতে দিচ্ছিলাম না। জানো বোধহয়, প্রেম করবার সময় মেয়ে-পুরুষে যা করে।

হ্যাঁ জানি।

আমি তাকে ছোরা দিয়ে মারতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু তার গায়ে ভীষণ জোর। সমস্ত জোর দিয়ে আমাকে নাকে এমন জোরে ঘুষি মারল যে আমার নাক ভেঙে গেল। আমাকে অজ্ঞান করে বোধহয় আমার উপর কিছু একটা করেছিল। মানে, আমি জানি সে করেছিল। পরদিন আমি যখন তার কীর্তি আর আমার নাকের অবস্থা দেখলাম, আমার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হল। ভাবলাম আমার বাচ্চা হবে। তা যদি হত, আমি নিশ্চয়ই আত্মহত্যা করতাম। কিন্তু তেমন কিছু হল না। তারপর আমি ডাক্তারবাবুর কাছে গেলাম। তিনি আমার নাকের চিকিৎসা করলেন কিন্তু টাকা নিলেন । অন্য ব্যাপারটা সম্বন্ধে আমি তাকে কিছু বলিনি।

লোকটা আর ফিরে এল না। আমি তার জন্য অপেক্ষা করলাম। কিন্তু পরের বারের আখ কাটা শেষ হবার আগে কিছু করলাম না। আমি মতলব ঠিক করেছিলাম। অপেক্ষা করছিলাম কখন ব্লাক-উইডোে মাকড়সারা আশ্রয় নিতে আসে। শেষে একদিন তারা এল। তাদের সবচেয়ে বড় মেয়ে মাকড়সাটাকে ধরে আমি একটা বাক্সের মধ্যে না খেতে দিয়ে বন্দী করে রাখলাম। মারাত্মক জানোয়ার এই মেয়েগুলো। তারপর আমি একটা অন্ধকার রাত্রির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। যে রাত্রে চাঁদ উঠবে না, সেই রাত্রে মাকড়সাটা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি পৌঁছলাম লোকটার বাড়িতে। তার বাগানে ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে থেকে তাকে শুতে যেতে দেখলাম। তারপর একটা গাছ বেয়ে ব্যালকনিতে উঠে পড়লাম। দাঁড়িয়ে রইলাম যতক্ষণ না তার নাক ডাকার আওয়াজ পাওয়া যায়। তারপর গুঁড়ি মেরে। তার জানালা গলে ভেতরে ঢুকলাম। সে উলঙ্গ হয়ে ঘুমচ্ছিল মশারির ভেতরে। মশারির একটা দিক তুলে আমি বাক্সটা। খুললাম। ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে মাকড়সাটাকে বার করে তার পেটের ওপর ছেড়ে দিলাম। তারপর বাড়ি ফিরে এলাম।

হে সৃষ্টিকর্তা। শ্রদ্ধার সঙ্গে বন্ড বলল, লোকটার কি দশা হল?

আনন্দের সঙ্গে মেয়েটা বলল, তার মরতে এক সপ্তাহ সময় লেগেছিল। ভীষণ যন্ত্রণা পেয়েছিল। তাই হয়, জানো, ডাইনেরা বলে এমন যন্ত্রণা আর হয় না। বন্ড কোন মন্তব্য করল না দেখে মেয়েটি বলল, তুমি নিশ্চয়ই বলতে চাও না যে আমি অন্যায় করেছিলাম, বল?

এ রকম অভ্যেস থাকা ভাল নয়, বন্ড নরম সুরে বলল, কিন্তু এই ঘটনার জন্যে আমি তোমাকে দোষ দিই না। তারপর কি হল?

তারপর আমি আবার একইভাবে থাকতে লাগলাম। পেট ভরাবার জন্য আমাকে খুব পরিশ্রম করতে হত আর সেটা ছাড়া আমার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল টাকা জমানো, যাতে আমার নাক ভাল করতে পারি। সত্যি বলছি, আগে আমার নাক খুবই সুন্দর ছিল। তোমার কি মনে হয় যে ডাক্তাররা এটাকে ঠিক আগের মত করে দিতে পারবে?

তুমি যেমনটি চাইবে ঠিক তেমনটি করে দেবে। তুমি কি করে পয়সা রোজগার করতে?

ঐ বিশ্বকোষ থেকে আমি জানতে পেরেছিলাম যে লোকে ঝিনুক জমায় আর দুর্লভ জাতের ঝিনুক ভাল দামে বিক্রি হয়। স্থানীয় একজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানলাম যে ঝিনুক-সগ্রাহকদের নটিলাস নামক একটা নিজস্ব পত্রিকা আছে। পত্রিকার গ্রাহিকা হবার মত টায় টায় টাকা আমার কাছে ছিল। পত্রিকার বিজ্ঞাপনে লোকে যে সব ঝিনুক চায়, আমি সেগুলোর খোঁজ করলাম।

তারপর আমি মায়ামির এক ঝিনুক বিক্রেতাকে চিঠি লিখি আর সে আমার কাছে ঝিনুক কিনতে শুরু করে। প্রথম দিকে অবশ্য আমি ভুল করেছিলাম। যেমন, ভেবেছিলাম যে লোকেরা সুন্দর ঝিনুকই পছন্দ করে। কিন্তু তা নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা সবচেয়ে বিশ্রী ঝিনুকগুলো খোঁজে। তারপর দুর্লভ জাতের ঝিনুক পেলে আমি সেগুলোকে ঘষে মেঝে পরিষ্কার করতাম, যাতে তাদের ভাল দেখায়। সেটাও ভুল। সগ্রাহকরা ভেতরের প্রাণীটাসুদ্ধ যে অবস্থায় সমুদ্র থেকে তোলা হয় সেরকমই ঝিনুক চায়। সুতরাং ডাক্তারবাবুর কাছ থেকে কিছুটা ফর্মালিন জোগাড় করে আমি প্রতিটি জ্যান্ত ঝিনুকে একটু করে ঢেলে দিতে লাগলাম, যাতে বোটকা গন্ধটা বন্ধ হয়। আর তারপর মায়ামি পাঠিয়ে দিতাম, লোকটার কাছে। বছর খানেক আগে আমার পুরো ব্যাপারটা রপ্ত হয়ে আসে আর এরমধ্যে আমি পনের পাউন্ড জমিয়ে ফেলেছি। আমি বুঝেছি ওরা কি জিনিস চায়। ভাগ্য ভাল হলে আমি বছরে পঞ্চাশ পাউন্ড পর্যন্ত জমাতে পারি। তাহলে দশ বছরের মধ্যে আমি আমেরিকায় গিয়ে নাকের অস্ত্রোপচারটা করিয়ে নিতে পারতাম।

আর তারপর, মেয়েটা উচ্ছ্বসিত হাসি হেসে বলল, হঠাৎ আমার ভাগ্য খুলে গেল। আমি একদিন ক্র্যাব-কীতে এলাম। অবশ্য এর আগেও এসেছিলাম এখানে। তবে এট ছিল বড়দিনের ঠিক আগে। এই বেগুনে ঝিনুকগুলো খুঁজে পেলাম। এদের দেখে আমার তেমন কিছু মনে হয়নি। তবু দু-একটা পাঠিয়ে দিলাম মায়ামিতে। সঙ্গে সঙ্গে চিঠি এলো যে আমি যতগুলো পাঠাতে পারব সবকটা সে কিনে নেবে আর এক একটার দাম দেবে পাঁচ ডলার করে। সে আরো বলল যে, এই ঝিনুকের আড্ডার হদিশ যেন কেউ না পায়, নইলে, যাকে বলে, বাজার নষ্ট হয়ে যাবে আর দামও পড়ে যাবে।

আমার মনে হল নিজস্ব একটা সোনার খনি পেয়ে গেছি। এখন পাঁচ বছরের মধ্যেই আমি পুরো টাকা জমিয়ে। ফেলতে পারব। তাই আমি তোমাকে সমুদ্রতীরে দেখে সন্দিগ্ধ হয়েছিলাম, ভেবেছিলাম তুমি আমার ঝিনুক চুরি করতে। এসেছ।

তুমিও আমাকে চমকে দিয়েছিলে। আমি ভেবেছিলাম তুমি ডক্টর নো-র নর্ম সহচরী।

অনেক অনেক ধন্যবাদ।

কিন্তু অস্ত্রোপচারের পর তুমি কি করবে? তোমার নিশ্চয়ই ঐ মাটির তলার ঘরে সারাজীবন কাটানোর ইচ্ছে নেই।

ভাবছি রূপোপজীবিনী হব। খুব সহজভাবে বলল মেয়েটা। নার্স বা সেক্রেটারি হবার ইচ্ছে নেই।

 বটে! সেকি জিনিস? বন্ড ভাবল মেয়েটা নির্ঘাৎ কোথাও থেকে কথাটা শুনেছে, যদিও মানে জানা নেই।

ঐ যে, যে মেয়েগুলোর সুন্দর সুন্দর বাড়ি আর জামাকাপড় থাকে। তুমি খুব জানো আমি কি বলতে চাই। পুরুষেরা তাদের ফোন করে, তাদের বাড়ি আসে। এক সঙ্গে শোয়, আর তার জন্য টাকা পায়। নিউইয়র্কে এক একবারের জন্য। তারা একশ ডলার পায়। ভাবছি, ওখানেই কাজ শুরু করব। অবশ্য, প্রথমদিকে আমার অতটাকা নিলে চলবে না। যতদিন না আমি ভালভাবে কাজটা শিখি। অশিক্ষিত রূপোপজীবিনীদের তুমি কত করে দাও?

বন্ড বলল, ঠিক মনে পড়ছে না। অনেকদিনের কথা।

মেয়েটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ঠিকই তো। তুমি বোধহয় কিছু না দিয়েই যত চাও তত মেয়ে পেতে পার। কুৎসিত লোকেদেরই কেবল টাকা দিয়ে প্রেম করতে হয়। বড় শহরের সব চাকরিই নিশ্চয় সাংঘাতিক। তবে এই কাজে টাকা বেশি পাওয়া যায়। তারপর আমি জ্যামাইকায় ফিরে বো ডেজার্ট কিনে নেব। তখন আমার অনেক টাকা হবে, তাই ভাল একজন মানুষকে বিয়ে করা শক্ত হবে না। আমাদের ছেলেমেয়ে হবে। এখন এই ভেনাস ঝিনুকগুলি খুঁজে পাওয়াতে হিসেব করে দেখেছি যে আমার বয়স তিরিশে পৌঁছবার আগেই আমি জ্যামাইকায় ফিরতে পারব। খুব ভাল হবে, তাই না?

তোমার মতলবের শেষ দিকটা ভালই লাগছে। কিন্তু প্রথমদিকটায় আমার সন্দেহ আছে। যাই হোক, রূপোপজীবিনীদের বিষয়ে এত কিছু কি করে জানলে? বিশ্বকোষ থেকে?

কক্ষনো না। বাজে বোকো না। দু-বছর আগে নিউইয়র্কে বড় একটা মামলা হয়েছিল। য়েলকে নামে এক লম্পট ছিল। সে একদল মেয়ে মানুষ পুষতো। ঐ মামলাটা গ্রীনার কাগজে বেরিয়েছিল। তাছাড়া কিংসটনেও ওরকম মেয়ে হাজার-হাজার আছে। উঁচুদরের নয়। তারা পাঁচ শিলিং করে পায় আর ঝোঁপঝাড়ের আড়াল ছাড়া তাদের ব্যবসা চালাবার কোন উপায় নেই। ধাই-মা আমাকে তাদের কথা বলেছিল। বলেছিল আমি যেন কখনো ওদের মত না হই, হলে কোনদিন সুখী হতে পারব না। পাঁচটা শিলিং এর জন্য অবশ্য আমি কখনো ও কাজ করব না। তবে একশো ডলার পেলে…

বন্ড বলল, সে টাকার সবটা তুমি রাখতে পারবে না। খদ্দের যোগাবার জন্য তোমাকে একজন ম্যানেজার রাখতে হবে। পুলিশকে ঘুষ দিতে হবে। আর কোন গোলমাল হলেই সোজা জেল। শোন। পোকামাকড় বা জানোয়ারের সম্বন্ধে তোমার এত কিছু জানা আছে যে, তাদের দেখাশুনা করবার চমৎকার একটা চাকুরী তুমি পেতে পার যে কোন আমেরিকান চিড়িয়াখানায় বা জ্যামাইকা ইনস্টিটিউটে। এ কাজ তোমার অনেক বেশি ভাল লাগবে। ভাল বর জুটিয়ে নেওয়া শক্ত হবে না। রূপোপজীবিনী হবার কথা তুমি আর একদম ভাববে না। অতি সুন্দর তোমার শরীর। যাকে তুমি ভালবাসবে, তাকে কেবল উপহার দেবে এটাকে।

বইয়ে অবশ্য ও কথা বলে, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যে, বো ডেজার্ট ভালবাসবার মত কেউ নেই। তোমার আগে কোন ইংরেজের সঙ্গে আমার আলাপ হয়নি। তোমাকে আমার ভাল লেগেছে তাই তোমাকে এসব কথা বলতে আপত্তি নেই। আমার মনে হয় জ্যামাইকার বাইরে পালাতে পারলে ভাল লাগবার মত অনেককেই খুঁজে পাব।

নিশ্চয়ই পাবে। আর তুমি যে চমৎকার মেয়ে তোমাকে প্রথম দেখেই আমি বুঝেছিলাম।

অর্থাৎ আমার পেছনটা দেখে।

 বন্ড হাসল, তা পেছন দিকটাও চমৎকার, সামনের দিকটাও চমৎকার। এবার ঘুমাও দেখি, হানি। জ্যামাইকায় ফিরে অনেক গল্প করা যাবে।

সত্যি? ঘুম জড়ানো গলায়, কথা দিচ্ছ

দিচ্ছি।

বন্ড ঘুম থলিটার মধ্যে মেয়েটার নড়াচড়ার শব্দ শুনতে পেল। বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়বার আগে যেমন বড়সড় নিঃশ্বাস ফেলে, সেরকম আওয়াজ মেয়েটার দিকে হল।

চারদিক নিস্তব্ধ। ঠাণ্ডা পড়ছে। বন্ড ভাঁজ করা হাঁটুদুটোর ওপর মাথা রাখল। সারা দিনের স্মৃতি এবং তার জীবনে নবাগত এই অসাধারণ মেয়ে টার্জানটির চিন্তায় তার মন আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে যেন একটা সুন্দর প্রাণী তার পোষ মেনেছে। মেয়েটার সব সমস্যার সমাধান করবার আগে এ বাঁধন খোলা যাবে না। বন্ড তা জানত। অবশ্য অধিকাংশ সমাধানই হবে–অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করে দেবে। এমন কি বন্ধুদের সাহায্যে মেয়েটার জন্য একটা ভাল চাকরি আর ভাল বাড়ি জোগাড় করা যাবে। বন্ডের টাকা আছে। মেয়েটাকে ভাল পোশাক পরিচ্ছদ কিনে দেবে, চুলগুলো ঠিক করিয়ে দেবে যাতে তার নতুন জীবন ভালভাবে শুরু হয়।

কিন্তু অন্যদিকটা? সে যে মেয়েটির প্রতি তীব্র দৈহিক কামনা অনুভব করছে তার কি হবে? একটি অবোধ শিশুর সঙ্গে তো সহবাস করা যায় না। কিন্তু সত্যিই কি মেয়েটা অপরিণত। মেয়েটার কিছুই শিশুসুলভ নয়। মেয়েটা পরিণত, বুদ্ধিদীপ্ত এবং বন্ডের দেখা কুড়ি বছরের মেয়ের চেয়ে বেশি আত্মনির্ভর।

শার্টের হাতায় টান পড়তে বন্ডের চিন্তা কেটে গেল। মৃদু কণ্ঠস্বর, তুমি ঘুমোচ্ছ না কেন? ঠাণ্ডা লাগছে?

 আরে না, আমি ঠিক আছি।

ঘুম থলির ভেতরটা কিন্তু বেশ গরম। তুমি আসবে এর মধ্যে? অনেক জায়গা আছে।

না হানি ধন্যবাদ। আমি আরামেই আছি।

 প্রায় চাপা গলায় মেয়েটা বলল, তুমি যদি ভেবে থাক…মানে–আমার সঙ্গে কিছু করতে হবে না তোমার। আমি পিঠোপিঠি শুতে পারি।

হানি প্রিয়ে, তুমি ঘুমোও দেখি। ওরকম করে শুতে পারলে ভালই হত, কিন্তু আজ নয়। তাছাড়া একটু পরেই কোয়ারেলের জায়গায় পাহারা দিতে হবে।

হুঁ, বুঝেছি। অসন্তুষ্ট গলায়, জ্যামাইকা ফিরে যাবার পর।

হতে পারে।

প্রতিজ্ঞা করো। নইলে আমি ঘুমোবই না।

হ্যা, হ্যাঁ, একশোবার প্রতিজ্ঞা করছি। এবার ঘুমোও।

চাপা কণ্ঠস্বরে, এইবার তাহলে তুমি আমাকে দাসখৎ লিখে দিলে, মনে থাকে যেন তুমি প্রতিজ্ঞা করেছ। শুভরাত্রি প্রিয় জেমস্।

শুভরাত্রি, প্রিয়ে হানি।

.

ভয়ঙ্করের আগমন

কে যেন উত্তেজিতভাবে বন্ডের কাঁধ চেপে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল সে।

কোয়ারেল ভয়ার্তকণ্ঠে ফিসফিসিয়ে উঠল, কি একটা পানির ওপর দিয়ে আসছে। নিশ্চয়ই সেই ড্রাগনটা।

মেয়েটার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। সে আশাঙ্কার সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে?

 বন্ড বলল, তুমি ওখানেই থাক, হানি। কোথাও যেও না। আমি এক্ষুনি ফিরে আসছি। বলে সে ঝোঁপের মধ্যে দিয়ে দৌড় মারল। ছুটে চলল বালির ওপর দিয়ে পাহাড়ের বিপরীত দিকে। কোয়ারেল তার পেছন পেছন এল।

খোলা জায়গাটার কুড়ি গজ দূরে বালুচরের শেষ প্রান্তে পৌঁছল তারা, প্রান্তিক ঝোঁপগুলোকে সরিয়ে বন্ড তার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারল।

কি ওটা? আধ মাইল দূরে পানির ওপর দিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে অদ্ভুত চেহারার একটা কিছু। জলন্ত কমলারঙের চোখের মাঝখানে কালো মনি, তাদের মাঝখানে, যেখানে মুখটা থাকা উচিত, সেখানে লক্-লক্ করছে একগজ লম্বা একটা নীল আগুনের শিখা। তারাদের ধূসর আলোয় দেখা যাচ্ছে কেমন একটা গম্বুজের মত মাথা আর একজোড়া বাদুড়ে ডানা। জিনিসটা গর্জন করে চলেছে, তার তলায় চাপা পড়ে যাচ্ছে গভীর ধক-ধক্ শব্দ। পানি কেটে এগিয়ে আসছে ঘণ্টায় দশ মাইল বেগে।

কোয়ারেল বলল, সর্বনাশ ক্যাপ্টেন! ঐ সাংঘাতিক জিনিসটা কি?

বন্ড উঠে দাঁড়াল। বলল, ঠিক বুঝতে পারছি না। একটা ট্রাকটার ধরনের জিনিসকে বিদঘুঁটে করে সাজানো হয়েছে। ওটা ডিজেলে চলছে, সুতরাং তুমি ড্রাগনের কথা ভুলে যেতে পার। এবার দেখা যাক, বন্ড আপন মনেই বলল, পালিয়ে লাভ নেই, দানবটা আমাদের চেয়ে জোরে চলতে পারে। আমরা জানি ঝোঁপজাড় বা জলা ওকে আটকাতে পারে না। দাঁড়িয়েই লড়াই করতে হবে। এর কোন জায়গাটা দুর্বল হবে? চালকদের কেবিন? অবশ্য সুরক্ষিত থাকবে, ঠিক তা জানা নেই। কোয়ারেল ওটা দুশোগজের মধ্যে এলেই তুমি গম্বুজটা লক্ষ্য করে গুলি চালাতে শুরু করবে। লক্ষ্য স্থির করে গুলি করবে। পঞ্চাশ গজের মধ্যে এলে আমি হেড লাইট দুটোর দিকে গুলি ছুঁড়ব। এ জিনিসটা ট্র্যাক্টারের মত চাকায় চলছে না, নিশ্চয়ই বড় ধরনের চাকা আছে। সম্ভবত এরোপ্লেনের চাকা। সেগুলোর দিকেও আমি গুলি চালাব। এখানেই থাক তুমি। আমি দশ গজ দূরে থাকব। ওরা পাল্টা গুলি চালারে মেয়েটাকে আড়াল করতে হবে। ঠিক আছে।

বন্ড হাত বাড়িয়ে কোয়ারেলের বিশাল কাঁধে চাপ দিল, আর বেশি ঘাবড়িয়ো না। ড্রাগনের কথা ভুলে যাও। এটা ডক্টর নো-র তৈরি একটা যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। ড্রাইভারদের মেরে আমরা গাড়িটাকে দখল করে নেব, তারপর ওটাতে চড়ে পূর্ব উপকূলের দিকে ফিরে যাব। কি বল?

কোয়ারেল একটু হেসে বলল, ভাল কথা, ক্যাপ্টেন। আপনি যখন বলছেন তখন তাই হবে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা জানেন ওটা সত্যিই ড্রাগন কিনা!

বন্ড বালির ওপর দিয়ে ছুটে গেল। ঝোঁপগুলোকে ভেঙে ভেঙে এগিয়ে গেল যতক্ষণ না তার সামনে গুলি চালাবার। রাস্তা একেবারে পরিষ্কার হয়। তারপর আস্তে ডাকল, হানি।

 এই যে জেমস্। কাছেই মেয়েটার গলা শোনা গেল।

সকালের মত বালি খুঁড়ে একটা গর্ত তৈরি কর। সবচেয়ে মোটা শেকড়গুলোর পেছনে। তারপর তার মধ্যে ঢুকে চুপচাপ শুয়ে থাক। গুলি চলতে পারে। ড্রাগন একটা স্রেফ রংকরা মোটর গাড়ি। ডক্টর নো-র কয়েকজন লোক ওটাকে চালাচ্ছে। ভয় পেও না, আমি কাছেই আছি। ঠিক আছে, জেমস, সাবধানে থেক।

বন্ড এক হাঁটু গেড়ে বসে ঝরাপাতার ওপর উঁকি মেরে দেখল ওরা মাত্র শ তিনেক গজ দূরে। হলদে হেড লাইট দুটো বালুচরের ওপর আলো ফেলছে। এখন তার মুখে নীল শিখা লক্লক্ করছে। আগুনটা বেরিয়ে আসছে ওটার লম্বা নাক থেকে নাকটা আবার একজোড়া হাঁ করা চোয়াল দিয়ে সাজানো আর সোনালি রং করা, যাতে সবকটাকে ঠিক ড্রাগনের মুখের মত দেখায়। আগুন ছোড়বার নল। পোড়া ঝোঁপগুলো এবং আহত ওয়ার্ডেনটির গল্পের রহস্য এখন পরিষ্কার হচ্ছে। কতদূর আগুন ছুঁড়তে পারে যন্ত্রটা?

বন্ডকে মানতে হল যে এই বস্তুটি যদি একটানা গর্জনের সঙ্গে দীঘির পানির ওপর দিয়ে এগিয়ে চলে তাহলে সত্যিই একটা ভয়াবহ দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। ডিজেল ইঞ্জিনের পরিচিত ধকধক শব্দটা কানে না গেলে হয়ত সে নিজেও ভয় পেত। স্থানীয় অধিবাসীদের বিরুদ্ধে এ যন্ত্রটা যে ভীষণ কাজ দেবে সন্দেহ নেই। কিন্তু আগ্নেয়াস্ত্রধারী দু জন নির্ভীক মানুষের বিরুদ্ধে এটা কতক্ষণ দাঁড়াতে পারে?

সঙ্গে সঙ্গে কোয়ারেলের রেমিংটন রাইফেলের গর্জন শোনা গেল। ঠং করে একটা আওয়াজের সঙ্গে গম্বুজওয়ালা মাথাটা থেকে একরাশ আগুনের ফুলকি ছিটকে বেরুল। আরেকটা গুলি চালাল কোয়ারেল, তারপর অনেকগুলো বুলেট। যন্ত্রটার মাথার চারিদিকে অজস্রবার আঘাত করল কিন্তু কিছুই হল না, ওটার গতি পর্যন্ত একটুও কমলো না। গড়িয়ে চলল একভাবে, কেবল একটু বেঁকে গেল, যেদিক দিয়ে গুলি আসছে সে দিকে।

বন্ড তার স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন রিভলবার বাম বাহুর ওপর ভর দিয়ে রেখে লক্ষ্য স্থির করল। রেমিংটনের আওয়াজ ছাপিয়ে তার রিভলবারের তীব্র গর্জন শোনা গেল। একটা হেড লাইট চুরমার হয়ে নিভে গেল। অন্য হেড লাইটে পাঁচবার গুলি চালাবার পর সেটাও চুরমার হয়ে নিভে গেল। যন্ত্রটা কোন পরোয়া না করে সোজা কোয়ারেলের দিকে এগিয়ে চলল। বন্ড রিভলবারে নতুন গুলি ভরে সাজানো বাদুড়ে ডানা দুটোর তলায় ফোলা চাকাগুলোর দিকে গুলি চালাতে লাগল। এখন ওটা মাত্র ত্রিশ গজ দূরে। আর সে স্পষ্ট বুঝতে পারল সামনের চাকায় একটার পর একটা গুলি লেগেও কিছু হল না। বন্ড এবার ভয়ের শিহরণ অনুভব করল।

আবার গুলি ভরল। হতচ্ছাড়া যন্ত্রটাকে কি পেছন দিক থেকে ঘায়েল করা সম্ভব? সে কি দীঘির মধ্যে ছুটে গিয়ে ওটাতে চড়ে পড়বার চেষ্টা করবে। ঝোঁপের মধ্যে এক পা এগুতে গিয়ে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে হল তাকে।

সহসা ওটার নাক থেকে এক ঝলক নীল আগুন সগর্জনে ছুটে গেল যেখানটায় কোয়ারেল লুকিয়ে ছিল। বন্ডের ডানদিকের ঝোঁপগুলো থেকে এক ঝলক কমলা ও লাল রঙের আগুন ঝলসে উঠল, আর শোন গেল এক অপার্থিব চিৎকার। পরক্ষণেই তা স্তব্ধ হয়ে গেল। কাজ শেষ করে লকলকে আগুনের শিখাটা যন্ত্রের নাকের মধ্যে ফিরে গেল। এবার যন্ত্রটা ঘুরে তার নীল মুখ গহ্বর সোজা বন্ডের দিকে উদ্যত।

বন্ড দাঁড়িয়ে নিজের ভয়াবহ পরিণামের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। কোয়ারেলের কথা ভাববার সময় নেই। কল্পনার চোখে সে দেখতে পেল পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া, ঘোয়া ওঠা কোয়ারেলের মৃতদেহটা পড়ে রয়েছে গলিত বালির ওপর। এক্ষুণি সেও মশালের মত জ্বলে উঠবে। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে মর্মান্তিক আর্তনাদ। তারপর হানি-র পালা। সৃষ্টিকর্তা। তাদেরকে এ কোথায় টেনে এনেছে। সে এ রকম মারাত্মক অস্ত্রধারী শত্রুকে আক্রমণ করবার মত উন্মাদ কি করে হল। যে দীর্ঘ তর্জনী জ্যামাইকাতে তাকে সাবধান করে দিতে চেয়েছিল, তাকে দেখেই কেন সে সতর্ক হয়ে যায়নি। বন্ড দাঁতে দাঁত ঘষল। শীগগীর কর হারামজাদারা, শেষ করে দে।

লাউডস্পীকারের কাংস্য-স্বর শোনা গেল, বেরিয়ে আয়, ইংরেজের বাচ্চা। মেয়েটাকেও নিয়ে আয়। চটপট কর, নইলে তোর বন্ধুর মত তোদেরকেও নরকের আগুনে পোড়াব। আদেশটা ভালভাবে বোঝানোর জন্য ছোট একটা আগুনের ঝলক তার দিকে ছুটে এল। বন্ড এক পা পিছিয়ে আত্মরক্ষা করল। পিঠে মেয়েটার স্পর্শ পেল। আমি না এসে পারলাম না, পারলাম না।

বন্ড বলল, ঠিক আছে, হানি। আমার পেছনে থাক।

 বন্ড মনস্থির করল। তার সামনে অন্য কোন পথ খোলা নেই। মৃত্যু যদি আসেই, তা অন্তত এ মৃত্যুর চেয়ে বীভৎস হবে না। সে মেয়েটার হাত ধরে বালির ওপর বেরিয়ে এল।

জোর আওয়াজ হল। ঐখানেই থাম্। লক্ষ্মী ছেলে। আর ঐ খেলনা বন্দুকটা ফেলে দে। চালাকি করার চেষ্টা করিস না। নইলে কাঁকড়াদের জন্য রান্না করা খাবার বানিয়ে দেব।

বন্ড রিভলবার ফেলে দিল। বিদায় স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন, বেরেটা থাকলে এর চেয়ে বেশি কাজে লাগত না। মেয়েটা ফোপাচ্ছে। বন্ড তার হাতে চাপ দিয়ে বলল, মাথা ঠাণ্ডা কর হানি। যেমন করে তোক আমরা এ ফাঁদ থেকে পালাব। ডাহা মিথ্যে কথার জন্য বন্ড নিজেকে বিদ্রূপ করল।

একটা লোহার দরজা খোলার ধাতব শব্দ শোনা গেল। গম্বুজটার পেছন থেকে একটা লোজ পানিতে লাফিয়ে নামল। তারপর তাদের দিকে এগিয়ে এল তার হাতে পিস্তল। আগুনের নলটার সামনে থেকে সরে ছিল সে। লকলকে নীল আগুন তার ঘর্মাক্তমুখে আলো ফেলছিল। একজন চীনে নিগ্রো। বিশাল চেহারা, পরনে কেবল হাফপ্যান্ট। তার বাঁ হাতে একজোড়া হাতকড়া ঝুলছে।

লোকটা একগজ দূরে এসে দাঁড়াল। বলর, হাত দুটোকে সামনে বাড়িয়ে কব্জি দুটা এক কর। তারপর আমার দিকে এগিয়ে আয়। তুই আগে আয় ইংরেজের বাচ্চা। খুব আস্তে।

বন্ড কথা মত কাজ করল। লোকটার সামনে আসতেই লোকটা দাঁতে পিস্তলটা চেপে ধরে হাত বাড়িয়ে বন্ডের কব্জিতে হাতকড়া এঁটে দিল। নীল আগুনে ইস্পাতের মত মুখটার দিকে বন্ড তাকিয়ে দেখল। ভয়ংকর। ট্যারা একটা মুখ। লোকটা মুখ ভেংচে বলল, বুদ্ধ বেজন্মা কোথাকার।

বন্ড ঘুরে দাঁড়িয়ে বিপরীত দিকে হাঁটতে লাগল। সে কোয়ারেলের দেহটা দেখতে চায়। বন্ডের পেছনে পিস্তলের গর্জন শোনা গেল, পায়ের কাছি বালি ছিটকে উঠল। থেমে গেল সে। ঘাবড়িয়ো না। যে লোকটাকে তোমরা এইমাত্র খুন করলে তাকে দেখে এখুনি ফিরে আসছি।

লোকটা পিস্তল নামিয়ে কর্কশ কণ্ঠে হেসে বলল, ঠিক আছে। যা প্রাণে চায় কর। পুষ্পমাল্য-টাল্য না আনার জন্য দুঃখিত। চটপট ফিরে আয় নইলে মেয়েটাকে ঝলসে দেব। দুমিনিট।

বন্ড হেঁটে চলল ধোঁয়া ওঠা ঝোঁপগুলোর দিকে। সেখানে পৌঁছে তার চোখ-মুখ কুঁচকে গেল। হ্যাঁ, ঠিক যে রকমটা সে কল্পনা করেছিল বরং তার চেয়েও ভয়ংকর, সে আস্তে আস্তে বলল, আমি দুঃখিত। কোয়ারেল। হাতকড়া বাঁধা দু হাতে খানিকটা ঠাণ্ডা বালি তুলে কোয়ারেলের দুই চক্ষুকোটরের দগ্ধাবশেষের মধ্যে ঢেলে দিল। তারপর ধীরপদে ফিরে এল।

লোকটা পিস্তলের ইঙ্গিতে তাদের সামনে যেতে বলল। তারা ঘুরে গিয়ে দাঁড়াল যন্ত্রটার পেছনে। সেখানে ছোট চৌকো একটা দরজা। ভেতর থেকে কে যেন বলল, ভেতরে এসে মেঝেতে বসে পড়। কোন জিনিসে হাত দিসনা। যেন, আঙ্গুল ভেঙ্গে দেব। তারা লৌহযন্ত্রের ভেতর ঢুকল। চারদিকে তেল আর ঘামের বিশ্রী গন্ধ। কোনরকমে হাঁটু মুড়ে বসে থাকার জায়গা পেল। বন্দুকধারী তাদের পেছন পেছন উঠে দরজা বন্ধ করে দিল। একটা আলো জ্বালিয়ে ড্রাইভারের পাশে বসল। বলল, ঠিক আছে স্যাম। রওনা হওয়া যাক। আগুনটা বন্ধ করতে পার। গাড়ি চালানোর। পক্ষে যথেষ্ট আলো আছে।

যন্ত্রের ইনস্ট্রমেন্ট প্যানেলে সারি-সারি ডায়াল ও সুইচ বসানো। ড্রাইভার হাত বাড়িয়ে গোটা দুয়েক সুইচ টেনে। দিল। গিয়ার বদলে দিয়ে তার সামনের একটা সরু ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকাল। বন্ড অনুভব করল যন্ত্রটা ঘুরছে। ইঞ্জিনের স্পন্দন দ্রুততর হল, তারপর চলতে শুরু করল।

মেয়েটা কাঁপা গলায় বলল, ওরা আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে

বন্ড ঘুরে তার দিকে তাকাল। ঘুমের জন্য মেয়েটার শুকনো চুলগুলো বিশৃঙ্খল, সোজা কাঁধ পর্যন্ত নেমে কুকড়ে গেছে ভেতরদিকে। হালকা ধূসর স্বর্ণাভ চুল বৈদ্যুতিক আলোয় রূপালি দেখাচ্ছে। ঠোঁটের দু পাশ এবং চোখের চারদিক ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।

বন্ড চাপা গলায় বলল, মনে হয় ডক্টর নো-র সঙ্গে দেখা করতে চলেছি। অত ভয় পেয়ো না, হানি। এ লোকগুলো ক্ষুদে গুণ্ডা ছাড়া আর কিছু নয়। তার সঙ্গে দেখা হলে তুমি কিন্তু কিছু বোলো না। আমি আমাদের দুজনের হয়ে বলব। তুমি তো ভারি সুন্দর করে চুল আঁচড়াও। চুল ছোট করে না ছেটে ভাল করেছ। এ রকমটা আমার খুব ভাল লাগে।

মেয়েটার মুখে হাসি দেখা গেল, এরকম সময়ে কি করে ওসব কথা তোমার মাথায় আসে? তবে আমার চুল তোমার ভাল লেগেছে শুনে খুশি হলাম। সপ্তাহে একবার আমি নারকেল তেলে চুল ধুই। নিজের অন্য জীবনটার কথা মনে পড়তে তার চোখে অশ্রু চকচক করে উঠল। চাপা গলায় বলল, আমি ঠিক থাকতে চেষ্টা করব। তুমি অন্তত যতক্ষণ পাশে থাকবে–ভয় পাব না।

বন্ড সরে মেয়েটার কাছ ঘেঁষে বসল। শৃঙ্খলাবদ্ধ হাত দুটো চোখের সামনে এনে পরীক্ষা করল আমেরিকার হাতকড়া। সে তার বাঁ হাতটাকে কুঁচকে হাতকড়ার গোল বন্ধনী থেকে বের করবার চেষ্টা করল। কিন্তু অসম্ভব, কোন সুবিধে হল না।

লোক দু জন তাদের দিকে পেছন করে নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বসে আছে। তারা জানে বন্দী দুজন সম্পূর্ণ বশে এসে গেছে। বন্ডের পক্ষে কোন বিপদের সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। জায়গাটা এত ছোট যে বন্ড দাঁড়াতে পর্যন্ত পারবে না। যদি বন্ড দরজাটা খুলে পানিতে ঝাঁপ দেয় তাহলে? তাহলে দরজা দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া ঢোকার স্পর্শ পেয়ে গাড়ি থামিয়ে দেবে। তারপর হয় তাকে পানির মধ্যেই সিদ্ধ করে দেবে কিংবা তুলে নেবে। এদের বুদ্ধি যদি একটু কম হত তাহলে বন্ডের পক্ষে তাদের মাথায় আঘাত করে অজ্ঞান করে দেওয়া অসম্ভব ছিল না। কিন্তু লোক দুটো কাজ জানে। এরা পেশাদার গুণ্ডা, অথবা এদের শিখিয়ে পড়িয়ে এতটা দক্ষ করা হয়েছে।

লোক দুজন কোন কথা বলছিল না। তারা কি রকম চালাকি করেছে, কোথায় যাচ্ছে, কিংবা তারা যে এত ক্লান্ত এসব নিয়ে কোন বকবক করল না। পাকা হাতে তাদের কাজ সেরে গাড়ি চালাল দক্ষ ও শান্তভাবে।

বন্ড এখন বুঝতে পারছিল না যে এ যন্ত্রটা কি হতে পারে। কালো আর সোনালি রং এবং অন্য সব বিচিত্র সাজগোছের তলায় একটা ট্র্যাক্টার জাতীয় গাড়ি, কিন্তু কোন জাতের তা বন্ডের জানা নেই বিরাট মসৃণ করে তৈরি চাকাগুলো বন্ডের প্রায় দ্বিগুণ উঁচু। চাকাগুলো কঠিন রাবারের তৈরি অথবা নরম রাবারে ঠাসা। পুরো জিনিসটাকে ড্রাগনের আকৃতি দেবার জন্যে দু পাশে সোনালি কালো লোহার ডানা লাগানো, রেডিয়েটারের সামনে ধাতুর তৈরি ড্রাগনের মাথা, আর হেড লাইটের কেন্দ্রে কালো রঙের ছোপ, যাতে সে দুটোকে চোখের মত দেখায়। এছাড়া বিশেষ কিছু নেই। কেবল কেবিনের ওপরটা পুরু লোহার গম্বুজে ঢাকা ও তার সামনে আগুন ছোড়বার যন্ত্র। জিনিসটা বন্ড যা ভেবেছিল তাই–ভয় দেখানো ও আগুন লাগানোর জন্যে তৈরি একটি বিচিত্র সজ্জার ট্রাক্টার। স্পষ্টতঃই এই দ্বীপে চলাফেরার পক্ষে এ জাতের গাড়ি সর্বশ্রেষ্ঠ। এই বিরাট চওড়া চাকাগুলো ঝোঁপঝাড়, জলাভূমি বা অগভীর দীঘির পানির ভেতর দিয়ে চলতে পারে।

বন্ড মুগ্ধ হল। এরকম পেশাদারি পাকা কাজ তার ভাল লাগে। ডক্টর নো নিশ্চয়ই একজন পরিশ্রমী ও যত্নবান লোক। ডক্টর নো-র গুপ্ত রহস্যের মুখোমুখি আসবে সে। আর তারপর? এত তথ্য সংগ্রহের পর তাকে অবশ্য আর দ্বীপের থেকে ফেরত দেওয়া হবে না। নিঃসন্দেহে তাকে হত্যা করা হবে। আর মেয়েটার কি হবে? বস্তু কি তার নির্দোষিতা প্রমাণ করে তাকে মুক্ত করতে পারবে? কিন্তু মুক্তি পেলেও এই দ্বীপ থেকে মেয়েটাকে আর বেরোতে দেবে না। বাকি জীবনটা তার এখানেই কাটাতে হবে। ডক্টর নো বা তার কোন অনুচরের রক্ষিতা হয়ে।

গাড়ির ঝাঁকুনিতে বন্ডের চিন্তায় বাধা পড়ল। তারা দীঘি পেরিয়ে এসেছে। পাহাড় থেকে যে রাস্তাটা কুটির পর্যন্ত নেমে গেছে সেই রাস্তা ধরে চলেছে। গাড়ি চড়াই বেয়ে উঠতে লাগলে, কেরিনটা হেলে গেল একটু। পাঁচ মিনিটের মধ্যে তারা পৌঁছে যাবে।

ড্রাইভারের সঙ্গীটি ঘাড় বেঁকিয়ে তাদের দেখল। বন্ড তার দিকে খুশির হাসি হেসে বলল, এই সাফল্যের জন্য তুমি নির্ঘাত একটা মেডেল পাবে।

বেগুনে রঙের ফোলা ঠোঁট দুটো বিকৃত হয়ে ঘৃণা ফুটে বেরোল, তোর-মুখটা বন্ধ কর।

 মেয়েটা বন্ডকে ঠেলা মেরে বলল, ওরা এরকম বিশ্রী ব্যবহার করছে কেন? এত রাগ কেন আমাদের ওপর

বন্ড হেসে বলল, বোধহয় আমরা ওদের ভয় পাইয়ে দিয়েছিলাম বলে। এখনো ভয় কাটেনি। কারণ আমরা ওদের দেখে তেমন ভয় পাচ্ছি না। এই মেজাজটা বজায় রাখতে হবে।

মেয়েটা আরও ঘেঁষে এসে বলল, চেষ্টা করব।

রাস্তা ক্রমশ খাড়া হচ্ছে। লোহার পাতের ফাঁক দিয়ে ধূসর এসে পড়ছে। ভোর হচ্ছে। বাইরে ঝলসানো গরম, বিশ্রী হাওয়া, আর মার্শ গ্যাসের দুর্গন্ধে ভরা একটি দিন জন্ম নিচ্ছে। বন্ড কোয়ারেলের কথা ভাবছিল। সেই নির্ভীক দৈত্যটি, যে আজকের সূর্য ওঠা আর দেখতে পেল না। যার সঙ্গে তাদের এখন জলাভূমির ভেতর দিয়ে দীর্ঘ যাত্রা শুরু করার কথা ছিল। জীবন বীমাটার কথা মনে পড়ল। কোয়ারেল বুঝেছিল মৃত্যু আসছে। তবু বিনা দ্বিধায় সে বন্ডকে অনুসরণ করেছিল। তার ভীতির চেয়েও প্রবল ছিল বন্ডের ওপর আস্থা। বন্ড সে বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারেনি। বন্ড কি মেয়েটিরও মৃত্যুর কারণ হবে।

গাড়ি থামল। ড্রাইভার একটা সুইচ টিপে পাশে রাখা মাইক্রোফোনটা তুলল। গাড়ির বাইরে লাউডস্পীকারের গর্জন শোনা গেল, সব ঠিক আছে। ইংরেজটাকে আর মেয়েটাকে ধরে এনেছি। অন্য লোকটা মারা গেছে। ঐ ক জনই ছিল। দরজা খোেল।

বন্ড দরজা খোলার আওয়াজ পেল। ড্রাইভার ক্লাচ দাবালো এবং তারা কয়েক গজ গড়িয়ে গিয়ে আবার থেকে গেল। লোকটা ইঞ্জিন বন্ধ করল। লোহার দরজাটা সশব্দে বাইরে থেকে খুলে গেল। এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া এসে ঢুকল কেবিনে। কয়েক জোড়া হাত বন্ডকে চেপে ধরে রুক্ষভাবে টেনে নামাল সিমেন্টের মেঝের ওপর।

বন্ড উঠে দাঁড়াল। তার একপাশে পিস্তলের খেচা এসে লাগল। একটা গলা শোনা গেল। ঐখানে দাঁড়িয়ে থাক। কোন চালাকি নয়। লোকটা আরেকটা চীনে নিগ্রো, বন্ড দেখল। হলদে চোখ দুটো কৌতূহলের সঙ্গে তাকে পরীক্ষা করছে। বন্ড নিস্পৃহভাবে ঘুরে দাঁড়াল। অন্য একটা লোক মেয়েটাকে পিস্তলের খোঁচা মারছিল। বন্ড তীব্রকণ্ঠে বলল, মেয়েটার গায়ে হাত দিও না। হেঁটে এসে মেয়েটার পাশে দাঁড়াল। লোক দুটো চমকে গেছে বলে মনে হল।

একজন প্রহরী বলল, খবরটা পাঠিয়ে দিয়েছি। এদেরকে ভেতরে পাঠাবার আদেশ এসেছে। সব ঠিক ছিল তো?

ড্রাইভারের সঙ্গীটি এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিল বলে মনে হল। সে বললে, নিশ্চয়ই। তবে একটু গুলি চলেছিল। আললাগুলো ভেঙ্গে গেছে। চাকাতে কয়েকটা ফুটো হতে পারে। ছেলেগুলোকে এক্ষুনি কাজে লাগিয়ে দাও–সব মেরামত করতে হবে। এই দুজনকে ভেতর দিয়ে এসে ঘুম লাগাব। বন্ডের দিকে ঘুরে, ঠিক আছে, এবার চল। লম্বা বাড়িটার দিকে ইঙ্গিত করে বলল সে।

বন্ড বলল, তুমি চল দেখি। ভদ্র ব্যবহার করতে শেখ। আর ঐ বাঁদরগুলোকে পিস্তল নামাতে বল, গুলি ছুটে যেতে পারে। চেহারা দেখে তো নেহাৎ বুদ্ধ বলে মনে হয়।

লোকটা কাছে সরে এল। অন্য তিনজনও এগিয়ে এল তার পেছন পেছন। তাদের লাল চোখে বিদ্বেষের আগুন জ্বলছে। সামনের লোকটা একটা বিরাট ঘুসি পাকিয়ে বন্ডের নাকের নিচে ধরল। চাপা উত্তেজিত গলায় বলল, শুনুন সাহেব। আপনাদের মত লোককে কোন কোন সময় শেষের দিকে আমাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। সৃষ্টিকর্তা করুন, এবার যেন তাই হয়। এবার পুরো একটা সপ্তাহ ধরে আমরা মজা মেরেছিলাম। আর মাইরী তোদেরকে যদি হাতে পাই…। লোকটার দুচোখে হিংসার আগুন। এবার ওর দৃষ্টি বন্ডকে পেরিয়ে মেয়েটার ওপর গিয়ে পড়ল। চোখ দুটো থেকে যেন লালা ঝরতে লাগল, বেগুনে ঠোঁট দুটোর ভেতর দিয়ে বেরিয়ে এল গোলাপী জিভের আগাটুকু। প্যান্টের দু পাশের হাত দুটো ঘষে নিয়ে সঙ্গী তিনজনের দিকে তাকাল, কি বল দোস্ত? অন্য তিনজনও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল মেয়েটার দিকে।

বন্ডের প্রবল ইচ্ছে হল পাগলের মত ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শৃঙ্খলাবদ্ধ দুহাতের আঘাতে মুখগুলো ভেঙে দিতে। তাতে যদি নিজেকে রক্তাক্ত হতে হয় সে-ও সহ্য হবে। সে বলল, ঠিক আছে। তোমরা হলে চারজন আর আমরা দুজন, তার ওপর দুহাত আমাদের বাধা। চল। তোমাদের কোন ক্ষতি করব না আমরা। আর বেশি বাড়াবাড়ি কোর না। ডক্টর নো সেটা নাও পছন্দ করতে পারেন।

নামটা শোনামাত্র লোকগুলোর মুখের চেহারা পাল্টে গেল। তিন জোড়া চোখ বন্ডের ওপর থেকে সরে তাদের নেতার দিকে চেয়ে বিস্ফারিত হল। সামনের লোকটি এক মিনিট ধরে সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে থেকে আন্দাজ করতে চেষ্টা করল যে তাদের মালিকের ওপর বন্ডের কোন দখল থাকা সম্ভব কিনা। কি যেন বলবার জন্য মুখ খুলল। তারপর চেপে গেল। দুর্বল গলায় বলল, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, আমরা একটু ঠাট্টা করছিলাম। অন্যদের দিকে তাকিয়ে তাই না?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, একশ বার। বিড়বিড় করে বলল তারা।

সামনের লোকটি রুক্ষভাবে বলল, এদিকে এস্, মিস্টার। লম্বা ঘরটা দিয়ে এগিয়ে চলল সে।

 মেয়েটার হাত ধরে বন্ড তাকে অনুসরণ করল। ডক্টর নো-র নামের গুরুত্ব বুঝতে পেরে সে খুশি হয়েছিল।

লোকটা ঘরের শেষে এক অমসৃণ কাঠের দরজার সামনে পৌঁছল। পাশের কলিং বেলটা দু বার টিপে দাঁড়িয়ে রইল। ক্লিক করে আওয়াজ হল, দরজাটা খুলল। দেখা গেল দশ গজ লম্বা কার্পেট বিছানো একটা পাথরের গলি। গলির অপর প্রান্তে সুন্দর ক্রীমরঙের দরজা।

লোকটা সরে দাঁড়াল। সোজা চলে যাও, মিস্টার। ঐ দরজায় টোকা দিয়ে। রিসেপশনিস্ট তোমাদের ব্যবস্থা করবেন।

বন্ড গলিতে ঢুকল, পেছনে মেয়েটা। তাদের পেছনের দরজাটা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল। বন্ড থেমে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল, এবার কি

হানি কাঁপা হাসি হেসে, পায়ের তলায় কার্পেট থাকলে তো ভারি আরাম লাগে।

 বন্ড তার হাতে চাপ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে ক্রীম রঙের দরজায় টোকা মারল।

দরজা খুলে গেল। বন্ড ভেতরে ঢুকল। পরক্ষণেই একেবারে থেমে গেল। মেয়েটা বন্ডের পেছনে আসছিল। সে ধাক্কা খেল বন্ডের সঙ্গে। বস্ত বুঝতে পারল না। শুধু দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *