বড়ো ভয়ে ভয়ে লিখিতে হয়। এখানে সকলেই সকল কথা গায় পাতিয়া লয়। বিশেষত যদি দুটো অপবাদের কথা থাকে। মনে করি, এমন কৌশলে লিখিলাম যে, সকলেই মনে করিবে আমার প্রতিবেশীকে লক্ষ্য করা হইতেছে, ভারি খুশি হইবে; কিন্তু দেখি বিপরীত ফল হয়। সকলেই মনে করে ওর মধ্যে যে কথাটা সব চেয়ে গর্হিত সেটা বিশেষরূপে আমার প্রতি আড়ি করিয়াই লেখা হইয়াছে– নতুবা এমন লোক আর কে আছে!
ভান এবং অন্ধ অহংকারের উপর স্বভাবতই দুটো শক্ত কথা বলিতে ইচ্ছা করে। যদি ঠিক জায়গায় আঘাত লাগে তো খুশি হওয়া যায়। কিন্তু ও সম্বন্ধে কিছু নাড়া দিলেই দুই-দশজন নয় একেবারে দেশের লোকে তাড়া করিয়া আসে। ইহার কারণ কী?
তবে কি আমরা দেশসুদ্ধ লোকই ঠাকুরঘরে বসিয়া কলা খাইতেছি? অর্থাৎ যেটা দেবতার উদ্দেশে দেওয়া উচিত, গোপনে তাহার মধ্য হইতে উপাদেয় জিনিসটি লইয়া নিজে ভক্ষণ করিতেছি? আসলে, দেবতার প্রতি ষোলো-আনা বিশ্বাসই নাই?
যে নৈবেদ্যটা সম্পূর্ণ স্বদেশের প্রাপ্য তাহার সারভাগ নিজের জন্য সঞ্চয় করিতেছি। শাস্ত্রের দোহাই দিয়া অন্তগুqnu জড়ত্বটাকে দুধকলা খাওয়াইতেছি।
যে কারণেই হৌক, আমরা সহজে ঠাকুরঘর আর ছাড়িতে চাই না। কার্যক্ষেত্রে বিস্তর কাজ, এবং অনেক চিন্তা, এবং বাধা-বিপত্তির সঙ্গে কেবলই সংগ্রাম। কিন্তু ঠাকুরঘরে কোনো কাজকর্ম নাই; কেবলই স্তবপাঠ এবং ঘন্টানাড়া। অথচ নিজের কাছে এবং পরের কাছে অতি অল্প চেষ্টায় পরম পবিত্র ভক্তিভাজন হইয়া উঠা যায়।
যদি কেহ বলে, ওহে, কাজকর্মের চেষ্টা দেখো। আমাদের ঠাকুর বলেন, আমরা জাত-পুরোহিত, কাজকর্মকে আমরা হেয় জ্ঞান করি; আমাদের পক্ষে সেটা শাস্ত্রবিরুদ্ধ।
এমন উন্নত মহানভাবে বলেন শুনিয়া তাঁর প্রতি ভক্তি হয়। ভূমিষ্ঠ প্রণাম করিয়া বলি– যে আজ্ঞা! আপনাকে আর কিছু করিতে হইবে না; আপনি এমনি পট্টবস্ত্র পরিয়া কেবল পবিত্র হইয়া বসিয়া থাকুন। ম্লেচ্ছদের মতো আপনি কাজকর্মে প্রবৃত্ত হইবেন না। মহাপুরুষেরা যে-সকল বচন রচনা করিয়া গিয়াছেন আপনি সেইগুলি সুর করিয়া আওড়ান (অর্থ না জানিলেও বিশেষ ক্ষতিবৃদ্ধি নাই)। যেগুলা সরল হৃদয়ের কথা সেগুলাকে পরম কৌশলে অতি সূক্ষ্ম তর্কের কথা করিয়া তুলুন এবং যেগুলা স্বভাবতই তর্কের কথা সেগুলা হইতে যুক্তি নির্বাসিত করিয়া দিয়া সহসা অকারণ হৃদয়াবেগপ্রাচুর্যে শ্রোতাদিগকে আর্দ্র বিগলিত বিমুগ্ধ করিয়া দিন। গোপনে কলা খান এবং দেশের শ্রাদ্ধ নির্বিবাদে সম্পন্ন করুন।
সাধনা, শ্রাবণ ১২২৯