1 of 2

ট্রেন বে-লাইন হলে

ট্রেন বে-লাইন হলে

স্কুল ছুটি হয়ে গেছে অথচ সে ফিরে যায়নি। বনলতা বিড়বিড় করে বকছে। কেমন হিম হয়ে গেছে শরীর। দারোয়ানকে রিকশা ডেকে দিতে বলার জন্যও যে শক্তির দরকার তাও সে হারিয়েছে। অংশু তো কোথাও যায় না। স্কুল ছুটি হয়ে গেছে, সে গেল কোথায়! কেমন বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে তার চিন্তাভাবনা! কী করবে! কোথায় যাবে—কাকে ফোন করবে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে, পড়েই যেত—কারণ, যেভাবে রোজকার কাগজে রোমহর্ষক মর্মান্তিক ঘটনার খবর বের হয়, তেমনি কোনো খবর যদি অংশু হয়ে যায়, তার পড়ে যাওয়া ছাড়া আর কি করার থাকবে।

আসলে বনলতা কিছুই ভাবতে পারছে না। কেমন শুধু অন্ধকার দেখছে। তার যে আরও কিছু প্রশ্ন করা উচিত ছিল, সে বোধও হারিয়ে ফেলেছে। প্রধান শিক্ষক আছেন কি না, তিনি যদি কিছু জানেন, কিংবা কাউকে কোনো খবর দিয়ে যদি সে কোথাও যায়, দারোয়ানকে বলে গেলে সে অবশ্য বলেই দিত-তবু কিছুটা হেঁটে এসে রাস্তায় দাঁড়ালে প্রথম যে করণীয় কাজ, ওর বাবার অফিসে ফোন, অংশু বাড়ি ফিরে যায়নি।

এতটা উদভ্রান্ত যে রাস্তা পার হতে পর্যন্ত পারছে না—রিকশা নেই, ট্যাক্সি যদি পাওয়া যায়—কিছুটা আলগা জায়গায় স্কুল, ট্যাক্সি বড়ো আসে না। স্কুল ছুটির সময় কিছু রিকশা মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু এই মুহূর্তে দুজন ঢ্যাঙা লোক সেখানে দাঁড়িয়ে গল্প করছে ছাড়া কোনো দৃশ্য ভেসে উঠছে না। একটু এগিয়ে গেলে ওর সহপাঠী কুন্তলকে পাওয়া যেতে পারে। এটা তো তার আগেই মনে হওয়া উচিত ছিল। আসলে সে তার স্বাভাবিক বুদ্ধি হারিয়েছে। কেমন মাথা ঘুরছে, দাঁড়াতে পারছে না সে। রোজই অংশু বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত বার বার ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে—উঁকি দেয়, আর আতঙ্কে ডুবে যেতে থাকে— আজ সেই অদৃশ্য আতঙ্ক তাকে সত্যি জড়িয়ে ফেলেছে, আগে ফোন করা দরকার, না, কুন্তলদের বাসায় খোঁজ নেবে! যদি সেখানে যায়—সামনে টেস্ট, দুজনের মধ্যে খুব ভাব। হয়তো গিয়ে দেখবে সেখানে সে বসে আছে। অফিস থেকে সাতটার আগে বের হতে পারে না মানুষটা। অযথা দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়ে কী লাভ! আগে কুন্তলদের বাড়ি। বাড়ি গিয়ে দেখল, দরজা-জানালা বন্ধ। সদরে তালা দেওয়া। পাশের ফ্ল্যাটে একজন মুখ বাড়িয়ে বলল, ওরা দুদিন হল নেই।

বনলতা প্রায় টলতে টলতে নেমে এল। ট্যাক্সি পেয়ে গেল সামনে। সোজা যে রাস্তায় অংশু বাসে করে ফেরে সেই রাস্তা ধরে গেল। কোথাও কোনো জটলা, কিংবা দুর্ঘটনা—ঘন্টা খানেকের তফাত-কিছু হলে বাস-রাস্তায় সে জানতে পারবে–এই ভেবে ট্যাক্সি থেকে মুখ বাড়িয়ে চারপাশ লক্ষ করছে। শরীরে প্রচণ্ড অস্বস্তি–সঙ্গে সঙ্গে কেন যে মনে হল অযথা দুশ্চিন্তা করছে। বাড়ি গিয়ে দেখবে, অংশু দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। মাকে দেখলেই বকাবকি শুরু করে দেবে। দু-একবার সে রাত করে ফিরেছে, তবে স্কুল ছুটি হলে সোজা বাড়ি, তারপর তার বের হওয়া। ছুটির দিনে ক্রিকেট ব্যাট লাল বল, কিংবা হাতে ব্যাডমিন্টনের র্যাকেট—তার প্রিয় খেলা আর প্রিয় সঙ্গী বই, সে তার এক নতুন জগৎ তৈরি করে নিচ্ছে বনলতা বুঝতে পারে। কখনো ভালো ইংরিজি বই দেখে। তবে কখনো সে না বলে কয়ে কিছু করে না।

কিন্তু, না অংশু ফিরে আসেনি। সে এবার আর পারল না। দাদাকে ফোনে জানাল, অফিসে অংশুর বাবাকে পেল না। মেজদার ফ্ল্যাটে ফোন করল। পিসির বাড়িতে–সবাই জেনে গেল অংশু আজ বাড়ি ফেরেনি। বনলতা ধীরে ধীরে দেখল, মানুষজনে ভরতি হয়ে যাচ্ছে। একতলা দোতালায় সব আত্মীয়স্বজন। দেয়াল ঘড়িতে রাত বাড়ছে। কাগজের অফিসে চলে গেল মেজদা।

হ্যালো মেডিক্যাল কলেজ—কোনো দুর্ঘটনার খবর। হ্যালো নীলরতন, আর জি কর, পি জি-না কোথাও কোনো দুর্ঘটনার খবর নেই।

সে স্কুলে আজ গেছে কি না এটাও জানা দরকার। অমলকে ফোনে পেয়ে গেল। সে বলল, অংশু ওর সঙ্গে টিফিনের পর বের হয়েছে। বাস ধরবে বলে বড়ো রাস্তার দিকে গেছে।

সুতরাং এসব ক্ষেত্রে যা যা করণীয় অংশুর আত্মীয়স্বজনরা করে যাচ্ছে-থানা পুলিশ, সর্বত্র খবর হয়ে গেল, আবার একজন স্কুলের ছাত্র বাড়ি ফেরেনি।

আশ্চর্য, বনলতা কাঁদতে পারছে না। বড়ো বড়ো চোখে শুধু দেখছে। সে থরথর করে কাঁপছে। আর অজস্র প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিল।–বকাবকি করেছিলে?

না।

কিছু বলে যায়নি?

না না। রোজকার মতো গেছে। রোজকার মতো ফিরে আসবে—কিন্তু ফিরে এল না কেন?

অংশুর বাবা ওপাশের ঘরে ইজিচেয়ারে লম্বা হয়ে পড়ে আছে।

কেন ফিরে এল না! বনলতা কেন যে তার পাপের কথা ভেবে ফেলল—ঠাকুর দেবতা সবার কাছে মানত করার সময় মনে হল—কোনো দূরবর্তী উপত্যকায় কে একজন হেঁটে যাচ্ছে। সেই কি নিয়ে গেল! শত্রুতা!

সিঁড়ি ধরে কেউ উঠছে, কেউ নেমে গেল-বনলতার এক কথা, ওকে এনে দাও। আমি আর কিছু চাই না।

দ্রুত ট্রেন চলে যাচ্ছে। ট্রেনের দরজায় কেউ দাঁড়িয়ে। বনলতা যেন তাকে চেনে। সে মুচকি হেসে যেন বলে গেল, তাহলে এই। কেমন লাগছে?

কখনো কোনো পাপবোধ বনলতাকে তাড়া করেনি। অংশু ফিরে না আসায় সে

যে কী সব ছাইপাঁশ ভাবছে। এখানে-সেখানে খুঁজছে কিছু—যদি অংশু যাবার আগে চিঠি রেখে যায়। ওর মাসির বাড়ি যদি যায়—কিংবা এই বয়েসটা বড়ো দুর্ভোগের বয়স। কে জানে, ঠিক তার মতো কোনো নারীর ছলনায় অংশু পড়ে গেল কি না।

এই প্রথম মনে হল সে ছলনা করেছে। সুদত্ত যে আত্মঘাতী হল কেউ জানে, এমনকী সুদত্তের মাও জানত না কেন সুদত্ত আত্মঘাতী হল।

জানত একমাত্র বনলতা। ঠিক জানত বললে ভুল হবে, সে বুঝতে পেরেছিল, ভালোবাসা সূর্যের চেয়েও ব্যতিক্রম। আলোর উৎস নেমে আসে, অবগাহন চলে— সাদা জ্যোৎস্নায় ছবি হয়ে থাকে দুজন—এমন সব দৃশ্য বনলতার চোখে ভাসছে।

বনলতা খুঁজছিল। অংশুর ঘরে ঢুকে ওর বিছানা, টেবিল, নিজস্ব দেরাজ যা কিছু আছে। খাতা, ওয়ার্ক এডুকেশনের লাল নীল রঙের কার্ড বের করে সে পাগলের মতো খুঁজছে। কেমন বেহুশ। কেউ উঁকি দিয়ে দেখে যাচ্ছে, কেউ এলে বনলতা দৌড়ে সিঁড়ির রেলিং-এ ছুটে যাচ্ছে, যদি কোনো খবর। ফোন বেজে উঠলে টলতে টলতে গিয়ে কেউ ধরার আগেই ধরে ফেলছে।

হ্যালো!

সুদত্ত বলছি। কেমন আছ?

বনলতা কাঠ হয়ে গেল। ঝন ঝন করে রিসিভারটা পড়ে গেল নীচে। পড়েই যেত। পাশে পিসিমা ছিলেন বলে রক্ষে। ধরে ফেলেছেন। সবাই ছুটে এসেছে। বনলতার বাবা বললেন,

এ-ঘরে এনে শুইয়ে দাও।

বনলতা কেমন এক গভীর আচ্ছন্নতার মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। সেই দূরবর্তী উপত্যকায় কি সত্যি কেউ থাকে!

বনলতা চোখ মেলে দেখল, বাবা-মা সবাই তার পাশে বসে। জিরো পাওয়ারের আলো জ্বলছে। পাশের বাড়ির জানালা বন্ধ করার শব্দ পেল। সিঁড়িতে আর কোনো পায়ের শব্দ নেই। কোনো খবরই কেউ দিয়ে গেল না। অংশু কোথায় গেল! অভিমান বড়ো সাংঘাতিক অসুখ। কিংবা বিনুর মেয়েটার সঙ্গে যদি ওর কিছু হয়? সহসা মনে হল, আরে সেই মেয়েটার খোঁজ নিলে হয়। ধড়ফড় করে উঠে বসলে বাবা বললেন, কোথায় যাবে! এত অস্থির হলে চলে। ঈশ্বরকে ডাক। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব। কালই বিজ্ঞাপন যাচ্ছে টিভিতে। নিখোঁজ-অংশু নিখোঁজ। এত উতলা হলে চলে!

ছাড় আমাকে, ছেড়ে দাও।

বনলতার বেশবাস ঠিক নেই। আঁচলটা ওর মা কাঁধে তুলে দিয়ে বুক ঢেকে দিল। স্তনের মধ্যে রয়েছে মাতৃদুগ্ধ। বনলতা স্তন ঠিক রাখার জন্য সন্তানকে মাতৃদুগ্ধ খাওয়ায়নি। স্তন সুডোল এবং নিস্তেজ। শিরা-উপশিরা সব এখন ম্রিয়মাণ–পুরুষ আত্মীয়স্বজনের চোখে মা চায় না কন্যার এই পুষ্ট স্তন ভেসে উঠুক। এমনও হতে পারে স্তনের আছে এক আশ্চর্য গাম্ভীর্য। যা এখন যতই পরিস্ফুট হোক—বাসি ফুলের মতো অর্থহীন।

বনলতা তার স্তন সম্পর্কে এ মুহূর্তে আর সচেতন নয়। বিবর্ণ মুখ। চুলে এলোমলো ঝড়ের দাপটে গ্রাহ্যহীন—ছুটে যাবার সময় আঁচল আবার পড়ে গেছে–একবার দেওয়াল ঘড়ির দিকে ঘোরের মধ্যে চোখ বুলিয়ে মুখ আরও ফ্যাকাশে। ফোন করতে গিয়ে হাত কাঁপছে। ছোটো বোন ধরে নিয়ে এসেছে ফোনের কাছে। বনলতা উবু হয়ে বসল। কিন্তু ডায়াল ঘোরাতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হবার মতো বসে থাকল বনলতা।

কাকে ফোন করবে?

বিনুকে।

বিনুকে করবে! আমরা করছি। উঠে এস।

কোনো রকমে বনলতা যেন উঠে দাঁড়াল। পাশে প্রায় শয্যাশায়ী সেই মানুষ—যে তার গভীর প্রপাতে অহরহ অবগাহন করতে অভ্যস্ত। এ মুহূর্তে সে মানুষ নীরব হয়ে গেছে। বুদ্ধিভ্রংশ হলে মানুষের এমন হবার কথা। বনলতার কি বুদ্ধিভ্রংশ হয়েছে। বিনর মেয়েটা তেরো চোদ্দো। এবং তেরো চোদ্দো বছরে কী কী হয়। নতুন উপসর্গ দেখা দেয়, তলপেটে ব্যথা হয়, আর কী হয়, জানালায় কোনো তরুণ হেঁটে যায়। যায় চোখ বিহ্বল থাকে—আর সব রহস্য, কিংবা কৌতূহল জেগে থাকে—যেন এই পৃথিবীর ঘাস মাটি উর্বর হয়ে আছে, দরকার কোনো দক্ষ চাষবাসের মানুষ। মাটি চষে ফেলবে, ফালা ফালা করে দেবে সব।

এ কি বনলতা এ মুহূর্তে সুদত্তের সেই কথাগুলিই যে আওড়াচ্ছে!

বোসো না!

বসতে পারি। হাত দেবে না। ছবি আঁকছ, আঁকো। তোমার ভারি খারাপ স্বভাব।

গোপনে চলে আস কেন তবে!

তোমাকে দেখব বলে। সারাদিন না, কী যে লাগে!

সোনা আমার। সুদত্ত চুমো খেল।

শরীর ঘেমে যায়। রোমকূপ সব অগ্নিবর্ণ হতে থাকে। আর প্রপাতে অস্পষ্ট ধারা। কোনো বনভূমির মধ্যে সে হাঁ করে আছে, প্রত্যাশার আগুন শরীরে, অথচ সচেতন সে তার পুষ্ট স্তন সম্পর্কে। তাকে সুন্দর করে বনফুলের মতো গোপনে ফুটতে দেওয়া ভালো। নাভির নীচে অগ্ন্যুৎপাত এবং শরীর অবশ হয়ে গেলে সুদত্তকে বলা, তোমাকে ছাড়া আমি কিছু সত্যি জানি না।

চাষবাসে ফালা ফালা করে দেবার ব্যাপারে কোনো আপত্তি থাকত না বনলতার।

তবে দেখাও।

কী দেখাব? কেন সেই—ওই যে, তুমি জেনেও এমন করো।

না বলতে হবে কী দেখাব!

আরে নরখাদক বাঘিনিটাকে। দেখাও না। কেমন সে গোপনে লুকিয়ে আছে। গভীর বনে। দারুণ, দারুণ।

আবার অসভ্যতা শুরু করলে?

সোনা আমার। লক্ষ্মী। বলেই জাপটে ধরা। এবং আশ্চর্য নীরব এক প্রবহমান সংগীত বেজে উঠতে থাকে শরীরে। কী যে হয়! যেন কোনো অতলে হারিয়ে যেতে যেতে জেগে যেত বনলতা। শাড়ি সামলে উঠে বসত। কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে বসে থাকা। আর সুদত্ত সুচারু ভঙ্গিতে তুলির ছবি টেনে দিচ্ছে। মাত্র কয়েকটা রেখায় বনলতা ছবির মধ্যে জীবন্ত হয়ে থাকত।

ধর বিনু বলছে।

ফোনটা এগিয়ে দিতেই বনলতা কোনোরকমে বলল, অংশু আজ বাড়ি ফেরেনি। তোদের কাছে গেছিল!

বিনু বলল, বাড়ি ফেরেনি! কোথায় গেছে!

জানি না, কিছু জানি না। অপুকে দে!

অপু!

হ্যাঁ অপু। ওর সঙ্গে আমার কথা আছে।

আমি মাসিমা।

তুই! অংশু তোকে কিছু বলেছে?

না মাসিমা। ও তো কিছু বলেনি।

আজ গেছিল?

না মাসিমা।

মিছে কথা বলছিস! বল, ঠিক করে বল, তুই ওকে কিছু বলেছিস কি না!

অংশুও কি বলেছিল, দেখাও সেই নরখাদক বাঘিনিকে। কারণ বনলতা জানে, অংশু সিনেমা ম্যাগাজিনে গোপনে সব নায়িকাদের ছবি দেখে থাকে—আজ বনলতার মনে হচ্ছে একটা চিতাবাঘের মতো ছুটছে কেউ-সে এক নারী, শিকারি চিতাবাঘ যেমন হয়ে থাকে। সহসা বনলতা চিৎকার করে উঠল, অংশুর কিছু হলে কাউকে ক্ষমা করব না, কাউকে না। কাউকে…..।

কাকে এই তিরস্কার! পাশাপাশি মানুষজন হতচকিত। মাথাটা খারাপ হবার বোধ হয়।

উপক্রম! বনলতার মা বলল, এত উতলা হস না মা। ভগবানকে ডাক। কাকে ক্ষমা করবি না বলছিস!

বনলতা ছেড়ে দিল ফোন। হেঁটে গেল—যেন সব সে হারিয়েছে। এই হারানোর ব্যাপকতা এত অসীম যে সে অন্ধকার দেখছে। শুধু অন্ধকার—গভীর নীল অন্ধকার —এবং দূরে আবার সেই মানুষ হেঁটে যাচ্ছে। হাতে অতিকায় তুলি, আকাশের দেওয়ালে বড়ো বড়ো ছবি এঁকে চলেছে।

এই দেখ বনলতা, আহা বসো না, ঠিকঠাক হয়ে বসো। ঘাড় একটু বাঁকাও। ঊরু সামান্য তুলে দাও। হ্যাঁ ঠিক আছে। না, না দুই উরুর ভাঁজ স্পষ্ট থাকুক। আমার বাঘিনিকে দেখতে দাও। ছবি দেখ। জংঘা এবং নাভিমূলে আছে অনন্ত রহস্য। আমরা পুরুষেরা ছুটছি, ঈশ্বরের সৃষ্টি রক্ষা হচ্ছে। বাঘিনি বললে তুমি, তুমি এত ব্যাকুল হয়ে পড়ো কেন! তুমি নিস্তেজ হয়ে পড়ো কেন?

আসলে বনলতা টের পায় সঙ্গে সঙ্গে, একজন তরুণ যুবকের সান্নিধ্য অতিশয় মনোরম।

বাবার এক কথা, না, বাউণ্ডুলে ছেলে, ওর সঙ্গে মিশবে না।

কবে মিশলাম!

শুনেছি, তুমি ওর সঙ্গে চৌরঙ্গি দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলে! তুমি ওর বাড়িতেও যাও। আমার মান-মর্যাদার কথা ভাব!

আবার ফোন। কে! কে!

কাগজের অফিস থেকে। ওরা আসছে। সব খবর নেবে। রিপোর্ট করবে। অংশুর ছবি বের করে রাখো। পাশপোর্ট সাইজের ছবি দরকার। মেজদা দরজায় উঁকি দিয়ে কথাগুলি বলছে!

সব বলবে। কখন বাড়ি থেকে বের হয় কখন ফেরে, কোথাও বিকেলে কিংবা। সন্ধেবেলায় যায় কি না!

খবরওয়ালারা এল, চলে গেল। বড়ো দ্রুত যানবাহনের মতো গতি নিয়ে আসে যায় সব কিছু, তারপর অদৃশ্য হয়ে যায়, ছবি ভাসে শুধু—কেউ ফিরে আসে না। দরজায় খুট খুট শব্দ, হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে ওঠে। বনলতা জানালায় বসে আছে। আকাশ আজও নীল এবং গভীর বেদনার প্রতিচ্ছায়া। কোনো এক করুণাময় যেন তুলি বুলিয়ে দিচ্ছে। তুমি সুদত্ত এভাবে প্রতিশোধ নিও না। আমার মতো অপুও বলছে, যায়নি। অংশু যায়নি। সে কিছু জানে না। আমি কি জানতাম, তোমার এই চলে যাওয়া শেষবারের মতো—আমি কী করব বল! কেউ চাইত না, আমি যাই।

আর কেন যে বাঘিনি এই শব্দ এত প্রতীকময় হয়ে যেত তার কাছে—শরীরের কোশে কোশে অগ্নিশিখা জ্বলে উঠলে কে না নষ্ট হয়ে যায়! আমি গোপনে নষ্ট হয়ে গেছিলাম। আমার ছলনা টের পেলে, বুঝলে আসলে শরীরসর্বস্ব হয়ে আছি, আমার সব আকাঙক্ষা এবং কৌতূহল নিবৃত্ত করা ছাড়া, তোমার কাছে চাইবার মতো কিছু নেই। তোমার অন্ধ মা, মানে মাসিমার সেই আর্ত চিৎকার কানে বাজে। একই ভাবে ফোন এসেছিল, বনলতা, সে তোমাকে কিছু বলে যায়নি—বনলতা, কেন যে সে রাতে ফিরে আসেনি—আমি ওর খোঁজ কোথায় করব! কোথায় যাই!

না না! বনলতা দুহাতে মুখ ঢেকে ফেলছে। সে অতীতের কোনো আর্ত চিৎকার শুনতেই রাজি না।

বনলতা ভাবতে পারছে না।

অকারণ এক যুবকের লাশ দেখা গেল রেলের ধারে পড়ে আছে। সুদত্ত নামে এক যুবকের লাশ যদি পড়ে থাকে—কেন পড়ে আছে, কী কারণ, এমন সব প্রশ্ন উঁকি দিতেই পারে। দিয়েও ছিল। মৃত্যুরহস্য উদঘাটনে পুলিশ আর খবরের কাগজগুলি সেদিন তোলপাড় করে ফেলেছে। অথচ কেউ জানে না সে এসেছিল তার নারীর কাছে, কিংবা নারী তার কাছে গিয়ে বলেছিল, সুদত্ত বাড়ি থেকে পাত্র দেখছে। তুমি কিন্তু আমার উপর বিশ্বাস হারিও না।

সুদত্তের চোখ নির্বোধের মতো দেখাচ্ছিল অথবা স্থির এবং নিষ্পলক–মানে তুমি, তুমি সত্যি কী চাও আমি জানি না। এতদিন তবে এ ভাবে আমাকে জড়িয়ে রাখলে কেন? বিশ্বাস হারাবার প্রশ্ন আসে কী করে?

আমি জানি, সুদত্ত আমার মঙ্গল অমঙ্গল সব তোমার কাছে গচ্ছিত। কোনো অপকারই তুমি করতে পার না। আমি যদি হারিয়ে যাই, তুমি আমাকে খুঁজে বেড়িও।

সুদত্ত বলেছিল, বুঝতে পারছি না, কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার জন্য তুমি কী রেখে যাবে তবে। স্মৃতি! বিশ্বাসভঙ্গ আমি করব না। কোনো এক অতীত থেকে উঠে আসা স্মৃতি বনলতাকে তোলপাড় করে দিচ্ছে। সে হাতড়াচ্ছে—হেতু সেই জানত–পাত্রপক্ষ যেদিন দেখতে এল, সেদিনও সে এতটুকু বিচলিত বোধ করেনি। বরং এমন সুপাত্র এবং দীর্ঘকায় সুন্দর পুরুষ তার হাত ধরে সংগোপনে কিংবা বন্য বাঘিনিকে পোষ মানাবার জন্য কী কাতর তার চোখমুখ। অংশুর বাবার চোখে আশ্চর্য ধার। তার শরীরের রোমকূপ আবার অগ্নিবর্ণ হয়ে গেলে, সে এক বিকেলে নীলার বাড়িতে যাবে বলে বের হয়ে পড়েছিল।

কে? দরজায় বাইরে কে দাঁড়িয়ে?

