টেলিফোন
স্বৰ্গত ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের একটি অসামান্য কৌতুকনকশা ছিল, যেখানে এক গ্রাম্য ব্যক্তি জীবনে প্রথমবার টেলিফোন ধরেছে। সে অবশ্য প্রথমে ধরতে চায়নি, কিন্তু টেলিফোনটির কাছাকাছি কোনও লোক ছিল না এবং রিসিভারটি ক্রমাগত বেজেই চলেছে, ফলে বাধ্য হয়েই সে রিসিভারটি তোলে। তখন অপর প্রান্ত থেকে যিনি ফোন করছেন, তিনি যথারীতি বলেছেন, ‘হ্যালো।’ এই গ্রাম্য ব্যক্তিটি, যে এ প্রান্তে ফোন ধরেছে, সে ভেবেছে তাকে হেলতে বলা হয়েছে। সুতরাং সে একটু কাত হয়েছে। আবার ও প্রান্ত থেকে ‘হ্যালো’ বলেছে আর এই ব্যক্তিটি আরও একটু কাত হয়েছে। যত ‘হ্যালো’ শুনছে, তত কাত হয়ে যাচ্ছে, মুখে কিছু বলছে না, ফলে ও-প্রান্ত থেকে ক্রমাগত ‘হ্যালো, হ্যালো…’ হয়ে যাচ্ছে, এ লোকটিও কাত হতে হতে একদম মেজেতে শুয়ে পড়েছে এবং তখন বলছে, ‘আর হেলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, হেলতে হেলতে আমি চিত হয়ে গেছি।’
আমার বর্ণনার ত্রুটির জন্যে হয়তো এই নকশাটিকে কারও কারও একটু মোটা দাগের মনে হতে পারে, কিন্তু ভানুবাবুর অননুকরণীয় প্রসাদগুণে অসম্ভব কৌতুকের সৃষ্টি হত এই উপস্থাপনায়।
টেলিফোন প্রসঙ্গে আমার অবস্থা ওই কৌতুকনকশার গ্রাম্য ব্যক্তিটির চেয়েও খারাপ। আমি টেলিফোনে কোনও কথা বুঝতে পারি না, বলতেও পারি না। বলতে পারি না তার কারণ আমার অস্বাভাবিক ভারী গলা, যা টেলিফোন যন্ত্রের মাধ্যমে আরও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। আমার সবচেয়ে বড় অসুবিধে হল যে, আমি কিছুতেই আস্তে কথা বলতে পারি না। এই অস্বাভাবিক কণ্ঠস্বর, তারপর চেঁচিয়ে, তারপর ফোনে, ওদিকে যিনি থাকেন তাঁর অবস্থা অকল্পনীয়। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে একবার ফোনে কথা বলছিলাম। দু’জনের মধ্যে ব্যবধান ডালহৌসি স্কয়ার থেকে প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, নীরেন্দ্রনাথ আমার চেঁচানি শুনে আমাকে উপদেশ দিয়েছিলেন, ‘শুধু শুধু টেলিফোন কোম্পানিকে পয়সা দিয়ে লাভ কী? তার চেয়ে ফোনটা নামিয়ে রেখে কথা বলো, আমি বেশ শুনতে পাব।’
বাড়িতে বা অফিসে আমি কখনওই পারতপক্ষে ফোন ধরি না, বিশেষ নিরুপায় না হলে ওই গ্রাম্য ব্যক্তিটির মতো ফোনের ক্রিং ক্রিং এড়িয়ে চলি। অবশ্য আমাদের বাড়িতে ফোন ধরার সুযোগও খুব কম। যেদিন প্রথম আমাদের সংসারে ওই যন্ত্রটি এল সেদিন থেকে ফোন বাজা মাত্র আমার ছোট ভাই এবং ছেলে দু’জনে পাগলের মতো ছুটে যায় ফোন ধরতে। ফোন বেজে চলে, এদিকে দু’জনের মধ্যে যাকে বলে ধ্বস্তাধ্বস্তি, মারামারি। ইতিমধ্যে আমাদের কাজের লোকটিও এই ফোন ধরার প্রতিযোগিতায় যোগদান করেছে। এদের মারামারি ও গোলমালে কত দরকারি ফোন যে চাপা পড়েছে, ধরাই হয়নি। আবার হয়তো ধরা হল, কিন্তু যিনি ফোন করেছেন, তিনি আমাদের দিক থেকে গোলমাল, চেঁচামেচির শব্দ শুনে ভয় পেয়ে নিঃশব্দে ছেড়ে দিয়েছেন।
প্রথমে ভেবেছিলাম এটা সাময়িক উত্তেজনা। কালক্রমে ধীরেসুস্থে দূর হয়ে যাবে। কিন্তু বেশ কয়েক বছর হতে চলেছে টেলিফোন লড়াই এখনও পূর্ণগতিতে চলেছে। আমি একবার জানতে চেয়েছিলাম, ওরা এ রকম কেন করে? আমার ভাই বলেছে, রং নাম্বার হলে মনের সুখে গালাগাল দেবে সেই জন্য। আমার ছেলে বলেছে, বিশেষ কোনও কারণে নয়, তবে কেন যেন টেলিফোন বেজে উঠলেই তার মাথায় রক্ত উঠে যায়, সে দিশেহারা বোধ করে। আর পরিচারকটি বলেছে, দাদাবাবু আর কাকাবাবু ও রকম করে বলে সেও ও রকম করে।
নিজের বাড়ির ফোনের কথা থাক। এক বন্ধুর বাড়িতে দেখেছি বন্ধুপত্নী প্রায় ঘণ্টাখানেক ফোনে কথাবার্তা বলার পর অবশেষে ক্লান্ত হলেন। অপর পক্ষকে জানালেন, ‘ভাই একটু ধরো। কানটা বদলিয়ে নিই।’ বলে ফোনটি ডান কান থেকে বাঁ কানে ঘুরিয়ে নিলেন। আরও কিছুক্ষণ কথা বলার পরে আলাপ শেষ হল। ভদ্রমহিলা টেলিফোনটা নামিয়ে রেখে সবে উঠেছেন, ইতিমধ্যে আরেকটি ফোন এল। তিনি আবার গিয়ে ফোন ধরলেন। ঘরের অপর প্রান্তে আমরা বসে গল্প করছিলাম, ভদ্রমহিলার স্বামী মানে আমার বন্ধুটি, চাপা গলায় বললেন, ‘আবার এক ঘণ্টা।’ কিন্তু পতিদেবতার ভবিষ্যৎ-বাণী নস্যাৎ করে দিয়ে এবারের আলাপ মাত্র দশ মিনিটের মধ্যে সাঙ্গ করলেন। বন্ধুপত্নী ফোন রেখে উঠে আসতে আমি রঙ্গ করে বললাম, ‘এত তাড়াতাড়ি কথা ফুরল?’ ভদ্রমহিলা ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘কী আর কথা বলব? এটা যে রং নম্বর ছিল।’
রং নম্বর কোনও এক যুগে বেশ রোমান্টিক ব্যাপার ছিল। তখন রং নম্বরের সুযোগ কম ছিল, টেলিফোন তখনও স্বয়ংক্রিয় হয়নি, নম্বরের জন্য এক্সচেঞ্জে টেলিফোন সহায়িকার উপর নির্ভর করতে হত। তিরিশের, চল্লিশের দশকে বাঙালি টেলিফোন-মহিলা আধুনিতার প্রতীক। তাঁদের নিয়ে কত গল্প, উপন্যাস, সিনেমা। পাড়ায় একজন মহিলা টেলিফোন অপারেটর থাকলে সমস্ত লোক অবাক হয়ে তাঁর যাতায়াত, কথাবার্তা পর্যবেক্ষণ করত। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘দূরভাষিণী’ এখনও অনেকেরই হয়তো মনে আছে।
অটোমেটিক হওয়ার পর থেকে টেলিফোনের সেই রোমান্টিক যুগ শেষ হয়েছে। এখন দূরভাষণ একটি প্রয়োজনীয় বিরক্তি। রং নম্বরে রং নম্বরে গ্রাহক সদা অতিষ্ঠ। অবশ্য যদি যন্ত্রটি চালু থাকে। যন্ত্রটি চালু না থাকলে, যা প্রায়শই হয়, অবশ্য রং নম্বরের ভয় নেই। আর এই ভুল নম্বর যখন হতে থাকে ক্রমাগতই হতে থাকে। একই লোক একই ভুল নম্বর বারবার পেতে থাকে। একবার এইরকম একটি লোক ক্লান্ত হয়ে আমাকে আমার ফোন নম্বর জিজ্ঞাসা না করে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘দাদা, এটা কি রং নম্বর?’ আমি কিছু না বুঝতে পেরে বলেছিলাম, ‘হ্যাঁ।’ সঙ্গে সঙ্গে লোকটি ফোন নামিয়ে রাখল। একটু পরে আবার ক্রিং ক্রিং, আবার সেই প্রশ্ন, ‘দাদা, এটা কি রং নম্বর?’ ক্রমাগত চলতে লাগল। আমি মরিয়া হয়ে গেলাম, ওদিকের লোকটিও তাই। কিন্তু শেষে সে আর পারল না, উনত্রিশ বারের মাথায় যখন আমি আবার জানালাম, হ্যাঁ, এটা রং নম্বর’, তখন ও প্রান্তে স্পষ্ট একটা গুলির শব্দ শোনা গেল এবং তারপরেই হাত থেকে রিসিভার মেজেতে পড়ে যাওয়ার আওয়াজ। বোধহয় লোকটা এত চেষ্টা করেও সঠিক নম্বর না পাওয়ায় হতাশ হয়ে আত্মহত্যা করল।
নবনীতা দেবসেনের বাড়িতে একবার গভীর রাতে একটা খুব গোলমেলে রং নম্বর এসেছিল। গলার স্বর এবং ইংরেজি উচ্চারণ শুনে নবনীতা বুঝতে পারে এটা একটা মাদ্রাজি মাতাল। আমরা জানতে চাই, ‘মাতাল বোঝা গেল কী করে? আর মাদ্রাজিই বা কেন?’ নবনীতা বলল, ‘ব্যাপারটা খুব সোজা। লোকটা পাঁচ সংখ্যার নম্বর চাইছিল; কলকাতা, বোম্বে, দিল্লি সব ছয় সংখ্যার নম্বর। আর তা ছাড়া মাতাল ছাড়া আর কে মধ্যরাতে অন্য শহরের রং নম্বর চাইবে?’
ফোনের গল্প অনেক। ব্যাপারটা সেই জন্য সাহিত্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখছি। কয়েকদিন আগে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে দেখেছি ফোনে ক্রিং ক্রিং বাজা মাত্র বাড়িসুদ্ধ সবাই, এমনকী শক্তির মতো দুঃসাহসী লোক পর্যন্ত চমকে চমকে উঠছে। কী ব্যাপার, এত ভয় কীসের? কোনও দুঃসংবাদ আসার আশঙ্কা করছে নাকি অথবা কোনও দুর্দান্ত লোকের শাসানি? শুনলাম তা নয়, টেলিফোনটা ধরতে গেলেই সাংঘাতিক শক দিচ্ছে, বৈদ্যুতিক শকের চেয়েও তীব্র। ফোন বাজলে ধরতে হবে, ধরলেই শক। এই ভয়ে সবাই অতিষ্ঠ। এর আগে কিংবা পরে, আর কোথাও এমন শকিং ফোনের কথা শুনিনি, শিবরাম চক্রবর্তী বেঁচে থাকলে হয়তো বলতেন শক থেকেই শক্তি।
এই শক তবু সহ্য করা যায়। কিন্তু একধরনের টেলিফোন কিন্তু প্রচণ্ড বিরক্তিকর। কিছুতেই আত্মপ্রকাশ করবে না, নাম বলবে না। ভাঙা ন্যাকা গলায়, ‘বলো তো, আমি কে বলছি? চিনতে পারছ না তো? কী করে চিনবে বলো? কতদিন পরে, কত রোগা হয়ে গেছি, মাথায় এতবড় টাক পড়েছে, সত্যি চিনতে পারছ না?’ এসব লোকের টেলিফোন নামিয়ে রাখা ছাড়া উপায় নেই।
পুনশ্চ: টেলিফোনে ক্রস কানেকশন থেকে দ্রুত অব্যাহতি পাওয়ার আমার একটি ফর্মুলা আছে। পরীক্ষা করে দেখতে পারেন, শতকরা নব্বই ভাগ ক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গে ফল পাওয়া যাবে। ফোন তুলে ডায়াল টোন পেয়েই শুনলেন লাইনে কারা কথা বলছে কিংবা আপনি কথা বলতে বলতে লাইনে কাদের বাক্যালাপ চলে এল। এদের লাইন ছেড়ে দিতে অনুরোধ করে কোনও লাভ নেই। বরং সঙ্গে সঙ্গে চাপা গলায় বলুন, ‘ট্রাঙ্ক কল, দিল্লি, ট্রাঙ্ক।’ দেখবেন অপর পক্ষদ্বয় ফোন নামিয়ে দিয়েছে, তারা ভাবছে তাদের বুঝি দিল্লি থেকে ট্রাঙ্ককল এসেছে। সেটা ধরার জন্য তারা ফোন নামাতেই আপনার জট আপাতত খুলে যাবে।