ট্রাঙ্কবন্দি তিনটি লাশ

ট্রাঙ্কবন্দি তিনটি লাশ

‘মাই ডটার ইজ মিসিং। প্লিজ কুছ কিজিয়ে।’

একবালপুর থানার ডিউটি অফিসারের ঘরে বসে এক নিঃশ্বাসে কথা বলছিলেন উমেশনাথ সিং। অফিসারটি প্রথমে হাতের ইশারায় এক পুলিশকর্মীকে বললেন, ‘জল দিন ওঁকে। সকালেই গাজিয়াবাদ থেকে কলকাতায় নেমেছেন প্রৌঢ়। আগের দু’দিন মেয়ে—নাতনিদের চিন্তায় ভালো করে নাওয়াখাওয়া পর্যন্ত হয়নি। আজ কলকাতায় নেমেই সরাসরি চলে এসেছেন একবালপুর থানায়।

—স্যর, দু’দিন ধরে আমার মেয়ের খোঁজ পাচ্ছি না। আমার দুই নাতনিরও খোঁজ নেই। এতবার ফোন করছি, কিন্তু ফোন বন্ধ। এরকম কখনও হয় না।

—আপনার মেয়ে থাকেন কোথায়? ওখানে খোঁজ নিয়েছেন?

—হ্যাঁ নিয়েছি, ফ্ল্যাট তালা বন্ধ। আশপাশের লোকজনও কিছু বলতে পারছেন না।

—কোনও আত্মীয়, বন্ধু, কারও বাড়িতে যাননি তো? দুই নাতনি আছে বললেন। তিনজন একসঙ্গে কোথায় আর যাবেন? বেড়াতে টেড়াতে…

—না। যেখানে যেখানে যেতে পারে, সব জায়গাতেই খোঁজ নিয়েছি। আর আমার মেয়ে কোথাও গেলে নিশ্চয়ই আমাকে জানাত। এভাবে মোবাইল বন্ধ করে কোথায় যাবে?

—ছবি এনেছেন সঙ্গে? আপনার মেয়ে—নাতনিদের? ডিটেলসগুলো লিখে দিন।

প্রৌঢ়ের বয়ানের ভিত্তিতে হল মিসিং ডায়েরি। ৩১মার্চ,২০১৪। দ্রুত বার্তা পৌঁছাল থানায় থানায়, ‘রেশমা সিং উইথ টু ডটারস আর মিসিং।’একবালপুর থানার সঙ্গে তদন্ত শুরু করল লালবাজারের মিসিং পারসনস স্কোয়াডও। সব থানায় পৌঁছে গেল মা ও দুই মেয়ের ছবি।

১৪ এপ্রিল, ২০১৪। ডায়মন্ডহারবার রোডের ছোট্ট দোকানটার সামনে সকাল থেকে লোকে লোকারণ্য। কদিন ধরে বন্ধই ছিল দোকানটা। দোকানের মালিক নাকি ভিতরে মেঝেতে টাইলস বসিয়েছেন নতুন করে। টাইলসের ফ্লোরের নীচে নতুন ট্যাঙ্কও বানিয়েছেন। দোকানের শাটার নামিয়ে ক’দিন আগেও কাজ হচ্ছিল, দেখেছেন এ পাড়ার অনেকে। হঠাৎ এই দোকানে এত পুলিশ কেন? কৌতুহলী ভিড় বাড়তে থাকে কলেবরে। সাত সকালেই চারপাশ কর্ডন করে দিয়েছে পুলিশ। দোকানটাকে মাঝখানে রেখে আশপাশের বেশ কিছুটা রাস্তা গার্ডরেল বসিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে। একবালপুর থানার অফিসাররা তো আছেনই। সঙ্গে হোমিসাইড শাখার গোয়েন্দারাও। কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে গেলেন বন্দর বিভাগের ডেপুটি কমিশনার, সঙ্গে বন্দর বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত লালবাজারের এক যুগ্ম কমিশনার। পুলিশের বডি ল্যাঙ্গোয়েজ দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না, গুরুতর কিছু হয়েছে একটা। সকাল থেকে দোকানের শাটার খুলে শুরু হয়েছে খোঁড়াখুঁড়ি। ছোট দোকানটার ভিতরে হাতে গ্লাভস, মুখে কাপড়ের মাস্ক লাগিয়ে শাবল, বেলচা নিয়ে ঢুকে পড়েছে কয়েকজন। ঘণ্টাখানেক বাদেই একটা পচা গন্ধে নাকে রুমাল চাপা দিতে হল সবাইকে। এ গন্ধটা পুলিশের চেনা। এটা পচা লাশের গন্ধ। যাঁরা খোঁড়াখুঁড়ি করছিলেন, তাঁদের একজনই হাঁক দিলেন, ‘স্যর, দেখুন।’

এতক্ষণ ঠাই দাঁড়িয়ে থাকা ডেপুটি কমিশনার, সঙ্গে হোমিসাইড বিভাগের অফিসাররা এগিয়ে এলেন। দোকানের মেঝে চার ফুট খুঁড়তেই মিলল পরপর দু’টো ট্রাঙ্ক। তার মধ্যে প্ল্যাস্টিক প্যাকেটে মোড়া তিন—তিনটি ডেডবডি। বডি আর কই, পচে গলে প্রায় গোটাটাই কঙ্কালসার, কী—ই বা অবশিষ্ট আর?

তবে বুঝতে অসুবিধা হয় না, তিনটি দেহই মহিলার। পরনের পোশাকটা দেখে যতটুকু বোঝা যায় বাইরে থেকে, তা দেখে মাথায় হাত দিয়ে হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন উমেশনাথ। এ তো তাঁরই মেয়ে আর নাতনিদের দেহ। কাঁধে হাত দিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেন এক সিনিয়র পুলিশ অফিসার, ‘উমেশনাথবাবু, ভেঙে পড়লে হবে না। সবার শাস্তি হবে। চিন্তা করবেন না। আপনাকে শক্ত হতে হবে। কাঁপা কাঁপা হাত দুটো জড়ো করে কোনওরকমে অফিসারটিকে পরশনাথ বললেন, ‘আমার মেয়ে কী ক্ষতি করেছিল? আর ওই দু’টো বাচ্চা? কার কী অনিষ্ট করতে পারে ওরা? এত নির্মমভাবে কেউ কাউকে মেরে ফেলতে পারে? যারা এ কাজ করেছে, তাদের প্রত্যেকের ফাঁসি চাই। চরম শাস্তি চাই ওদের। না—হলে আমার শান্তি নেই।’

একবালপুর ট্রিপল মার্ডার কেস। উমেশনাথবাবুর দায়ের করা অভিযোগের ভিত্তিতে রুজু হল ঠান্ডা মাথায় মা আর দুই মেয়েকে নারকীয় কায়দায় খুন করে দেহ লোপাটের মামলা।

উমেশনাথ সিংয়ের মেয়ে রেশমা সিং, দুই নাতনি নিবেদিতা আর সম্প্রীতি। দু’জনেই কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের ছাত্রী। মেধাবী। রেশমার স্বামী সুমিত সিং কাজ করতেন একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায়। ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন বছর কয়েক আগে। জামাইয়ের মৃত্যুর পর উমেশনাথ মেয়ে আর দুই নাতনিকে গাজিয়াবাদে নিজের কাছে এনে রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাবার কথায় রাজি হননি রেশমা। তিনি চেয়েছিলেন, দুই মেয়েকে কলকাতায় নিজের কাছে রেখেই বড় করতে। এতদিন দু’জনে এখানে পড়াশোনা করেছে। এখন হঠাৎ ওদের সরিয়ে নিয়ে গেলে পড়াশোনারও তো ক্ষতি হবে, বাবাকে বোঝালেন রেশমা। শেষ পর্যন্ত তিনি মেয়েদের নিয়ে কলকাতায় থেকে গেলেন। রোজ নিয়ম করে গাজিয়াবাদ থেকে উমেশনাথ ফোন করতেন মেয়ে—নাতনিদের। স্বামীর মৃত্যুর পর যে টাকা পেয়েছিলেন রেশমা, সেই টাকায় একবালপুরের ডাঃ সুধীর বসু রোডের ইয়াসিন মঞ্জিলের ফ্ল্যাটে এসে উঠলেন মেয়েদের নিয়ে। সেটা ২০১১—এর কথা। ওই বাড়িতেই ফ্ল্যাট বছর পঁয়ত্রিশের মহম্মদ সিরাজের। রেশমা আর তাঁর দুই মেয়েকে দেখে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন তিনিই। ‘দিদি, ফ্ল্যাটটা নিয়ে নিন। অনেক সস্তায় পেয়ে যাবেন। জায়গাটাও ভালো’, রেশমাকে বলেছিলেন সিরাজ। সিরাজের ব্যবহার ভালো। তাছাড়া রেশমার উপরতলাতেই থাকেন তিনি। বিপদে আপদে একটা চেনা লোককে তো পাশে পাওয়া যাবে। দামটাও তুলনায় কম। সিরাজকে ১১ লক্ষ টাকা সেলামি দিয়ে ফ্ল্যাটটা নিয়ে নিলেন রেশমা। কাছে ডায়মন্ডহারবার রোডে সিরাজের দোকান। স্কুলে যাওয়া আসার পথে নিবেদিতা—সম্প্রীতির সঙ্গে রোজ দেখা হত সিরাজ ‘আঙ্কল’—এর। তিনি ছাড়াও এই পরিবারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন আরও একজন। শম্ভু। রেশমার বন্ধু। এ বাড়িতে যাতায়াত ছিল নিয়মিত। রেশমার মেয়েরাও চিনত তাঁকে। বন্ধুত্ব এতটাই গাঢ় ছিল দু’জনের যে স্বামীকে হারানোর পর রেশমার ফিক্সড ডিপোজিটের নথিতে সাক্ষী হিসাবেও সই করেছিলেন শম্ভু। আশপাশের অনেকে রেশমার পরিবারের সঙ্গে শম্ভুর ঘনিষ্ঠতার কথা জানত। জানতেন উমেশনাথও।

দোকানে গর্ত খুঁড়ে চলছে মৃতদেহ উদ্ধারের কাজ
দোকানে গর্ত খুঁড়ে চলছে মৃতদেহ উদ্ধারের কাজ

বাবা—মেয়ের রোজকার কথোপকথনে হঠাৎ ছেদ পড়ল ২৯ মার্চ, ২০১৪। সকাল থেকে বহুবার কথা বলার চেষ্টা করলেন উমেশনাথ। প্রতিবারই মোবাইল নট—রিচেবল। পরদিনও তাই। মেয়ের কোনও বিপদ হল না তো? উদ্বিগ্ন বাবা কথা বললেন হাওড়ার বাসিন্দা পারিবারিক আত্মীয় সন্তোষ সিংয়ের সঙ্গে, ‘রেশমার ফোন তো ক্রমাগত নট রিচেবল হয়ে রয়েছে। কী হল, বুঝতেই পারছি না। আপনি কি একটু ওদের ফ্ল্যাটে দেখে আসবেন!’ সন্তোষ এলেন ওই দিন দুপুরেই, কিন্তু একবালপুরের ফ্ল্যাটের দরজা তো তালাবন্ধ। সব জানালেন উমেশনাথকে।

—উমেশনাথজী ফ্ল্যাট তো বন্ধ। ওরা আপনাকে বলেনি কোথায় যাচ্ছে?

—না, কোথাও গেলে তো আমাকে নিশ্চয়ই বলত। সবচেয়ে বড় কথা মোবাইল তো কখনও নট—রিচেবল থাকে না রেশমার। বাড়িতেও নেই।

—আমার কিন্তু সুবিধার মনে হচ্ছে না সবটা। আপনি চলে আসুন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

—আমি কি পুলিশকে একবার ফোন করব?

—হ্যাঁ, জানিয়ে রাখুন। তবে আমার মনে হয়, আপনি একবার কলকাতায় চলেই আসুন। কিছু একটা তো হয়েইছে।

উদ্বিগ্ন উমেশনাথ প্রথমে গাজিয়াবাদ থেকে ফোন করলেন একবালপুর থানায়। পরদিন নিজেই চলে এলেন কলকাতায়। উমেশনাথের সঙ্গে গিয়ে মেয়ের ফ্ল্যাটের দরজা ভাঙল পুলিশ। তেমন কিছু মিলল না ঘরে। ফেরার সময় দেখা হল সিরাজের সঙ্গে। উদ্বিগ্ন উমেশনাথকে দেখে সিরাজ বললেন, ‘আপনার মেয়ে কোথাও গিয়েছেন হয়তো। শম্ভু এসেছিল তো কদিন আগে। ওর কাছে খোঁজ নিয়েছেন? ও হয়তো বলতে পারবে। ইয়াসিন মঞ্জিল থেকে বেরনোর কিছুক্ষণ বাদে হঠাৎ একটা ফোন এল উমেশনাথের মোবাইলে। রেশমারই মোবাইল নম্বর থেকে! ধড়ে প্রাণ ফেরে প্রৌঢ়ের। কিন্তু রেশমা নন। ফোনের ওপারে একটি পুরুষ কণ্ঠ বলে, ‘আঙ্কল আমি শম্ভু। আপনার মেয়ে নাতনি সবাই এখন বেঙ্গালুরুতে। আমার সঙ্গেই আছে।’

উদ্বিগ্ন উমেশনাথ বলেন, “আমি একবার আমার মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে চাই। ও কোথায়? আমরা সবাই খুব দুশ্চিন্তায় আছি।’

ও—প্রান্ত থেকে সংক্ষিপ্ত জবাব আসে, ‘আমরা সুস্থ আছি।’ চিন্তা করবেন না। সন্ধ্যায় রেশমার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেব।’

‘আমি একবার কথা বলতে চাই…’ বলতে থাকেন মেয়ের খোঁজে আকুল প্রৌঢ়। ফোন কেটে যায়। আবার ‘নট রিচেবল। ঘণ্টা কয়েক বাদে একটা মেসেজ আসে ওই মোবাইল নম্বর থেকে, ‘সরি। ভেরি সরি। হম আপকে ফোন নহি উঠা রহা হ্যায়। হম সাত বাজে ফোন করেঙ্গে। প্রথমে ফোন, তারপর মেসেজ, তবু উৎকণ্ঠা যায় না বাবার মন থেকে। পুলিশ বলে তাঁকে, ধৈর্য্য ধরুন। মেয়ে ফোন করলে জিজ্ঞেস করুন, উনি কোথায়।’

সন্ধ্যায় আবার ফোন এল উমেশনাথের কাছে। মেয়ের মোবাইল থেকেই, ‘আমি শম্ভু বলছি। আমরা টালিগঞ্জে রয়েছি। একটু বাদে রেশমাকে ফোনে ধরিয়ে দিচ্ছি। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আবার ফোন কেটে যায়। কিন্তু বেঙ্গালুরু থেকে এত তাড়াতাড়ি টালিগঞ্জ কীভাবে চলে এল মেয়ে, খটকা লাগে বাবার। সবটা পুলিশকে জানালেন প্রৌঢ়।

—আমার মেয়ের নিশ্চিতভাবে কোনও বিপদ হয়েছে। প্লিজ আপনারা দেখুন। আমি হাতজোড় করছি।

—আরে চিন্তা করছেন কেন? ওই শম্ভুকে তো আপনি চেনেন। ও আপনাদের পরিচিত। শম্ভু তো আপনাকে বলেছে, আপনার মেয়ে—নাতনিরা ওর সঙ্গেই আছে। মিছিমিছি চিন্তা করছেন কেন এত?

—আপ সমঝ নহি রহে হ্যায়, কুছ তো প্রব্লেম হ্যায়। মেরি বেটি কো উওহ বাত কিউ নহি করনে দেগি?

—এত উতলা হবেন না। আগে দেখুন আবার ফোন করে কি না শম্ভু।

কলকাতা পুলিশে কাজ করে যাওয়া এক অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস অফিসারের সঙ্গে উমেশনাথের কিঞ্চিৎ পরিচয় ছিল আগে থেকে। উত্তরপ্রদেশে তাঁদের বাড়ির কাছাকাছিই বাড়ি ওই অফিসারটির। বেশ কয়েক দিন গড়িয়ে গিয়েছে। মেয়ের খোঁজ নেই। পুলিশও তেমন গা করছে না। মরিয়া হয়ে ওই অবসরপ্রাপ্ত অফিসারের সঙ্গে উমেশনাথ যোগাযোগ করলেন, যাতে তিনি অন্তত পুলিশকে একটু বলে দেন। পুলিশ যাতে একটু গুরুত্ব দিয়ে খোঁজ করে তাঁর মেয়ের। লালবাজারে ফোন যাওয়ায় কাজ হল কিছুটা অবশ্যই। খানিকটা নড়েচড়ে বসল একবালপুর থানা। বিভাগীয় ডেপুটি কমিশনার কথা বললেন এসএসপিডির অফিসারদের সঙ্গেও। বন্দর এলাকার ডাকাতি, অপহরণ,স্মাগলিংয়ের মতো অর্গানাইজড ক্রাইমের তদন্তের জন্য পুলিশের বিশেষ বিভাগ এই এসএসপিডি বা স্পেশাল স্টাফ পোর্ট ডিভিশন। ঘটনার গুরুত্ব বুঝে বন্দর বিভাগের ডেপুটি কমিশনার কাজে লাগালেন এই বিভাগকেও। রেশমা সিং আর তাঁর মেয়েদের খোঁজে সাহায্য নেওয়া হচ্ছিল লালবাজারের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টেরও।

এরমধ্যে গড়িয়ে গিয়েছে এক সপ্তাহের বেশি সময়। মা—দুই মেয়ে একসঙ্গে নিখোঁজ। তার উপর থানা বিষয়টাকে গোড়ায় গুরুত্ব দেয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। লালবাজারে পুলিশ কমিশনার গোয়েন্দা প্রধান, বন্দর বিভাগের ডেপুটি কমিশনার ও দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম কমিশনারকে ডেকে নিলেন নিজের ঘরে।

—যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন কী হয়েছে। সবাই তো একসঙ্গে উধাও হয়ে যেতে পারেন না। তাও আবার না—জানিয়ে। কোনও র‌্যানসম কল আসেনি তো?

—এখনও পর্যন্ত কোনও র‌্যানসম কল নেই। সেটা এলে উমেশনাথবাবুর কাছেই আসার কথা। তবে আসেনি। সেটাই খুব ইন্টারেস্টিং। তিনজনকে অপহরণ করে এতদিন আটকে রাখলেও কোনও সাড়াশব্দ নেই কেন?

—কিডন্যাপিং যদি হয়েও থাকে তাহলে মোটিভ কী? আশপাশের সবার সঙ্গে আবার কথা বলুন।

—স্যর, এটা এখনও পরিষ্কার নয়। আমরা সবরকম চেষ্টা করছি।

—যা করার দ্রুত করুন। একটা বিষয় মাথায় রাখবেন, কেসটা ডেলিকেট। মা—দুই মেয়ে একসঙ্গে মিসিং। তার উপর থানার বিরুদ্ধে একটা নেগলিজেন্সের অভিযোগ উঠেছে। আর কোনও সমস্যা যাতে না—হয়, সেভাবে হ্যান্ডেল করবেন গোটা বিষয়টা।

যে কোনও অপরাধের তদন্তে পিও, অর্থাৎ প্লেস অব অকারেন্স বা অকুস্থল হল প্রথম সিঁড়ি, যার পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণেই অনেক সময় বেরিয়ে আসে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র। কিন্তু এখানে এখনও কোনও অপরাধ হয়েছে, এটাই তো বলা যাচ্ছে না। গোয়েন্দারা আবার গেলেন ইয়াসিন মঞ্জিলে, রেশমা সিংদের ফ্ল্যাটে।

সবকিছুই দেখলেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। বিছানার চাদর—বালিশ—তোশক, বাথরুমের বেসিন কমোড, ঘরের প্রতিটি সেন্টিমিটার—মিলিমিটারের তল্লাশি করেও তেমন কোনও সূত্র মিলল না। শুধু নজরে পড়ার মতো ঘরের টেলিভিশন সেটের উপর পাওয়া গেল একটা গোলাপি রংয়ের খাম। একটা বিয়ের আমন্ত্রণপত্র। খামের উপর লেখা, ‘রেশমা সিং।’

—কার বিয়ের কার্ড?

—স্যর, এতে তো দেখছি কোনও মহম্মদ আশফাকের নাম।

—ঠিকানা রয়েছে নিশ্চয়ই। দেখো তো..

—হ্যাঁ, সুধীর বসু রোডেরই তো ঠিকানা। জায়গাটা কাছেই।

—রেশমা সিংরা তো তেমন একটা মেলামেশা করতেন না বলে শুনেছি। তাহলে ওঁদের নামে বিয়ের কার্ড কে পাঠালো বলো তো। চলো, একবার যাওয়া যাক আশফাকের ঠিকানায়। ওখানে যদি কোনও ক্লু পাওয়া যায়। আশফাকের সঙ্গে কথা বললেন তদন্তকারীরা। রেশমাদেবীর পড়শি সিরাজের ভাগ্নে এই আশফাক। তবে রেশমার সঙ্গে তো তেমন একটা আলাপ নেই তাঁদের পরিবারের। তাহলে তাঁর বিয়েতে রেশমাকে নিমন্ত্রণ করলেন কে? খটকা লাগে তদন্তকারীদের। আশফাকরা পুলিশকে জানালেন, পারিবারিক রীতি অনুযায়ী নিমন্ত্রিত ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের তিন—চারটি করে কার্ড দিয়েছিলেন তাঁরা, যাতে ওই আত্মীয়রা আবার তাঁদের পরিচিতদের নিমন্ত্রণ করতে পারেন। তেমনই কেউ বিয়ের কার্ড দিয়ে থাকতে পারেন রেশমাকে। তাহলে কি সিরাজই ভাগ্নের বিয়েতে নেমন্তন্ন করেছিলেন রেশমাদেবীদের? ডেকে পাঠানো হল সিরাজকে। রেশমা তাঁর কাছ থেকে ফ্ল্যাট নিয়েছিলেন, আবার তিনি ভদ্রমহিলার প্রতিবেশীও। তবে কি সিরাজের সঙ্গে শুধু পড়শিসুলভ পরিচিতি নয়, আত্মীয়ের বিয়েতে নিমন্ত্রণ করার মতো সম্পর্ক ছিল রেশমা সিংয়ের পরিবারের? বলা মাত্রই থানায় হাজির হলেন সিরাজ।

—স্যর আমিই দিয়েছিলাম ভাগ্নের বিয়ের নিমন্ত্রণের কার্ড।

—কেন? রেশমাদেবী কি আশফাককে চিনতেন?

—না, স্যর। আমার সঙ্গে তো রেশমাদেবীর পরিবারের ভালো সম্পর্ক। ওঁদের সঙ্গে রোজ দেখা হত। দিদির ভালোমন্দ খোঁজখবর নিতাম নিয়মিত। তাই…

তাহলে তো ও বাড়িতে নিশ্চয়ই তোমার যাতায়াত ছিল নিয়মিত। একটু যেন হকচকিয়ে যান সিরাজ।

—না, মানে রোজ দেখা হত তো দিদির সঙ্গে, ওঁর মেয়েদের সঙ্গে, ওইটুকুই।

—তাহলে উনি কোথায় গিয়েছেন, নিশ্চয়ই কিছু না কিছু তো জানো?

—আমি কিছু জানি না। তবে শম্ভু হয়তো বলতে পারবে। ও তো মাঝেমধ্যে আসত এই বাড়িতে। ওর সঙ্গেই কোথাও…

—তুমি নিশ্চিত যে শম্ভুর সঙ্গেই রেশমাদেবী কোথাও গিয়েছেন?

—আমার মনে হয় স্যর। শম্ভুর কথা তো উনি বলতেন। শঙ্কুকে আমরাও দেখেছি অনেকদিন। বারবার শম্ভুর কথা কেন? খটকা লাগলেও জোরালো কিছু বেরোল না সিরাজের কথায়। ছেড়ে দেওয়া হল প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে। তবে থানা থেকে সিরাজ বেরিয়ে যাওয়ার পর তদন্তকারী অফিসারটিকে বললেন এসএসপিডির পোড়খাওয়া ইন্সপেক্টর, এর উপর নজর রাখো একটু। সিরাজ কিছু তো জানে। আড়াল করছে কি কিছু?’

ইতিমধ্যে খোঁজ মিলল শম্ভুর। কিন্তু তিনি তো নয়ডায়! কলকাতা পুলিশের ফোন পেয়ে আকাশ থেকে পড়লেন শম্ভু, ‘স্যর, আমি তো বলছি, রেশমা আমার খুব ভালো বন্ধু। কিন্তু আমি জানি না ও কোথায়! আমার সঙ্গে অনেক দিন যোগাযোগও নেই।’ তদন্তকারী অফিসারের বিশ্বাস হয় না। শম্ভু ঠিক কথা বলছেন কি না, জানতে তাঁর বাড়ি ও কর্মস্থলেও খোঁজ নিল পুলিশ। তবে তাঁকে সন্দেহ করার মতো কিছু মিলল না। ২০১২—তেই শেষবার কলকাতায় এসেছেন শম্ভু, তেমন সাক্ষীও মিলল। তিনি মিথ্যে কথা বলছেন না। তাহলে?

রেশমা সিং বা তাঁর মেয়েদের খোঁজ পাওয়ার মতো বড় কোনও সূত্র হাতে আসছিল না পুলিশের। আপ্রাণ চেষ্টা করেও যখন সূত্র অধরা থেকে যায়, তখন হতাশ হয়ে না—পড়াটাই দক্ষ পুলিশ অফিসারের আবশ্যিক গুণের মধ্যে পড়ে। হাল ছাড়েনি পুলিশ। তদন্তকারী অফিসারদের মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে একটা প্রশ্ন, শম্ভু আসেনি কলকাতায়। তাহলে সিরাজ কেন বারবার শম্ভুর কথা বলছে? আবার ডাকা হল সিরাজকে।

আবার সেই একই বুলি, ‘স্যর, উওহ জরুরঝুটবোল রহা হ্যায়। আপউনকো অ্যারেস্ট কিজিয়ে।’ কথা বলতে বলতে হঠাৎ একটা জিনিস নজরে পড়ে দুঁদে গোয়েন্দাদের। সিরাজের হাতে কীসের একটা কাটা দাগ, সামান্য আঁচড়ের যেন। ‘ও কিছু না স্যর, ক’দিন আগে রাস্তায় হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। একটু ছড়ে গিয়েছিল,’ জবাব দেন সিরাজ। ছড়ে যেতেই পারে, অসম্ভব কিছু নয়। তবু পোড়খাওয়া গোয়েন্দার মস্তিষ্ক বলে, কাউকেই সন্দেহের বাইরে রেখো না। নজরদারি চলতে থাকে সিরাজের উপর, তাঁর তিনটি মোবাইলের উপরও। দু’টো নম্বর সিরাজের নিজের, অন্যটা তাঁর এক আত্মীয়ের নামে নেওয়া, তবে ব্যবহার করেন সিরাজই। কল ডিটেলস রেকর্ড আনানো হল। সবকটা নম্বরের। খুঁটিয়ে দেখা হল সেই তালিকা। দেখা গেল, তৃতীয় নম্বরটি থেকে ২৯ মার্চ রাতে বহুবার ফোন গিয়েছে দুটো আলাদা নম্বরে। ঠিক যে দিন থেকে উমেশনাথের সঙ্গে তাঁর মেয়ের যোগাযোগ বন্ধ হয়েছে। দু’টো নম্বরের একটা সিরাজের এক ভাইপোর, অন্যটা এক পরিচিতর।

কেন? যে সিরাজ এমনিতে রাতে মোবাইল বন্ধ রাখে, হঠাৎ তার রাতভর কথা কীসের? ওই রাতেই? নিছক কাকতালীয়? নাকি অন্য কিছু?

সিরাজের সঙ্গে এ বার ডেকে পাঠানো হল বাকি দুই মোবাইল নম্বরের মালিককেও। দু’জনেরই বয়স ১৮—এর নীচে। প্রথমে আলাদা আলাদা বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হল তিনজনের। সিরাজ এখনও নির্বিকার, নির্লিপ্ত। গোয়েন্দাদের বললেন, ‘স্যর, আমার ভাগ্নের বিয়ে ছিল ২৯ মার্চ। তাই নিয়েই কথা হচ্ছিল। কোন শেরওয়ানিটা পরবো, কী কী মস্তি করব, ভাইপোকে জিজ্ঞেস করছিলাম। আপনাদের এত বার বলছি। তবু বিশ্বাস করছেন না।’ বাকি দু’জনকেও একই প্রশ্ন করা হল। বার বার। অনন্ত ধৈর্য্য লাগে একই প্রশ্ন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অসংখ্যবার করতে। তবু করে যেতেই হয়, যদি কোনও কথার ফাঁকে সত্যিটা বেরিয়ে পড়ে। কাজ হল ঘণ্টার পর ঘণ্টা ম্যারাথন জেরায়। গোয়েন্দাদের লাগাতার জেরায় কবুল করে ফেলল সিরাজের ভাইপো, ‘স্যর, আমরা ভুল করে ফেলেছি। মাথায় শয়তান ভর করেছিল। মেরে ফেলেছি তিনজনকেই।’

—মানে, তিনজনকেই খুন করে ফেলেছিস?

—হ্যাঁ স্যর, মেরে ফেলেছি। আমি একা নই। আরও কয়েকজন ছিল।

—তারপর?

—মেরে পুঁতে দিয়েছি।

ইন্টারোগেশন রুমে তখন সবাই চুপ। এ বার ওই ভাইপোর সঙ্গে মুখোমুখি বসানো হল অন্য নাবালক কিশোরটিকে। তদন্তকারীদের সামনেই সিরাজের ভাইপো অন্যজনকে বলে, ‘আমি সব বলে দিয়েছি। তুইও দে। আমরা ভীষণভাবে ফেঁসে গিয়েছি। পুলিশের জেরার চাপে ভেঙে পড়ে দুই কিশোর। এ বার আর জাল কেটে বেরনোর পথ ছিল না সিরাজের। সাময়িক বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে রাতভর চলল জেরা, তিনজনকে। যা উঠে এল, তাতে দুঁদে গোয়েন্দারও রোম খাড়া হয়ে যেতে বাধ্য। জানা গেল, যা ঘটেছিল, যেভাবে ঘটেছিল, যে কারণে ঘটেছিল।

রেশমা সিংয়ের পরিবারের সঙ্গে সিরাজের আলাপ ২০১১—তে, যখন ইয়াসিন মঞ্জিলে ফ্ল্যাট খুঁজছেন রেশমা। ওই ফ্ল্যাটে নিয়মিত না—হলেও যাতায়াত ছিল সিরাজের। বছর তিনেক বাদে ফ্ল্যাটটা ছেড়ে অন্যত্র উঠে যাওয়ার কথা ভাবছিলেন রেশমা। কিন্তু ফ্ল্যাট বিক্রি করবেন কাকে? কথায় কথায় সিরাজকেও ফ্ল্যাট বিক্রির কথা বলেন তিনি। রেশমাকে প্রস্তাব দেন সিরাজ, ফ্ল্যাটটা অন্য কাউকে দেবেন কেন? তিনি নিজেই কিনে নেবেন। ফ্ল্যাটের অধিকারস্বত্ত্ব রেশমা তাঁকে দিয়ে গেলে আরও বেশি দামে সেটা বিক্রি করতে পারবেন সিরাজ। প্রাথমিক কথাবার্তা হলেও রেশমা পিছিয়ে এলেন। তাঁর কেমন সন্দেহ হল, সিরাজ সস্তায় তাঁর কাছ থেকে ফ্ল্যাটের অধিকারস্বত্ত্ব নিতে চাইছেন। তারপর আরও অনেকটা বেশি দামে অন্য কারও কাছে বিক্রি করে দেবেন। অন্য কাউকে ফ্ল্যাট বিক্রির কথা ভাবতে শুরু করেছিলেন রেশমা। কথাও বলেছিলেন।

তাতে তো বড় লোকসান হয়ে যাবে। কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না সেটা। প্ল্যান ছকতে থাকেন সিরাজও। ভয় দেখিয়ে লাভ হবে না। রেশমাদেবীরা পুলিশের কাছে গেলে মুশকিল। তাই চিরতরে সরিয়ে দিতে হবে মা, দুই মেয়েকে। একেবারে হাপিশ। কিন্তু একা তো সব কাজ হবে না। রেশমাকে সরিয়ে দিতে পারলে শুধু ফ্ল্যাট নয়, আরও টাকাপয়সা মিলতে পারে। মোটা টাকার লোভ দেখিয়ে প্রথমে নিজের ভাইপোসহ আরও কয়েকজনকে জোগাড় করেন সিরাজ। খুনের সপ্তাহ খানেক আগে বড় দু’টো ট্রাঙ্কের বরাত দেন। তারপর ওঁত পেতে থাকেন সুযোগের। তিনজনকে যাতে পরপর খতম করা যায়, এমন একটা সুযোগ!

দোকান থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ডেড বডি। পাশে লাশ পচা গন্ধে নাকে রুমাল পুলিশ—জনতার
দোকান থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ডেড বডি। পাশে লাশ পচা গন্ধে নাকে রুমাল পুলিশ—জনতার

চলেও এল সুযোগ। ২৯ মার্চ সকালে ওষুধ আনতে দোকানে গিয়েছিলেন রেশমা। বাড়িতেই ছিল তাঁর দুই মেয়ে। আশপাশ কিছুটা ফাঁকা দেখে রেশমা সিংয়ের ঘরের দরজায় বেল বাজালেন সিরাজ। রেশমার মেয়ে ভিতর থেকে জিজ্ঞেস করল, ‘কে?’ পরিচিত কণ্ঠে জবাব আসে, ‘আমি। সিরাজ আঙ্কল। তোমার মা বলেছিলেন ঘরে ইলেকট্রিকের কী কাজ করানোর আছে। মিস্ত্রি নিয়ে এসেছি।’ দরজা খুলে দেয় সম্প্রীতি। দরজা বন্ধ করে নিশ্চিন্তে পিছন ফিরতেই তার মাথায় ভারী হাতুড়ির ঘা বসিয়ে দেয় আততায়ীরা। দিদির আর্ত চিঙ্কার শুনে দৌড়ে আসে নিবেদিতা। তাকেও একইভাবে আঘাত করা হয়। তারপর ঘরের মধ্যে টেনে এনে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয় দু’জনেরই। সম্ভবত সে সময় প্রাণপণে বাঁচার চেষ্টা করেছিল দুই বোন। তাদের আঙুলের নখের আঁচড়ে ছড়ে যায় সিরাজের হাত। কিছুক্ষণ বাদে ওষুধ নিয়ে ফেরেন রেশমাদেবী। ঘরের বেল বাজালে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকিয়ে তাঁকেও একই কায়দায় খুন করা হয়। মাথায় হাতুড়ির বাড়ি, তারপর শ্বাসরোধ। দেহগুলিকে প্ল্যাস্টিকে মুড়ে বড় ট্রাঙ্কে ভরা হয়। প্রমাণ লোপাট করতে গোটা ঘর ভালো করে ধোয়া হয় জল দিয়ে। তারপর ওই ট্রাঙ্কগুলো সরানোর মতো ফাঁকা সময় খুঁজতে থাকে আততায়ীরা।

কাছে ডায়মন্ডহারবার রোডের দোকানের মেঝেয় টাইলস বসানো হবে বলে আগেভাগেই আশপাশের লোকজনকে বলে রেখেছিলেন সিরাজ। বেশি টাকা দিয়ে মিস্ত্রি লাগিয়ে মেঝে খুঁড়ে রাখা ছিল পরিকল্পনা মাফিকই। ৩০ মার্চ ভোর হতে না হতেই সিরাজ আর তাঁর সঙ্গীরা মিলে ট্রাঙ্ক দু’টো রেশমা সিংয়ের ফ্ল্যাট থেকে নামিয়ে নিয়ে এলেন দোকানে। দোকানের মালপত্র সরানো হয়েছিল কাজের জন্য, আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দোকানে ভেবেছিলেন আশপাশের দোকানদাররা। সন্দেহ হয়নি কারও। সবকিছু মিটে গেলে দিব্যি ভাগ্নের বিয়েতেও যান সিরাজ, ফুর্তিও করেন বন্ধুদের নিয়ে, কারও কিচ্ছুটি মনে হয়নি। তাঁর ভাইপো, নাবালক সঙ্গীটিও চলে যায় নিজেদের বাড়ি। দেহ লোপাট হলেও ভয় একটা ছিল, রেশমা সিংয়ের বাড়ির লোকজন খোঁজ করতে গেলে কী বলবেন? শম্ভুর ঘাড়ে দোষ চাপানোটা ছিল সহজ।

তবে এতকাণ্ডের পরও শেষরক্ষা হল না। এমনই হয়। পাপ কি কখনও চাপা পড়ে থাকে?

এক এক করে সব সাক্ষ্যপ্রমাণ নিখুঁতভাবে সংগ্রহ করেছিল পুলিশ। তদন্তকারীরা খুঁজে বের করলেন সব ক’জন মিস্ত্রিকে। খুনের পর হাতুড়িটা আদিগঙ্গায় ফেলে দিয়েছিল খুনিরা। জাল ফেলে, ডুবুরি নামিয়ে উদ্ধার করা হয়েছিল ব্যাগে ভরা সেই হাতুড়ি। দোকান থেকে কেনা নতুন ট্রাঙ্কের রসিদ, মিস্ত্রিদের বয়ান, মোবাইলের টাওয়ার লোকেশন আর কল ডিটেলস, আশপাশের প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ থেকে উঠে আসা ঘটনা পরম্পরা মালা গাঁথার মতো নিপুণ দক্ষতায় সাজিয়ে আদালতে চার্জশিট জমা দেয় পুলিশ। আপাতত আদালতের রায়ের অপেক্ষা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *