1 of 3

ট্রেন কাহিনি

ট্রেন কাহিনি

পশ্চিমবাংলায় প্রতি মাসে গড়ে অন্তত পাঁচটি ট্রেন ডাকাতি হয়। ব্যাঙ্ক ডাকাতি হয় দুটি। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবাংলা অনেক এগিয়ে আছে। আমাদের এইসব ডাকাতদের নিয়ে আমরা রীতিমতন গর্ব করতে পারি। তারা কাজে ফাঁকি দেয় না, কোনওরকম ভুল চুক করে না, সেই জন্য ধরা পড়ার কোনও প্রশ্নই নেই। দু-একটি ব্যাঙ্ক ডাকাত দৈবাৎ ধরা পড়লেও ট্রেন ডাকাতরা কক্ষনো ধরা পড়ে না। সেই জন্যই নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য ও লাভজনক পেশা হিসেবে ট্রেন-ডাকাতি দিন-দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

দুর্ভাগ্যের বিষয় আমার আজও একটাও ট্রেন-ডাকাতি বা ব্যাঙ্ক ডাকাতির দৃশ্য নিজে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পাইনি। আমার কোনও-কোনও বন্ধুর এই অভিজ্ঞা হয়েছে এবং তারা যখন সবিস্তারে সেই দৃশ্যের বর্ণনা করে, তখন আমি তাদের রীতিমতন হিংসে করি। ওরা এমন একটা অভিজ্ঞতা লাভে সৌভাগ্যবান, অথচ আমার কেন হল না? ব্যাঙ্কে যাওয়ার সুযোগ আমার বেশি। ঘটে না বটে, কিন্তু ট্রেনে তো আমাকে প্রায়ই যাতায়াত করতে হয়। যে-কোনও দিন এরকম একটা ঘটনার মধ্যে আমার পড়ে যাওয়া উচিত ছিল। ট্রেন ডাকাতরা যে আমাকে এ ভাবে এড়িয়ে চলছে, এটা তাদের ঘোরতর অন্যায়। যাই হোক, একদিন-না-একদিন আমার খপপরে তাদের পড়তেই হবে।

ট্রেন বিষয়ে আমার অন্য একটা অভিজ্ঞতার কথা এখানে বলি।

বছর দু-এক আগে আমি কুচবিহার থেকে কলকাতা ফিরছিলুম। কুচবিহার থেকে বাসে এসেছিলুম নিউ জলপাইগুড়ি রেল স্টেশনে। দার্জিলিং মেইল ছাড়বে সন্ধেবেলা। আমার কাছে। সেকেন্ড ক্লাস থ্রি-টায়ার কম্পার্টমেন্টের বার্থ রিজার্ভেশান শ্লিপ এবং টিকিট আছে। অর্থাৎ রাত্তিরে নিশ্চিন্তে এক ঘুম দিয়ে সকালবেলা কলকাতায় পৌঁছে যাব। চমৎকার ব্যবস্থা। ট্রেনের খাবার। আমার পছন্দ হয় না বলে আমি স্টেশানের বাইরের এক রেস্তোরাঁয় আমার মনোমতন ডিনার। সেরে নিলুম। হাতে খানিকটা সময় আছে বলে বইয়ের দোকান থেকে কিনলুম দুটি পেপার ব্যাক  থ্রিলার। এর পরেও আমার কাছে যে টাকা বাকি রইল তা দিয়ে হাওড়া স্টেশন থেকে আমার বাড়ি পর্যন্ত ট্যাক্সি ভাড়া কুলিয়ে যাবে, সিগারেটের খরচও কুলিয়ে যাবে। আর আমার চিন্তা কী?

যথা সময়ে প্ল্যাটফর্মে গিয়ে একটা উত্তেজনা দেখতে পেলুম। লোকজন সব উদ্বিগ্ন মুখে ছোটছুটি করছে, যাকেই জিগ্যেস করি কী হয়েছে, সে-ই বলে ট্রেন নেই! তারপর মাইক্রোফোনে ঘোষণা শুনতে পেলুম যে দার্জিলিং মেল ক্যানসেলড হয়ে গেছে! যাত্রীদের ভাড়ার টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে, সবাই যেন সুশৃঙ্খলভাবে লাইনে গিয়ে দাঁড়ায় ইত্যাদি।

আমি প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেলুম! এই স্টেশান থেকেই দার্জিলিং মেল ছাড়ে, ট্রেনটি জলজ্যান্ত প্ল্যাটফর্মেই দাঁড়িয়ে আছে, আমি নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছি, তাহলে যাবে না কেন? শীতকালে কোথাও বন্যা হয়নি দাঙ্গা-হাঙ্গামারও কোনও খবর নেই, তবু ট্রেন বাতিল করবার কারণ কী? রেলের কর্মচারীরা সব প্ল্যাটফর্ম থেকে উধাও, স্টেশন মাস্টারের ঘরের সামনে দারুণ ভিড়। আরও আধঘণ্টা অপেক্ষা করবার পর বুঝতে পারলুম, সত্যিই ট্রেনটি যাবে না। অন্যদের দেখাদেখি আমিও টিকিটের টাকা ফেরত নেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়ালুম। কাউন্টারের ব্যক্তিটি যে কোনও প্রশ্নের উত্তরেই বিরক্ত-ভাবে বলছেন, আমি জানি না, আমি কিছু জানি না!

তার একটু পরে আমি বুঝতে পারলুম আমার বিপদের গুরুত্বটা। এরপর আর কোনও ট্রেন নেই। দার্জিলিং মেল বন্ধ থাকলে সন্ধ্যের পর উত্তর বাংলা থেকে কলকাতায় আসার কোনও উপায় নেই। সন্ধের পর কোনও ট্রেন নেই। রকেট বাস নামে একটি সরকারি বাস চলে, তার টিকিট তিন চারদিন আগেই শেষ হয়ে যায়। কয়েকটি বে-সরকারি বাসও চলে শুনেছিলুম, সেগুলোরও কোনও চিহ্ন দেখতে পেলুম না। রেল কর্তৃপক্ষ কোনওরকম কৈফিয়ৎ না দিয়ে দার্জিলিং মেল বন্ধ করে দিলেন, একবার চিন্তাও করলেন না হাজার-হাজার যাত্রীর কী অবস্থা হবে! উত্তর বাংলার দূর-দূরান্ত থেকে যাত্রীরা নিউ জলপাইগুলি স্টেশনে আসে দার্জিলিং মেল ধরবার জন্য। তারা। এখন কী করবে? সকলের পক্ষে বাড়ি ফিরে যাওয়াও সম্ভব নয়। বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে অনেক মহিলাদের অসহায়ভাবে ঘোরাঘুরি করতে দেখলুম।

অনেকেই এসে ভিড় করলেন জলপাইগুলিতে সরকারি বাস ডিপোর সামনে। জনতা দাবি তুলেছে আরও অন্তত দুটি স্পেশাল বাসের ব্যবস্থা করা হোক। বাস ডিপোর কর্মীরা বলছেন, আর বাস নেই। শুরু হয়ে গেল উত্তপ্ত তর্ক-যুদ্ধ। আমি হিসেব করে দেখলুম, সেখানে যত লোক দাঁড়িয়ে আছে, পাঁচখানা বাস দিলেও সব মানুষ কুলোবে না। একটা দুটো অতিরিক্ত বাস দিয়েই বা কী লাভ? মারামারি লেগে যাবে।

ক্রমেই রাত বাড়ছে। আমি চঞ্চল ও অধীর হয়ে পড়ছি, অথচ কী করব বুঝতে পারছিনা। এরপর অতিরিক্ত বাস দিলেও তাতে মারামারি করে ওঠা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এদিকে শুনতে পাচ্ছি, জলপাইগুড়ির সব হোটেল ভরতি হয়ে যাচ্ছে। এরপর আর রাত্রে থাকবারও জায়গা পাব না। রাত্রে আমি থাকতে চাইও না, কারণ পরের দিন দুপুরে কলকাতায় আমার খুবই জরুরি একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। অথচ আমার যাওয়ার কোনও উপায়ই নেই?

উপায় একটা জুটে গেল। কয়েকজন মাড়োয়ারি যুবক একটা ট্যাক্সি ঠিক করল, সেই ট্যাক্সিতেই সোজা কলকাতায় যাবে। ওরা ছিল পাঁচজন, আমিও ওদের দলে জুটে গিয়ে কাতরভাবে অনুরোধ জানালুম, আমাকেও নিয়ে চল ভাই!

ট্যাক্সি ভাড়া ঠিক হল নশো টাকা। অর্থাৎ প্রত্যেকের দেড়শো টাকা শেয়ার। মাড়োয়ারি যুবকেরা চা-বাগানের মালিক, তারা তক্ষুণি টাকা বার করে দিল, কিন্তু আমার কাছে অত টাকা নেই। আমি ড্রাইভারকে বললুম, কলকাতায় আমার বাড়িতে পৌঁছে টাকাটা দিয়ে দেব আপনাকে, কেমন? ড্রাইভার ত্যারছাভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তারপর কলকাতায় পৌঁছে যদি আপনি টাকা দিতে না চান? যদি বলেন আমি বেশ ভাড়া চার্জ করেছি? তখন আমি কী করব?

আমি বললুম, ভাই, দেখুন আমার এই গোল চাঁদপানা মুখখানা। এই মুখ দেখলে কি আমায় ঠক বা জোচ্চোর বলে মনে হয়?

ড্রাইভারটি রাজি হয়ে গেল। কিন্তু যেহেতু আমি পুরো টাকা দিইনি, তাই ইচ্ছে মতন বসার জায়গা বেছে নেওয়ার অধিকারও আমার নেই। আমাকে বসতে হল সামনের সীটে ড্রাইভার ও অন্য একজন যাত্রীর মাঝখানে অস্বস্তিকর অবস্থায়।

ট্যাক্সিটা ছাড়ল রাত এগারোটায়। এবং একটু পরেই অন্য যাত্রীরা ঘুমিয়ে পড়ল। ড্রাইভার আমায় বলল, আমিও যদি হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ি, তবে কিন্তু গাড়ির অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে। সে দায়িত্ব আমার নয়। সুতরাং আপনি জেগে থাকুন, আর আমার সঙ্গে গল্প করুন।

আমার যে গল্পের স্টক এত কম তা আমি বুঝেছিলুম সেই রাতে। আধ ঘণ্টার পর আর আমি কথা খুঁজে পাই না। তাছাড়া ট্যাক্সি ড্রাইভারদের খুশি করার মতন গল্প কোথায় পাওয়া যায়, তাও আমি জানি না। আমি এক-একটা গল্প বানাতে আরম্ভ করলে সে বলে, না, ওটা ভালো নয়! অন্য একটা বলুন!

সারারাত জেগে আমি একটার পর একটা সিগারেট টেনে এবং অনর্গল অর্থহীন কথা বলে কাটালুম। আমার বাড়ি পৌঁছোলুম বেলা বারোটায়। মনে-মনে একটা আশঙ্কা ছিল, সেটাই সত্যি ফলে গেল। আমার বাড়িতে কেউ নেই, দরজায় তালা বন্ধ। এখন টাকা কোথায় পাব? ট্যাক্সি ড্রাইভার এমনভাবে আমার দিকে তাকাল যেন সে বলতে চায়, খুব তো গোল মুখের গর্ব করছিলে! আসলে তুমি একটি জোচ্চোরই! যাই হোক, পাড়ার চায়ের দোকান থেকে ধার করে

ড্রাইভারকে মিটিয়ে দিলুম তার প্রাপ্য।

সেদিন আমি চারখানা খবরের কাগজে তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখেছিলুম। দার্জিলিং মেইল ক্যান্সেল হওয়ার কোনও খবর কোথাও নেই। রেল কর্তৃপক্ষ নিঃশব্দে ট্রেন বাতিল করে প্রতিদিন সারা ভারতবর্ষে কত লোককে যে নিয়ে এইরকম মজা করছেন, তার হিসেব কেউ রাখে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *