ট্যাঁপার অভিজ্ঞতা

ট্যাঁপার অভিজ্ঞতা

অনেক দিন আগের ঘটনা, লিখেওছিলাম এ বিষয়ে সে সময়ে, তবে তার কাগজপত্র হারিয়ে গেছে। সত্যি না বানানো যদি জানতে চান তাহলে বলি, যে গল্প শুনবে তার অত খবরের কী দরকার? তার কাছে যে ঘটনা বানানো আর যে ঘটনা কোন কালে চুকেবুকে গেছে, তাতে কী তফাত? ব্যাপারটা শুনুন তো আগে।

আজকের আধ-বুড়োদের নিশ্চয় মনে আছে যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় বোমার ভয়ে সবাই কলকাতা ছেড়ে পালিয়ে নানান অস্বাস্থ্যকর আর বিপদসঙ্কুল জায়গায় গিয়ে নিরাপত্তা খুঁজেছিল। সেই সময়ে আমার এক খুড়োর বাড়ির সকলে ঠিক করলেন মাস ৬-৭-এর জন্য কার্সিয়াং গেলে ভালো হয়। সেখানে একটা ছোট বাড়ি খুব সস্তায় পাওয়া যাচ্ছিল। স্বাস্থ্যকর জায়গা; চমৎকার দৃশ্যবলী। তা বড় পিসিমা কিছুতেই অদেখা বাড়িতে যাবেন না, তাই তাঁর নাতি ট্যাঁপাকে পাঠানো হল একবার সে দেখে আসবে।

ট্যাঁপাকে পায় কে! ছোট একটা সুটকেসে গরম কাপড়চোপড় আর একটা মোটা কম্বল পুরে সে তো রওনা দিল। বড় বাজারে মালিকের অফিস থেকে চাবি নিতে গিয়ে শুনল, চাবির দরকার নেই, বাড়ি খোলা, তোষক বালিশ মায় বাসনপত্র সব আছে। বললেই চৌকিদার সব খুলে দেবে, তাকে পোস্টকার্ড দেওয়া হয়েছে।

যথা সময়ে ট্রেন থেকে নেমে, সুটকেসটা কাঁধে করে ডাও-হিল রোড দিয়ে ট্যাঁপা চলল। চমৎকার জায়গা, সাপের মতো এঁকেবেঁকে পথ উঠেছে, বাঁকে বাঁকে খুদে দোকান আছে, সেখানে পান বিড়ি দেশলাই কেরোসিন চাল ডাল আলু নুন সব পাওয়া যায়।

অর্ধেক পথ উঠে ডান হাতে ছোট্ট রাস্তা বেরিয়েছে। একটা মোড় নিয়েই ছবির মতো সুন্দর ছোট্ট বাড়ি। এ অঞ্চলে ঐ একটাই বাড়ি। লাল টিনের ছাদ, সবুজ দরজা-জানলা। লাল রঙের কাঠের গেট। সেটি ক্যাঁচ করে খুলে, ভেতরে গিয়ে ট্যাপা “চৌকিদার! চৌকিদার!” করে মেলা হাঁকডাক করেও যখন সাড়া পেল না, তখন নিজেই সামনের কাচের দরজাটি ঠেলে ভেতরে ঢুকল।

লম্বা হলঘর, নারকেলের ছোবড়ার ম্যাটিং পাতা। সোফা চেয়ার টেবিল, মায় ছাতা-টুপি রাখার একটা আয়না দেওয়া র‍্যাক পর্যন্ত রয়েছে। শোবার ঘরের সুইচ টিপে দেখল আলো জ্বলছে, চানের ঘরে কল খুলতেই জল এল। খাসা বাড়ি। এখানে ৬-৭ মাস আরামে কাটানো যাবে। কাল সকালেই ফিরে যাবে। সঙ্গে দু’বেলার জন্য প্রচুর খাবার।

ঠিক সেই সময় চারিদিক ঝেঁপে বৃষ্টি এল। পাহাড়ে যেমন হয়, সঙ্গে সঙ্গে ঘন কুয়াশায় আকাশ, পাহাড়, উপত্যকা সব লেপেপুঁছে একাকার হয়ে গেল। দিন না রাত কারো বুঝবার জো রইল না। এমন সময় দরজায় কে ধাক্কা দিল।

দরজা খুলে ট্যাঁপা দেখে এক রোগা ফিরিঙ্গি বুড়ো, হাতে একটা ছোট ব্রিফকেস, ভিজে চুপ্পুড়। কোথায় আছাড় খেয়েছে, প্যান্টের হাঁটুতে শ্যাওলা আর কাদা লাগা, গাল-বসা, ফ্যাকাশে মুখ। শীতে ঠক ঠক করে কাঁপছে। দাঁতে দাঁত-কপাটি লাগছে।

সাহেব বলল, “ভিতরে আসতে পারি কি?”

