টেলিফোন

টেলিফোন

নিজেই নিজেকে বাঁশ দিয়ে বসে আছি। বাঁশ যে কত রকমের হাতে পারে ধারণা ছিল না। কেতাবে পড়েছিলাম, মুংলি, তলতা আর গেঁটে। সেসব হল কাজের। উপকারী বাঁশ। যে বাঁশ আমরা পরস্পর পরস্পরকে দিয়ে থাকি সে বাঁশ অদৃশ্য এবং তার ধরন বহু। সংস্পর্শে না এলে জাত বোঝা যায় না। যেমন আমি এখন চারটে বাঁশের পাল্লায় পড়েছি। চারটেই আছোলা এবং নগদ মূল্যে কেনা। বন্ধু ভেবেই কেনা। এখন তারা মহাশত্রুর চেহারায় গলা দিয়ে গান বের করে ছেড়েছে, গেছে সুখ গেছে শান্তি।

বাম্বু নাম্বার ওয়ান, টেলিফোন। একটা টেলিফোন নাও হে। কত বড়ো স্ট্যাটাস সিম্বল। ইয়া মোটা একটা বইতে তোমার নাম থাকবে। কত জ্ঞানী, গুণী, সম্মানিত ব্যক্তির সঙ্গে একাসনে। অজ্ঞাতকুলশীল নও। ডাইরেক্টরিতে নাম। নামের পাশে নম্বর। এই শহরের নম্বরী কয়েদি। লোককে কেমন বড় গলায় বলতে পারবে, কাল তাহলে সকালে ফোন কোরো। তিনি তখন মুখটা করুণ করে বলবেন, আমার যে ফোন নেই। সঙ্গেসঙ্গে তুমি কত উঁচুতে উঠে যাবে। টেলিফোনের হাতে লাটাই, স্ট্যাটাসের আকাশে তুমি একটি ঘুড়ি। এক টানে চড় চড় করে তুমি সুনীল আকাশে নারকেল গাছের মাথার ওপর উঠে লাট খেতে থাকবে। এক কথায় ফ্রম ছাতুবাবু টু লাটুবাবু। মানুষের বর্তমান জাতিভেদ তো এইভাবে—আমার ফোন আছে, তোমার নেই। আমার ফ্রিজ আছে, তোমার ফ্রিজ নেই। আমার গাড়ি আছে, তোমার গাড়ি নেই। কিংবা আমার স্কুটার আছে, তোমার সাইকেল। আমার মোটর সাইকেল, তোমার মোপেড! আবার এইভাবেও হতে পারে—তুমি দোতলায় ফ্ল্যাটে থাক, আমি থাকি আটতলায়, ছ-তলায়। অবশ্য দোতলা এইভাবে ছ-তলার জাতে উঠতে পারেন, আমার যে হার্ট ভাই। তার মানে দোতলা উইথ হার্ট ইজ ইকোয়াল টু ছ-তলা উইদাউট হার্ট।

মানুষের জাতিভেদ আবার এভাবেও হতে পারে—আমার বউ সুন্দর, তোমার বউ মাটো-সুন্দরী। আমার বউয়ের গায়ের রং দুধে আলতায়, তোমার বউ কেলে-ক্যাকটাস। অবশ্য এইভাবে কাটান দেওয়া যেতে পারে, কালো হলে হবে কী ভাই শ্বশুর বিশাল বিশাল, বিশাল বড়োলোক। তার মানে দুধে আলতার হাজব্যাণ্ড ইজ ইকোয়াল টু রিচ বাপের কালো মেয়ের হাজব্যাণ্ড।

জাতিভেদ আবার এইভাবেও হতে পারে, আমার বাড়ির দক্ষিণখোলা, তোমার বাড়ির দক্ষিণ চাপা। আমার সাউথে বাড়ি, তোমার ন্যাস্টি নর্থে। আমার ছেলে শিবপুরের ইঞ্জিনিয়ার, তোমার ছলে যাদবপুরের। এই যখন জগত তখন তোমার উপায় থাকতে একটা ফোন নেবে না কে? তাছাড়া টেলিফোন এমারজেন্সির সময় কত কাজে লাগে জান? ধর তোমার হঠাৎ থ্রম্বোসিস হল, অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে হবে। জাস্ট ডায়াল। কত যেন নম্বর? অ্যাম্বুলেন্স তেড়ে এলো, মাথার ওপর নীল আলো ঘোরাতে ঘোরাতে। কী অলুক্ষুণে কথা! কেন? থ্রম্বোসিস হবেই। আজ হোক, কাল হোক, হবেই হবে। হয় করোনারি, না হয় সেরিব্রাল। শোননি, জন্মিলে মরিতে হবে। তারপর ধর তোমার বউ বাথরুমে ঢুকে গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেশলাই কাঠি জ্বেলে দিল। সে আবার কী? একটা সম্ভাবনা। হতেই পারে। এ যুগ হল সেলফ ইমমলেশানের যুগ। সকলেরই আত্মঘাতী হবার প্রবল ইচ্ছা হিক্কার মতো গলার কাছে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে। একটু উসকে দিলেই হল। ফোন থাকলে কত সুবিধে। ঝট করে ডাক্তার ডাকতে পারবে। পুলিশে খবর দিতে পারবে। বাড়িতে মাঝরাতে ডাকাত পড়তে পারে। তখন তোমার ফোন কত হেল্পফুল হবে জান। অফিস থেকে মাইনে নিয়ে ফেরার পথে তুমি ছুরিকাহত হতে পার। তখন তুমি হাসপাতলে গিয়ে খাবি খাবে। সেই সময়ে তোমার বাড়িতে ফোনে খবর দেওয়া সহজ হবে।

ভালো দিকও আছে। ফোন হলে ক্রশ কানেকশানে প্রেমালাপ শুনবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ঝগড়াও শুনতে পাবে। টেলিফোনে স্ত্রী ঝাড়ছে বাপের বাড়ি থেকে স্বামীকে। স্বামী ঝাড়ছে শ্বশুরবাড়িতে ঘাপটি মেরে বসে থাকা উড়ু উড়ু মেজাজের বউকে। শুনতে পাবে সিনিয়ার শাসাচ্ছে জুনিয়ারকে। শুনতে পাবে ঘুষের কথা, শেয়ার মার্কেটের কথা। টেলিফোনে এত ব্যবসাদার এক ব্যবসাদারকে ভাও বলছে। কত সব গোপন কথা রিসিভার তুললেই শুনতে পাবে। কত পাগল আছে জানতে পারবে। কুকুর পাগল, ফুল পাগল, পাখি পাগল, বউ পাগল, খেলা পাগল, ঘোড়া পাগল।

তা ছাড়া ফ্রী মেলে তুমি মাঝে মাঝে নানা রকম চিঠি চাপাটি পাবে। নতুন ম্যাগাজিন বেরিয়েছে। স্টেনলেস স্টিলের বাসন পাওয়া যাবে পোস্টে। বশীকরণের মাদুলি দিচ্ছেন বিলেত ফেরত তান্ত্রিক। ভাগ্য বলে দিচ্ছেন মিডল স্ট্রিস্টের পামিস্ট। দুর্বলতা কাটাবার ট্যাবলেট বেরিয়েছে রুপোলি মোড়কে মোড়া। হাঁপানির দাওয়াই বেরিয়েছে। পনেরো দিনে সারাবার গ্যারান্টি। ফুসফুস ক্লিয়ার। বাঁশি বাজানো যাবে ইচ্ছে করলে। ভুঁড়ি আর মেদ কমাবার গেজেট। পাকা চুল এক রাতে কাঁচা করে দেবার আয়ুর্বেদিক লোশান। যৌবন ফিরিয়ে আনার স্বপ্নদত্ত কবচ। কত কী যে তুমি পেতে থাকবে ধারণা নেই। পৃথিবী যে কত মধুময় জানতে পারবে।

একেই বলে গ্যাস খাওয়া। সেই ফোন এসে বসল দু-দেওয়ালের কোণে চকচকে টেবিলে। আহা! কী শোভা। দ্বিতীয় তাকে রেক্সিন মলাটে ডাইরেক্টরী। যার কোন এক পাতায় পিঁপড়ের মতো খুদিখুদি অক্ষরে আমার নাম ছাপা। শ’ পাঁচেক ভিজিটিং কার্ড ছাপিয়ে ফেলেছি। নামের তলায় ফোন নং। লেটারহেড এসে গেছে। কত বড়ো একটা ব্যাপার। জটাধারীর মতো ফোনধারী। ইউরোপ, আমেরিকা হলে কিছুই নয় । ভারতবর্ষে দিস ইজ সামথিং। পাঁচজনকে বলা চলবে। আমার কোন প্রবলেমই নেই, যেই গ্যাস ফুরোলো সঙ্গেসঙ্গে ডিস্ট্রিবিউটারকে ফোনে বলে দিলুম। ইলেকট্রিক লাইন খারাপ হয়েছে, জাস্ট এ ফোন। ডাক্তার। জাস্ট এ কল। হ্যাঁ ভালোই আছি। রিপিট প্রেসক্রিপশান। তিন নম্বর ওষুধটা বাদ। থ্যাঙ্ক ইউ। পোলাও খেয়ে পেট ছেড়েছে? অফিসে ফোনো জানিয়ে দাও, আজ আর আমি যাব না। বিকেলে তেড়ে বৃষ্টি এসেছে? অফিস থেকেই বাড়িতে ফোন হ্যালো, হ্যাঁ শোনো, খিচুড়ি লাগাও উইথ গরম গরম বেগুনি অ্যাণ্ড পাঁপড় ভাজা।

কিন্তু এমন সম্ভাবনার কথা আমাকে আগে কেউ বলেননি তো? এই ভাদ্রমাসের ঠিকুর রোদে ছাতা মাথায় আমি চলেছি। কোথায় চলেছি! ডাক্তার ডাকতে? পোস্টাফিসে চিঠি রেজিস্ট্রি করতে? না আমার বাড়ি থেকে বত্রিশটা বাড়ি উত্তরে সোমাদির বাড়ি। আমার দিদি নয়। নারকেলেডাঙা থেকে যে যুবকটি ফোন করছে তার দিদি। যুবকটি আমাকে কাকাবাবু বলে সম্বোধন করেছে। তার মানে সোমা নামক মহিলাটি সম্পর্কে আমার কে হলেন? জানার দরকার নেই। ছেলেটির গলায় প্রচন্ড উদ্বেগ। কী জানি কোনো বিপদ আপদ কিনা! তার সোমাদিকে ডেকে দিতেই হবে। মানবিক কর্তব্য। সোমাদি বাথরুমে! সেইখানে থেকেই খুশির গলায় বলে উঠলেন, ও বুঝেছি। নাড়ু ফোন করেছে। আমার তো বাথরুম থেকে বেরোতে একটু দেরি হবে কাকাবাবু। আমি কাকাবাবু! আমি তাহলে দু-জনেরই কাকাবাবু! ভালো। কী করব তাহলে? আপনি শুধু জিজ্ঞেস করবেন, টিকিট পেয়েছে কি না। যদি বলে হ্যাঁ, তাহলে বলবেন, আমি মেট্রোর সামনে দাঁড়িয়ে থাকব। আসতে যেন দেরি না করে। বলবেন একা একা বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে খুব খারাপ লাগে। তোড়ে জল পড়ার শব্দের সঙ্গে বাথরুম থেকে গান ভেসে এলো—আমি বনফুল গো-ও।

হ্যালো! ভাইপো, আমার ভাইঝি, তোমার দিদি এখন স্নান ঘরে বনফুল। তুমি কি টিকিট পেয়েছ বাবা? হ্যাঁ পেয়েছি কাকাবাবু। তবে দুপুরের নয় বিকেলের। ওর সঙ্গে কথা ছিল দুপুরের। আপনি কাইন্ডলি সময় পরিবর্তনটা একটু বলে আসুন।

ফোন শেষ হলেও চান শেষ হয়নি। মেয়েদের স্নান হল জলহস্তীর স্নান। চলছে চলবে! হ্যাঁ টিকিট পেয়েছে। তবে ম্যাটিনির নয়, ইভনিং শোর। ও হাউ সুইট! ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে। কে সুইট, কাকাবাবু না সেই অদৃশ্য অজানা নারিকেল ভাইপো!

সামনের বাড়ির শিখার বাবা সেদিন খুব ঝাড় দিলেন। আপনি মশয় মিটমিটে শয়তান। ভদ্রলোক উত্তেজিত হলে খুব মশয় মশয় করেন। মুদ্রা দোষ। আমার অপরাধ? ইই আর এ ক্রিমিন্যাল। ছুপা রুস্তম। সে আবার কী? হিন্দি সিনেমা নাকি? আপনি একটা ভিলেইন। ভিলেনির কী দেখলেন? আমার মেয়ে শিখা আপনার বাড়ি থেকে ফোন করে? হ্যাঁ মাঝে মাঝেই করে, রোজই করে। কেন করতে দেন? সে কী! একবার রাত ন-টার সময় আপনার কে বন্ধু মাছ ধরার চারের ফর্মুলা জানবার জন্যে ফোন করেছিলেন। সেদিন আমার জ্বর। মাথার যন্ত্রণায় ছটফট করছি। বাইরে বৃষ্টি। আপনার মেছো ফ্রেণ্ডকে বলেছিলাম, ভাই কাল সকালে ফোন করুন। সেই বন্ধু পরে আপনাকে বলেছিলেন, সামনের বাড়ির লোকটা ছোটোলোক। অসামাজিক। পাড়া থেকে দূর করে দেওয়া উচিত। সঙ্গেসঙ্গে আপনি আমাকে তেড়ে এলেন। আপনার ছেলে রাস্তায় দেখা হলেই বলতে শুরু করল, টেকো চলেছে টেকো। শালার পয়সা হয়েছে। একদিন বসার ঘরে কাদা ছিটিয়ে দিয়ে গেল। দুর্গাপুজোয় গলায় গামছা দিয়ে এক-শো টাকা চাঁদা নিয়ে গেল। অসামাজিক নির্যাতনে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। আপনার মত আদর্শ সামাজিক মানুষের মেয়েকে টেলিফোনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে একঘরে হতে চাই না।

নোওও! ভদ্রলোক সকালের সাইরেনের মতো চিৎকার করে উঠলেন। বাই অ্যালাউয়িং শিখা টু ইউজ ইয়োর ফোন ইও আর এইডিং অ্যাণ্ড অ্যাবেটিং এ ক্রাইম। আপনার জানা উচিত এ বাজারে একটা আইবুড়ো মেয়ে যখন ফোন করে তখন কাকে করে? বয় ফ্রেণ্ডকে। বয় ফ্রেণ্ড মানে কি? লুটেরা। ভোমরা। ফুলে ফুলে মধু খাব কিন্তু পিঁড়েতে কভি নেহি বৈঠেগা। চোখের সামনে দেখছেন একটা মেয়ে চিটেড হচ্ছে, প্রেমের উপন্যাস আর হিন্দি ছবি দেখে ইশক ইশক বলে বলে লাফাচ্ছে, কোথাকার কে এক ডাঁশা ছেলেকে আপনারই টেলিফোনে ইনটিমেট হবার সুযোগ দিচ্ছে আর আপনি কি না যার গেল তার গেল বলে ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাঙ তুলে বসে আছেন? এই আত্মকেন্দ্রিকতার জন্যেই আমাদের সমাজ আজ উচ্ছন্নে যেতে বসেছে। যেহেতু আপনার মেয়ে নেই, সেই হেতু অন্যের মেয়ে সম্পর্কে আপনার কোনো ভাবনাই নেই। ব্যাট আই টেল ইউ, ওই ফোনে যখন আর একটা মেয়ে আপনার ছেলের কানে প্রেম ঢেলে আপনার খপ্পরের বাইরে নিয়ে গিয়ে গলায় মালাটি পরিয়ে আপনাকে কলাটি দেখিয়ে কেটে পড়বে তখনই বুঝবেন প্রেম কী ফেরোসাস জিনিস! যৌবন উত্তম জিনিস ততক্ষণই, যতক্ষণ বৃদ্ধদের কনন্ট্রোলে থাকে। ঘোড়ার লাগামটি গেল তো সবই গেল।

অফকোর্স! টেলিফোন হল এমারজেন্সি। আপনার ঘরে সাজিয়ে রাখার খেলনা নয়। সকলকেই ব্যবহার করতে দিতে হবে। কিন্তু সেন্সার করে। সিনেমা, টি ভি, রেডিয়ো, কাগজ শক্তিশালী জনসংযোগ মাধ্যম। কিন্তু! দেয়ার ইজ এ বাট। ভালোও করতে পারে খারাপও করতে পারে। সেই জন্যেই সেন্সার। স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে কথা বলবে, স্বামী স্ত্রীর সঙ্গে বলবে। ছেলে বন্ধু ছেলে বন্ধুর সঙ্গে কথা বলবে। মেয়ে বন্ধু মেয়ে বন্ধুর সঙ্গে। কিন্তু মশয় আমার স্ত্রী অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে কথা বলবে, কিংবা আপনি মশয় দুপুরে পরস্ত্রীকে খুঁচিয়ে তুলবেন, সে তো হতে পারে না।

খুব জ্ঞান বেড়ে গেল। এবার থেকে কাউকে টেলিফোনে আর প্রেম করতে দোব না। তিনি যে-ই হোন। অপসংস্কৃতি নট অ্যালাউড। পাশের বাড়ির ওপরের ফ্ল্যাটের ছেলেটি সবে বিয়ে করে আলাদা হয়ে এখানে এসে উঠেছে। মটোরবাইক চালায়। মাস্তান মাস্তান দেখতে। তবে শুনেছি ভালো চাকরি করে। মাঝে মাঝে বউকে পিছনে বসিয়ে ভটভট করে হাওয়া খেতে বেরোয়। সেই বউটি একদিন ঝোড়ো পাখির মতো ঘরে এসে ঢুকল, জ্যাঠামশাই, জ্যাঠামশাই একটা ফোন করব। টেলিফোনের কল্যাণে বয়েস উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে, কাকাবাবু, জ্যাঠামশাই, এইবার দাদু হব।

হ্যাঁ বা না-এর তোয়াক্কা কে করে। রিসিভার তোলো আর ডায়াল করো। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় ফোন করবে? দ্যাটস নট ইয়োর লুক আউট! কানে রিসিভার, আঙুল পাক মারছে ডায়ালে, একটা কলের চার্জ কত? দরকার হয় পয়সা বুঝে নিন বাট ডোন্ট বি সিলি। হ্যালো, সেজদি, শোন ভাই রিসিভারে হাত চাপা দিয়ে ধমকের সুরে আমাকে বললে, বাইরে গিয়ে বসুন। ইউ হ্যাভ নো কমন সেন্স। মেয়েদের কথা শুনতে খুউব ভালো লাগে, না! ও পাশের সেজদি বোধ হয় জিজ্ঞেস করেছে, কাকে বলছিস? ঘরের বাইরে যেতে যেতে শুনলুম বলা হচ্ছে, আর একটা আনম্যানারলি বুড়ো। মুখ দেখলেই মনে হয় কুচুটে। প্রায় ঘণ্টাখানেক সেজদির সঙ্গে কথা হল। দু-এক টুকরো ভেসে এল। এই বয়েসেই কান গরম হয়ে ওঠে। মেয়ের সবে বিয়ে হয়েছে। পৃথিবী এখন গোলাপী।

হারাধনবাবুর হোমিয়ো ডাক্তার গড়পারে থাকেন। হারাধনবাবুর শরীরের ওপর রোগের সাঁড়াশি আক্রমণ। রোগ মিলিয়ে এক ওষুধ এনে বসতে না বসতেই আর এক অসুখ প্রবল হয়ে ওঠে। উঠুক না, ক্ষতি কি! আমার ফোন আসায় অসুস্থ মানুষটির কত সুবিধে হয়েছে! ফোনে চিকিৎসা। রুগ্ন শরীর নিয়ে ট্রাম-বাস। বাস-ট্রাম করতে হচ্ছে না। বেঁচে থাকো বাবা; ভগবান তোমার মঙ্গল করুন।

হ্যাললো। হ্যাঁ কে ডাক্তার মনোরঞ্জন? ডক্টর মনোরঞ্জন মুখার্জী, এম.বি.বি.এস., এইচ.এম.বি। না? যা: রং নাম্বার হয়ে গেল। তুমি একবার দেখ তো ভাই। বুড়ো মানুষ, কী ঘোরাতে কী ঘুরিয়ে ফেলেছি। বয়েস হয়ে গেলে মানুষের চলে যাওয়াই ভাল; কিন্তু যেতে যে প্রাণ চাইছে না রে ভাই। মায়া, মায়া! আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। প্রথমে ভাবলুম পুত্রবধূর মুখ দেখছি, আর কী, এবার তো গেলেই হয়। সঙ্গেসঙ্গে মনে হল, না, আর ক’টা দিন, নাতির মুখ দেখে তারপর যেখানে যেতে হয় যাব। এরপর মনে হবে নাতবউ দেখব।

হ্যাঁ—হ্যালো। কে ডক্টর মুখার্জি। কথা বলুন।

পেয়েছ বাবা! ফোনটাকে এমনভাবে দু-হাত চেপে ধরলেন যেন জীবনদন্ড। হারাধন বলছি। রুগী নম্বর পাঁচ পাঁচ তিন। খাতাটা খুলুন। হ্যাঁ খাতাটা খুলুন। তেইশ তারিখে ওষুধ এনেছি। হ্যাঁ হ্যাঁ তেইশ। এক পুরিয়া খেয়েছি। খেলে কী হবে!

হারাধনবাবু ফোন তাঁর বহুবিধ অসুখের এক একটিকে ঝেড়ে-ঝুড়ে বের করতে লাগলেন। বিচিত্র সব রোগলক্ষণ। শুনলে গায়ে কাঁটা দিতে থাকে। বেঁচে থাকতে ভয় ভয় করে। বয়েস বাড়তে বাড়তে হারাধন হবার আগেই যেন হাসতে হাসতে কেটে পড়তে পারি প্রভু!

সামনের দিকে তিনখানা বাড়ি এগোলেই এক আদুরে পরিবার আছে। আদিখ্যেতায় ভরা। কর্তা, গিন্নি, একটি ফুটবলের মতো বাচ্চা মেয়ে। দোতলার দক্ষিণ খোলা ফ্ল্যাট। কর্তা বারান্দার রেলিঙে হাতের ভর রেখে সিগারেট খান। পরনে ডোরাকাটা স্লিপিং গাউন। কোমরে ট্যাসেলের ফাঁস। শাম্পু করা বাদামী রঙের ফুরু ফুরু চুল। গোলগাল, ফুলোফালা ঘুম ঘুম মুখ। বারান্দায় কর্তার গায়ে ঠেসান দিয়ে গিন্নি দাঁড়িয়ে থাকেন। পিঠে এলোচুল। হাতকাটা গাঢ় বেগুনি ব্লাউজ। লতাপাতা আঁকা শাড়ির আঁচল বুক থেকে খুলে বারান্দার রেলিঙে শেফালী তোমার আঁচলখানি বিছাও, শারদ প্রাতের মতো লুটিয়ে থাকে। মেয়েটি থাকে দু-জনের মাঝখানে। ইংরেজিতে কথা চলে, ও, নো, নো, নো, বান্টি, সেহেব্যার্ড নট বার্ড! দ্যাটস আগলি। রাস্তার লোক মুখ তুলে চায়। রাস্তার মাথার ওপর সাইনবোর্ডের মতো ঝুলে থাকেন এই সুখী পরিবার। সিগারেট, ধোঁয়া শাড়ি, গাউন, চুল, যৌবন, চিবিয়ে চিবিয়ে কথা, সব মিলিয়ে আমাদের পথের ধারে—কপোত-কপোতী যথা উচ্চ বৃক্ষচূড়ে।

ওই বেগুনি মহিলা হঠাৎ তাঁর আদুরী মেয়েকে নিয়ে বিকেলের দিকে হাজির। বিলাইতি সেন্টের মতো কেমন করানো গন্ধ। মিহি ছুরির মতো কথা। করাতকলের কাঠ কাঠার সময় যেমন শব্দ হয় সেইরকম শব্দ। এক্সকিউজ মি। কেন এক্সকিউজ কেন? কী করেছেন আপনি? আর কিছু করে থাকলেও আপনি করেননি, করেছেন আপনার স্বামী। ওভাবে রাস্তায় জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরো ছোঁড়া উচিত নয়।

ও, নো নো, সে এক্সকিউজ নয়। এ হল কথার কথা। অ্যাংলো বেঙ্গলি সমাজের রীতিই হল, কথা শুরু করার আগে এক্সকিউজ মি বলা। ধাক্কা মেরে চলে যাবার সময় বা এগিয়ে যাবার সময় এক্সকিউজ মি বলা। পা মাড়িয়ে দিয়ে, সুটকেসের খোঁচা মেরে চোখে আঙুল গুঁজে দিয়ে সরি বলা। ভদ্রসমাজের নিয়মই হল, সরি বললে সাতখুন মাফ। আমার হাত ফসকে একবার একটা ফুলগাছের টব রাস্তায় এক ভদ্রলোকের ঘাড়ে পড়ে গিয়েছিল। দোতলা থেকে পড়েছে। আমি বুঝতে পারছি ঘাড়ে পড়বে, ভীষণ লাগবে। চিৎকার করে তিনবার বললুম সরি, অ্যাম সরি, ড্যাম সরি। রাস্তায় লোক জড়ো হয়ে গেল। চিৎকার, চেঁচামেচি, সাংঘাতিক ব্যাপার। অশিক্ষিতের দেশ তো। ম্যানারস জানে না। আদব কায়দা জানে না। আমি তখন খুব রেগে গিয়ে বললুম, আন্তর্জাতিক নিয়ম জানেন না আপনারা, সরি বলার পর আর কিছু করার থাকে না। যান, ভদ্রলোককে হাসপাতালে নিয়ে যান। নেহাত অজ্ঞান হয়ে গেছেন তাই তো জ্ঞান থাকলে উনিও বলতেন, সরি, সরি। আফটার সরি দেয়ার শুড বি নো ওয়ারি। হ্যাঁ, আর একটা জিনিস জেনে রাখুন, হঠাৎ হেঁচে ফেললে সরি বলতে হয়। আমার এমন অভ্যাস হয়ে গেছে বাথরুমে হেঁচে ফেললেও সরি বলি। এটা হল সেই এক্সকিউজ মি।

এক্সকিউজ মি?

এ মা! কী বোকা? আপনি এক্সকিউজ মি বলবেন না। আপনি হাসি হাসি মুখে শুধু শুনে যাবেন।

আমি মুখে হাসি মেখে শুনতে লাগলুম, তিনি বলতে লাগলেন—

আমার এই মেয়েটা বাবাকে ছেড়ে এক মিনিটও থাকতে পারে না। কী মুশকিল বলুন তো? এক ধরনের ফাদার কমপ্লেক্স।

তা আমাকে কী করতে হবে?

না না, ও রকম রুডলি কথা বলবেন না। একজন মহিলার সঙ্গে নরম গলায়, হেসে হেসে, ওবলাইজিংলি কথা বলতে হয়। চোখের দৃষ্টিতে একটা সপ্রেম ঝিলিক থাকবে।

চোখে প্রেমের ঝালর ঝুলিয়ে বললুম, বলুন কী করতে পারি?

এই মেয়ে তিনবার আসবে, একবার বারোটার সময়, একবার তিনটের সময়, একবার ছ’টার সময়। আপনার ফোনে বাবার সঙ্গে কথা বলবে। ক-টা দিন। তারপর তো আমরা কোম্পানির দেওয়া কোয়ার্টারে চলে যাব। বান্টি। বা-আ-ন্টি? কাম হিয়ার। ওই যে ফোন। টু থ্রি ফোর নাইন। মুকার্জি প্লিজ। মুকু! এই নাও তোমার আদরের মেয়ে। কী মেয়েই যে হয়েছে বাবা! শোনো তুমি বাপু চাকরি-বাকরি ছেড়ে দাও। মেয়ে কোলে নিয়ে সারাদিন বাড়িতে বসে থাকো। আমি আর পারছি না বাবা। অ্যাঁ, কি বললে! আমার মেয়ে! আমার মতোই হবে! ও নো, নো, অসভ্যতা কোরো না।

সেই মেয়ে! যেমন একগুঁয়ে তেমনি বায়নাদার। ফোন ধরলে আর ছাড়তে চায় না। কেড়ে নিতে গেলে চিল চেঁচায়, খ্যাঁক খ্যাঁক করে কামড়ে দেয়। বুকের কাছে দু-হাতে রিসিভার চেপে ধরে দেয়ালে পিঠ ঠেসে ঘাড় কাত করে বলে, আমার ফোন, আমার বাবা ফোন।

এই হল আমার বাঁশ নম্বর এক। আজকাল মাঝে মাঝেই মাঝরাতে অন্ধকার বসার ঘর থেকে থেকে ফোন বাজে। আমি জানি কে? একটি বৃদ্ধ মানুষের কন্ঠস্বর ভেসে আসবে। নাম নেই ধাম নেই, যেন প্রেতকন্ঠ!

হ্যালো! কী হল আজও ঘুম আসছে না?

না। তুমিও তো দেখছি জেগে আছ!

আমারও যে আসছে না।

আসবে না ভাই, ঘুম আর আসবে না। আমাদের দিনের পাপ যত বাড়ছে রাতের বিবেক তত আসছে।

কেমন হল?

কী কেমন হল?

ময়দানে খেলার নামে নরবলি। চোদ্দোটা তাজা প্রাণ চলে গেল। সংবাদ বিচিত্রায় অজয়ের বাবার আর্ত চিৎকার শুনেছ?

শুনেছি।

বলো, ঘুমোনো যায়? জেগে থাক, জেগে থাক। সজাগ থাক। ঘুমোলেই মরবে। নাগিনীরা ফেলিতেছে চারিদিকে বিষাক্ত নিশ্বাস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *