ঠাট্টা – সমরেশ বসু
বিয়ে হয়ে গেল সন্ধ্যালগ্নেই। ফাল্গুন মাস। মাসের শেষ। সানাইওয়ালা চোখ বুজে ঢলে ঢলে বাজিয়ে চলেছে সেই চিরপরিচিত গানখানি, ‘চোখের বাণে বিধলে পরাণ, এখন প্রাণে বাঁচি না’। —সানাইয়ের রঙের সুর। আর বাতাসে ইতিমধ্যেই লেগেছে সুর উদাস চৈত্র-বাউলের। যেন ঘরের কোণে সুখের শয্যায় ডাক পড়েছে রিক্ত মহানন্দ ঘরছাড়া সন্ন্যাসীর।
বিয়ে হল শহরতলির আধা-পল্লি এক জায়গায়। বিয়ে-বাড়ির আলোর আর মানুষের ভিড়ে উদাস হাওয়া চলেছে গান করে আপন মনে। চোখের জলে হেসে হেসে মর্মরিত সে-সুর বাড়িটার বকুলের বাতাসে, চাঁপা গাছের ঝাড়ে। সবাই খুব খুশি। সন্ধ্যা লগ্নেই বিয়ে শেষ। রাত্রি ন’টার মধ্যেই খাওয়া-দাওয়ার পালাও চুকে গেল একরকম। কলকাতার বর। বরযাত্রীরা কলকাতার মানুষ। কুড়ি মাইল দূর মফস্সল, যেন কত দুস্তর ব্যবধান। ট্রেন ধরতে পেরে সবাই খুশি। বর শুধু খবর পাঠিয়েছিল, তার বন্ধু দীনেশ, বরযাত্রী এসেছে, সে যেন আজ না যায়।
বরকে নিয়ে আসা হয়েছে বাসর ঘরে। বর বেশ সুপুরুষ যুবক, নাম শিবেন। খুবই সপ্রতিভ আর সাবলীল, অসঙ্কোচ কথা ও হাসিতে বাসর প্রায় একলাই তুলেছে মাতিয়ে। কইয়ে বলিয়ে বলে ইতিমধ্যে, নাম করে ফেলেছে। একেবারে চোখে মুখে কথা।
কলকাতায় প্লাই-উডের ব্যবসা করে টাকা করেছে বিস্তর। যাকে বলে বড়লোক জামাই। সেইজন্য, চালে একটু মাত করে ফেলা অতি-সপ্রতিভতা। কনে আছে পাশে, গাঁটছড়া বাঁধা। মেয়েটিও একটু বাছাই, অর্থাৎ সুন্দরী। হাতে পায়ের গোছে, চোখে মুখের ধারে, সু-বাঁধা মস্ত খোঁপায়, সে রূপসী। তার উপরে যেটুকু ভার, সেটুকু হল তার অলঙ্কার, প্রসাধন ও সিল্ক শাড়ি-সজ্জা। নাম তার রানী। কটাক্ষ ঝিলিকে আর হাসি-টেপা ঠোঁটে বোঝা যাচ্ছে, সে বেশ খুশি।
মেয়েরা বাসর জাগাতে বসেছে আসর জাঁকিয়ে। নিরঙ্কুশ মেয়েদের রাজ্যে অসঙ্কোচে একলা শিবেন মেতে গেছে মজলিশে। শালি আছে নানান শ্রেণির। রানীর সহোদরা থেকে পিসতুতো, মাসতুতো, নানান সম্পর্কের বোন। তা ছাড়া বান্ধবীর দল আর সকলেই বাসরঘরের উপযুক্ত। অর্থাৎ ডাঁসা। বয়সে কম বেশি ঢল খাওয়া দলে আছে বিবাহিতা শালি ও শালাজ-বাহিনী। বয়সে ঢল হলেও চোখে মুখে কথায় কেউ কম নয়। এদের মধ্যে বিশেষ করে আছে বাণী, রানীর বিবাহিতা দিদি। সে আছে শিবেনের পাশে। শুধু বাসর জমাবার জন্যে নয়, বরকনের সামাজিক নিয়ম-কানুনের পরিচালনও তার হাতে। একে নমস্কার কর, রূপোর জাতিটা হাতছাড়া কর না ভাই শিবেন, কাজললতাটা খোঁপায় গুঁজে রাখ রানী, এই সব বলছে মাঝে মাঝে। তা ছাড়াও আছেন, ছানিপড়া চোখ রাতকানা, রানীর বুড়ি দিদিমা। পাকারসের বাড়াবাড়ির মুখে তিনি থেকে থেকে ছাড়ছেন সেকেলে কাঁচা রস। আর বাদবাকি বয়স্ক বয়স্কাদের এ-আসরে প্রবেশ নিষেধ।
জমেছে প্রথম থেকেই। প্রথমেই বাণী নিয়ে এল এক মুখ-ঢাকা থুত্থুড়ি বুড়িকে। বলল, “শিবেন ভাই, ইনি তোমার আর এক দিদিশাশুড়ি, পেন্নাম কর।”
শিবেন এক মুহুর্তেই দিদিশাশুড়ির আপাদমস্তক দেখে বলল, “মাপ করবেন দিদি, এঁর মুখ না দেখে পেন্নাম করতে পারব না।”
“কেন?”
শিবেন চোখ ঘুরিয়ে বলল, “মানুষটা বুড়ি থুত্থুড়ি হলেও পা দুখানি কেমন বাচ্চা বাচ্চা আলতা পরা যেন।”
অমনি হাসির হুল্লোড়। দিদিশাশুড়ি লাফিয়ে উঠে ঘোমটা খুলল। দেখা গেল, রানীর এক চৌদ্দ বছরের বোন।
ওমা! কী চোখ ভাই জামায়ের!
আসল দিদিমা বললেন “দূ—র বোকা জামাই! ওই পায়েই তো খপ করে হাত দিতে হত।”
ওমা! কী অসভ্য! অসভ্যতা কি না কে জানে। তবুও বাসর-ঘরে, চোখে চোখে হাসির ঝিলিক ইশারা-ইঙ্গিত ঢলে ঢলে গায়ে পড়াপড়ি। ঠাট্টা ও বিদ্রূপে, ঘুরে ফিরে একটা-ই বিচিত্র সঙ্কেতের উঁকিঝুকি। লক্ষ করলে এরই মধ্যে চোখে পড়ে, কোনও চোখে চাপা বিদ্বেষ কিংবা বিষাদ। সে খুবই নগণ্য। আসলে বাসর জাগে যৌবনের আসরে।
কেউ বলে, “এই রানী, চোখ তুলে দেখ।”
শিবেন বলে ঠোঁট টিপে, “কার দিকে?”
আবার হাসি৷ কী মুখফোঁড়। অর্থাৎ জামাই একেবারে একস্পার্ট।
তারপরে গান। জামাইকে গাইতে হবে। সে মাথা নেড়ে একেবারে অস্বীকার করল। আসলে তার হাত ইলেক্ট্রিক গিটারে খেলে ভাল।
বাণী বলল,—“হেরে গেলে ভাই শিবেন। তবে শোন এবার আমার বোনেদের গান।” বলে সে একে একে ডাকতে লাগল, আর একে একে এসে বসতে লাগল হারমোনিয়ামের সামনে।
সবাই যখন এলিয়ে পড়ল গান গেয়ে, তখন শেষরাত্রের ওস্তাদের মতো শিবেন টেনে নিল হারমোনিয়ামটা। গলা শুনে বোঝা গেল, একেবারে আনাড়ি নয়, গজল সুরে গাইল।
সবাই বলে উঠল, “ইস! কী মিথ্যুক লোক রে বাবা।”
অর্থাৎ জামাই গান জেনেও মিথ্যে বলেছে। গায়িকারা একেবারে মুষড়ে না পড়লেও হেরে যাওয়ার পাল্লাটা যেন ভার হয়ে রইল তাদের দিকেই।
ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে বলল এবার একস্পার্ট শিবেন, “আমাকে তো হল অনেক টেস্ট। এবার আপনাদের হোক।”
বলে পকেট থেকে বার করল মস্ত বড় চামড়ার পার্স। একখানি নতুন দশ টাকার নোট রাখল সামনে। অন্য পকেট থেকে গোল্ডফ্লেকের টিন বের করে একটি সিগারেট নিয়ে বলল, “নিজের হাতে সিগারেট ধরিয়ে যে দিতে পারবে তিন টান, তাকে দশ টাকার নোট। কে পারেন?”
অমনি নারীবাহিনীতে হাসি উত্তাল, ঢেউ ঢলাঢলি। কী চালাক!
বাণী বলল ঠোঁট উল্টে, “পারিনে ভেবেছ? তবে, সিগারেট-ই যদি টানব দশ টাকা কেন? ওটা ডবল হোক্৷ “তা-ই সই।” শিবেন রাখল আর একটা নোট।
অপ্রস্তুত বাণী এবার হেসে উঠল খিল্খিল্ করে। ঠাট্টা করেও ভদ্রলোকের মেয়ে একবার সিগারেট টানলেই যে তার ভ্রষ্ট দোষ হয়, এটাই সে জানে। তা ছাড়া, ঠোঁটে সিগারেট, মুখে ধোঁয়া! মাগো! বলল, “ওয়াক!ও আমি শত টাকায়ও পারব না ভাই।”
অনেকেই হেসে হেসে বলল, আমি পারি। আমি পারি। কিন্তু কেউ পারল না। যেন, হয়তো পারত কেউ কেউ। শুধু নির্জনে দু’জনের বাজি হলে। কিন্তু এত মেয়ের মধ্যে! সভাস্থলে বসে! তা কি পারা যায়। ছি! বলবে কী লোকে।
কেবল, অনেকের হাস্যদীপ্ত চোখে ছায়া জেগে রইল দুটি দশ টাকার নোটের। আর নোটে ছাপা সিংহের হিংস্র দাঁত। ভেংচাতে লাগল তার চেয়ে কড়া হাসিতে। জয়ের উল্লাসে যেন এই হাসিটিই তীব্র ঠাট্টায় জ্বলতে লাগল শিবেনের ঠোঁটে।
ওদিকে সানাইওয়ালাটি ক্ষেপে গেছে ‘চোখের বাণে বিধলে পরাণ’-এ। বাসরের দক্ষিণ জানালায় দীর্ঘশ্বাস ঝরে বকুলের বাতাসে।
শিবেন বলল, “পারলেন না কেউ। এদিকে জিজ্ঞেস করে দেখুন?” বলে ইশারায় দেখিয়ে দিল বাঁয়ে কনে রানীকে। একজন বলল, “কি লো রানী?”
রানী লজ্জায় হারিয়ে গেল সিল্কের শাড়িতে।
হঠাৎ একজন বলল, “আমি পারি।”
সবাই ফিরে তাকাল সেদিকে। রানীর পিসতুতো বোন মায়া। চোখে মুখে নেই এমন কিছু বাসরের চাকচিক্য। বরং রুক্ষ চুলগুলি বাতাসে মুখে এসে পড়েছে। দেখতে একরকম। বয়স হবে কুড়ি বাইশ। এসেছে কলকাতা থেকে। লেখাপড়া জানা মেয়ে। একলা এসেছে।
সবাই দেখল মায়া টিপে টিপে হাসছে। আর সকলের মতোই যেন ছলনার হাসি। হেসে উড়িয়ে দিল সবাই।
শিবেন বলল, “সত্যি।”
মায়া বলল, “মিথ্যে বুঝি? ভেবেছেন, হেরে যাব সবাই। দিন সিগারেট আর দেশলাই।”
সবাই হেসে উঠল খিল্খিল্ করে। সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠ বাণীর। তবু যেন হাসিটা সকলের একটু লাগাম ধরা। একটু চমকে চমকে উঠছে সকলের ভ্রূ।
পরমুহূর্তেই ফশ্ করে জ্বলল দেশলাইয়ের কাঠি। দেখা গেল, মায়ার ঠোঁটে সিগারেট ধরিয়ে দু’আঙুলে ধরে, গুনে গুনে টান দিল তিনটি। যেন কত একস্পার্ট। তারপরে হাসি।
আশা ছিল, হেসে উঠবে সকলে। কিন্তু মায়ার ঠোঁটের ফাঁকের ধোঁয়া যেন চেপে বসল সকলের মুখে। কী যেন ঘটে গেল। বন্ধ হল হাসি। সকলের চোখে চোখে কী কথা বিনিময় হল নিঃশব্দে। চাপা বিদ্বেষ ও ঘৃণা দেখা দিল চোখ ও ঠোঁটের কোণে। বাসরটি হয়ে উঠল অ্যাসিডের গন্ধপাওয়া সাপের মতো থমকানো সন্দিগ্ধ।
শিবেনের ডগলাসি গোঁফের ফাঁকে দেখা দিল, মাছের গন্ধ পাওয়া অভিজ্ঞ চতুর বেড়ালের হাসি। মায়ার দিকে ফেরানো তার একটি চোখ একটু ছোট হয়ে এল। ভাবখানা, হুঁ! চিনেছি। বলে উঠল, “গুড! একে বলে স্পোর্টিং স্পিরিট। আমার খুব ভাল লাগে।”
বলে নোট দু’খানি তুলে দিলে মায়ার হাতে। দেওয়ার সময় একটু যেন আঙুলের চাপ লেগে গেল মায়ার হাতে। মনে মনে চমকে থতিয়ে গেল মায়া। তবু মুখে হাসল ফিক্-ফিক্ করে।
আর সবাই হাসবার চেষ্টা করল। কিন্তু একেবারে খাপছাড়া হাসি৷ কোথায় ভাঙন ধরে গেছে। প্রথমে একেবারে নির্বাক হল বাণী। সে হঠাৎ বলল, “আসছি ভাই শিবেন।”
বলে সে বেরিয়ে গেল। তারপর একে একে বিদায় নিতে লাগল সবাই জমাটি আসর ভেঙে। সকলের দৃষ্টি মায়ার মুখের কাঁথায় ছুঁচের ফোঁড় দিয়ে গেলে। মায়াও উঠল। হাসল তেমনি শিবেনের মুখের দিকে চেয়ে। এর মধ্যেই যেন বসে গেছে চোখের কোল, একটু ত্রাস, সামান্য বিষণ্ণতা।
গোঁফ বাঁকিয়ে, একটু ঢুলুঢুলু চোখে, যেন একটু অর্থপূর্ণ হেসে ঘাড় নাড়ল শিবেন জিজ্ঞেস করল, “বাড়িটা কোথায় কলকাতায়?”
মায়া বলল, “তিন বাই বারো ভবানী পাঠক লেনে।”
কিন্তু বিদ্বেষে চোখ জ্বলছে কনে রানীর। দিদিমা বললেন ফিসফিস করে, “সুবর্ণ বিধবা হয়ে মেয়েটার মাথা চিবিয়ে খেয়েছে।”
সুবৰ্ণ মায়ার মায়ের নাম। এতক্ষণে, সানাইওয়ালাটার তাড়ি-গেলা দমভরা হৃৎপিণ্ডে অবসাদ এসেছে। সুরটা যেন কেমন এখন, ‘চোখের জলে, কেঁদে কেঁদে, তোমারি পথ চাহি গো’ সুরে বাজছে।
বাসরের ঘরে আসর ভেঙেছে বটে। উৎসবের শেষে, ভোজ-ভাঙা এঁটো কাঁটার হাটে বসেছে আর একটি আসর। রানীর বাবা-মাও আছেন সেখানে। সেখানে ছি ছি, ফিসফিস, ঘৃণা ও বিদ্বেষ। শুধু তা-ই নয়, এমনকী শুধু টাকার হ্যাংলামিও নয়। আত্মীয়স্বজনের মুখে চুনকালি মাখা লোভ ও অভ্যাস-নোংরামিটুকু টের পেয়েছে। সবাই।
বাণী বলল, “জামাই তো বোকা নয়। স্পষ্ট দেখলাম, সে কী রকম করে হাসছে। চান্কে দেখে ভাবল, তার শালিরা বুঝি সবাই এইরকম। সকলের মাথা হেঁট।”
মায়া এসে দাঁড়াল কাছে। অমনি সবাই চুপ হয়ে গেল। সকলের চোখ থেকে ছুটে এল রাশি রাশি কাঁটা।
মায়া যেন এসব দেখেও দেখল না। টাকার কোথাও তুলল না একবার হেসে। মুখে ছড়ানো রুক্ষ চূর্ণ চুল সরিয়ে, হেসে জিজ্ঞেস করল রানীর মা সুখদাকে, “মামিমা, বড্ড ঘুম পেয়েছে। কোথায় শোব।”
সুখদা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, “বড় বউমা’র ঘরে।”
সবাইকে একবার আড়চোখে দেখে, হেসে চলে গেল মায়া। তার নরম বুকের ভাঁজে ভাঁজ করা দুটি নোট ভিজে উঠছে বিনবিনে ঘামে। সেখানে যেন নোটে ছাপা সিংহগুলি গর্জাচ্ছে। আর মায়ার ধুকধুকি বাড়ছে আরও জোরে।
বাণী বলল হিসিয়ে চিবিয়ে, “আচ্ছা মেয়ে, পিসতুতো বোনই হও আর যা-ই হও, দেখি তোমাকে পারি কি না শায়েস্তা করতে।”
রাত পোহাল। কথা হল, জলযোগ করে বেলা দশটার গাড়িতে যাবে মেয়ে-জামাই। কুশণ্ডিকা হবে কলকাতায় গিয়ে।
কিন্তু সারা বাড়িটাতেই যেন কী ঘটে গেছে। রানীর বউদি ও বোনেরা, অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনেরা কেবলি ফিস্ফাস্ করছে। বাতাসও করছে তেমনি হুস্হাস্ করে। যেন তিক্ত চাপা স্বরে শুধু বলছে, ছি ছি…।
মায়া চা খাচ্ছিল বড় বউয়ের ঘরে। রানীর ছোট বোন এসে ঠোঁট বেঁকিয়ে বললে, “মায়াদি, মা ডাকছে তোমাকে খাবার ঘরে।”
চকিতে একটু ছায়া খেলে গেল মায়ার চোখে। তারপর ঠোঁট টিপে হাসল। ভেঙে পড়া বাসী খোঁপা গোছাবার চেষ্টা করল একটু। আঁচল গুছিয়ে নিল, হাত চাপল একটু বুকে।
এসে দেখল, গুরুতর ব্যপার। যেন সভা বসেছে। সুখদা আছেন, বসে আছেন তাঁর স্বামী প্রকাশরঞ্জন। শত হলেও তাঁরই ভাগ্নি। বাড়ির বউয়েরা মেয়েরা আছে। আরও আছে, আত্মীয়-স্বজন দু’চারজন। সবচেয়ে বেশি আছে বাণী নিজে। এমনকী রানীও আছে গাঁটছড়া কাঁধে নিয়ে। শিবেন গেছে বাইরের ঘরে, বন্ধু দীনেশের কাছে।
সকলের মুখ গম্ভীর। দিদিমা বললেন ফিস্ফিস্ করে, “একে কলকাতায় বাস, তার অভাব। বারোটা বেজে গেছে মেয়ের।”
সুখদা বললে মায়াকে, “ঠাকুরঝি কি তোকে এসবও শিখিয়েছে?”
মায়া যেন বোঝেনি কিছুই। বড় বড় চোখ তুলে বলল “কী?”
দপ্ করে জ্বলে উঠল বাণী, “ন্যাকামো করিস্নে। এই সিগারেট বিড়ি খাওয়া কতদিন চলছে?”
মায়ার কটা-কটা মুখ কালো হল একটু। বলল, “আমি তো খাইনে।”
বাণী জ্বলে উঠল আরও। তিক্ত গলায় বলল, “তবে বুঝি টাকা পেলেই খাস্?” সারা ঘরের চোখগুলি নিঃশব্দে যেন ওই কথায় জিজ্ঞেস করল তাকে।
মায়া যেন্ কতই অবাক, এমনি স্বরে বলল, “সিগারেট খেলে কেউ টাকা দেয় নাকি?”
কে যেন বলে উঠল, “কী পাজি!”
মায়া আবার বলল, “ও তো জামাইবাবুর সঙ্গে বাজি হয়েছে, তাই।”
সভার প্রতিনিধি-নেত্রী বাণী ফুসে এল শিখার মতো, “ওসব জানি। কারা বাজি লড়ে সিগারেট ফোঁকে, তাও জানি। কিন্তু এ বাড়িতে ওসব চলবে না। যা টাকা ফিরিয়ে দিয়ে আয় শিবেনকে।”
মায়ার মনে হল, বুকের মধ্যে সিংহগুলি আঁচড়াআঁচড়ি করছে। বলল, “টাকা তো আমাকে জামাইবাবু দিয়েছেন।”
আরও জোরে ঝেঁকে উঠল বাণী, “অত আর জামাইবাবুর সোহাগ দেখাতে হবে না। দিয়ে আসতে হবে টাকা।”
নিঃশব্দে, ক্রুদ্ধ চোখে সমস্ত ঘরটাই সায় দিল বাণীর কথায়। এমনকী, রানীও মনে মনে বলল, “শয়তান কোথাকার।”
মায়া বলল শান্ত ঝিমধরা অথচ পরিষ্কার গলায়, “কেন টাকা দিতে যাব বাণীদি?”
রাগে ও ঘৃণায় রুদ্ধশ্বাস সমস্ত ঘরটা। বাণী যেন মারতে এল, “ওসব জানিনে— ওসব করে টাকা নেওয়ার ঢের জায়গা আছে। এখানে চলবে না।”
মায়া বলল আরও পরিষ্কার গলায়, “দিতে হয়, তোমরা দিয়ে এস, আমি নিজে পারব না।”
বলে সে দাঁড়িয়ে রইল একমুহূর্ত। সারা ঘরটা অসহ্য রাগ ও ঘৃণায় নির্বাক। আরও আশ্চর্য, টাকাটা কিন্তু বের করল না মায়া কিছুতেই। ভেঙেপড়া খোঁপাটা দেখিয়ে চলে গেল বাইরে।
সুখদা তিক্ত গলায় বললেন স্বামীকে, “কী ভাগ্নি তোমার। দু’কলম লিখে একটু বোনকে জানিয়ে দাও।”
তা-ই ঠিক হল। অন্তত বাড়িতে গিয়ে যাতে মায়ের কাছে ধরা পড়ে মায়া। তবুও জ্বলতে লাগল সারা ঘরটি। ওদিকে আবার তাড়া আছে মেয়ে-জামাই বিদায়ের।
আর এই সময়ে বাইরের ঘরে জমে গেছে শিবেন আর দীনেশ। দীনেশ চোখ বড় করে বলল “মাইরি?”
শিবেন বলল, “মাইরি। এমন ফুঁকলে, মিনার্ভা কাফের মিস্ ক্যাথিকেও বলে ওদিক থাক্। শিবেন মুখুজ্জের চোখকে অত সহজে ফাঁকি দেওয়া যায় না, মুখ দেখেই বুঝেছি। চট্ করে মেরে নিলে কুড়ি টাকা। ঠিকানা নিয়ে নিয়েছি।”
দীনেশ বলল, “সত্যি? গুড্ বয়। কাজ সেরেই রেখেছিস্।”
“তব্বে?” শিবেন বলল, “ব্যবসা করি প্লাই-উডের। কাঠ যতই পাতলা হোক, ব্রেন ঠিক ভারী আছে বাবা!”
দুই বন্ধু হাসল চোখে চোখে চেয়ে।
তারপর যাওয়ার সময় এল ঘনিয়ে। সকলের ব্যস্ততার ফাঁকে, সুখদা ও প্রকাশরঞ্জনকে প্রণাম সেরে নিল মায়া। হাতে ছোট একটি পুঁটুলি। কেউ কিছু জিজ্ঞেসও করল না। বললও না থাকতে। প্রকাশরঞ্জন তার হাতে একটি চিঠি দিয়ে বললেন, “তোর মাকে দিস আমার চিঠি। না দিলেও আমি জানতে পারব পরে।” মায়া ঘাড় নেড়ে চলে গেল। কেবল এই ব্যস্ততার মধ্যেও সারা বাড়িটা একমুহূর্ত বিস্মিত অসহ্য ক্রোধে দেখল তার চলে যাওয়া। সানাইওয়ালা বাজাচ্ছে একটি চেনা ভৈরবী সুরের গান।
বিদায় দিতে অনেকেই এল স্টেশনে। বাণীও আছে। কয়েক মিনিট দেরি আছে গাড়ির। শিবেন আর দীনেশ সিগারেট খাওয়ার জন্য একটু সরে গেল ভিড়ের মধ্যে। হঠাৎ চোখে পড়ল মায়াকে। দাঁড়িয়ে আছে বুকে আড়াআড়ি হাত রেখে। শিবেন নাম ধরেই ডাকল, “মায়া না?”
নাম শুনে চমকে ফিরল মায়া। এক মুহূর্ত অবাক হয়ে হঠাৎ হেসে বলল, “কে জামাইবাবু? এই গাড়িতে যাচ্ছেন?”
শিবেন দীনেশের দিকে একবার দেখে বলল, “হ্যাঁ। তুমি কি এই গাড়িতেই যাচ্ছ?”
তুমি? সম্বোধন শুনে যেন ঝিলিক দিয়ে উঠল মায়ার হাসি। বলল, হ্যাঁ।
“তবে এক কামরাতেই চল।”
“কোন ক্লাসের টিকিট আপনাদের?”
“সেকেন্ড। তোমার থার্ড? তা হোক না চার্জ দিয়ে দেব। চল, চল।” হাত না ধরেও যেন তাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে এল শিবেন। তার শিকারি জীবনের অভিজ্ঞতা বোধহয় একবারও মনে করল না নতুন বউ রানীর কথা। আর সকলের চোখে দেখা দিল এক অশুভ সঙ্কেত। বাণী বলে দিল রানীর কানে কানে, “সাবধান! ডাইনি, পিছু নিয়েছে।”
গাড়ি এল। সঙ্গে গেল রানীর ছোট্ট বোন। আর ছিলেন পিতৃহীন শিবেনের বরকর্তা মেসোমশাই। বাণী যেন তাঁকেও চোখ দিয়ে বলতে চাইল, “সাবধান!” লোকাল ট্রেন চলল ধিকিয়ে ধিকিয়ে। মায়া বসেছে রানীর পাশে। কিন্তু অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে আছে রানী। রাগে ঘৃণায় ও অভিমানে, নতুন বউয়ের চোখে আসছে জল। বাপ মা’কে ছেড়ে আসার কান্নাটা চাপা পড়ে-গেল।
শিবেন আর দীনেশ রয়েছে পাশাপাশি, মায়াদের মুখোমুখি। মেসোমশাই বসেছেন একটু দূরে। এমনিতেই তিনি কিঞ্চিৎ কৃপাপ্রার্থী শিবেনের কাছে। ওরই পয়সায় কেনা নতুন জামা-কাপড় পরে সেজে এসেছেন বরকর্তা। ভয়ও করেন কিছু কিছু।
দীনেশকে মায়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল শিবেন। তারপর বলল, “না বলেই চলে এসেছিলে যে তুমি?”
মায়া বলল, “ভেবেছিলাম গাড়ি ধরতে পারব না।”
শিবেনের গোঁফের ফাঁকে হাসিটুকু যেন চাপতে পারছে না নিজেকে। আড়ে আড়ে দেখছে রানীকে। ভগ্নীপতির চেয়েও একটু বেশি রস গলায় ঢেলে বউভাতের বিশেষ নিমন্ত্রণ জানাল মায়াকে। তারপর বলল, “আজই চল না।”
মায়া হেসে ঘাড় নাড়ল নীরবে।
একটু যেন বিদ্রূপের সুরেই বলল শিবেন, “কেউ বুঝি ভাববে?”
ঠোঁট টিপে হেসে ঘাড় নেড়ে সায় দিল মায়া।
কথা শেষ হতে চায় না শিবেনের। দীনেশ শুধু চেয়ে আছে খানিকটা নির্লজ্জের মতো।
একবার মায়া কথা বলতে গেল রানীর সঙ্গে। কিন্তু সেখানে সিল্কের শাড়ি যেন কোঁচকানো পাথর হয়ে গেছে। কথা নেই। মুখও ফেরাল না। গলার কাছে যেটা ঠেকেছিল রানীর, সেটা গলে পড়ছে চোখ দিয়ে।
আর মায়ার বুকের মধ্যে আঁচড়াচ্ছে শাণিত নখে সেই জানোয়ারগুলি।
এল শিয়ালদহ স্টেশন। শিবেন মায়াকে বলল একটু আড়ালের ফাঁকে, “তোমাদের বাড়ি যাব শিগ্গিরই।”
তারপর ট্যাক্সি ডাকা। বিদায় নিল মায়া। শিবেন আর দীনেশ সেদিকে দেখে, মুখোমুখি ফিরল দু’জনে।
ভবানী পাঠক লেনে সন্ধ্যা নামো নামো। একটি বন্ধ কানা গলি।
ফাল্গুনের শেষ বাতাস এখানে ভুলে ঢোকে কখনও কখনও। ঢোকে রোষে দিশাহারা হয়ে। মায়া এল এই সময়ে।
তিন বাই বারোর বাড়িটা একেবারে শেষে। একতলার দক্ষিণ-চাপা ঘরটা মায়াদের। লাইটের কানেকশন নেই। হ্যারিকেন জ্বেলে পড়তে বসেছে, চোদ্দো, বারো, দশ, আট বয়সের চারটি ছেলে-মেয়ে। মায়ার ছোট ছোট ভাই-বোন। তার বড় আঠারো বছরের ভাইটি নিশ্চয় গিয়েছে টুইশানিতে। মায়া বড় সকলের।
এক কোণে বিছানায় শুয়ে আছেন অসুস্থ মা সুবর্ণ। স্বামী মারা গেছেন চার বছর। সব কিছুর সঙ্গে এখনও সেই শোকটুকু চেপে আছে বুকে।
লাফিয়ে উঠল ভাই-বোনেরা।—“মা, দিদি এসেছে, বিয়েতে খুব খেয়েছিস, না?”
মায়া হাসল একটু। সুবর্ণ পাশ ফিরলেন আস্তে আস্তে। বললেন, “মায়া এলি?”
“হ্যাঁ মা।”
“কী এনেছিস দিদি অতগুলি?”
“দেখাচ্ছি বোস্ আগে।”
সুবৰ্ণ বললেন, “দুপুরে ফিরবি বলেছিলি?”
মায়া বলল, “ফিরতাম। কিন্তু সীতাদি’র জামাকাপড়গুলি ছেড়ে দিয়ে একেবারে নিজেরটা পরে এলাম মা। তা ছাড়া একটু ঘুরে এসেছি।”
“বিয়ে হল ভাল মতো? বর কেমন?”
“সবই ভাল মা।”
“আমার কথা কিছু বলল দাদা বউদি?”
“হ্যাঁ, দুঃখ করল অনেক।”
নিশ্বাস ঝরল সুবর্ণের। তারপর মায়ার দিকে ফিরে মনটা চমকাল একটু। উৎকণ্ঠিত হয়ে বললেন, “তোকে অত শুকনো দেখাচ্ছে কেন রে মায়া? হাতে ওগুলো কী?”
মায়া হ্যারিকেনটা সামনে এনে মায়ের কাছে বোঝা মুক্ত করল। বলল, “তোমার সেই আট টাকা দামের ওষুধটা এনেছি মা।”
উদ্বেগভরা গলায় জিজ্ঞেস করলেন সুবর্ণ, “কোত্থেকে রে?”
মায়া নিঃশব্দে হেসে বলল, “বলছি। আর হেনা-মিনু-নন্টি-বীরুর জন্যে চারটে জামা।”
অমনি চারজনে ছোঁ মেরে তুলে নিল জামা।
সুবৰ্ণ তেমনি ব্যাকুল গলায় বললেন, “কোথায় পেলি টাকা?”
মায়া হেসে বলল, “বলছি গো।” বলে প্রকাশরঞ্জনের চিঠিটা দিল সুবর্ণকে। “তোমাকে চিঠি দিয়েছেন মামা।”
সুবর্ণ রুগ্ন চোখে ভ্রূ-কুঁচকে পড়লেন চিঠি। বেশ বড় চিঠি। তারপর অনেকক্ষণ চোখ বুজে পড়ে রইলেন চিঠিখানা বুকে নিয়ে। মায়া নিঃশব্দে বসে রইল মায়ের কাছে। ছোট ছোট ভাই-বোনেরা তখন জামা দেখতে, ভালমন্দের বিচারে মগ্ন।
আচমকা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন সুবর্ণ, “সিগারেট কি খেয়েছিস আর কখনও?” মায়া বলল, “না মা।”
সুবর্ণ চোখ খুলে বললেন, “কষ্ট হয়নি?”
মায়া কথা বলল না।
সুবর্ণ ডাকলেন, “মায়া।”
মায়া বলল “হ্যাঁ মা, বড় বিচ্ছিরি গন্ধ। সহ্য করতে পারিনি। রাত্রে বমি হয়ে গেছল।”
সুবৰ্ণ বললেন, “তবুও—”
আর কিছু বলতে পারলেন না। রুগ্ন হাত দিয়ে কাছে টানলেন মায়াকে। মায়ার জলভরা চোখ দুটি আঁচল দিয়ে মুছিয়ে বললেন রুদ্ধগলায়, “কাঁদিসনে।”
জোয়ারের ভরা গঙ্গার মতো নিঃশব্দ হয়ে রইল দু’জনে।
২১.০৮.১৯৫৫
লেখক পরিচিতি
সমরেশ বসু : ১১ ডিসেম্বর ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে জন্ম। বিচিত্র অভিজ্ঞতাপূর্ণ জীবন। লেখাকেই জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। প্রথম সাড়া জাগানো গল্প ‘আদাব’, ১৯৪৬ সালে। কালকূট ছদ্মনামে দেশ পত্রিকায় ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ বিপুল সাড়া জাগায়। ১৯৫৮, ১৯৭২ এবং ১৯৯৩-এ আনন্দ পুরস্কার। ১৯৮০-তে পেয়েছেন অকাদেমি পুরস্কার। মৃত্যু: ১২ মার্চ ১৯৮৮।