আমি বনলতা। তোমার কাছে মার্জনা চাইতে এলাম।

মার্জনা? কীসের মার্জনা! নাটকের সংলাপ যে! তুমি কী বলছ বুঝতে পারছি না! আমি কেন আর আগের মতো ঠাট্টা পরিহাস কিছুই করতে পারছি না। আমি জানি, সেই হিংস্র নরখাদক বাঘিনির কথা বললেই ব্যাকুল হয়ে উঠবে। গভীর প্রতীকী কথাবার্তা তুমি এমন করে বুঝতে, অথচ সেই তুমি আর অকুণ্ঠচিত্ত নও। ছলনা শেষে এ ভাবে মানুষকে ভারাক্রান্ত করতে পারে আমি জানতাম না। এগুলো সম্ভবত সুদত্তের সেদিনের ভাবনা।

সুদত্ত কোনো কথা বলেনি। মাথা নীচু করে বসেছিল। সে তার মুখ তুলে দেখেছে, চোখে জল। তার কোনো ভাষা ছিল না। নারী ছলনাময়ী টের পেয়ে সে নীরব হয়ে গেছিল। বালকের মতো অবোধ চোখে তাকিয়েছিল শুধু।

আমি যাই সুদত্ত।

এস। সে উঠে এসেছিল। বারান্দা পর্যন্ত এগিয়ে আবার ফিরে গেল। বনলতা ফিরে তাকায়নি। তাকালে কী হত জানে না। বিশ্বাসের দায় সঁপে দিয়ে চলে এসেছিল।

এই বিশ্বাসের দায় সুদত্ত অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। সে হঠকারী যুবকের মতো যদি সত্যি কিছু ফাঁস করে দেয়, তবে তার তুলির টানে কিশোরী আর ছবি হয়ে যাবে কী করে! সে ঠিক অন্য দিনের মতো বিকেলে বের হয়ে গেছিল। কাঁধে ব্যাগ। কেউ জানত না সে ভিতরে ভিতরে অস্থির। বাস-স্ট্যাণ্ডে দাঁড়িয়েছিল। কোন বাসে উঠতে হবে সে যেন বুঝতে পারছে না। কোথায় যাবে সে জানে না। আচ্ছন্ন এক যুবকের এই বেশবাস, চাউনি, মৃত মাছের মতো চোখ যার, হৃদয়হীন হয়ে আছে—কেউ জানে না, সুদত্ত সেদিন আর বাড়ি ফেরারও আগ্রহ বোধ করছে না। সে সব হারিয়েছে। সে বুঝে উঠতে পারেনি, বাসটা তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। যেন এমন কোথাও এক অজ্ঞাত জায়গার খোঁজে আছে সে যেখানে নিজেকে চিরদিনের মতো আড়াল করতে পারবে।

বনলতা শুনেছে, সুদত্তর লাশ পাওয়া গেছিল মসলন্দপুর স্টেশনের কাছে।

কেউ বলেছে, গাড়ি থেকে পড়ে গেছে।

কেউ বলেছে, দুর্ঘটনা। আর কিছু নয়। সুদত্ত মাঝে মাঝে ছবি আঁকার জন্য বের হয়ে পড়ত। কোনো শস্যখেতের পাশে বসে থাকত একা। চাষি রমণীর মুখ আঁকত। কিংবা শস্য রোপণের দৃশ্য। দূরের সেই আকাশ, কিছু গাছ কিংবা পাখি এ সবই ছিল তার ছবির বিষয়। পরম যত্নে স্কেচগুলি তার ঝোলায় ভরে, উঠে দাঁড়াত। বড় সুন্দর মনে হত তার কাছে মানুষের জীবনযাপন। এবং আগ্রহ আছে এক নারীর—যার আসার কথা, সে আসবেই, তার টেবিল ঘেঁটে বের করবে মনোরম সব ছবি—দেখে বলবে, কী দারুণ হাত! আর আশ্চর্য বনলতা দেখত, সব ছবিতেই আছে রমণীর মুখ, নানা রকমের, যেমন সুদত্ত তাকেই নানা বয়সে সব নারীর মধ্যে ধরে রাখার জন্য পাগল।

সুতরাং দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে, কেউ আবিষ্কার করতে পারেনি।

বনলতা সকালবেলায় কাগজে সুদত্তর খবর পড়ে বিমর্ষ হয়ে থাকত। কেউ এলে চকিতে উঠে দাঁড়াত। তারপর সেই সহজ ভঙ্গি, ইস সুদত্ত একটা পাগল। কী বোকা! ছবি আঁকার নামে এত ঘোর ভালো না। ঠোঁট উলটে বলত, এত অন্যমনস্ক হলে হয়! কারণ সুদত্তের বন্ধুবান্ধবেরাও দেখা করতে আসত। তারা তারও সহপাঠী। বোকা সুদত্তকে নিয়ে হাসি মশকরা পর্যন্ত শুরু হলে বনলতা বলত, আমি বলেছিলাম না তোদের, বাসে সে কখনো না দৌড়ে গিয়ে উঠবে না। ট্রেন ছাড়লে দৌড়ে ওঠার অভ্যাস। এত সতর্ক করেছি, শেষে যা ভেবেছিলাম, তাই হল।

সুদত্তের অপমৃত্যু নিয়ে গায়ে একটা মাছি বসলেও সে টোকা দিয়ে উড়িয়ে দিত।

তোর সঙ্গে কবে শেষ দেখা?

অনেকদিন আসেনি আড্ডায়।

তুই তো ওর বাড়ি যেতিস, কিছু বুঝতে পারিসনি।

বাড়ি আবার কবে যেতাম! মাসিমা একবার যেতে বলেছিলেন, সুদত্ত বার বার বলত, মা তোমার কথা খুব বলে, তুমি গেলে মা খুশি হবেন, এসো, সেই একবার যাওয়া।

কারণ বেফাঁস কথাবার্তা বলে সে এই অপমৃত্যুর সঙ্গে নিজেকে জড়াতে যায়নি। গোপনে সে যে বারবার গেছে, ভিতর বাড়িতে মাসিমা, সে বাইরের ঘরে, সামনের বারান্দা পার হয়ে বড়ো কাঁঠাল গাছের ছায়ায় সুদত্তের ঘর—একা নিবিষ্ট মনে তার ছবি আঁকা, কিংবা মাঝে মাঝে যে চা দিয়ে যেত, বনলতা গেলে তা দেবার হুকুম ছিল না। ভিতরের দিকে দরজা বন্ধ থাকত। বাইরের দিকে জানালা-দরজা খোলা, তারপর পাঁচিল, এবং সামনে এক পরিত্যক্ত নিবাস ছাড়া কেউ সাক্ষী ছিল না তার উপস্থিতির।

বনলতা ঘড়ি দেখল।

অংশু কি অপুর কাছে পালিয়ে যায়! অংশু যদি কোনো কারণে বেফাঁস কিছু করে বসে, এবং যদি অপু বলে, দাঁড়াও না, তুমি এত অসভ্য, মাকে বলে দেব কারণ অপুর পড়ার ঘর নীচে। গোপনে অংশু যেতেই পারে—অথবা সহসা সেও কি হিংস্র নরখাদক বাঘিনির পাল্লায় পড়ে গিয়ে হতচকিত-কিংবা অস্থির হয়ে উঠেছিল—সে জানে গোপন অভিসারের মধ্যে আছে কীটের বাসা।

কে জানে সেই কীট-দংশনে অংশু বেহুশ হয়ে বের হয়ে পড়েছে কি না! যদি বের হয়ে যায়, কিংবা সুদত্তর মতো কোথায় যাবে স্থির করতে না পারে, তবে অন্য কোনো দূরবর্তী ট্রেনে চেপে যে বসেনি কে বলবে! মাথা ঠিক থাকে না। পাগল পাগল লাগতেই পারে এবং পারিবারিক মর্যাদা নষ্ট হবার ভীতি যদি পেয়ে বসে তাকে—তবে সে একটা কিছু করে বসতেই পারে। অংশু সতেজ গাছের মতো বেড়ে উঠেছে। চারপাশে ডালপালা পুঁতে বড়ো করে তোলা হচ্ছিল, যেন কোনো কারণে আগাছায় জড়িয়ে না ফেলে। কোনো পরগাছা তার শরীরে বাসা না বাঁধে কী প্রাণান্তকর সেই চেষ্টা—সব অংশু ব্যর্থ করে দিয়ে শেষে নিখোঁজ।

বনলতার কী মনে হল কে জানে, যেন এখনও সময় আছে হাতে—বের হয়ে পড়া দরকার, সে কিছু জানে না, যদি অপু জানে, তার একমাত্র এখন করণীয় সোজা অপুর কাছে চলে যাওয়া।

করজোড়ে বলবে, বল অপু, বল। অংশু কোনদিকে গেছে। তুই একমাত্র অংশুর খবর দিতে পারিস। তোর ওয়ার্ক এডুকেশনের খাতায় আমি যে চিঠি পেয়েছি। এমনি চিঠি, কিংবা চিঠিতে তোর কোনো সংকেত ছিল কি না, যা একমাত্র অংশু বুঝতে পারে—তোর সেই খাতার সাদা পাতাগুলি কোনোটাই সাদা নয়। হাজার হাজার অক্ষরের কিংবা বর্ণমালার সমষ্টি। যেমন আমার মুখ দেখে মা-বাবা টেরই পায়নি, সুদত্তের অপমৃত্যুর ব্যাখ্যা দিতে পারি একমাত্র আমি।

তোর মুখ কী সাদা পাতার মতো শূন্য—কোনো ভাষাই পড়া যায় না—আমাকে লুকোবি, ঘরপোড়া গোরু আমি—দ্যাখ কী করি, বলেই বনলতা উঠে সোজা সিঁড়ির দিকে নেমে যেতে গেলে, বাড়িসুদ্ধ লোকজন ছুটে গেল। মাথা ঠিক রাখতে পারছে না। তাকে আটকে দেওয়া হল। আর তখন চিকার, ছাড়, ছাড়ু, বলছি! আমাকে যেতে দাও! শেষ খবর সেই দিতে পারে। আমার অংশুর এক আলাদা সত্তা, আমি জানব কী করে। সে তো আমার কথা তার বাবার কথা ভাবল না। বলে সে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল।

আর গভীর রাতে দেখা গেল বনলতা কখন নিজেই নিখোঁজ হয়ে গেছে। কোথায় গেল কেউ জানল না! এমনকী অংশু ফিরে এসেও জানতে পারেনি। মা কেন বোকার মতো তাকে খুঁজতে বের হয়ে গেছে! সে ট্রেনে চড়ে মসলন্দপুর যাবে বলে রওনা হয়েছিল—ওখানে কে আছে জানে না, তবু সেই স্টেশনে একবার তার যাওয়া দরকার বোধ করেছিল। ট্রেন বে-লাইন হয়ে যাওয়ায় সে ফেরার রাস্তা হারিয়ে ফেলে।

আততায়ী

আজও টাকাটা নিয়ে ফেরত আসতে হল। এক টাকার একটা নোট তার মাথার মধ্যে এভাবে আগুন ধরিয়ে দেবে দু-দিন আগেও টের পায়নি। যেন নোটটা যতক্ষণ মানিব্যাগে থাকবে ততক্ষণই তাকে বিচলিত করবে। উত্তপ্ত রাখবে এবং অস্বস্তির মধ্যে দিন কাটাতে হবে। সামান্য একটা এক টাকার নোট এভাবে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দেবে সে ভাবতেই পারেনি। আজকাল এক টাকার দামই বা কী! কিচ্ছু না। কিন্তু এক টাকার নোটটা যেন তার সঙ্গে বাজি লড়ছে। নোটটা এবং সে।

আসলে জীবনে একজন প্রতিপক্ষ সবসময় এসে তার সামনে দাঁড়ায়। প্রতিপক্ষটি প্রথমে খাটো থাকে—ক্রমে সে হাত-পা বিস্তার করতে থাকে এবং একদিন এই প্রতিপক্ষই জীবনে চরম শত্রু হয়ে দাঁড়ায়। দু-দিন ধরে এই নোটটা তার প্রতিপক্ষ, এটাকে বাজারে চালাতেই হবে।

সকালে বাজার করতে গিয়ে হাফ পাউণ্ড পাঁউরুটি কেনার সময় ব্যাগ থেকে খুঁজে নোটটা বের করে দিয়েছিল। আর তক্ষুনি দোকানির কাতর গলা, না স্যার চলবে না। কিছু নেই।

নেই মানে!

মাঝখানটা একেবারে সাদা। ন্যাতা হয়ে গেছে। কে দিল?

কে দেবে! বাসের কনডাক্টর। এক টাকার নোট পাওয়াই যায় না। নেবে না কেন? এক টাকার নোট অচল হয় না। আমি তো ঘরে বসে ছাপিনি! নেবে না কেন?

বাবু, বদলে দিন। দেব না। নিতে হবে। এক টাকার নোট অচল হয় না। আপনি পাঁউরুটি ফেরত দিন। অচল কি না জানি না। আমি নিতে পারব না। মাথা তার গরম হয়ে যাচ্ছিল। সেও দোকানির মতোই বলেছিল, ভাই কনডাক্টর নোটটা পালটে দাও। ছেঁড়া।

কিছু নেই।

কী হাসি!

কী বলছেন দাদা, কিছু নেই। না থাকলেও চলে। ছাপ থাকলেও চলে। বাজারে এক টাকার নোট পাওয়াই যায় না, আপনার লাক ভালো।

লাক ভালো বলছ!

হ্যাঁ, তাই বলছি। নিতে হয় নিন, না হয় চেঞ্জ দিন। কোথাকার লোক আপনি, বাসে ট্রামে চড়েন না।

বাসে ট্রামে চড়ি কি না তোমাক কৈফিয়ত দেব না। চলবে না! পালটে দাও। আমার কাছে চেঞ্জ নেই।

ধুস নিতে হয় নিন, না হয় নেমে যান।

এক কথায় দু-কথায় বচসা শুরু হতেই বাসের লোকজন মজা পেয়ে গেছিল। একজন বলল, কী হল দাদা! এক টাকার নোট আজকাল অচল হয় না জানেন। দু-পয়সা, পাঁচ-পয়সা উঠেই গেল। আপনি দেখছি আজব লোক মশাই।

বাস বাদুড় ঝোলা হয়ে ছুটছে। তার সামনে দুজন যুবতী, ফিক ফিক করে হাসছে। তার মনে হয়েছিল, সে একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। সামান্য এক টাকার একটা নোট নিয়ে। এত কথা বলা উচিত হয়নি। অনেকে সিট থেকে উঁকি দিয়ে তাকে দেখেছে। এমন বিপাকে যেন সে জীবনেও পড়েনি। সত্যি তো এক টাকার নোটের বড়ো ক্রাইসিস। কীই বা দাম! নোটটা নিয়ে আর সে কোনো কথা বলেনি। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। আজকাল মানুষ সামান্য বিষয়ে কত মজা পায়! সে সব বাস-যাত্রীদের মজার খোরাক হয়ে গেল। তাকে নিয়ে দু-একজন বেশ ঠাট্টা রসিকতাও চালিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ সে বুঝতে পারছে, কনডাক্টরের পক্ষ নিয়েছে সবাই!

তার এভাবে মাথা গরম হবার কারণ বাড়ি গেলে আবার এক ধকল যাবে। ছবি বলবে, কে আবার অচল টাকা গছিয়ে দিল তোমাকে! যেমন মানুষ তুমি—ঘরে দুটো পাঁচ টাকার নোট, একটা দশ টাকার নোট, গোটা তিনেক দু-টাকার নোট অচল হয়ে পড়ে আছে। ছবির এককথা—দেখে নেবে না! তুমি কী! যে যা দেয় নিয়ে নাও! লোক ঠিক চিনেছে।

বাড়ি ফিরে নোটটা নিজের কাছেই রেখে দিয়েছে। বরং বলা যায়, নোটটা ছবির চোখ এড়িয়ে লুকিয়ে রেখেছে। দু-দিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যদি চলে যায়। কিন্তু চলে যাচ্ছে না। সে তবে ঠিকই ধরেছিল, চলবে না। নোট অচল।

কিন্তু বাসের সবাই বলেছে, এক টাকার নোট অচল কবে হল আবার! চেনা গেলেই হল—হ্যাঁ এক টাকার নোট। এই তো সরকারের টিপ ছাপ আছে বোঝা যায়। বোঝা গেলেই হল।

এই যে বাবু।

হ্যাঁ, আমাকে ডাকছ? চলে যাচ্ছেন যে।

কী করব! দাঁড়িয়ে থাকব?

নোটটা চলবে না। বদলে দিন।

দুটো মর্তমান কলা কিনে নোটটা দিয়েই হাঁটা দিয়েছিল সে।

আর টাকা নেই। আমি তো বানাইনি।

না থাকে কাল দেবেন। এটা নিয়ে যান।

রেখে দাও। পরে পালটে দেব।

বাবু। কালই দেবেন। নিয়ে যান।

রাখলে দোষের কী? ছোঁয়াচে নাকি!

তা বাবু বলতে পারেন।

সে অগত্যা নোট ফিরিয়ে নিয়েছে। কাছে টাকা থাকতেও দেয়নি। দিলে যেন প্রমাণ হবে ঠগ, জোচ্চোর। অচল টাকা চালিয়ে বেড়াবার স্বভাব।

তারও মাথা গরম হয়ে যায়। যেন পারলে সেই বাস কনডাক্টরের মাথার চুল ধরে ঝাঁকিয়ে বলে, বেটা তুমি সাধু। আর আমি শালা চোরের দায়ে ধরা পড়েছি।

ঘরে বাইরে সব জায়গায়। বাজার থেকে ফিরেই সে গুম হয়ে বসে থাকল কিছুক্ষণ। ছেলেরা স্কুলে যাবে। বাস এসে গেছে। ছবি রান্নাঘরে ওদের টিফিন হাতে নিয়ে ছেলে দু-জনকে বাসে তুলে দিতে যাচ্ছে। সে দেখেও দেখল না। মাথার মধ্যে বুড়বুড়ি উঠছে, লোকটাকে ধরতে হবে। টাকাটা নিয়ে সে এত হেনস্থা হবে অনুমানই করতে পারেনি। একটা এক টাকার নোট যেন পকেটে থেকে মজা লুটছে। তোমার মজা বের করছি, দাঁড়াও।

ছবি ফিরে এসে বলল, কী ব্যাপার? এত সকালে কোথায় বের হবে?

কাজ আছে।

কী কাজ বলবে তো। কিছুই রান্না হয়নি।

যা হয়েছে দাও।

সে বেশি কথা বলতে পারছে না। যেন সবাইকে তার চেনা হয়ে গেছে। বাজার করতে গেলে সে ঠকে, বাসে মিনিবাসে সে ঠকে, অফিসে পদোন্নতি নেই, স্বভাব দোষে সর্বত্র সে অচল। ঘরেও। বাজার করে দিয়ে রেজকি ফেরত দিলেই ছবির এককথা, এটা নিলে! চলবে!

আরে এখন সব চলে। রাখো তো, ভ্যাজর ভ্যাজর করবে না।

তার অফিস বিকেলবেলায়। কাগজের অফিসে কাজ করলে যা হয়! এত সকালে বের হবে শুনে ছবি চমকে গেছে। রান্নাঘরে তার মেজাজ চড়া!—এ কী লোকরে বাবা, আগে থেকে কিছু বলবে না। এখন কী দিই!

বলছি না যা হয়েছে তাই দাও।

শুধু ভাত হয়েছে।

ওতেই হবে। ফ্রিজে কিছু নেই।

না।

ডিম ভেজে দাও। একটু মাখন দাও। ওতেই হবে যাবে।

কোথায় যাচ্ছ বলবেতো!

বলছি না কাজ আছে।

সেটা কী রাজসূয় যজ্ঞ!

তাই বলতে পার।

কথা বাড়ালে খাণ্ডবদাহন শুরু হয়ে যাবে। সে আর কথা বাড়াল। চুপচাপ খেয়ে বের হয়ে গেল।

রাস্তায় এসে দাঁড়াতেই পাশ থেকে একজন চেনা লোক বলল, দাদা এত সকালে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন?

একটু কাজ আছে।

কত নম্বর বাস? দু-শ এগারো?

দরজায় দেখল, না সে লোকটা নেই।

আবার দু-শ এগারো।

এটাতেও নেই।

বেলা বাড়ে সেই লোকটাকে সে কিছুতেই শনাক্ত করতে পারে না।

লোকটা কী উধাও হয়ে গেল।

ঝাঁ ঝাঁ রোদুরে ফিরে এসে সে শুয়ে পড়ল। সেদিন আর অফিসে বের হল না। মাথায় পেরেক ফুটিয়ে লোকটা উধাও হয়েছে। শুয়োরের বাচ্চা তুমি কত বড়ো ঠগ আমি দেখব। চেঞ্জ দিতে পারেন দিন, না হলে নেমে যান।

পরদিন সকালে ফের এককথা।

বের হচ্ছি।

এত সকালে!

কাজ আছে বলছি না।

কী কাজ।

রাজসূয় যজ্ঞ শুরু হয়েছে। বুঝলে!

ছবি বলল, সারাজীবনই তো রাজসূয় যজ্ঞ করলে, এ আবার কী নতুন যজ্ঞি শুরু হল তোমার!

ছবি খোঁটা দিয়ে কথা না বলতে পারলে আরাম পায় না। এতদিনে ছবি বুঝে গেছে, সত্যি অচল মাল নিয়ে তাকে কাজ করতে হচ্ছে। দুনিয়ার লোক মুখিয়ে আছে, লোকটাকে ঠকাবার জন্য। বাজারে, কাজের জায়গায়, বন্ধুবান্ধব সবাই যেন জেনে ফেলেছে, তার কাছে এলে ফিরে যাবে না। সে ধার দিয়ে ঠকেছে, সে বিশ্বাস করে ঠকেছে, জমি কেনার সময় দালালি বাবদ অনেক টাকা গচ্চা দিতে হয়েছে, বাড়ি করার সময় ঠিকাদার মাথায় হাত বুলিয়ে বেশ ভালো রকমের টুপি পরিয়ে দিয়ে গেছে। দরজা সেগুনের দেবার কথা, দিয়েছে গাম্বার কাঠের। একটু বাতাস উঠলেই খড়খড় করে নড়ে ওঠে। কোনো দরজা বৃষ্টি হলে ফুলে ফেঁপে যায়, লাগাতে গেলে হাতি জুতে টানাটানি নাকি করতে হয়। সব অভিযোগই ছবির। রান্নাঘরের দেয়ালের দুটো টাইলস খসে পড়েছে। তা পড়বে না, যেমন মানুষ! কথায় যে চিড়ে ভেজে তাকে দেখে নাকি ছবি সেটা সত্যি টের পেয়েছে।

এবারে আর ভিজতে দেবে না।

কী দাদা দাঁড়িয়ে আছেন! এত সকালে।

দাঁড়িয়ে আছি তো তোর কীরে ব্যাটা! সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকব। আমার খুশি। সে এমন ভাবল।

কি পেলেন?

কাকে?

সেই লোকটাকে।

তুমি জান কী করে?

না যে-ভাবে ক-দিন থেকে রোজ দাঁড়িয়ে থাকছেন!

সে কী পাগল হয়ে যাচ্ছে! তাকে দেখেই কী টের পায়, একজন ঠগ জোচ্চোরকে সে খুঁজতে বের হয়েছে। চোখে মুখে কী তার কোনো আততায়ীর মুখ ভেসে উঠছে।

সে বলল, এমনি দাঁড়িয়ে আছি।

বাস-স্টপে এসে এমনি সারা সকাল কেউ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না! মাথায় কোনো গণ্ডগোল সত্যিই কী দেখা দিয়েছে। আমি দাঁড়িয়ে থাকি, খুশি! তোর কীরে শুয়োরের বাচ্চা! অবশ্য সে প্রকাশ করল না। মাথা তেতে আছে। সবার সঙ্গে সে দুর্ব্যবহার শুরু করে দিয়েছে। লোকটাকে শনাক্ত করতে না পারলে সে কী সত্যি পাগল হয়ে যাবে!

আবার দু-শ এগারো।

না নেই।

তীর্থের কাকের মতো দাঁড়িয়ে আছে।

দুটো দরজায় যারা ঘন্টি বাজায়, দেখে। তাদের কারও মুখ মেলে না।

এবারে ভাবল, না, এভাবে হবে না। সে উঠেই পড়ল। বাস-স্ট্যান্ডে গিয়ে খোঁজ করল। নেই। সে আবার একটা বাসে উঠে পড়ল। কিছু দূরে গিয়ে নেমে পড়ল।

নেই। আসলে সে যেন সবার মুখেই সেই একজনের মুখ দেখতে পায়। কে যে আসল ধুরন্ধর তা টের পায় না। ধরতে পারলেই মুখে ঘুসি মেরে বলত, নে শুয়োরের বাচ্চা, তোর টাকা রাখ। আমার টাকা ফেরত দে।

একদিন এভাবে সারাদিন এই করে সে যখন বুঝল, আসল আততায়ীকে ধরা যাবে না, যায় না, তখন একটা গাছের নীচে বসে পড়ল। পার্স থেকে নোটটা বের করে দেখল! হাজার অপমানের কথা মনে পড়তে থাকল। টাকাটা আবার দেখল। উলটেপালটে দেখতে দেখতে কী ভাবল কে জানে, সে নোটটা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলে হাওয়ায় উড়িয়ে দিল। সঠিক আততায়ীকে খুঁজে বের করা জীবনে কঠিন। বাতাসে নোটের কুচি উড়ে যেতেই সে একেবারে হালকা হয়ে গেল। কী আরাম। বাড়ি ফিরে সে আবার অনেকদিন পর ঘুমোল। সকালে উঠে দেখল, গাছপালা, পাখি, ঘরবাড়ি, মানুষজন সব আবার তার কাছে সুন্দর হয়ে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *