টেলিফোন
ক্রিং, ক্রিং, ক্রিং!…
ঝট করে ভেঙে গেল ঘুম। টেলিফোনের ঘণ্টা!
সঙ্গে সঙ্গে শুনলুম ঘরের দেওয়াল-ঘড়িটা চিৎকার করছে ঢং, ঢং, ঢং, ঢং…
একে-একে গুণলুম রাত বারোটা— তন্দ্রাকাতর চোখ না খুলেই।
আরও দুটো শব্দ এল কানে— গড় গড় গড় গড় বজ্রের গর্জন এবং ঝুপ ঝুপ ঝুপ ঝুপ বৃষ্টির পতন!
ক্রিং, ক্রিং, ক্রিং, ক্রিং…
নিজের ডাক্তারি জীবনকে ধিক্কার দিতে দিতে ধড়মড় করে উঠে বসলুম বিছানার ওপরে। এই সলিলাক্ত দুপুর রাত্রি, নিশ্চয় কোনো রোগী—
ক্রিং, ক্রিং, ক্রিং, ক্রিং…
বিছানা ছেড়ে নেমে ‘রিসিভার’টা তুলে নিয়ে সাড়া দিলুম, ‘হ্যালো!’
‘ডাক্তার?’
‘হ্যাঁ।’
‘ডাক্তার, ডাক্তার, ডাক্তার! শিগগির আসুন, শিগগির!’
‘কোথায়?’
‘আমার বাসায়। সাত নম্বর সাতকড়ি লেন স্ট্রিট।’
‘অসুখটা কী?’
‘আমি এখনি মারা যাব! আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে! আমি আর কথা কইতে পারছি না! শিগগির এসো, শিগগির! ডাক্তার!’
আর কোনো সাড়া নেই। রিসিভারটা রেখে দিয়ে কী করব ভাবতে লাগলুম। জানলার ওপরে শোনা গেল দমকা ঝোড়ো বাতাসের করাঘাত। কিন্তু শেষটা যাওয়াই স্থির করলুম।
গাড়ির ভেতর থেকেই টর্চের আলো ফেলে আবিষ্কার করলুম সাতকড়ি সেন স্ট্রিটের সাত নম্বরকে।
একখানি পুরোনো ছোটোখাটো দোতলা বাড়ি। প্রত্যেক জানলা— এমনকী সদর দরজা পর্যন্ত ভেতর থেকে বন্ধ। দরজা-জানলার ফাঁকফোকর দিয়ে দেখা যাচ্ছে না একটিমাত্র আলোকরেখাও।
এত রাত্রে ড্রাইভারের ঘুম ভাঙাইনি, নিজেই এসেছি গাড়ি চালিয়ে। ব্যাগটা পাশ থেকে তুলে নিয়ে রাস্তায় গিয়ে নামলুম—
রাস্তায় গিয়ে নামলুম? একী রাস্তা, না বেগবতী স্রোতবস্বতী? কলকল করে ছুটন্ত জল ধাক্কা মারছে হাঁটুর ওপর পর্যন্ত উঠে। যেদিকে তাকাই, চিহ্ন নেই জনপ্রাণীর— এ যেন মানুষের পৃথিবীই নয়! কেবল মানুষ কেন, পথচারী কুকুর-বিড়াল এবং রাত্রির পেচক-বাদুড়রাও যেন আজকের এই পৃথিবী ছেড়ে পলায়ন করেছে কোথায়, কেউ জানে না। কেবল দীপ্তনেত্র গ্যাস-পোস্টগুলো পায়ের তলায় নিজেদের অভাবিত প্রতিবিম্ব দেখে দাঁড়িয়ে আছে স্তম্ভিতের মতো।
হু-হু-হু-হু! কী কনকনে ভিজে বাতাস! ঝম-ঝম-ঝম-ঝম! ও বৃষ্টি, না নৈশ প্রেতিনিদের পায়ের মলের শব্দ?
শীতে কাঁপতে-কাঁপতে সাত নম্বর বাড়ির কাছে গিয়ে সদর দরজার কড়া নাড়তে লাগলুম সজোরে।
হঠাৎ খুলে গেল দরজাটা। বাড়ির ভেতরটাও অন্ধকার। কে দরজা খুললে দেখবার জন্যে ‘টর্চ’ ব্যবহার করলুম, কিন্তু কারুকেই আবিষ্কার করতে পারলুম না।
ভাবলুম, বোধ হয় কোনো অন্তঃপুরিকা এসে দরজা খুলে দিয়েই তাড়াতাড়ি আবার ভেতরে চলে গিয়েছেন।
কিন্তু কী মুশকিল, এরা ডাক্তারকে ডাক দিয়েছে অথচ বাড়ির ভেতরে একটা লণ্ঠন পর্যন্ত জ্বেলে রাখেনি!
অন্ধকারেই বাড়ির ভেতরে দুই-চার পা এগিয়ে গলা তুলে বিরক্তভাবে বললুম, ‘মানুষের চোখ অন্ধকারে চলে না। একটা আলো দেখাবার ব্যবস্থা করুন।’
অত্যন্ত গম্ভীর এবং অত্যন্ত কর্কশ কণ্ঠে কে বললে, ‘আলো নেই। আলো দেখাবার লোকও নেই। টর্চ জ্বেলে এগিয়ে আসুন। ডানদিকেই সিঁড়ি। দোতলায় উঠে বাঁ-দিকের প্রথম ঘরেই রোগীকে দেখতে পাবেন।’
কে কথা কইছে? কোথা থেকে কথা কইছে? চারদিকে টর্চের আলো ফেলতে লাগলুম। সামনে দেখা গেল কেবল একটা সরু পথ। তার ওপরে ছাদ, দুই পাশে দুই দেওয়াল। কোথাও মানুষের ছায়া পর্যন্ত নেই। যে কথা কইলে সে নিশ্চয় আমাকে দেখতে পেয়েছে, নইলে আমার টর্চের উল্লেখ করত না। কিন্তু আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?
‘ডাক্তার, ডাক্তার! নির্বোধের মতো দাঁড়িয়ে রইলে কেন? ওপরে এসো— ওপরে এসো!’ অপার্থিব কণ্ঠস্বর— আসছে যেন খুব কাছ থেকে, আসছে যেন বহু দূর থেকে!
বুকের কাছটা করতে লাগল ছমছম ছমছম। সদর দরজাকে সশব্দে নাড়া দিয়ে আচম্বিতে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল বৃষ্টির কান্নাজল-মাখানো খানিকটা দমকা হাওয়া।
আমি আর দাঁড়ালুম না। নিজের দুর্বলতায় নিজেই লজ্জিত হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চললুম। ডানদিকের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলুম এবং উঠতে উঠতে সবিস্ময়ে লক্ষ করলুম, সিঁড়ির প্রত্যেক ধাপে জমে রয়েছে প্রায় আধ-ইঞ্চি পুরু ধুলো। সেই ধুলোর ওপরে নেই একটিমাত্র পদচিহ্ন। যেন বহুকালের মধ্যে এই সিঁড়ির ওপর দিয়ে কোনো মানুষই ওঠা-নামা করেনি!
আর একটা ব্যাপার অনুভব করলুম। আমার চারদিক ঘিরে যেন কোনো মৃত বা জীবন্ত অদৃশ্য বিভীষিকার ধারণাতীত উপস্থিতি! যেন আমার প্রত্যেক পদক্ষেপ লক্ষ করছে তার জাগ্রত চক্ষুহীন দৃষ্টি!
থেকে থেকে আমার গা এমন শিউরে-শিউরে উঠতে লাগল যে আবার থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে ভাবতে লাগলুম, অতঃপর এই অস্বাভাবিক বাড়ি ত্যাগ করে আবার বাইরে বেরিয়ে যাওয়া উচিত কিনা?
আবার কে যেন ব্যঙ্গের স্বরেই বললে, ‘ডাক্তার, কত মড়ার হাড় নেড়েচেড়ে রাতের-পর-রাত কাটিয়েছ, কত পচা-গলা মড়ার দেহ কেটে কেটে ডাক্তারি পাস করেছ, তবু তুমি ভয় পাচ্ছ কেন?’
মনের ভাব লুকোবার জন্যে জোর দিয়ে সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে বললুম, ‘আমি ভয় পাইনি!’
‘কিন্তু তুমি কাঁপছ!’
‘ঠান্ডা হাওয়ায় আমার শীত করছে।’
কানে এল একটা শুকনো ও চাপা বিশ্রী হাসির আওয়াজ।
দারুণ ক্রোধে জেগে উঠল আমার পুরুষত্ব। বেশ চেঁচিয়েই বললুম, ‘কারুর হাসি শোনবার জন্যে আমি এখানে আসিনি, আমি এসেছি রোগী দেখতে।’
বাঁ-পাশের ঘরের ভেতর থেকে শোনা গেল, ‘উত্তম! ভেতরে এসো দরজা খুলে।’
দরজায় ধাক্কা মারলুম, খুলল না।
‘দেখতে পাচ্ছ না, দরজায় বাইরে থেকে শিকল-তোলা আছে?’
তাই বটে। শিকল নামিয়ে ঠেলা মেরে দরজা খুলতেই ভেতর থেকে বেগে বেরিয়ে এল যেন হিমালয়ের তুষার মাখানো বাতাসের একটা ঝটকা। ঠকঠক করে কাঁপতে-কাঁপতে আবার পিছিয়ে এলুম।
সেই ভয়াবহ কণ্ঠ ততোধিক ভয়াবহ যন্ত্রণাবিকৃত স্বরে বলল, ‘এসো, এসো, আর দেরি কোরো না! আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে— আমি আর কথা কইতে পারছি না— ডাক্তার, ডাক্তার!’
নিজেকে সামলে নিয়ে ভেতরে গিয়ে দাঁড়ালুম। ঘুটঘুট করছে অন্ধকার। নাকে লাগল গলিত শবের দুর্গন্ধ। সেটা আমলে না এনে ‘টর্চ’ জ্বালবার উপক্রম করতেই কে বলল, ‘আলো জ্বেলো না ডাক্তার, আলো জ্বেলো না!’
‘কেন?’
‘আতঙ্কে আঁতকে উঠবে, মূর্ছিত হয়ে পড়ে যাবে!’
এখানে কোনো পাগল কি লুকিয়ে লুকিয়ে আমার সঙ্গে কথা কইছে? না কেউ আমার সঙ্গে ‘প্র্যাক্টিকাল জোক’ করতে চায়? অধীরকণ্ঠে বললুম, ‘কী আশ্চর্য, আলো না জ্বাললে আমি রোগীকে পরীক্ষা করব কেমন করে?’
‘তবে জ্বালো আলো!’
জ্বাললুম।
ময়লা চাদরে মোড়া বিছানার ওপরে নিশ্চেষ্টভাবে পড়ে রয়েছে একটা সুদীর্ঘ দেহ। দেখলে বোঝা যায় সেটা অনেক দিনের পুরাতন মৃতদেহ, অথচ পচে বা গলে যায়নি! কিন্তু কী ভীষণ তার মুখমণ্ডল! ভুরু দুটো উঠে গিয়েছে কপালের অনেকটা ওপরে এবং দুই কোটরের মধ্যে চক্ষু দুটো যে কত নীচে তলিয়ে গিয়েছে, দেখতেই পাওয়া যায় না! এমনভাবে সে মুখব্যাদান করে আছে যে দেখলেই বুকটা ছাঁৎ করে ওঠে! এবং সবচেয়ে ভয়ানক দৃশ্য হচ্ছে, তার মুখগহ্বরের ভেতর থেকে কিলবিল করতে করতে বেরিয়ে আসছে সার বেঁধে পোকার-পর-পোকা!
স্তম্ভিত নেত্রে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। হে ভগবান, এই কি আমার রোগী?
‘ডাক্তার, ডাক্তার! এ যমযন্ত্রণা আর সইতে পারছি না যে! শিগগির এসো— দেখতে পাচ্ছ না, আমাকে আক্রমণ করেছে দলে দলে নরকের কীট? এই পোকাগুলিকে তাড়িয়ে দাও, এই পোকাগুলিকে তাড়িয়ে দাও— উঃ!’
বেশ বুঝতে পারলুম, সেই রোমাঞ্চকর অমানুষিক কণ্ঠস্বরটা বেরিয়ে আসছে ওই হাঁ-করা মুখবিবরের ভেতর থেকেই। এবং তারও চেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার এই যে, মুখের ভেতর থেকেই কণ্ঠস্বর নির্গত হচ্ছে বটে, কিন্তু একটুও নড়ছে না মূর্তির ওষ্ঠাধর!
স্তম্ভিত ভাবের ভেতর দিয়ে কেটে যেতে লাগল মুহূর্তের-পর-মুহূর্ত!
তারপর চোখের সামনে স্পষ্ট দেখলুম, মৃতদেহটা টলমল করতে করতে উঠে বসছে আস্তে, আস্তে, আস্তে! কিন্তু তার উঠে বসবার ভঙ্গি দেখলে মনে হয়, সে যেন নিজে উঠে বসছে না, কেউ যেন তাকে ধরে ধরে তুলে বসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে— তার মাথাটা পড়েছে কাঁধের ওপরে লুটিয়ে আর তার হাত দুটো করছে ঝল-ঝল-ঝল-ঝল! কিন্তু যে তাকে তুলে বসাতে চায়— সে কোথায়, সে কোথায়! সে যে একেবারেই অদৃশ্য!
আচম্বিতে মৃতদেহটার কাঁধের ওপরে লটকে পড়া মুণ্ডটা ধীরে ধীরে সিধে হয়ে উঠল এবং ধীরে ধীরেই ফিরল আমার দিকে এবং তার দৃষ্টিহীন চক্ষু কোটরের অনেক তলা থেকে চক-চক করতে লাগল যেন দুটো রাঙা আগুনের ফিনকি!
হঠাৎ যেন একটা বিদ্যুৎ প্রবাহে কেটে গেল আমার সমস্ত আচ্ছন্নভাব! এক লাফে ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে ক্রমে উঠি-কী-পড়ি এমনিভাবে সশব্দে নেমে এলুম নীচের দিকে—
—এবং সঙ্গে-সঙ্গে পিছনে পিছনে ছুটে এল সেই অলৌকিক কণ্ঠস্বর, ‘ডাক্তার, ডাক্তার ডাক্তার, ডাক্তার!’
দিনতিনেক পরে সাহস সঞ্চয় করে এক সকালে কৌতূহলী মনে আবার হাজির হলুম সাত নম্বর সাতকড়ি সেন স্ট্রিটে।
দেখলুম বাড়ির সদর দরজায় তালা দেওয়া এবং বাড়ির দেওয়ালে ঝুলছে ভাড়াপত্র ‘এই বাড়ি ভাঙা দেওয়া যাইবে।’
অবাক হয়ে ভাবছি, এমন সময় পিছন থেকে শুনলুম, ‘ডাক্তারবাবু এখানে কেন?’
ফিরে দেখি আমারই পরিচিত লোক, এই অঞ্চলেই তাঁর বাসা। বললুম, ‘দিনতিনেক আগে এই বাড়িতে এক রোগী দেখতে এসেছিলুম। কিন্তু আজ দেখছি সদরে তালা দেওয়া।
তিনি বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, বাড়ি ভুল করেছেন। এ-বাড়ি আজ এক বৎসর ধরে খালি পড়ে আছে। বাড়িখানার ভারি বদনাম, কেউ ভাড়া নিতে চায় না।
আসল কথা চেপে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘এ-বাড়ির শেষ ভাড়াটে কে?’
‘ভুবনেশ্বরবাবু।’
‘তিনি এখন কোথায়?’
‘পরলোকে।’
‘এই বাড়িতেই তিনি মারা যান?’
‘হ্যাঁ। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ায় হঠাৎ তিনি মারা পড়েন। তাঁর আত্মীয়স্বজন কেউ ছিল না, পাড়ার লোকেরাই উদ্যোগী হয়ে সৎকারের ব্যবস্থা করে।’
কিন্তু পরলোকেও কি টেলিফোন-যন্ত্রের ব্যবস্থা আছে?
কারণ ভুবনেশ্বরবাবু তারপরেও বার কয়েক আমার সঙ্গে সংযোগস্থাপন করেছিলেন।
প্রতি শনিবারেই রাত বারোটায় ফোনের ঘণ্টা বেজে ওঠে, আর সেই ভয়ানক কণ্ঠস্বরে শুনি ‘ডাক্তার, ডাক্তার, ডাক্তার! শিগগির এসো, শিগগির!’
ভুবনেশ্বরবাবু আজও আমাকে ডাকাডাকি করেন কি না জানি না, কারণ, এখন শনিবার রাত্রে টেলিফোনের ডাকে আমি আর সাড়া দিই না।