উলটোরথ
ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে ডাক্তার আমাকে তার জিপে তুলে নিলে। এবার উলটোপথের পালা। চলো মুসাফির বাঁধো গাঠোরিয়া। এবার যাত্রা চম্প্রুং গ্রামে, যেখানে আমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে লামা পেম্পা গে (অথবা পেম্পা খাণ্ডু)। সুভাষবাবু বললেন—”আগামিকাল বিকেলেই দেখা হবে”—সব ঠিকঠাক–আমাকে চং গ্রাম থেকে তুলে নিয়ে একেবারে তেজপুরে পৌঁছে দেবেন ওঁরা, অ্যাগ্রিকালচার বিভাগের বাসে। একটা কী মিটিং আছে, ৩-৪ জনে যাচ্ছেন। পথে চম্প্রুং-এ থেমে, আমাকে তুলে নেওয়া খুবই সরলকর্ম। পেম্পা গের গুম্ফা সবাই চেনে।
— কুকুরছানার কী হবে?”
—”কিছু ভাববেন না, আমি যাবার সময়ে নিয়ে যাব। ওকে নিয়ে তো আপনি চম্প্রুং যেতে পারেন না। রাখবেন কোথায়? আপনি তো থাকবেন গুম্ফা ঘরে।”
—”সেটা কী?”
—”এখানে সবার বাড়িতে দুটো করে ঘর থাকে তো? একটা বসবাসের, আর একটা পুজোর। ওই পুজোর ঘরটাতেই অতিথিদের রাখে। তাই বলছি।”
—”বেশ, তবে আমি আগে চলে যাই, কুকুরছানা পরে আসুক?”
—”তাই কথা রইল!”
—”ভুলবেন না কিন্তু”—
সুভাষবাবু হাসলেন,—”চলুন, ডাক্তারের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিই।”
.
বাক্স গুছোচ্ছি, হঠাৎ একপাশে শক্তমতন হাতে কী যেন ঠেকল। কী এতে? ভীষণ ভয় পেয়ে গেলুম। বোমা-টোমার মতন ঠেকছে! গোলমতন। অমনি হাতড়ে হাতড়ে সব কিছু টেনে বের করে মেঝেয় ঢেলে ফেললুম। বোমা দুটিও বেরিয়ে পড়ল।
দুটি মিল্কমেড কনডেন্সড মিল্কের টিন। আমার চোখের জল বাঁধ মানল না। ডাক্তার লাজুক, অপ্রস্তুত, আলগা, সুদূর স্বভাবের আড়াল থেকে একটা মমতা মাখা উষ্ণতা উকি মেরেই লুকিয়ে পড়ে—এখানে সেটা একেবারেই বর্ণচর্মহীনভাবে ধরা দিয়েছে। দুটি কনডেন্সড মিল্কের টিনে।
যে-রাত্রে এসে পৌঁছুলাম তাওয়াং-এ, জাং থেকে ব্র্যান্ডি আর কনডেন্সড মিল্কের টিন কিনে এসেছিল ডাক্তার। সস্তায় পাওয়া যায়, যদি মিলিটারি বন্ধু-বান্ধবরা কিনে দেয়। আমি আবার কনডেন্সড মিল্ক চামচ করে চেটে খেতে খুব ভালবাসি। চা করবার জন্য টিন খোলা হতেই আমি বাহাদুরের কাছে এক চামচ চেয়ে নিয়ে চেটে চেটে খাচ্ছিলুম। ডাক্তার তো হাঁ! এ কী কাণ্ড? ডবল এম এ, পি এইচডি, এফ আর এ এস–ধেড়ে ধেড়ে দুই মেয়ের গর্ভধারিণী, প্রধানা অতিথি, চেটে চেটে চামচ করে কনডেন্সড মিল্ক খাচ্ছেন? ওর অবাক নজর দেখে লজ্জা পেয়ে গিয়ে আমি বক্ শুরু করি—”বুঝলেন, আমি রসগোল্লা, গোলাপ জামুনের চেয়েও এটাই বেশি ভালবাসি! যুদ্ধের মধ্যে আমাদের শৈশব কেটেছে তো, তখন থেকেই রুচিটা তৈরি হয়েছে, লোভটা শিকড় গেড়েছে। সত্যি বলতে কী, এটা আমার রাবড়ির মতন লাগে!”
ব্যাখ্যাটা ডাক্তারের মনে ধরল কিনা জানি না, সে কোনও কথা না বলে টিনটা নিয়ে এসে, আরেকটু ঢেলে দিল আমার চামচে ভর্তি করে।
.
তারপর এই কদিন সত্যি বলতে কী আমি যে মাঝে মাঝে ঘুরে ফিরে অল্পস্বল্প কনডেন্সড মিল্ক চেটে দেখিনি, তা নয়। তবে ডাক্তারের সঙ্গে এ নিয়ে আর কথাবার্তা হয়নি। আজ যাবার সময়ে আমার ব্যাগের মধ্যে আমার অজান্তে দুটো টিন কে যে ভরেছে তা বুঝতে অসুবিধে হল না। চোখের জলের আর দোষ কী? বাঙালি মা-মাসির সেন্টিমেন্টের শঙ্খঘন্টা অনাত্মীয়া সিন্ধি যুবকের বুকের মধ্যে হঠাৎ বাজতে শুনলে, তার প্রতিধ্বনি আমার বুকেও না বেজে পারে?
বাহাদুর খুবই দুঃখিত। মাত্র তিনদিন? ফের কবে আসবেন? আর আসবেন না? সে কী?… এত কম দিনের জন্যে কেউ এত কষ্ট করে এত দূর আসে?
—”হামলোগ তো সম্ঝা কি নয়া মেমসাব ইধরই বলি হো কে চলে আয়েঙ্গে। পুরানা মেমসাব কো জাগা মেঁ। চায় দুকানমে এইসাহী বোলতা থা। দেখো নয়া মেমসাব আ গয়া।”
খুব সন্দিগ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করি- “পুরানা মেমসাবটি কে?”
ডাক্তার তাড়াতাড়ি উত্তর দেয়—”আমার কেউ না! উনি এখন বদলি হয়ে গেছেন। এখানে ডি সি ছিলেন এতদিন, মিস নিরু নন্দা, আই এ এস, খুবই সৎ ও কর্মঠ মহিলা। সর্বজনপ্রিয় হয়েছিলেন।”
—”অল্পবয়সি মেয়ে। প্রচুর কাজ করেছেন কিন্তু গ্রামে গ্রামে ঘুরে। এখানে পীচফল আর আপেলের চাষ শুরু করেছেন। আলুর চাষটাও খুব এনকারেজ করেছেন। অবশ্য আগেই শুরু হয়েছিল ওটা, আমরাই তো আলু সাপ্লাই করি এখন আপনাদের শেয়ালদার বাজারে, আর কোলড্ স্টোরেজে”—তাওয়াং-এর মহামান্য অ্যাগ্রিকালচারাল অফিসার কথা বলছেন, সন্দেহ নেই! কথা যখন আলু-আপেল বিষয়ে, তাঁর ফর্সা মুখটি আপেলের মতোই টুকটুক করছে আহ্লাদে!
—”ওঃ হো—এবারে বুঝেছি, কী জন্যে জামীরীর আই বি-তে অমন ঠকাঠক সেলাম, আর ‘হুজুর মেমসাব’, ‘জি মেমসাব’ ট্রিটমেন্ট পাচ্ছিলেন আপনি” –
ডাক্তার হঠাৎ স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে চেঁচিয়ে ওঠে—
—”বাহাদুরের বন্ধুদের মতন ওরাও নিশ্চয়ই ভেবেছে নতুন মেমসাব এলেন পুরানা মেমসাবের জায়গায়, তা নইলে এভাবে কেউ হুকুম করতে পারে? তক্তা ওঠাও, ড্রইংরুম খোলাও–বাব্বাঃ। সে কী দুর্দান্ত পার্সোনালিটি! আমি তো থ! অত রাত্রে চৌকিদারকে দিয়ে চা বানিয়েই খেলেন!”
ডাক্তার হঠাৎ চুপ করে যায়। একসঙ্গে অনেকগুলো কথা বলে ফেলেছে। অথবা, এর পরেই হয়তো তার মনে পড়ে গেছে চামচভর্তি কনডেন্সড মিল্কের কথাটা! হ্যাঁ, পার্সোনালিটি ই বটে একখানা!
আমি অন্য প্রসঙ্গ পাড়ি সুভাষবাবুর কাছে।
—”নিরু নন্দা এখন কোথায়?”
—”দিল্লিতে, ‘বসন্ত বিহারে’, ওর বাবার কাছে। ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি, হুট করে কখনও দিল্লি গিয়ে পড়লে ওকে নিশ্চয়ই আমাদের কথা জানাবেন। বলবেন এখানে সকলেই ওকে ভালবাসে। সম্মান করে। মনে রেখেছে। টেল হার উই মিস হার আ লট।”
.
শ্রীমতী নিরু নন্দার কাছে আমারও কৃতজ্ঞতার শেষ নেই, এই মেয়েটির সঙ্গে আমার কখনও দেখা হয়নি, কিন্তু তার সুকৃতির সুফল আমি ভোগ করেছি পরিপূর্ণ ভাবে। চপ্রুং গ্রামে, তুন্ড্রালা গ্রামে পাহাড়ি পোম্পাদের মধ্যে “ডি সি মেমসাহেব”-এর প্রতি যে শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা গড়ে উঠেছিল, আরেকজন স্বাধীন মেয়েকে দেখে, সেই ভালবাসাই তারা আবার উজাড় করে দিয়েছিল বলে মনে হয়। কেন না আমি তো তাদের জন্যে কিছুই করিনি, একেবারেই অপরিচিত। আমাকে তারা যে ভাবে আত্মীয়ের মতো আপন করে নিল, সেটা মোটেই তুচ্ছ নয়। লোকাল মানুষেরা একেবারে চমৎকৃত। এখানে তো বাইরের লোক বেশি আসে না, এরা মোটে মিলতে-মিশতে অভ্যস্ত নয়, তাই বাইরের লোকদের নিয়ে সংশয় বাতিকে ভোগে। কাউকেই চট করে নিজেদের মধ্যে টেনে নেয় না, বিশ্বাস করে না। বাহাদুর আমার সঙ্গে “পুরানা মেমসাব” এর কী যে মিল পেল জানি না, নিশ্চয়ই সেই একই কারণে আমি এই স্বজন-সুলভ ভালবাসা পেলুম মোম্পাদের বাড়িতেও।
এটা কেউই ঠিক আশা করেননি। তাওয়াং-এ যাঁরা ছিলেন, সেই ভারতীয় অফিসাররা প্রায় সবাই খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলেন আমার মোম্পাদের বাড়িতে গিয়ে বাস করবার অন্যায় আবদার শুনে। একটু বিরক্তও বোধ হয়। এ আবার কী আদিখ্যেতা! ওরা খুব নোংরা, স্নান করে না, গায়ে উকুন, যাচ্ছেতাই খাবার খায়—”ভাববেন না চাইনিজ খেতে দেবে”—( যাদের চা-ই ওইরকম!) তাদের অবস্থাও অত্যন্ত দরিদ্র, তদুপরি আমি ওদের ভাষা জানি না, এবং ওদের সমাজের সঙ্গে মিশতে অভ্যস্ত নই। যদিও তারা জাত হিসেবে চোর-জোচ্চোর নয়, এবং খুবই ভদ্র, তবু, এই আব্দারটা ছেড়ে দিয়ে, বরং জিপ নিয়ে, সারাদিন গ্রামে গ্রামে টহল মেরে ঘুরে এলেই তো হয়! কিন্তু আমি কি এইসব কথায় ভিজবার পাত্র? আমার তো পেম্পা খাণ্ডুর সঙ্গে সকালে কথাই হয়ে গেছে। যাব, আজই যাব। বিকেলবেলায়। সাম্প্রং ভিলেজ।
লামার বাড়ির আব্দার
পেম্পা গে সত্যি রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল যখন আমাদের জিপগাড়ি পৌঁছোল। ডাক্তার নেমে আমার বাক্স এবং আমাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে চলল পেম্পা গে-র বাড়ি। বেশ একটু উঁচুতে, খানিক সিঁড়ি ভেঙে, পেম্পা গে-র গুম্ফা ঘর। ডাক্তার বসল না, জিপ ছেড়ে দিতে হবে।
—”পরে দেখা হবে, চলি!” হঠাৎই পেছন ফেরে ডাক্তার।
—”কবে? কোথায় কখন? ধন্যবাদ, ভাই শ্যামসুন্দর, অনেক ধন্যবাদ, এমন বিভুঁই-বিদেশে তোমার মতন একটা ভাই না পেলে আমি কী করতুম?”
—”আর কাউকে পেয়ে যেতে। তোমার সঙ্গীর অভাব হবে না কোনওকালে।”
—”কালই তো চলে যাচ্ছি”—
—”আবার তো দেখা হবে—টেক কেয়ার, গুডলাক।”
“কী করে? কোথায়?”
—”হবে হবে, কোথাও না কোথাও”—প্রায় দৌড়ে ডাক্তার গিয়ে জিপে উঠল। ঘোরানো পথ দিয়ে জিপ মিলিয়ে গেল উপরের দিকে। আবার কবে দেখা হবে, ডাক্তার? কোথায়?”
.
—”এই আমার গুম্ফা। আমিই এর লামা।” পেম্পা বলে হিন্দিতে।— “আমার বড় ছেলেও লামা, তার বয়েস আঠারো—অন্য একটা গ্রামে তার গুম্ফা—ওই যে দেখা যায়” দূরে, আরেকটু নীচের দিকে আঙুল দেখাল সে। সাম্প্রং তাওয়াং-এর চেয়ে নীচে; এখানে অনেক গাছপালা, ফলের বাগানে সন্ধ্যা ঘনিয়েছে। সামনেই, নীচের ঢালুতে আরেকটি জনবসতি, ওই যে, সেখানে আরেকটি ছোট গুম্ফার ছাদ দেখা যায়। তাতে গোধূলির আলো লেগেছে।
পেম্পা সগৌরবে বলল :
—”আমার ছেলেই ওই গুম্ফার লামা।”
গুম্ফা-ঘরের মধ্যে জমা অন্ধকার লুকোচুরি খেলছে প্রদীপ আর মোমবাতির সঙ্গে। অমন সুন্দর ধূপের গন্ধে প্রণাম করবার ইচ্ছে আপনিই হয় মনে মনে। মেঝেয় পুরু, নরম, চমৎকার কারুকাজ করা কার্পেট পাতা। ভিতর দিকের গর্ভগৃহে ধ্যানস্থ বুদ্ধমূর্তি। কিন্তু তিনি তো একা নন? পাশাপাশি বেশ কজন বীভৎস মূর্তিমান দেবদেবীর দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বুদ্ধের সামনে একটি “চওঁরীঘীউক দীয়া!” আর তাঁদের সামনে বেশ কয়েকটি মোটাসোটা মোমবাতি জ্বলছে। ভীম-ভৈরবের সবাই দাঁত খিচিয়ে চোখ পাকিয়ে আমার দিকেই চেয়ে আছেন। বেশ বড় বড় পিতলমূর্তি। মানুষ প্রমাণ দেবদেবীগুলি মোটেই ভাল দেখতে নয়। তুলনায় নিজেকে পরমাসুন্দরী মনে হয়। (একটা চেড়ি-পরিবৃতা সীতা টাইপের সেল্ফপিটির অনুভূতিও জাগে!) ওদের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে লামা পেম্পা গে-র সঙ্গে গল্প করি। কিন্তু ওরা চোখ যে ফিরিয়ে নেয় না! বিস্ফারিত দৃষ্টি দিয়ে বিঁধতে থাকে।
পেম্পার বয়েস এখন চল্লিশ। তার স্ত্রীর বয়েস চুয়ান্ন। বিয়ের সময়ে ছিল কুড়ি আর চৌত্রিশ। বাবা মা পছন্দ করে বউ এনেছিলেন। বাবাও লামা ছিলেন, পিতামহও তাই
পিতামহ-পিতামহীকে পেম্পা দেখেছে, তাঁরা মৃত, বাবা-মাও মৃত। “বুই তো বুড়ী হোগয়া”—বেশ দুঃখ ভরে বলল পেম্পা।—”চৌধা সাল কা বড়া হ্যায় না?”—বাবা-মা অমন বিয়ে দিলেন কেন?—”আচ্ছা লড়কি থা, বহুত কাম কা থা, বুঢ়া পিতাজি বুডটী মাতাজিকো দেখভাল করতা থা—ইস লিয়ে।”
—”এখন বুঝি সে আচ্ছা লড়কি নেই আর? আপনাকে দেখভাল করে না বুঝি?”
—”তা করে। খুব খাটে। বাচ্চাদের দ্যাখে। বাগান-টাগান দ্যাখে।”
—”কয়টি বাচ্চা?”
—”এক ছেলে। লামা। তিন মেয়ে। বড় মেয়ের নাম কিন্দর খামো, বয়েস সতেরো, বাড়িতে কামকাজ করে। মেজোটির বয়েস চোদ্দো। সে আনি হয়েছে, আনি গুম্ফায় থাকে। আর ছোটর আট, সে স্কুলে যায়। তার নাম উড়াকিন খামো।”
—”এত হিন্দি শিখলেন কোথায়?”
—”ইনডিয়ায়। আমি তো অনেকবার ইনডিয়ায় গেছি। তিনবার ধরমশালাতে দালাই লামাকে প্রণাম করতে গেছি। ছাব্বিশে জানুয়ারি দেখতে দিল্লিতে গেছি দুবার। বুদ্ধগয়া গিয়েছিলাম এই তো চারবছর আগে। তা ছাড়া কুলুমানালি—আমি ইনডিয়াতে অনেকবার গেছি কিনা”-
মনের সুখে পেম্পা কথা বলছে, আর আমি ভাবছি, হায়রে ভারত সরকার! এত করে “ইহা হয় মাতা ভারত”—”আমরা হই গর্বিত, হইয়া ভারতবর্ষীয়’—ইত্যাদি পোস্টার সেঁটেও এদের ল্যাঙ্গুয়েজটা পোষ মানাতে পারা গেল না?”ইনডিয়াতে গেছি” কী ভাষা? এটা শুনলে চিনেরাই বা কী বলবে, পাকিস্তানই বা কী বলবে!
—”সাম্প্ৰং বস্তি থেকে দশজন গিয়েছিলাম কুলু মানালি, আপেল চাষের শিক্ষা নিতে। অ্যাপল্ প্রুনিং শিখতে। তখন চারমাস ছিলাম তো—জানুয়ারি থেকে এপ্রিল—ভাল করে হিন্দি বোলি শিখে গেছি। কুলুতে, থানাদার বলে জায়গাটার নাম, সেখানে দেখলাম একজন চাষির দুশো একর আপেল ক্ষেত আছে জানেন? এখানে এত জমিই নেই কারুর। লামাদের তো জমিজমা থাকেই না। চমরীও থাকে না। কেবল ঘোড়া থাকে—চড়ে ঘুরতে হয় বলে।”
—”দালাই লামা কেমন লোক? কথা বলেছিলেন আপনার সঙ্গে?”
—”খুব ভাল। আমার মা মারা যেতে ওঁর কাছে গিয়েছিলাম। তাঁর জন্য টাকা দিতে, দালাই লামার পুজো দিতে। এত ভাল লোক তিনি, গেলে খানা দেন, চায় দেন, যত্ন করে বাচি করেন, যানে কা টাইমমে বোলা, ‘সাবধানীসে যানা, রাস্তামে বহুৎ গুণ্ডা হ্যায়!’ আমরা বিশ পঁচিশজন লামা মিলে গিয়েছিলাম, দালাই লামাকে পুজো করতে, সবাই খুশি হয়ে ফিরেছি।” কথা বলছি, এমন সময়ে দোরগোড়াতে একটি অপরূপ সুন্দরী কিশোরী এসে দাঁড়ায়। তিব্বতি ভাষায় কী কথা বলে। বাইরে তখন অন্ধকার। লামা আমাকে বলেন-
—”আমার বড় মেয়ে, কিন্দন খামো। জিজ্ঞেস করছে খানা এখানেই এনে দেবে না আমাদের বাড়িতে গিয়ে খাবেন? তারপর আবার এখানে আপনাকে পৌঁছে দিয়ে যাব। “
—”ওরে বাবা। এখানে পৌঁছে দেবেন কেন? এখানে রাত্তির বেলা একা একা কে থাকবে?” (এতগুলো ভয়ংকর দর্শন অচেনা দেবদেবীর মধ্যে! চেনা-শুনোর মধ্যে ওই যা একা বুদ্ধদেব। অমন হাসিহাসি মুখে আধাবন্ধ চোখে “ভয় নেই ভয় নেই” বলে হাত তুলে পদ্মাসনে থাকলেই কি হয়? ভয় করবেই! মানুষকে আমি ভয় পাই না, যত অচেনাই হোক। তা বলে তিব্বতি দেবদেবী?) না বাবা! “আমি…আপনাদের বাড়িতেই যাই না কেন? সেখানেই খাব, সেইখানেই শুয়ে থাকব। কিন্দর খামোর কাছে কি শুয়ে থাকা যাবে না?”
–“কেন যাবে না? কিন্তু আপনারই তো কষ্ট হবে। আমাদের গরিব ঘর। লামাদের গেস্টরুম এই গুম্ফা। ইধরই জেয়াদা আরাম হোগা।”
—”জেয়াদা আরাম কে চায়? আমি বাবা একা একা এই এতজন ঠাকুর দেবতার মধ্যে রাতভোর থাকতে পারব না। মনে হবে স্বর্গেই এসেছি বুঝি। আমি মানুষজনের মধ্যেই থাকতে চাই।”
—”চলুন তবে।” আমার ব্যাগ তুলে নেয় লামা পেম্পা খাণ্ডু।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে খানিকটা হেঁটে গিয়েই পেম্পা গে-র বসতবাড়ি। দরজার বাইরে প্রেয়ার হুইল লাগানো। এখানে সবার বাড়ির বাইরেই এটা দেখছি। চাকাটি ঘুরিয়ে দিয়ে, ঈশ্বরের কাছে আগেই খবরটি পাঠিয়ে, যে হ্যাঁ দিনের কাজ শেষ করে আমি নিরাপদে ঘরে ফিরেছি, তোমারই কল্যাণে, ‘তোমার জয় হোক’–বলে, গৃহস্থ তার গৃহে পা দেয়। এটা আমার ভারি পছন্দ হল। যদি পারতুম আমাদের বাড়িতে না হোক অন্তত আহার ঘরের বাইরে আমি এমনি একটা ব্যবস্থা করতুম। রোজ যাতে গৃহে পা দেবার আগেই গৃহদেবতাকে একবার স্মরণ করা যায়। আমার তো বিপদে পড়লে, শুধু বিপদতারণের মুখটি মনে পড়ে। আনন্দে থাকলে আনন্দরূপের মুখখানি মনে থাকে না। ভগবানের কেবলই আমাকে বিপদে ফেলা উচিত, যদি আমাকে দিয়ে তাঁর কথা ভাবানোর ইচ্ছে হয় তাঁর। তাই প্রেয়ার হুইলটা বেশ ব্যবস্থা আমার মতো আর যারা, তাদের জন্যে। “ভগবানকে তো ভালবাসি, কিন্তু পুজো-আচ্চা ভালবাসি না”—টাইপের নিশ্চয় আরও অনেক দুর্ভাগা-দুর্মতি আছে এই জগতে।
প্রেয়ার হুইল ঘোরালে আবার টুংটাং শব্দ হয় সুন্দর। প্রত্যেকেই একবার করে ঘুরিয়ে, দরজা সদর চৌকাঠ পেরুলুম। উঠোন। উঠোন পেরিয়ে কাঠের বারান্দায় (মাথায় ঢাকা নেই উঠতে হয়। সেখান থেকে, মাথাটি নিচু করে, আর উঁচু পাথরের চৌকাঠ পার হয়ে গুহার মতন ঘরে ঢুকতে হয় নিচু দরজা দিয়ে। শীতের দেশ বলেই দরজা নিশ্চয় এত নিচু। এখানকার মানুষরা বেঁটে নয় বিশেষ। লম্বাও নয় অবশ্যই। কিন্তু পেম্পা, ও তার মেয়েকে, বাঙালি মতে, লম্বাই বলা যায়।
ঘরে ঢুকতেই হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালেন এক অপূর্ব সুন্দরী মহিলা।
—”কারমো, আমার পত্নী!” বসে বসে কিছু পান করছে সে। একটি হাত জামার মধ্যে ভরা। হায় রে একেই বুড়ী বলছিল নেমকহারাম স্বামী? কোথায় বুড়ী? হ্যাঁ বলিরেখা দেখা দিয়েছে কপালে, কিন্তু মুখের লাবণ্যে, ঝকঝকে দাঁতের আর চোখের হাসিতে, এবং দেহের গঠনে যুবতীই। বছর পঁয়ত্রিশ-চল্লিশের বেশি কিছুতেই মনে হবে না। পেম্পা গে-কে অবশ্য চব্বিশ-পঁচিশ দেখায়, এই যা! রূপসী বড় মেয়ের পাশে তাকে বাপ বলে মনেই হচ্ছে না।
ঘরে আরেকটিও মানুষ আছে—অল্পবয়সি একটি ছেলে, মুণ্ডিত মস্তক, এখনও দাড়ি গোঁফ ওঠেনি, মুখখানি খুবই কচি, খুব মিষ্টি। চোখের দিকে চোখ পড়তেই লাজুক হাসি হেসে দিল। হাসিটা দেখে ভীষণ চমকে উঠি। এ তো পুরুষের হাসি নয়? এ নিশ্চয় মেয়ে!
—”আমার আন্নি-মেয়ে! তবিয়ত খারাপ বোলকে গুম্ফাসে চলা আয়া।” ফের কালই ফিরে যাচ্ছে সে গুম্ফায়। মিষ্টি হাসিটি দেখে বুকের মধ্যে মোচড় দিল। এই মেয়ে সারাজীবন থাকবে ব্রহ্মচারিণী হয়ে, ন্যাড়া মাথায়? ইয়েশি আনির অবশ্য মাথায় চুল আছে, বয়েজ কাট। চোদ্দো বছরের মেয়েটি মাথায় মায়ের মতোই লম্বা হয়েছে, মায়ের মতোই রূপসী। বালক সন্ন্যাসীর মতো চেহারা।
রূপবতী মা সুন্দরী মেয়েদের নিয়ে নিজের সাজানো সংসারের মাঝখানে মা লক্ষ্মীর মতো বসে আছে। লামা স্বামীর অপেক্ষায়। আপনমনে আগুন পোয়াচ্ছে, জপ করছে, আর রশি খাচ্ছে। হাতে কাঠের জপমালা। উনুনের ধারে বসে বসে এই জপ করতে করতে রশি খাওয়া, ভারি সুদৃশ্য মনে হল আমার। রিল্যাক্স্ড। প্রশান্ত, নিরুদ্বেগ মুহূর্ত। আমাদের দেখেই একগাল হাসি। তারপর উঠে খাবারের ব্যবস্থা শুরু। গিন্নি তো?
গহন রয়নমে ন যাও বালা!
এদিকে আমি বাথরুমে যেতে চাই। মেয়েটাকে যতই বলি, সে হাসে। এ তো বড় জ্বালা হল! বাথরুম যাবার উপায় নেই? এটা লোকের বসতি, বেরিয়ে গিয়ে মাঠে ঘাটেই বা যাই কী করে! এদের কি বাথরুম থাকে? না ওই বনপাহাড়িই ভরসা? কিছুই বুঝতে পারছি না। শেষে লজ্জার মাথা খেয়ে লামা-বাবুটিকেই বলি—”বাথরুম কিধার যায়ে গা?” সে বলে—”বাত্তুন কেয়া হ্যায়?” সর্বনাশ!—”ল্যাট্রিন?—ল্যাট্রিন কিধার?”
—”লাত্তিন? লাত্তিন কেয়া হ্যায়?”
যাব্বাবা! এখন তো বাকি যা যা প্রতিশব্দ জানি, তা আরও ভয়ংকর, আরও সুদূর শব্দ পাউডার-রুম, টয়লেট, ডাবলিউ সি, লু, জন, লিট্ল রুম, ল্যাভেটরি—এসবের তো কোনওটাই চলবে না!
—”শৌচাগার? শৌচাগার কাঁহা হ্যায়?”
—”ছৌ—কেয়া? মুঝে পাতা নেই। ছৌ—কেয়া?”
হায় রে! কেবল একটা কথা বললেই ঠিক বুঝবে। উঃ! ভদ্রলোক হয়ে জন্মানোর কি কম ঝামেলা? যাব একটা দরকারে, বলবে আরেকটা দরকারের কথা। কী যে বাধা, জিবের ডগায় যেন দশমন ওজনের শেকল দিয়ে তালা-চাবি এঁটে রেখেছে কেউ! অতিকষ্টে সেই মোক্ষম শব্দটাই উচ্চারণ করে ফেলি; হিন্দিতে অবশ্য শব্দটা একটু কম খারাপ শুনতে। অরিজিনালিও তো শব্দটা পারসিই, বাংলায় ওটা ফোর লেটার হয়ে যায় তো?
শব্দটা বাংলাতে শুনতেও যত খারাপ, দেখতেও তত খারাপ। বছর দশ-বারো আগে, ইংলন্ডে পৌঁছে একবার ইমিগ্রেশনের কিউ-তে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। সেখানেই প্রথম দেখলুম, তীর চিহ্নের পাশে বড় বড়, গোটা গোটা, বাংলা কালো হরফে লেখা আছে ‘পায়খানা’। তীরচিহ্ন বরাবর দৃষ্টিপাত করে একটা ভারতীয় প্রণালীর ওই ব্যবস্থাও দেখলুম। দুশো বছরের রাজ্যপাটেও যা সম্ভব হয়নি,—তা হয়েছিল অশিক্ষিত ইস্ট পাকিস্তানি ইমিগ্রান্টদের নোংরা করার কল্যাণে। খাস বিলেতে বাংলা ভাষায় নোটিস দেখলে প্রাণটার তো দোয়েল পাখির মতো পুচ্ছ তুলে নেচে ওঠার কথা? কিন্তু হায় রে এ-লুটিশ’ অ্যাইসা লুটিশ, যে প্রাণ তো নাচলই না, বরং পালাই পালাই করে উঠল। যদি বিদেশে গিয়ে একটিই বাংলা শব্দ দেখতে পাই—সেটি কি এইটি?
এ রকম তখন আমার মনে হয়েছিল। কিন্তু আজকে টের পেলুম, সেই নোটিসের মূল্য কী। ভাষা না জেনে ওই প্রাকৃতিক ইঁদুরকলের খপ্পরে পথে বেচারি পূর্ব পাকিস্তানিদের কী অবস্থাই যে হত, এতদিনে সেটা টের পেলুম। কোনও কোনও মুহূর্তে, কোনও কোনও দৃষ্টিতে, ওই শব্দগুলি নিশ্চয় খুব শান্তিদায়ক হয়েছে! –
.
পেম্পা গে-ও এই হিন্দি শব্দটা জানে। তৎক্ষণাৎ, খুব ব্যস্ত হয়ে আমাকে উঠোনে নিয়ে গেল। সদর দরজার দিকেই যাচ্ছি, হঠাৎ বাঁহাতে একটা ছোট্ট কাঠের ঘর—ছোট দরজাটির শেকল খুলে দিল পেম্পার কন্যা। এই সময়ে খুব সসম্মানে হিন্দি শব্দটিকে উচ্চারণ করল লামা,—যেন “রাষ্ট্রপতি ভবন” দেখাচ্ছে কোনও বিদেশি ডিপ্লোম্যাটকে।
আমিও সত্যিই এতটা আশা করিনি—দরজা-টরজাওলা, বন্ধ বাথরুম! বাড়ির প্রায় মধ্যেই! বাঃ! মহানন্দে ভিতরে ঢুকতে গিয়েই কপালটা ঠাশ করে ঠুকে গেল দরজার ফ্রেমে। আমি মেট্রোর সেই লম্বালোকের মতন এই বলে, মনে করি বুঝি সব দরজাই আমার তুলনায় যথেষ্ট। আরেকটু কম বিনয় থাকলে, আজ মাথাটা ঠুকত না! মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে যেই না অন্ধকার গৃহাভ্যন্তরে পদার্পণ করা, অমনি প্রচণ্ড ভয়ে মনে হল হৃদপিণ্ডটি শোঁ শোঁ করে হাঁটুতে নেমে যাচ্ছে- পায়ের নীচে কোনও জমি নেই—আমার পা গিয়ে পড়েছে অতল-নিতল শূন্যে। হাত দিয়ে দরজাটা ধরে ফেলে সামাল দিলুম— টর্চ ছিল, জ্বেলেও ফেললুম। কিন্তু তার আগেই একটা অনুপলের জন্যে, আমার মনে ঘোর মৃত্যুভয় এসেছিল।
মৃত্যুভয় বড় জটিল, বড় সরল। প্রবল শ্বাসকষ্টের রুগি আমি, মৃত্যুযন্ত্রণার সঙ্গে আমার বেশ মাখামাখি পরিচয়। ভাবতুম মৃত্যুভয় বুঝি আর আমার বাকি নেই। থাকবে কী করে, যখন প্রতিটি শ্বাসই নাভিশ্বাস? বুকের মধ্যে যখন ঐকান্তিক প্রার্থনা উঠে আসে—এ নিশ্বাসই যেন শেষ নিশ্বাস হয়, হে প্ৰভু, হে ঈশ্বর।
সুখ বলো দুঃখ বলো জীবন যা দিতে পারে, হাত ভরেই দিয়েছে। এখন বিনা অভিযোগে যে কোনও মিনিটেই গদি ছেড়ে দিতে পারি। অনেক সময়ে ঘর গেরস্ত মানুষের ধারণা হয় মৃত্যুভয়টা নিজের জন্য নয়। —”আমি মরলে আমার বাচ্চা-কাচ্চার কী হবে!” সে ভাবনা ও আমার নেই। কেবল যতদিন বেঁচে আছি, ততদিনই বাচ্চা-কাচ্চার দায়িত্ব আমার। মরে গেলে আমার কী? জীব দিয়েছেন যিনি ভারও নেবেন তিনি। আমি তো নিমিত্ত মাত্র। একটা মস্ত জিনিস শিখে গেছি।—জগতে কারুর জন্যই কারুর আটকায় না। “ইনডিসপেন্সেবল্” বলে, কিংবা “অত্যাগসহন” বলে এই স্রোতোময় জীবনে কোনও শব্দ নেই। আজ আমি যদি পৃথিবী থেকে উবে যাই, শেষপর্যন্ত কারুরই আটকাবে না। সব ত্যাগই সহ্য হয়ে যায়। কিন্তু অতর্কিত এসে, প্রাণভয় যে কী জিনিস, আমাকে তা টের পাইয়ে দিলে। এই অন্ধকারের দোর ঠেলেই গহন গভীর নিরাশ্রয়তার মধ্যে পদক্ষেপ করে, নিরালম্ব শূন্যতার মধ্যে পা যখন ডুবে যাচ্ছে, তখন মর্মে মর্মে বুঝলুম আয়ুর ভিখারি হওয়া কাকে বলে। “পায়ের নীচে মাটি নেই” এটা একটা মেটাফরিক্যাল বাক্য হয়ে আমাদের জীবনে প্রায়ই আসে—কিন্তু এমন উৎকট আক্ষরিক বাস্তব হয়ে আর কবার?
চকিত মুহূর্তের ব্যাপার মাত্র
ক্ষণিকেই দরজা আঁকড়ে ধরে পতন সামলে নিই টর্চ জ্বেলে, পা তুলে চৌকাঠের নিরাপত্তায় রাখি।
সামনে মেঝেটি পরপর কাঠের তক্তা বিছিয়ে তৈরি। তক্তাগুলি কখনও ইঞ্চি ছয়েক দূরে, কখনও বা ফুটখানেক। ঘরটি আড়ে ছোট কিন্তু বহরে লম্বা। ভেতরদিকে ঝুড়ি করে মুরগি রাখা। মুরগি, না মোরগ? তারা আমাকে দেখে কঁক কঁক করে স্বাগত জানাল। আরে, মিস্টার সেনের ট্রাকের তারাই নয় তো?—টর্চ ফেলে দেখলুম তক্তার নীচে টানা গর্তে, শুকনো পাতার ঘন স্তূপ দেখা যাচ্ছে। পুরো ঘরটাই একটা বিরাট গর্তের ওপরে তক্তা দিয়ে সেতুবন্ধ করে তৈরি হয়েছে। প্রতিটি তক্তাই খুব পরিষ্কার। আলাদা করে বিশেষ কোনও গর্ত নেই। কোনও দুর্গন্ধও নেই। ভেতরে জলের ব্যবস্থা নেই। কাগজ তো নেই-ই। ধুলোবালি, পাতা, মাটি—কিছুই নেই। কী মুশকিল।
এরা করে কী?
না কি কিছুই করে না?
শৌচকর্ম বলে একটা ব্যাপার আছে না?
ভাগ্যিস, ব্যাগের মধ্যে সর্বদাই টয়লেট-পেপার রাখি। তাই নিজের বেলায় তবু যা হোক চলবে,—কিন্তু ওদের কী হবে?—এই ঘোর স্বাস্থ্যচিন্তা মাথায় ঢুকে গেল বলে, বেরুবার সময়েও ঠকাস করে মাথাটা আরেকবার ঠুকে গেল চৌকাঠে।
একই সন্ধ্যায় দুবার ভয় পেয়েছি। একবার সাম্প্রং গুম্ফার তান্ত্রিক দেবদেবীদের সাহচর্যে রাত্রিযাপনের সম্ভাবনায়, আর একবার এই দরজা খুলে গভীর শূন্যের মধ্যে পা ফেলে। পুরো ট্রিপটায় এ ছাড়া আর ভয় পাওয়ার স্মৃতি নেই
ভোজ কয় যাহারে
কারমো খানা রেডি করে ফেলেছিল ওই সময়টুকুর মধ্যে। পা, ঝ্যান, চা এবং রক্শি।
পা হল একরকমের ঝোল, তাতে কলমীর মতন একরকম শাক আছে, চমরীর চর্বি আছে (ওরা বলে চুপি), চমরীর ঘি এবং মাঠা দিয়ে তৈরি। তাতে নুন-লঙ্কা দেওয়া, বেশ সুস্বাদু। আর ভাত-রুটির বদলে ওরা ঝ্যান বলে একটা বস্তু খায়। পেম্পা বলল, ওটা কদুসেদ্ধ’। নমক-চা, আর রশি মদ দুটি সামুভার জাতীয় পাত্রে উনুনের ওপরে চড়ানো আছে। কাপে ঢেলে দেবার সময়ে গিন্নি গরম রকশিতে ফেটানো কাঁচা ডিম গুলে দিচ্ছে, রশির রং হয়ে যাচ্ছে হলদে-সাদা। খেতে খানিক এগের মতো, খানিক ব্র্যান্ডির মতো। স্বাদটি ভাল।
—”ধান, কদ্দু আর গেঁহু” দিয়ে তৈরি হয় রকশি—লামারা খায় না। একেবারে বাচ্চারাও খায় না। কিন্তু মায়েরা সবাই খায়। মা-ই ঘরে রশি বানিয়ে রাখে। ছাংও। সিং ছাং ধান আর কদ্দু দিয়ে তৈরি, ওতে গেঁহু নেই। সুভাষবাবু বলেছিলেন ফিল্টার্ড বিয়ারের মতন। আমি সিং ছাং খেয়ে অতশত বুঝিনি। বিয়ার চিরতার মতো, তেতো জিনিস, খেতে একটুও ভাল নয়। সিং ছাং তো তেতো নয়। তবে কেন বিয়ার, তা কে জানে?
রক্শি, চা, পা, ঝ্যান খেয়ে বেশ পেট ভরল। খাবার পরে আগুনের ধারে আড্ডা বসল। কথা বলছে একা লামাই। ভাষা না জানায় কারমো কথা বলতে পারছে না। ছোট মেয়ে উড়াকিন খামো অসম্ভব মিষ্টি, ঠিক জাপানি পুতুলের মতন দেখতে। চুল চিনেছাঁটে কাটা, দুটি গাল দুটি আপেল, মা-দিদিদের মতোই পোশাক পরা। খুব হাসে। খাবার সময়ে প্রচণ্ড মোটকা এক ছাইরঙা গম্ভীর বেড়াল এসে সভাপতির মতো আসন গ্রহণ করলেন। তাঁর নাম শিম্পু। শিম্পুর ঘরে ঢোকা বারণ নেই, কিন্তু চৌকাঠের বাইরে আরেকজন যিনি এসে বসলেন এবং বেঁটে লেজ ঘন ঘন নাড়তে লাগলেন, তাঁর—”ঘরমে ঘুস্না মনা হ্যয়।”—তিনি এক ভুটিয়া কুকুর, লোমে চোখ ঢাকা, তাঁর নাম চট্ট। দুজনেই ধূসর, দুজনেই খুব মোটাসোটা, আর মিষ্টি। তবে শিম্পুর মতো পায়াভারী নয়। ঘরে ঢুকতে না পেয়ে সে একটু জাতে নিচু হয়ে আছে। তার সঙ্গে জলচল নেই।
কথায় কথায় টের পেলুম, যে মোম্পাদের মধ্যে জাতিভেদটা খুব প্রবল মোট ছ’টা জাত আছে। মোম্পাদের মধ্যে বানিয়া জাতি নেই, আর ক্ষত্রিয় জাতি নেই। ক্ষেতিকাম করনেওয়ালা জাতি আছে, পেন্টিং করনেওয়ালা অর্থাৎ তাংখা বানানেওয়ালা জাতিও আছে, তবে তাওয়াং এরিয়াতে অনেক রকম জাতি নেই, ৩-৪ রকমই আছে। আর তিব্বতে? মূর্তি বানানেওয়ালা জাতি, কিতাব বানানেওয়ালা জাতি—আরও কত জাতি আছে। লামাদের মধ্যেও জাত আছে, “পাক্কা লামারা” একজাত, যারা বিয়ে থা করে না ব্রহ্মচর্য নিয়ে গুম্ফায় বাস করে, আর “ফ্যামিলি-লামা” আরেক জাত, যারা গ্রামের গুম্ফা চালায়, কিন্তু সংসারেই থাকে। অন্য অন্য জাতের লোকেরাও লামা হয়ে যেতে পারে, তবে যারা সবচেয়ে নিচু জাত,—কসাই, আর লোহার, এরা ছাড়া। যারা জুতো বানায়, আর যারা মাটির জিনিস বানায় তারাও সব নিচু নিচু জাত, কিন্তু জলচল; এরা অস্পৃশ্য নয়। লামা হতে ওদের বাধা নেই। কিন্তু ইয়াপ আর শোইপা, যারা লোহার অস্ত্র বানায়, ঘোড়ার নাল বসায়, আর যারা মিট কাটনেওয়ালা, তারা মোম্পাদের সমাজে মিশতে পায় না। আলাদা একটা পাড়া তৈরি করে থাকে। অর্থাৎ ghetto ব্যবস্থা আছে। এদের সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি চলে না। ওরাও অবশ্য তিব্বতিই, তবে, “ও তো অলগ্ তিব্বতিলোগ, মোম্পা নেহি।” মোম্পারা ওদের সঙ্গে ওঠবস করে না, ঘরে এলে, চা খেতে দেয় না। যদি বা দেয় কখনও, তবে সেই কাপ আর নিজেরা ব্যবহার করে না। দু-তিন হপ্তা বাইরে ফেলে রাখে, তার পরে ওর মধ্যে ধূপ জ্বালিয়ে শোধন করে নেয়। অসবর্ণ বিয়ে চলে না। করলে জাতিভ্রষ্ট, সমাজচ্যুত এবং গ্রামছাড়া হতে হয়।
তবে হ্যাঁ, এরা অন্যজাতি বটে, কিন্তু এদের সঙ্গে কোনও শত্রুতা নাই মোম্পাদের। শত্রুতা কেবল খাম্পাদের সঙ্গে। তারা আরেকটা বুনো পাহাড়ি উপজাতি। তিব্বত থেকে লামারা ওদের পাঠাত খাজনা আদায় করতে। মোম্পারা শান্ত জাতি। খাম্পারা নির্দয়, উদ্দাম। ওরা তিব্বতি লামাদের চাকর হয়ে এখানে এসে খাজনা আদায়ের নামে যা নয় তাই করত, অত্যাচারের সীমা থাকত না। মারপিট তো আছেই, মেয়েদেরও কেড়ে নিয়ে যেত। সোনা, শস্য সবই নিয়ে যেত। মোম্পা জাতি তো চিরকাল এমন গরিব গরিব ছিল না। খাম্পারাই সব কেড়ে নিয়েছে।
এই সাম্প্সং গুম্ফা কি আজকের? চারশো বছরের পুরনো। যেমন ‘মেরা লামা’ বলে একজন তাওয়াং গুম্ফা বানিয়েছেন, তেমনি ‘লামা জাং’ সাম্প্ৰং গুম্ফা বানিয়েছেন। পেম্পা গে বংশানুক্রমে এই গুম্ফার পূজারী। সাম্প্রং-এ আগে মিঠা জল ছিল না।
ছিল আদমি-খানেওয়ালা এক ঝিল। সে বড় ভয়ানক ঝিল। এখানে কেউ এলে বাঁচত না। তার জন্যে লামা জাং সেই ঝিল শুকিয়ে দিয়ে, খটখটে পাহাড় করে দিলেন। তারপরে নতুন জল বানালেন। নতুন ঝর্না নামালেন। বললেন—এই ঝর্নাটি যেখান দিয়ে বয়ে যাবে, সেইখানেই ক্ষেতখামার হবে, গ্রাম-ঘর হবে, মানুষ-জন হবে, পুজো-আচ্চা হবে।
লামা পেম্পা গে মনের সুখে নমক্-চা খেতে খেতে গল্প করছে, তার বউ আর আমি খাচ্ছি রশি। আমার এ ব্যাপারটা বেশ মজার লাগছে। এমনিতে আমি মদ্য-খেকো নই। কিন্তু আজ এখানে রশি খেতে খুবই ভাল লাগছে। কিন্তু কলকাতায় বসে অকারণে রাম-জিন-বিয়র হুইস্কি খেতে আমার প্রবৃত্তি হয় না! হ্যাঁ, খাবার আগে একটু ড্রাই শেরী কি ড্রাই ভারমুথ, খাবার সঙ্গে ঠাণ্ডা শালি কি হক্, বোজোলে, কি বারগান্ডি, খাবার পরে এক ফোঁটা কুয়ানেত্রা কি কনিয়াক্, ড্রামবুয়ী কি ব্রেম দ্য মঁন্থ। এতে মোটেই আপত্তি নেই! বিদেশের পরিবেশে এটা খুব মানানসই। কিন্তু দেশে তো তা নয়। কলকাতা শহরে অনেক লোকই মদ খায় দেখি মাতাল হবারই জন্য। সেইজন্যই বোধ হয় বাঙালির কাছে খাদ্যের বেলায় স্বাদ যতটা জরুরি, পানীয়ের বেলায় আর আস্বাদনটা তেমন জরুরি থাকে না। কেন থাকে না? যেহেতু গোটা মদ্যপান ব্যাপারটাই বাঙালির জীবনে নিষিদ্ধ ফলের মতো— ছাপোষা বাঙালি গৃহস্থ-সংস্কৃতির বহির্ভূত ও মধ্যবিত্ত সামাজিক সংস্কারের বিরোধী উটকো ব্যাপার হয়তো সেই কারণেই আমাদের ঘরে ব্যাপারটা এমনধারা খাপছাড়া, এত শ্রীহীন, যেমন-তেমন। আর এত সর্বনেশেও।
এখানে কিন্তু ব্যাপারটা আলাদা। মানানসই। খুব ভাল লাগছে, যেহেতু এটা প্রাত্যহিক সংসার জীবনের অঙ্গ। এই পরিবেশের সঙ্গে এটা চমৎকার স্বাভাবিক। আমি সাঁওতালদের মধ্যে এরকম ভাবে কখনও যাইনি, গেলে নিশ্চয়ই মহুয়া খেতুম, হাঁড়িয়া খেতুম। কলকাতার ড্রইংরুমে বসে কখনও কেরোসিন এবং লোডশেডিং অথবা পিকাসো এবং ক্রফো, কি রেগন এবং থ্যাচার গভীরভাবে আলোচনা করতে করতে, ঘামতে ঘামতে, রাম-জিন-হুইস্কি গলাধঃকরণ, নাঃ মশাই— থ্যাংকিউ, ওতে আমার রুচি হয় না।
দ্রৌপদীর দেশ
হঠাৎ শুনি পেম্পা বলছে—
—”আমার বউ খুব ভাল মেয়ে। ওর আরও বিয়ে হতে পারত। ওর দুই বোনের একজনের দুটি স্বামী, আরেকজনের তিনটি। তবে লামাকে শাদি করেছে বলে, কারমো আর শাদি করেনি।”
–“কী বললেন? দুটি-তিনটি স্বামী?”
–“ইন্ডিয়ার মতো নয় তো এখানে, মোম্পা মেয়েরাও অনেক শাদি করতে পারে। পুরুষরাও পারে।”
–“মেয়েরা অনেক শাদি করলে শ্বশুর ঘর করতে কোথায় যায়?”
—”যায় না। স্বামীরাই আসে বউয়ের বাড়িতে। দুই স্বামীতে মিলে-মিশে থাকে, ভাই ভায়ের মতন। জমি-জমা দ্যাখে, চমরী-বরি দ্যাখে।”
—”বাচ্চা হলে? কার বাচ্চা কেমন করে জানবে?”
—”প্রথম স্বামীর নামেই সব বাচ্চা। ভাইয়ে ভাইয়ে অনেক সময়ে একটাই বউ বিয়ে করে, পয়সা কম থাকলে। বড় ভাইয়ের নামে সব বাচ্চা। অনেক সময়ে যদি দ্যাখে বউয়ের বাচ্চা হচ্ছে না, অনেক জমি-জমা, ভেড়া-ঘোড়া, চওঁরী-বক্রি আছে, তখন স্বামীই বউয়ের আরেকটা বিয়ে দিয়ে আরেকটা বরকে নিয়ে আসে, বউয়ের যাতে বাচ্চা হয়। সে-বাচ্চাও বড় স্বামীর নামে। কখনও বা নিজেই আরেকটা বউ নিয়ে আসে। যদি বড়লোক হয়। দুই বউতে মিলাপ হুয়া, তো ঠিক হ্যায়। নেহি হুয়া তো ডাইবোর্স হোতা হ্যায়, কেস হোতা, ফাইন দেনা পড়তা। বউয়ের বেলাও হতে পারে, বরের বেলাও। যে বড়লোক সে অন্যকে খোরপোষ দেবে। যার দোষ, সে ফাইন দেবে। গ্রাম পঞ্চায়েৎ আছে। গাঁওবুঢ়া আছে। সেই সব ঠিক করে দেয়। যে বরটি বউকে ফেলে, কি বরকে ফেলে যে বউটি পালিয়ে যাবে, তার সম্পত্তি তার জন্যে রেখে বাকিটা তার বউ-বাচ্চা কি বর-বাচ্চাদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হবে। ত্যাগ করে যাওয়া মহা পাপ।
আজকাল খুব প্যার-কা চল্ হুয়া। প্যার করে যদি শাদি হয়, ঠিক আছে, তাতে খরচা অনেক কম। আর যদি নিয়মমাফিক শাদি হয়, তাতে অনেক খরচ। মেয়েকে পণ দিতে হয় বরের বাড়ি থেকে। দুশো থেকে, আটশো টাকা পর্যন্ত চাইতে পারে। প্রথমেই ৫-৬ বারে খাদা আর ৫-৬ বোতল রক্শি ভেট দিতে হবে। পরে যদি মেয়েপক্ষ রাজি হয়, তবে বিয়ে পাকা হলে খুব খাওয়াদাওয়া হবে, নাচ গান হবে, বিয়েও হয়ে যাবে। রক্শি খাওয়া হবে খুব।”
—”মেয়েরাই টাকা পায়?”
—”হ্যাঁ, মেয়েরাই তো বেশি খাটে। ওদেরই তো জেয়াদা ভাও? তবে যে-বাবা-মার ছেলে নেই, সে কখনও হয়তো শখ করে পয়সা দিয়ে ছেলে নিয়ে যাবে। এমনিতে মেয়েদেরই বাবা-মা ছেলেদের কাছ থেকে পণ নেয়।”
—”সম্পত্তি কি মেয়েরাই পায়?”
—”ছেলে মেয়ে দুজনেই পায়। বাবা-মা দুজনেরই তো সম্পত্তি আছে।”
—”একাধিক স্বামীর বাচ্চারা? কে কারটা পায়?”
—”কেন? সব বাচ্চারাই সব বাবাদের সম্পত্তির ভাগ পাবে। এতে আর মুশকিল কী?”
—”কীরকম বয়সে বিয়ে হয়?”
–“মেয়েদের পনেরো থেকে বিশ কি চল্লিশ, ছেলেদেরও ওই ষোলো থেকে পঁচিশ কি চল্লিশ।”
‘বিশ কি চল্লিশ’টা এক নিশ্বাসে এমন করে আগে কখনও শুনিনি। শুনে মনে যারপরনাই ভরসা পেলুম। যাক, তা হলে কিছু আশা আছে! (অন্তত মোম্পাদের দেশে!)
বিয়ে হতে দেরি করলে কখনও কখনও বিয়ে না হয়েও বাচ্চা হয়ে যায়। তাতে লড়কি কো শরম হোতা হ্যায়।
–“আর ছেলেদের?”
—”ছেলেদের লজ্জা কীসের?”—লামা অবাক হয়ে যায়। তার বিস্ময় দেখে আমিও কী বলব ভেবে পাই না। সত্যিই তো। বাচ্চা তো মেয়েটারই হচ্ছে! ছেলের তাতে কী!
—”তা, লজ্জা হবার পর সে মেয়ে কী করে?”
—”মাফি মাঙ্ লেতা। ব্যস্! সব ঠিকঠাক! তারপর ওর আবার বিয়ে হয়। যে ওকে বিয়ে করে, সেই বাচ্চার বাবা হয়ে যায়। তার সম্পত্তি ওই বাচ্চাকে দেয়।”
কী সহজ ভাবেই পেম্পা বলে!
আহা এই মোম্পাদের মতো লজিকাল যদি আমরা হতুম?
—”স্বামী মারা গেলে স্ত্রী কী করে?”
—”আবার বিয়ে করে। প্রথম স্বামীর বাচ্চারাই প্রথম স্বামীর সম্পত্তি পায়। পরের পক্ষের বাচ্চারা সেটা পাবে না।”
—”আর বউ মারা গেলে? স্বামী?”
—”ওই একই। পারলে করে। তবে, বড়লোক না হলে বিয়ে করে না বড় একটা। খরচা আছে তো?”
—”বড়লোক কারা?”
—”যাদের সত্তর-আশিটা চওঁরী আছে। কারুর হয়তো একশো-দুশোটা ভেড়া আছে, চল্লিশ-পঞ্চাশটা বকরি আছে। তারা বড়লোক।”
—”যার সাত-আটটা চওঁরী, দশ-বারোটা ভেড়া, দুটো-তিনটে বকরি আছে?”
সেও বড়লোক। না, সে মাঝারি। আগে দুশো টাকায় চওঁরী মিলত, এখন চোদ্দোশো। আগে ত্রিশ-চল্লিশ টাকায় ভেড়া মিলত, এখন দুশো। বকরিও তাই। লোকের থাকবে কী করে বেশি বেশি? দুটো একটা করেই থাকে। আর ভৈস-চওঁরী মিশ্রণে যে চওঁরী, শ্রেষ্ঠ দুধ সেই দেয়, তার দাম আড়াই হাজার।”
—”এসব দেখাশোনা করে কারা?”
—”গোরু ভেড়া চরানোর কাজটা বাচ্চারাই করে, আর পুরুষরাও করে। পুরুষরা বাঁশ কাটে, তক্তা চেরে। ব্যস্। আর কী? রকশি খায়। তামাক খায়। উল বোনে।”
—”বাকি সব কাজই মেয়েরা করে?”
—”হ্যাঁ, ক্ষেতির কাজ বলো, তাঁত চালিয়ে থান কাপড়া বানানা বলো, দুধ দোয়ানো, ঘি বানানো, ওদিকে ছাং বানানা, রক্শি বানানা, খানা পকানা।–আম্মার কি কাজের শেষ আছে? তাই আম্মাদেরই জন্যে পণ দিতে হয়। ওরাই তো সব।”
তবে জাতের কাজ যেটা, সেটা পুরুষরাই করে। যেমন তাংখা আঁকা, মাটির পাত্র গড়া, কি চামড়ার জিনিস কি কাঠের পাত্র কি লোহার জিনিস তৈরি করা, কি জন্তু মেরে মাংস কাটা—এসব কাজ পুরুষের।
ঘরের ভেতর ঘর
গল্প করছি যে ঘরে বসে, সেটা বেশ বড় একটা হলঘর। দরজা একটাই। কোনও জানলা নেই। ঢুকেই উলটোদিকে ঘরের মাঝখানে ফায়ার প্লেসে অর্থাৎ উনুনে আগুন জ্বলছে। একটা কুপিও জ্বলছে। দেখলুম কয়েকটি মোমবাতিও রয়েছে মোটা মোটা। জ্বলছে না। আমার জন্য একটা হ্যাজাক জ্বালান হল। মুহূর্তেই ঘর দিনের আলোর মতো উজ্জ্বল। ফায়ার প্লেস মানে মাটির উনুনে কাঠের আঁচ। তার সামনে ভুট্টার মালা শুকোচ্ছে। উনুনে বসানো থাকে তিনটে পাত্র। পেতলের গাড়ুর মতো চেহারা, গরম জলেরটা সবচেয়ে বড়, চায়েরটা মেজো, রশিরটা ছোট। ফায়ার প্লেসের মাথায় তাক রয়েছে ম্যান্টলপিসের মতন—তাতে ঝকঝকে পেতল আর তামার বড় বড় বাসন–ডেকচি, কড়াই, ড্রাম, হাতা, সসপ্যান সাজানো। সামনেই একটি ঝাঁটা। একধারে বিরাট চান্দুং, সেই মাখন চা তৈরির তিব্বতি যন্ত্রটা,—কালো রং করা কাঠের ওপর তামার আর পেতলের পাত, আর পুঁতি বসানো—যেটা সুভাষবাবু আমাকে কিনতে দেননি। (ভালই করেছেন!) দুধারে দুটি পেতলের আংটা লাগানো। উনুনের উলটোদিকে দুটি বড় গোল লোহার ড্রাম আছে তার ওপরে কাঠের ঢাকনা, ঠিক টেবিলের মতো দেখায়। ড্রামগুলোর নাম থিরপো, পেতলের বিরাট হাতা করে (যাদের ঠিক সসপ্যানের মতো দেখতে) মগের মতো ডুবিয়ে সেই জল তুলতে হয়। সেই জল গরম করে, অন্যান্য কাজে ব্যবহার করে, রান্না করে। আর কোথাও কোনও জল নেই। সব জল ভরা থাকে ঘরেই। একটি ঘরের মধ্যেই সব কিছু। ঘরটির মধ্যে তাঁবু-তাঁবু একটা ভাব আছে। দেয়াল ঘেঁষে বড় বড় সিন্দুক রাখা। ভেতরে ঢুকেই দরজার পাশ দিয়ে কালো রং করা কাঠের সিঁড়ি উঠেছে দেড়তলার ঘরে।
কিন্তু পেম্পা খাণ্ডুর বাড়িতে ওই ঘরটি পুজোর ঘর নয়, ভাঁড়ার। যেহেতু ওদের তো আস্ত গুম্ফাই রয়েছে! একটা মাচাও আছে এ ঘরের মধ্যে। তাতে মালপত্র তোলা রয়েছে।
আড্ডা মেরে শুতে শুতে ৯টা বেজে গেল। ওরা সাধারণত সাতটার মধ্যে খেয়ে নেয়, আটটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে। ভোরে সূর্যের সঙ্গে সঙ্গে, পাঁচটা না বাজতেই উঠে পড়ে। ছোট মেয়েটিও শোয়নি—সবাই মিলে আমায় ঘিরে বসে আছে, কিছুই তো বুঝছে না, কথাও বলছে না। তবে হাসে খুব। আর হাসিই কথা বলে।
শোয়াটা খুব মজার। দেয়ালের ধারের বড় বড় বাক্সগুলো থেকে বড় বড় কুশন বেরুল, আর মোটা মোটা কম্বল, এবং খুব দামি দামি কার্পেট। কয়েকটা কুশন পেতে, তার ওপরে হাজার তিনেক দামের একটা কার্পেট বিছিয়ে, কম্বল মুড়ি দিয়ে চমৎকার শুয়ে পড়লুম। ওভারকোটটা গুটিয়ে বালিশের মতন মাথার নীচে গুঁজে নিলুম। সব আলোগুলো নিবে গেছে। সারা ঘর এখন অন্ধকার। দরজা বন্ধ। নিবিয়ে দেওয়া অগ্নিকুণ্ডের ঘরময় একটা চাপা লালচে আভা দপদপ করছে। পোড়াকাঠের শব্দ হচ্ছে, ফুটফাট। নিশ্বাসের শব্দ। বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়ল বোধ হয়। এরা যে যেমন পোশাক পরে ছিল, তেমনিই শুয়ে পড়ল। আমিও দেখাদেখি তাই করি। তাওয়াং-এও তো তাইই চলছিল। জুতোটুকু খুলে রেখে, ট্রেনের মতন, কাপড় না বদলেই শুয়ে পড়া।