ঠাকুর পরিবার
কি ইউরোপীয়, কি দেশীয়, বাঙলার সকল সমাজের ঘরে ঘরে এই পরিবারটির নাম সুপরিচিত। পরিবারটির রাজনৈতিক, সামাজিক গুণাবলী, অতুল ঐশ্বর্য এবং সর্বোপরি সুপ্রসিদ্ধ দ্বারকানাথ ঠাকুরের উদার দানশীলতার জন্য পরিবারটি উচ্চস্থান অধিকার ও রক্ষা করে চলেছেন। দ্বারকনাথ তো তাঁর দানশীলতার জন্য ইউরোপে ‘ভারতীয় প্রিন্স’ নামে পরিচিত ছিলেন। বহু মানবিক গুণের সমাবেশ হয়েছিল এই মানুষটির মধ্যে; সে সব গুণাবলীই বহুধা বিভক্ত হয়ে যেন তাঁর বংশধরদের মধ্যে রক্ষিত হয়েছে। সম্পদে, সামাজিকতায়, জনহিতৈষণায় ও দানশীলতায় বাংলার আর কোন পরিবার সম্ভবত এই পরিবারটির সঙ্গে তুলনীয় নয়। এই প্রদেশে এমন জেলা খুব কম আছে; যেখানে ঠাকুর পরিবারের কোন না কোন শরিকের জমিদারী না আছে।
ঠাকুর পরিবার দাবী করেন যে, আদিশূর যে-পঞ্চব্রাহ্মণকে কনৌজ থেকে আমন্ত্ৰণ করে এনেছিলেন, তাঁদের অন্যতম ভট্টনারায়ণ এঁদের আদিপুরুষ। ১০৭২ খ্রিস্টাব্দে তিনি এদেশে বসবাস করতে আরম্ভ করেন। ভট্টনারায়ণ কয়েকখানি সংস্কৃত পুস্তকের প্রণেতা। এগুলির মধ্যে আছে ‘কাশীরমণ মুক্তিবিচার’, ‘প্রয়োগরত্ন’, ‘বেণীসংহার নাটক’ এবং ‘গোভিল সূত্ৰ ভাষ্য’।
ধরণীধর : ভট্ট নারায়ণের নবম পুরুষ ধরণীধর মনুসংহিতার ওপর একখানি ভাষ্য লেখেন। ভাই বনমালী ‘ভক্তি রত্নাকর’ ও ‘দ্রব্য শুদ্ধিপ্রকরণ রহস্য’ নামক ধর্মগ্রন্থ প্রণয়ন করেন। একাদশ পুরুষ ধনঞ্জয় (ওরফে পোষো) বৈদিক শব্দের একখানি নির্ঘণ্ট প্রকাশ করেন। বল্লাল সেন বা লক্ষ্মণ সেনের শাসনকালে তিনি বিচারকের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁর পুত্র হলায়ুধ ছিলেন লক্ষ্মণ সেনের প্রধান মন্ত্রী এবং ‘ব্রাহ্মণ সর্বস্ব’, ‘ন্যায়, পন্ডিত, শিব, মৎস্যসূক্ত তন্ত্র,’ ‘অভিধান রত্নমালা’ ও ‘রবি রহস্য’ গ্রন্থের প্রণেতা। তাঁর পুত্র বিভূ’র দুই পুত্র, ১. মহেন্দ্র এবং ২. গণেন্দ্র; এঁদের দুজন থেকেই দুটি বংশধারার উৎপত্তি হয়েছে। যে বংশের কথা আমরা এখানে লিখছি তার প্রতিষ্ঠাতা মহেন্দ্র। মহেন্দ্রের পঞ্চম পুরুষ এবং ভট্টনারায়ণের অষ্টাদশ পুরুষ রাজারাম ধৰ্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের ওপর ‘শ্রৌত সিদ্ধান্ত’ নামক একখানি গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর পৌত্র জগন্নাথ (ওরফে পন্ডিত রাজা) তিনখানি গ্রন্থ রচনা করেন, ১. অলঙ্কার শাস্ত্রের ওপর ‘রস গঙ্গাধর’, ২. মিশ্র বিষয়ে কাব্যগ্রন্থ ‘ভামিনী বিলাস’, এবং ৩. জ্যামিতি বিষয়ক ‘রেখা গণিত’। তাঁর পুত্র পুরুষোত্তম বিদ্যাবাগীশ ‘প্রয়োগ রত্নমালা’, সংস্কৃত অভিধান ‘ত্রিকান্ড শেষ’, ‘একস্বর কোষ’ (বর্ণমালাসমূহের অভিধান), ‘হরজোট’ ‘হর বোলি’ ‘গোত্রপ্রবর দর্পণ’, ‘মুক্তি চিন্তামণি’, ‘বিষ্ণুভক্তি’, ‘কল্পলতা’, এবং ‘ভাষা বৃতি’ রচনা করেন। এই পুরুষোত্তমই পীর আলি খাঁ নামক একজন আমিনের ভোজসভায় নিষিদ্ধ ভোজ্যের ঘ্রাণ নেওয়ায়, অন্য মতে পীর আলির সঙ্গে ভোজ্য গ্রহণ করেছিলেন এমন একজনের কন্যাকে বিবাহ করায়, তাঁকে ‘পীর আলি’ (পিরালী) দোষ লাগে। এ বিবাহের পর তিনি বসবাসের জন্য যশোহরে চলে যান। তাঁর পুত্র বলরাম ‘প্ৰবোধ প্রকাশ’ নামক একখানি ব্যাকরণ রচনা করেন।
পঞ্চানন : ইনি বলরামের পঞ্চম পুরুষ এবং ভট্টনারায়ণের একবিংশ পুরুষ। পঞ্চানন যশোহর ছেড়ে গোবিন্দপুর চলে আসেন; সে যুগের ইংরেজ ভদ্রলোকদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়, তাঁদের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। তখন ইংরেজের অধীনে চাকরি করেন এমন সকল ব্রাহ্মণকেই ঠাকুর বলে সম্বোধন করা হত, পঞ্চাননও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। এই উপাধি থেকেই পরিবারটির পদবী হয়ে যায় ‘ঠাকুর’। ইংরেজিতে বিকৃত হয়ে ঠাকুর হয়ে দাঁড়ায় ‘টেগোর’।
জয়রাম : পঞ্চাননের পুত্র জয়রাম আমিনের চাকরি করতেন। আমিন হিসাবে তিনি সমগ্র ২৪ পরগণা জরিপ করেন। কেল্লা নির্মাণের জন্য তাঁর বাস্তু অধিগৃহীত হওয়ায়, তিনি পাতুরিয়াঘাটায় বাসস্থান স্থাপন করেন। তিনি চার পুত্র, ১. আনন্দী রাম, ২. দর্পনারায়ণ, ৩. নীলমণি এবং ৪. গোবিন্দরামকে রেখে ১৭৬২তে পরলোকগমন করেন। জ্যেষ্ঠ এবং কনিষ্ঠের বংশধর নেই। মধ্যম দর্পনারায়ণের বংশধরগণ বর্তমানে ঠাকুর পরিবারের বড় তরফ এবং নীলমণির বংশ ছোট তরফ নামে পরিচিত।
বড় তরফ
দর্পনারায়ণ : জয়রামের মধ্যম পুত্র। ইনি ইংরেজি ও ফরাসী ভাষায় সুপন্ডিত ছিলেন। চন্দননগরে ফরাসী সরকারির অধীনে চাকরি করে এবং ব্যবসা বাণিজ্য দ্বারা প্রভূত ধন-সম্পদের মালিক হন। নাটোর এস্টেটের বিভিন্ন অংশ বিক্রি হতে থাকলে, তিনি রংপুরে বিরাট এক জমিদারী খরিদ করেন। তাঁর দুই বিবাহ; প্রথমা পত্নীর গর্ভে তার পাঁচ পুত্রের জন্ম হয় : রাধামোহন, গোপীমোহন, কৃষ্ণমোহন, হরিমোহন এবং পিয়ারীমোহন; দ্বিতীয়ার গর্ভে জন্ম হয় রাডলি মোহন এবং মোহিনীমোহন, তাঁর এই দুই পুত্রের। পারিবারিক গুরুকে বর্জন এবং অন্যান্য অসদাচরণের জন্য তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র রাধামোহন ও তৃতীয় পুত্র কৃষ্ণমোহনকে ত্যাজ্য পুত্র করেন। তাঁর পঞ্চম পুত্র মুকবধির পিয়ারীমোহনের জীবনধারণের ব্যবস্থা করে, এবং পারিবারিক ইষ্ট দেবতার সেবার জন্য ৩০,০০০ টাকা গচ্ছিত রেখে, তিনি তাঁর বাকি সম্পদ ও সম্পত্তি অপর চার পুত্রের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দেন ৷
গোপীমোহন : দর্পনারায়ণের মধ্যম পুত্র গোপীমোহন জানতেন কীভাবে অভিজাত একটি পরিবারের গৌরব বৃদ্ধি করতে হয়; তিনি শিক্ষা-সংস্কৃতিমূলক কাজ, দান এবং বিবেচনাপূর্ণ জনহিতৈষণা দ্বারা বংশের ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি করেন।
তাঁর জীবন ও কাজ ছিল সুখ ও সন্তোষপূর্ণ। সুখী হয়েছিলেন তিনি তাঁর গৌরবান্বিত পুত্র পৌত্রদের জন্যও। তাঁর খ্যাতিমান ছয় পুত্রের মধ্যে হরকুমার ও প্রসন্নকুমার এবং হরকুমারের পুত্রগণ রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও সাহিত্যিক উদ্যমের জন্য দেশীয় সম্ভ্রান্ত সম্প্রদায়ের গৌরবস্বরূপ। মাননীয় মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর এবং সঙ্গীতের ডক্টরেট শৌরন্দ্রমোহন বিখ্যাত পিতামহ ও পিতা অপেক্ষা কম খ্যাতিমান নন। বর্তমান প্রেসিডেন্সি (প্রাক্তন হিন্দু) কলেজে দাতাদের নামের একটি মর্মর ফলক বসান হয়েছে সেখানে গোপীমোহনের নাম আছে দ্বিতীয় স্থানে– প্রথম স্থানের অধিকারী হলেন বর্ধমানের মহারাজা।
গোপীমোহনের দুর্গাপূজা উৎসবে কলকাতার প্রধান ও বিশিষ্ট ইউরোপীয় অধিবাসীগণ যোগদান করতেন। অন্যান্যের মধ্যে জেনারেল ওয়েলেসলি (পরবর্তীকালে ডিউক অব ওয়েলিংটন) একটি পূজা উৎসবে উপস্থিত ছিলেন। এই সময় একটি মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে– টানাপাখার দড়ি ছিঁড়ে পাখাঁটি জেনারেলের কাছেই সশব্দে পড়ে যায়– সৌভাগ্যবশত জেনারেলের কোন আঘাত লাগেনি।
সাধারণের মধ্যে প্রচলিত কুসংস্কারের যে তিনি কত ঊর্ধ্বে ছিলেন– একটি দৃষ্টান্তে সেটি স্পষ্ট হবে। বিখ্যাত প্রতিকৃতিশিল্পী চিনেরী কলকাতা এলে অধিকাংশ সম্ভ্রান্ত ও অভিজাত বাঙালী কুসংস্কারবশত নিজ নিজ বা পরিবার-পরিজনের প্রতিকৃতি আঁকতে ভয় পেলেন, ঠিক যেমন ইউরোপীয়গণ উইল করতে ভয় পান, এই সংস্কারবশত যে, উইল করালে আয়ু কমে যাবে। কিন্তু গোপীমোহন এই বহু ব্যাপক কুসংস্কারের বিরোধী ছিলেন– মিঃ চিনেরীকে দিয়ে তিনি তাঁর প্রতিকৃতি আঁকিয়ে নিলেন। ঐ বংশের মাননীয় প্রসন্নকুমার ঠাকুরের বৈঠকখানায় প্রতিকৃতিখানি এখনও টাঙানো আছে।
সংস্কৃতভাষা শিক্ষা, সঙ্গীত ও শরীরচর্চার তিনি ছিলেন পৃষ্ঠপোষক। প্ৰচলিত বহু কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে হলেও, পিতৃপিতামহের ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী পূজাপার্বণ আচার- আচরণ তিনি কঠোর নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতেন– ব্রাহ্মণ, ঘটক প্রভৃতিদের উদারভাবে অর্থবস্ত্র দান করতেন। একবার রাইটার্স বিল্ডিংসে কিছু নবাগত অসামরিক (ইংরেজ) কর্মচারী একটি ব্রাহ্মণী ষাঁড়ের ওপর অযথা অকথ্য অত্যাচার চালাচ্ছিল। তাঁদের কবল থেকে তিনি ষাঁড়টিকে রক্ষা করেন। যে যুগে তাঁর এই সাহসিকতা, ধর্মনিষ্ঠা ও স্বাদেশিকতা বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছিল।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চল, এমন কি উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ থেকে আগত সঙ্গীতজ্ঞগণ তাঁর বাড়িতে সমাদৃত হতেন। তাঁর সামনে গান-বাজনার অনুষ্ঠান হত, গুণীজন পুরস্কৃত হতেন। আর দেশের সঙ্গীতশিল্পিগণ তাঁর কাছে থেকে নিয়মিত মাসোহারা পেতেন।
বিখ্যাত কুস্তীগীর রাধা গোয়ালা তাঁর বেতনভুক ছিলেন। তাঁর সুরাহ্ (শুরার বাড়ির সংলগ্ন বাগানে কুস্তীর নিয়মিত প্রতিযোগিতা হত। কলকাতায় বাণিজ্য-সংস্থা মেসার্স ব্যারেটো অ্যান্ড কোম্পানির মিঃ জোসেফ ব্যারেটো ছিলেন গোপীমোহনের বন্ধু। মিঃ জোসেফও ছিলেন কুস্তীপ্রেমিক। তিনিও কয়েকজন কুস্তীগীর রেখেছিলেন। দুই বন্ধুতে সুরাহ্ (শুরার) বাগানে কুস্তী প্রতিযোগিতা দেখতেন। দীর্ঘজীবী রাধা গোয়ালা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত গোপীমোহন এবং তাঁর পুত্রদের কাছ থেকে পেন্সন পেয়েছিলেন।
হাসির কবিতা রচয়িতা ‘লক্ষ্মীকান্ত’ এবং সমগ্র বাঙলায় গান ও কবিতা রচনার জন্য বিখ্যাত কালী মীর্জাও তাঁর কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা পেতেন। দীনদুঃখী এবং গুণীদের জন্য তাঁর দানের ভান্ডার সব সময়ই উন্মুক্ত থাকত। এককালের বিশিষ্ট ভূস্বামী পরিবারের বিশ্বনাথ চৌধুরীও দুর্দশাগ্রস্ত হওয়ায় তাঁর কাছ থেকে ভাল মাসোহারা পেতেন।
দয়ালু দানশীল গোপীমোহন নির্ভরশীল আত্মীয়পরিজনদেরও উপেক্ষা করেন নি; তাঁদের মঙ্গলের প্রতি তাঁর সবসময় দৃষ্টি থাকত। তাঁর বহুদিনের বিশ্বস্ত বৃদ্ধ দেওয়ান রামমোহন মুখোপাধ্যায়ের নামে তিনি রাজশাহীর একটি জমিদারী খুব সস্তায় কিনে প্রভুসেবার পুরস্কারস্বরূপ তাঁকেই দান করে দেন। চন্দননগরের গোদলপাড়ার অধিবাসী এই রামমোহন এই জমিদারী ভোগ করে গেছেন; তাঁর পৌত্র গোপালচন্দ্র এখন ঐ জমিদারীর জমিদার।
সরকারও তাঁকে বিশেষ শ্রদ্ধা করতেন। তাঁকে হিন্দু কলেজের ‘পুরুষানুক্রমিক গভর্নর’ নিয়োগ করা হয়; কলেজের একজন ছাত্রকে বিনা বেতনে পড়ার অনুমতিদানের অধিকার তিনি আজীবন ভোগ করেছেন।
যশোহরের রাজা বরদাকান্ত রায়ের পিতা তাঁর জমিদারীর বিরাট একটি অংশ রক্ষা করার জন্য গোপীমোহনের কাছে কার্যকরী আর্থিক সাহায্য লাভ করেছিলেন। মামলায় জেতার পর রাজা গোপীমোহনকে অশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছিলেন। সেই সময় থেকে দুটি পরিবারের মধ্যে একপ্রকারের আত্মীয়তা গড়ে ওঠে। এবং এঁদের বংশধরগণ আজও পরস্পরকে জ্ঞাতি ভ্রাতারূপে গণ্য করেন।
শোভাবাজারের রাজা রাজকৃষ্ণ দেবের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। প্রগাঢ় বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ তাঁরা পরস্পরের মধ্যে উষ্ণীষ বিনিময় করেন– সেকালে এটাই ছিল প্রকৃত বন্ধুত্বের প্রতীক। কিন্তু রাজা রাজকৃষ্ণ ও তাঁর সৎভাই রাজা গোপীমোহনের মধ্যে শরীকানা মামলায়, গোপীমোহন ঠাকুর গোপীমোহনকে সাহায্য করতে থাকেন; ফলে, দুজনের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়।
যৌবনে রাজা রাজকৃষ্ণ ধর্মীয় নিয়মনিষ্ঠা বিশেষ মানতেন না। একদিন কোন ধর্মীয় শোভাযাত্রায় তিনি খালি পায়ে শোভাযাত্রাটিকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। ঠাকুর পরিবারের সামনে দিয়ে শোভাযাত্রাটি চলবার সময় রাজা গোপীমোহন ঠাকুর রসিকতা করে বললেন, ‘কত ভূমিকায়ই অভিনয় করলে, রাজা!’ ঠাকুর পরিবারের পিরালী দোষের প্রতি ইঙ্গিত করে রাজকৃষ্ণ রাজা গোপীমোহনের মনে ঘা’ দিয়ে বললেন, ‘তা আমি করি, কিন্তু কোন ভূমিকাতেই তোমার অভিনয় তো দেখা যায় না ৷ গোপীমোহন আত্মস্থ ও গম্ভীর হয়ে নিজের উপবীতখানি ইঙ্গিতবহরূপে ঠিকভাবে টেনে দিয়ে বললেন, ‘না রাজা, কিন্তু আমি সেস্থানে আছি, তার নাগালও তুমি কখনও পাবে না।’
কিন্তু একথা ভাবলে ভুল হবে যে, তিনি বিষণ্ণ গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। আত্মপ্রতিষ্ঠ মর্যাদাসচেতন হলেও, প্রয়োজনে এবং উপযুক্ত ক্ষেত্রে তিনি রঙ্গরসিকতাও উপভোগ করতেন।
তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রদ্বয়ের বিবাহের সময় দু’তিন দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছিল; বৃষ্টির আর বিরাম নেই। প্রথামত বিয়ের শোভাযাত্রা আর বের হতে পারে না। এই সময় একজন পশ্চিমা পন্ডিত বললেন, মন্ত্রের শক্তিতে তিনি বৃষ্টি থামিয়ে দিতে পারেন। রাজা জানালেন, পারলে, তিনি মোটা পুরস্কার পাবেন।
পন্ডিত তাঁর যত মন্ত্র ছিল সবই বলে গেলেন; বৃষ্টি কিন্তু থামল না। হেসে রাজা বললেন, কই পন্ডিত বৃষ্টি তো থামল না। পন্ডিত বললেন, মেঘ থেকে বৃষ্টি ঝরে পড়া আমি বন্ধ করতে চেয়েছিলাম, সেটা করেছি; কিন্তু আমি মন্ত্র বলবার আগেই যে বিন্দুগুলো মেঘ থেকে ঝরে পড়েছিল, আকাশে থাকা সে বিন্দুগুলোকে তো আমি মেঘে ফেরৎ পাঠাতে পারি না। সেগুলোর পড়া শেষ হলেই, বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যাবে।
রাজা খুব হেসে বললেন, বৃষ্টি রুখতে না পারলেও, আপনার উপস্থিত বুদ্ধির জন্য আমার প্রতিশ্রুত পুরস্কার আপনি পাবেন। (দ্রষ্টব্য : ওরিয়েন্টাল মিসেলেনি, ১৭শ সংখ্যা, আগস্ট, ১৮৮০)।
রাজা গোপীমোহন ঠাকুর সংস্কৃত, ফরাসী, পর্তুগীজ, ইংরেজি, ফার্সী ও উর্দু জানতেন। তাঁর ঐশ্বর্য, দানশীলতা, প্রভাব প্রতিপত্তি, ক্ষমাশীলতা এবং ধর্মীয় বিষয়ে কঠোর নিষ্ঠা তাঁকে এবং এই পরিবারটিকে ভারতীয় অভিজাত সমাজে অতি উচ্চস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছে। মূলাজোড়ে ভাগীরথী তীরে তিনি দ্বাদশ শিবমন্দির ও একটি কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মৃত্যুকালে তিনি ছয় পুত্র রেখে যান : সূর্যিকুমার, চন্দ্রকুমার, নন্দকুমার, কালীকুমার, হরকুমার এবং প্রসন্নকুমার। প্রথম চারজন ছিলেন নিঃসন্তান।
হরকুমার : গোপীমোহনের পঞ্চম পুত্র হরকুমার অত্যন্ত নিষ্ঠাবান হিন্দু ছিলেন। উচিত অনুচিত কার্যকলাপ সম্পর্কে সচেতন হরকুমার সরল সাদাসিধা জীবনযাপন করতেন। তিনি ছিলেন সংস্কৃতে প্রগাঢ় পন্ডিত। সংস্কৃতে তিনি এমনভাবে কথা বলতেন যেন একটি প্রচলিত ভাষায় কথা বলছেন।…
কয়েক বছর আগেও, হরকুমারকে শিক্ষিত বললে, শাসকদের অনেকেই হয়তো উপহাস করতেন, কিন্তু ‘এখন’ মানবিক বিদ্যায় সুশিক্ষিত ব্যক্তিমাত্রেই তাঁকে পন্ডিত বলে স্বীকার করেন…। (আধুনিক) শিক্ষাকে এড়িয়ে যাবার জন্যে তিনি সংস্কৃত শেখেননি। এই ভাষা ও সাহিত্যে গভীরভাবে প্রবেশ করবার জন্যই তিনি সংস্কৃত শিক্ষা করেন।
দুই ভাই হরকুমার ও প্রসন্নকুমার স্থির করেন, মূলাজোড় মন্দিরে পিতার সম্মানে উপযুক্ত সংস্কৃত প্রশস্তিযুক্ত একটি মর্মর ফলক স্থাপন করবেন। উপযুক্ত সংস্কৃত শ্লোকের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হল। মৃতের প্রতি সম্মান জ্ঞাপনের জন্য যে সব কারণে ডাঃ স্যামুয়েল জনসন ল্যাটিন বাক্য উৎকীর্ণ করতে পক্ষপাতী ছিলেন, উচ্চ শিক্ষিত হিন্দুগণ হয়তো তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আরও যুক্তিযুক্ত কারণে সংস্কৃত ভাষায় স্মৃতিফলক উৎকীর্ণ করাতে আগ্রহান্বিত হয়ে উঠলেন। সুশিক্ষিত দু’তিনজন সংস্কৃতজ্ঞকে বিচারক নিযুক্ত করা হল। বিখ্যাত পন্ডিতগণ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করলেন। অন্যান্যদের সঙ্গে হরকুমারও ছদ্মনামে শ্লোক পাঠালেন। কাউকে ঘুণাক্ষরে জানতেও দিলেন না যে তিনিই ওই শ্লোকের রচয়িতা। তাঁরই শ্লোক শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হওয়ায়, সেটি উৎকীর্ণ করা হল এবং আজও মূলাজোড়ে সেটি অবস্থিত। ভাই প্রসন্নকুমার তাঁর এই সাফল্যের জন্য আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।
তাঁর সংস্কৃতের গুরুমহাশয়ের নাম ছিল ঝড়ুমামা; পূর্ববঙ্গের মানুষ। এই ঝড়ুমামা হিন্দুস্থানে ব্যাপকভাবে প্রচলিত মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ না পড়ে, পড়েছিলেন কল্প ব্যাকরণ। অল্প বয়সেই হরকুমার সংস্কৃত ব্যাকরণের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং সংস্কৃত ব্যাকরণ ও সাহিত্য গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন। পরিণত বয়সে তিনি সংস্কৃত কলেজের প্রখ্যাত পন্ডিত নিমচাঁদ শিরোমণির নিকট বেদান্ত দর্শন অধ্যয়ন করেন। সে সময় হিন্দুদের মধ্যে সংকীর্ণতা এত বেশি ছিল যে, কোন দর্শনশাস্ত্রের অধ্যয়নকে সকলে সন্দেহের চোখে দেখতেন, তাঁদের আশঙ্কা ছিল দর্শনশাস্ত্র অধ্যয়ন করলে মানুষ প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাসে আস্থাহীন হয়ে পড়বে। এই কারণে, এক বিবাহ উৎসবে জ্ঞাতিভ্রাতা উমানন্দনের সঙ্গে তার দেখা হলে, উমানন্দন বললেন, তুমি বেদান্ত পড়ছ শুনে বড় দুঃখ পেলাম, হরকুমার। কারণ জানতে চাইলে, উমানন্দন বললেন, ওসব পড়লে মানুষ ম্লেচ্ছ হয়ে যায়; আমার আশঙ্কা, এত লেখাপড়া শেখার পর, এখন বেদান্ত পড়ে তুমিও ধর্মকর্মে বিশ্বাস হারাবে, এতো আমরা সকলেই জানি। একটু হেসে হরকুমার বললেন, মনে রেখো বেদান্তদর্শনের স্রষ্টা ব্যাসদেবই সব পুরাণের রচয়িতা। তোমার মত অনুযায়ী ব্যাসদেবের তো ঘোর নাস্তিক হবার কথা। খ্রিস্টীয় অব্দের পনেরোশ বছর আগে প্রচলিত বৈদিক ভাষা থেকেই আমাদের আধুনিক সংস্কৃত ভাষার উৎপত্তি; ব্যাসদেব সেই সংস্কৃত ভাষার মহত্ত্বম রত্ন। সলোমনেরও বহু শতাব্দী পূর্বে সংস্কৃত ছিল কথ্য ভাষা এও তো সত্য কথা! বহু আধুনিক লেখকের অর্বাচীন লেখা সকলে সানন্দে পড়ছেন, আর সংস্কৃত সাহিত্যের মহৎ অংশ পড়লে কেউ অধঃপাতে যাবে এ কুসংস্কার বড় দুঃখের।
দুই ভাই হরকুমার ও প্রসন্নকুমারের ইংরেজি শিক্ষা আরম্ভ হয় স্বগৃহে। তারপর তাঁদের ভর্তি করা হয় মিঃ শেরবোর্নের স্কুলে এবং শেষ পর্যন্ত হিন্দু কলেজে। তখন হিন্দু কলেজের প্রধান শিক্ষক ছিলেন মিঃ ডি অ্যানসেলিন, তিনিই হলেন, দুই ভাইয়ের গৃহশিক্ষক। ফার্সী ভাষাও হরকুমার ভালভাবে শিখেছিলেন, অবাধে এবং দ্রুত তিনি এই ভাষাটিতে কথা বলতে পারতেন। তিনি সঙ্গীত শাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন, সাধাগলায় সুর তাল রাগ সমন্বিত গান যেমন তিনি গাইতেন তেমনি সেতার বাজনায় ছিলেন ওস্তাদ।
হরকুমার সভাসমিতি করে বেড়াবার মানুষ ছিলেন না, বিষয়সম্পত্তির দিকেও তাঁর বিশেষ নজর ছিল না। ফলে, অব্যবস্থা ও দুর্নীতির জন্য তাঁদের পৈতৃক যৌথ সম্পত্তি বিপন্ন হয়ে পড়ল; এ সংবাদ তিনি পেলেন তাঁদের এক পুরাতন বিশ্বস্ত কর্মচারীর কাছে। হরকুমার ও প্রসন্নকুমার তখন সেরেস্তার নথিপত্র পরীক্ষা করে দেখলেন কর্মচারীটির গোপন সংবাদ একান্তই সত্য। হরকুমার এখন বিষয়কর্মে মনোনিবেশ করে প্রমাণ করলেন যে, এ বিষয়েও তিনি সমান পারদর্শী। তাঁর প্রথম কাজ হল শরীকদের মধ্যে সম্পত্তি ভাগ করা; কাজটি সহজ না হলেও, তিনি সুচারুরূপে সম্পাদন করেছিলেন। তাঁর নিজের অংশটিও ঋণে জর্জরিত। অধ্যবসায়, অক্লান্ত পরিশ্রম ও কঠোর মিতব্যয়িতা দ্বারা সেটিকে তিনি শুধু রক্ষা করলেন না, ক্রমে সেটিকে যথেষ্ট বাড়িয়েও তুললেন।
১৮৫৮তে তিনি পরলোক গমন করেন। তাঁর মৃতুতে সুপন্ডিত, গুণী, অনুসন্ধিৎসু, পরিশীলিত চরিত্রের এই অভিজাত মানুষটির জন্য পরিচিত সকলেই শোকমগ্ন হন।
পারিবারিক গ্রন্থাগারে তিনি অমূল্য দুর্লভ সংস্কৃত পুথির সংগ্রহ রেখে গেছেন। তিনি কয়েকখানি প্রসিদ্ধ সংস্কৃত গ্রন্থের রচয়িতা। মণিরত্নও তিনি ভাল চিনতেন– তাঁর সংগ্রহে বেশ কিছু উচ্চশ্রেণীর মণিরত্ন ছিল। [দ্রষ্টব্য : ওরিয়েন্টাল মিসেলেনি, ১৮শ সংখ্যা, সেপ্টেম্বর, ১৮৮০]
এই বিশিষ্ট পরিবারের বর্তমান প্রতিনিধি হরকুমারের দুই পুত্র অনারেল মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, সি এস আই এবং রাজা শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর, সি আই ই রাজনীতি ও সাহিত্যজগতে উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। এঁরা সব দিক দিয়েই গোপীমোহন ঠাকুরের যোগ্য উত্তরাধিকারী। এই দুই ভাই পদমর্যাদা, প্রভাব প্রতিপত্তি ও খ্যাতির দিক থেকে বিশিষ্ট পিতামহের বিশিষ্টতাকেও ছাড়িয়ে গেছেন। এই দুই ভাইয়ের উচ্চ আধুনিক শিক্ষা বা উচ্চতম পদাধিকারী ইউরোপীয়দের সঙ্গে মেলামেশা সত্ত্বেও এঁদের জাতীয় ধর্মবিশ্বাস বা জাতীয় আচারবিচার একটুও শিথিল হয়নি। সুসংস্কৃত ইউরোপীয় আদবকায়দার অভ্যস্ত হয়েও তাঁরা পিতৃপিতামহের সহৃদয় দানশীলতা ও সরলতা অটুটভাবে বজায় রেখেছেন। এতদিন পর্যন্ত হিন্দু অভিজাতদের দূর্নাম প্রচলিত আছে যে, তারা অলস, বিলাসী এবং কামুক– এই দুই ভাই তাঁর মূর্তিমান প্রতিবাদ। একজন রাজনীতিক্ষেত্রে এবং অপর জন সাহিত্যক্ষেত্রে আপন আপন কীর্তিদ্বারা ঐ কলঙ্ক মোচনে সাহায্য করেছেন।