ট্যাঁপা বলল, “নিশ্চয়, নিশ্চয়, এমন দিনে কেউ কুকুর বেড়ালকেও ফিরিয়ে দেয় না। এসো। ভিজে কাপড়চোপড় ছেড়ে আমার গরম পাজামা সুট পরো। চা আছে, খাও।”

শোবার ঘরের দুটি খাটে বিছানা পাতা, একটি করে কম্বল। সাহেব চা খেয়ে বিছানায় ঢুকবার আগে ব্রিফকেস খুলে রাশি রাশি একশো টাকার নোট বের করে ম্যাটিং-এর উপর শুকোতে দিল। দুটো কম্বলেও তার শীত যায় না দেখে, ট্যাঁপা তার সাধের গরম জলের ব্যাগটি পর্যন্ত তার পায়ের কাছে ঠুসে দিল।

তারপর খাবারদাবার খেয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে, নিজেও অন্য খাটে শুয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম। তিন দিন ছিল প্রবল বৃষ্টি। খাবারদাবার শেষ। রান্নাঘরে পুরনো প্রাইমাস স্টোভ ছিল, ছেঁড়া একটা ছাতাও ছিল। ট্যাঁপা মোড়ের দোকান থেকে চাল ডাল আলু পেঁয়াজ তেল এনে, স্টোভ ধরাতে গিয়ে বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় আর কী! ছাদ অবধি আগুন উঠল। সাহেব দৌড়ে এসে, তারি মধ্যে হাত ঢুকিয়ে কলটা খুলে, আগুন কমাল। বড় ভালো মানুষটা। জ্বর গা, কিছু খেল না, শুধু চা আর কনডেন্সড মিল্ক। নোটগুলো সম্বন্ধে বললও না কিছু। শুকোলে আবার ব্রিফকেসে ভরে রাখল। তৃতীয় দিন সকালে রোদ এসে ঘর ভরে দিল, আকাশ ঘন নীল, মেঘের চিহ্ন নেই। ট্যাঁপা তার জিনিসপত্র গুছিয়ে সায়েবের কাছে বিদায় নিয়ে স্টেশনের দিকে চলে গেল। বলা বাহুল্য কলকাতায় ফিরে শুনল তার দেরি দেখে ইতিমধ্যে ঘাটশীলা যাওয়া ঠিক হয়ে গেছে। জিনিসপত্র নিয়ে বড় পিসিমারা আগের দিন রওনা হয়েও গেছেন। মনটা খারাপ হয়ে গেল।

এরপর ১৫ বছর কেটে গেল। ট্যাঁপা তখন দস্তুর মতো সংসারী। হঠাৎ এক পুজোর ছুটিতে কার্সিয়াং যাবে ঠিক করল। খুব সহজেই সেই বাড়িটাই পাওয়া গেল। এবার ট্যাঁপা নিজেই উদ্যোগী হয়ে আগে গেল বাড়ির অবস্থা দেখে আসতে। এবার সঙ্গের সুটকেস স্টেশন মাস্টারের জিম্মায় রেখে, খালি হাতে বাড়ি দেখতে গেল। সেদিন বিকেলেই ফেরার ইচ্ছে।

সেই বাড়ি; সেই একটু ঝুলেপড়া পাকা গেট ক্যাঁচ্ করে খুলে গেল। সেদিনও চৌকিদার এল না; কিন্তু সদর দরজা খুলে গেল; আলো জ্বলল, কলে জল এল। আর সেই ১৫ বছর আগের মতো চারদিক অন্ধকার করে, আকাশ পাহাড় উপত্যকা লেপেপুঁছে বৃষ্টি নামল।

তারি মধ্যে সদর দরজায় কে ধাক্কা দিল, মনে হল ঘড়ির কাঁটা ১৫ বছর ফিরে গেছে। দরজা খুলেই ট্যাঁপা দেখল এক রোগা ফিরিঙ্গি বুড়ো, হাতে ছোট ব্রিফকেস, ভিজে চুপ্পুড়। কোথায় আছাড় খেয়েছে, প্যান্টের হাঁটুতে শ্যাওলা আর কাদা। ঠক ঠক করে কঁপছে, দাঁতে দাঁত-কপাটি লাগছে। গাল-বসা ফ্যাকাশে মুখ।

সাহেব বলল, “ভিতরে আসতে পারি কি?” ট্যাঁপা দরজাটা হাঁ করে খুলে দিয়ে, সাহেবের পাশ কাটিয়ে, সেই জল ঝড় মাথায় করে, এলোপাথাড়ি পাহাড়ের পথ ধরে স্টেশনের দিকে ছুট দিল। ফিরেও দেখল না সাহেব কী করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *