দ্বিতীয় খণ্ড (আমার গুরু, আমার স্বর্গত পিতাকে)
2 of 6

ঠাকুর দেখার বিপত্তি

ঠাকুর দেখার বিপত্তি

ছোটরা বায়না ধরবেই। ঠাকুর দেখতে চল। ব্লেডের ঠাকুর। পেরেকের ঠাকুর। ছোবড়ার ঠাকুর। জলের ঠাকুর। অদৃশ্য ঠাকুর। ডিস্কো ঠাকুর। বিস্কুটের প্যান্ডেলে চায়ের ঠাকুর। ঠাকুর দেখার আগে, দ্যাখো প্যান্ডেলের বাহার। অজন্তা, ইলোরা, সোমনাথ, মীনাক্ষী, মসলিপুরম, ল্যাঙ্কাসটার হাউস, হোয়াইট হাউস, সাঁসেলিজা, শোলাপুর।

ডেকরেটাররা আজকাল ভেলকি দেখাতে পারেন। দুটো বাড়ির মাঝখানে সামান্য ফাঁক ছিল। উঠে গেল বাঁশের, চটের, চ্যাটাইয়ের কারিকুরিতে তিনতলা বাড়ি। চোখ টেরা। ময়দানবের খেলা। আসল, নকল বোঝা দায়। বৈঠকখানায় মা বসেছেন আসর সাজিয়ে। সরস্বতী সেতার বাজাচ্ছেন, লক্ষ্মী টাকা গুনছেন, কার্তিক যেন পুরনো কলকাতার বাবু। অসুর ডন বৈঠক মারছেন।

ঠাকুর দেখার দায়িত্ব ক্রমশই বাড়ছে। প্রথমে দ্যাখো আলো। চন্দননগরের মাথা বটে! আলোর হাতি বল খেলছে। আলোর মেয়ে সাইকেল চালাচ্ছে। আলোর গিন্নি ঝ্যাঁটা মারছে। আলোর বেড়াল ইঁদুর ধরছে। আলোর ভক্ত বাঁক কাঁধে তারকেশ্বর ছুটছে। সারা শহর জুড়ে আলোর কেলেঙ্কারি। মাথার ওপর আলোর মালা। ধরধর করে আলো ছুটছে। আলোর চোরপুলিশ। আলোর পরে প্যান্ডেল। হাঁ করে দাঁড়িয়ে দ্যাখো। পারলে পড়ে নাও বিবরণ। কোনও ঐতিহাসিক স্থাপত্যের অনুকরণ। এইবার গিজি গিজি ভিজি ভিজি ভিড়ে নিজেকে ফেলে দাও। ভিড়ই ঠেলতে-ঠেলতে এদিক দিয়ে ঢুকিয়ে ওদিক দিয়ে বের করে দেবে। লাউডস্পিকারে ঘনঘন ঘোষণা, পকেট সামলে, ঘড়ি সামলে, হার সামলে, দুল সামলে। এরই মাঝে হারিয়ে যাবার ধুম পড়ে যাবে। ছিড়িক গান, আকাশবাণীর কায়দায় ভারী গলার ঘোষণা—উল্টোডাঙার মধুমতী, তোমাকে তোমার জগা খুঁজছে। যেখানেই থাকো আমাদের এনকোয়ারির সামনে চলে এস। গান, প্রভু আরও আলো, আরও আলো। হাওড়ায় বক্রেশ্বরবাবু আপনাকে আপনার স্ত্রী ভামিনী দেবী গরু খোঁজা খুঁজছেন। এইসব শুনতে-শুনতে, গোঁত্তা খেতে-খেতে, মা দুর্গে, অসুরনাশিনী মা, আর যে পারি না।

ছোটদের হাত ধরে বেরোতেই হবে। না বেরলে চাকরি যাবে দাদুর। সংসারের দানাপানি বন্ধ হয়ে যাবে। বউমা বলবে, যান না বাবা, বসে না থেকে, বাচ্চাটাকে একটু ঠাকুর দেখিয়ে আনুন না। বৃদ্ধ চললেন। ছেলে ষাট টাকা দামের একটি তাঁতের ধুতি দিয়েছে। খাদি থেকে কেনা রিডাকসানের পাঞ্জাবি। চোখে ছানি-কাটা চশমা। সে এক করুণ দৃশ্য। মধুরও বটে। শিশুর অসংখ্য প্রশ্ন। দাদু অসুর কেন উল্টে আছে? উত্তর, মা দুর্গা উল্টে দিয়েছেন। প্রশ্ন, কখন সোজা করবেন? উত্তর, কৈলাসে গিয়ে। প্রশ্ন, অসুর কেন সিংহকে মারছে না? সিংহ কেন অসুরকে খাচ্ছে না? উত্তর, খিদে নাই দাদু। প্রশ্ন, অসুর কি ভিটামিন খায় দাদু? অসুরের মা নেই? প্রশ্নে-প্রশ্নে দাদু অস্থির।

বউকে নিয়ে স্বামী না বেরোলে স্বামীর চাকরি যাবে। কার্তিকের তীর তো ছোঁড়াই হল না। আজীবন হাতেই ধরা রইল। মা তো একাই একশো। দশটা হাতে দশ রকমের অস্ত্র। বাহন আবার সিংহ। যুদ্ধটা যদিও খুবই সেকেলে। পারমাণবিক যুগে অচল। মায়ের হাতে কবে যে স্টেনগান ধরানো হবে। অসুরের হাতে ক্ষুর আর বোতল বোমা! কে জানে! তা স্ত্রীর বাক্যবাণ বড় সাংঘাতিক। হৃদয় ঝাঁঝরা করে দেয়। ‘বচ্ছরকার এই তিনটি দিন বাড়িতে বসে-বসে হেঁসেল ঠেলো। এমন জীবনের মুখে ঝাড়ু মারি।’

‘ঠাকুর কী দেখবে? দেখার কী আছেটা! সেই তো এক পোজ, এক ধুনুচি নৃত্য। মাইকের ঘ্যারোর-ঘ্যারোর। কোদলানো রাস্তা, ভ্যাড়ভ্যাড়ে কাদা, গ্যাদগ্যাদে লোক। ভালোও লাগে?’

দ্যাখার না থাক দ্যাখাবার তো থাকে। ইনস্টলমেন্টে এত শাড়ি কেনা হয়েছে। আলমারিতে লাট খাবে। নতুন-নতুন শাড়ি পরে মেয়েরা বেরিয়ে পড়েছেন। উন্মাদিনীর মতো হকের পল্লী থেকে ছুটছেন বিরাশির পল্লীতে। পথের মাঝে কেউ থেমে পড়ে শাড়ির ভাঁজ ঠিক করছেন। নিচু হয়ে টেনে-টেনে ঝুলের গরমিল মনোমত করছেন। অন্যের শাড়ি দেখে স্বামীকে ফিসফিস করে বলছেন, ‘দ্যাখো দ্যাখো তানচৈ বেনারসী। তোমার জন্যে কেনা হল না। টেরিফিক।’

স্বামী শাড়ি দেখতে গিয়ে মনে-মনে গেয়ে উঠলেন, ‘চাঁদ দেখতে গিয়ে আমি তোমায় দেখে ফেলেছি।’ আবার যাদের সদ্য একটি হয়েছে তাঁদের মহাজ্বালা। লক্ষ্মণের শ্রীফল ধরার মতো, ধরে-ধরে পেছন-পেছন ঘুরে বেড়াও। ‘লতু গোটা সতেরো তো হল। টেংরি খুলে যাবার যোগাড়। এইবার চল না, প্যাভেলিয়ানে ফেরা যাক।’ ‘না, সেঞ্চুরি না করে আমি ফিরব না।’

ইচ্ছের ঠাকুর দেখা আর অনিচ্ছার ঠাকুর দেখা, দুইয়ে মিলে পুজোর কটা দিন জমবে ভালো। বয়সে যারা তরুণ তারা প্রাণের টানে পথে নেমে আসবে। মা তো উপলক্ষ। আসল লক্ষ্য, এমন দিন বছরে একবারই আসে মা তারা। ললিতা, বিশাখা, সিল্ক, জর্জেট, শিফন, নাইলন। হাইহিল, ফ্ল্যাট হিল। দিশি, বিলিতি সুগন্ধ। কলকাতার নরকে স্বর্গের ব্রাঞ্চ। এরই মাঝে, ঠোঁট ঈষৎ ফাঁক করে, টইটম্বুর ফুচকা, অসীম কায়দায়, সামনে ঝুঁকে শাড়ি বাঁচিয়ে মুখে ঠেলা। অষ্ট সখী ঘিরে ধরেছে ফুচকা শিল্পীকে। তার গায়ে আজ নতুন জামা উঠেছে। কাঁধের গামছাটিও নতুন। পাশ দিয়ে চলেছে কুচকাওয়াজ। ছেলে, বুড়ো, যুবক, তরুণী পিলপিলিয়ে চলেছে। মাইকে-মাইকে শব্দব্রহ্ম। কোনওটায় বম্বের হিট হিরো হিট ফিল্মের ডায়ালগ ছাড়ছে, মহব্বত, ইনসান, মওত, কুত্তে, সরাফাৎ, হকিকৎ, হাম, তুম, আজা, লড়কন, ধড়কন শব্দের জগাখিচুড়ি কানের ভেতর দিয়ে মর্ম স্পর্শ করছে। বাঞ্ছারামের গলিতে স্যাঁতানো ঘরে পড়ে আছে প্রত্যহের সংসার। খাটের ওপর বেরোবার আগে শ্রীমতী ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গেছেন বাড়িতে পরার শাড়ি। চেয়ারের পেছনে ঝুলছে প্রত্যহের পাজামা। মেঝেতে হালকা হয়ে ছড়িয়ে আছে প্রসাধনের পাউডার। চিরুনি থেকে চুল ছাড়ানো হয়নি। টিপের পাতা মোড়া হয়নি। ড্রয়ারের ডালা বন্ধ হয়নি। পাখার সুইচ অফ করা হয়নি।

আলো শব্দ, গান, আনন্দের জোয়ার বইছে। ছোটোখাটো সমস্যারও শেষ নেই। জোজোর নতুন জুতো ফোস্কা উপহার দিয়েছে। সে আর হাঁটতে পারছে না। জুতো এখন বগলে। জুলির হাই হিলের একটা হিল খুলে পড়ে গেছে। বউদির শাড়ির আঁচল বাঁশের পেরেকে আটকে ফালা। দাদা এক রাউন্ড ঝেড়ে, পাল্টা ঝাড় খেয়ে পাশে-পাশে এমন গোবদা মুখে চলেছে যেন বড়লোকের বাড়ির দারোয়ান ভজন সিং। লিলির পেছনে এক ডজনজুয়ান লেগে গেছে। যে প্যান্ডেলে যাচ্ছে, সেই প্যান্ডেলেই পেছনে-পেছনে। মাকে বলেছে, ‘ও, মা, ওই দ্যাখো, মুখপোড়াটা এখানেও এসেছে।’ মা বলেছেন, ‘তাকাসনি। ‘তাকিয়ে মরছ কেন?’ এরই মাঝে দু চারটে মারামারির সাক্ষী হতে হবে। সেই এক সমস্যা, হয় নারী না হয় পকেটমার।

আজকাল আবার ঠাকুর দেখার হোলনাইট হয়েছে। ইটখোলার লরি ভাড়া করে রাত এগারোটা নাগাদ পাড়া কাঁপিয়ে বেরিয়ে পড়ো। লরিতে একপাল ছেলেমেয়ে। কোনও-কোনও রক্ষণশীল বাড়ির মেয়ের সঙ্গে অভিভাবক হিসেবে কোলের ভাইটিকে পাউডার টাউডার মাখিয়ে তুলে দেওয়া হয়েছে।

‘আমরা বাবা মেয়েকে কোথাও একলা ছাড়ি না।’ সঙ্গে সাক্ষিগোপাল। একলরি ছেলেমেয়ে চিৎকারে দশদিক কম্পিত করে ছুটল টালা থেকে টালিগঞ্জ। হোলনাইটের জন্যে অষ্টমী আর নবমীই হল দিন। নবমী হল মহা মজা। সকালে ফিরে এসে বিছানায় লেটকে পড়ো। বিজয়ার বাজার থেকে দায়মুক্ত। স্ত্রী বলবেন স্বামীকে, ‘যাও, তুমিই নিয়ে এস, বোঁদেটা একটু শুকনো এনো। ঘুগনির মটোর একটা-একটা করে দেখে নিও, বড় পোকা থাকে। নারকোলটা বাজিয়ে নিও। রসগোল্লা টিপে নিও। দালদা নিও গাছ মার্কা। খোকাকে আর ডাকব না। সারা রাত জেগে ঘুমিয়ে পড়েছে।

উৎসবের দিনে, কিছু-কিছু ছাড়পত্র পাওয়া যায়। কেউ -কেউ ঢুক করে সামান্য হুইস্কি মেরে চোখ ঈষৎ আরক্ত করে একটু তদন্তে বেরোন। ‘আহা! মা কি সেজেছেন।’ ‘কোন মা? তোমার চোখ তো ভাই প্রতিমের দিকে নেই!’ ‘আরে ভাই, যে মা ঘটে, সেই মা-ই তো পটে। আমি জ্যান্তো, দ্বিভুজা দুর্গা দেখছি। মা কি সেজেছেন। টাঙ্গাইলের খোলে সুঠাম দেহছন্দ। শ্যাম্পু করা চুল, পিঠে আলুলায়িত। অসুর আমি এ-পাশে মূর্ছিত। আসছে বছর আবার এস মা।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *