ঠাকুরের কাছে দরবার
ঠাকুর, আপনি বলেছিলেন, গৃহদুর্গ সর্বাধিক নিরাপদ স্থান। ইচ্ছে থাকলেই সেখানে বসে সাধন-ভজন করা যায়। ভালভাবেই করা যায়। সে-গৃহ যে আর দুর্গ নেই ঠাকুর! শতবর্ষ পরে গৃহ এখন শত্রুপুরীর চেহারা নিয়েছে। গৃহ একালে সুদৃশ্য হয়েছে অবশ্যই। সাজসজ্জার অভাব নেই। গুণী স্থপতিরা নকসা করে দেন। শয়নকক্ষ, বসার কক্ষ, ভোজন-পরিসর। প্রকৃতির ডাকে রাত- বিরেতে লণ্ঠন হাতে পুকুর পাড়ে ছুটতে হয় না। লাগোয়া স্নানাগার। অষ্টপ্রহর চলছে জলের ধারা। ডবল জানালা। বাহারি পর্দা, পেলমেট। সোফা, কার্পেট। ঢাকনা পরানো আলো। গান শোনাবার ইলেকট্রনিক ব্যবস্থা। বাক্স বোঝাই সিনেমা। বোতাম ঘোরালেই দিল্লির প্রমোদ তরঙ্গ। রান্নাঘরে নির্ঘুম অগ্নিশালায় চটজলদি রান্নার ব্যবস্থা। শিল-নোড়া নির্বাসিত। গুঁড়ো মসলা। ভারতীয় পদের সংখ্যা কমে চীনে খাবারের প্রচলন। নারীপ্রগতি যত বাড়ছে ততই বাড়ছে সংসারের রুক্ষতা। মা কোথায়? মায়েরা সব গেলেন কোথায়? শিক্ষা আর স্বাধীনতা যেন একালের পরশুরাম। মাকে হত্যা করেছে। গৃহ আছে মনোরম, গৃহদেবতা নেই। পূজা-পার্বণ নাকি কু-সংস্কার। শাঁখ আর বাজে না, সন্ধ্যা আর দেখানো হয় না। ঠাকুর আপনি বলেছিলেন, টাকা মাটি। একালে টাকাই সব টাকাই ঈশ্বর।
আপনি বলেছিলেন, সাত্ত্বিকের সংসার হবে শিবের সংসার। একটু অগোছালো, ধুলোটুলো হয়তো থাকল, কিন্তু দুখচেটে, তেলচিটে নয়। অপবিত্ৰ নয়। অতিথি এসে অশ্রদ্ধা পেয়ে ফিরে যায় না। ভিখারি ভিক্ষা পায়, রাতে আলো জ্বলে ঘরে ঘরে। সুন্দর একটি ঠাকুরঘর থাকবে নির্জন, নিরালা, ধূপ- ধুনোর গন্ধভরা। সন্ধ্যায় একটি প্রদীপ জ্বলবে আপন মনে। আমার সন্দেহ হয় ঠাকুর, একালের কটি গৃহে আপনি জলগ্রহণ করবেন। অন্নগ্রহণ? সেতো অনেক দূরের কথা। আপনি যে স্পর্শদোষ ভীষণ মানতেন। দেহলক্ষণ দেখে মানুষ চিনতেন আপনি। আপনি বলে গেছেন—”হাড়পেকে, কোটর চোখ, ট্যারা এরকম অনেক লক্ষণ আছে, তাদের বিশ্বাস সহজে হয় না। ‘দক্ষিণে কলাগাছ, উত্তরে পুঁই, একলা কালো বিড়াল কি করব মুই।” একালের কজনকে আপনি পা স্পর্শ করে প্রণামের অধিকার দিতেন, আমার সন্দেহ আছে। সেই ভগবতী দাসীর ঘটনা আমার মনে আছে। সে ছিল মথুরবাবুদের পুরনো দাসী। প্রথম বয়সে তার স্বভাব ভাল ছিল না। একদিন ভগবতী আপনার সঙ্গে নানা কথা কইতে কইতে সাহস পেয়ে আপনার পা ছুঁয়ে প্রণাম করেছিল। সঙ্গে সঙ্গে আপনি এমন করে উঠেছিলেন, যেন বৃশ্চিক দংশন করলে। ‘গোবিন্দ’, ‘গোবিন্দ’ বলতে বলতে ছুটে গেলেন ঘরের কোণের গঙ্গাজলের জালার কাছে। পায়ের সেই জায়গা দুটো জল দিয়ে ধুয়ে তবে শান্তি। আজকাল আমরা ভগবতী দাসীর চেয়েও বেশি শিথিল জীবন-যাপন করি। আমাদের চরিত্রের সব বাঁধনই প্রায় আলগা হয়ে গেছে। মানুষের বিচার একালে আর চরিত্র দিয়ে হয় না। হয় বৈষয়িক সাফল্য দিয়ে। গাড়ি, বাড়ি, অর্থ, সামাজিক পদমর্যাদা। একালে সাধুর চেয়ে ক্ষমতাশালী শয়তানই বেশি পূজনীয়। আমাদের তাহলে কি হবে ঠাকুর! আপনাকে তো ত্যাগ করতে পারব না। জীবনের সুর যে আপনি বেঁধে দিয়েছেন।
আপনি বলেছিলেন: “ঈশ্বরলাভের জন্যে সংসারে থেকে, এক হাতে ঈশ্বরের পাদপদ্ম ধরে থাকবে আরেক হাতে কাজ করবে। যখন কাজ থেকে অবসর হবে, তখন দুই হাতেই ঈশ্বরের পাদপদ্ম ধরে থাকবে, তখন নির্জনে বাস করবে, কেবল তাঁর চিন্তা আর সেবা করবে।” ঈশ্বরের পাদপদ্ম ধরতে পেরেছি কিনা জানি না, দুহাতেই কাজ করে চলেছি, অকাজ সব। অপেক্ষায় আছি, অবসর মিললেই দুহাতে তাঁর সেবা; কিন্তু তাঁকে ধরার আগেই তো রোগে ধরবে। উপার্জন কমে আসবে। আর সংসার তো কাবুলিওয়ালার সংসার। সবসময় ‘দেহি, দেহি’। আসল দাও, সুদ দাও। পাঁকাল হয়ে পেছলাবার চেষ্টা করলে, মায়েরা আজকাল দুহাতে ছাই মেখে ধরে। আমি তো আপনার উপদেশ মতো সংসাররূপ কাঁঠালটি ভাঙার আগে দুহাতে চৈতন্যরূপ তেল মাখার চেষ্টা করিনি ঠাকুর। শুধু এইটুকু মনে রেখেছিলুম—”ত্যাগ তোমাদের কেন করতে হবে? যেকালে যুদ্ধ করতেই হবে, কেল্লা থেকেই যুদ্ধ ভাল। ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে যুদ্ধ, খিদে-তৃষ্ণা এসবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে। এ-যুদ্ধ সংসার থেকেই ভাল। আবার কলিতে অন্নগত প্রাণ, হয়তো খেতেই পেলে না। তখন ঈশ্বর-টীশ্বর সব ঘুরে যাবে। একজন তার মাগকে (স্ত্রীকে) বলেছিল, ‘আমি সংসারত্যাগ করে চললুম।’ মাগটি (স্ত্রীটি) একটু জ্ঞানী ছিল। সে বললে, ‘কেন তুমি ঘুরে ঘুরে বেড়াবে? যদি পেটের ভাতের জন্য দশ ঘরে যেতে না হয় তবে যাও। তা যদি হয়, তাহলে এই এক ঘরই ভাল।’ তোমরা ত্যাগ কেন করবে? বাড়িতে বরং সুবিধা। আহারের জন্য ভাবতে হবে না। সহবাস স্ব-দারার সঙ্গে, তাতে দোষ নাই। শরীরের যখন যেটি দরকার কাছেই পাবে। রোগ হলে সেবা করবার লোক কাছে পাবে। জনক, ব্যাস, বশিষ্ঠ জ্ঞানলাভ করে সংসারে ছিলেন। এঁরা দুখানা তরবার ঘুরাতেন। একখানা জ্ঞানের, একখানা কর্মের।” জ্ঞান যার লাভ হয়নি তার কি হবে! নিজে সোজা থাকবার চেষ্টা করলেও সংসারের সদস্যরা মেরে ধনুক করে দেবার চেষ্টা করে। তাদের ‘দেহি দেহি’ রব, আমার ‘ত্রাহি ত্রাহি’ চিৎকার।
আপনি বলেছিলেন বিদ্যার সংসার, বিদ্যা-স্ত্রী। স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলুম : “তুমি কি বিদ্যা-স্ত্রী?” তিনি বললেন : “কোয়ালিফিকেশন দেখেই তো এনেছিলে!”
“সে-বিদ্যা নয়, সহমর্মী, সহধর্মী। ঢোকার কায়দা তো জানা হলো, বেরিয়ে আসার কায়দা জান?”
সে তো মৃত্যু!”
“না। মরণ এসে ঘাড় ধরে বের করে দেবার আগেই নিজে তুলে নেবার কৌশল। কর্ম যখন মুক্তি দেবে তখন দুহাতে তাঁকে ধরার কথা বলেছেন ঠাকুর।”
“তখন হাঁড়ি চড়বে কিসে? “
“কেন পুত্র?”
“তার তো কোন চাকরিই নেই। এযুগে চাকরি পাওয়া একই কথা! “ “তাহলে রিটায়ার করার পর সামান্য যাকিছু মিলবে, তাতেই না হয় ছোটা খানা!”
“মেয়ের বিয়ে? তাইতেই সব চলে যাবে?”
ঠাকুর, তাহলে কি হবে! আপনার মতো সাহস করে বলি কি করে— ‘রাজার ছেলের মাসোহারার অভাব হয় না!’