টোপ – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

টোপ – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

সকালে একটা পার্সেল এসে পৌঁছেছে। খুলে দেখি, একজোড়া জুতো।

না, শত্রুপক্ষের কাজ নয় । একজোড়া পুরোন ছেঁড়া জুতো পাঠিয়ে আমার সঙ্গে রসিকতার চেষ্টাও করে নি কেউ। চমৎকার ঝকঝকে বাঘের চামড়ার নতুন চটি। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়, পায়ে দিতে লজ্জা বোধ হয় দস্তুরমত। ইচ্ছে করে বিছানায় শুইয়ে রাখি।

কিন্তু জুতোজোড়া পাঠাল কে ? কোথাও অর্ডার দিয়েছিলাম বলেও তো মনে পড়ছে না। আর বন্ধুদের সব কটাকেই তো চিনি, বিনামূল্যে এমন একজোড়া জুতো পাঠাবার মত দরাজ মেজাজ এবং ট্যাঁক কারো আছে বলেও জানি না। তাহলে ব্যাপারটা কী ?

খুব আশ্চর্য হব কিনা ভাবছি, এমন সময় একখানা সবুজ রঙের কার্ড চোখে পড়ল। উইথ বেস্ট কমপ্লিমেন্টস অব রাজাবাহাদুর এন আর চৌধুরী, রামগঙ্গা এস্টেট।

আর তখনি মনে পড়ে গেল। মনে পড়ল আট মাস আগেকার এক আরণ্যক ইতিহাস, একটি বিচিত্র শিকার-কাহিনী।

রাজাবাহাদুরের সঙ্গে আলাপের ইতিহাসটা ঘোলাটে, সূত্রগুলো এলোমেলো। যতদূর মনে হয়, আমার এক সহপাঠী তাঁর এস্টেটে চাকরি করত। তারই যোগাযোগে রাজাবাহাদুরের এক জন্মবাসরে আমি একটা কাব্য সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেছিলাম। ঈশ্বর গুপ্তের অনুপ্রাস চুরি করে যে প্রশস্তি রচনা করেছিলাম, তার দুটো একটা লাইন এই রকম :

ত্রিভুবন প্রভাকর ওহে প্রভাকর

গুণবান মহীয়ান হে রাজেন্দ্রবর।

ভূতলে অতুল কীর্তি রামচন্দ্র সম—

অরাতিদমন ওহে তুমি নিরূপম।

কাব্যচর্চার ফলাফল হল একেবারে নগদ নগদ। পড়েছি—আকবরের সভাসদ আবদুর রহিম খানখানাম হিন্দী-কবি গঙ্গের চার লাইন কবিতা শুনে চার লক্ষ টাকা পুরস্কার দিয়েছিলেন। দেখলাম, সে নবাবী মেজাজের ঐতিহ্যটা গুণবান মহীয়ান অরাতিদমন মহারাজ এখনো বজায় রেখেছেন। আমার মত দীনাতিদীনের ওপরেও রাজদৃষ্টি পড়ল, তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন, প্রায়ই চা খাওয়াতে লাগলেন, তারপর সামান্য একটা উপলক্ষ করে দামী একটা সোনার হাতঘড়ি উপহার দিয়ে বসলেন এক সময়ে। সেই থেকে রাজা-বাহাদুর সম্পর্কে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ হয়ে আছি আমি। নিছক কবিতা মেলাবার জন্যে যে বিশেষণগুলো ব্যবহার করেছিলাম, এখন সেগুলোকেই মনপ্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতে শুরু করেছি।

রাজাবাহাদুরকে আমি শ্রদ্ধা করি। আর গুণগ্রাহী লোককে শ্রদ্ধা করাই তো স্বাভাবিক। বন্ধুরা বলে, মোসাহেব। কিন্তু আমি জানি ওটা নিছক গায়ের জ্বালা, আমার সৌভাগ্যে ওদের ঈর্ষা। তা আমি পরোয়া করি না। নৌকো বাঁধতে হলে বড় গাছ দেখেই বাঁধা ভাল, অন্তত ছোটখাটো ঝড়-ঝাপ্টার আঘাতে সম্পূর্ণ নিরাপদ।

তাই মাস আষ্টেক আগে রাজাবাহাদুর যখন শিকারে তাঁর সহযাত্রী হওয়ার জন্যে আমাকে নিমন্ত্রণ জানালেন, তখন তা আমি ঠেলতে পারলাম না। কলকাতার সমস্ত কাজকর্ম ফেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে বেরিয়ে পড়া গেল। তাছাড়া গোরা সৈন্যদের মাঝে মাঝে রাইফেল উঁচিয়ে শকুন মারতে দেখা ছাড়া শিকার সম্বন্ধে কোন স্পষ্ট ধারণাই নেই আমার। সেদিক থেকেও মনের ভেতরে গভীর এবং নিবিড় একটা প্রলোভন ছিল। জঙ্গলের ভেতর ছোট একটা রেল লাইনের আরো ছোট একটা স্টেশনে গাড়ি থামল। নামবার সঙ্গে সঙ্গে সোনালী তক্‌মা আঁটা ঝকঝকে পোশাক পরা আর্দালি এসে সেলাম দিল আমাকে। বললে, হুজুর, চলুন।

স্টেশনের বাইরে মেটে রাস্তায় দেখি, মস্ত একখানা গাড়ি—যার নাম রোল্‌স রয়েস, সংক্ষেপে যাকে বলে ‘রোজ’। তা রোজই বটে। মাটিতে চলল, না রাজহাঁসের মত হাওয়ায় ভেসে গেল, সেটা ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারলাম না। চামড়ার খটখটে গদি নয়, লাল মখমলের কুশন। হেলান দিতে সঙ্কোচ হয়, পাছে মাথার সস্তা নারকেল তেলের দাগ ধরে যায়। আর ববার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হয়—সমস্ত পৃথিবীটা চাকার নিচে মাটির ডেলার মত গুঁড়িয়ে যাক—আমি এখানে সুখে এবং নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়তে পারি।

হাঁসের মত ভেসে চলল ‘রোজ’। মেটে রাস্তায় চলেছে অথচ এতটুকু ঝাঁকুনি নেই। ইচ্ছে হল একবার ঘাড় বার করে দেখি, গাড়িটা ঠিক মাটি দিয়েই চলেছে, না দু-হাত ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে ওর চাকাগুলো।

পথের দু’পাশে তখন নতুন একটা জগতের ছবি। সবুজ শালবনের আড়ালে আড়ালে চা-বাগানের বিস্তার, চকচকে উজ্জ্বল পাতার শান্ত, শ্যামল সমুদ্র। দূরে আকাশের গায়ে কালো পাহাড়ের রেখা।

ক্রমশ চা-বাগান শেষ হয়ে এল, পথের দুপাশে ঘন হয়ে দেখা দিতে লাগল অবিচ্ছিন্ন শালবন। একজন আর্দালি জানাল, হুজুর, ফরেস্ট এসে পড়েছে।

ফরেস্টই বটে ! পথের ওপর সূর্যের আলো সরে গেছে, এখন শুধু শান্ত আর বিষয় ছায়া। রাত্রির শিশির এখনও ভিজিয়ে রেখেছে পথটাকে। ‘রোজে’র নিঃশব্দ চাকার নিচে মড়মড় করে সাড়া তুলছে শুকননা শালের পাতা। বাতাসে গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টির মত শালের ফুল ঝরে পড়ছে পথের পাশে, উড়ে আসছে গায়ে। কোথা থেকে চকিতের জন্যে ময়ূরের তীক্ষ্ন চিৎকার ভেসে এল। দু’পাশে নিবিড় শালের বন, কোথাও কোথাও ভেতর দিয়ে খানিকটা খানিকটা দৃষ্টি চলে, কখনো কখনো বুনো ঝোপে আচ্ছন্ন। মাঝে মাঝে এক এক টুকরো কাঠের গায়ে লেখা ১৯৩৫, ১৯৪০। মানুষ বনকে শুধু উচ্ছন্ন করতে চায় না, তাকে বাড়াতেও চায়। এই সব প্লটে বিভিন্ন সময়ে নতুন করে শালের চারা রোপণ করা হয়েছে, এ তারই নির্দেশ।

বনের রূপ দেখতে দেখতে চলেছি। মাঝে মাঝে ভয়ও যে না করছিল, এমন নয়। এই ঘন জঙ্গলের মধ্যে হঠাৎ যদি গাড়ির ইঞ্জিন খারাপ হয়ে যায়, আর তাক বুঝে লাফ মারে একটা বুনো জানোয়ার, তাহলে—

তাহলে পকেটের ফাউন্টেন পেনটা ছাড়া আত্মরক্ষার আর কোন অস্ত্রই সঙ্গে নেই।

শেষটায় আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞাসা করে বসলাম, হ্যাঁরে, এখানে বাঘ আছে ?

ওরা অনুকম্পার হাসি হাসল।

—হ্যাঁ, হুজুর।

—ভালুক ?

রাজা-রাজড়ার সহবৎ কাজেই যতটুকু জিজ্ঞাসা করব, ঠিক ততটুকুই উত্তর। ওরা বলল, হ্যাঁ হুজুর।

অজগর সাপ ?

জী মালিক।

প্রশ্ন করবার উৎসাহ ওই পর্যন্তই এসে থেমে গেল আমার। যে রকম দ্রুত উত্তর দিয়ে যাচ্ছে, তাতে কোন প্রশ্নই যে ‘না’ বলে আমাকে আশ্বস্ত করবে, এমন তো মনে হচ্ছে না। যতদূর মনে হচ্ছিল গরিলা, হিপোপোটেমাস, ভ্যাম্পায়ার কোন কিছু বাকী নেই এখানে। জুলু কিংবা ফিলিপিনোরও এখানে বিষাক্ত ব্যুমেরাং বাগিয়ে আছে কিনা এবং মানুষ পেলে তারা বেগুন-পোড়া করে খেতে ভালবাসে কিনা, এ জাতীয় একটা কুটিল জিজ্ঞাসাও আমার মনে জেগে উঠেছে ততক্ষণে। কিন্তু নিজেকে সামলে নিলাম।

খানিকটা আসতেই গাড়িটা ঘস ঘস করে ব্রেক কষল একটা। আমি প্রায় আর্তনাদ করে উঠলাম, কিরে, বাঘ নাকি !

আর্দালিরা মুচকি হাসল, না হুজুর, এসে পড়েছি।

ভাল করে তাকিয়ে দেখি, সত্যিই তো। এসে পড়েছি সন্দেহ নেই। পথের বাঁ দিকে ঘন শালবনের ভেতরে একটুখানি ফাঁকা জমি। সেখানে কাঠের তৈরি বাংলো প্যাটার্নের একখানি দোতলা বাড়ি। এই নিবিড় জঙ্গলের ভেতরে যেমন আকস্মিক, তেমনি অপ্রত্যাশিত।

গাড়ির শব্দে বাড়িটার ভেতর থেকে দু-তিনজন চাপরাশী বেরিয়ে এল ব্যতিব্যস্ত হয়ে। এতক্ষণ লক্ষ্য করি নি, এবার দেখলাম বাড়ির সামনে চওড়া একটা গড়খাই কাটা। লোকগুলো ধরাধরি করে মস্ত বড় একফালি কাঠ খাদটার ওপরে সাঁকোর মত বিছিয়ে দিল। তারই ওপর দিয়ে গাড়ি গিয়ে দাঁড়াল রাজাবাহাদুর এন আর চৌধুরীর হান্টিং বাংলোর সামনে।

আরে, আরে, কী সৌভাগ্য। রাজাবাহাদুর যে স্বয়ং এসে বারান্দায় দাঁড়িয়েছেন আমার অপেক্ষায়। এক গাল হেসে বললেন, আসুন, আসুন, আপনার জন্য আমি এখনো চা পর্যন্ত খাইনি।

শ্রদ্ধায় আর বিনয়ে আমার মাথা নিচু হয়ে গেল। মুখে কথা জোগাল না, শুধু বেকুবের মত কৃতার্থের হাসি হাসলাম এক গাল।

রাজাবাহাদুর বললেন, এত কষ্ট করে আপনি যে আসবেন, সে ভাবতেই পারি নি। বড় আনন্দ হল, ভারি আনন্দ হল। চলুন, চলুন, ওপরে চলুন।

এত গুণ না থাকলে কি আর রাজা হয়। একেই বলে রাজোচিত বিনয়।

রাজাবাহাদুর বললেন, আগে স্নান করে রিফ্রেশড্‌ হয়ে আসুন, টি ইজ গেটিং রেডি। বোয়, সাহাবকো গোসলখানামে লে যাও।

চল্লিশ বছরের দাড়িওয়ালা বয় নিঃসন্দেহে বাঙালী। তবু হিন্দী করে হুকুমটা দিলেন রাজাবাহাদুর, কারণ ওটা রাজকীয় দস্তুর। বয় আমাকে গোসলখানায় নিয়ে গেল।

আশ্চর্য, এই জঙ্গলের ভেতরেও এত নিখুঁত আয়োজন। এমন একটা বাথরুমে জীবনে আমি স্নান করি নি। ব্রাকেটে তিন-চারখানা সদ্য পাট ভাঙা নতুন তোয়ালে, তিনটে দামী সোপ কেসে তিন রকমের নতুন সাবান, র‍্যাকে দামী দামী তেল, লাইমজুস। অতিকায় বাধটব—ওপরে ঝাঁঝরি। নিচে টিউবওয়েল থেকে পাম্প করে এখানে ধারাস্নানের ব্যবস্থা। একেবারে রাজকীয় কারবার—কে বলবে এটা কলকাতার গ্র্যান্ড হোটেল নয়। ব্রাকেটে ধোপদুরস্ত ফরাশডাঙার ধুতি, সিল্কের লুঙ্গি, আদ্দির পাজামা। দামের দিক থেকে পাজামাটাই সস্তা মনে হল, তাই পরে নিলাম।

বয় বাইরেই দাঁড়িয়েছিল। নিয়ে গেল ড্রেসিং রুমে। ঘরজোড়া আয়না, পৃথিবীর যা কিছু প্রসাধনের জিনিস কিছু আর বাকী নেই এখানে।

ড্রেসিং রুম থেকে বেরোতে সোজা ডাক পড়ল রাজাবাহাদুরের লাউঞ্জে। রাজাবাহাদুর একখানা চেয়ারে চিৎ হয়ে শুয়ে ম্যানিলা চুরুট খাচ্ছিলেন। বললেন, আসুন, চা তৈরি।

চায়ের বর্ণনা না করাই ভাল। চা, কফি, কোকো, ওভালটিন, রুটি, মাখন, পনির, চর্বিতে জমাট ঠাণ্ডা মাংস, কলা থেকে আরম্ভ করে পিচ্‌ পর্যন্ত প্রায় দশ রকমের ফল।

সেই গন্ধমাদন থেকে যা পারি গোগ্রাসে গিলে চললাম আমি। রাজাবাহাদুর কখনো একটুকরো রুটি খেলেন, কখনো একটা ফল, অর্থাৎ কিছুই খেলেন না, শুধু পরপর কাপ তিনেক চা ছাড়া। তারপর আর একটা চুরুট ধরিয়ে বললেন, একবার জানলা দিয়ে চেয়ে দেখুন।

দেখলাম। প্রকৃতির এমন অপূর্ব রূপ জীবনে আর দেখি নি। ঠিক জানলার নিচেই মাটিটা খাড়া তিন-চারশো ফুট নেমে গেছে, বাড়িটা যেন ঝুলে আছে সেই রাক্ষুসে শূন্যতার ওপর। তলায় দেখা যাচ্ছে ঘন জঙ্গল, তার মাঝ দিয়ে পাহাড়ী নদীর একটা সঙ্কীর্ণ নীলোজ্জ্বল রেখা। যতদূর দেখা যায়, বিস্তীর্ণ অরণ্য চলেছে প্রসারিত হয়ে ; তার সীমান্তে নীল পাহাড়ের প্রহরা।

আমার মুখ দিয়ে বেরোল, চমৎকার।

রাজাবাহাদুর বললেন, রাইট। আপনারা কবি মানুষ, আপনাদের তো ভাল লাগবেই। আমারই মাঝে মাঝে কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে মশাই। কিন্তু নিচের ওই যে জঙ্গলটি দেখতে পাচ্ছেন, ওটি বড় সুবিধের জায়গা নয়। টেরাইয়ের ওয়ান অব দি ফিয়ার্সেস্ট ফরেস্টস্‌। একেবারে প্রাগৈতিহাসিক হিংস্রতার রাজত্ব।

আমি সভয়ে জঙ্গলটার দিকে তাকালাম। ওয়ান অব দি ফিয়ার্সেস্ট ! কিন্তু ভয় পাওয়ার মত কিছু তো দেখতে পাচ্ছি না। চারশো ফুট নিচে ওই অতিকায় জঙ্গলটাকে একটা নিরবচ্ছিন্ন বেঁটে গাছের ঝোপ বলে মনে হচ্ছে, নদীর রেখাটাকে দেখাচ্ছে উজ্জ্বল একখানা পাতের মত। আশ্চর্য সবুজ, আশ্চর্য সুন্দর। অফুরন্ত রোদে ঝলমল করছে অফুরন্ত প্রকৃতি—পাহাড়টা যেন গাঢ় নীল রং দিয়ে আঁকা। মনে হয়, ওপর থেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়লে ওই স্তব্ধ গভীর অরণ্য যেন আদর করে বুকে টেনে নেবে রাশি রাশি পাতার একটা নরম বিছানার ওপরে। অথচ—

আমি বললাম, ওখানেই শিকার করবেন নাকি ?

—ক্ষেপেছেন, নামব কী করে। দেখছেন তো, পেছনে চারশো ফুট খাড়া পাহাড়। আজ পর্যন্ত ওখানে কোন শিকারীর বন্দুক গিয়ে পৌঁছায় নি। তবে হ্যাঁ, ঠিক শিকার করি না বটে, আমি মাঝে মাঝে মাছ ধরি ওখান থেকে।

—মাছ ধরেন ! আমি হাঁ করলাম : মাছ ধরেন কি রকম ? ওই নদী থেকে নাকি ?

সেটা ক্রমশ প্রকাশ্য। দরকার হলে পরে দেখতে পাবেন—রাজাবাহাদুর রহস্যময় ভাবে মুখ টিপে হাসলেন ; আপাতত শিকারের আয়োজন করা যাক, কিছু না জুটলে মাছের চেষ্টাই করা যাবে। তবে ভাল টোপ ছাড়া আমার পছন্দ হয় না, আর তাতে আবার অনেক হাঙ্গাম।

—কিছু বুঝতে পারছি না।

রাজাবাহাদুর জবাব দিলেন না, শুধু হাসলেন। তারপর ম্যানিলা চরুটের খানিকটা সুগন্ধি ধোঁয়া ছড়িয়ে বললেন, আপনি রাইফেল ছুঁড়তে জানেন ?

বুঝলাম, কথাটাকে চাপা দিতে চাইছেন। সঙ্গে সঙ্গে জিহ্বাকে দমন করে ফেললাম আমি, এর পরে আর কিছু জিজ্ঞাসা করাটা সঙ্গত হবে না, শোভনও নয়। সেটা কোর্ট-ম্যানারের বিরোধী।

রাজাবাহাদুর আবার বললেন—রাইফেল ছুঁড়তে পারেন ?

বললাম, ছেলেবেলায় এয়ার গান ছুঁড়েছি।

রাজাবাহাদুর হেসে বললেন—তা বটে। আপনারা কবি মানুষ, ওসব অস্ত্রশস্ত্রের ব্যাপার আপনাদের মানায় না। আমি অবশ্য বার বছর বয়সেই রাইফেল হাতে তুলে নিয়েছিলাম। আপনি চেষ্টা করে দেখুন না, কিছু শক্ত ব্যাপার নয়।

উঠে দাঁড়ালেন রাজাবাহাদুর। ঘরের একদিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁকে অনুসরণ করে আমি দেখলাম—এ শুধু লাউঞ্জ নয়, রীতিমত একটা ন্যাচারাল মিউজিয়াম এবং অস্ত্রাগার। খাওয়ার টেবিলেই নিমগ্ন ছিলাম বলে এতক্ষণ দেখতে পাই নি, নইলে এর আগেই চোখে পড়া উচিত ছিল।

চারিদিকে সারি সারি নানা আকারের আগ্নেয়াস্ত্র। গোটাচারেক রাইফেল, ছোট বড় নানা রকম চেহারা। একটা হুকের সঙ্গে খাপে আঁটা এক জোড়া রিভলবার ঝুলছে ; তার পাশেই দুলছে খোলা একখানা লম্বা শেফিল্ডের তরোয়াল—সূর্যের আলোর মত তার ফলার নিষ্কলঙ্ক রঙ। মোটা চামড়ার বেল্টে ঝকঝকে পেতলের কার্তুজ—রাইফেলের, রিভলবারের। জরিদার খাপে খানতিনেক নেপালী ভোজালি। আর দেওয়ালের গায়ে হরিণের মাথা, ভালুকের মুখ, নানারকমের চামড়া—বাঘের, সাপের, হরিণের, গো-সাপের। একটা টেবিলে অতিকায় হাতির মাথা—দুটো বড় বড় দাঁত এগিয়ে আছে সামনের দিকে। বুঝলাম—এরা রাজাবাহাদুরের বীরকীর্তির নিদর্শন।

ছোট একটা রাইফেল তুলে নিয়ে রাজাবাহাদুর বললেন, একটা লাইট জিনিস। তবে ভাল রিপিটার ; অনায়াসে বড় বড় জানোয়ার ঘায়েল করতে পারেন।

আমার কাছে অবশ্য সবই সমান। লাইট রিপিটার যা, হাউইটজার কামানও তাই; তবু সৌজন্য রক্ষার জন্য বলতে হল—বাঃ, তবে তো চমৎকার জিনিস।

রাজাবাহাদুর রাইফেলটা বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে : তাহলে চেষ্টা করুন। লোড করাই আছে, ছুঁড়ন ওই জানলা দিয়ে।

আমি সভয়ে তিন পা পেছিয়ে গেলাম। জীবনে বেকুবি অনেক করেছি। কিন্তু তার পরিমাণটা বাড়াতে আর প্রস্তুত নই। যুদ্ধ ফেরৎ এক বন্ধুর মুখে তাঁর রাইফেল ছোঁড়ার প্রথম অভিজ্ঞতা শুনেছিলাম—পড়ে গিয়ে পা ভেঙে নাকি তাঁকে এক মাস বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়েছিল। নিজেকে যতদূর জানি—আমার ফাঁড়া শুধু পা ভাঙার ওপর দিয়েই কাটবে বলে মনে হয় না।

বললাম, ওটা এখন থাক, পরে হবে না হয়।

রাজাবাহাদুর মৃদু কৌতুকের হাসি হাসলেন। বললেন, এখন ভয় পাচ্ছেন, কিন্তু একবার ধরতে শিখলে আর ছাড়তে চাইবেন না। হাতে থাকলে বুঝবেন, কত বড় শক্তিমান আপনি। ইউ ক্যান ইজিলি ফেস অল দ্য রাস্কেলস অব—অব—

হঠাৎ তাঁর চোখ ঝকঝক করে উঠল। মৃদু হাসিটা মিলিয়ে গিয়ে শক্ত হয়ে উঠল মুখের পেশীগুলো :অ্যান্ড এ রাইভ্যাল—

মুহূর্তে বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল আমার। রাজাবাহাদুরের দু’চোখে বন্য হিংসো।রাইফেলটা এমন শক্ত মুঠিতে বাগিয়ে ধরেছেন, যেন সামনে কাউকে গুলি করবার জন্যে তৈরি হচ্ছেন তিনি। উত্তেজনার ঝোঁকে আমাকেই যদি লক্ষ্য ভেদ করে বসেন, তাহলে—

আতঙ্কে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম আমি। কিন্তু ততক্ষণে মেঘ কেটে গেছে, রাজারাজড়ার মেজাজ ! রাজাবাহাদুর হাসলেন।

—ওয়েল, পরে আপনাকে তালিম দেওয়া যাবে। সবই তো রয়েছে, যেটা খুশি আপনি ট্রাই করতে পারেন। চলুন, এখন বারান্দায় গিয়ে বসা যাক, লেটস হ্যাভ সাম এনার্জি।

প্রাতরাশেই প্রায় বিন্ধ্য পর্বত উদরসাৎ করা হয়েছে, আর কী হলে এনার্জি সঞ্চিত হবে বোঝা শক্ত। কিন্তু কথাটা বলেই রাজাবাহাদুর বাইরের বারান্দার দিকে পা বাড়িয়েছেন। সুতরাং আমাকেও পিছু নিতে হল।

বাইরের বারান্দায় বেতের চেয়ার, বেতের টেবিল। এখানে ঢোকবার পরে এত বিচিত্র রকমের আসনে বসছি যে আমি প্রায় নার্ভাস হয়ে উঠছি। তবু যেন বেতের চেয়ারে বসতে পেয়ে খানিকটা সহজ অন্তরঙ্গতা অনুভব করা গেল। এটা অন্তত চেনা জিনিস।

আর বসবার সঙ্গে সঙ্গেই বোঝা গেল এনার্জি কথাটার আসল তাৎপর্য কী। বেয়ারা তৈরিই ছিল, ট্রেতে করে একটি ফেনিল গ্লাস সামনে এনে রাখল—অ্যালকোহলের উগ্র গন্ধ ছড়িয়ে গেল বাতাসে।

রাজাবাহাদুর স্মিত হাস্যে বললেন, চলবে ?

সবিনয়ে জানালাম, না।

—তবে বিয়ার আনবে ? একেবারে মেয়েদের ড্রিঙ্ক ! নেশা হবে না।

—নাঃ, থাক। অভ্যেস নেই কোনদিন।

—হুঁঃ, গুড কন্ডাক্টের প্রাইজ পাওয়া ছেলে। রাজাবাহাদুরের সুরে অনুকম্পার আভাস : আমি কিন্তু চোদ্দ বছর বয়সেই প্রথম ড্রিঙ্ক ধরি।

রাজারাজড়ার ব্যাপার—সবই অলৌকিক। জন্মাবার সঙ্গে সঙ্গেই কেউটের বাচ্চা। সুতরাং মন্তব্য অনাবশ্যক। ট্রে বারবার যাতায়াত করতে লাগল ; রাজাবাহাদুরের প্রখর উজ্জ্বল চোখ দুটো ঘোলাটে হয়ে এল ক্রমশ, ফর্সা গাল গোলাপী রং ধরল। হঠাৎ অসুস্থ দৃষ্টিতে তিনি আমার দিকে তাকালেন।

—আচ্ছা বলতে পারেন, আপনি রাজা নন কেন ?

এরকম একটা প্রশ্ন করলে বোকার মত দাঁত বের করে থাকা ছাড়া আর গত্যন্তর নেই। আমিও তাই করলাম।

বলতে পারলেন না ?

—না।

—আপনি মানুষ মারতে পারেন ?

এ আবার কী রকম কথা। আমার আতঙ্ক জাগল।

—না।

—তাহলে বলতে পারবেন না, ইউ আর অ্যাবসোলিউটলি হোপলেস।

উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ালেন রাজাবাহাদুর। বলে গেলেন : আই পিটি ইউ।

বুঝলাম, নেশাটা বেশ চড়েছে। আমি আর কথা বাড়ালাম না, চুপ করে বসে রইলাম সেখানেই। খানিক পরেই ঘরের ভেতরে নাক ডাকার শব্দ। তাকিয়ে দেখি, তাঁর লাউঞ্জের সেই চেয়ারটায় হাঁ করে ঘুমুচ্ছেন রাজাবাহাদুর, মুখের কাছে কতকগুলো মাছি উড়ছে ভনভন করে।

সেইদিন রাত্রেই শিকারের প্রথম অভিজ্ঞতা। জঙ্গলের ভেতর বসে আছি মোটরে। দুটো তীব্র হেডলাইটের আলো পড়েছে সামনের সঙ্কীর্ণ পথে আর দু’ধারের শালবনে। ওই আলোক-রেখার বাইরে অবশিষ্ট জঙ্গলটায় যেন প্রেতপুরীর জমাট অন্ধকার। রাত্রির তমসার আদিম হিংসা সজাগ হয়ে উঠেছে চারদিকে—অনুভব করছি সমস্ত স্নায়ু দিয়ে। এখানে হাতির পাল ঘুরছে দূরের কোন পাহাড়ের পাথর গুঁড়িয়ে গুঁড়িয়ে, ঝোপের ভেতরে অজগর প্রতীক্ষা করে আছে অসতর্ক শিকারের আশায়, আসন্ন বিপদের সম্ভাবনায় উৎকর্ণ হয়ে আছে হরিণের দল আর কোন একটা খাদের ভেতরে জ্বলজ্বল করছে ক্ষুধার্ত বাঘের চোখ। কালো রাত্রিতে জেগে রয়েছে কালো অরণ্যের প্রাথমিক জীবন।

রোমাঞ্চিত ভীত প্রতীক্ষায় চুপ করে বসে আছি মোটরের মধ্যে। কিন্তু হিংসার রাজত্ব শালবন ডুবে আছে একটা আশ্চর্য স্তব্ধতায়। শুধু কানের কাছে অবিশ্রান্ত মশার গুঞ্জন ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। মাঝে মাঝে অল্প অল্প বাতাস দিচ্ছে—শালের পাতায় উঠছে এক একটা মৃদু মর্মর। আর কখনো কখনো ডাকছে বনমুরগী, ঘুমের মধ্যে পাখা ঝাপটাচ্ছে ময়ূর। মনে হচ্ছে, এই গভীর ভয়ঙ্কর অরণ্যের ভয়ঙ্কর প্রাণীগুলো যেন নিশ্বাস বন্ধ করে একটা নিশ্চিত কোন মুহূর্তের প্রতীক্ষা করে আছে।

আমরাও প্রতীক্ষা করে আছি। মোটরের মধ্যে নিঃসাড় হয়ে বসে আছি আমরা—একটি কথাও বলবার উপায় নেই। রাইফেলের একটা ঝকঝকে নল এঞ্জিনের পাশে বাড়িয়ে দিয়ে শিকারী বাঘের মতই অকিয়ে আছেন রাজাবাহাদুর। চোখ দুটো উদগ্র প্রখর হয়ে আছে হেডলাইটের তীব্র আলোক-রেখাটার দিকে, একটা জানোয়ার ওই রেখাটা পেরোবার দুঃসাহস করলেই রাইফেল গর্জন করে উঠবে।

কিন্তু জঙ্গলে সেই আশ্চর্য স্তব্ধতা। অরণ্য যেন আজ রাত্রে বিশ্রাম করছে, একটি রাত্রের জন্যে ক্লান্ত হয়ে জানোয়ারগুলো ঘুমিয়ে পড়েছে খাদের ভেতরে, ঝোপের আড়ালে। কেটে চলেছে মন্থর সময়। রাজাবাহাদুরের হাতের রেডিয়াম ডায়াল ঘড়িটা একটা সবুজ চোখের মত জ্বলছে, রাত দেড়টা পেরিয়ে গেছে। ক্রমশ উসখুস করছেন উৎকর্ণ রাজাবাহাদুর।

—নাঃ, হোপলেস। আজ আর পাওয়া যাবে না। বহুদূর থেকে একটা তীক্ষ্ণ গম্ভীর শব্দ, হাতির ডাক। ময়ূরের পাখা ঝাপটানি চলছে মাঝে মাঝে। এক ফাঁকে একটা প্যাঁচা চেঁচিয়ে উঠল, রাত্রি ঘোষণা করে গেল শেয়ালের দল। কিন্তু কোথায় বাঘ, কোথায় বা ভালুক ? অন্ধকার বনের মধ্যে দ্রুত কতকগুলো ছুটন্ত খুরের আওয়াজ—পালিয়ে গেল হরিণের পাল। কিন্তু কোন ছায়া পড়ছে না আলোকবৃত্তের ভেতরে। মশার কামড় যেন অসহ্য হয়ে উঠছে।

—বৃথাই গেল রাতটা। —রাজাবাহাদুরের কণ্ঠস্বরে পৃথিবীর সমস্ত বিরক্তি ভেঙে পড়ল : ডেভিল লাক। সিটের পাশ থেকে একটা ফ্লাস্ক তুলে নিয়ে ঢকঢক করে ঢাললেন গলাতে, ছড়িয়ে পড়ল হুইস্কির উগ্র উত্তপ্ত গন্ধ।

— থ্যাঙ্ক হেভেনস। —রাজাবাহাদুর হঠাৎ নড়ে বসলেন চকিত হয়ে। নক্ষত্ৰবেগে হাতটা চলে গেল রাইফেলের ট্রিগারে। শিকার এসে পড়েছে।

আমিও দেখলাম। বহুদূরে আলোর রেখাটার ভেতরে কী একটা জানোয়ার দাঁড়িয়ে পড়েছে স্থির হয়ে। এমন একটা জোরাল আলো চোখে পড়াতে কেমন দিশেহারা হয়ে গেছে তাকিয়ে আছে এই দিকেই। দুটো প্রদীপের আলোর মত ঝিকঝিক করছে তার চোখ।

ড্রাইভার বললে, হয়না।

—ড্যাম—রাইফেল থেকে হাত সরিয়ে নিলেন রাজাবাহাদুর, কিন্তু পরমুহূর্তেই চাপা উত্তেজিত গলায় বললেন, থাক, আজ ছুঁচোই মারব।

দুম্‌ করে রাইফেল গর্জন করে উঠল। কানে তালা ধরে গেল আমার, বারুদের গন্ধে বিস্বাদ হয়ে উঠল নাসরন্ধ্র। অব্যর্থ লক্ষ্য রাজাবাহাদুরের—পড়েছে জানোয়ারটা।

ড্রাইভার বললে, তুলে আনব হুজুর ?

বিকৃতমুখে রাজাবাহাদুর বললেন, কী হবে ? গাড়ি ঘোরাও।

রেডিয়াম ডায়ালের সবুজ আলোয় রাত তিনটে। গাড়ি ফিরে চলল হান্টিং বাংলোর দিকে। একটা ম্যানিলা চুরুট ধরিয়েই রাজাবাহাদুর আবার বললেন, ড্যাম !

কিন্তু কী আশ্চর্য—জঙ্গল যেন রসিকতা শুরু করেছে আমাদের সঙ্গে। দিনের বেলা অনেক চেষ্টা করেও দুটো-একটা বনমুরগী ছাড়া আর কিছু পাওয়া গেল না—এমন কি একটা হরিণ পর্যন্ত নয়। নাইট শূটিংয়েও সেই অবস্থা। পরপর তিন রাত্রি জঙ্গলের নানা জায়গায় গাড়ি থামিয়ে চেষ্টা করা হল, কিন্তু নগদ লাভ যা ঘটল, তা অমানুষিক মশার কামড়। জঙ্গলের হিংস্র জন্তুর সাক্ষাৎ মিলল না বটে, কিন্তু মশাগুলোকে চিনতে পারা গেল। এমন সাংঘাতিক মশা যে পৃথিবীর কোথাও থাকতে পারে এতদিন এ ধারণা ছিল না আমার।

তবে মশার কামড়ের ক্ষতিপূরণ চলতে লাগল গন্ধমাদন উজাড় করে। সত্যি বলতে কী, শিকার করতে না পারলেও মনের দিক থেকে বিন্দুমাত্র ক্ষোভ ছিল না আমার। জঙ্গলের ভেতরে এমন রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন কল্পনারও বাইরে। জীবনে এমন দামী খাবার কোনদিন মুখে তুলি নি, এমন চমৎকার বাথরুমে স্নান করি নি কখনো, এত পুরু জাজিমের বিছানায় শুয়ে অস্বস্তিতে প্রথম দিন তো ঘুমুতেই পারি নি আমি। নিবিড় জঙ্গলের নেপথ্যে গ্রান্ড হোটেলের স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটাচ্ছি—শিকার না হলেও কণামাত্র ক্ষতি নেই কোথাও। প্রত্যেক দিনই লাউঞ্জে চা খেতে খেতে চারশো ফুট নিচেকার ঘন জঙ্গলটার দিকে চোখ পড়ে। সকালের আলোয় উদ্ভাসিত শ্যামলতা দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তীর্ণ হয়ে আছে অপরূপ প্রসন্নতায়। ওয়ান অব দি ফিয়ার্সেস্ট ফরেস্টস্‌ ! বিশ্বাস হয় না। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি, বাতাসে আকার-অবয়বহীন পত্রাবরণ সবুজ সমুদ্রের মত দুলছে, চক্র দিচ্ছে পাখির দল—এখান থেকে মৌমাছির মত দেখায় পাখিগুলোকে ; জানলার ঠিক নিচেই ইস্পাতের ফলার মত পাহাড়ী নদীটার নীলিমোজ্জ্বল রেখা—দুটো একটা নুড়ি ঝকমক করে মণিখণ্ডের মত। বেশ লাগে।

তারপরেই চমক ভাঙে আমার। তাকিয়ে দেখি, ঠোঁটের কোণে ম্যানিলা চুরুট পুড়ছে, অস্থির চঞ্চল পায়ে রাজাবাহাদুর ঘরের ভেতরে পায়চারি করছেন। চোখমুখে একটা চাপা আক্রোশ—ঠোঁটদুটোয় নিষ্ঠুর কঠিনতা। কখনো ভোজালি তুলে নিয়ে নিজের হাতের ওপরে ফলাটা রেখে পরীক্ষা করেন সেটার ধার। আবার কখনো বা জানলার সামনে খানিকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন নিচের জঙ্গলটার দিকে। আজ তিন দিন থেকে উল্লেখযোগ্য একটা কিছু শিকার করতে পারেন নি—ক্ষোভে তাঁর দাঁতগুলো কড়মড় করতে থাকে।

তারপরই বেরিয়ে যান এনার্জি সংগ্রহের চেষ্টায়। বাইরের বারান্দায় গিয়ে হাঁক দেন—পেগ।

কিন্তু পরের পয়সায় রাজভোগ খেয়ে এবং রাজোচিত বিলাস করে বেশি দিন কাটানো আর সম্ভব নয় আমার পক্ষে। রাজাবাহাদুরের অনুগ্রহ একটা দামী জিনিস বটে, কিন্তু কলকাতায় আমার ঘর-সংসার আছে একটা দায়িত্ব আছে তার। সুতরাং চতুর্থ দিন সকালে কথাটা আমাকে পাড়তে হল।

বললাম, এবার আমাকে বিদায় দিন তাহলে। রাজাবাহাদুর সবে চতুর্থ পেগে চুমুক দিয়েছেন তখন। তেমনি অসুস্থ আর রক্তাভ চোখে আমার দিকে তাকালেন। বললেন, আপনি যেতে চান ?

—হ্যাঁ, কাজকর্ম রয়েছে—

—কিন্তু আমার শিকার আপনাকে দেখাতে পারলাম না—

—সে না হয় আর একবার হবে।

—হুম। —চাপা ঠোঁটের ভেতরেই একটা গম্ভীর আওয়াজ করলেন রাজাবাহাদুর : আপনি ভাবছেন আমার ওই রাইফেলগুলো, দেওয়ালে ওই সব শিকারের নমুনা—ওগুলো সব ফার্স ?

আমি সন্ত্রস্ত হয়ে বললাম, না, না, তা কেন ভাবতে যাব ! শিকার তো খানিকটা অদৃষ্টের ব্যাপার—

হুম ! অদৃষ্টকেও বদলানো চলে। রাজাবাহাদুর উঠে পড়লেন :আমার সঙ্গে আসুন।

দুজনে বেরিয়ে এলাম। রাজাবাহাদুর আমাকে নিয়ে এলেন হান্টিং বাংলোর পেছন দিকটাতে। ঠিক সেখানে—যার চারশ ফুট নিচে টেরাইয়ের অন্যতম হিংস্র অরণ্য বিস্তীর্ণ হয়ে আছে।

এখানে আসতে আর একটা নতুন জিনিস চোখে পড়ল। দেখি কাঠের একটা রেলিং দেওয়া, সাঁকোর মত জিনিস সেই সীমাহীন শূন্যতার ওপরে প্রায় পনের-যোল হাত প্রসারিত হয়ে আছে। তার পাশে দুটো বড় বড় কাঠের চাকা, তাদের সঙ্গে হুক লাগানো দু’ জোড়া মোটা কাছি জড়ানো। ব্যাপারটা কী ঠিক বুঝতে পারলাম না।

—আসুন। —রাজাবাহাদুর সেই ঝুলন্ত সাঁকোটার ওপরে গিয়ে দাঁড়ালেন। আমিও গেলাম তাঁর পেছনে পেছনে। একটা আশ্চর্য বন্দোবস্ত। ঠিক সাঁকোটার নিচেই পাহাড়ী নদীটার রেখা, নুড়ি-মেশানো সঙ্কীর্ণ বালুতট তার দুপাশে, তাছাড়া জঙ্গল জঙ্গল। নিচে তাকাতে আমার মাথা ঘুরে উঠল। রাজাবাহাদুর বললেন, জানেন এসব কী ?

—না।

—আমার মাছ ধরার বন্দোবস্ত। এর কাজ খুব গোপনে—নানা হাঙ্গামা আছে। কিন্তু অব্যর্থ।

—ঠিক বুঝতে পারছি না।

—আজ রাত্রেই বুঝতে পারবেন। শিকার দেখাতে আপনাকে ডেকে এনেছি, নতুন একটা শিকার দেখাব। কিন্তু কোনদিন এর কথা কারো কাছে প্রকাশ করতে পারবেন না।

কিছু না বুঝেই মাথা নাড়লাম—না।

—তাহলে আজ রাতটা অবধি থাকুন। কাল সকালেই আপনার গাড়ির ব্যবস্থা করব।—রাজাবাহাদুর আবার হান্টিং বাংলোর সম্মুখের দিকে এগোলেন ; কাল সকালের পরে এমনিতেই আপনার আর এখানে থাকা চলবে না। একটা কাঠের সাঁকো, দুটো কপিকলের মত জিনিস। মাছ ধরবার ব্যবস্থা, কাউকে বলা যাবে না এবং কাল সকালেই চলে যেতে হবে। সবটা মিলিয়ে যেন রহস্যের খাসমহল একেবারে। আমার কেমন এলোমেলো লাগতে লাগল সমস্ত। কিন্তু ভাল করে জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না, রাজাবাহাদুরকে বেশি প্রশ্ন করতে কেমন অস্বস্তি লাগে আমার। অনধিকার চর্চা মনে হয়।

বাংলোর সামনে তিন-চারটে ছোট ছোট নোংরা ছেলেমেয়ে খেলা করে বেড়াচ্ছে, হিন্দুস্থানী কীপারটার বেওয়ারিস সম্পত্তি। কীপারটাকে রাজাবাহাদুর শহরে পাঠিয়েছেন। কিছু দরকারী জিনিসপত্র কিনে কাল সে ফিরবে। ভারি বিশ্বাসী আর অনুগত লোক। মাতৃহীন ছেলেমেয়েগুলো সারাদিন হুটোপুটি করে ডাকবাংলোর সামনে। রাজাবাহাদুর বেশ অনুগ্রহের চোখে দেখেন ওদের। দোতলার জানলা থেকে পয়সা, রুটি কিংবা বিস্কুট ছুঁড়ে দেন, নিচে ওরা সেগুলো নিয়ে কুকুরের মত লোফালুফি করে। রাজাবাহাদুর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেন সকৌতুকে। আজও ছেলেমেয়েগুলো হুল্লোড় করে তাঁর চারপাশে এসে ঘিরে দাঁড়াল। বলল, হুজুর, সেলাম। —রাজাবাহাদুর পকেটে হাত দিয়ে কতকগুলো পয়সা ছড়িয়ে দিলেন ওদের ভিতর। হরির লুটের মত কাড়াকাড়ি পড়ে গেল।

বেশ ছেলেমেয়েগুলি। দুই থেকে আট পর্যন্ত বয়েস। আমার ভারি ভাল লাগে ওদের। আরণ্যক জগতের শাল-শিশুদের মত সতেজ আর জীবন্ত, প্রকৃতির ভেতর থেকে প্রাণ আহরণ করে বড় হয়ে উঠছে।

সন্ধ্যার ডিনার টেবিলে বসে আমি বললাম, আজ রাত্রে মাছ ধরবার কথা আছে আপনার।

চোখের কোণা দিয়ে আমার দিকে তাকালেন রাজাবাহাদুর। লক্ষ্য করেছি, আজ সমস্ত দিন বড় বেশি মদ খাচ্ছেন আর ক্রমাগত চুরুট টেনে চলেছেন। ভাল করে আমার সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলেন নি। ভেতরে ভেতরে কিছু একটা ঘটে চলেছে তাঁর।

রাজাবাহাদুর সংক্ষেপে বললেন—হুম।

আমি সসঙ্কোচে জিজ্ঞাসা করলাম, কখন হবে?

একমুখ ম্যানিলা চুরুটের ধোঁয়া ছড়িয়ে তিনি জবাব দিলেন, সময় হলে ডেকে পাঠাব। এখন আপনি গিয়ে শুয়ে পড়ন। স্বচ্ছন্দে কয়েক ঘন্টা ঘুমিয়ে নিতে পারেন।

শেষ কথাটা আদেশের মত শোনাল। বুঝলাম আজ বেশিক্ষণ আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলি এ তিনি চান না। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে বলাটা অতিথিপরায়ণ গৃহস্থের অনুনয় নয়, রাজার নির্দেশ। এবং সে নির্দেশ পালন করতে বিলম্ব না করাই ভাল।

কিন্তু অতি নরম জাজিমের বিছানায় শুয়েও ঘুম আসছে না। মাথার ভেতরে আবর্তিত হচ্ছে অসংলগ্ন চিন্তা। মাছ ধরা, কাঠের সাঁকো, কপিকল, অত্যন্ত গোপনীয়! অতল রহস্য।

তারপর এপাশ-ওপাশ করতে করতে কখন যে চৈতন্য আচ্ছন্ন হয়ে এল তা আমি নিজেই টের পাই নি।

মুখের ওপর ঝাঁঝাল একটা টর্চের আলো পড়তে আমি ধড়মড় করে উঠে পড়লাম। রাত তখন কটা ঠিক জানি না। আরণ্যক পরিবেশ নির্জনতায় অভিভূত। বাইরে শুধু তীব্রকণ্ঠ ঝিঁঝির ডাক। আমার গায়ে বরফের মত ঠাণ্ডা একটা হাত পড়েছে কার। সে হাতের স্পর্শে পা থেকে মাথা পর্যন্ত শিউরে গেল আমার। রাজাবাহাদুর বললেন, সময় হয়েছে, চলুন। আমি কি বলতে যাচ্ছিলাম—ঠোঁটে আঙুল দিলেন রাজাবাহাদুর : কোন কথা নয়, আসুন।

এই গভীর রাত্রে এমনি নিঃশব্দ আহ্বান—সবটা মিলিয়ে একটা রোমাঞ্চকর উপন্যাসের পটভূমি তৈরি হয়েছে যেন। কেমন একটা অস্বস্তি, একটা অনিশ্চিত ভয়ে গা ছমছম করতে লাগল আমার! মন্ত্রমুগ্ধের মত রাজাবাহাদুরের পেছনে পেছনে বেরিয়ে এলাম।

হান্টিং বাংলোটা অন্ধকার। একটা মৃত্যুর শীতলতা ঢেকে রেখেছে তাকে। একটানা ঝিঁঝির ডাক—চারদিকের অরণ্যে কান্নার শব্দের মত পত্ৰমর্মর। গভীর রাত্রিতে জঙ্গলের মধ্যে মোটর থামিয়ে বসে থাকতে আমার ভয় করছিল, আজও ভয় করছে। কিন্তু এ ভয়ের চেহারা আলাদা—এর মধ্যে আর একটা কী যেন মিশে আছে ঠিক বুঝতে পারছি না, অথচ পাও সরতে চাইছে না আমার। মুখের ওপরে একটা টর্চের আলো, রাজাবাহাদুরের হাতের স্পর্শটা বরফের মত ঠাণ্ডা, ঠোঁটে আঙুল দিয়ে নীরবতার সেই দুর্বোধ্য কুটিল সঙ্কেত।

টর্চের আলোয় পথ দেখিয়ে রাজাবাহাদুর আমাকে সেই ঝুলন্ত সাঁকোটার কাছে নিয়ে এলেন। দেখি তার ওপরে শিকারের আয়োজন। দুখানা চেয়ার পাতা, দুটো তৈরি রাইফেল। দুজন বেয়ারা একটা কপিকলের চাকা ঘুরিয়ে কী একটা জিনিস নামিয়ে দিচ্ছে নিচের দিকে। এক মুহূর্তের জন্য রাজাবাহাদুর তাঁর নয় বোলের হান্টিং টর্চটা নিচের দিকে ফ্লাশ করলেন। প্রায় আড়াইশো ফুট নিচে সাদা পুঁটুলির মত কী একটা জিনিস কপিকলের দড়ির সঙ্গে নেমে যাচ্ছে দ্রুতবেগে।

আমি বললাম, ওটা কি রাজাবাহাদুর?

—মাছের টোপ।

—কিন্তু এখনো কিছু বুঝতে পারছি না।

—একটু পরে বুঝবেন। এখন চুপ করুন।

এবারে স্পষ্ট ধমক দিলেন আমাকে। মুখ দিয়ে ভক ভক করে হুইস্কির তীব্র গন্ধ বেরুচ্ছে। রাজাবাহাদুর প্রকৃতিস্থ নেই। আর কিছুই বুঝতে পারছি না আমি—আমার মাথার ভেতরে সব যেন গণ্ডগোল হয়ে গেছে। একটা দুর্বোধ্য নাটকের নির্বাক দ্ৰষ্টার মত রাজাবাহাদুরের পাশের চেয়ারটাতে আসন নিলাম আমি।

ওদিকে ঘন কালো বনান্তের ওপরে ভাঙা চাঁদ দেখা দিল। তার খানিকটা ম্লান আলো এসে পড়ল চারশ ফুট নিচের নদীর জলে, তার ছড়ানো মণিখণ্ডের মত নুড়িগুলোর ওপরে। আবছাভাবে যেন দেখতে পাচ্ছি—কপিকলের দড়ির সঙ্গে বাঁধা সাদা পুঁটলিটা অল্প অল্প নড়ছে বালির ওপরে। এক হাতে রাজাবাহাদুর রাইফেলটা বাগিয়ে ধরে আছেন, আর এক হাতে মাঝে মাঝে আলো ফেলছেন নিচের পুঁটলিটায়। চকিত আলোয় যেটুকু মনে হচ্ছে—পুঁটলিটা যেন জীবন্ত, অথচ কী জিনিস কিছু বুঝতে পারছি না। এ নাকি মাছের টোপ। কিন্তু এ কী মাছ—এ কিসের টোপ?

আবার সেই স্তব্ধতার প্রতীক্ষা। মুহূর্ত কাটছে, মিনিট কাটছে, ঘন্টা কাটছে। রাজাবাহাদুরের টর্চের আলো বারে বারে পিছলে পড়হে নিচের দিকে। দিগন্ত প্রসার হিংস্র অরণ্য ভাঙা-ভাঙা জ্যোৎস্নায় দেখাচ্ছে তরঙ্গিত একটা সমুদ্রের মত। নিচের নদীটা ঝকঝক করছে, যেন একখানা খাপ-খোলা তলোয়ার। অবাক বিস্ময়ে আমি বসে আছি। মিনিট কাটছে, ঘন্টা কাটছে। টোপ ফেলে মাছ ধরছেন রাজাবাহাদুর।

অথচ সব ধোঁয়াটে লাগছে আমার ; কান পেতে শুনছি ঝিঁঝির ডাক, দূরে থতির গর্জন, শালপাতার মর্মর। এ প্রতীক্ষার তত্ত্ব আমার কাছে দুর্বোধ্য। শুধু হুইস্কি আর ম্যানিলা চুরুটের গন্ধ নাকে এসে লাগছে আমার। মিনিট কাটছে, ঘন্টা কাটছে, রেডিয়াম ডায়াল ঘড়ির কাঁটা চলছে ঘুরে। ক্রমশ যেন সম্মোহিত হয়ে গেলাম, ক্রমশ যেন ঘুম এল আমার। তার পরেই হঠাৎ কানের কাছে বিকট শব্দে রাইফেল সাড়া দিয়ে উঠল—চারশ ফুট নিচে থেকে ওপরের দিকে উৎক্ষিপ্ত হয়ে উঠল প্রচণ্ড বাঘের গর্জন। চেয়ারটা সুদ্ধ আমি কেঁপে উঠলাম। টর্চের আলোটা সোজা পড়েছে নুড়ি-ছড়ানো বালির ডাঙাটার ওপরে। পরিষ্কার দেখতে পেলাম ডোরাকাটা অতিকায় একটা বিশাল জানোয়ার সাদা পুটলির ওপরে একখানা থাবা চাপিয়ে দিয়ে পড়ে আছে, সাপের মত ল্যাজ আছড়াচ্ছে অন্তিম আক্ষেপে! ওপর থেকে ইন্দ্রের বর্জ্যের মত অব্যর্থ গুলি গিয়ে লেগেছে তার মাথায়। এত ওপর থেকে দুর্নিবার মৃত্যু নামবে আশঙ্কা করতে পারে নি। রাজাবাহাদুর সোৎসাহে বললেন—ফতে!

এতক্ষণে মাছ ধরবার ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছি। সোল্লাসে বললাম, মাছ তো ধরলেন, ডাঙায় তুলবেন কেমন করে?

—ওই কপিকল দিয়ে। এই জন্যেই তো ওগুলোর ব্যবস্থা।

ব্যাপারটা যেমন বিচিত্র, তেমনি উপভোগ্য। আমি রাজাবাহাদুরকে অভিনন্দিত করতে যাব, এমন সময়—এমন সময় পরিষ্কার শুনতে পেলাম শিশুর গোঙানি। ক্ষীণ অথচ নির্ভুল। ও কিসের শব্দ!

চারশ ফুট নিচে থেকে ওই শব্দটা আসছে। হ্যাঁ—কোন ভুল নেই। মুখের বাঁধন খুলে গেছে কিন্তু বড় দেরিতে। আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল, আমার চুল খাড়া হয়ে উঠল। আমি পাগলের মত চিৎকার করে উঠলাম, রাজাবাহাদুর, কিসের টোপ আপনার! কী দিয়ে আপনি মাছ ধরলেন?

—চুপ!—একটা কালো রাইফেলের নল আমার বুকে ঠেকালেন রাজাবাহাদুর। তারপরেই আমার চারদিকে পৃথিবীটা পাক খেতে খেতে হাওয়ায় গড়া একটা বুদ্বুদের মত শূন্যে মিলিয়ে গেল। রাজাবাহাদুর জাপটে না ধরলে চারশ ফুট নিচেই পড়ে যেতাম হয়তো।

কীপারের একটা বেওয়ারিশ ছেলে যদি জঙ্গলে হারিয়ে গিয়ে থাকে, তা অস্বাভাবিক নয়, তাতে কারো ক্ষতি নেই। কিন্তু প্রকাণ্ড রয়্যাল বেঙ্গল মেরেছিলেন রাজাবাহাদুর, লোককে ডেকে দেখানোর মত।

তার আট মাস পরে এই চমৎকার চটিজোড়া উপহার এসেছে। আট মাস আগেকার সে রাত্রি এখন স্বপ্ন হয়ে যাওয়াই ভাল, কিন্তু এই চটিজোড়া অতি মনোরম বাস্তব। পায়ে দিয়ে একবার হেঁটে দেখলাম, যেমন নরম, তেমনি আরাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *