ঠাকুরদার বন্দুক – কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়
অফিসের ঠিকানায় গোটা-গোটা অক্ষরে আমার নাম লেখা নীল ইনল্যাণ্ড লেটারটা পেয়ে অবাকই হয়েছিলাম। আরও অবাক হয়েছিলাম, প্রেরকের নামটা দেখে। আলিপুরদুয়ারের রায়ডাক থেকে চিঠিটা পাঠিয়েছেন অমিয়ভূষণ মল্লিক। অমিয়ভূষণ নামটার সঙ্গে আমি পরিচিত এবং এই নামটা আমাদের বাড়িতে শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয় না।
এক সময় আমার ঠাকুরদা শিবনাথ লাহিড়ী আলিপুরদুয়ারে থাকতেন। সেখানে ঠাকুরদার কাঠচেরাই কলের একটা ছোটো ব্যাবসা ছিল। কিন্তু ওঁর আসল নেশা ছিল শিকার। আমার জন্মের আগেই ঠাকুরদা মারা গিয়েছিলেন। বাড়িতে যেটুকু শুনেছি, অমিয়ভূষণ ছিলেন শিকারে ঠাকুরদার ঘোর প্রতিদ্বন্দ্বী। শেষ শিকারে তিনি ঠাকুরদাকে এমন ঠকিয়েছিলেন যে, ঠাকুরদা চিরদিনের মতো শিকার ছেড়ে কলকাতায় চলে এসেছিলেন। আসার আগে নিজের হাতে নষ্ট করে দিয়ে এসেছিলেন শিকার সম্পর্কিত যাবতীয় জিনিসপত্র। তাই মরা বাঘকে পায়ের নীচে রেখে বন্দুক হাতে সদর্পে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন, এরকম একটা ছবিও আমাদের কলকাতার বাড়িতে নেই।
একটা কৌতূহল নিয়ে অমিয়ভূষণবাবুর চিঠিটা খুলে ফেললাম। উনি লিখেছেন, ‘বহু চেষ্টায় তোমার অফিসের ঠিকানা জোগাড় করে তোমাকে এই চিঠি দিচ্ছি। কারণ, তোমার বাড়ির ঠিকানায় চিঠিটা পাঠালে এই চিঠি তোমার হাতে শেষ পর্যন্ত পৌছবে কি না, আমি নিশ্চিত নই। তুমি হয়তো আমার নাম এবং বদনাম দুই-ই শুনে থাকবে। নিশ্চয়ই জানো, যুবক বয়সে শিবনাথ আর আমি দু-জনেই শিকারি ছিলাম। স্পষ্ট ভাষায় বলা ভালো, শিকার নিয়ে আমাদের দু-জনের মধ্যে একটা চাপা প্রতিযোগিতাই ছিল।
‘ভারত যে বছর স্বাধীন হল, সেই সময়ের আশপাশে এক নরখাদক চিতাবাঘিনি আলিপুরদুয়ার দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল। আমি আর তোমার ঠাকুরদা নিরন্তর চেষ্টা করছিলাম বাঘিনিটিকে মারার জন্য। এক রাত্রে বাঘিনিটি অবশ্য মারা পড়েছিল। সেদিন তোমার ঠাকুরদা এবং আমি দু-জনেই জঙ্গলে ছিলাম। সেই ছিল তোমার ঠাকুরদার শেষ শিকারযাত্রা। কার গুলিতে বাঘিনিটি মারা গিয়েছিল, সেই নিয়ে তোমাদের পরিবারে হয়তো ভিন্ন মত আছে। তবে মৃত বাঘিনির মাথায় বেঁধা গুলিটা বের করে যখন দেখা গিয়েছিল সেটা আমার বন্দুক নি:সৃত ছিল, নি:সন্দেহ স্বীকৃতি এবং সরকারি পুরস্কার আমার ভাগ্যেই জুটেছিল।
বাঘিনি শিকারের সেই জঙ্গল দিনে-দিনে ক্রমশ পাতলা হয়েছে। অনেক জায়গায় বসতি, গ্রাম গড়ে উঠেছে। এরকমই এক গ্রামের কিছু কাঠুরে সম্প্রতি এক জায়গায় মাটি খুঁড়তে গিয়ে কিছু বাঘের হাড়গোড়ের সঙ্গে তোমার ঠাকুরদার বন্দুকটি খুঁজে পেয়েছে। এ অঞ্চলের অধিবাসীদের বন্যপ্রাণীর হাত থেকে বহুকাল রক্ষা করায় আমার যে অবদানটুকু আছে, তাতে এলাকার গ্রামবাসীদের বিশেষ কৃতজ্ঞতা আছে আমার উপর। বন্দুকটি থানায় না জমা দিয়ে ওরা আমার কাছে দিয়ে গিয়েছে।
‘বন্দুকটা আমার হাতে আসা পর্যন্ত আমি প্রচন্ড অস্বস্তিতে আছি। জীবনের উপান্তে এসে অদ্ভুত এক মনস্তাপ হচ্ছে। মনে হচ্ছে, তোমার ঠাকুরদার শিকার ছেড়ে দেওয়ার রহস্য তার কোনও উত্তরপুরুষকে বলে না গেলে আমি মৃত্যুর পরেও শান্তি পাব না। ফোনে তোমার বাবার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলাম। উনি আমার নাম শুনে ফোন রেখে দিয়েছিলেন। তাই তোমাকে এই চিঠিটা লিখছি, যাতে তুমি সময় নিয়ে, ধৈর্য ধরে এই চিঠিটা পড়তে পারো এবং তারপর যদি তুমি আলিপুরদুয়ারে একবার আসতে পার, তা হলে তোমাকে ঘটনাটা বিস্তারিত বলতে পারি। আর তোমার ঠাকুরদার বন্দুকটা যাতে স্মারক হিসেবে তোমাদের পরিবারে ফেরত যায়, তাও যথাযথ হস্তান্তর করতে পারি…
এক নিশ্বাসে আমি চিঠিটা পড়ে ফেললাম এবং সত্যিই ঠাকুরদার শিকারি জীবনের ইতির রহস্যটা জানবার জন্য অদম্য একটা আগ্রহ তৈরি হল। বাড়িতে আমি যা এতকাল শুনেছি, তার সঙ্গে অমিয়ভূষণবাবুর চিঠিটার বক্তব্যে অনেক মিল আছে। আমি শুনেছি, এক রাত্রে ঠাকুরদা এবং অমিয়ভূষণবাবু বাঘিনি শিকারের উদ্দেশ্যে জঙ্গলে গিয়েছিলেন। সেই রাতে গুলিতে বাঘিনিটি মারা পড়েছিল। তবে পরের দিন সকালে অমিয়ভূষণবাবুকে যখন মৃত বাঘিনির কাছে পাওয়া গিয়েছিল এবং ঠাকুরদা জঙ্গল থেকে রক্তমাখা জামা পড়ে বন্দুক ছাড়াই বেরিয়ে এসেছিলেন, সকলের বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল যে, ঠাকুরদা বাঘিনির আক্রমণে জখম হয়ে বন্দুকটা খুইয়েছেন এবং অমিয়ভূষণ মল্লিক শুধু বাঘিনিটিকেই মারেননি, ঠাকুরদাকেও প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ঠাকুরদা হয়ে গিয়েছিলেন এক পালটে যাওয়া মানুষ। শুধু ঠাকুরমাকে একবারই বলেছিলেন, বাঘিনিকে উনিই মেরেছিলেন। তবে সেটা করতে গিয়ে একটা বড়ো পাপ করে ফেলেছেন। কী সেই পাপ, সেই নিয়ে অথবা শিকার নিয়ে বাকি জীবনে ঠাকুরদা আর-একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি।
আমরা গোটা পরিবার বিশ্বাস করি, ঠাকুরমাকে বলে যাওয়া ঠাকুরদার কথাটা পুরো সত্যি। তাই অমিয়ভূষণ মল্লিক সম্পর্কে আমাদের বাড়িতে ধারণা এতটাই খারাপ যে, বাবাকে অমিয়ভূষণবাবুর চিঠিটার কথা বললে এক্ষুনি আমাকে কুচিয়ে ফেলে দিতে বলবেন। কিন্তু চিঠিটা আমাকে ভাবাল। বাবা-মাকে পুরো সত্যিটা জানালাম না। ডুয়ার্সের লাটাগুড়িতে আমার এক বন্ধু থাকে, অর্ণব। ওর কাছে বেড়াতে যাব বলে একদিন চেপে বসলাম কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসে।
অর্ণবকে অবশ্য আমি খুলে জানিয়েছিলাম সব কিছু। অর্ণবও আলিপুরদুয়ার যাওয়ার পথে ময়নাগুড়ি স্টেশনে উঠে পড়ল ট্রেনে। দু-বন্ধু মিলে ঠিক করলাম, অমিয়ভূষণবাবুর বাড়ি গিয়ে এক রাত্রির আতিথেয়তা নিয়ে ঠাকুরদার গল্পটা শুনে আর বন্দুকটা নিয়ে পরের দিন লাটাগুড়িতে অর্ণবের বাড়িতে চলে আসব। অমিয়ভূষণবাবুর চিঠিতে ওঁর ফোন নম্বর ছিল। আমাদের যাওয়ার দিনক্ষণ জানিয়ে দিলাম ওঁকে। স্টেশনে উনি গাড়ি আর লোক পাঠিয়েছিলেন আমাদের দিয়ে যাওয়ার জন্য।
অমিয়ভূষণবাবুর বাড়িটা সাবেকি ধরনের বড়ো বাড়ি। বসার ঘরটা গোলাকৃতির। দরজার মুখে দু-দিকে দু-টো বড়ো হাতির দাঁত। দেয়ালে জায়গায় জায়গায় বাঘ আর হরিণের স্টাফ করা মাথা ঝুলছে। কয়েক জায়গায় বড়ো-বড়ো বাঘছাল ঝুলছে। এছাড়া শিকারসুদ্ধ অমিয়ভূষণবাবুর বাঁধানো ছবি, বাঁধানো সরকারি সার্টিফিকেট, বিভিন্ন সংস্থার মানপত্র, শিকারে ব্যবহার করা বিভিন্ন বন্দুক ঝুলছে। ঘরে ঢুকে সোফায় বসব কী! আমি আর অর্ণব হাঁ করে ঘুরে ঘুরে সেই সব দেখতে থাকলাম। এমন সময় ভারী চটির আওয়াজ পেলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, এক বৃদ্ধ লাঠি হাতে ঘরে ঢুকছেন। ইনিই যে অমিয়ভূষণ মল্লিক পরিচয় করিয়ে দেওয়ার দরকার হল না।
অমিয়ভূষণ এগিয়ে এলেন আমার দিকে। চোখটা একটু উদাস। আমার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, ‘তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, ঠিক যেন শিবনাথ এসে দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে।’ ভদ্রলোক আমাদের বসিয়ে নানান গল্প করতে লাগলেন। তবে আমরা উসখুস করছিলাম, কখন উনি ঠাকুরদার শেষ বাঘিনি শিকারের গল্পটা বলবেন আর ঠাকুরদার বন্দুকটা দেখাবেন। কিন্তু বিকেলবেলার আগে তার সুযোগ হল না।
দুপুরে ভালো খাওয়া দাওয়া হল, তারপর বিশ্রাম। বিকেলবেলায় অমিয়ভূষণবাবু বাড়ির বাগানে আমাদের চা খাওয়ার জন্য ডাকলেন। চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে সরাসরি চলে এলেন শিকারের প্রসঙ্গে। গল্পটা ভূমিকা দিয়ে শুরু করে দিলেন, ‘বাঘ বা বাঘিনিরা একটা বয়স পেরিয়ে নরখাদক হয়। তখন এরা হয়ে যায় অত্যন্ত ধূর্ত। এদের শিকার করার জন্য রাতের পর রাত শিকারিদের অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে জঙ্গলে মাচায় কাটাতে হয়। তবে নরখাদক বাঘ, বাঘিনিদের চরিত্রের একটা বৈশিষ্ট্য আছে। মানুষ বা পশু, যা এরা শিকার করে, সেটাকে মেরে ফেলে বহুদূর নিয়ে যায়। যতটা পারে খায়, বাকিটা রেখে যায় পরে খাবে বলে। বাঘের খাওয়া মৃতদেহের ভুক্তাবশেষকে ‘মড়ি’ বলে। মড়ি শিকারিদের কাছে একটা বড় টোপ।’
‘সেটা ১৯৪৮ সাল। গ্রীষ্মের সময় একটা চিতাবাঘিনির মানুষখেকো হয়ে ওঠার খবর প্রথম পাওয়া গেল। তখন অবশ্য বাঘিনিটির গতিবিধি আর ত্রাস রাজাভাতখাওয়া অঞ্চলে ছিল। আমি আর শিবনাথ দু-জনেই বর্ষাকালে ওই অঞ্চলে আলাদা-আলাদা করে ওকে মারতে গিয়েছিলাম। বাঘিনিটি ছিল অত্যন্ত ধূর্ত। দু-জনেই কয়েকবার অল্পের জন্য ফসকে ছিলাম। মনে হয়, বাঘিনিটি আমাদের চিনে ফেলেছিল। আমরা যেমন ওর পায়ের ছাপ চিনে নিয়েছিলাম, বাঘিনিটিও তেমনি আমাদের গায়ের গন্ধ চিনে নিয়েছিল। আর তাই বোধহয় শিকার-শিকারির খেলা খেলতে রাজাভাতখাওয়া ছেড়ে একসময় এই অঞ্চলে চলে এসেছিল।’
‘সেবার দুর্গাপুজো সবে শেষ হয়েছে। এই অঞ্চলে হঠাৎ করে বাঘিনিটির উপস্থিতির কথা জানা গেল। তারপর দিনে দিনে তার উপদ্রব ক্রমশ বেড়ে গেল। দিন পনেরোর মধ্যে তিন-তিনটি মানুষ মেরে ফেলল। সেই সঙ্গে গোরু, ছাগল তো ছিলই। লোকে ভয়ে সূর্য ডোবার পর বাড়ির বাইরে বেরোনো বন্ধ করে দিল। কালীপুজোর কয়েকদিন আগে বাঘিনিটি মারল এক সরকারি অফিসারকে। প্রশাসন খুব উদবিগ্ন হয়ে উঠল। তখনকার ম্যাজিস্ট্রেট একদিন ওঁর অফিসে আমাকে আর শিবনাথকে একসঙ্গে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, ‘আমরা যেন বাঘিনিটিকে যেমন করে হোক মেরে ফেলি। যে মারতে পারবে, তাকে হাজার টাকা সরকারি পুরস্কার দেওয়া হবে।
‘কালীপুজোর ঠিক আগেরদিন জঙ্গলের এক জায়গায় একটা অর্ধভুক্ত গোরু পাওয়া গেল। শিকার খাওয়ার ধরন দেখে ততদিনে আমরা অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছি। কাছাকাছি পায়ের ছাপ দেখে বুঝতে পারলাম, গোরুটা সেই বাঘিনিটিরই শিকার। যেহেতু সেটা অর্ধভুক্ত, তাই বাকিটা খাওয়ার জন্য তার সেখানে ফিরে আসার প্রবল সম্ভাবনা আছে। আমি আর শিবনাথ নিজের নিজের মতো পরিকল্পনা করতে থাকলাম। আমি অতিরিক্ত একটা টোপ ফেললাম। মড়ি অর্থাৎ মরা গোরুটার কাছে একটা কচি ছাগলও বেঁধে রাখার ব্যবস্থা করলাম।
‘মড়িটাকে মধ্যে রেখে দু-দিকের দু-টো গাছের উপর আমার আর শিবনাথের মাচা বাঁধা হল। দিনের আলো থাকতে থাকতে স্থানীয় লোকেরা আমাদের মাচায় পৌঁছে দিয়ে গ্রামে ফিরে গেল। রাতের অন্ধকারে বাঘিনির আসার অপেক্ষায় রইলাম আমরা। নীচে ছাগলছানাটা খুঁটিতে দড়ি বাঁধা অবস্থায় ঘেরাফেরা করছে। আস্তে আস্তে রাত ঘনিয়ে এল। ঘুটঘুটে অন্ধকার। কয়েক হাত দূরের মাচাটায় শিবনাথকে, এমনকী খুঁটিতে বাঁধা ছাগলছানাটিকেও দেখতে পাচ্ছি না। জঙ্গলে জেগে উঠল রাতের আওয়াজ। ঘড়ির কাঁঁটাটা যেন খুব ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। তবে রাতের পর রাত জঙ্গলে এভাবে মাচায় কাটানোর অভ্যেস আমাদের দু-জনেরই ছিল।
‘বাঘ বা বাঘিনি যখন আসে, তখন জঙ্গলে আওয়াজের একটা পরিবর্তন হয়। সেটা দিনে একরকম, রাতে আর একরকম। দিনের আলোয় বড়ো বড়ো গাছের মগডালে বসে থাকা পাখি বা বাঁদরের মতো জন্তুরা অনেক দূর থেকে দেখতে পায় মহারাজ বা মহারানি আসছে। ওরা চঞ্চল হয়ে ওঠে। বার্কিং ডিয়াররা অদ্ভুত গলায় ডাকে। কিন্তু রাতে অন্যরকম। রাতের বেলায় জঙ্গল বোধহয় তার নিজস্ব অনুভূতি দিয়ে বুঝতে পারে, সেআসছে।
‘সেদিনও সেরকমই একসময় জঙ্গলের ডাক পালটে গিয়ে থমথমে হয়ে গেল। নিজেকে টানটান করে নিলাম। মনে মনে একটাই প্রতিজ্ঞা, শিবনাথকে হারিয়ে নরখাদক বাঘিনিটিকে আমি মারবই। হাতঘড়ির ডায়ালে রেডিয়ামের বিজবিজে আলোর ফুটকিতে দেখলাম, রাত সাড়ে বারোটা। মাচার উপর উপুড় হয়ে শুয়ে বন্দুকের ট্রিগারে আঙুল রেখে আমি নিজেকে একদম প্রস্তুত করে নিলাম। তারপর শুধুই প্রতীক্ষা।
‘ঘন অন্ধকারেও বুঝতে পারলাম যে, সেআমার কাছাকাছি এসে গিয়েছে। গাছের নীচ দিয়ে খসখসে একটা আওয়াজ মাচাটার কাছে এসে থামল। আমার মনে শুধু একটাই খটকা, মড়িটার কাছে বেঁধে রাখা ছাগল ছানাটার আওয়াজে কেমন যেন একটা আহ্লাদি ভাব, যেন কারও সঙ্গে খেলা করছে। আমি এক মিনিট, দু-মিনিট করে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করলাম। মনে হল, ধূর্ত বাঘিনি আমাদের উপস্থিতি বুঝতে পেরে গিয়েছে আর আমাদের ধন্ধে ফেলতে ছাগলছানাটার সঙ্গে খেলা করছে। আমার কাছে ছিল একটা জোরালো পেন্সিল টর্চ। ডান হাতে বন্দুক আর বাঁ হাতে টর্চটা ধরে ছাগলছানার দিকে তাক করে সুইচটা টিপতেই টর্চের ছোট্ট ফোকাসে ঝলসে উঠল হলুদের উপর সাদা ডোরাকাটা একটা চামড়া এবং প্রায় একই সঙ্গে গর্জে উঠল উলটোদিকের মাচা থেকে শিবনাথের বন্দুক।
আমি কপাল চাপড়ালাম। টর্চের আলো ফেলে এ যেন শিবনাথকে হাতে ধরিয়ে দেখিয়ে দিলাম কোথায় বন্দুক চালাতে হবে। হতাশ হয়ে আমি চিত হয়ে শুয়ে পড়লাম। আর তখনই আমার চোখে পড়ল, আমি যে গাছের মাচাটায় আছি, তার মগডালে জ্বলজ্বল করছে দু-টো হলদেটে চোখ। এই হলুদ চোখ আমি চিনতাম। ওই বাঘিনি ছাড়া কারও চোখ ওরকম হলুদ হয় না। চোখ দু-টো আমাকে সরাসরি দেখছে। যে-কোনও মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়বে।’
‘বন্দুক আর টর্চটা আঁকড়ে ধরে আমি ঝাঁপ দিলাম মাচা থেকে। গুলি চালিয়ে শিবনাথও ততক্ষণে নেমে এসেছে মাচা থেকে। শিবনাথ ভেবেছিল, শেষ পর্যন্ত বাঘিনিটিকে মারতে পেরেছে। কিন্তু অচিরেই ভুলটা ভাঙল। মগডাল থেকে বাঘিনি ততক্ষণে নেমে এসেছে আমার মাচার উপর। আমাদের ছিল ওয়ান শাটার বন্দুক। শিবনাথের তখন আর সময় ছিল না নিজের বন্দুকে গুলি ভরে নেওয়ার। চকিতে ও মাটিতে পড়ে থাকা আমার বন্দুকটা তুলে নিল। বাঘিনি যে মুহূর্তে আমার শরীর লক্ষ করে লাফ দিল, শিবনাথের হাতে আমার বন্দুকটা গর্জে উঠল।’
টানা এতটা গল্প বলে অমিয়ভূষণবাবু থামলেন। বাগানে বসে আমরা দু-বন্ধু রুদ্ধশ্বাসে মুগ্ধ হয়ে গল্পটা শুনছিলাম। কাজের লোক গরম-গরম ফুলকো লুচি, বেগুন ভাজা দিয়ে গিয়েছিল। গল্পের টানে সেই লুচিও চুপসে গিয়েছে। অমিয়ভূষণবাবু শান্ত গলায় বললেন, ‘খাও তোমরা।’
লুচির প্লেটটা হাতে তুলে নিয়ে বললাম, ‘তারপর কী হয়েছিল?’
অমিয়ভূষণবাবুর মাথাটা ঝুলে গেল। গভীর একটা শ্বাস ফেলে বললেন, ‘শিবনাথ সেদিন আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিল। কিন্তু খ্যাতির অন্ধ লোভে এই সত্যিটা আমি কোনওদিন কারও কাছে স্বীকার করিনি। যে শিবনাথের সঙ্গে আমার শিকার নিয়ে এত রেষারেষি ছিল, সেই শিবনাথ শুধু আমার প্রাণই বাঁচায়নি, বাঘিনিকেও মেরেছে। এই সত্য জানাজানি হলে লোক সমাজে শিকারি হিসেবে আমি আর মুখ দেখাতে পারতাম না। তাছাড়া বাঘিনির মাথায় বেঁধা গুলিটা যেহেতু আমার বন্দুকেরই ছিল, তাই বাঘিনিকে যে আমিই মেরেছিলাম, লোকে নি:সন্দেহ ছিল।’
অর্ণব জিজ্ঞেস করল, ‘বাঘিনিকে যে শিবনাথদাদুই মেরেছিলেন এবং আপনার প্রাণও বাঁচিয়েছিলেন, এই সত্যিটা কারও কাছে কোনওদিন প্রমাণ করতে পারবেন না, এই মানসিক দুঃখেই কি উনি চিরদিনের জন্য শিকার ছেড়ে দিয়েছিলেন?’
‘না:!’ নীচু মাথাটা আস্তে আস্তে নাড়তে থাকলেন অমিয়ভূষণবাবু, ‘‘শিবনাথ গুলি করার পর আমি একটাই আওয়াজ পেয়েছিলাম, ‘ধপ!’ বাঘিনিটি গলা দিয়ে শেষ ডাক ছাড়ার অবকাশ পায়নি। আমি কোনওরকমে হাতড়ে-হাতড়ে টর্চটা খুঁজে পেলাম। টর্চটা জ্বালিয়ে দেখলাম, বাঘিনি মরে পড়ে আছে। তারপর আমি টর্চটা ঘোরালাম ছাগলটা যেখানে বাঁধা ছিল সেই দিকে। দেখলাম, ছাগলটা বহাল তবিয়তে আছে আর সেখানে পড়ে একটা ছোট্ট বাঘশিশু। তার সারা শরীরটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। তারপরেই দেখলাম, শিবনাথ এগিয়ে এল বাঘশিশুটির কাছে। হাঁটু মুড়ে বসে পরম মমতায় মৃত বাঘশিশুটিকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। আসলে শিকারি হলেও শিবনাথের মনটা ছিল বড্ড নরম। একটা নিষ্পাপ বাঘশিশু যখন একটা ছাগলছানার সঙ্গে খেলা করছিল, তখন তাকে গুলি করে মারার শোকটা ও কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। আমি দেখলাম, কাঁধে বন্দুক আর কোলে বাঘশিশুটিকে নিয়ে একটা ঘোরের মধ্যে ও গভীর জঙ্গলের দিকে চলে গেল।
‘মাচার থেকে পড়ে গিয়ে আমার চোট লেগেছিল। শিবনাথের পিছনে পিছনে যাওয়ার শারীরিক ক্ষমতা ছিল না। সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে মনও অত্যন্ত অবসন্ন ছিল। আমি গাছের তলাতেই মৃত বাঘিনির পাশে আচ্ছন্নের মতো বসে থাকলাম। একসময় ভোর হল। গ্রামবাসীরা রাত্রেই জঙ্গলের মধ্যে দু-টো গুলির আওয়াজ পেয়েছিল। সকালের আলো ফুটতেই কালীপুজোর ঢাকিদের নিয়ে ঢাক, ঢোল, ক্যানেস্তারা পিটিয়ে হইহল্লা করতে করতে ওরা চলে এল মাচার কাছে। বাঘিনিটাকে পড়ে থাকতে দেখে আনন্দে আমাকে কাঁধে তুলে নিল। আনন্দের আতিশয্যে কারও মনে পড়ল না শিবনাথের কথা। লোকে বরং বাঘশিশুর রক্তে লাল হওয়া শিবনাথের জামাটা দেখে অন্য গল্প ভাবল। কেউ জানল না, কী গভীর দুঃখে শিবনাথ বাঘশিশুর সঙ্গে নিজের বন্দুকটাও কবরে দিয়ে দিয়েছিল।’
অমিয়ভূষণবাবু পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমাল বের করে চশমাটা খুলে রুমালটা চোখের কোলে দিয়ে চুপ করে গেলেন। আমি আর অর্ণবও চুপ করে গিয়েছিলাম। সন্ধে মুড়িয়ে রাতের আকাশ কালো হয়েছে। সেখানে ঝিকিমিকি করে একটা একটা তারা ফুটে উঠেছে। আমার মনে হল, ওই তারাদেরই কোনও একটা ঠাকুরদা। উনিও শুনছেন অমিয়ভূষণবাবুর কথা। অস্ফুটে আমি বলে উঠলাম, ‘ওটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট ছিল ঠাকুরদা, তোমার কোনও দোষ ছিল না।’
অমিয়ভূষণবাবুর এক কাজের লোক ব্রাউন পেপারে মোড়া ঠাকুরদার বন্দুকটা এনে আমার হাতে দিল। মোড়কটা খুলে বন্দুকটার উপর আলতো করে হাত বোলালাম। কাঠের বাঁটের উপর খোদাই করে লেখা আছে ঠাকুরদার নাম, শিবনাথ লাহিড়ী।
অমিয়ভূষণবাবু বললেন, ‘আমি প্রয়োজনীয় সরকারি কাগজপত্র সব করিয়ে রেখেছি। বন্দুকটা তুমি নিয়ে যাও।’
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম। মনে পড়ল জিম করবেটের কথা। শুনেছি, ঠাকুরদার আদর্শ ছিলেন জিম করবেট। জিম করবেটও কোনওদিন নিছক শিকারের জন্য বাঘ শিকার করেননি। তিনি যদিও মনে প্রাণে একজন খাঁটি ভারতীয় ছিলেন, কিন্তু ভারত স্বাধীন হওয়ার পর কিনিয়া চলে গিয়েছিলেন। যাওয়ার আগে ওঁর বাঘ শিকারের বন্দুকগুলো নৈনিতালের কাছে গভীর জঙ্গলের এক অজ্ঞাত জায়গায় পুঁতে দিয়ে গিয়েছিলেন।
অমিয়ভূষণবাবুকে বললাম, ‘শিকার ছেড়ে দিয়ে ঠাকুরদা বন্দুকটা এখানকার জঙ্গলকেই উৎসর্গ করে গিয়েছিলেন। আপনি এখানকার জঙ্গলটা সবচেয়ে ভালো চেনেন। বন্দুকটা সেই জায়গাতেই রেখে দিন না, যাতে জিম করবেটের বন্দুকের মতো ঠাকুরদার বন্দুকটাও চিরকাল জঙ্গলেই থাকে।’
কথাগুলো বলে আমি আবার আকাশের দিকে তাকালাম। সেই তারাটা যেন খুব খুশি হয়ে পিটপিট করছে। আমার চোখে জল চলে এসে আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে গেল তারাটা।