ঠিকে ভুল
উপক্রমণিকা
কলিকাতার কোন এক প্রকাণ্ড অট্টালিকার একটি প্রকোষ্ঠ-মধ্যে চারি বন্ধুতে বসিয়া কথোপকথন করিতেছিল। চারিজনই সমবয়স্ক যুবক।
পার্শ্ববর্ত্তী গৃহে একজন বৃদ্ধ একখানা কৌচের উপরে অর্দ্ধ শায়িতভাবে বসিয়া একখানি পুস্তক পাঠ করিতেছিলেন। বৃদ্ধের পেশোক-পরিচ্ছদ পরিষ্কার, চোখে সোনার চশমা। শুভ্র শ্মশ্রুও ছোট করিয়া ইংরাজি ধরণে ছাঁটা। এই উভয় প্রকোষ্ঠের মধ্যবর্তী দ্বার কিয়ৎ পরিমাণে উন্মুক্ত ছিল, তাহাতেই যুবকগণ তাঁহাকে দেখিতে পাইতেছিল। তাহারা মধ্যে মধ্যে বৃদ্ধ ভদ্রলোকের দিকে বঙ্কিমনেত্রে দেখিতেছিল।
যুবক চতুষ্টয়ের মধ্যে সহসা একজন নিম্নস্বরে বলিল, “প্রায় পড়া শেষ হইয়া আসিল।”
অপর একজন বলিল, “ডিটেকটিভ উপন্যাস—পাঁচকড়ি বাবুর ‘মায়াবী’।”
অপর একজন বলিল, “বলেন কি! বৃদ্ধ বয়সে ডিটেকটিভ উপন্যাসের উনি এত ভক্ত। উনি খুব এক মনে পড়িতেছেন, দেখিতেছি।”
প্রথমোক্ত যুবক বলিল, “ভারি! ডিটেকটিভ উপন্যাস, খুন, জাল, জুয়াচুরির গল্প পাইলে সমস্ত দিনরাত্র আহার নিদ্রা ত্যাগ করিয়া তাহা পড়িতে বা শুনিতে প্রস্তুত—তখন আর অন্য কোন কাজের কথা মনে থাকে না। উহাই ইঁহাকে আটকাইয়া রাখিবার একমাত্র উপায়; কিন্তু উনি শেষের পৃষ্ঠায় আসিয়াছেন—এখন উপায় কি?”
এই সময়ে বৃদ্ধ পুস্তক বন্ধ করিয়া নাসিকা হইতে চশমা খুলিয়া উঠিয়া বসিলেন। তিনি উঠিতে উদ্যত হইয়াছেন, এমন সময়ে যুবকদিগের মধ্যে একজন স্বর খুব উচ্চে তুলিয়া বলিল, “সে কথা সত্য, তবে কাল রাত্রে যে ব্যাপারটা ঘটিয়াছে, তাহাতে পাঁচকিড় বাবুর ক্ষমতাশালী বিখ্যাত ডিটেক্টিভ অরিন্দমও সে রহস্য ভেদ করিতে পারিতেন না।”
এই কথায় অপর যুবকত্রয় বিস্মিত ও উৎসুকভাবে তাঁহার মুখের দিকে চাহিল। কথাটা বৃদ্ধের কর্ণেও প্রবেশ করিয়াছিল, তিনি সেই গৃহের ভিতর দিয়া বাহিরে যাইবেন বলিয়া দ্বারের নিকটে আসিয়াছিলেন, কথাটা শুনিয়া একটু দাঁড়াইলেন। কৌতূহলপূর্ণদৃষ্টিতে সেই যুবকের মুখের দিকে চাহিলেন।
যে যুবক পূৰ্ব্বে কথা কহিয়াছিল, সে বলিল, “হাঁ—হাঁ—শুনিয়াছি। এ রহস্য ভেদ পুলিসের সাধ্য নহে; তবে ব্যাপারটা কি কিছুই শুনি নাই—বল দেখি, শোনা যাক।”
অপর যুবক ক্ষণেক ইতস্ততঃ করিয়া বলিল, “পুলিস ব্যতীত এ কথা আর কেহই জানে না, পুলিসও আমারই কাছে শুনিয়াছে। এ রকম অত্যাশ্চর্য্য কাণ্ড আর কেহ কখনও দেখে নাই, এ রহস্য যে কখনও ভেদ হইবে, তাহার আশাও নাই।”
প্রথম যুবক বলিল, “বল—বল—আমরা সকলেই শুনিবার জন্য বড় ব্যস্ত হইয়াছি।”
অপর যুবক বলিল, “জানই ত, আমি বিশেষ কাজে আজ সকালে কাশী যাইব স্থির করিয়াছিলাম; কেবল এই ব্যাপারের জন্যই পুলিস আমাকে যাইতে দেয় নাই—কি অন্যায়!”
প্রথম যুবক বলিল, “অন্যায় আর কি, যাহাতে দোষী ধরা পড়ে, তাহা করা আমাদের সকলেরই কর্ত্তব্য নয় কি? (বৃদ্ধের প্রতি) দাদা মহাশয়! ভয়ানক—একটা কাণ্ড হইয়াছে, কেহই রহস্য ভেদ করিতে পারিতেছে না।”
বৃদ্ধ দাদা মহাশয় এই সময়ে যুবকদের গৃহমধ্যে আসিয়াছিলেন, তাঁহার জন্য স্থান ছাড়িয়া দিয়া শেষোক্ত যুবক—ইহার নাম পরেশ চন্দ্র, বৃদ্ধের পৌত্র—বলিল, “যাহাতে দোষী ধরা পড়ে, আমাদের সকলেরই তাহা করা কর্ত্তব্য—নয় কি দাদা মহাশয়?”
দাদা মহাশয় বলিলেন, “আমার বিশেষ কাজ না থাকিলে আমি তোমার বন্ধুর ব্যাপারটা কি শুনিতাম, তবে—”
শ্রীমান্ পরেশচন্দ্র প্রতিবন্ধক দিয়া বলিল, “না—না, দাদা মহাশয়, আপনি না শুনিয়া যাইতে পারেন না। দেবেন্দ্র বাবু এই ভয়ানক কাণ্ডের কথা এখনই বলিতেছেন।”
এই বলিয়া সে বন্ধুত্রয়কে সরিয়া বসিতে বলিল, নিজেও দাদা মহাশয়কে বসাইবার জন্য স্থান ছাড়িয়া দিল। বৃদ্ধ একটু বিরক্ত ও অসন্তুষ্টভাবে ভ্রুকুটি করিয়া বলিলেন, “আচ্ছা, এখনও খানিকটা সময় আছে, কিছু দেরি করিতে পারি।”
পরেশচন্দ্র সোৎসাহে বলিল, “দেবেন্দ্র বাবু, বলুন—বলুন, আমরা সকলেই শুনিবার জন্য অত্যন্ত ব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছি।”
দেবেন্দ্রনাথ মস্তক কণ্ডূয়ন করিতে করিতে বলিল, “কিন্তু—”
পরেশ। কিন্তু কি? বলুন।
দেবেন্দ্র। কিন্তু পুলিস আমাকে এ সম্বন্ধে কোন কথা কাহাকেও বলিতে বিশেষ করিয়া নিষেধ করিয়াছে।
পরেশ। আপনি কি মনে করেন, এ কথা আমরা কাহারও কাছে প্রকাশ করিব?
প্রাচীন ব্যক্তি দেবেন্দ্রনাথকে বলিলেন, “আপনি এ বিষয়ে নিশ্চিত থাকুন।”
প্রথম অংশ – আরম্ভ
তখন দেবেন্দ্রনাথ বলিতে লাগিলেন, “কাল রাত্রে কি রকম ঝড় বৃষ্টি হইয়াছিল, তাহা আপনারা সকলেই জানেন। আমি সেই সময়ে একজন বন্ধুর বাড়ীতে আটক হইয়া পড়িয়াছিলাম, ঝড় বৃষ্টির জন্য বাড়ী ফিরিতে পারি নাই। প্রায় রাত্রি একটার পরে ঝড় বৃষ্টি থামিল, তখন বাড়ী ফিরিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া উঠিলাম।
“আমার বন্ধুটি তাঁহার চাকরকে একখানা গাড়ির সন্ধানে পাঠাইলেন কিন্তু কোনরূপে কোন স্থানে গাড়ি মিলিল না; তখন আমি পদব্রজেই বাড়ী যাওয়া স্থির করিয়া বাহির হইলাম।
“বাহিরে আসিয়া বুঝিলাম যে, আমার বাড়ীতে পৌঁছান সহজ হইবে না, একে সেদিন অমাবস্যা, তাহার উপরে ঝড়ে সমস্ত গ্যাস নিবিয়া গিয়াছে, পথে এত অন্ধকার যে, পার্শ্বস্থিত ব্যক্তিকেও দেখা যায় না। আমি জীবনে কখনও এমন অন্ধকার দেখি নাই। এক হাত দূরে—এমন কি আমার নিজের হাত আমি নিজে দেখিতে পাইতেছি না। আমার বোধ হইল যে, সহসা কে যেন আমাকে অনন্ত অন্ধকার-সাগরে ডুবাইয়া দিয়াছে। অন্ধকার ভিন্ন পৃথিবীতে যেন আর কিছুই নাই!
“আমার বন্ধুর বাড়ী হইতে দ্রুতপদে কিয়দ্দূর অগ্রসর হইয়াছিলাম; কিন্তু সম্মুখে, পশ্চাতে, দক্ষিণে, বামে কিছুই দেখিতে না পাইয়া আমি স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইলাম। এ অবস্থায় আমি পথ খুঁজিয়া যে, বাড়ীতে পৌঁছিতে পারিব, এ আশা সম্পূর্ণ সুদূরপরাহত বলিয়া বোধ হইল; ভাবিলাম, ফিরিয়া বন্ধুর বাড়ীতে যাই; কিন্তু সেটা আর ভাল দেখায় না। বিশেষতঃ তাঁহার বাড়ীও যে আর খুঁজিয়া পাইব, অন্ধকারের প্রতাপ দেখিয়া সে আশাও আমার বড় ছিল না। তাঁহার বাড়ী হইতে কয়টা বাড়ী ছাড়িয়া আসিয়াছি, এমন কি তাহাও বুঝিতে পারিলাম না।
“দূরে দূরে মানুষের পায়ের ও গলার শব্দ পাইলাম, কিন্তু বুঝিলাম, এই মহা অন্ধকারের হাতে পড়িয়া তাহাদের অবস্থাও আমার অপেক্ষা ভাল নহে। কি করিব, কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া কিয়ৎক্ষণ তথায় দাঁড়াইয়া রহিলাম। তৎপরে একটা বাড়ীর প্রাচীর ধরিলাম, এবং অতি সাবধানে প্রাচীর ধরিয়া ধরিয়া চলিলাম।
“কিছুদূর এইরূপে আসিয়া দেখি, আর প্রাচীর নাই। সম্মুখে গলি না বড় রাস্তা, তাহাও স্থির করিতে পারিলাম না। কোনদিকে কিছু দেখিবার উপায় নাই—কেবল ভয়ানক অন্ধকার, তা চোখ খুলিয়া দেখ, আর মুদিয়া দেখ—সমান। কোনদিকে যাইব, স্থির করিতে না পারিয়া স্তম্ভিতভাবে কিয়ৎক্ষণ আবার সেইখানে দাঁড়াইয়া রহিলাম। এমন সময়ে দূরে মনুষ্য পদশব্দ শুনিয়া চিৎকার করিয়া ডাকিয়া বলিলাম, ‘কে মহাশয়, এদিকে একবার অনুগ্রহ করিয়া আসুন, আমি পথ দেখিতে পাইতেছি না।’
“কোন উত্তর পাইলাম না, সেই পদশব্দ ক্রমশঃ দূরে মিলাইয়া গেল। তখন ‘পাহারাওয়ালা’ ‘পাহারাওয়ালা’ বলিয়া ডাকিলাম, কিন্তু তাহাতে কোন উত্তর পাইলাম না। সমস্ত সহর যেন ঘোর নিস্তব্ধতা-সাগরে ডুবিয়া গিয়াছে। কেবল দূরে কোন বাড়ীতে হারমোনিয়ামের সহিত কোন স্ত্রীলোক গান করিতেছে বলিয়া বোধ হইল; কিন্তু সেই বাড়ী কোন্ দিকে, অন্ধকারে তাহা কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না।
“এখানে দাঁড়াইয়া থাকা বৃথা ভাবিয়া আমি সম্মুখে দুই হাত প্রসারিত করিয়া অন্ধের ন্যায় সাবধানে চলিলাম; কোথায় কোন্ দিকে যাইতেছি, তাহা স্থির করিতে পারিলাম না। প্রায় পনের মিনিট চলিলাম, আগে পাশে বা সম্মুখে কোন বাড়ী আছে কি না, কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। সহসা একটা লোহার রেলিংয়ে আমার মাথা ঠুকিয়া গেল। আমি হাত দিয়া বুঝিলাম, ইহা একটা বাড়ীর রেলিং। তখন সেই রেলিং ধরিয়া ধরিয়া আবার সাবধানে চলিলাম।
“কিছুদূর আসিয়া দেখিলাম, আর রেলিং নাই। আবার স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইলাম, সম্মুখে রেলিং নাই, দুই পার্শ্বে হাত দিয়া দেখিলাম, কোনদিকেই আর রেলিং নাই। কি করিব ভাবিতেছি, এই সময়ে সহসা একটা আলো অস্পষ্টভাবে সেই অন্ধকার মধ্য হইতে আমার চোখের উপরে আসিয়া পড়িল। আলো দেখিয়া প্রাণে ভরসা আসিল। আমি আলোর দিকে চাহিলাম। দেখিলাম, কিছুদূরে একটা বাড়ীর ভিতর হইতে সেই আলো আসিতেছে, সেই বাড়ীর দ্বারে একটি ভদ্র যুবক দাঁড়াইয়া রহিয়াছেন। আমি কোথায় আসিয়া পড়িয়াছি, কোন্ দিকে গেলে নিজের বাড়ীতে পৌঁছিতে পারিব, তাহা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিবার জন্য অগ্রসর হইলাম।
“কিন্তু পর মুহূর্ত্তেই সেই বাড়ীর দরজা বন্ধ হইল। আমি যুবককে আর সেখানে দেখিতে পাইলাম না। তিনি বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করিলেন বা কোনদিকে চলিয়া গেলেন, তাহা আমি কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। তবে সৌভাগ্যবশতঃ বাড়ীর দরজাটা একেবারে বন্ধ হয় নাই, তখনও দরজার ফাক দিয়া দীপালোকের সূক্ষ্ম রশ্মিরেখা দেখা যাইতেছিল। সেই বাড়ীর লোকের কাছে পথ জানিয়া লইব ভাবিয়া, আমি সেই আলো লক্ষ্য করিয়া অতি সাবধানে অগ্রসর হইলাম।
“সহসা নিকটে মনুষ্যপদশব্দ শুনিতে পাইলাম। অন্ধকারে কে একজন দ্রুতপদে আমার গায়ের কাছ দিয়া চলিয়া গেল, আমি তাহাকে ডাকিলাম, কিন্তু কেহ কোন উত্তর দিল না, দেখিতে দেখিতে পদশব্দ ক্রমশঃ দূরে গিয়া মিলাইয়া গেল। অন্য সময় হইলে এই ব্যক্তির এইরূপ উর্দ্ধশ্বাসে গমনের জন্য আমি কি ভাবিতাম, বলিতে পারি না; কিন্তু অন্ধকারে এই আপন্ন অবস্থায় আমি কিরূপে বাড়ীতে ফিরিতে পারিব, তাহাই ভাবিয়া ব্যাকুল হইতেছিলাম, তখন অন্য কোন বিষয় চিন্তা করিবার অবস্থা আমার ছিল না।
“আমি দেখিলাম, সেই বাড়ীর দ্বার তখনও সেইরূপ ঈষন্মুক্ত রহিয়াছে। আমি অতি সাবধানে সেই দ্বারদেশে আসিলাম, সবলে কড়া ধরিয়া নাড়িলাম, কিন্তু কেহ কোন উত্তর দিল না।
“আমি কোথায় আসিয়াছি, বাড়ী যাইব কোন্ পথে, ইহা কাহারও নিকটে না জানিয়া লইয়া আবার সেই অন্ধকার-সমুদ্রে ঝাঁপ দেওয়া উন্মত্ততা* ভিন্ন আর কিছু হইবে না, ভাবিয়া, আমি এই বাড়ীর লোককে পথ জিজ্ঞাসা করা স্থির করিলাম। যখন আলো জ্বলিতেছে, তখন বাড়ীতে অবশ্যই লোক আছে, বিশেষতঃ যখন এইমাত্র বাড়ী হইতে লোক বাহির হইয়া গেল, যখন দরজা খোলা রহিয়াছে, তখন রাত্রি বেশি হইলেও কেহ-না-কেহ জাগিয়া আছে, এই ভাবিয়া আমি সবলে কড়া নাড়িলাম। বহুক্ষণ অপেক্ষা করিলাম, কেহ কোন উত্তর দিল না, আমি প্রকৃতই বড় বিস্মিত হইলাম। বাড়ীর সকলে ঘুমাইতেছে, আর লোকটা অনায়াসে দরজা খুলিয়া চলিয়া গেল! কি আশ্চর্য্য, চোরের উপদ্রবের কোন আশঙ্কা নাই!
“আমি সেই দরজা ঠেলিয়া আরও কতকটা উন্মুক্ত করিলাম। সম্মুখে একটি অপরিষ্কার পথ, দুইদিকে ঘর, ভিতরে দ্বার-পথের উপরে একটা আলো জ্বলিতেছে। আমি বাড়ীতে প্রবেশ করিয়া উচ্চকণ্ঠে ডাকিলাম, ‘বাড়ীতে কে আছেন, বাড়ীতে কে আছেন,’ কেহ উত্তর দিল না। পুনঃপুনঃ ডাকাডাকিতেও কেহ সাড়া-শব্দ দিল না। আমি নিতান্ত বিস্মিত হইয়া পড়িলাম। তবে কি এই বাড়ীতে জনমানব নাই? অথচ আলো জ্বলিতেছে? কেহ আসিলে এত ডাকাডাকি, হাঁকাহাঁকিতে ও কি তাহাদের নিদ্রা ভঙ্গ হইত না? অসম্ভব!
“আমি কতকটা নিরুপায়ভাবে পার্শ্ববর্তী গৃহের দরজা ঠেলিলাম, ঠেলিবামাত্র দরজা খুলিয়া গেল। ভিতরে চাহিয়া দেখি, বেশ একটি সুসজ্জিত ঘর, এই ঘরে একটা সুন্দর মূল্যবান কেরোসিন ল্যাম্ফ জ্বলিতেছে, কিন্তু গৃহমধ্যে কেহ নাই!
“আমি আবার উচ্চৈঃস্বরে ডাকিলাম, ‘বাড়ীতে কে আছেন?’ কোন উত্তর নাই। একটা দরজায় সবলে করাঘাত করিতে লাগিলাম, তবুও কেহ উত্তর দিল না। তখন নিতান্ত বিস্মিত হইয়া পার্শ্ববর্তী একটা ঘরে প্রবেশ করিলাম। কি আশ্চর্য্য, তথায়ও কেহ নাই!
“এইরূপে আমি তিন-চারিটি ঘর অতিক্রম করিয়া আসিলাম, সকল ঘরই সুন্দররূপে সুসজ্জিত, কিন্তু কোন ঘরেই কেহ নাই। তখন আমার প্রকৃতই ভয় হইল। বাড়ীতে আলো জ্বলিতেছে—ঘরগুলি সুন্দর সুসজ্জিত—এইমাত্র এক ব্যক্তি আমার চোখের উপরে এই বাড়ী হইতে বাহির হইয়া গেল, অথচ বাড়ীতে কেহ নাই—কি আশ্চৰ্য্য!
“সহসা ভয়ে আমার বুক কাঁপিয়া উঠিল, আমি দ্রুতপদে বাহিরের দিকে চলিলাম। সদর দরজার গলির পার্শ্বেই একখানা বেঞ্চি ছিল—পূর্ব্বে আমি এ বেঞ্চিখানা দেখিতে পাই নাই, কারণ সেদিকে আমার নজর ছিল না, এখন এ বেঞ্চিখানার উপরে আমার দৃষ্টি পড়িল। দেখিলাম, তাহার উপরে একজন মহাবলবান হিন্দুস্থানী দ্বারবান্ নিদ্রিত রহিয়াছে, বেশ সবলে তাহার নিশ্বাস পড়িতেছে, সে যে গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন, তাহা তাহাকে দেখিলেই স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়।
“ইহার নিদ্রাভঙ্গ করা উচিত কিনা, আমি কিয়ৎক্ষণ তাহার পার্শ্বে দাঁড়াইয়া ভাবিতে লাগিলাম। জাগিলে হয় ত এ আমাকে চোর ভাবিয়া হঠাৎ আক্রমণ করিতে পারে। ইহার শরীরের গঠন দেখিয়া খুব বলবান বলিয়াই বোধ হইল। তাহাতে ইহাকে আঁটিয়া উঠিতে পারিব না; কিন্তু না জাগাইয়া উপায় কি? আমার এখান হইতে পথ দেখিয়া বাড়ী যাইবার কোন সম্ভাবনা নাই। এই লোক আমাকে পথ বলিয়া দিতে পারে, সম্ভবতঃ কিছু ব্যয় করিলে একটা আলো দিয়া সাহায্য করিতে পারে, কি একটা আলো পাইলে অনায়াসেই আমি নিরাপদে নিজের বাড়ীতে উপস্থিত হইতে পারি।
“এই সকল ভাবিয়া আমি তাহার হাত ধরিয়া নাড়া দিলাম; কিন্তু আমি যাহা ভাবিয়াছিলাম, ঘটিল—তাহার সম্পূর্ণ বিপরীত; তাহার কোন সাড়া-শব্দ নাই। অনেক ঠেলাঠেলির পর সে চক্ষু মেলিল, তাহার পর আমাকে দেখিয়া ব্যস্ত-সমস্ত হইয়া উঠিয়া বসিল, পুনঃপুনঃ আমাকে সেলাম করিতে লাগিল। আমি বুঝিলাম, তাহার এখনও ঘুমের ঘোর বেশ রহিয়াছে, আমি কে জানিতে পারে নাই; ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল বলিয়া এইরূপ পুনঃপুনঃ সেলাম দিতেছে।
“তাহার ভাব দেখিয়া বুঝিলাম, তাহার নিকট হইতে কোন সাহায্য পাইবার উপায় নাই, লোকটা অতিরিক্ত ভাং খাইয়া হতভম্বভাবে রহিয়াছে। তাহাকে ঠেলা মারিয়া বলিলাম, ‘আমি এই বাড়ীর মালিকের সঙ্গে দেখা করিতে চাই।’
“সে আবার পুনঃপুনঃ সেলাম দিয়া বলিল, ‘আইয়ে বাবু সাহেব, আইয়ে, বিবি সাহেব ঐ ঘরমে হৈ।’
“বিবি সাহেব! কি মুস্কিল, বিবি সাহেবকে আমি কি জবাবদিহি করিব? এত রাত্রে তাহার বাড়ীতে উপস্থিত হইয়াছি, তাহার কারণ কি দর্শাইব? আমি প্রকৃতই মনে মনে মহা-সমস্যায় পড়িলাম। এত রাত্রে কোন বিবি সাহেবকে বিরক্ত করিতে আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না, আমি কেবল কোন একজন ‘শুধু’ সাহেব পাইলে তাহার কাছে পথ জানিয়া লইয়া বাড়ীতে যাইতে পারিব ইহাই আমার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু এখন এ কি বিপদে পড়িলাম!
“আমি তখন অনন্যোপায়। সেই হিন্দুস্থানীর পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইতে বাধ্য হইলাম। সে অতি সাবধানে ধীরে ধীরে একটি দরজা খুলিল, উঁকি মারিয়া বিস্মিতভাবে আমার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, ‘বিবি সাহেব এ ঘরে নাহি হৈ–ঐ দোস্বা ঘরমে হোয়েগী।’
“সে ঘরেও তিনি নাই। ঘরের ভিতরে আলো নাই, পার্শ্ববর্তী ঘরের আলো আসিয়া ঘরটি কিঞ্চিৎ আলোকিত করিয়াছে; আমি এই জন্য প্রথমে এই ঘর ভাল করিয়া দেখিতে পাইলাম না। হিন্দুস্থানী আমাকে তথায় রাখিয়া ‘বিবি সাহেব দোতল্লা পর হোয়েগী’, বলিয়া সত্বর বাহির হইয়া গেল। এত সত্বর বাহির হইয়া গেল যে, আমি তাহাকে নিষেধ করিবারও অবসর পাইলাম না।
“সে চলিয়া গেলে আমি ঘরটি ভাল করিয়া চারিদিক দেখিতে লাগিলাম। এক পাশে একখানি কৌচের উপরে দৃষ্টি পড়ায় আমি চমকিত হইয়া উঠিলাম। একটি লোক কৌচের উপরে বসিয়া আছে। লোকটি নিশ্চয়ই বরাবর কৌচের উপরে বসিয়া আছে, সম্ভবতঃ—সম্ভবতঃ কেন, নিশ্চয়ই সেই ব্যক্তি আমার ডাকাডাকি হাঁকহাঁকি সব শুনিয়াছে, অথচ কোন উত্তর দেয় নাই কেন? আশ্চর্য্য! এ বাড়ীর সমস্তই অত্যদ্ভুত বলিয়া বোধ হইতেছে!
“তাহার মুখ বাহিরের জানলার দিকে ছিল; আমি তাহার দৃষ্টি আকর্ষণ করিবার জন্য গলার শব্দ করিলাম; কিন্তু সে কোন শব্দ বা উত্তর করিল না। আমি ভাবিলাম, তাহা হইলে এ উপবিষ্ট অবস্থাতেই ঘুমাইতেছে। আমার পথটা জানিয়া লওয়াই উদ্দেশ্য, সুতরাং আমি ভাবিলাম, ইহাকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করাই বিহিত। এখন যত শীঘ্র এই অদ্ভুত বাড়ী হইতে বাহির হইয়া যাইতে পারলেই বাঁচি।
‘আমি তাহার কাছে গিয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইলাম। সহসা আমার বোধ হইল যে, আমার সর্ব্বাঙ্গের রক্ত যেন জল হইয়া গেল; আমার বুক ধড়াস ধড়াস্ করিয়া কাঁপিতে লাগিল, আমার সর্ব্বাঙ্গে ঘাম ছুটিল। আমি দেখিলাম, লোকটির চোখ দুটি কপালে উঠিয়াছে, তাহার মুখ ভয়াবহ ব্রিকৃত ও মৃত্যু-মলিন। কি মুস্কিল! লোকটা মরিয়া বসিয়া আছে!
“তাহার মুখের ভাব দেখিবামাত্রই আমার প্রতীতি হইল যে, লোকটি খুন হইয়াছে। এ প্রতীতি এমনই জন্মিল যে, কি অস্ত্রে ইনি খুন হইয়াছেন, তাহা দেখিবার জন্য স্বতই ঘরের মেঝের দিকে একবার দৃষ্টিসঞ্চালন করিলাম, কিন্তু কোন-অস্ত্র দেখিতে পাইলাম না।
“তাহার পর আমার নিজের বিপদের কথা স্মরণ হওয়ায় আমি ভীতভাবে পশ্চাদ্দিকে চাহিলাম। এই গভীর অন্ধকার রাত্রি, এই নির্জ্জন বাড়ী, মৃতদেহের সম্মুখে একাকী আমি—আমাকে খুনী বলিয়া ধরিলে আমার রক্ষা পাওয়া কঠিন হইবে। এরূপ অবস্থায় মানুষের মনের ভাব কিরূপ হয়, তাহা যিনি এ অবস্থায় পড়িয়াছেন, তিনি ব্যতীত আর কেহ উপলব্ধি করিতে পারিবেন না।
“আমার প্রথমে মনে হইল, এখনও সময় আছে, পলাইয়া অন্ধকারে মিশিয়া যাই, তাহা হইলে আমাকে কেহই ধরিতে পারিবে না। এখানে আমাকে কেহই চিনে না, কিন্তু তৎক্ষণাৎ আবার মনে হইল যে, যখন আমি এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড দেখিলাম, তখন এ সম্বন্ধে সকল জানিয়া পুলিসকে সংবাদ দেওয়া আমার প্রধান কর্তব্য।
“অবশেষে কর্তব্যজ্ঞানটাই প্রবল হইল। আমি তখন মৃতদেহটি ভাল করিয়া দেখিলাম। দেখিতে পাইলাম, মৃতব্যক্তি অতি সুপুরুষ যুবক–বালক বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। বয়স বাইশ- তেইশের অধিক নহে। পরিহিত পরিচ্ছদ অতি পরিপাটী, দেখিলেই কোন ধনী সম্ভ্রান্ত লোকের পুত্র বলিয়া স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়।
“এ যে আত্মহত্যা নহে—খুন, সে বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ রহিল না। আত্মহত্যা হইলে কোন-না-কোন অস্ত্র নিকটে পড়িয়া থাকিত, খুনই নিশ্চয়! আমি যুবকের বুকের দিকে চাহিয়া দেখিলাম, বুকে রক্তের চিহ্ন রহিয়াছে! বিশেষ করিয়া দেখিয়া বুঝিলাম যে, কোন শাণিত ছুরিকা কেহ যুবকের বুকে আমূল বিদ্ধ করিয়াছে, ছুরিকা হৃপিণ্ড ভেদ করায় যুবকের নিমেষমধ্যে মৃত্যু হইয়াছে।
“তাহার পর আমি ভাবিলাম, এখন আমার প্রধান কর্ত্তব্য অনুসন্ধান করা, কে এই বাড়ীতে আছে, বা এই বাড়ীতে ছিল, এখন পলাইয়াছে। এই বিবি সাহেব কে? এই হিন্দুস্থানী ব্যতীত আর কাহাকেও এ পর্যন্ত এ বাড়ীতে দেখিতে পাই নাই—সে-ও কি এতক্ষণে পলাইল?
“যুবক যে আত্মহত্যা করে নাই, সে বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। তাহার মুখের ভাব ও আত্মহত্যা করিবার উপযোগী কোন অস্ত্র সেখানে পড়িয়া নাই দেখিয়াই আমি বুঝিলাম যে, যুবককে কেহ খুন করিয়াছে। এ অবস্থায় পুলিসে সংবাদ না দিয়া আমার এ বাড়ী ত্যাগ করিয়া যাওয়া কোনমতেই বিহিত বলিয়া বোধ হইল না। এ বিষয়ের বিশেষ তদন্ত না করা, উচিত নহে।
“এখন দেখা আবশ্যক, এ বাড়ীতে কে ছিল। একজন লোককে আমি অতি ব্যস্ত-সমস্ত হইয়া এ বাড়ী হইতে বাহির হইয়া যাইতে দেখিয়াছি; সে কে, তাহার চেহারা কিরূপ, তাহাও অন্ধকারে ভাল করিয়া দেখিতে পাই নাই। লোকটি যে ভয়ে বা অন্য কোন কারণে এ বাড়ী হইতে পলাইতেছিল, তাহাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই, কারণ সে এত রাত্রে যে বাড়ীর দরজা খুলিয়া রাখিয়া যাইতেছে, তাহাও তাহার মনে নাই।
“তাহার পর সেই হিন্দুস্থানী দ্বারবান। যে স্পষ্টতঃ গাঢ় নিদ্রায় নিমগ্ন ছিল; অধিকন্তু তাহার চেহারা ও ভাব দেখিলে, সে যে এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত আছে, তাহা বলিয়া বোধ হয় না। তাহার পর বিবি সাহেব—হিন্দুস্থানী ভৃত্যটা তাহাকে এই ঘরে দেখিতে পাইবে আশা করিয়াছিল; এখানে যে একজন লোক মরিয়া পড়িয়া রহিয়াছে, তাহা সে নিশ্চয়ই জানিত না, জানিলে এ ভাবে এ ঘরে কখনই প্রবেশ করিতে সাহস করিত না।
“সে বিবি সাহেব কে, সে এখনই বা কোথায়? খুব সম্ভব, সে বেহারার অজ্ঞাতসারেই বাড়ী ছাড়িয়া পলাইয়াছে। ভৃত্য এ সকল ব্যাপার জানিলে তাহার এরূপ ভাব হইত না।
“যাহাই হউক, আমি এ রহস্যের সবিশেষ অনুসন্ধান না করিয়া সহজে এ বাড়ী ত্যাগ করিতে পারিলাম না। গৃহমধ্যে একপার্শ্বে একটা বাতী জ্বলিতেছিল, সেটা তুলিয়া লইয়া আমি পার্শ্ববর্ত্তী একটা ঘরে প্রবেশ করিলাম।
“এ ঘরটি ক্ষুদ্র নহে, প্রকাণ্ড হলঘরের মত; সেইজন্য বাতীর আলোকে গৃহের সর্বস্থান ভাল দেখিতে পাইলাম না। ঘরটি ভাল করিয়া দেখিবার জন্য আমি আলোটি উচ্চে তুলিয়া ধরিলাম, তাহাতে আমার পদপ্রান্তে যাহা দেখিলাম, তাহাতে আমি যে তখন কেন চীৎকার করিয়া উঠিলাম না, তাহা বলিতে পারি না। অন্য কেহ হইলে হয় ত এ দৃশ্যে তৎক্ষণাৎ মূৰ্চ্ছিত হইয়া পড়িত। আমি দেখিলাম, আমার পদপ্রান্তে এক অপরূপসুন্দরী যুবতীর মৃতদেহ পড়িয়া রহিয়াছে। তাহার দুই হাত দুইদিকে বিক্ষিপ্ত, গলদেশে একছড়া হীরকমুক্তাখচিত কণ্ঠহার বাতীর আলোকে ঝকিতেছে, তাহার মুখ মৃত্যুবিবর্ণ, তাহার চক্ষু বিস্ফারিত, একরাশি কেশ গৃহতলে বিলুণ্ঠিত। তাহার মুখ চমৎকার সুন্দর হইলেও এখন সে মুখের ভাব দেখিয়া ভয় হয়।
“আমি কিয়ৎক্ষণ স্তম্ভিত হইয়া নিস্তব্ধভাবে দাঁড়াইয়া রহিলাম। কতকক্ষণ এইরূপ বিস্ময়- বিমূঢ়ভাবে ছিলাম, বলিতে পারি না। স্ত্রীলোকটি প্রকৃতই মরিয়াছে কি না, দেখিবার জন্য তাহার পার্শ্বে জানু পাতিয়া বসিলাম; নাসিকার কাছে হাত দিয়া দেখিলাম, তাহার নিশ্বাস-প্রশ্বাস নাই, শরীরের অবস্থা দেখিয়া বোধ হইল, অন্ততঃ দুইঘন্টা হইল, তাহার মৃত্যু হইয়াছে।
“যেভাবে যুবকের মৃত্যু হইয়াছে, এই অপরূপ রূপলাবণ্যবতী নবীনা সুন্দরীরও যে সেইভাবে মৃত্যু হইয়াছে, তাহাতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ রহিল না। সেইজন্য ইহারও বুকে হাত দিয়া বিশেষরূপে দেখিলাম। দেখিলাম, সেইরূপ ক্ষুদ্র ক্ষত—দেখিয়া বুঝিলাম, কেহ কোন দীর্ঘফলক সুতীক্ষ্ণ অপ্রশস্ত ছুরিকা তাহার হৃদয়ে আমূল বিদ্ধ করিয়াছে। ছুরিকা হৃপিণ্ড ভেদ করিয়া বসিয়াছে, তাহাই নিমেযমধ্যে তাহার মৃত্যু ঘটিয়াছে।
“ইহাতে আমি স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম, একই অস্ত্রে এক ব্যক্তিই উভয়কে খুন করিয়াছে। সে কে? যাহাকে অন্ধকারে এই বাড়ী ছাড়িয়া চলিয়া যাইতে দেখিয়াছিলাম, সে-ই কি এই ভয়াবহ দুই হত্যাকাণ্ড সংঘটন করিয়াছে?
“আমি সেইখানে দাঁড়াইয়া মনে মনে এইরূপ কত কি ভাবিতেছি, সহসা আমার হাতের বাতীটার দিকে আমার নজর পড়িল, বাতীটা তখন অনেকটা শেষ হইয়া আসিয়াছে। আমি আর একটা বাতীর চেষ্টায় ঘরের চারিদিকে দৃষ্টি সঞ্চালন করিলাম। দেখিলাম, গৃহকোণে আর একটা অর্দ্ধদগ্ধ বাতী পড়িয়া রহিয়াছে, তাহা তখনই তুলিয়া লইলাম; এবং দুইটা আলো জ্বালিলে ঘরটা আরও বেশি আলোকিত হইবে ভাবিয়া, আমি তাহা জ্বালিতে গেলাম। কিন্তু তখন আমার হাত এত কাঁপিতেছিল যে, একটা বাতী হইতে আর একটা বাতি জ্বালিয়া লইব, এ ক্ষমতা আমার ছিল না—কিছুতেই দুই বাতীর মুখ নিমেষের জন্য পরস্পর সংলগ্ন করিতে পারিলাম না। সহসা এই সময়ে নিকটে কাহার পদশব্দ শুনিয়া চমকিত হইয়া ফিরিলাম; দেখিলাম সেই হিন্দুস্থানী দ্বারবান্ দরজার বাহিরে আসিয়া স্তম্ভিতভাবে দাঁড়াইয়াছে। সে যে তখনও সেই মৃতদেহ দেখিতে পায় নাই, তাহা আমি তাহার মুখ দেখিয়াই বুঝিলাম।
“আমি সত্বর গিয়া সবলে তাহার হাত ধরিলাম। সে বলিল, ‘বিবি সাহেব বাড়ী নাই, তাহারা সকলেই চলিয়া গিয়াছেন।’
“আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কে চলিয়া গিয়াছে, কাহারা এই বাড়ীতে ছিল?’
সে উত্তর করিল, ‘দুইজন ভদ্রলোক।’
“কে তাহারা? তাহাদের নাম কি?’
“আমি কঠোরভাবে এই কথা জিজ্ঞাসা করায় সে বুঝিল, একটা কিছু গুরুতর ব্যাপার ঘটিয়াছে, তাহাই সে ইতস্ততঃ করিতে লাগিল; বলিল, ‘আমি তাহাদের নাম জানি না, তাহাদের এ বাড়ীতে আর কখনও দেখি নাই।’
“আমার কঠোরভাবে সে ভয় পাইয়াছে বুঝিয়া, আমি তাহার হাত ছাড়িয়া দিয়া নরম হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘তাহারা কতক্ষণ এ বাড়ীতে ছিল, কখন এ বাড়ী হইতে গিয়াছে?’
“সে পার্শ্ববর্তী একটা ঘর দেখাইয়া বলিল, ‘একজন ঐ ঘরে বিবি সাহেবের সঙ্গে কথা কহিতেছিলেন, তাহার পর আর একজন আসিয়াছিলেন; তাহারা কথা কহিতেছেন দেখিয়া আমি বাহিরে বেঞ্চে শুইয়াছিলাম, পরে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম। ঘুম ভাঙিলে হুজুরকে দেখিলাম।’
“তাহার ভাবে বুঝিলাম যে, লোকটা যাহা বলিতেছে, তাহা মিথ্যা নহে; তাহাই বলিলাম, যে ভদ্রলোক দুইজন আসিয়াছিলেন, তুমি নিশ্চয়ই তাহাদের নাম শুনিয়াছিলে—মনে করিবার চেষ্টা কর।’
“ক্ষণেক কি ভাবিয়া সহসা সে বলিয়া উঠিল, ‘হাঁ, মনে পড়িয়াছে, তাঁহারা কাগজে নাম লিখিয়া দিয়াছিলেন, আমি সেই কাগজ বিবি সাহেবকে দিয়াছিলাম, আমি পড়িতে জানি না।’
“সে কাগজ কোথায়?’
“বোধ হয়, ঐ ঘরে আছে।’
“সে আমাকে পার্শ্ববর্ত্তী কক্ষে লইয়া গিয়া দুইখণ্ড কাগজ আমার হাতে দিল—”
সহসা মধ্যপথে থামিয়া দেবেন্দ্রনাথ, শ্রোতা বন্ধুদিগের মুখের দিকে চাহিয়া ইতস্ততঃ করিতে লাগিল।
.
বৃদ্ধ দাদা মহাশয় জিজ্ঞাসিলেন, “তাহাদের কি নাম?”
দেবেন্দ্রনাথ আরও একটু ইতস্ততঃ করিয়া বলিল, “আপনারা তাহাদের নাম জানেন, দুইজনে সহোদর ভাই। একজন কুমার আনন্দপ্রসাদ, অপর তাহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রাজা গুণেন্দ্রপ্রসাদ।”
বন্ধুগণ সকলেই অতি বিস্মিতভাবে দেবেন্দ্রনাথের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। সকলেই সমস্বরে বলিয়া উঠিলেন, “কি আশ্চর্য্য! রাজা গুণেন্দ্রপ্রসাদ!”
বৃদ্ধ দাদা মহাশয় বলিলেন, “অসম্ভব, রাজা গুণেন্দ্রপ্রসাদ পশ্চিমে ছিলেন। আমি জানি, তিনি গত কল্য এখানে পৌঁছিয়াছেন।”
দেবেন্দ্রনাথ বলিল, “আপনি যাহা বলিতেছে তাহা ঠিক। তিনি গত কল্যই এখানে পৌঁছিয়াছেন, আর কালরাত্রেই আমি তাঁহারই মৃতদেহ দেখিয়াছি।”
এ কথায় সকলেই মহাবিস্মিত হইলেন। দাদা মহাশয় বলিলেন, “তাহার পর কি হইল, শুনি— তিনি যে রাজা গুণেন্দ্রপ্রসাদ, তাহা কিরূপে জানা গেল?”
দেবেন্দ্রনাথ বলিল, “কাগজ দুইখানা পাইয়াই আমি ছুটিয়া সেই যুবকের মৃতদেহের কাছে আসিলাম। তাহার পকেটে ঘড়ি ও চেইন ছিল; দেখিলাম, ঘড়ির উপরে লিখিত রহিয়াছে, রাজা গুণেন্দ্রপ্রসাদ; সুতরাং তখন বুঝিতে হইল যে, রাজা গুণেন্দ্রপ্রসাদই নিহত হইয়াছেন।
“আমি এই ব্যাপারে এরূপ স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছিলাম যে, ভৃত্যের কথা আমার আদৌ মনে ছিল না। সহসা একটা বিকট শব্দ শুনিয়া ফিরিয়া দেখিলাম তখন ভৃত্য এই ঘরে মৃতদেহ দেখিতে পাইয়াছে, তাহাই সে ভয়ে এরূপ চীৎকার করিয়া উঠিয়াছে, এবং তাহার মুখ বিকৃত হইয়া গিয়াছে। সহসা সে তিন লম্ফে দরজার দিকে ছুটিল। আমিও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছুটিলাম; কিন্তু আমি দরজায় পৌঁছিবার পূর্ব্বে সে সেই ঘোরতর অন্ধকারে মিশিয়া গেল। পথে আসিয়া আমি অনেক চিৎকার করিয়া তাহাকে ডাকিলাম, কিন্তু সে কোনই উত্তর দিল না। বোধ হয়, সে অন্ধকারে কোন বাড়ীর পার্শ্বে লুকাইয়াছিল, কারণ আমি তাহার পদশব্দও আর শুনিতে পাইলাম না।
“কোনদিকে কিছু দেখিবার উপায় নাই। পশ্চাতে ফিরিয়া দেখিলাম, সেই বাড়ীর দরজা ধীরে ধীরে বন্ধ হইতেছে। যদি একবার দরজা বন্ধ হইয়া আলো অন্তর্হিত হয়, তাহা হইলে হয় ত অন্ধকারে আমি বাড়ীটাই আর খুঁজিয়া পাইব না।
“আমি উর্দ্ধশ্বাসে দরজার দিকে ছুটিলাম, কিন্তু পা কিসে বাধিয়া যাওয়ায় পড়িয়া গেলাম। মাথায়ও গুরুতর আঘাত লাগিল, উঠিয়া আর আলো দেখিতে পাইলাম না, এবং সেই অতুল অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়াইয়া কয়েক মুহূৰ্ত্ত কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। তাহার পর বাড়ীটার দিকে হাতড়াইয়া হাতড়াইয়া চলিলাম।
“যতদূর আমি যাই, সে বাড়ী আর পাই না; তখন বুঝিলাম, আমি অপর দিকে আসিয়া পড়িয়াছি। বাড়ীটা ছাড়িয়া কতদূর আসিয়াছি, তাহা আমি স্থির করিতে পারিলাম না। তখন চীৎকার করিয়া পুলিস-পাহারাওয়ালা ডাকিতে লাগিলাম। ডাকিয়া কোন উত্তর পাইলাম না। ক্রমে অনেক দূরেও আসিয়া পড়িলাম।
“যতদূর সেই অন্ধকারে যাইতেছি, কেবলই ‘পুলিস’ ‘পুলিস’ বলিয়া চিৎকার করিতে করিতে যাইতেছি, অবশেষে একটা আলো দেখিতে পাইলাম। দেখিলাম, সম্মুখে প্রজ্জ্বলিত-লণ্ঠন-হস্তে একজন শ্মশ্রুগুম্ফ-পরিশোভিত-বদন পাহারাওয়ালা-মূর্ত্তি।
“পাহারাওয়ালার সহিত থানায় আসিয়া, আমি যাহা যাহা দেখিয়াছিলাম, তাহা সমস্ত বলিলাম। অন্ধকারে যতদূর অনুমান করিতে পারিয়াছিলাম, বাড়ীটা সম্বন্ধে তাহাই বলিলাম। তখনই ইনস্পেক্টর বাড়ীটা খুঁজিয়া বাহির করিবার জন্য চারিদিকে লোক পাঠাইলেন। সঙ্গে সঙ্গে কুমার আনন্দপ্রসাদকে গ্রেপ্তার করিতে বলিলেন। তিনিই যে এই দুই খুন করিয়াছেন, সে বিষয়ে তাঁহার কথায় বিন্দুমাত্র সন্দেহ রহিল না। তিনি আমার নাম ঠিকানা লইয়া, লোক সঙ্গে দিয়া বাড়ী পাঠাইয়া দিলেন।
“এই পর্য্যন্ত সে রাত্রের ঘটনা। তাহার পর এ সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিয়া পুলিস যাহা জানিতে পারিয়াছে, তাহাই এইবার বলিতেছি; —আজ সকালে ইনস্পেক্টর আমার সঙ্গে দেখা করিয়াছিলেন।
“অন্ধকারে পথ দেখিতে না পাইয়া আমি সেদিন সত্যসত্যই বন্ধুর বাড়ী হইতে অনেক দূরে গিয়া পড়িয়াছিলাম। এমন কি পুলিস আজ দুই প্রহর পর্যন্ত সে বাড়ী খুঁজিয়া পায় নাই, সেই অবধি কুমার আনন্দপ্রসাদকেও গ্রেপ্তার করিতে সক্ষম হয় নাই। আনন্দপ্রসাদ এ পর্যন্ত নিজ বাড়ীতে ফিরেন নাই। তিনি কোথায় আছেন, তাহার সন্ধান হয় নাই, তাহাতেই পুলিস মনে করে যে, এই দুই খুনই কুমার আনন্দপ্রসাদের দ্বারাই হইয়াছে।
“এই বাড়ীতে মেহেরজান বলিয়া একটি কাশ্মিরী স্ত্রীলোক বাস করিত। ইহার সম্বন্ধে পুলিস পশ্চিম-প্রদেশ হইতে নানা কুৎসা শুনিয়াছে। এই স্ত্রীলোক যে কি না করিয়াছে—তাহার কোন স্থিরতা নাই। তবে সকলেই জানে যে, ইহার ন্যায় সুন্দরী ও বুদ্ধিমতী স্ত্রীলোক সহজে দেখিতে পাওয়া যায় না।
“কয়েক বৎসর হইতে রাজা গুণেন্দ্রপ্রসাদ ইহাকে দেখিয়া উন্মত্তপ্রায় হয়েন। প্রায়ই তিনি ইহার বাড়ীতে বাস করিতেন। তখন তাঁহার পিতা জীবিত ছিলেন, তিনি মেহেরজানের কবল হইতে পুত্রকে রক্ষা করিবার জন্য তাঁহাকে পশ্চিমে বেড়াইতে পাঠাইয়া দেন। কেবল গত কল্য গুণেন্দ্রপ্রসাদ পশ্চিম হইতে এখানে ফিরিয়া আসিয়াছেন। পুলিস অনুসন্ধান করিয়া এ সকল অবগত হইয়াছে। গুণেন্দ্রপ্রসাদের পিতা শুনিতে পান যে, পশ্চিমেও তাঁহার পুত্র মেহেরজানের সহিত বেড়াইতেছেন, তাহাতেই তিনি পুত্রের উপর রাগত হইয়া গুণেন্দ্রপ্রসাদকে ত্যাজ্য পুত্র করিয়া তাঁহার সমস্ত সম্পত্তি তাঁহার অপর পুত্র আনন্দপ্রসাদকে উইল করিয়া দিয়া, গিয়াছেন।
“এ সকল ঘটনা প্রায় এক বৎসর হইল, ঘটিয়াছিল। প্রায় ছয় মাস হইল, মেহেরজান কলিকাতায় ফিরিয়া আইসে। গুণেন্দ্রপ্রসাদ পশ্চিমেই এতদিন ছিলেন।
“কলিকাতায় ফিরিয়া আসিলে সকলেই জানিতে পারে যে, মেহেরজান অযোধ্যার এক নবাবকে বিবাহ করিয়াছে। সেই নবাব তাহাকে কলিকাতায় এই বাড়ীতে রাখিয়াছিলেন। তিনিই মেহেরের সকল খরচ যোগাইতেছিলেন।
“এদিকে কুমার আনন্দপ্রসাদ পিতার ভাবী উত্তরাধিকারী হওয়ায় দুই হস্তে ঋণ করিতেছিলেন। পুলিসের বিশ্বাস, এই সকল ঋণের জন্য আনন্দপ্রসাদ ভ্রাতাকে খুন করিয়াছেন। ভাই জীবিত থাকিলে পাছে তিনি পিতার সমস্ত সম্পত্তি না পান, এই ভয়ই এই হত্যাকাণ্ডের কারণ।
“কল্য গুণেন্দ্রপ্রসাদ কলিকাতায় ফিরিয়া আসিয়াই মেহেরজানকে খুঁজিয়া বাহির করিয়া কল্যই রাত্রে তাহার বাড়ীতে তাহার সহিত দেখা করিতে যান। তাঁহার ভাইও তাঁহার সন্ধান পাইয়া মেহেরজানের বাড়ীতে তাঁহার অনুসরণ করেন। তথায় দুই ভায়ে কলহ উপস্থিত হয়, আনন্দপ্রসাদ সুবিধামত গুণেন্দ্রপ্রসাদের বুকে ছোরা বসাইয়া দেন। এই হত্যাকাণ্ডের একমাত্র সাক্ষী মেহেরজান। মেহেরজান বাঁচিয়া থাকিলে তিনি নিরাপদ নহেন, এবং তাঁহার ভ্রাতৃহত্যা করা কোন কাজেই আসিবে না, তাহাই আনন্দপ্রসাদ মেহেরজানকেও হত্যা করেন। হিন্দুস্থানী বেহারা ভাং খাইয়া নিদ্রিত না থাকিলে তাহারও নিশ্চয়ই সেই দশা হইত।
“পুলিস আনন্দপ্রসাদ, গুণেন্দ্রপ্রসাদ ও মেহেরজানের পূর্ব্ব বৃত্তান্ত হইতে ইহাই অনুমান করিয়া আনন্দপ্রসাদকে ধৃত করিবার চেষ্টা করিতেছে, কিন্তু এই বিস্তৃত সহরে তিনি যে কোথায় লুকাইয়া আছেন, তাহা এখনও স্থির করিতে পারে নাই।
“এ রহস্য এই পর্য্যন্ত হইয়া আছে। পুলিস যে কতদূর কি করিতে পারিবে, তাহা বলা যায় না। প্রকৃতই আনন্দপ্রসাদ খুনি কী না তাহা নিশ্চিত বলাও যায় না।”
.
একজন দেবেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা করিল, “মৃতদেহ দুইটির কি হইল?”
দেবেন্দ্রনাথ বলিল, “পুলিস এখনও সেই বাড়ীর সন্ধান করিতে পারে নাই। নিশ্চয়ই মৃতদেহ দুইটি এখনও সেই বাড়ীতে পড়িয়া আছে।”
“বাড়ীটা কোথায়, আপনি তা অনুমান করিয়া বলিতে পারেন না?”
“অন্ধকারে কোথা হইতে কোথায় গিয়া পড়িয়াছিলাম, তাহার কিছুই ঠিক বলিতে পারিতেছি না।”
দাদা মহাশয় উঠিয়া বলিলেন, “এতক্ষণে পুলিস নিশ্চয় সন্ধান পাইয়াছে। বিশেষতঃ আনন্দপ্রসাদ ধৃত হইলে, তখন তাহার নিকটেই বাড়ীর ঠিকানা পাওয়া যাইবে। তাহার ন্যায় বড় লোক কত দিন লুকাইয়া থাকিবে?”
পরেশচন্দ্র বলিল, “দাদা মহাশয়! আপনি কি মনে করেন, যথার্থই কুমার আনন্দপ্ৰসাদত এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড করিয়াছেন?”
দাদা মহাশয় বলিলেন, “আমি এখন ব্যস্ত আছি, মৃতদেহ পাওয়া গেলে, আর আনন্দপ্রসাদ ধৃত হইলে এ বিষয়ে আলোচনা করিব।”
যুবকদিগের মধ্যে রমেশচন্দ্র নামে একজন বলিল, “আমি আনন্দপ্রসাদ আর গুণেন্দ্রপ্রসাদ কিরূপ লোক তাহা জানি না; তবে আমি জানি, এক সময়ে এই সুন্দরী মেহেরজান নিজামের এক বহুমূল্য কণ্ঠহার চুরি করিয়াছিল
দাদা মহাশয় গমনে উদ্যত হইয়াছিলেন, ফিরিয়া বলিলেন, “এই মেহেরজান! যে খুন হইয়াছে?”
রমেশচন্দ্র বলিলেন, “হাঁ—এই মেহেরজান, ইহার নাম সকলেই জানে। এই চুরি ব্যাপারটার কথা লম্বা নহে, তবে এই ঘটনায় এই স্ত্রীলোকের চরিত্র বেশ বুঝিতে পারা যায়।”
“না না—আমার বিশেষ কাজ আছে—অন্য সময়ে শুনিব,” বলিয়া দাদা মহাশয় আরও দুই পদ অগ্রসর হইলেন।
রমেশচন্দ্র বলিলেন, “দেখিতেছি, আপনারা সকলেই শুনিবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছেন!”
অপর যুবকত্রয় বলিয়া উঠিলেন, “বলুন—বসুন আপনি, আমরা এই মেহেরজানের কথা শুনিতে ব্যগ্র হইয়াছি।”
এই সময়ে একজন ভৃত্য আসিয়া দাদা মহাশয়কে বলিল, “হুজুর, গাড়ি আসিয়াছে।”
রমেশচন্দ্র বলিল, “কণ্ঠহারটির দাম বিশ লক্ষ টাকা, সহজ ব্যাপার নহে। এই স্ত্রীলোকের সাহস অসীম—বুদ্ধিমতীর চূড়ান্ত।”
দাদা মহাশয় বিরক্তভাবে ভৃত্যকে বলিলেন, “যাও, গাড়ি একটু দেরি করিতে বল।”
এই বলিয়া বৃদ্ধ আবার নিজের আসনে বসিলেন। পরেশচন্দ্র সোৎসাহে বলিলেন, “এইবার শোনা যাক—মেহেরজানের চুরির বিষয়।”
দ্বিতীয় অংশ – মধ্য
রমেশচন্দ্র বলিতে লাগিলেন, “নিজাম এই কণ্ঠহার কিনিতে চাহিলে কলিকাতায় একজন প্রধান ইংরাজ জহুরী—নাম উল্লেখের প্রয়োজন নাই—আমাকে দিয়া ইহা হায়দ্রাবাদে পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। – আমিই তাঁহার সর্ব্বাপেক্ষা বিশ্বাসী কৰ্ম্মচারী।
“এত মূল্যবান দ্রব্য নিরাপদে লইয়া যাওয়া সহজ নহে। আমি ইহা আমার একটা সিগার-কেসের ভিতরে রাখিয়া উহা আবার একটি ছোট ব্যাগে রাখিলাম। এই ব্যাগটি সর্ব্বদাই গলায় ঝুলিয়া রাখিয়াছিলাম সুতরাং এ অবস্থায় কণ্ঠহার আমার নিকট হইতে কাহারই চুরি করার সম্ভাবনা ছিল না। বিশেষতঃ এই কণ্ঠহারের কথা কেহই জানিত না; পাছে কেহ সন্দেহ করে, সেইজন্য দ্বারবান্ বা লোকজন কাহাকেই সঙ্গে লই নাই। সামান্য একটা ছোট ব্যাগে এমন মূল্যবান হীরক-হার রহিয়াছে, তাহা কাহারও সন্দেহ করিবার উপায় ছিল না।
“কিন্তু আমি সম্পূর্ণ ভুল বুঝিয়াছিলাম। এই বুদ্ধিমতী, ধূৰ্ত্তা স্ত্রীলোক কিরূপে যে এই কণ্ঠহারের সন্ধান পাইয়াছিল, তাহা বলা যায় না। তবে ইহা নিশ্চয় যে, সে কলিকাতা হইতেই আমার পিছু লইয়াছিল। আমি পূর্ব্বে ইহা বিন্দুমাত্র জানিতে পারি নাই।
যখন জব্বলপুরে গাড়ী বদলাইয়া একখানা সেকেণ্ড ক্লাসে উঠিলাম, তখন আমি ভাবিলাম, আমি একাই এই গাড়ীতে যাইতে পারিব। বিশেষতঃ আমি গার্ডকে সন্তুষ্ট করায় আমার গাড়ীতে আমি একাই যাইতেছিলাম। গার্ড আমার গাড়ীতে আর কাহাকেও প্রবেশ করিতে দিল না। ইহাতে আমি একরূপ নিরাপদ ছিলাম; জানিতাম, কাহারই এ কণ্ঠহার হস্তগত করিবার সুবিধা হইবে না।
“জব্বলপুরে গাড়ীতে আমি মালপত্র ঠিক করিয়া একটা চুরুট বাহির করিয়া টানিতেছি গাড়ী ছাড়ে-ছাড়ে—ঘণ্টা পড়িয়া গিয়াছে, আমিও ভাবিলাম যে, নিশ্চিন্তে যাইতে পারিব, এ গাড়ীতে কেহ উঠিবে না। এই সময়ে দুইজন রেল-কর্মচারী সহসা আমার গাড়ীর দরজা খুলিয়া একটি স্ত্রীলোককে গাড়ীতে উঠাইয়া দিল, তখন গাড়ী চলিয়াছে, তাহারা জানালা দিয়া তাহার জিনিসপত্র ছুড়িয়া ঠেলিয়া গাড়ীর ভিতরে ঢুকাইয়া দিল। তখন গাড়ী মহাবেগে ছুটিল!
“আমি তাড়াতাড়ি আমার ব্যাগটি টানিয়া কোলের কাছে লইলাম, চুরুটটি মুখ হইতে নামাইলাম; যখন একটি ভদ্রমহিলা গাড়ীতে উঠিয়াছেন, তখন আর গাড়ীতে ধূমপান করা উচিত নহে, ভাবিয়া চুরুটটি জানালা দিয়া বাহিরে নিক্ষেপ করিলাম।
“তাঁহার ব্যাগটি আমার পায়ের নীচে আসিয়া পড়িয়াছিল। আমি সেটি তুলিয়া লইয়া তাঁহাকে সসম্ভ্রমে জিজ্ঞাসা করিলাম, কোথায় সেটি রাখিব।
“তখন আমি তাঁহাকে ভাল করিয়া দেখিলাম। দেখিলাম, তিনি অপরূপসুন্দরী—বয়স বাইশ- তেইশের বেশি নহে, পরিধানে পার্শী পরিচ্ছদ; বুঝিলাম, তিনি পার্শী রমণী; কিন্তু তাঁহার মুখ দেখিয়া সহজে তাঁহাকে পার্শী বলিয়া বোধ হয় না।
“তিনি মৃদু মধুর হাসি হাসিয়া বলিলেন, ‘আপনি কষ্ট পাইবেন না, আমি নিজেই সব ঠিক করিয়া রাখিতেছি। আর এক মিনিট বিলম্ব হইলে গাড়ী আর পাইতাম না। না পাইলে বিশেষ ক্ষতি হইত।’
“এই বলিয়া তিনি তাঁহার ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত দ্রব্যাদি নিবিষ্টমনে গুছাইয়া রাখিতে লাগিলেন; ক্ষণপরে আমায় জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আপনি কোথায় যাইবেন?’
“বোম্বাই।”
“ভালই হইল, আপনাকে সঙ্গী পাইলাম। আমিও বোম্বাই যাইতেছি। আপনাকে বাঙ্গালী বলিয়া বোধ হইতেছে।’
“হাঁ, আমি বাঙ্গালী, কলিকাতায় আমার বাড়ী।’
“কলিকাতায় আমরা অনেক দিন কাটাইয়াছি, বাঙ্গালীদের আমি বিশেষ শ্রদ্ধা সম্মান করি।’
“তাহার পর আমাদের কলিকাতা সম্বন্ধে নানা কথা হইতে লাগিল। পোষাক-পরিচ্ছদের জাঁকজমক ও হস্তে অনেকগুলি বহুমূল্য অঙ্গুরীয়তে আমি বুঝিলাম, তিনি কোন ধনীর গৃহিণী— তাঁহার এইরূপ স্বাধীনভাবে একজন অপরিচিতের সহিত কথোপকথন করায় আমি একটু বিস্মিত হইলাম; তখনই আমার মনে হইল, পার্শী রমণীগণ স্বাধীনতার দিকে অনেকখানি অগ্রসর হইয়াছেন, সুতরাং তাঁহাদের এরূপ করা অসঙ্গত নহে।
“এই স্ত্রীলোককে সম্ভ্রান্ত-মহিলা, সুশিক্ষিতা পরমসুন্দরী স্থির করিলেও ইহার প্রতি আমার সন্দেহ করা উচিত ছিল; কিন্তু কেন কি জানি, আমি ইহাকে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করিলাম না।
“পথে যে স্টেশনেই আমাদের গাড়ী থামিতেছিল, সেই স্টেশনেই এই রমণী কোন-না-কোন অজুহাতে আমাকে গাড়ী হইতে বাহির করিয়া দিবার চেষ্টা পাইতেছিলেন। প্রথম আব্দার, তাঁহার চাকর অন্য গাড়ীতে আছে, অনুগ্রহ করিয়া তাহাকে ডাকিয়া দিতে হইবে, তাহার নাম খণ্ডে রাও।
“আমি দুই-তিন স্টেশনে নামিয়া খণ্ডে রাওকে খুঁজিলাম, কিন্তু তাহাকে দেখিতে পাইলাম না। একবার ফিরিয়া আসিয়া দেখি, রমণী আমার ট্রাঙ্কটির উপর হাত দিয়া দাঁড়াইয়া আছেন। আমার মুহূর্তের জন্য যেন বোধ হইল, তিনি আমার ট্রাঙ্কটি খুলিবার চেষ্টা করিতেছিলেন, কিন্তু তাহার মুখের অবিচলিত ভাব দেখিয়া আমার সে সন্দেহ এক নিমেষে অন্তর্হিত হইল।
“তিনি মৃদু হাসিয়া বলিলেন, ‘আপনার বাক্সটি পড়িয়া গিয়াছিল; দেখুন কিছু ভাঙিয়াছে কি না।”
“এখন ভাবিলে লজ্জায় মরিয়া যাইতে হয়, আমি এমনই গাধা, তাহার সম্মুখে বাক্সটি খুলিয়া তন্মধ্যস্থিত সকল জিনিসই ওলট-পালট করিয়া দেখিলাম। সে বক্রদৃষ্টিপাতে বাক্সে কি আছে, তাহা দেখিয়া লইল। যদ্যপি তাহার বুদ্ধির কাছে আমি প্রতি পদক্ষেপে বোকা বনিয়া যাইতেছিলাম, তবে সৌভাগ্যের বিষয়, সে যাহা সন্ধান করিতেছিল, তাহা আমার গলদেশে লম্বিত কুরিয়ার ব্যাগের মধ্যে ছিল, আমি যখনই গাড়ি হইতে নামিয়া যাইতেছিলাম, তাহাও আমার সঙ্গে সঙ্গে যাইতেছিল।
“ট্রাঙ্ক দেখার পর হইতেই তাহার পরিবর্তন হইল। আর তত কথা নাই—যেন কি একটা কিছু ঘটিয়াছে, আর বেশি কথা কহিতেছে না দেখিয়া আমিও তাহাকে বিরক্ত করা যুক্তিসঙ্গত মনে করিলাম না। এখন বুঝিতেছি, ট্রাঙ্কে হীরার কণ্ঠহারের চিহ্ন নাই দেখিয়া সে নিশ্চিত জানিতে পারিয়াছে যে, ব্যাগের মধ্যেই তাহা আছে। কিন্তু ব্যাগ আমার কণ্ঠে লম্বিত, সেই ব্যাগের মধ্যে হীরার কণ্ঠহার, কিরূপে তাহা সে হস্তগত করিবে, তাহাই ভাবিয়া সে মনে মনে মহা ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছে;; মুখভাবেও তাহা অনেকটা প্রকাশ পাইতেছে। সহসা এতখানি ব্যাকুল হইয়া উঠিবার আরও একটা কারণ—আর সময় নাই, আর এক ঘণ্টার মধ্যেই গাড়ী বোম্বাই পৌঁছিবে। ইহারই মধ্যে তাহাকে কার্য্যোদ্ধার করিতে হইবে।
“এই সময়ে আমার মূর্খতা বা অসাবধানতার জন্যই হউক, একটু গ্রীষ্মবোধ হওয়ায় গায়ের কোটটা খুলিবার ইচ্ছা করিলাম। কোট খুলিতে গেলে ব্যাগটি গলা হইতে আগে খুলিয়া রাখিতে হয়। আমি ব্যাগটি গলা হইতে খুলিয়া ডান হাতের কাছে রাখিয়াছি, আর সবেমাত্র কোটটি খুলিবার উপক্রম করিতেছি, এই সময়ে গাড়ী আসিয়া প্যারেল স্টেশনে থামিল। অমনই রমণী জানালার দিকে মুখ বাড়াইয়া ব্যগ্র ও ব্যাকুল হইয়া বলিয়া উঠিল, ‘খণ্ডে রাও—খণ্ডে রাও— আমার চাকর, আমায় দেখিতে পায় নাই, যান — যান—অনুগ্রহ করিয়া তাহাকে ডাকিয়া আনুন।’
তাহার ব্যাকুলস্বরে ও ব্যস্তভাবে আমি কি করিতেছি, বুঝিতে পারিলাম না। লম্ফ দিয়া গাড়ী হইতে নামিয়া যাহাকে সম্মুখে পাইলাম, তাহাকেই জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম, ‘তুমি কি খণ্ডে রাও? তুমি কি খণ্ডে রাও’?
“সকলেই আমাকে পাগল ভাবিয়াছিল, গাড়ী ছাড়ে দেখিয়া আমি হাঁপাইতে হাঁপাইতে ছুটিয়া আসিয়া আবার গাড়িতে উঠিলাম। হাস্যাস্পদের একশেষ আর কি!
“গাড়ীতে আসিয়া দেখিলাম, রমণী যেখানে বসিয়াছিল, ঠিক সেইখানে সেইভাবেই বসিয়া আছে। তবে সে ব্যাকুল ভাব আর নাই, এবার তাহার মুখভাব প্রসন্ন— চোখে আনন্দদীপ্তি। সে বলিল, ‘আপনাকে অনর্থক কষ্ট নিলাম, বোম্বেয় গেলে তাহাকে পাইব। আনাড়ী চাকর সঙ্গে লইলে এইরূপই ঘটে?”
“তাহার পর সে উৎসাহিতভাবে আমার সহিত এতই কথা কহিতে লাগিল যে, আমার ব্যাগটি খুলিয়া দেখিবারও অবসর হইল না—মনেও হইল না; তবে গাড়িতে উঠিয়াই আমি ব্যাগটিকে আবার গলায় টাঙাইয়া দিয়াছিলাম।
“এইরূপ বাক্যবর্ষণের মধ্যেও তাহার মনে যেন কি একটা তুমুল বিপ্লব চলিতেছিল, কথার উপর কথা ফেলিয়া সে আমাকে তখন একেবারে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিল, তাহাও আমি কতকটা বুঝিতে পারিলাম। বুঝিলে হইবে কি, তবুও তাহার প্রতি আমার সন্দেহ হইল না—ব্যাগ খুলিয়া দেখিলাম না, ব্যাগের মধ্যে কণ্ঠহার আছে কি না। এখন আমি বুঝিতেছি, তখন তাহার মনে কি তুমুল বিপ্লব চলিতেছিল, আর আধ ঘণ্টার মধ্যে বোম্বেয় পৌঁছিব, যদি এই আধ ঘণ্টার মধ্যে আমি ব্যাগ খুলিয়া দেখি, তাহা হইলে তাহার রক্ষা নাই, গাড়ীতে আর দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিল না, তাহা হইলে হয়, তাহার যাবজ্জীবন জেল, না হয়, বিশ লক্ষ টাকার কণ্ঠহার লাভ, সমস্তই আমার একবার মাত্র ব্যাগ দেখার উপর নির্ভর করিতেছে। এ অবস্থায় এই স্ত্রীলোকের মনে কি অবস্থা হইয়াছিল, তাহা সহজেই বুঝিতে পারা যায়।
“আমি ব্যাগ খুলিয়া দেখিতে গেলে সে যে আমার বুকে ছোরা বসাইবে, তাহাতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। ব্যাগ খুলিবার জন্য ব্যাগে হাত দিলেই সেদিন সেই গাড়ীতেই নিশ্চয় আমার মৃতদেহ পাওয়া যাইত?
“গাড়ী আসিয়া ক্রমে বোম্বের ভিক্টোরিয়া স্টেশনে দাঁড়াইল; সেখানে লোকে লোকারণ্য। আমি তাহার জন্য একখানি গাড়ী ঠিক করিয়া দিতে উদ্যত হইলে সে বলিল, ‘আপনাকে কষ্ট দিব না। আমার চাকরকে খুঁজিয়া লইতেছি।’
“এই বলিয়া সে সত্বরপদে ভীড়ের মধ্যে অন্তর্হিত হইল, আমি একখানা গাড়ী ভাড়া করিয়া একটা হোটেলে গিয়া উঠিলাম। একদিন বোম্বেয় বিশ্রাম করিয়া পরে হায়দ্রাবাদ রওনা হইব, এইজন্যই বোম্বেয় আসিয়াছিলাম।
“আমি প্রথমে হোটেলে আসিয়া ব্যাগ হইতে কণ্ঠহার বাহির করিয়া পকেটে রাখিব, মনে করিলাম। হোটেলেও সর্ব্বদা একটা ব্যাগ গলায় ঝুলাইয়া বেড়ান অসম্ভব।
“ব্যাগ খুলিয়া আমার মাথা ঘুরিয়া গেল। ব্যাগে সে সিগারকেস নাই!
“আমার সর্ব্বাঙ্গে ঘাম ছুটিল, আমি পাগলের ন্যায় ব্যাগ হইতে সমস্ত দ্রব্যই গৃহতলে নিক্ষেপ করিতে লাগিলাম, কণ্ঠহার কোথায়?
“আমি জানিতাম, ট্রাঙ্কের মধ্যে আমি সেই কণ্ঠহার কখনই রাখি নাই, সে কণ্ঠহার সহ সিগারকেস আমার গলায় ব্যাগে ঝুলিতেছিল; সুতরাং কেহ নিশ্চয়ই তাহা আমার ব্যাগ হইতে তুলিয়া লইয়াছে; একবার ক্ষণেকের জন্য গলা হইতে ব্যাগটা নামাইয়াছিলাম। এখন রমণীর সকল কথা, সকল কাৰ্য্যকলাপ জ্বলন্ত-অক্ষরে আমার চক্ষের উপরে জ্বলিয়া উঠিল। এখন বুঝিলাম, আমাকে বোকা বানাইয়া সেই ধূৰ্ত্তা স্ত্রীলোক কণ্ঠহার চুরি করিয়াছে! আমার সর্ব্বনাশ করিয়া গিয়াছে! তাহারই এ কাজ, নতুবা আর কেহ কণ্ঠহার লইতে পারে না। কলিকাতা হইতে আসিবার সময় কেবল সেই রমণী আমার গাড়ীতে উঠিয়াছিল, পথে তাহার সহিতই আসিয়াছি—সে ব্যতীত আর কে লইবে? বিশ লক্ষ টাকা দামের কণ্ঠহার! আমার মনিব যে বিশ্বাস করিয়া আমার হাতে দিয়াছিলেন—সেই বিশ্বাসের কি এই প্রতিদান? তাঁহারা ভাবিবেন, আমিই চুরি করিয়াছি, খুব বিশ্বাস—জেলে যাইব, কেহই আমার কথা বিশ্বাস করিবে না।
“আমি মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িলাম। কিন্তু পর মুহূর্ত্তেই লম্ফ দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলাম। এখনও সময় আছে, এখনও সন্ধান করিলে তাহাকে পাওয়া যাইতে পারে, আমি একখানা গাড়িতে উঠিয়া পুলিস কমিশনারের কাছে ছুটিলাম।
“সেখানে একজন সুপারিন্টেণ্ডেণেন্ট আমার কথা পরম নিশ্চিন্ত মনে ধীরে ধীরে লিখিয়া লইতে লাগিল। এমন নিরেট মূর্খ! আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করিলে, আর যে তাহাকে ধরিতে পারা যাইবে না সে জ্ঞান তাহার নাই। আমার পীড়াপীড়িতে সে আমাকে কমিশনার সাহেবের কাছে লইয়া গেল। দেখিলাম, তিনি কাজের লোক আমার কথা শুনিয়াই আগে তিনি টেলিফোনে মুখ লাগাইয়া থানায় থানায় চারিদিকে এই স্ত্রীলোকের সন্ধানের আজ্ঞা দিলেন। আমার মুখে তাহার বর্ণনা শুনিয়া তৎক্ষণাৎ সৰ্ব্বত্র সেই বর্ণনা প্রচার করিয়া দিলেন। স্টেশনে স্টেশনে, স্টিমার-ঘাটে—সৰ্ব্বত্র লোক পাঠাইলেন। অবশেষে আমাকে আশ্বস্ত করিয়া বলিলেন, ‘ভয় নাই মহাশয়, এত শীঘ্র সে কিছুতেই পলাইতে পারিবে না—নিশ্চয়ই ধরা পড়িবে।’
“আমি তাঁহাকে ধন্যবাদ দিয়া হোটেলে ফিরিয়া আসিলাম, আর আমি কি করিতে পারি?
“আমার তখনকার মনের অবস্থা বর্ণনা করিব না, বিশেষতঃ তাহা একান্ত অসম্ভব। আমি বহুক্ষণ পাগলের ন্যায় পথে পথে ঘুরিলাম, অবশেষে নিতান্ত ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হইয়া হোটেলের দিকে ফিরিলাম। ফিরিয়া আসিলাম, কি করিব, কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া একটু ধুমপান করিয়া মন ও মস্তিষ্ক স্থির করিব ভাবিয়া এই সিগার কেসটি পকেট হইতে বাহির করিলাম। ইহা সর্বদাই আমার পকেটে থাকে, ভাল চুরুট পাইলেই কিনিয়া ইহাতে রাখি।
“ইহার মুখ খুলিয়া একটা চুরুট লইবার জন্য ভিতরে হাত দিলাম, কিন্তু চুরুট পাইলাম না – সে কি! ইহা সর্ব্বদাই চুরুটে পূর্ণ থাকে, চুরুট কোথায় গেল? আরও ভিতরে হাত দিলাম, একটা চামড়ার চাকিতে হাত পড়িল, আমার নিশ্বাস বন্ধ হইয়া আসিল, আমি তাহা টানিয়া বাহির করিলাম।
“এ কি! এই ত সেই হীরার কণ্ঠহার! সহসা আমার মাথায় কেহ লগুড়াঘাত করিলেও আমার এ অবস্থা হইত না। প্রথমে ইহাই যে সেই কণ্ঠহার, তাহা আমার একেবারে বিশ্বাস হইল না। সে হার অন্য পুরাতন সিগার-কেসে ছিল—ইহা কি সে হার নয়? মায়াবিনী কি মায়াবলে আসল কণ্ঠহার চুরি করিয়া নকল কণ্ঠহার আমার পকেটে রাখিয়া গিয়াছে!
“আমি পুনঃপুনঃ হার ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখিতে লাগিলাম। না এই সেই কণ্ঠহার—ইহাতে কোন সন্দেহ নাই! আমিই ভুলক্রমে কণ্ঠহারসুদ্ধ সিগার-কেসটি পকেটে রাখিয়া ভুলক্রমে চুরুটসুদ্ধ সিগার-কেসটি ব্যাগে রাখিয়াছিলাম। এই ভুলই আমাকে ঘোর-সঙ্কটে রক্ষা করিয়াছে, সেই মায়াবিনী ঠকিয়াছে! যখন সে সিগার-কেস খুলিয়া হার না দেখিয়া তৎপরিবর্ত্তে ভাল ভাল চুরুট দেখিবে, তখন তাহার কি অবস্থা হইবে, তাহাই ভাবিয়া আমি হাস্য সম্বরণ করিতে পারিলাম না। আনন্দে হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলাম, আমাকে পাগল ভাবিয়া দুই-একজন পথিক বিস্মিত ভাবে আমার মুখের দিকে চাহিয়া দেখিল।
“এখন আমার ইচ্ছা নয় যে, আমার এই মহা বোকামী জগতে প্রচারিত হয়। স্ত্রীলোকটি যদি ধরা পড়িয়া থাকে, তবে আমি লোকালয়ে খুবই হাস্যাস্পদ হইব, কারণ তখন এ কথা আর গোপন থাকিবে না, আমার মনিবও আমাকে সহসা ক্ষমা করিবেন না, কারণ কেবল দৈববলেই এই কণ্ঠহার রক্ষা পাইয়াছে, আমার সাবধানতা বা বুদ্ধিবলে নহে। এখন স্ত্রীলোকটি ধরা না পড়িলেই সকল কথা চাপা পড়িয়া যায়। এবার আমি পুলিস-কমিশনার সাহেবকে চুরির অনুসন্ধান হইতে নিরস্ত করিবার জন্য উর্দ্ধশ্বাসে আবার তাঁহার আফিসের দিকে ছুটিলাম।
“তিনি আমার কথা শুনিয়া ভ্রুকুটি করিলেন। আমার সম্বন্ধে কি ভাবিলেন, তাহা তিনিই অবগত ছিলেন, তবে আমার উপরে যে বিশেষ বিরক্ত হইয়াছেন, তাহা বেশ বুঝিতে পারিলাম। আমি পূর্ব্বে তাঁহাকে যাহা বলিয়াছিলাম, তাহা যদি সত্য বলিয়া তিনি জানিতে না পারিতেন, তাহা হইলে আমি মহা বিপদে পড়িতাম।
“তাঁহার কাছে যাহা শুনিলাম, তাহা এই,স্ত্রীলোকের নাম মেহেরজান, বোম্বে-পুলিস তাহাকে বেশ চিনে, তবে আইনের কবলে তাহাকে ফেলিতে পারে নাই বলিয়া সেই ধূৰ্ত্তা সয়তানীকে ধরিতে পারে নাই। তিনি অনুসন্ধানে জানিতে পারিয়াছেন যে, সে প্রকৃতই সেদিন বোম্বেয় পৌঁছিয়াছিল, পুলিস তাহাকে স্টেশনে লক্ষ্য করিয়াছিল, তখন তাহার পার্শী-রমণীর বেশ ছিল। একজন বাঙ্গালীও সেই গাড়িতে তাহার সঙ্গে আসিয়াছিলেন; তখন মেহেরজানের বিরুদ্ধে কিছু না থাকায় তাহারা তাহাকে ধরিতে পারে নাই। সে দ্রুতবেগে স্টেশন হইতে বাহির হইয়া যায়—তাহার পর সে কোথায় গিয়াছে, তাহার আর কোন সন্ধান নাই। সে ছদ্মবেশে সিদ্ধহস্ত, তাহাকে আর সহজে ধরা সম্ভব নহে।
“আমি বলিলাম, “যখন কণ্ঠহার পাইয়াছি—তখন আর আমি এ সম্বন্ধে আর কোন গোলযোগ করিতে ইচ্ছা করি না।”
“তিনি বলিলেন, ‘কাজেই,—এখন তাহার বিরুদ্ধে কিছুই নাই—অনর্থক আমাদের কষ্টভোগ হইল।”
“আমি তাঁহার কাছে নিতান্ত বিনীতভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করিলাম। পরে আর কোন গোলযোগ ঘটে নাই, আমি কণ্ঠহার যথাস্থানে নিরাপদে পৌঁছাইয়া দিতে সক্ষম হইয়াছিলাম।”
.
দাদা মহাশয় ওষ্ঠাধর ও নাসিকা কুঞ্চিত করিয়া মহা বিরক্তভাবে বলিয়া উঠিলেন, “আমি মনে করিয়াছিলাম, তুমি খুন সম্বন্ধে নূতন একটা কিছু বলিবে। ইহা তোমার হাস্যজনক বোকামীর ঘটনা জানিলে আমি এতক্ষণ এখানে অপেক্ষা করিতাম না—এখন আমি চলিলাম।”
এই বলিয়া তিনি গমনে উদ্যত হইলে চতুর্থ যুবক বলিলেন, “মহাশয়কে আর একটু অপেক্ষা করিতে হইতেছে।”
ইনি এতক্ষণ একটা কথাও কহেন নাই। তাহার কথা শুনিয়া দাদা মহাশয় বিস্মিত হইয়া বলিলেন, কেন? আমাকে অপেক্ষা করিতে হইবে কেন? তোমরা কি মনে কর, সংসারে আমার আর কোন কাজ নাই?”
চতুর্থ যুবক বলিল, “তাহা বলিতেছি না, তবে কুমার আনন্দপ্রসাদের নামে গুরুতর দোষারোপ হইয়াছে, তিনি এখন খুনী বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছেন, তাঁহার এ অপবাদ দূর করা আমার কৰ্ত্তব্য।”
দাদা মহাশয় অতিশয় বিস্মিত হহা বলিলেন, “আপনার!”
চতুর্থ যুবক বলিল, “হাঁ—আমারই। আমি এতক্ষণ নীরব ছিলাম। তাহার কারণ আমি ভাবিয়াছিলাম যে, ইনি হয় ত এ সম্বন্ধে নূতন কিছু বলিবেন, এখন দেখিতেছি, তাহা কিছু নয়, উহার গল্পের সহিত এ খুনের কোন সম্বন্ধ নাই। সেইজন্য দেবেন্দ্রবাবু যে পর্য্যন্ত বলিয়াছেন, তাহার পর এ খুন সম্বন্ধে যাহা যাহা ঘটিয়াছে, তাহাই আমি বলিব, ইহাতে বুঝিবেন, কুমার আনন্দপ্রসাদের দ্বারা এ খুন হয় নাই।”
দাদা মহাশয় আবার বসিলেন। বসিয়া বলিলেন, “আপনি জানিলেন কিরূপে?”
চতুর্থ যুবক বলিল, “তাহাও বলিতেছি। আমি কুমার আনন্দপ্রসাদের উকিল—কেবল উকিল নহে, তাঁহার বিশেষ বন্ধু। এমন কি তাঁহাদের পারিবারিক কোন কথাই আমার অবিদিত নাই। আমি যাহা বলিতে যাইতেছি, তাহা নীরস কথা নহে। এরূপ রহস্যপূর্ণ খুনের কাহিনী আপনার পাঁচকড়ি বাবুরও কোন ডিটেকটিভ উপন্যাসের মধ্যে পাইবেন কি না সন্দেহ।”
“তবে দেখিতেছি, শুনিতে হইল—ব্যাপারটা কি।”
এই বলিয়া দাদা মহাশয় ভৃত্যকে ডাকিয়া বলিলেন, “কোচম্যানকে বল, সে ঘণ্টা হিসাবে ভাড়া পাইবে।” ফিরিয়া বলিলেন, “বল।”
তৃতীয় অংশ – শেষ
এইবার চতুর্থ যুবক বলিতে লাগিল, “আজ বেলা বারটার সময় আমি কুমার আনন্দপ্রসাদের বাড়ীতে তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে গিয়াছিলাম, কিন্তু তিনি তখন বাড়ীতে ছিলেন না। সন্ধান লইয়া জানিলাম, তিনি রাত্রি হইতে বাড়ীতে আইসেন নাই। তাঁহার দাদা রাজা গুণেন্দ্রপ্রসাদ দেশে ফিরিয়া অন্যত্রে উঠিয়াছেন, এই সংবাদ পাইয়া তিনি তাঁহাকে আনিবার জন্য তৎক্ষণাৎ রওনা হয়েন, সেই পর্য্যন্ত তাঁহার কোন সংবাদ নাই।
“আমি এ কথা শুনিয়া বিস্মিত হইয়া কোথায় তাঁহার সন্ধানে যাইব ভাবিতেছি, এই সময়ে একজন পুলিস-ইনস্পেক্টর তথায় আসিলেন। তাঁহার কাছেই এই খুনের বৃত্তান্ত শুনিলাম; আরও শুনিলাম, তিনি এই খুনের জন্য কুমার আনন্দপ্রসাদকে গ্রেপ্তার করিতে আসিয়াছেন। এ সংবাদে আমার মনের কি অবস্থা হইল, তাহা বলা বাহুল্য। মেহেরজান কোথায় থাকে, তাহা আমরা কেহই জানি না, পুলিস এখনও সে বাড়ীর সন্ধান পায় নাই, নতুবা আমরা প্রথমে রাজা গুণেন্দ্রপ্রসাদের দেহ আনিয়া সৎকার করিতাম।
“আমি আনন্দপ্রসাদের বিশেষ বন্ধু, আমি তাঁহার চরিত্র বিশেষরূপে জানি, তিনি যে এরূপ ভয়ানক কাজ করিয়াছেন, তাহা মুহূর্ত্তের জন্য বিশ্বাস করিতে পারিলাম না। করিতে পারিলাম না বটে, তবে ইনস্পেক্টর তাঁহার বিরুদ্ধে যেরূপ প্রমাণ দিলেন, তাহাতে বুঝিলাম, এ যাত্রা তাঁহার রক্ষা পাওয়া অতি কঠিন।
“বহুক্ষণ ইনস্পেক্টর অপেক্ষা করিলেন, তথাপি আনন্দপ্রসাদ ফিরিলেন না; তখন তিনি হতাশভাবে প্রস্থান করিলেন। আমাকে উকিল বলিয়া জানিতেন, আমার নিকটে অঙ্গীকার করিলেন যে, এ সম্বন্ধে নূতন কিছু ঘটিলে তিনি আমাকে সংবাদ দিবেন।
“আমি কি করিব, স্থির করিতে না পারিয়া বহুক্ষণ আনন্দপ্রসাদের বাড়ীতে অপেক্ষা করিলাম, অবশেষে হতাশচিত্তে বাড়ীর দিকে যাইতেছিলাম, এই সময়ে একজন পাহারাওয়ালা তথায় ছুটিয়া আসিয়া আমার হাতে একখানি পত্র দিল। আমি ব্যগ্রভাবে পত্রখানি খুলিলাম। ইনস্পেক্টর লিখিয়াছেন;
“মহাশয়, সেই হিন্দুস্থানী দ্বারবান্টা ধরা পড়িয়াছে, শীঘ্র আসুন।”
আমি তৎক্ষণাৎ থানার দিকে ছুটিলাম।
“থানায় আসিলেই ইনস্পেক্টর আমাকে বলিলেন, ‘বেহারাটা ধরা পড়িয়াছে, সে যে মেহেরজানের চাকর, তাহা আমরা পূর্ব্ব হইতে জানি, কিন্তু রাত্রে যাহা ঘটিয়াছে, তাহার সে কিছুই বলিতে চাহে না, তাহার সম্বন্ধে বা মেহেরজান সম্বন্ধে বা খুন সম্বন্ধে সে কিছুই বলিতে চাহে না— কেবলই ভয়ের ভাণ করিতেছে। অনেক চেষ্টায়ও তাহার নিকট হইতে কোন কথা বাহির করিতে পারি নাই।”
“আমিও কতকটা চেষ্টা করিয়া দেখিলাম, কিন্তু সে হিন্দুস্থানীটা কোন কথা কহিল না। আমি হতাশ হইয়া বাড়ী ফিরিতেছিলাম, এই সময়ে আনন্দপ্রসাদের বাড়ীর একজন লোক ছুটিয়া আসিয়া বলিল, ‘কুমার বাহাদুরকে পাওয়া গিয়াছে, তিনি হাঁসপাতালে আছেন—এইমাত্র হাঁসপাতালের লোক আসিয়া সংবাদ দিয়াছে।”
“আমি ও ইনস্পেক্টর উভয়ে সত্বরে হাঁসপাতালে উপস্থিত হইলাম, গত রাত্রে আনন্দপ্রসাদকে অজ্ঞান অবস্থায় হাঁসপাতালে আনা হয়, তিনি অন্ধকারে একজন মাড়োয়ারী ভদ্রলোকের গাড়ীর নীচে পড়িয়াছিলেন, তিনিই সেই গাড়ীতে তুলিয়া তাঁহাকে হাঁসপাতালে আনিয়াছিলেন। তাঁহাকে হাঁসপাতালে কেহ চিনিত না, তাঁহার জ্ঞান হওয়ায় তখন তাঁহার নিকটে তাঁহার নাম ঠিকানা পাইয়া হাঁসপাতাল হইতে তাঁহার বাড়ীতে সংবাদ পাঠান হইয়াছিল।
“ইনস্পেক্টর আনন্দপ্রসাদকে বলিলেন, ‘আপনাকে বলা উচিত যে, আপনার ভ্রাতাকে খুন করিবার জন্য আমি আপনাকে গ্রেপ্তার করিতে বাধ্য হইলাম।’
“আনন্দপ্রসাদ গ্রেপ্তার হইলেন বলিয়া যে ভয়ে বিচলিত হইলেন, তাহা বোধ হইল না, বরং তাঁহার ভ্রাতা খুন হইয়াছেন শুনিয়া শোকে নিতান্ত অধীর হইয়া পড়িলেন। তিনি কি বলিতে যাইতেছিলেন, ইনস্পেক্টর বলিলেন, ‘আপনি কিছু এখন না বলিলেই ভাল হয়, কেননা আপনি এখন যাহা কিছু বলিবেন, তাহা আপনারই বিরুদ্ধে যাইবে।’
“আমি আনন্দপ্রসাদকে বলিলাম, ‘আমি তোমার উকিল, আমি বলিতেছি, তুমি সকল কথা খুলিয়া বল।’
“তখন আনন্দপ্রসাদ ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন, ‘আমি আমার দাদাকে খুন করিয়াছি—লোকে এ কথা বিশ্বাস করে—মুখে আনিতে সাহস করে! আমি তাঁহাকে কত শ্রদ্ধাভক্তি করি, তাহা কে না জানে? যাহা কিছু ঘটিয়াছে, সব বলিতেছি—নিজেকে নিদোষী সাব্যস্ত করিবার জন্য নহে; আমাকে দোষী বলিতে সাহস করে কে? যাহা হউক ব্যাপারটা কি শুনুন, কাল সন্ধ্যার সময়ে আমি সংবাদ পাইলাম যে, দাদা ফিরিয়া আসিয়াছেন, তিনি বাবার ত্যাজ্যপুত্র বলিয়া বাড়ী আইসেন নাই, এক অপর ভাড়াটিয়া বাড়ীতে আসিয়াছেন। আমি তৎক্ষণাৎ সেই বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম; শুনিলাম, তিনি রাত্রি আটটার সময়ে বাহির হইয়া গিয়াছেন; কোথায় গিয়াছেন, কেহ তাহা জানে না। আমি জানিতাম, মেহেরজান কলিকাতায় আছে, আমি পূর্ব্বে তাহার বাড়ীতে প্রবেশ করি নাই সত্য, তবে তাহার বাড়ী চিনিতাম। আমি তখনই মেহেরের বাড়ীর দিকে চলিলাম। আমি মেহেরের বাড়ীর দ্বারে আসিয়া কড়া নাড়িলে এক হিন্দুস্থানী দ্বারবান্ দরজা খুলিয়া দিল। আমি এক টুকরা কাগজে আমার নাম লিখিয়া ভিতরে পাঠাইয়া দিলাম। পর মুহূর্ত্তেই আমার দাদা ছুটিয়া আসিয়া খুব স্নেহপ্রকাশ করিয়া আমার হাত ধরিলেন; তাঁহার পশ্চাতে মেহেরজানকে দেখিলাম। মেহেরজান আমাকে চিনিত, আমাকে দেখিয়া মৃদু হাসিয়া বলিল, ‘দুই ভায়ে অনেকদিন পরে দেখা, নিশ্চয়ই অনেক কথা আছে, দুইজনে এই ঘরে বসো, আমি অন্য ঘরে যাইতেছি।’ বলিয়া সে ভিতরে অন্য গৃহে চলিয়া গেল। দাদা আমার হাত ধরিয়া এক সুসজ্জিত কক্ষে আনিয়া বসাইলেন। আমি বসিয়াই বলিলাম, ‘বাবা রাগ করিয়া যাহা করিয়া গিয়াছেন, তুমি মনে কর কি আমি তাহার পোষকতা করিব? তোমার সম্পত্তি তোমার, আমি তোমার ছোট ভাই মাত্র। আমি বুঝিয়াছি, তুমি রাগ করিয়া বাড়ী যাও নাই।’ দাদা বলিলেন, ‘রাগ নয়, অনেক দিন দেশে ছিলাম না, খবর লইয়া যাইব, মনে করিয়াছিলাম।’ আমি বলিলাম, ‘এ তোমার অন্যায়, এখনই আমার সঙ্গে যাইতে হইবে—আমি ছাড়িব না।’ দাদা বলিলেন, ‘এখনই যাইতেছি, কেবল ইহার কাছে শেষ বিদায় লইব।’ আমি বিস্মিত হইয়া বলিলাম, ‘যথার্থই কি তুমি ইহাকে ত্যাগ করিবে? ইহা কি সত্য?” দাদা বলিলেন, “নিশ্চয়ই, মেহের এক নবাবকে বিবাহ করিয়াছে। নানাস্থানে ইহার সম্বন্ধে নানা কথা শুনিয়াছি, ইহার ন্যায় ভয়ানক স্ত্রীলোক আর হয় না।’ আমি না বলিয়া থাকিতে পারিলাম না; অথচ কলিকাতা পৌঁছিয়াই ইহার নিকট আগে ছুটিয়া আসিয়াছ? দাদা বলিলেন, ‘তাহার কারণ আছে, আমি এখানে পৌঁছিয়াই ইহার এক পত্র পাইলাম, তাহাতে লিখিয়াছে, সে মরণাপন্ন পীড়িত, বন্ধু-বান্ধব-বিহীন, বড় কষ্টে পড়িয়াছে। পত্র পাইবামাত্র না আসিলে এ জীবনে আর দেখা হইবে না। এই পত্র পাইয়া, কেবল দয়াপরবশ হইয়া আমি এখানে আসিয়াছি, তাহার উপরে আর আমার বিন্দুমাত্র অনুরাগ নাই। এখানে আসিয়া দেখি, সে যাহা লিখিয়াছিল, তাহা সর্ব্বৈব মিথ্যা। দেখিতেছ ত সে রাজার হালে রহিয়াছে—এমন মায়াবিনী আর দুনিয়ায় নাই। আমি তাহাকে এরূপভাবে মিথ্যা পত্র লিখিবার কারণ জিজ্ঞাসা করিলে সে হাসিয়া বলিল, তাহা না হইলে আমি এখানে আসিতাম না। যাহাই হউক, তুমি এখন যাও—আমি দশ মিনিটের মধ্যে বাড়ী পৌঁছিব। তোমার সম্মুখে ইহার সঙ্গে কথা কহা ভাল দেখায় না।’ অগত্যা আমি বিদায় লইলাম। জীবনে কখনও দাদার সঙ্গে আমার সামান্য একটি কথান্তরও হয় নাই—আর আমি কি না তাঁহাকে খুন করিব?’
“এই বলিয়া আনন্দপ্রসাদ ইনস্পেক্টরের দিকে ফিরিলেন। আনন্দপ্রসাদ যাহা বলিতেছিলেন, এতক্ষণ তিনি সমস্তই নোট-বুকে লিখিয়া লইতেছিলেন। বলা শেষ হইলে তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া আনন্দপ্রসাদ বলিলেন, ‘কেমন মহাশয়, আপনার এ কথা বিশ্বাস হয়?”
“ইনস্পেক্টর তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন না। তাঁহার ন্যায় বিচক্ষণ ডিটেকটিভ আর নাই। তাঁহার কল্পনাশক্তি অসীম। যদি ইনি কখনও কোন জটিল মামলায় পড়িতেন, তিনি মনে মনে কল্পনায় নিজে সেই খুনী হইতেন, খুনী এ সম্বন্ধে যাহা কিছু করিতে পারে, তিনিও কল্পনায় তাহা করিতেন, এই সকল কল্পনা এমনই ভাবে করিতেন যে, হত্যাকারী তাঁহার হস্তে কখনও নিষ্কৃতি পাইত না। অনেকে ভাবিত, তিনি ডিটেকটিভ না হইলে সুকবি হইতেন। ইনস্পেক্টরের নাম, যোগেন্দ্রনাথ।
“যোগন্দ্রেনাথ কিয়ৎক্ষণ নীরব থাকিয়া বলিলেন, ‘রাজা গুণেন্দ্রপ্রসাদ ত্যাজ্যপুত্র হওয়া অবধি আপনি হেণ্ডনোটে অনেক টাকা ধার করিতেছেন। গুণেন্দ্রপ্রসাদ ফিরিয়া আসায় আপনি ভাবিলেন, তিনি মোকদ্দমা করিবেন, সেই মোকদ্দমায় তাঁহার জিৎ হইবে, তখন আপনার ঋণ পরিশোধ করিবার কোন উপায় থাকিবে না। এইরূপ সময় আপনি মেহেরজানের বাড়ীতে রাত্রে উপস্থিত হইলেন। তাহাকে হত্যা করিলে সকল গোলযোগ মিটিয়া যায়, আপনিই রাজা হয়েন। ‘
“আনন্দপ্রসাদ বলিলেন, ‘ও! আপনি এই রকমে মোকদ্দমা গড়িয়াছেন? আমার রাজা হইবার জন্য মেহেরজানেরও কি মৃত্যুটা আবশ্যক?
“যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, ‘সে-ই আপনার হত্যাকাণ্ডের একমাত্র সাক্ষী, নিশ্চয়ই আপনি তাহার মুখ জন্মের মত বন্ধ না করিলে সে কখনই এ কথা গোপন রাখিত না।’
“আনন্দপ্রসাদ বলিলেন, ‘বটে! তাহা হইলে বেহারাটাকেও খুন করিলাম না কেন?’
‘সে ভাং খাইয়া অজ্ঞান ছিল, সে কিছুই দেখে নাই।’
‘আপনি ইহা বিশ্বাস করেন?’
‘আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে বড় কিছু ক্ষতি-বৃদ্ধি নাই। সে ভার জুরীদের।’
“কুমার আনন্দপ্রসাদ লম্ফ দিয়া উঠিলেন; বলিলেন, ‘কি ভয়ানক! কি ভয়ানক!’
“আমরা তাঁহাকে ধরিয়া স্থির রাখিতে পারিলাম না, তিনি সক্রোধে বলিলেন, ‘ইহারা আমার ফাঁসীর বন্দোবস্ত করিতেছে, আর তোমরা আমাকে ধরিয়া রাখিতেছ! আমি ইহার সঙ্গে এখনই সেই বাড়ীতে যাইব, তিনি আমার দাদা, আমার কর্ত্তব্য, ইহা দেখা, তিনি খুন হইয়াছেন, আর আমি নিশ্চিন্ত বসিয়া থাকিব? না—কখনই না, আমি বলিতে পারি, কে তাঁহাকে খুন করিয়াছে—এ সেই রাক্ষসী মেহেরের কাজ। কাল রাত্রে মেহের যখন দাদার কাছে শুনিয়াছিল যে, দাদা তাহাকে ত্যাগ করিয়াছেন, তখন সে রাগে নিশ্চয়ই তাঁহার বুকে ছোরা বসাইয়া দিয়াছিল, সে ছোরা নিশ্চয়ই তাহার কাছে আছে—ইহাতে আপনি কি বলেন?’
“যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, ‘সম্ভবতঃ ছোরা সেখানে আপনিই রাখিয়াছেন।’
“কুমার সবেগে উঠিয়া যোগেন্দ্রনাথকে আক্রমণ করিতে উদ্যত হইলেন, কিন্তু তাঁহার ক্ষতস্থান হইতে রক্ত ছুটিল, তিনি মূৰ্চ্ছিত হইলেন।
“তাঁহাকে তদবস্থায় ডাক্তারদিগের হস্তে রাখিয়া আমরা মেহেরজানের বাড়ীর দিকে চলিলাম। তাঁহার নিকটেই সে ঠিকানা পাইয়াছিলাম। সুতরাং সে বাড়ী এখন খুঁজিয়া লইতে আমাদিগকে ক্লেশ পাইতে হইল না।
“পথে যাইতে যাইতে যোগেন্দ্রবাবু আমাকে বলিলেন, ‘কুমারকে ইচ্ছা করিয়া রাগাইয়া দেওয়ায় বোধ হয়, আপনি আমার উপরে রাগ করিয়াছেন; কিন্তু এ সকল ব্যাপারে এরূপ ব্যবহারই আমাদের কর্তব্য। রাগাইয়া কোন কথা বাহির করিতে পারিলে অনেকটা সুবিধা হয়। ইনি যাহা বলিয়াছেন, তাহা যদি সত্য হয়, যথার্থই যদি মেহেরজান খুন করিয়া থাকে, তাহাতে আমি বিশেষ সন্তুষ্ট ব্যতীত অসন্তুষ্ট হইব না।’
“আমরা মেহেরজানের গৃহে প্রবেশ করিলাম। দৈবেন্দ্র বাবু যেরূপ বর্ণন করিয়াছিলেন, তাহাই ঠিক, বাড়ীর দরজা তখনও খোলা রহিয়াছে, আমরা গৃহপ্রবেশ করিয়া যে কক্ষে রাজা গুণেন্দ্রপ্রসাদের মৃতদেহ ছিল, তথায় গিয়া দেখিলাম, তাঁহার মৃতদেহ সেইরূপই রহিয়াছে, পার্শ্ববর্তী একটা ঘরে মেহেরজানের মৃতদেহও দেখিতে পাইলাম। কিন্তু অনেক অনুসন্ধানে ও আমরা সেখানে কোন অস্ত্র খুঁজিয়া পাইলাম না।
“আমি বলিলাম, ‘কুমার যেরূপ বলিলেন, তাহাতে ছোরাখানা যদি ইহার হাতে দেখিতে পাইতাম, তবে সন্তুষ্ট হইতে পারিতাম।’
“যোগেন্দ্রবাবু বলিলেন, ‘ছোরাখানা যে দেখিতে পাইলাম না, ইহাই সৰ্ব্বাপেক্ষা অধিক প্রমাণ যে, গুণেন্দ্রপ্রসাদ খুন হইবার পূর্ব্বেই আনন্দপ্রসাদ বাড়ী ত্যাগ করিয়া গিয়াছিলেন। আনন্দপ্রসাদ পঞ্চমবর্ষীয় নহেন, অবশ্যই তিনি জানিতেন, মেহেরের হাতে ছোরাখানা রাখিয়া দিলে সকলেই বুঝিবে, এই স্ত্রীলোক রাজাকে খুন করিয়া নিজেও আত্মহত্যা করিয়াছে। তাহার পর আরও দেখুন, আনন্দপ্রসাদ নিজেই জোর করিয়া বলিলেন যে, আমরা ছোরাখানা এখানে দেখিতে পাইব, কিন্তু তিনি যদি নিজে ছোরাখানা লইয়া যাইতেন, তাহা হইলে এ কথা কখনই মুখে আনিতেন না। এদিকে কেহ আত্মহত্যা করিয়া তাহার পর ছোরাখানা লুকাইয়া রাখিয়া আবার আসিয়া মরিয়া পড়িয়া থাকে না; সুতরাং বুঝিতে হয়, আনন্দপ্রসাদ খুন না করিলেও অপরের দ্বারা এই দুইটি খুন হইয়াছে। কাজেই এ বাড়ীর বাহিরে আমাদের খুনির সন্ধান করিতে হইবে।’
“এই বলিয়া যোগেন্দ্রনাথ প্রতি ঘর তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিতে আরম্ভ করিলেন, আমি মুহূর্ত্তের জন্য তাঁহার সঙ্গ ছাড়িলাম না। পাছে তিনি কুমারের বিরুদ্ধে কিছু প্রমাণ সংগ্রহ করেন, এইজন্য তিনি যাহা কিছু দেখিতেছেন, আমিও তাহাই দেখিব বলিয়া কৃতসংকল্প হইলাম।
“যোগেন্দ্র বাবুর অনুসন্ধান শেষ হইলে তিনি একস্থানে বসিয়া, প্রথমে দেবেন্দ্র বাবু যাহা বলিয়াছিলেন, নোটবুক খুলিয়া তাহা পাঠ করিলেন, তৎপরে কুমার যাহা বলিয়াছেন, তাহাও পাঠ করিলেন, তৎপরে বর্ণনা মিলাইতে লাগিলেন। দেবেন্দ্র বাবুর বর্ণনায় কুমার আনন্দপ্রসাদকেই খুনী বলিয়া বোধ হয়, আর কুমারের হিসাবে মেহেরজানই খুনী, যোগেন্দ্রনাথ কাহার কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে করিতেছেন, তাহা আমি কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না।
“কিয়ৎক্ষণ পরে যোগেন্দ্র বাবু নিজেই এ সম্বন্ধে কথা কহিলেন; বলিলেন, ‘আমরা দুইটি মতের আলোচনা করিতেছি, প্রথম-কুমার আনন্দপ্রসাদ দুই খুন করিয়াছেন। দ্বিতীয়—মেহেরজান রাজাকে খুন করিয়া নিজে আত্মহত্যা করিয়াছে। যতক্ষণ হিন্দুস্থানী বেহারা কিছু না বলিতেছে, ততক্ষণ আমি এই দুই কথাই বিশ্বাস করিতে পারিতেছি না।’
“আমি বলিলাম, ‘সে অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছিল, কিছুই দেখিতে পায় নাই।’
“যোগেন্দ্রবাবু একটু ইতস্ততঃ করিলেন। আমি বুঝিলাম, তিনি মনে মনে স্থির করিলেন যে, আমার কাছে সব কথাই বলিতে পারেন। তাহাই বলিলেন, ‘সে যে অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছিল, তাহা বলিতে পারি না। সে যে মূর্খ, তাহা নিশ্চয় বলা যায়। এখন দেখিতে হইবে, এ বাড়ীতে সে কি করিত—বেহারার কাজ করিত—না তাহার মনিব নবাবের হইয়া এই স্ত্রীলোককে পাহারা দিত। এ বাড়ীর একজন কর্তা আছে, সেই কৰ্ত্তাই স্ত্রীলোককে টাকা দিত—সে সেই নবাব; সেই নবাবই কি তাহার হইয়া এই হিন্দুস্থানীকে মেহেরের পাহারায় নিযুক্ত করে নাই? অযোধ্যায় এই নবাবকে খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে, ঘরের সাজসজ্জা দেখিলেই স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়, সে যে-ই হউক, সে নিতান্ত ছোট-খাট নবাব নহে। এ বেহারা তাহারই লোক; তাহারই হইয়া এই বাড়ীর পাহারায় ছিল। কাল রাত্রে কুমার চলিয়া গেলে এ বাড়ীতে কেবল মেহেরজান আর গুণেন্দ্রপ্রসাদ ছিল—আর ছিল এই হিন্দুস্থানীটা। সে উভয়কে প্রেমালাপে নিযুক্ত দেখিয়া তাহার মনিবের কথামতো সে যে উভয়কে খুন করে নাই, তাহাই বা কে বলিতে পারে? ইহাও কি সম্ভব নহে?”
“কুমার আনন্দপ্রসাদের উপরে দোষারোপ না হইয়া অপর কাহারও উপরে হউক, আমি ইহাই ঐকান্তিক ইচ্ছা করিতেছিলাম। তথাপি আমি বলিলাম, ‘এ সম্বন্ধে বিশেষ প্রমাণ আছে কি?’
“যোগেন্দ্র বাবু মৃদুহাস্য করিয়া বলিলেন, ‘তাহা জানি, তবে সে-ই যে খুনী, তাহার বিরুদ্ধে যে প্রমাণ আছে, এ কথা বলিলে হিন্দুস্থানীটা এখন নিজেকে বাঁচাইবার জন্য অনেক কথা বলিতে পারে; খুব সম্ভব, আর বজ্জাতি করিয়া মুখ বন্ধ রাখিবে না। এখন আসুন, থানায় গিয়া তাহার সঙ্গে দেখা করি।’
“আমরা বহির্দ্বারের নিকটে আসিলে দেখিলাম, একজন ডাক-হরকরা বাড়ীর দিকে আসিতেছে। তাহাকে দেখিয়াই যোগেন্দ্র বাবু বলিয়া উঠিলেন, ‘আমি কি অসাবধান, আমি এতক্ষণ লক্ষ্য করি নাই—এ বাড়ীর দরজায় একটা চিঠির বাক্স রহিয়াছে। কি আশ্চর্য্য, এই বাক্সে যে সকল চিঠিপত্র আছে, তাহা যে এতক্ষণ হস্তগত করা আমার উচিত ছিল। কি আশ্চর্য্য!’
“তিনি বাক্সটা টানিয়া দেখিলেন, চাবি বন্ধ। এই সময়ে ডাকহরকরা দ্বারে আসিল। যোগেন্দ্ৰ বাবু তাহার হাত হইতে একখানি পত্র লইলেন। দেখিলেন, কলিকাতার কোন দোকানদারের তাগিদ। তিনি বলিলেন, ‘তাই ত, ইহাতে আমাদের কোন কাজ হইবে না।’ তখন তিনি ডাক- হরকরার দিকে ফিরিয়া বলিলেন, ‘আমি কে দেখিতেছ?”
“ডাক-হরকরা ঘাড় নাড়িল। যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, ‘এই বাড়ীর লোক গ্রেপ্তার হইয়াছে, এখানকার সমুদয় জিনিস আমার জিম্মায় আছে। আজ এখানে আর কোন পত্র দিয়াছ?’
“ডাক-হরকরা বলিল, ‘হাঁ, সকালে ডাকে দুইখানা পত্ৰ দিয়াছি।’
“কাহার হাতে দিয়াছিলে?”
“এ বাড়ীতে কাহারও হাতে দিতে হয় না—বাক্স আছে, বাক্সেই ফেলিয়া দিই।”
“লক্ষ্ণৌর ডাকমার্কা কোন চিঠি লক্ষ্য করিয়াছ?”
“অনেক—প্রায়ই আসে।”
“একই লোকের হাতের লেখা?”
“বোধ হয়, তাহাই।”
“বেশ, ইহাতেই হইবে।”
“এই বলিয়া যোগেন্দ্রবাবু ডাক-হরকরাকে বিদায় দিয়া নিজের পকেট হইতে একখানা ছোট ছুরি বাহির করিয়া চিঠির বাক্স খুলিতে চেষ্টা পাইতে লাগিলেন। বলিলেন, ‘অন্ততঃ এই বাড়ীর মালিক প্রকৃত কে, তাহা এখন জানিতে পারিব। রাত্রি হইতে এ বাড়ীতে কেহ নাই, সুতরাং সকালের চিঠি বাক্সেই আছে। চিঠি হইতে যে কত বদমাইস ধরা পড়িয়াছে, তাহার সংখ্যা হয় না।’
“যোগেন্দ্র বাবু কথা কহিতে কহিতে ছুরি দিয়া চাবি খুলিবার চেষ্টা করিতেছিলেন, কিন্তু তিনি এত ব্যগ্র হইয়া পড়িয়াছিলেন যে, কিছুতেই চাবি খুলিতে পারিতেছিলেন না; অতি কষ্টে অবশেষে চাবি খুলিয়া গেল। আমরা দুইজনে ব্যস্ত হইয়া বাক্সের মধ্যে হাত দিলাম, তখন আমরা উভয়ে এত বিস্মিত ও স্তম্ভিত হইলাম যে, কাহারও মুখে কথা সরিল না, উভয়ে উভয়ের মুখের দিকে অবাক হইয়া চাহিয়া রহিলাম। কি মুস্কিল! বাক্সে যে কিছু নাই।
“কতক্ষণ আমরা দুইজন দুইজনের মুখের দিকে মূকের ন্যায় চাহিয়াছিলাম, তাহা বলিতে পারি না, যোগেন্দ্র বাবু প্রথমে আত্মসংযম করিলেন, তিনি আমায় টানিয়া লইয়া সেই শূন্য বাক্সটা দেখাইয়া দিলেন। দেখাইয়া বলিলেন, ‘ইহাতে কি ঘটিয়াছে, বুঝিতে পারেন কি? ইহাকে সহজে বুঝিতে পারা যায় যে, আমাদের আগে এখানে অন্য লোক আসিয়াছিল। কেহ ইহারই মধ্যে এখানে আসিয়া চিঠি লইয়া গিয়াছে।’
“আমি বলিলাম, “নিশ্চয়ই সেই হিন্দুস্থানী বেহারা।’
যোগেন্দ্রবাবু বলিলেন, “সে ভোর হইতে নজরবন্দী আছে, সে কখনই চিঠি লইতে পারে না। কুমার আনন্দপ্রসাদ হাঁসপাতালে পড়িয়া আছেন, সুতরাং তিনিও চিঠি লয়েন নাই, কাজেই অন্য কোন লোক, যাহাকে আমরা জানি না, চিনি না—সেই খুনী, সে হয় ত চিঠির জন্য আসিয়াছিল; ভাবিয়াছিল, চিঠি পুলিসের হাতে পড়িলে সে ধরা পড়িবে, তাহার আর রক্ষা পাইবার উপায় থাকিবে না। হয় ত সে চিঠির জন্যও আসে নাই—ছোরাখানা বা তাহার অন্য কোন দ্রব্য এই বাড়ীতে ছিল, তাহা আমাদের হাতে পড়িলে তাহার বিষম বিপদের সম্ভাবনা, তাহাই সে তাহা লইতে আসিয়াছিল; পরে ফিরিবার সময়ে চিঠিগুলি বাক্সের মধ্যে দেখিয়া চিঠিগুলি লইয়া গিয়াছে। সে যাহাই হউক, নিশ্চয়ই তাহা তাহার ঘোরতর বিরুদ্ধে যাইত। নতুবা সে কখনই খুন করিয়া পরদিন পুনরায় সেই বাড়ীতে আসা—এরূপ অসম-সাহসিক কার্য্য করিতে সাহস করিত না।
“আমি মৃদুস্বরে তাঁহার কানে কানে বলিলাম, ‘কে জানে, এখনও সে এখানে লুকাইয়া আছে কি না।’
“না—তাহা নহে। আমি অনেক বিষয়ে ভুল করিতে পারি—কিন্তু এ বিষয়ে ভুল করি নাই। আমি বাড়ীটা বিশেষ তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করিয়াছি; যাহাই হউক, আমরা আবার একবার অনুসন্ধান করিয়া দেখিব, আমরা এতক্ষণ পরে মূল সূত্র ধরিয়াছি, এই সুত্র ধরিয়া কাজ করিলে আমরা নিশ্চয়ই প্রকৃত খুনীকে ধরিতে পারিব। ‘
“এই বলিয়া যোগেন্দ্রবাবু আবার প্রতি ঘর তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান আরম্ভ করিলেন। দরজার পাশে—খাটের নীচে—সিঁড়ির কোণ—তিনি কিছুই বাদ দিলেন না। এমন কি বিছানা সকল ও উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিতে লাগিলেন; আমিও তাঁহার সঙ্গে থাকিয়া সাধ্যানুসারে অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম, কিন্তু কাহাকেও কোথাও দেখিতে পাইলাম না।
“যোগেন্দ্র বাবু বলিলেন, ‘লোকটা যে-ই হউক, তাহার কাছে বাক্সের চাবি ছিল, নতুবা চিঠির বাক্স খুলিয়া চিঠি বাহির করিয়া আবার বাক্স বন্ধ করিয়া পলাইতে পারিত না। ইহাতে বুঝিতে পারা যায় যে, হয় সে এ বাড়ীতে থাকিত, না হয় সৰ্ব্বদাই এ বাড়ীতে আসিত। হিন্দুস্থানীটা বলে সে ভিন্ন আর কোন দাস-দাসী এ বাড়ীতে ছিল না। স্ত্রীলোকের বাড়ীতে একজন দাসী বা পাচিকা ছিল না, ইহা একরূপ অসম্ভব। মেহেরজান মুসলমানী, সে একজন নবাবকে বিবাহ করিয়াছিল, সে যে বেগমের মত থাকিত, তাহা তাহার এই বাড়ীর সাজ-সজ্জা দেখিলেই বুঝিতে পারা যায়; আর সে যে নিজের হাতে রাঁধিয়া খাইত, তাহা কখনই সম্ভবপর নহে; অথচ এই হিন্দুস্থানী লোকটা যে রন্ধন করিয়া দিলে সে খাইত, তাহাও বিশ্বাস করা অসম্ভব।’
“আমি বলিলাম, “তাহা হইলে আপনার বিশ্বাস যে, একজন দাসী বা পাচিকা তাহার বাড়ীতে ছিল।’
“দেবেন্দ্র বাবু অন্ধকারে এই বাড়ীতে প্রবেশ করিয়া এই হিন্দুস্থানী বেহারা ব্যতীত আর কাহাকেও দেখিতে পান নাই, সুতরাং নিশ্চিত করিয়া এখন কিছু বলা যায় না।’
“আপনার কি মনে হয়?’
“আমার মনে হয়, সে রাত্রেই পলাইয়াছিল। দেবেন্দ্র বাবু তাহাই তাহাকে দেখিতে পান নাই।”
“আপনি কি মনে করেন, সে-ই খুন করিয়াছে?’
“কি করিয়া বলিব? তাহার অস্তিত্ব সম্বন্ধেই সন্দেহ এখন রহিয়াছে, বিশেষতঃ তাহার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ এখনও আমরা পাই নাই।’
“সে-ই কি পত্ৰ লইয়া গিয়াছে?’
“তাহাই এখন জিজ্ঞাস্য, সে যদি স্ত্রীলোক হয়, তাহা হইলে সে চিঠি লইবার জন্য সম্ভবতঃ এতদূর ব্যস্ত হইত না। আর যদি পুরুষ হয়, তাহা হইলে হয় ত চিঠির জন্য ব্যস্ত হইত। সে স্ত্রীই হউক, আর পুরুষই হউক, হয় ত অন্য কিছু লইতে আসিয়াছিল, কোন চিঠি বাক্সে আছে কি না দেখিতে গিয়া কয়েকখানা চিঠি আছে, দেখিয়া লইয়া চলিয়া গিয়াছে।’
“তাহা হইলে কিছুই নিশ্চিত হইতেছে না?’
“নিশ্চিত একেবারে কিরূপে হয়? এরূপ ব্যাপারে অনুমানই পরে নিশ্চিত হইয়া দাঁড়ায়, এখন আমাদের অনুসন্ধানের ভিত্তিই অনুমান।’
“এখন দেখা যাইতেছে, তিনজনের উপরে সন্দেহ আসিতেছে।’
“যোগেন্দ্র বাবু আমার মুখের দিক চাহিয়া রূঢ়ভাবে বলিলেন, ‘কে—সে?’
“আমি বিনীতভাবে বলিলাম, ‘দেবেন্দ্র বাবুর কথা বিশ্বাস করিলে, কুমারের উপরই সন্দেহ হয়।’
“তাহার পর?’
“আপনার কথা যদি সত্য হয়, তাহা হইলে এই বেহারা নবাবের তরফ হইতে এখানে মেহেরজানের পাহারায় ছিল; তাহার উপরে নবাবের হুকুমই ছিল যে, মেহেরজান যদি অপরের সহিত আলাপ করে, তাহা হইলে তাহাদের উভয়কে খুন করিবে। রাজা গুণেন্দ্রপ্রসাদের সহিত মেহেরকে প্রেমালাপ করিতে দেখিয়া সে উভয়কেই খুনি করিয়াছে।’
“বেশ—উকিল হইতে পারিবেন। তাহার পর?’
“তাহার পর আপনার এই দাসী বা পাচিকা, নিশ্চয়ই সে মুসলমানী। তাহার বিরুদ্ধে বিশেষ কোন প্রমাণ দেখিতেছি না।’
“এইবার হারিলেন, সে পুরুষ হইতেও পারে।’
“মানিলাম সে পুরুষ, তাহার খুন করিবার উদ্দেশ্য কি—বিনা কারণে বিনা উদ্দেশ্যে কেহ খুন করে না।’
“আপনিই উদ্দেশ্য ভাবিয়া বলুন।’
“আমি ত কিছুই ভাবিয়া পাইতেছি না।’
“তবে আমি বলি।’
“বলুন।’
যোগেন্দ্র বাবু গম্ভীরমুখে বলিলেন, ‘এই তিনজন ছাড়া আরও অন্য দুইজনের উপরে সন্দেহ করিবার গুরুতর কারণ আছে।’
“আমি অতিমাত্র বিস্মিত হইয়া বলিয়া উঠিলাম, ‘আরও দুইজন! কে তাহারা?”
“যোগেন্দ্র বাবু মৃদু হাসিয়া বলিলেন, “কিছু কি মনে হয় না?’
যোগেন্দ্র বাবু গম্ভীরভাবে বলিলেন, ‘তবে শুনুন। প্রথমে এই দাসী বা পাচিকার উদ্দেশ্যে বলি—সংসারে অনেকরূপ অদ্ভুত ঘটনা ঘটিতেছে।’
“কি উদ্দেশ্য বলুন।’
“রাজা অনেক দিন হইতে মেহেরজানের নিকট আসিতেন, এই সুপুরুষ রাজাকে যে দাসী ভালবাসিবে, তাহাতে কি বিস্মিত হইবার কিছু আছে?”
“আমি বাধ্য হইয়া স্বীকার করিলাম, ‘না—অসম্ভব নহে।’
“যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, ‘বেশ এ অবস্থায় দাসী ঈর্যায় উন্মত্তা হইয়া যে মেহেরজান ও রাজা উভয়ের বুকে ছোরা বসাইবে—ইহা কি নিতান্ত অসম্ভব? এ রকম ঘটনা বহু বহু ঘটিয়াছে, তাহা কি শুনেন নাই। স্ত্রীলোক ভালবাসায় বিফলমনোরথ হইলে যে রাক্ষসী হয়, তাহা কি জানেন না?
“আমি ইহার কোন উত্তর দিতে পারিলাম না, নীরব রহিলাম। প্রকৃতই এরূপ ঘটনা সচরাচর ঘটে।
“যোগেন্দ্র বাবুও নীরবে রহিলেন। তিনি কোন কথা কহেন না দেখিয়া আমি বলিলাম, ‘আর যদি সে পুরুষ হয়?’
‘যোগেন্দ্র বাবু মৃদু হাসিলেন, বলিলেন, ‘ইহাও কি আমায় বলিতে হইবে?’ “বলুন, আমি ত কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না।’
“যোগেন্দ্র বাবু বলিলেন, ‘যেটা বলিলাম, সেইটাই উল্টাইয়া লউন না কেন? মনে করুন, সে পুরুষ মেহেরজানকে ভালবাসিত, এমন সুন্দরীকে ভালবাসা স্বাভাবিক, আবার ইহাও স্বাভাবিক যে, তাহাকে রাজার সহিত প্রেমালাপ করিতে দেখিয়া ক্রোধে উন্মত্ত হইয়া উভয়কেই সে খুন করিয়া এখান হইতে পলাইয়াছে।’
“আমি বলিলাম, ‘এ অনুমান মাত্র—প্রমাণ নাই।’
‘যোগেন্দ্র বাবু ভ্রুকুটি করিয়া বলিলেন, “কাহারও বিরুদ্ধেই এখন কোন প্রমাণ নাই। তাহাই যদি না হইবে, তাহা হইলে আমাদের এত আলোচনা করিবার আবশ্যক কি?’
“আমি বলিলাম, ‘যাহাই হউক, আপনি আর দুজনের কথা বলিয়াছেন।’
“যোগেন্দ্র বাবু বলিলেন, ‘এই চিঠি অন্তৰ্দ্ধানের জন্যই আর দুইজনের উপরে সন্দেহ হইতেছে।’
“কেন—তাহারা আবার কে?’
“এই দাসী বা চাকর যে চিঠি লইবার জন্য ব্যস্ত হইবে, তাহা বোধ হয় না। চাকর-বাকরের চিঠির সঙ্গে বড় সম্বন্ধ থাকে না।’
“এইজন্য আপনি বলিতে চাহেন যে, এখানে কোন ভদ্রলোক সে সময়ে উপস্থিত ছিলেন? “খুব সম্ভব—এইজন্যই আরও দুজনের উপরে সন্দেহ করিতেছি।’
“তাহারা কে?’
“প্রথম—নবাব।’
“তিনি লাক্ষ্ণৌতে—ডাকওয়ালা বলিল যে, সে আজ সকালে লাক্ষ্ণৌর ডাকমার্কা চিঠি বাক্সে ফেলিয়া গিয়াছিল।’
“তাহা সত্য, কিন্তু তাহা হইলে কি তাঁহাকে এখানে খুনের রাত্রে থাকিতে নাই?’
“যাহার চিঠি আজ সকালে এখানে পৌঁছিয়াছে, তিনি কিরূপে এখানে চিঠির আগে উপস্থিত হইবেন?’
“ইহা কি একেবারেই অসম্ভব?’
“আমার ত তাহাই মনে হয়।’
“যাহা মানুষের মনে হয়, তাহা হইতে ঘটনা অনেক সময় উল্টা হয়। বিশেষতঃ এ সকল বিষয়ের বিপরীত দিক দিয়া না আসিলে যথাস্থানে পৌঁছান যায় না।’
“বুঝিতে পারিলাম না। ‘
“মনে করুন, তাঁহার গুণবতী ভার্যার উপরে নবাবের সন্দেহ হইয়াছিল, তাহাই তাহাকে ধরিবার জন্য তাহার অজানিতভাবে এখানে হঠাৎ আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল।’
“চিঠি?’
“যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, ‘চিঠিও ঐ জন্য। পাছে তিনি আসিবেন, এরূপ সন্দেহ করে বলিয়া নবাব খান-কতক চিঠি লিখিয়া লক্ষ্ণৌয়ে কাহারও নিকটে রাখিয়া কলিকাতায় রওনা হন; নবাবের আদেশমত সে প্রত্যহ এক-একখানা চিঠি ডাকে ফেলিয়া দিত। এখানে তাঁহার স্ত্রী তাঁহার পত্র পাইয়া নিশ্চিন্ত—নিশ্চিন্তভাবে এখানে প্রেমে মগ্ন ছিল, এমন সময়ে নবাবের আবির্ভাব—গৃহমধ্যে রাজা ও মেহেরজান—এই যুগলমিলন দৃশ্য দেখিয়া নবাব যে উভয়কেই হত্যা করিবেন, ইহাতে আশ্চৰ্য্য কি!’
“আমি বলিলাম, “ইহা খুব সম্ভব। এখন নবাব যে কলিকাতায় পৌঁছিয়াছেন, আর তিনি রাত্রে মেহেরজানের গৃহে উপস্থিত হইয়াছিলেন, ইহা সপ্রমাণ করিতে পারিলেই খুনী যে কে, সে বিষয়ে আর কোন সন্দেহ থাকিবে না।’
“যদি নবাব নিশ্চয়ই আসিয়া থাকেন, তবে তাহার প্রমাণ সংগ্রহ করাও কঠিন হইবে না। “আমার বিশ্বাস, তিনিই খুন করিয়াছেন। কুমার আনন্দপ্রসাদ কখনই খুন করে নাই, এ কথা আমি খুব জোর করিয়া বলিতে পারি। বেহারাটা বা দাসী বা অন্য চাকরের বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই। যদি কেহ খুন করিতে পারে—তবে এই নবাব। তিনিই নিশ্চয়ই খুন করিয়াছেন।’
‘যোগেন্দ্র বাবু হাসিয়া বলিলেন, ‘দেখিতেছেন—যতক্ষণ নিশ্চিত প্রমাণ না পাওয়া যায়— ততক্ষণ কুমার, বেহারা, দাসী ও নবাব, ইহাদের উপরেই গুরুতর সন্দেহ করিতে পারা যায়। তবে ইহাদের মধ্যে কে খুন করিয়াছে—ইহাই জিজ্ঞাস্য; তাহাই স্থির করা আমার কার্য্য। আসুন, দেখা যাক, বাড়ীর কোন স্থানে আর কোন চিঠি পাওয়া যায় কি না—এ কথা আমার পূর্ব্বেই মনে হওয়া উচিত ছিল।’
“তিনি আবার ব্যগ্রভাবে ঘরে ঘরে অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইলেন, কিন্তু আর কোন চিঠি-পত্ৰ পাওয়া গেল না।
“তিনি হতাশভাবে বলিলেন, ‘দেখিতেছি, এই গুণবতী নিজের স্বামীর পত্রও যত্নে রাখিতেন না। খুব সম্ভব, সবগুলিই ভস্মীভূত করিয়াছেন। নতুবা একটু-না-একটু চিঠির চিহ্নও দেখিতে পাওয়া যাইত। চলুন—এখন প্রথম চেষ্টা, বেহারাটাকে লইয়া দেখি। সে খুন না করিলেও কে করিয়াছে, তাহা নিশ্চিত জানে, নতুবা সে কখনই এরকম মুখ বন্ধ করিয়া থাকিত না।’
“আমি কোন কথাই কহিলাম না, এই মহা রহস্যের কোনই ভাব বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। কুমার আনন্দপ্রসাদের বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ না পাইলেই আমি সন্তুষ্ট।
“আমরা বাড়ী হইতে বাহির হইলাম। যোগেন্দ্রনাথ বাড়ীর বাহিরটা বিস্ফারিত নয়নে দেখিতেছিলেন, সহসা লম্ফ দিয়া উঠিলেন। আমি বিস্মিত হইয়া বলিয়া উঠিলাম, ‘ব্যাপার কি?’ “যোগেন্দ্র বাবু ছুটিয়া বাড়ীর দরজার পার্শ্ব হইতে কি কতকগুলো কাগজ তুলিয়া লইলেন। আমি বলিলাম, “কি কাগজ পাইলেন—ব্যাপার কি?’
যোগেন্দ্র বাবু কোন কথা কহিলেন না, কাগজগুলি তিনি অত্যন্ত মনোযোগের সহিত দেখিতেছেন। আমি আবার বলিলাম, ‘ব্যাপার কি?’
“এবার তিনি কথা কহিলেন; বলিলেন, ‘দেখিতেছেন—তিনখানা চিঠি, পড়িবার জন্য খোলা পৰ্য্যন্তও হয় নাই, মাঝখানে ছিঁড়িয়া কেহ ফেলিয়া দিয়া গিয়াছে—সব আজিকার ডাক-মার্কা দেওয়া, এইগুলিই আজ আসিয়াছিল, সুতরাং এখন বুঝিতে পারা যাইতেছে, সে লোক যে-ই হউক, সে চিঠির জন্য আসে নাই। তাহা হইলে চিঠি এরূপে ছিঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়া যাইত না—অন্য কিছুর জন্য আসিয়াছিল।’
“আমি বলিলাম, “নবাব বা অন্য কোন ভদ্রলোক হইলে এরূপ ভাবে পত্র কখানা ছিঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়া যাইত না।’
“যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, ‘হাঁ—একথা ঠিক। সেইজন্য বলিতেছি যে, এ দাসীর কাজ। বোধ হইতেছে, সে খুনের রাত্রে এ বাড়ীতে ছিল না, পরদিন সকালে আসিয়াছিল। আসিয়া বাড়ীতে ভয়াবহ কাজ হইয়াছে দেখিয়া পলাইয়াছে। সে-ই বাক্স খুলিয়া প্রত্যহ চিঠি লইত, সেইজন্যই সৰ্ব্বদা তাহার কাছেই চিঠির বাক্সের চাবি থাকিত। অভ্যাসবশতঃ বাক্স খুলিয়া তিনখানা চিঠি বাহির করিয়া লইয়াছিল, তাহার পর চিঠির মালিক আর নাই দেখিয়া—এ চিঠির আর কোন প্রয়োজন নাই ভাবিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিয়া এখান হইতে চলিয়া গিয়াছে।’
“ইহাই সম্ভব—চিঠি কাহার?’
“চলুন থানায় দেখিবেন, এখন খুনী ধরিতে আর অধিক বিলম্ব হইবে না।’
“আমার কৌতূহল আরও বৃদ্ধি পাইল; আমি বলিয়া উঠিলাম, ‘তাহা হইলে খুনী স্থির হইয়াছে?’
“যোগেন্দ্রবাবু বিস্মিতভাবে কেবলমাত্র বলিলেন, ‘চলুন থানায়।’
“আমি কিছু হতাশ হইলাম; বুঝিলাম, তিনি এখন কিছুতেই বলিবেন না, অগত্যা আমি নীরব থাকিতে বাধ্য হইলাম।
“আমরা থানার দিকে যাইতেছি, কেবল কয়েক পদ অগ্রসর হইয়াছি মাত্র, এই সময়ে যোগেন্দ্ৰ বাবু পূর্ব্বের ন্যায় আবার সোৎসাহে লম্ফ দিয়া উঠিলেন, পরে ব্যগ্রভাবে পথিপার্শ্বস্থিত নৰ্দ্দমা হইতে কি একটা কুড়াইয়া লইলেন। আমি দেখিলাম, সে একখানি রক্তাক্ত রুমাল। তিনি সেই রুমাল খানি একবারমাত্র দেখিয়া নিজের পকেটে রাখিলেন, সহাস্য বদনে বলিলেন, ‘ভগবান্ এবার আমার উপরে বিশেষ অনুকূল, যেটুকু বাকী ছিল, তাহাও মিলিয়াছে।”
“আমি বলিলাম, ‘দেখিতেছি, রুমালখানা রক্তমাখা।’
“যোগেন্দ্র বাবু মৃদু হাসিয়া বলিলেন, ‘হাঁ—গুণধর খুন করিয়া রক্তমাখা হাত এই রুমালে মুছিয়াছিলেন। পাপীরা পাপকার্য্যে কত বুদ্ধিপ্রকাশ করে, আবার সময়ে সময়ে কত গলদ করিয়া ফেলে! এই দেখুন না, নামলেখা রুমালখানায় হাত মুছিয়া এইখানে ফেলিয়া গিয়াছে।’
“আমি বিস্মিত হইয়া বলিয়া উঠিলাম, ‘নাম লেখা! কাহার নাম?’
“যোগেন্দ্র বাবু গম্ভীরমুখে বলিলেন, “থানায় চলুন, সকলই জানিতে পারিবেন।’
“কৌতূহলে আমি আপাদমস্তকপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছিলাম; কিন্তু কি করি, যোগেন্দ্র বাবুর ভাবে বুঝিলাম, তিনি কিছুতেই বলিবেন না, অগত্যা আমি নীরবে তাঁহার সঙ্গে চলিলাম।।
“থানায় আসিয়া তিনি সেই বেহারাকে মহা তম্বি করিতে লাগিলেন, সে-ই খুন করিয়াছে, তাহার বিরুদ্ধে যে প্রমাণ আছে, তাহা তাহাকে সুস্পষ্ট বুঝাইয়া দিলেন। এমন ভাবে বুঝান হইল যে, সে বুঝিল, তাহার ফাঁসী অবশ্যম্ভাবী, তাহার রক্ষা পাইবার আর আশামাত্রও নাই।
“তখন সে নিতান্ত ভীত হইয়া পড়িল, কাতর যোগেন্দ্র বাবুর দুই পা জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিয়া বলিল, ‘দোহাই হুজুর—আমি খুন করি নাই।’
“যোগেন্দ্রনাথ কঠোরস্বরে বলিলেন, ‘কেবল খুন করি নাই বলিলে জজে শুনে না। কে খুন করিয়াছে, তুই জানিস্; যদি ফাঁসী যাইতে না চাস্ ত, সব খুলিয়া বল।’
“সে ব্যাকুল হইয়া বলিল, ‘হুজুর, সব বলিব।’
“যোগেন্দ্র বাবু বলিলেন, ‘এতক্ষণ বলিলে আমাদের এত কষ্ট পাইতে হইত না।’
“অনেক নিমক খাইয়াছি।’
“এখন বল্, বেটা!’
“রাজা বাহাদুর আসিবার পর তাঁহার ভাই আসেন, তিনি রাজার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা কহিয়া চলিয়া যান, তাহার একটু পরে বিবি সাহেবের বাবু আসেন, তিনি বিবি সাহেব ও রাজাকে একত্রে দেখিয়া দুইজনকেই খুন করেন। আমি দেখিলাম যে, আমি ইহা দেখিয়াছি, জানিলে তিনি আমাকে ও খুন করিবেন, তাহাই নেশার ভাণ করিয়া পড়িয়া রহিলাম। তিনি চলিয়া গেলে বাড়ী হইতে পলাইলাম। হুজুর, আমি আর কিছুই জানি না।’
“আমি ব্যগ্র হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘সেই বাবুর নাম কি?”
“যোগেন্দ্র বাবু আমার হাত ধরিয়া টানিয়া বলিলেন, ‘তাহা আমরা জানি, আসুন।’
“অন্য গৃহে আনিয়া তিনি আমার হাতে একখানি ছিন্নপত্র দিলেন, আমি জোড়া দিয়া পড়িলাম;–‘আজ নবাব আসিবে, তুমি কিছুতেই আসিও না। তোমার মেহেরজান।’
“যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, ‘দেখিতেছেন, রাজাকে ডাকিয়াছিল, বলিয়া গুণবতী বাবুটিকে আসিতে বারণ করিয়া পাঠাইয়াছিল।’
“সে চিঠি বাক্সে আসিল কিরূপে?’
“দাসীর ভুলে, সে বাক্সে চিঠিখানা রাখিয়া দিয়াছিল; ভাবিয়াছিল, যাইবার সময়ে লইয়া যাইবে। কিন্তু যাইবার সময় সে একবারে চিঠির কথা ভুলিয়া গিয়াছিল, তাহাতেই বাবু আদৌ চিঠি পান নাই, যথাসময়ে বাবু আসিয়া উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, রাজা ও মেহেরজান একত্রে, তখন এ অবস্থায় এ সকল লোক যাহা করে, তাহাই করিয়াছিল—দুজনকেই খুন করিয়াছিল।’
“তাহার প্রমাণ কোথায়?’
“প্রমাণ এই, বলিয়া যোগেন্দ্রনাথ রক্তমাখা রুমালের একটা কোণ আমার সম্মুখে ধরিলেন; তাহাতে এক ব্যক্তির নাম লেখা।
“আমি বলিলাম, ‘এই লোকই যে সেই লোক—তাহার প্রমাণ কি?’
“তাহার প্রমাণ এই।’
“যোগেন্দ্রবাবু একখানি নাম দেখাইলেন, দুই নামই এক। আমার মুখ শুখাইয়া গেল। যোগেন্দ্র বাবু গম্ভীরভাবে বলিলেন, “আর কোন প্রমাণ আবশ্যক আছে, আর কি মহাপাপী ফাঁসী-কাঠে ঝুলিবে না?”
এই বলিয়া তিনি নীরব হইলেন।
.
তখন আর সকলেই মহা ব্যগ্রভাবে বলিয়া উঠিলেন, “লোকটা কে—তাহার নাম কী— কোথায় থাকে?’
তিনি নীরব।
এবার দাদা মহাশয়ও বিচলিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “চুপ করিয়া রহিলেন কেন? সে কে?”
তখন তিনি ধীরে ধীরে উঠিয়া দাঁড়াইয়া, অতি ভয়াবহ গম্ভীরভাব ধারণ করিয়া বলিলেন, ‘বলিতে কষ্ট হয়, যিনি প্রথমে মৃতদেহের কথা পুলিসকে জানাইয়াছিলেন, তাঁহারই এই কাজ। এই দেবেন্দ্ৰ বাবুই এই দুই খুন করিয়াছেন, রুমালে ও চিঠির খামে তাঁহারই নাম পাওয়া গিয়াছে।
“ইনি!” বলিয়া দাদা মহাশয় অনেকখানি সরিয়া গিয়া বিস্ফারিত নয়নে দেবেন্দ্রনাথের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন।
দেবেন্দ্রনাথ উচ্চহাস্য করিয়া বলিলেন, “বহুৎ আচ্ছা! সত্যই আমি বুঝিতে পারি নাই যে, শেষে তুমি আমার ঘাড়েই এই খুনটা চাপাইবে। তুমি যদি ডিটেকটিভ উপন্যাস লিখিতে আরম্ভ কর, তাহা হইলে শক্তিশালী, ডিটেকটিভ ঔপন্যাসিক পাঁচকড়ি বারুকেও তোমার কাছে হার মানিতে হইবে।’
যিনি মধ্যে হীরক-হার চুরির গল্প বলিয়াছিলেন, তিনি বলিলেন, “এ গল্পই নহে। এরূপ প্রমাণে কখন কাহারও ফাঁসী হয় না। আমার গল্প সম্ভবতঃ ঘটিতে পারে—তোমার একেবারেই না।”
নিজেদের মধ্যে যুবকেরা এমন উত্তেজিতভাবে এইরূপ কথা কাটাকাটি করিতে লাগিলেন যে, তাহা সকলে ক্ষণেকের জন্য দাদা মহাশয়ের অস্তিত্ব ভুলিয়া গিয়াছিল। দাদা মহাশয় মহাবিরক্ত হইয়া বলিলেন, “কি মুস্কিল! এ কি বিদ্রূপনা তোমরা সকলে পাগল হইয়াছ?”
উকিল বাবু মস্তক কণ্ডূয়ন করিতে করিতে বলিলেন, “আপনি ডিটেকটিভ উপন্যাস অত্যন্ত ভালবাসেন, তাহাই—তাহাই—একটা ডিটেকটিভ গল্প আপনাকে শুনাইতেছিলাম। এটা কি আপনার প্রখ্যাতনামা পাঁচকড়ি বাবুর ডিটেকটিভ উপন্যাসের অপেক্ষা কোন রকমে নিকৃষ্ট?”
বৃদ্ধ ভ্রুকুটি করিয়া বলিলেন, “তোমরা এখন বলিতে চাও যে, ইহার কিছুই সত্য ঘটে নাই রাজা গুণেন্দ্রপ্রসাদ প্রকৃত খুন হন নাই?”
উকিল বাবু অধিকতর মস্তক কণ্ডূয়ন করিতে করিতে বলিলেন, “অধীন গুণেন্দ্রপ্রসাদ আপনার সম্মুখে—আমিই গুণেন্দ্রপ্রসাদ।”
বৃদ্ধ ভৃত্যকে ডাকিয়া বলিলেন, “গাড়ির ভাড়া দিয়া বিদায় করিয়া দেও, রাত হইয়া গিয়াছে, আজ আর আমি উমেশের ওখানে নিমন্ত্রণে যাইব না।”
বন্ধু চতুষ্টয়ে পরস্পরে পরস্পরের মুখের দিকে চাহিলেন।
বৃদ্ধের প্রিয়তম পৌত্র পরেশচন্দ্র থামিয়া থামিয়া, ঢোঁক গিলিয়া বলিলেন, আপনার–আপনার—আজ রাত্রে–দাদা মশাই— “
মধ্যপথে বাধা দিয়া দাদা মহাশয় বলিলেন, “আজ রাত্রে কি?”
পরেশচন্দ্র বলিলেন, “চন্দননগরের বাগারে আপনার যাবার কথা ছিল।”
বৃদ্ধ বলিলেন, “কে বলিল? স্বপ্ন দেখিলে নাকি! রাত্রে উমেশের বাড়ী আমার নিমন্ত্রণ ছিল, কেবল তোমার বন্ধুদের গল্পে যাওয়া হইল না, তাহাতে আমি বিশেষ দুঃখিত হই নাই—সময়টা ভালই কাটিয়াছে।”
আবার বন্ধুগণ পরস্পরের মুখের দিকে পরস্পরে চাহিল।
বৃদ্ধ বলিলেন, “রাত্রি হইয়াছে, আর রাত জাগা চলে না—এখন বাড়ীর ভিতরে যাওয়াই ভাল।” তাহার পর রাজা গুণেন্দ্রপ্রসাদের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “আপনার গল্পটি বেশ–মন্দ নহে, আর রমেশকে নির্দ্দেশ করিয়া ইহার কণ্ঠহার চুরি খুব ভাল নহে। (দেবেন্দ্রের প্রতি) আপনার গোড়াপত্তন অন্ধকার রাত্রি—শূন্য বাড়ী—দুই দুইটা মৃতদেহ—সুন্দর। যাহা হ’ক, পাছে আপনারা এই রাত্রে অনর্থক কষ্ট পান, এত আনন্দ আপনাদের কাছে পাইরা, সেটা করিতে দেওয়া আমার পক্ষে ভাল নহে। এইখানা পড়ুন। পড়িলেই বুঝিতে পারিবেন, আপনাদেরই ‘ঠিকে ভুল’ হইয়াছে।”
এই বলিয়া তিনি একখানা টেলিগ্রাম তাহাদের সম্মুখে ফেলিয়া দিয়া বাড়ীর ভিতরে যাইবার জন্য উঠিলেন। দ্বারের কাছে গিয়া ফিরিয়া পৌত্রকে বলিলেন, “পরেশ, তোমার জিনিষ-পত্র কিছু নষ্ট হবে না, সব এখানে পাঠাইয়া দিতে হুকুম দিয়াছি।”
টেলিগ্রামে লিখিত রহিয়াছে;–
“হুকুম মত তাঁহাদের বাগানে প্রবেশ করিতে দিই নাই—সকলকে তাড়াইয়া দিয়াছি, দ্রব্যাদি কাল সদরে পাঠাইয়া দিব।”
বন্ধুচতুষ্টয় পরস্পরের দিকে চাহিয়া নীরব-নিস্তব্ধ—নিস্পন্দ।
দাদা মহাশয় তখন বাড়ীর ভিতরের ত্রিতলের সোপানবলীতে পাদবিক্ষেপ করিতেছেন।
উপসংহার
ব্যাপারটা এই;
বৃদ্ধ রামসদয় বাবু জন কোম্পানীর বাড়ীর মৎসুদ্দী—অগাধ টাকার মালিক। তাঁহার একমাত্র পুত্র, একটি পুত্র রাখিয়া অকালে কালগ্রাসে পতিত হইয়াছিলেন। সেই পৌত্র পরেশচন্দ্র—পরেশ বৃদ্ধের নয়নের মণি।
তাহাই বলিয়া বিচক্ষণ রামসদয় বাবু আদর দিয়া তাহার মস্তক ভক্ষণ করেন নাই। তাহাকে প্ৰাণ অপেক্ষা ভালবাসিতেন সত্য, কিন্তু তাহার উপরে তাঁহার শাসনও অতিশয় কঠোর ছিল। এখন পরেশচন্দ্র সুশিক্ষিত হওয়ায় রামসদয় বাবু তাহাকে লক কোম্পানীর আফিসে মুৎসুদ্দী করিয়াছেন।
রামসদয় বাবু অতি হিসাবী লোক ছিলেন, তাঁহার বাজে খরচ একেবারেই ছিল না; তবে তাহার একমাত্র সখ ছিল—বাগানের। তিনি বহু অর্থব্যয় করিয়া চন্দন-নগরে গঙ্গার তীরে একখানি সুন্দর বাগান-বাড়ী নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন। তিনি এই বাগানকে এতই ভালবাসতেন যে, নিতান্ত বন্ধু না হইলে কাহাকেও সঙ্গে লইয়া যাইতেন না। তাঁহার অনুপস্থিতিতে কাহারই বাগানে যাইবার হুকুম ছিল না, এমন কি প্রিয়তম পৌত্র পরেশেরও নহে।
পরেশ বাবুর চাকরী হইলে তাহার বন্ধুগণ একটা উচ্চশ্রেণীর ভোজের জন্য তাহাকে ধরিয়া বসিল। কেবল ইহাই নহে, সকলেই তাহাদের বাগানের প্রশংসা শুনিয়াছিল, কিন্তু কেহই দেখে নাই; নিদয় রামসদয় বাবু কাহাকেই তাঁহার সঙ্গে ব্যতীত বাগানে প্রবেশ করিতে দিতেন না। বাগানের সরকার ও দ্বারবানের উপরে এ সম্বন্ধে বিশেষ হুকুম দেওয়া ছিল।
পরেশচন্দ্র বলিল, “দাদা মহাশয়ের শীঘ্রই দিন-কয়েকের জন্য বরাকরে আমাদের কয়লার খনি দেখিতে যাইবার কথা আছে; তিনি চলিয়া গেলেই একদিন বাগান-ভোজ করা যাইবে।”
এক শনিবার তাঁহার রাত্রের গাড়িতে বরাকরে যাইবার সকলই স্থির হইল। সুবিধা বুঝিয়া প্রাতে পরেশচন্দ্র স্বয়ং চন্দননগরে গিয়া সরকারকে সকল দ্রব্যাদি কিনিতে বলিল। পূর্ব্বেই বন্ধুদিগের নিমন্ত্ৰণ হইয়া গিয়াছিল।
সরকার একটু ইতস্ততঃ করিয়া বলিল, “বাবু—বাবু—”
পরেশচন্দ্র তাহার পিঠ চাপড়াইয়া বলিল, “কোন গোল হয়, সে দায় আমার।”
পরেশচন্দ্র উপস্থিত থাকিয়া সমস্ত দ্রব্যাদি ক্রয় করাইল এবং রন্ধনের বন্দোবস্তের সকল আয়োজন ঠিক করিয়া গৃহে ফিরিল।
সরকার মহাশয় রামসদয় বাবুর সংসারে বৃদ্ধ হইয়াছেন, তিনি এ ব্যাপারটা বড় ভাল বুঝিলেন না। বাবুর নিকটে এ কথা না জানাইলে তাঁহার এত দিনের চাকরীটুকু যাইবে, তিনি রামসদয় বাবুকে বিলক্ষণ চিনিতেন। তাহাই তিনি গোপনে একজন মালীকে দিয়া রামসদয় বাবুর নিকটে বরাবর তাঁহার অফিসে এক পত্র লিখিলেন।
সেই মালীর নিকটেই রামসদয় বাবুর উত্তর আসিল, “পরেশ বাবুই হউন, আর স্বয়ং ভগবানই হউন, কাহাকেও বাগানে ঢুকিতে দিও না—দূর করিয়া দিবে। জিনিষ-পত্র সব বাড়ীতে পাঠাইবে। তাহাদের তাড়াইয়া আমাকে তখনই টেলিগ্রাফ করিবে।”
বৈকালে আফিস হইতে ফিরিয়া আসিয়া রামসদয় বাবু বাড়ীতে প্রবেশ করিলেন, বলিলেন, “শরীর তত ভাল নহে, দিন কত আর বরাকরে যাইব না। আজ সাড়ে নয়টার গাড়ীতে বাগানে যাইব, সোমবারে ফিরিব।”
বলা বাহুল্য, এ সংবাদে পরেশচন্দ্রের মস্তকে সহসা বজ্রাঘাত হইল। এখন আর বাড়ী-বাড়ীতে গিয়া বন্ধুগণকে নিষেধ করা অসম্ভব, সে সময়ও এখন আর নাই। বন্ধুগণ—সকলেই সন্ধ্যার গাড়ীতে রওনা হইবে। এখন উপায় কি?
শেষে উপায় স্থির হইল, যে কোন গতিকে দাদা মহাশয়কে আজ রাত্রে কিছুতেই বাগানে যাইতে দেওয়া হইবে না। এগারটায় শেষ গাড়ী—এগারটা পর্য্যন্ত তাঁহাকে এখানে আটকাইয়া রাখিতে পারিলে আর তিনি রাত্রে যাইতে পারিবেন না; সকালেই তাহারা সকলে বাগান হইতে পলাইতে পারিবে। বোধ হয়, ত্রিসংসারে পরেশচন্দ্রের মত এমন সঙ্কটে আর কেহ কখনও পড়ে নাই। কিন্তু কিরূপে দাদা মহাশয়কে আটক করা যায়?
একমাত্র উপায় আছে। তাহার দাদা মহাশয় খুন প্রভৃতির গল্প শুনিতে ও ডিটেকটিভ উপন্যাস পড়িতে অত্যন্ত ভালবাসেন। ইহা পাইলে আর সকল কথাই তিনি ভুলিয়া যান, এই উপায়ে–
তাহা এইরূপ কৌশলে গল্প বলিয়া রাত্রি এগারটা পর্য্যন্ত যদি তাঁহাকে আটকাইয়া রাখিতে পারা যায়, হইলে এই সঙ্কটে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।
এই মহা বিপদে পরেশচন্দ্র তাহার পরম বন্ধু রাজা গুণেন্দ্রপ্রসাদের বাড়ীর দিকে ছুটিল। সেখানে দেবেন্দ্রনাথ ও রমেশচন্দ্রের সঙ্গে তাহার দেখা হইল; তাহারা চন্দননগরে রওনা হইবার জন্য প্রস্তুত হইতেছিল।
পরেশচন্দ্রের ব্যাকুল ভাব ও বিবর্ণ মুখ দেখিয়া তাহারা সবিস্ময়ে বলিয়া উঠিল, “ব্যাপার কি হে?”
বিপন্ন পরেশচন্দ্র বন্ধুদিগকে সকল কথা বলিল। শুনিয়া তাহারা সকলেই বলিয়া উঠিল, “কি সৰ্ব্বনাশ! তবে এখন উপায়?”
তখন যে উপায় আছে, তাহাও পরেশচন্দ্র বলিল। শুনিয়া দেবেন্দ্রনাথ বলিল, “আমি সময়ে সময়ে মাসিকপত্রে গল্প লিখিয়া থাকি, একটা ভয়ানক খুনের গল্প বলিতে প্রস্তুত আছি; কিন্তু গল্প ছোট হইবে, তাহাতে ততখানি সময় কাটা দায়। বড় গল্পে আমার হাত নাই।”
রমেশ বলিল, “আমি তোমার সহায় হইব, মাসিকপত্রে গল্পলেখা আমার অভ্যাস না থাকিলেও অন্ততঃ আমি একটা গল্প বলিয়া কোন রকমে আধ ঘণ্টা কাটাইতে পারিব।”
রাজা গুণেন্দ্রপ্রসাদ হাসিয়া বলিলেন, “তাহার পরও যদি সময় থাকে, সে ভার আমার থাকিল। সৌভাগ্যের বিষয়, তোমার দাদা মহাশয় আমাদের চিনেন না।”
দেবেন্দ্রনাথ একটা খুব লম্বা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, “এমন ভোজটা ফাঁকে গেল হে? হা অদৃষ্ট!”
পরেশচন্দ্র কাতরভাবে বলিল, “কিন্তু আর একটা কথা হইতেছে, সেখানে এ সময়ে কে তাহাদের অভ্যর্থনা করিবে?”
গুণেন্দ্রপ্রসাদ বলিলেন, “ভয় নাই, আমরাও পৌঁছিব। আমার ‘স্টীমলঞ্চ ‘ ঠিক করিয়া রাখিতে এখনই হুকুম দিতেছি। সাড়ে এগারটায় ছাড়িলেও সাড়ে বারটার আগে গিয়া পৌঁছিব। ততক্ষণ সকলকে সেখানে অভ্যর্থনা করিবার জন্য আমার সেক্রেটারীকে এখনই পাঠাইয়া দিতেছি। তাহাকে বলিয়া দিলেই হইবে যে, আমরা বিশেষ কোন কারণে আটক পড়িয়াছি, একটু বেশি রাত্রে পৌঁছিব। মনে করিলাম, এতদিন পরে দেশে ফিরিলাম, আজ একটু আমোদ করিব, মাঝে হইতে কি মুস্কিলের ব্যাপার দেখ!”
যাহা হউক, এইরূপ বন্দোবস্তই হইল। আহিরীটোলার ঘাটে রাজার ‘স্টীমলঞ্চ ‘ ধুম উদগীরণ করিতে লাগিল। সেক্রেটারী তৎক্ষণাৎ চন্দননগরে রওনা হইল; তাহারা চারিজন বন্ধুতে মিলিয়া রামসদয় বাবুর বাড়ীতে উপস্থিত হইয়া তাঁহার বসিবার ঘরের পাশের ঘরেই আড্ডা লইল। তাহার পর যাহা যাহা হইয়াছে, আমরা অবগত আছি।
* * * *
যাহা হউক, এদিকে দাদা মহাশয় অন্তঃপুরে অন্তর্হিত হইলে, টেলিগ্রামখানা পড়িয়া কতকক্ষণ বন্ধুগণ স্তম্ভিতপ্রায় বসিয়া ছিল, তাহা তাহারা কেহই জানিতে পারিল না। অবাঙ্গুখে পরস্পর পরস্পরের মুখ নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। ক্ষণপরে প্রথমে রাজা গুণেন্দ্রপ্রসাদ গৃহের সেই একান্ত নিস্তব্ধতা ভেদ করিয়া উচ্চহাস্য করিয়া উঠিলেন; বলিলেন, “বুড়োর সঙ্গে চালাকি, বাবা! আমরা ভাবিতেছি, তাঁহাকে আটকাইয়া রাখিয়াছি, বকিয়া মরিতেছি, আর তিনি পরম নির্বিঘ্নে বিনামূল্যে আমাদের কাছে মজার ডিটেকটিভ উপন্যাস শুনিতেছিলেন, আর আমাদের গদর্ভ ভাবিয়া মনে মনে হাসিতেছিলেন। ছিঃ ছিঃ! এমন লাঞ্ছনা মনুষ্যজীবনে হয়!”
পরেশচন্দ্র মুখখানা অন্ধকার করিয়া বলিল, “তাই ত, সেখারে আমাদের বন্ধুদের কি মহা দুর্গতিই হইয়াছে! তাহারা এ জীবনে আর আমার মুখ দেখিবে না।”
রমেশচন্দ্র বলিল, “না দেখিবারই কথা, এরূপ পয়সা খরচ করিয়া গিয়া মুখরোচক পোলওএর পরিবর্তে দেহপীড়ক গলাধাক্কা ভোজন করিয়া ফিরিলে কে আর কাহার মুখ দেখে?”
দেবেন্দ্রনাথ হাসিয়া বলিল, “আমাদের কেবল ভগবান দয়া করিয়া বাঁচাইয়া দিয়াছেন। তাহাদের অবস্থা, তাহাদের চেষ্টা, তাহাদের মনস্তাপ, আমি কল্পনা চক্ষে দেখিয়া—কি বলিব—আমরা রক্ষা পাইয়াছি, বলিয়া বিপুল আনন্দ উপলব্ধি করিতেছি।”
পরেশচন্দ্র বলিল, “এ উপহাস বিদ্রুপের সময় কি! আমার অবস্থা তোমরা ঠিক বুঝিতেছ না।”
দেবেন্দ্রনাথ বলিল, “তোমার অবস্থা বুঝিতেছি, বাগানে তাহাদের অবস্থাও বুঝিতেছি। ভায়া, তোমার অবস্থা অপেক্ষা তাহাদের অবস্থা আরও শোচনীয়।”
* * * *
তাহার পর পরেশচন্দ্র প্রায় অষ্টাদশবার ভোজ দিয়া বন্ধুগণের বন্ধুত্ব পুনর্লাভ করিতে সক্ষম হইয়াছিল; নতুবা সকলেই এক রকম তাহার মুখদর্শন বন্ধ করিয়াছিল।
সমাপ্ত।