ঠাকুর ভরত সিংহের ব্যান্ডপার্টি
পাড়ায় ঢুকতেই দুধারে দুটো কোঅপারেটিভ ফ্ল্যাটবাড়ি। সেখানে না-হােক একশাে সওয়াশাে ঘর বাসিন্দা আছে। তা ছাড়া কুল্যে দুখানা রাস্তার গায়ে ঘেঁষাঘেঁষি করে কম করেও আরও দেড়শাে-পৌনে দুশাে ফ্যামিলি বাস করে। বলা যায় একুনে প্রায় চারশাের মতাে গেরস্থ এই বসতি আলাে করে বাস করে।
পাড়ার দুদিকে দুটি প্রাচীন ক্লাব। একটিতে রেস উঠে গেছে। অন্যটিতে গলফ টিকে আছে। এখনাে শহর কলকাতার এই বসতির গায়েই একটি দহ আছে। লােকে বলে পাগলা পিরের দ। ঝুরি সমেত বটতলায় দরগা—সবই অটুট। এমনকি সপ্তাহে একটি দিন সেখানে লােক আসে আগরবাতি হাতে—সিন্নি। চড়ায়-চামর দুলিয়ে ধুপ-ধুনাের ভেতর গানও হয়। এমনকি মানতের মুর্গি, ভাত খেয়ে ফুলে উঠলে ওখানেই কেটে বিক্রি হয়। আস্ত কেজি তেইশ টাকা।
এরকম জায়গাতেই ভারত সরকারের মেট্রো রেলের টার্মিনাস। রাজ্য সরকারের এস বাস, ট্রাম, অটো রিকশার ছড়াছড়ি। এখানে ভাের সাতটার ভেতর করপােরেশনের জমাদার এসে রাস্তায় ঝট দেয়। ড্রেন ধােলাই করে। আলাের লােক এসে স্ট্রিট লাইটের সুইচ ওপরে তুলে দেয়। মাদার ডেয়ারি, খবরের কাগজ আসে। আর আসে ডাকপিওন। দিনে তিনবার। গাদাগুচ্ছের ফেরিওয়ালা। যাদের বেশির ভাগই আনে ফুলঝাড়ু। তারপরেই মিহিদানা। নারকেলের মাছসন্দেশ। খােয়া ক্ষীরের চাকতি।
অথচ এমন গুরুত্বপূর্ণ জায়গার কথা কোনাে ভূগােলে নেই। অ্যাটলাসে এ পাড়ার জন্যে কোনাে জায়গা হয়নি। তিনটি লন্ড্রি, দুটি মুদিখানা, একটি মিষ্টির দোকান, সাতটি দিশি কুকুর, আর প্রায় চল্লিশজনের মতাে রিটায়ার্ড লােক নিয়ে এ পাড়ার মহৎ বৈশিষ্ট্য—মাঝে মাঝেই এখানে যাতায়াতের রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে বি. কম, পাস ও ফেল ছেলেছােকরারা একটি রবারের বল নিয়ে রাতে ক্রিকেট খেলে ইলেকট্রিক জ্বেলে। স্কোর লেখে। হাউজদ্যাট বলে চিৎকার করে ওঠে। ডিউজ বলের বদলে রবারের বল—মাঠের পিটুলিগােলায় বেড়ে ওঠা এ পাড়ার ভবিষ্যৎ অল্পদিনের ভেতরেই গম্ভীর হয়ে উঠবে—বয়স্করা তাই বলছেন। কেননা, পৃথিবী খুব কঠিন জায়গা—এটাই নাকি বাবার হােটেলে ওদের কেউ জানায়নি এখনাে।
এ পাড়ারই কয়েকটি বাড়ির সিঁড়ি রাস্তা থেকে উঠেছে। সেখানে গুটিয়ে বসে আলােচনা হয়–নেতাজি বড়াে? না, নেহরু? জ্যোতিবাবু সেকেন্ড ম্যারেজে পণ নিয়েছিলেন? মারাদোনাকে আনতে ডলার জুটবে তাে? এসব কথায় একমেব লক্ষ্মীট্যারা কয়লার দোকানিও যােগ দেয়। কেরােসিনের দোকানি যােগ দিতে পারে না। কারণ—দোকানে সবসময় লাইন।
নিশুতি রাতে কোনাে সাইকেল রিকশায় চড়ে এ-পাড়ায় ফিরলে রিকশাওয়ালা ভাড়া নিয়ে চলে যাবার সময় হয়তাে বলে বসবে—এই যে দেখলেন বাড়িটা—এখানে আমরা ছােটোবেলায় খেলতাম। এখানে তখন বাঁশঝাড় ছিল। এ বাড়ির মালিক আর নেই। মারা গেছেন। মাত্র চল্লিশ টাকায় এ জায়গাটা আমার দাদুর কাছ থেকে লিখে নিয়েছিল।
এই এতরকমের উল্টোস্রোতের ভেতর এ-পাড়াকে যে রসেবশে সুস্থির রেখেছে–রেখে আসছে—তার এখন আসার সময় হল। ঘড়ি মিলিয়ে নিন। সকাল সওয়া সাতটা। ওই যে ট্রাম লাইন থেকে সে হেঁটে আসছে। মাথার চুল সিঙাড়ার কায়দায় কিছু কঁপানাে—হাতে কাঠের বাক্স-বগলে একটি আসন কিংবা অ্যাপ্রন।
ও ভরত—
গুড মর্নিং। ভালাে আছেন তাে? দনিতে খুঁজলাম–পেলাম নাতাে। ও আজকাল পাওয়া যায় না।
এক এক জনকে এক এক কথা বলতে বলতে ভরত এসে পাড়ায় ঢুকল। এবার বােঝা যাচ্ছে—সে একজন পরামানিক।
পাড়ার একই বাড়ির তিন ভাই পাগল। তারা তিন ভাই এই সময়টায় নিয়ম করে মিষ্টির দোকানে আসে। এসে বাসি জিলিপি টুকরাে করে করে কাকদের জন্যে শূন্যে ছােড়ে। কাগজ বিলির পর হকাররা এখানে বসে চা খায়। তখনই ভরত পাড়ায় ঢােকে খবরাখবর নিতে নিতে–দিতে দিতে। তারপর ঝুঁকে পড়ে হকারদের হাত থেকে বাংলা কাগজের হেডলাইন দেখে নেয়।
তখন তখনই হকাররা গাল বাড়িয়ে দেয়। ভরতের বউনি হয়। গাল কামায়, গোঁফ সাইজ করে। হিন্দুস্থানি হকারদের সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলে। বাঙালিদের সঙ্গে বাংলায়। কেউ তাকে বলে—আপ। কেউ বলে—তুমি। আবার কেউবা দাড়ি কামানাের পর ফিটকিরির বদলে ক্রিম চাইলে ভরত একটা টিউব টিপে দেখা যায় না এমন পরিমাণ ক্রিম খড়খড়ে আঙুলের ডগায় মাখিয়ে খদ্দেরের গালে ঘষে।
খদ্দের বলে, ক্রিম কোথায় ? এ তাে শুধু হাত ঘষে গাল ব্যথা করে দিচ্ছ।
দামি ক্রিম তাে—অল্প একটু মাখলেই কাজ হয়।—এই বলে ভরত উঠে দাঁড়ায়। তখন পাড়ায় আরামি লােকেরা ঘুম থেকে উঠছে। মর্নিং ওয়াকাররা ঘরকুনাে। এ-বাড়ি সে-বাড়ির ফুলবাগানের চিৎকার ছাপিয়ে রেডিওর সেতার।
ভরত মিষ্টির দোকানিকে বলল, দুটো সিঙাড়া দিয়াে আজ। কাল রাতে কিছু খাইনি তাে—গলার স্বর এত আন্তরিক—মনে হবে কোনাে অতি বিশ্বাসী বন্ধু কোনাে জরুরি খবর দিয়ে তার বদলে মাত্র দুটি সিঙাড়া চাইছে।
সিঙাড়া দুটি দিয়ে দোকানি জানতে চাইল, খাওনি কেন কাল রাতে ভরতদা?
খাবাে কী। কাল দুপুরে ওই ফ্ল্যাট বাড়িতে তিনটে চুল কাটলাম। যত বলি খাব না—তত ওরা দেবে। বলল, ভরত দুটি খেয়ে যাও।
তিন বাড়িতেই বলল ?
দুটো বাড়িতে। এক বাড়িতে দুটো মাথা পড়েছিল। আরেক বাড়িতে একটা। সে জ্যাম জেলি টোস্ট ওমলেটের ছড়াছড়ি এক বাড়িতে। আরেক বাড়িতে ছাড়তে চায় না। বলে মুড়িঘণ্টের এই তরকারিটা খেয়ে যাও ভরত—
কোন ফ্ল্যাট বলত ভরতদা? এত কদর তােমার।
এ কি আবার মনে থাকে। গাদাগুচ্ছের ফ্যামিলি। তেতলায় পাশাপাশি ফ্ল্যাট। আমার হাতের কাজ ওদের খুব পছন্দ। বিরাট চাকরি করে তাে। সাহেবি কোম্পানিতে।
তাই খেতে বলল? হুঁ। তবে কী বলছি? তােমার ব্যান্ডপার্টি নিয়ে যাওনি।
যা বােঝ না তাতে কথা বল কেন? রােজকার শেভিং হেয়ার কাটিংয়ে কেউ ফ্যামিলি নিয়ে যায়। হত বিয়ে কি পৈতে কি আশীর্বাদ—তখন আলাদা কথা। পার্টি নিজেই বলে দেয়-ভরত ব্যান্ডপার্টি নিয়ে আসবে। আমিও তখন ছেলেমেয়েদের নিয়ে নেমন্তন্ন রাখতে যাই—
এক এক বাড়িতে ভরত এক এক কথা পাড়ে। সেকথায় যাবার আগে বলতে চাই—যদি কোনােদিন এ-পাড়ার ইতিহাস লিখতে যাই তাে সবার আগে এ-পাড়ায় চুলদাড়ি কাটতে আসা এই ভরতের একটা শর্ট বায়ােগ্রাফি নিতে হবে সে ইতিহাসে। কেননা—ভরত এ-পাড়ায় কর্কটক্রান্তি। ভরত এ-পাড়ার মকরসংক্রান্তি।
সূর্যের খানিকবাদেই এখানে তার উদয়। সূর্যাস্তের বেশ পরে সে এখান থেকে অস্ত যায়। এমনিতে সে জনারণ্যে হারিয়ে যাবার মতােই। খুবই সাধারণ। বগলে পুরনাে কাঠের বাক্স। পায়ে তাপ্লিমারা স্যান্ডেল। প্যান্টালুন ঝুলে পড়ছে। শার্টের কলার ফাটা। হাসলে এবড়ােখেবড়াে দাঁত। তবে মাথার চুলটি কালাে। কুচকুচে। জাতে উঠবার জন্যেই যেন খানিক কথা হিন্দিতে বলে ফেলে। তখন তার মুখে কেউকেটা ভাব ফুটে ওঠে। আর ষােলােআনা অভিজাত হবার জন্যে অবরে সবরে ইংরেজিও বলে। তবে অস্পষ্ট গলায়। যাতে কিনা ইংরেজি ওয়ার্ডগুলাে পুরােপুরি ধরা না যায়।
ভরত তােমার দেশ কোথায় ?
পাটনা শরিফ জানেন তাে। আমরা ওখানকার ঠাকুর। ঠাকুর হয়ে পরামানিক হলে কী করে? বিহারে আমরা ঠাকুর ছিলাম। বাবা এখানে রেসে কাজ করতে এসে পরামানিক হয়ে যায়—বলতে বলতে ভরত বলবে—দেখুন না—আমার বড়াে ছেলেটার জন্যে যদি কিছু করে দিতে পারেন। অফিসে পিওন-টিওন। আপনারা তাে বড়াে অফিসার—
কে বলেছে? হা। সব জানি আমি। এসব কি চাপা থাকে স্যার। আপনি বললে হবে —এ কি হতে পারে?
যত বলি—না ভাই আমি কিছু নয়। আমার কথায় চাকরি হবার নয়—তত ভরত হাসে। শেষে বলে—আপনি বলে দিলে ঠিক কাজ হয়ে যাবে। আপনার তাে অনেক জানাশােনা—আপনি বলে দিলে ঠিক হয়ে যাবে। যখন এ-পাড়ায় প্রথম এলেন—তখনই লােকে বলাবলি করছিল—অসীম ক্ষমতা আপনার।একটু ম্যাসেজ করি?
না ভাই। আবার তুমি পয়সা বাড়িয়ে দেবে। এক দাড়ি কাটতেই যদি চার টাকা লেগে যায়—
আপনার যা ইচ্ছে দেবেন।-বলেই ঠাকুর ভরত সিং তার নিজের ধান্ধায় মাথা, ঘাড়, হাত দুখানা নিয়ে টানাটানি–টেপাটেপি শুরু করে দেয়। জ্বর ওপর মােলাম করে দুহাত বুলােতে বুলােতে কথা জুড়ে দেয়। ব্যানার্জিবাবু—চেনেন তাে—মিলিটারির কর্নেল—ওই বকুলগাছের গায়ে দোতলা—রিটায়ার করে এসে আমায় দিয়ে চুলের ছাঁট দিলেন। প্রথম দিনই সাত টাকা। ভাবুন সেই শস্তার বাজারে সাত টাকা—
আমি কিন্তু এই চড়া বাজারেও সাত টাকা দিতে পারব না। বললাম তাে—আপনার যা ইচ্ছে হয় দেবেন। আমি তাে এ-পাড়ায় প্রথম এসে মাথা পেয়েছি দুপয়সায়। গাল এক পয়সায়—
তাই রেট ছিল বুঝি?
তবে কী। আমার বাবা এ-পাড়ায় চুল কাটতে এসে দু-তিনদিন পরে বাড়ি ফিরত। আমরা তখন ছােটো।
এত দেরি করে ফিরত কেন?
বাঃ। তখন তাে কলকাতায় এত পরামানিক ছিল না। বাবা এ-পাড়ায় চুল কাটতে ঢুকত যখন-তখন তাে চারদিকে সাহেব গিজগিজ করছে। বাঙালি খুঁজে পাওয়া যায় না এখানে তখন। কাটতে কাটতে বাবা বাঙালিপাড়ায় ঢুকে পড়ত। সেই বারুইপুরে গিয়ে থামত। ফিরত লাউ, কুমড়াে, বেগুন নিয়ে। অনেকে পয়সার বদলে তাই দিত তখন।
এসব কতদিনকার কথা?
তা ধরুন পঞ্চাশ ষাট বছরের আগের কথা। আমি স্কুলে যাচ্ছি সবে। তা আমিও প্রায় পঞ্চাশ বছর আপনাদের চুল কাটছি।
তােমার বয়স কত? গেস করুন। পারব না।
আমার এখন সিক্সটিনাইন চলছে। যৌবনে আমার পাথরের মতাে শরীর ছিল। ভদ্রঘরের মেয়েরা—পাঞ্জাবি-বাঙালি–কে না? সবাই আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইত।
তুমি কী করতে?
আমার লজ্জা করত। কাটিয়ে দিতাম। তখন টালিগঞ্জ ফাঁড়িতে পুলিশদের সঙ্গে কসরত করি। এই গানটা শুনেছেন? শুনুন তবে
কী আর করা যায়। মাথাটি তখন ভরতের হাতে।
ভরত গান ধরল—
হায় চাদ।
তুমি শুধু জানাে
মাের মনের ব্যথা— এ গান তাে স্বপনকুমার গেয়েছিল। রেকর্ডে শুনেছি। ঠিক ধরেছেন। আরেকখানা শুনুন—
জুলপিতে লাগছে— ওঃ। বলেই হাত সরিয়ে গান ধরল ভরত
এ জীবনে আর কিছু ভালাে লাগে না।
আজ তুমি নেই বলে গাে
আজ তুমি নেই–
ঝপ করে গান থামিয়ে কঁচি বের করল ভরত। আপনার পেছনটা একটু গােলমাল হয়ে আছে।
থাকুক ভরত। আমি এখন বেশি পয়সা দিতে পারব না। পরে দেবেন। তাই বলে মাথাটা এমন করে থাকবে? হাতের কঁচি চলতে লাগল। আর মুখে কথা।
এসব জায়গা কী ছিল বলুন। একশাে টাকা করে কাঠা সেধেছে। কিনিনি। আজ যদি কেনা থাকত দু-কাঠা তাে আমি এখন দু-লাখ টাকার মালিক। কে কাঠের বাক্স নিয়ে ঘুরত সারাদিন।
কী করতে তাহলে?
একখানা বাড়ি হাঁকিয়ে একতলায় ভাড়াটে বসিয়ে সেই পয়সায় পায়ের ওপর পা দিয়ে থাকতাম। উঃ। কী ভীষণ পাল্টে গেল চোখের সামনে। সােনার ভরি আঠারাে টাকা। রুপাের ছ-আনা। দুধের সের দু-পয়সা। দুধ কেউ কিনত না। সবার বাড়িতে গােরু। আমাদেরই ছিল দশটা গােরু। সব দিশি। ওদের নিয়ে চরাতে যেতাম যে মাঠে—তার নাম এখন নিউ আলিপুর। কফির চাষ হত ওখানে। বিয়ে করলাম অল্প বয়সে। কিছু জানতাম না।
তার মানে ভরত?
সত্যিই কিছু জানতাম না স্যার। কেউ দেখিয়ে দেবারও মুরুব্বি ছিল না। বিয়ের আটবছর পর ছেলে হল। মাথার ওপর মুরুব্বি থাকলে তাে শস্তায়
জমি ধরে ফেলতাম। শুনুন আরেকখানা গান—
ভরত। এই তুমি গান শুনিয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে সারা গা টিপে দিচ্ছ। শেষে পয়সা চাইবে পাঁচ টাকা
ভরত কোনাে জবাব না দিয়ে নাকি সুরে গলা ছাড়ল—
দিল আপনা প্রীত পরায়ই
কিসনে হ্যায় এ রাত বনায়ই
পানিমে এ আগ লগায়ই
আঁখিয়ামে দীপ জ্বালায়ই-ই-ই কেমন?
গানটা সুন্দর না ?
শেষে বলতেই হয়—তােমার গলায় শুনতে যেন আরও বেশি ভালাে লাগল।
যৌবনে আমি ভালােই গাইতাম স্যার। মেয়েরা গান শােনার জন্যে মুখিয়ে থাকত।
শােনাতে? মাঝেমধ্যে শুনিয়েছি বৈকি! ক-জনকে? তা দু-চারজনকে তাে নিশ্চয়। তাদের নাম মনে পড়ে? এই ধরুন—মঞ্জু, শুভ্রা—সব নাম মনে নেই। বড়াে একটা মুশকিলে পড়েছি— কীসের মুশকিল?
দেখুন তাে ওই সাদা বাড়ির ছেলের বিয়ে। আবার একই দিনে একই লগ্নে ফ্ল্যাটবাড়ির এক ইঞ্জিনিয়ার ছেলের বিয়ে। দু-জায়গাতেই যেতে বলেছে—
একটায় যাবে।
তা হয় নাকি? দু-জায়গাতেই ধুতি দেবে। টাকা দেবে। বিয়ের বিদায় তাে বােঝেন। ওটাই আমাদের একটা ফাউ।
ছেলেকে শিখিয়ে নেবে।
কচি ধরতেই শিখল না। বলেন কেন? সাদা বাড়ির ছেলেটার অন্নপ্রাশন, পৈতে—দুয়েতেই ছিলাম। এবার বিয়েতেও যেতে হবে। কম দিনের সম্পর্ক।
তাহলে ওটাতেই যাও।
তা হয় না। ফ্ল্যাটবাড়ির বিয়েতে নাপিত বিদায় নগদেই দেবে একশাে টাকা। একটা বিয়ে হবে যাদবপুরে—অন্যটা সেই সুখিয়া স্ট্রিট তাহলে ট্যাক্সি ভাড়া কর।
এটা মন্দ বলেননি কিন্তু স্যার। আপনাদের হল গিয়ে পড়াশুনাে করা পাকা মাথা।
আমি কিন্তু ভরত আজ দুটাকার একটি পয়সাও বেশি দিতে পারব না। সেই ভেবে কথা বল।
এই ঠাকুর ভরত সিং বা সিংহ সাদা বাড়ির বিয়ের দিন হাজির হল কালাে কুচকুচে মাথা নিয়ে। সঙ্গে তিন ছেলে এক মেয়ে। স্বয়ং বর আপত্তি করল। চন্দন মাখা অবস্থায় সে চেঁচাতে লাগল। কথা হয়েছে—একজন নাপিত যাবে—
সঙ্গে। তার সঙ্গে আরও চারজন ? | ভরত সিংহ নিজেই এগিয়ে গিয়ে বরকে বলল, তুমি গাড়িতে ওঠো না। আমরা উনচল্লিশ নম্বর বাসে চলে যাবাে।
বর গাড়িতে ওঠার মুখে বেঁকে বসল, তাই বলে পুরাে ব্যান্ডপার্টি নিয়ে হাজির হবে?
পুরাে কোথায় দেখলে! আরও দুটোকে রেখে এসেছি। তুমি চিন্তা করাে । মন দিয়ে বিয়ে করােগা। আমার ব্যান্ডপার্টি আমি ভিড়ের ভেতর ঠিক ম্যানেজ করে নেব। কত লােক বিয়েতে। তার ভেতর কে কার—খোঁজ নিচ্ছে—
লােকে চুল দাড়ি কাটে সকাল সকাল। কিন্তু ভারতের জন্যে এ পাড়ার স্বভাব খারাপ হয়ে গেছে। সে বেলা আটটায় যেমন দেখা দেয়—তেমনি দেখা দেয় বেলা দশটা, এগারােটা, বারােটা, একটা, দুটো পর্যন্ত। ওদিকে আবার বিকেল চারটে থেকে সন্ধে অব্দি সে যেকোনাে বাড়ি গিয়ে বিনীতভাবে জানান দেবে—আমি এসেছি। হাতের কাজ করতে করতে গলায় গান বা গল্প তার থাকবেই। আর এই পথেই খদ্দেররা তাকে জলখাবার, লাঞ্চ, বিকেলের টি, সন্ধেরাতের ভাজাভুজি টুকিটাকি জুগিয়ে যায়।
দুপুরে ভরত কষ্ট করে আর বাড়ি ফেরে না। ফেরাফিরি সেই সন্ধে রাতে।
কত দিতে হয় বউয়ের হাতে? | দিন গেলে কম করেও পঁচিশটা টাকা স্যার। আমরা তাে আটখানা পেট। রােজ চালই লাগে দুকিলাে। সেই সঙ্গে শস্তার আলু অন্তত এক-দেড় কেজি। বেগুন, ঝিঙে, পেঁয়াজ আছে। আছে ডাল। নুন—তেল।
মাছ?
মাছ! হাসালেন স্যার। বিয়ে শ্রাদ্ধে নেমন্তন্ন পেলে ওদের নিয়ে যাই। পাছে আমিষ ভুলে যায়। বাবার আমলের ভাড়া বেড়ে বেড়ে এখন একখানা আটহাতি ঘরের ভাড়া দাঁড়িয়েছে মাসে আশি টাকা। ইলেকট্রিক আলাদা। পাশেই খাটাল। কিন্তু ফ্যামিলি নিয়ে কোথায় যাব? ওরই ভেতর দিন কাটাচ্ছি। বড়াে ছেলেটার—
আজও কিছু হল না।
তখন যদি এ-পাড়ায় জমি ধরে রাখতে—
সে-কথা আর বলতে। কেউ বুঝতে পারিনি। ওই যে দাস সাহেবের বাড়ি দেখছেন—-ওটায় থাকত খাস সাহেবরা। লালচুলাে। তাদের বাবুর্চি সব বার্মিজ। সাহেবরা সন্ধে হলে নাচত। আর বাবুর্চিরা সাহেবদের হাতে হাতে আনন্দ শরবৎ এগিয়ে দিত–
কী শরবত? আনন্দ শরবত। খেলে খুব আনন্দ হয়। তুমি জানলে কী করে ভরত?
বাবুর্চিরা যে আমায় এক গ্লাস খাইয়ে দিল। একবার খেলে সারাজীবন মুখে হাসি থাকে। খাবার পর মনে যা আনন্দ হয়েছিল কী বলব স্যার। ক-দিন তাে ফুর্তি চেপে রাখতে পারি না। খালি খিকখিক করে হাসি। সবসময় মনের ভেতর আনন্দের বাতাস বয়ে যাচ্ছে।
তাই নাকি?
তবে বলছি কী। দেখেন না—খাস সাহেবরা ওই আনন্দ শরবত খেয়ে সবসময় ফুর্তিতে ভাসে। নাচে। শিকার করে। কুকুর নিয়ে বেড়ায়। দৌড়ােয়। চাই কি ফুর্তিতে গড়াম করে গুলি করে বসল।
তুমিও দৌড়তে নাকি ফুর্তিতে? না। তা দৌড়ােইনি বটে। তবে দেখেছেন নিশ্চয় লক্ষ করে—না হেসে আমি পারি না। সব সময় আমার মুখে হাসি লেগে থাকে। বাবা মারা গেল। আমি কাদতে পারলাম না। দুঃখ করতে জানি না তাে। সেই চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছর আগে বার্মিজ বাবুর্চিদের হাতে আনন্দ শরবত খেয়েছিলাম—তার ফল। একটানা বছর-দশেক তাে আমার মুখে পাকাপাকি জুই ফুলের গন্ধ ছিল। শরবতটা এত স্ট্রং ছিল—
যাঃ ! কে বলেছে?
আপনার বউমা স্যার। এখনাে নাকি এ গন্ধটা আমার মুখে মাঝে মাঝে ফিরে আসে। ওই শরবতটা খেয়ে জীবনে আমি কোনােদিন দুঃখ করতে পারিনি স্যার। ইংলিশ-জার্মান গ্রেট ওয়ার গেল—আদিগঙ্গার ওপর নবাবদের মান্ধাতার ব্রিজ পাল্টে সিমেন্টের পােল হল, ব্ল্যাকআউট এল, জাপানি বােমা পড়ল খিদিরপুরে—আমি কোনােদিন দুঃখ করতে পারলাম না। দিশি, বিলিতি, গােরা, কালাে—সবার চুল দাড়ি কেটে বেড়ালাম মহানন্দে
এ-পাড়ার সবাই ঠাকুর ভরত সিংহের দিকে তাকিয়ে ভাবে জুই ফুলের গন্ধ, আনন্দ শরবত, ছ-আনা ভরি রুপাে, দু-পয়সা সেরের খাঁটি দুধ, খাস কলকাতায় একশাে টাকায় কাঠা আর গােরু চরানাের মাঠ বলতে এখনকার নিউ আলিপুর—যেখানে সরেস মাটিতে পেল্লাই কফি হত।
এরই ভেতর মাথা বা গাল বুঝে ভরত বলে—একটা গান গাই তাহলে। দিল এক মন্দির দেখেছিলেন ?
দিলীপকুমার ছিল। অপােজিটের হিরােইনটার নাম মনে আসছে না।
দেখ হামে আওয়াজ না দে না হােক বেদরদ জামানে— ছােড় চলে হাম আজ তুঝকো দুনিয়া নেহি বসানে—
হাে বেদরদ জামানে। গান থামিয়েই ঠাকুর ভরত সিং বলল, চোদ্দোটা টাকা দিন—
জার্মান স্টিলের এমন একখানা ক্ষুর আনব দেখবেন–আলাদা করে তুলে রাখবেন। দাড়ির একটা দানাও পাবেন না কামাবার পর।
গরম পড়তে না পড়তেই এই ভরত সিং কী এক আশ্চর্য প্রক্রিয়ায় তিন পাগল ভাইকে পর পর নেড়া করে ফেলত। খুবই অবলীলায়। ঠিক যেমন গুরুদশার পর লােকাল বড়াে বড়াে মানুষের মাথা সে অনায়াসে কামিয়ে দেয়।
মুশকিল বাধল সাধারণ একটি সরল মিথ্যে কথায়। ভরত চাইলেও সব মাথা তার হাতের নীচে আসত না। কেননা, কেউ কেউ অফিস ফেরত রাস্তাঘাটের সেলুনে চুল কেটে বাড়ি ফিরত। কেউবা ভরতকে সময় দেবার সময় পায় না। সারা পাড়ার প্রায় হাজার দুই মাথার সবটাই ভরতের হাতে আসা সম্ভব নয়।
এই সুযােগে গা ম্যাসাজ করাতে করাতে পাড়ারই কোনাে অল্পবয়সি আমুদে খদ্দের দাড়ি কামাবার পর আয়নায় তাকিয়ে ঠাকুর ভরত সিংকে বলল, ভারী সুন্দর এক পরামানিক আসছে আজ ক-দিন। দিব্যি চুল কাটে— গােড়ায় ভরত নিজের ওজন মাফিক গম্ভীর হয়ে থাকল।
তাই দেখে সেই আমুদে খদ্দের ভাবলেশহীন মুখে বলল, ফিটফাট পােশাক। নতুন ক্ষুর। ক্রিম ছাড়া অন্য কিছু ব্যবহার করে না। দিব্যি কামায়। একি তােমার ভেঁতা ক্ষুর ! ভাঙা সাবান !! | এতেও ভরতকে টলাতে না পেরে সেই খদ্দের বলল, তুমি আমাদের পুরনাে লােক ভরত। কিন্তু না বলে পারছি না—যেমন হাত—তেমনি স্মার্ট চালচলন। হাজার হােক তুমি বুড়াে হয়ে গেছ। আর সে হল গিয়ে ইয়ংম্যান!
কখন আসে বলুন তাে?
আসে ভাই—সময়মতােই আসে!! | ঠাকুর ভরত সিং যেন পাগল হয়ে উঠল। এ পাড়ার মাথাগুলাে প্রায় পঞ্চাশ বছর তার একচেটিয়া। এসে গােপনে গােপনে এভাবে সেসব মাথার দখল নিচ্ছে? বলুন তাে—কোন বাড়ির চুল কেটেছে?
সে তুমি পাড়ার মােড়ে দাঁড়িয়ে থাকলেই দেখতে পাবে। তােমার হাতে কাটা মাথা তাে তুমি চিনতেই পারবে। বাদবাকি তুমি এবার বুঝে নাও !!
ক-দিনের ভেতর দেখা গেল ঠাকুর ভরত সিং কেমন আনমনা। একটা বাড়ি চুল কাটে তাে বাইরে খানিকক্ষণ রাস্তায় রাস্তায় দাঁড়ায়। ঢলঢলে প্যান্টলুনের বদলে মাড় দেওয়া কড়কড়ে ইস্ত্রির ক্রিজ। কাঠের বাক্সটা যেন আগের চেয়ে ঝকঝকে। নতুন টিউবের ক্রিম। সে ভরত আর নেই।
তারই খোঁজাখুঁজিতে সারা পাড়াও যেন নড়ে-চড়ে বসল। নতুন পরামানিককে কেউ দেখেনি। কিন্তু ভারতের হাবভাবে অনেকেই ভাবল, সত্যিই বুঝি পাড়ায় নতুন কোনাে পরামানিক এসেছে–যে কিনা ইয়ংম্যান, স্মার্ট। আড়াইশাে তিনশাে ফ্যামিলির সব বাড়িতে ঢুকে ঢুকে তাে দেখা যায় না—সে এসেছে কি না। সে চুল কাটছে কিনা।
পাড়ার অনেকেই সেই অদেখা পরামানিক আসছে বলে ভেবে নেওয়ায়— ভরতও ভেবে নিল—সত্যিই একজন স্মার্ট ইয়ংম্যান এ-পাড়ার বাড়ি বাড়ি চুল কেটে বেড়াচ্ছে কিন্তু তাকে মুখােমুখি পাওয়া যাচ্ছে না।
এরপর ঠাকুর ভরত সিং শেষরাতে এসে হাজির হতে লাগল। তখনাে আকাশে তারা। রাস্তায় দিশি কুকুর। রাত পাহারার নাইট গার্ডরা লাঠি ঠুকে ঠুকে ঘরে ফিরছে। মর্নিংওয়াকাররা বেরিয়ে পড়ল বলে।
নদের চঁাদ নামে নাইট গার্ডটির পেট ভর্তি পিলে। ন্যাবা হয়ে সারাজীবনের জন্যে চোখ হলদে। নতুন বিয়ে করেছে। বয়স এই ছাব্বিশ সাতাশ। বিধবা মা তিনবাড়ি বাসন মাজে। সে শেষরাতের জ্যোৎস্নায় ঠাকুর ভরত সিংকে বসিয়ে বলল, তুমি যখন ওই কয়লার দোকানের দিকে চুল কাটতে কাটতে চলে যাও-সে-ব্যাটা পরামানিক তখন ওই বকুলগাছের নীচে বাক্স হাতে এসে দাঁড়ায়—
কেমন দেখতে বলতাে নদের চাঁদ দেখতে এমন কিছু নয়। তবে বাক্স হাতে ফিক ফিক করে হাসে চারদিক তাকিয়ে। সারারাত ধরে পড়ে থাকা বকুলফুলে গাছতলায় তখন ঘিয়ে সাদা রঙের চাদর। পায়ের কাছে পড়ে থাকে সে চাদর লােকটার ড্রেস কীরকম? আমার গালখানা কামাও তাে আগে-পয়সা নেই কিন্তু
তাতে কী।—বলে বউনিতেই বাকিতে গালে সাবান লাগাল ভরত। ক-দিন আগেও এ-কাজ তাকে দিয়ে করানাে যেত না। এখন সে প্রায়ই অন্যমনস্ক হয়ে যায়। গালে ক্ষুর টানতে টানতে আবার জানতে চাইল ভরত, ড্রেস কীরকম?
মামুলি ভরতদা। একদম মামুলি। তবে হ্যা—
কী ? নদের চাঁদ বা অন্য নাইট গার্ডরা কেউই রাতে পাহারা দেয় না। মাদুর এনে স্ট্রিট লাইটের নীচে রাত বারােটা সওয়া বারােটা নাগাদ শুয়ে পড়ে। মর্নিংওয়াকাররা বেরিয়ে পড়ার আগে ঠিক ব্রাহ্মমুহূর্তে ঘুম থেকে উঠে ওরা লাঠি ঠুকে ঠুকে বাড়ি ফিরে যায়। পাহারা দেয় রাস্তার কুকুররা। ওদের মাদুরের পাশেই কুণ্ডুলি পাকিয়ে পড়ে থাকে সারারাত। একদিন নিশুতি রাতে নাইট গার্ডরা অঘাের ঘুমের ভেতর ট্যাক্সি চাপা পড়ছিল। হেডলাইটের আলাে দেখে ভাগ্যিস দিশি কুকুরগুলাে চেঁচিয়ে ওঠে। নয়তাে ড্রাইভার ব্রেক কষতেই ভুলে যেত। এখন পাড়ার জুয়াড়ি মাতালরা জানে—নাইট গার্ডরা কোথায় ঘুমােয়। তারা বকুল গাছটায় এসে ট্যাক্সি থামিয়ে দেয়।
ভালাে ঘুম হওয়ায় নদের চঁাদ চোখে আরাম পাচ্ছিল। সেই সঙ্গে ভােররাতের বাতাস। সে ফুরফুরে কথা দিয়ে সেই অদেখা পরামানিকের পােশাকের খতিয়ান দিতে লাগল। কেননা—ভােরের পয়লাতেই বিনা পয়সায় গালটা কামানাে হয়ে যাচ্ছে। চাই কি সকালের চা এমনিতেই খাওয়াবে মিষ্টির
দোকানি। তার দোকানও যে পাহারা পাচ্ছে ফি রাতে।
নদের চাঁদ বলল, এক একদিন এক এক রকম পােশাক পরে। কাল দেখি মালকেঁচা দিয়ে ধুতি পরেছে। গায়ে বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবি। হাতের বাক্সটা আগাগােড়া সাদা রঙ করেছে।
ভরতের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ব্যাটা বহুরূপী।
তা নয়তাে কী! শুনলে আশ্চর্য হবে—এরপর মাথায় একটা তারের আঙটায় ময়ূরের পেখম এমন করেই বসিয়েছে—যেন মুকুট! কোনাে লজ্জা নেই!!
ভরত গম্ভীর হয়ে বলল, বেহায়া!
তারপর মাসখানেকের ভেতর লতায় পাতায়–নানান গেরস্থের নানান কথায় সেই অদেখা যুবক নরসুন্দরটি ঠাকুর ভরত সিংয়ের চোখে সর্বত্রগামী। কিন্তু অদৃশ্য এক ভগবান হয়ে দাঁড়াল প্রায়। ভরত এ-মােড়ে—তাে সে ও-মােড়ে। ভরত এ-বেলায় এখানে তাে সে ও-বেলায় সেখানে। একটুর জন্যে তাকে ধরতে পারছে না ঠাকুর ভরত সিং।
সারা পাড়াকে যে ভরত হেসে-গল্প ফেঁদে ভাসিয়ে রাখত—সেই ভরত ওই অদৃশ্য বহুরূপী যুবক অনধিকারীকে পাকড়াও করার জন্যে হন্যে হয়ে উঠল। চুল দাড়ি কাটে—কিন্তু আগের সে মন আর নেই কাজে। সব সময় যেন তক্কে তক্কে থাকে। এই বুঝি সেই ছােকরা পরামানিককে ধরে ফেলে। গেরস্থবাড়ির ছেলে-ছােকরাদের ঠাট্টাও বােঝে না। তারা ভরতকে দেখলেই এই বলে নাচায়–ইস একটু আগে যদি আসতে।
কেন? কেন? একটু আগেও এখানে ছিল লােকটা কোনদিকে গেল? কোনদিকে? তুমিও এলে—সেও ছটফট করে চলে গেল। কোনদিকে গেল বলুন তাে?
ভরতের চোখ ছােটো হয়ে শিকারি হয়ে ওঠে। ছেলে-ছােকরারা হাসি চেপে বলে—দ্যাখাে গিয়ে ফ্ল্যাটবাড়িগুলােয় ঢুকল কিনা। ওখানে আবার সব সাহেব খদ্দের। মােটা রেট। মােটা বকশিস তাে ওসব বাড়িতে
ফ্ল্যাটবাড়ি দুটো। রাস্তার মােড়ে—দু-ধারে। কোনটায় খুঁজবে? দুটো বাড়িই পাঁচতলা। এক এক তলায় আট দশটি করে ফ্ল্যাট। সব ফ্ল্যাটেরই দরজা বন্ধ থাকে। বেল টিপলে তবে খােলে। কোন ফ্ল্যাটের বেল টিপবে ভরত?
তবু তাে ছেড়ে দেওয়া যায় না। আশকারা পেয়ে গেছে। চিড়বিড় করে ছুটতে থাকে ঠাকুর ভরত সিং। একতলা, দোতলা, চারতলা, পাঁচতলা। তড়িঘড়ি সিঁড়ি ভাঙতে হয় ভরতকে।
ডানহাতের ফ্ল্যাটবাড়ির আটনম্বরে বেল টিপতেই ইঞ্জিনিয়ারিং স্টুডেন্ট স্নেহাশীষ বলল, ও ভরতদা?
ভরত তখন কয়েক বাড়ি বেল টিপে হাঁপাচ্ছে। খােলা দরজার ভেতর দিয়ে আট নম্বরের অনেকটা দেখা যায়। সুন্দর সােফা। গান শােনার যন্ত্র। মাটির ঘােড়া। পেতলের ঘড়া। কাগজের ঢাউস ফুল। দেওয়ালে মাছ মুখে বেড়ালের ছবি। ভরত কোনােরকমে বলতে পারল, এখানে এসেছিল?
স্নেহাশীষ বলল, এইতাে নখ কেটে দিয়ে চলে গেল—কোনদিকে গেল বলতে পারেন? খেয়াল করিনি ভরতদা।
ভরত খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। তার নাকের সামনে আট নম্বরের দরজা বন্ধ হল। ওপরে ওঠার সিঁড়িগুলাের ঢেউ খেলানাে তলপেট দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। তেতলায় ওঠার সিঁড়ির তলপেট। তার ঠিক ওপরেই চারতলায় ওঠার সিঁড়ির তলপেট। তার ওপরে পাঁচতলায় ওঠার—
ভরত পড়ে যাচ্ছিল। এখনাে তার কয়েক তলা সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হবে। এখানে লিট নেই। আবার নেমে গিয়ে রাস্তার ওপারের ফ্ল্যাটবাড়িটায় ঢুকে এক এক
তলায় আন্দাজে দোরে দোরে বেল টিপতে হবে।
নিজেকে সামলে নেবার জন্যে সে চওড়া সিঁড়ির একটা ধাপে গিয়ে বসল। দারুণ হাওয়া সেখানটায়।
কতদিন সে ঠিক মতাে হাওয়া খায়নি। বড়াে ফ্ল্যাটবাড়ির খােলামেলা চওড়া সিঁড়িতে বসে ভরত রাস্তায় দাঁড়ানাে কৃষ্ণচূড়ার মাথাটা খুব সহজেই দেখতে পেল, গাছটা উঁচু দোতলা অব্দি মাথা ধরে উঠেছে।
পরদিন কিন্তু ঠাকুর ভরত সিং কাকভােরে পাড়ার মাথায় দেখা দিল না।
সে আগে যেমন আসত—সেই সাতটা সওয়া সাতটায় মিষ্টির দোকানের সামনে এসে হাজির হল। তিন ভাই পাগল তখন মহানন্দে বাসি জিলিপি ভেঙে ভেঙে কাকদের জন্যে শূন্যে ছুঁড়ে দিচ্ছিল।
হকাররা অবাক হয়ে দেখল, ভরতের কোনাে তাড়াহুড়াে নেই। ধীরেসুস্থে এসে সে খদ্দেরদের বেঞ্চে হকারদের পাশেই বসে গেল। বসেই আর পাঁচজন খদ্দেরের মতােই হাঁক দিল, দেখি—এক ভড় চা দাও, দোকানিও অবাক।
চায়ের অর্ডার দিতে গিয়ে ওঠানাে হাতের ডগায় ভরত একটা আধুলি ধরে থাকে।
কী ব্যাপার ? দোকানিকে ভরত বলল, তােমার তাে খরচার চা। আজ থেকে পয়সা নেবে ভাই।
এবার সবার চোখ পড়ল ভরতের কাঠের বাক্সে। তাতে সাদা রঙ দিয়ে পরিষ্কার করে লেখা–আপনার পরিচয় নিজের কাছে জানিবেন।
বাঙালি হকাররা সেই ক-টি কথার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। এ কী কথা লিখেছেন ভরত ভাই? ভরত কোনাে রা করল না। চুপ করে ফিকফিক করে হাসল। শেষে বলল, যা বােঝাে ভাই—আগুনের মতােই বেলা দশটার ভেতর সারা পাড়ায় কথাগুলাে ছড়িয়ে পড়ল। অনেকেই বলল, এ কি কোনাে ধাঁধা? না, কোনাে গুরুবাণী ?
আড়াইশাে-পৌনে তিনশাে গেরস্থ সামান্য ওই পাঁচটি কথার ভেতর খাবি খেতে লাগল। ভরতের কোনাে গুরু আছে—আগে তাে কোনােদিন শােনা যায়নি। তবে কি ভরত সাধু হয়ে যাচ্ছে? হিমালয়ে চলে যাবার আগে সে তার খদ্দেরদের যাচাই করে দেখছে না তাে?
আপনার পরিচয় আপনার কাছেই জানিবেন।
কী মানে হতে পারে এই কথা ক-টির? কেউ কেউ ইংরেজিতে তর্জমা করে মানে বের করার চেষ্টা করতে লাগল। তবে কি ভরত বলতে চায়—আপনার ব্যবহারই আপনার পরিচয়।
হবেও বা। মানুষ মাত্রেরই নিজের কাছে তার আত্মার পরিচয় থাকে। ভরত কি তাহলে ইদানীং আত্মা বা আধ্যাত্মিক পথের পথিক?
এইরকম সব জিজ্ঞাসা সারাটা পাড়ায় কুরে কুরে খেতে লাগল। ভরত কেন রাতারাতি সাইনবাের্ড লিখিয়েদের দিয়ে ওই কথা ক-টি তার কাঠের বাক্সে লেখাল ?
নিশ্চয় এর ভেতর কোনাে গূঢ় সংকেত লুকিয়ে আছে। শুধু খুঁজে বের করে দেখার অপেক্ষা। আজও এ-পাড়া সেই সংকেত খুঁজে পায়নি। তাই আজও ঠাকুর ভরত সিং এ-পাড়ার কর্কটক্রান্তি—আবার মকরসংক্রান্তি বটে। সে আগের মতােই বিয়ে পৈতেয় ডাক পেলে নিজের ব্যান্ডপার্টি সঙ্গে নিয়ে নেমন্তন্ন রাখতে আসে।
শুধু সে আর সেই অদেখা বহুরূপী যুবক নরসুন্দরটির খোঁজ নেয় না। তার কথা কোনাে গেরস্থ আর তােলেও না।