ট্র্যাপ – উইলিয়াম এফ নোলান

ট্র্যাপ – উইলিয়াম এফ নোলান

ভিন্স থম্পসন দরজা খুলে ঘরে ঢুকতেই দেখল দোরগোড়ায় এক টুকরো কাগজ পড়ে আছে।

বেশ তো! ভাবল সে, আবার তাহলে ডাক পড়ল। মাসখানেক আগে আর শেষবার ডাক পড়েছিল।

দরজা বন্ধ করে টুকরোটার ভাঁজ খুলল ভিন্স। সেই একই চেহারার চিরকুট, শুধু একটা ফোন নাম্বার আর নিচে ইংরেজী আদ্যাক্ষর R। আর কিছু লেখা নেই। লাইট জ্বালাল ভিন্স, শিখার ওপর মেলে ধরল চৌকোণা কাগজটাকে। দ্রুত কালো হয়ে এল অক্ষর আর সংখ্যাগুলো, কুঁকড়ে গেল কাগজ। অবশেষে ছাই-এ পরিণত হলো। ফুঁ দিয়ে আঙুল পরিষ্কার করল ভিন্স, হাত বাড়াল ফোনের দিকে।

ভিন্স? R এর কণ্ঠ বরাবরের মতোই ধাতব আর খনখনে শোনা গেল ওপাশ থেকে।

হ্যাঁ। এইমাত্র খবর পেলাম।

যেতে পারবে তো?

বললে এখুনি বেরিয়ে পড়ি।

এখনই দরকার নেই। আরেকটু পরে বেরুতে হবে। সানসেট-এর পরে বেল এয়ার রোডের মাথায়। পাহাড়টার চুডোর বাঁ দিকে খোলা একটা উঠোন। পঞ্চাশ গজের মতো এগোলে পাহাড়ের মাঝখানে সাদা প্লাস্টার করা একটা বাড়ি দেখতে পাবে। সামনে একটা গ্যারেজ আছে। গ্যারেজের ভেতরে লুকিয়ে থাকবে তুমি। দরজা খোলাই পাবে। কাজেই ভেতরে ঢুকতে কোন অসুবিধে হবে না। এগারোটা নাগাদ তোমার শিকার চলে আসবে। সুতরাং তোমাকে পৌনে এগারোটার মধ্যে ওখানে হাজির থাকতে হবে।

১৬৬

হ্যাঁ, ঠিক আছে। লোকটার চেহারা-সুরত কিরকম?

লম্বা। একহারা গড়ন। চল্লিশের কোঠায় বয়স।

আগের মতোই কাজ সারব?

হ্যাঁ, পরিষ্কার কাজ চাই আমার।

আর কিছু?

না, আর কিছু জানাবার নেই, ভিন্স। কেটে গেল লাইন।

রিসিভারটা যথাস্থানে রেখে কাউচে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল ভিন্স থম্পসন। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি। কাজ হাসিল মানেই একতাড়া কড়কড়ে নোট। উইলমাকে এবার ফারের কোটটা কিনে দেবে ভিন্স। বেচারীর খুব শখ ফারের কোট পরার। আগামী রাতটা ওরা সেলিব্রেট করবে, একসাথে নাচবে, খাবে দামী খাবার…..।

একটা সিগারেট ধরাল ভিন্স, ফুসফুসে টেনে নিল ধোঁয়া। ভাবছে। রহস্যময় R-কে নিয়ে। এই লোককে কখনো কেউ দেখেনি, জানে না তার পরিচয় কি। অদৃশ্য একটা লোকের কাছ থেকে ফোনে নির্দেশ পায় ভিন্স। চিরকুটে ফোন নম্বর লেখা থাকে। তারপর হুকুম আসে অমুককে খতম করো। কাজ শেষ। সাথে সাথে কড়কড়ে নোট। কোন ঝামেলা নেই। অন্তত এ পর্যন্ত কোন সমস্যায় পড়তে হয়নি ভিন্সকে।

তবুও অস্বস্তিতে ভোগে ভিন্স। নাম পরিচয়হীন এই R কে অশরীরী মনে হয় তার। লোকটার পরিচয় জানার চেষ্টা করেছে অনেক। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। তার মতো আরো অনেকেই R-এর ধাতব, খনখনে কণ্ঠের সাথেই শুধু পরিচিত। কেউ দেখেনি তাকে। তবে ভিন্স একটা কথা স্বীকার করে R এর সেটআপে কোন ভুল থাকে না। অত্যন্ত নিখুঁত তার পরিকল্পনা। সব রকম ঝুঁকি এড়িয়ে চলে বলেই ভিন্স আজও পুলিশের কাছে ধরা পড়েনি।

ভিন্স ঘড়ি দেখল। রাত সাড়ে নটা। আধঘণ্টার মতো লাগবে বেল এয়ার-এ পৌঁছুতে। আরো দশমিনিট যাবে পাহাড় চুড়োয় উঠতে। তার মানে গলা ভিজিয়ে নেয়ার জন্য যথেষ্ট সময় এখনো পাবে সে।

.

বার-টা খদ্দেরে ভরা। শুক্রবার তাই। বেশ কসরৎ করে ভেতরে ঢুকতে হলো ভিন্সের। স্কচ আর পানি আনতে বলে ভিড়ের ওপর চোখ বোলাতে লাগল সে।

আজ রাতে আমি একটা মানুষ খুন করতে যাচ্ছি, মনে মনে ভাবল ভিন্স। আর সেই হতভাগ্য লোকটা হয়তো এ ঘরেই কোথাও আছে। ড্রিঙ্ক এসে গেছে। অল্প চুমুকে গ্লাসটা খালি করছে ভিন্স।

R-এর জন্য এ পর্যন্ত কতজনকে খুন করছে ভিন্স? দশজন? বারোজন? সংখ্যাটা যাই হোক তাতে কিছু আসে যায় না ভিন্সের। ভিন্স থম্পসনের কাছে খুন হচ্ছে পেশা, হিসেব রাখার দায়িত্ব অজানা মি. R এর। বছরখানেক আগে ফ্রিসকো থেকে লস এঞ্জেলস এসেছে ভিন্স। ওর পুরানো বন্ধু মিচ R-কে বলে তার এ কাজটা জুটিয়ে দিয়েছে। R তার কাজে খুশী, মিচ বলেছে ভিন্সকে। তবে মজার ব্যাপার মিচ নিজেও নাকি R সাহেবের চেহারা এখনো চাক্ষুস করেনি।

পেশাদার খুনী হিসেবে বেশ ঠাঁটেবাটে আছে ভিন্স। মার্সিডিজ গাড়ি কিনেছে একটা। বান্ধবীকে দামী গিফট দিতে পারছে। সুদৃশ্য ফ্লাটে থাকছে। ব্যস, আর কি চাই? বারের ওয়েটারগুলোকে বকশিস পেয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসতে দেখে মনে মনে করুণা হলো ভিন্সের। ওরা তিন মাসে যা আয় করে ভিন্স একরাতেই তা রোজগার করে।

স্কচটা শেষ করে আরেকটা ড্রিঙ্ক নিল ভিন্স।

বার ছেড়ে যখন বের হলো, শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগল। একটুও পা টলছে না তার। জানে হাতের কাজটা শেষ করে মাঝরাতের মধ্যে ঘরে ফিরতে পারবে সে। চাই কি উইলমাকে ফোন করে খবরটাও জানাতে পারে।

বেল এয়ার রোডের ঠিক মুখে সানসেট-এর জং ধরা, উঁচু গেটটার নিচে গাড়ি থামাল ভিন্স। কাছে পিঠে গাড়ি-ঘোড়া-মানুষজন কিছু নেই। দ্রুত ড্যাশ বোর্ড খুলে হালকা চেহারার ইটালিয়ান বেরেটা পিস্তলটা বের করল। অস্ত্রটা সবসময় এখানেই রাখে সে। ম্যাগাজিন খুলে চেক করল, তারপর আলগোছে পকেটে রেখে দিল। বুকভরে বাতাস টানল একবার।

R-এর হয়ে ভিন্স কাজ শুরু করার সময় পিস্তলটা নিয়ে বেশ ঝামেলা হয়েছিল। R-এর লোকজন কাজ শুরুর আগে কখনও পিস্তল নিয়ে ঘোরে না। R এর মতে তাতে ঝুঁকি থাকে বেশি। পুলিশের হাতে ধরা পড়লে আর রক্ষে থাকবে না। কিন্তু R এর যুক্তি মানতে চায়নি ভিন্স। বেরেটা ছাড়া নিজেকে অর্ধ উলঙ্গ মনে হয় ওর। ষোলো বছর বয়স থেকে অস্ত্রটাকে নিজের কাছে রাখছে, এক মুহূর্তও কাছ ছাড়া করেনি। কারণ বেরেটা ছাড়া খুবই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে সে।

পাহাড়ের পাশে, ধনী লোকজনের বাড়িঘরের কাছ ঘেঁষে পাক খেয়ে চলে গেছে বেল এয়ার রোড। পাহাড়ের চুড়ায় ওঠার সময় ভিন্সের একবার মনে হলো সে বুঝি পিছলে নেমে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। রাস্তাটা অন্ধকার এবং সরু। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে অন্য গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়ে খাদে পড়তে চায় না ভিন্স।

খাড়া রাস্তা বেয়ে চুড়োয় উঠে এল ভিন্স, মার্সিডিজ থামাল কয়েকটা গাছের নিচে, নিকষ অন্ধকারে। বন্ধ করে দিল ইঞ্জিন। এখানে ওর গাড়িটাকে কেউ দেখতে পাবে না। নিচে, মাইলের পর মাইল জোড়া বাতির ঝিলিক। বেভারলী হিলস আর হলিউডের ঘর বাড়ি।

গাড়ি থেকে নামল ভিন্স। হাঁটতে শুরু করল। খুব ঠান্ডা। ছুরির ফলার মতো ধারাল বাতাস গেঁথে যায় মুখে। এদিক-ওদিক নজর বোলাল ভিন্স।

কোথাও অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ল না তার। মনে মনে R এর নিখুঁত সেটআপের আরেকবার প্রশংসা করল সে। ধারেকাছে আর কোন বাড়িঘর নেই, সাদা প্লাস্টার করা বাড়িটির সামনে গ্যারেজ। গ্যারেজ এবং রাস্তার মাঝখানে ফাঁকা উঠোন মতো। বেশ লম্বা জায়গাটা। গুলির আওয়াজ কারো কানে গেলে ভাববে ঢালে গাড়ি ওঠার সময় ইঞ্জিন কোন গোলমাল হয়েছে। খাড়া, পাহাড়ী পথে গাড়ি তুলতে গিয়ে অনেক সময় ইঞ্জিন মিসফায়ার করে, গুলি ফোঁটার শব্দ হয়।

ভিন্স আবার ঘড়ি দেখল। রাত দশটা চুয়াল্লিশ। এখন আগে বাড়া যাক। গ্যারেজের সামনে এসে স্লাইডিং ডোরে হাত রাখল ভিন্স। R ঠিকই বলেছে, খোলাই আছে দরজা, ধাক্কা দিতে খুলে গেল।

ভেতরে, গ্যারেজের এক কোণায় সিগারেটের অনেকগুলো কার্টন চোখে পড়ল ভিন্সের। দরজা বন্ধ করে বাক্সগুলোর দিকে এগোল সে।

ঠান্ডা, শক্ত মেঝেতে আরাম করে বসল ভিন্স দেয়ালে হাত দিয়ে। শিকার দরজা খুললেই গাড়ির আলোয় স্পষ্ট দেখা যাবে তাকে। এরচেয়ে সহজ টার্গেট আর হয় না। সময় গড়িয়ে যেতে লাগল। সিগারেটের জন্য খাঁ খাঁ করে উঠল বুক। ঝুঁকি হয়ে যাবে ভেবে ধূমপানের ইচ্ছেটাকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করল ভিন্স। ডান হাতে বেরেটা তুলে নিল সে, ট্রিগারে আলতোভাবে আঙুল বোলাচ্ছে। একটা গুলিই যথেষ্ট। যখন আর্মিতে ছিল ভিন্স, মার্কসম্যান হিসেবে স্বর্ণপদক পেয়েছিল। আর ইদানিং তো প্র্যাকটিস বেশ জমে উঠেছে। কাজেই টার্গেট মিস হবার কোন কারণ নেই।

নিচের রাস্তায় গাড়ির শব্দ! সতর্ক হয়ে গেল ভিন্স। ইঞ্জিনটা গোঙাচ্ছে। পেশী ঢিল করল সে, সিধে হলো, হাতে উদ্যত বেরেটা। প্রস্তুত।

ভিন্স শুনল গাড়িটা রাস্তার মাথায় চলে এসেছে। এবার ফাঁকা উঠোনের দিকে এগোচ্ছে। সন্দেহ নেই, এসে পড়েছে শিকার।

সারবাঁধা কার্টনগুলোর মাঝে ডুবে গেল ভিন্স। অপেক্ষা করছে। বাইরে থেকে দরজা খোলার শব্দ ভেসে এল, মেঝেতে জুতোর মচমচ আওয়াজ।

এখন যে কোন সময়…

গ্যারেজের দরজা উপর দিকে উঠতে শুরু করল, ভিন্স দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে রাখল, সময় বুঝে টিপে দেবে ট্রিগার।

চেপে রাখা শ্বাস সশব্দে ফেলল ভিন্স।

গালি দিল একটা।

কেউ নেই ওখানে।

খোলা দোরগোড়ায় তীব্র আলো ছড়াচ্ছে শক্তিশালী দুটো হেডলাইট।

ভিন্স টের পেল ওর গলা শুকিয়ে এসেছে, ঢিপ ঢিপ করছে বুক। আলোর বন্যার দিকে চোখে পিটপিট করে তাকাল সে। কিছুই দেখা গেল না।

শুধু আলো, গাড়ির ইঞ্জিনের অবিরাম শব্দ আর বাতাসের শোঁ শো। হঠাৎ মি. R এর ধাতব, খনখনে কণ্ঠের কথা মনে পড়ে গেল ভিন্সের:

লম্বা, একহারা গড়ন। চল্লিশের কোঠায় বয়স। আতঙ্কিত হয়ে পড়ল ভিন্স। এ যে তার দেহের অবিকল বর্ণনা!

অকস্মাৎ সব পরিষ্কার হয়ে গেল ভিন্সের কাছে। মনে পড়ল মিচের। কথা। সে যে অদৃশ্য R সাহেবের ব্যাপারে অন্যের কাছে খোঁজ-খবর নিচ্ছিল এটা তার পছন্দ হয়নি। ভিন্স R এর কাছে ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল। মনে পড়ল R ঝুঁকি নেয়া পছন্দ করেন না।

এখন, মনে মনে বলল ভিন্স, তোমার করণীয় কাজ একটাই–যত দ্রুত সম্ভব কেটে পড়ো এখান থেকে! নিজের গাড়িতে যদি ভাগ্যক্রমে উঠতে পার তো বেঁচে গেলে এযাত্রা। তবে তার আগে, ওই হেডলাইট জোড়ার একটা ব্যবস্থা করতে হবে।

পরপর দুবার গুলি করল ভিন্স। আলোর নরম দুটো ঝর্ণাধারা ঝিকিয়ে উঠে নিভে গেল। ঘন অন্ধকারে ছুটল ভিন্স।

সামনের রাস্তা নিরাপদ মনে হলো ওর কাছে। গ্যারেজের সামনে দাঁড় করানো গাড়িটাকে সবেগে পাশ কাটাল সে, কুঁজো হয়ে ছুটছে, হাতে উঁচিয়ে ধরা বেরেটা।

এই সময় পুরোপুরি অন্ধ হয়ে গেল ভিন্স। যেন আঁধার ফুঁড়ে বেরোল ওগুলো, একসাথে ডজনখানেক অত্যুজ্জল ফ্লাশ লাইটের চোখ ধাঁধানো আলো চোখে এসে পড়ল। ধাঁধিয়ে দিল চোখ। ঈশ্বর! ওরা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে!

গুলির শব্দটা যদি কেউ শুনেও ফেলে নিশ্চয়ই ভাববে গাড়ির ইঞ্জিনে কোন গোলমাল। খাড়া পাহাড়ি রাস্তায় ওঠার সময় গুলি ফোঁটার মত শব্দ তো এখানে করেই থাকে ইঞ্জিন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *