টেলিফোন
ক্রিং-ক্রিং…ক্রিং-ক্রিং…ক্রিং-ক্রিং…
বীরশেবাবু বিরক্ত হয়ে খাটের পাশের টেবিলের উপর রাখা টেলিফোনটার দিকে দেখলেন। টেলিফোনের পাশেই ঘড়ি, তাতে বারোটা বাজে। রাত বারোটা। বীরেশবাবু সবে হাতের বইটা বন্ধ করে ঘরের বাতিটা নেবাতে যাচ্ছিলেন। এদিকে টেলিফোনটা বেজেই চলেছে। বীরেশবাবু রিসিভারটা তুলে নিলেন।
‘হ্যালো—’
‘ফোর সিক্স ফাইভ ওয়ান সেভেন সিক্স?’
‘ইয়েস—’
‘বীরেশবাবু আছেন? বীরেশ চন্দ্র নিয়োগী?’
‘কথা বলছি।’
‘ও। নমস্কার।’
‘নমস্কার।’
‘এত রাত্রে ফোন করছি বলে কিছু মনে করবেন না।’
‘ঠিক আছে। কী ব্যাপার?’
‘আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা ছিল।’
‘আপনি কে বলছেন জানতে পারি কি?’
‘আমার নাম গণপতি সোম।’
বীরেশবাবুর বিরক্তিটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। বললেন, ‘কিন্তু এখন ত কথা বলার সময় হবে না। আমি শুতে যাচ্ছিলাম। আর, তাছাড়া আপনাকে ত চিনিও না।’
‘আমি কিন্তু আপনাকে চিনি। আপনার পেশা ডাক্তারি। তিন মাস হল এই বাড়িতে এসেছেন। আগের বাড়িতে আগুন লেগে প্রচুর ক্ষতি হয়। তাই আপনাকে এখানে উঠে আসতে হয়। আপনার স্ত্রী গত হয়েছেন আজ এগার বছর হল। আপনার বয়স পঞ্চান্ন। আপনার একটি ছেলে আছে—ইঞ্জিনীয়ার—সে ভূপালে থাকে। কেমন ঠিক বলিনি?’
বীরেশবাবু যারপরনাই বিস্মিত হলেন। বললেন, ‘আপনি এত কথা জানলেন কি করে?’
‘ধরে নিন এটা আমার একটা বিশেষ ক্ষমতা। এখন বলুন আপনি আমার কথাগুলো শুনতে চান কিনা।’
‘বেশি সময় লাগবে না ত?’
‘না। অবিশ্যি কথার পর যদি কথোপকথন চলে তাহলে কিছুটা সময় লাগতে পারে।’
‘ঠিক আছে। বলুন।’
‘আজ থেকে সাত বছর আগের কথা বলছি। আমার পেশা ছিল ওকালতি। আপনি সেই সময় মুক্তারামবাবু স্ত্রীটে থাকতেন, তাই নয় কি?’
‘ঠিকই বলেছেন।’
‘আপনার ছেলের নাম অরূপ।’
‘হ্যাঁ।’
‘সে তখন সিটি কলেজে পড়ত।’
‘হ্যাঁ।’
‘এটাও আপনি জানেন কিনা দেখুন—আপনার ছেলের একটি বন্ধু ছিল, নাম শ্রীপতি।’
‘তা হতে পারে। ছেলের বন্ধুদের খবর আমি সব সময় রাখতাম না।’
‘এই শ্রীপতি ছিল আমার মেজো ছেলে। খুব ভালো ছেলে ছিল—যেমন পড়াশুনায়, তেমনি স্বভাব-চরিত্রে। তার বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে অন্তরঙ্গ ছিল আপনার ছেলে অরূপ। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমার ছেলে কুসঙ্গে পড়ে। তার ফলে ক্রমে তার মধ্যে অনেক বদ অভ্যাস দেখা দেয়। অরূপ অনেক চেষ্টা করেছিল তাকে বুঝিয়ে বলে এই কুসঙ্গ ত্যাগ করাতে, কিন্তু তাতে সে সফল হয় নি। অথচ শ্রীপতির উপর থেকে অরূপের টান যায়নি। অরূপ বদ্ধপরিকর ছিল যে শ্রীপতিকে আবার সৎপথে ফিরিয়ে আনবে। কিন্তু তার চেষ্টা বৃথা হয়। এসব কি আপনার জানা?’
‘অরূপের এই বন্ধুকে আমি দেখেছি, কিন্তু সে যে কুসঙ্গে পড়েছিল সেটা জানতাম না।’
‘এবার একটা দুর্ঘটনার কথা বলি। আমার ছেলেকে জুয়ার নেশায় ধরে। সে রেসের মাঠে যেতে শুরু করে। তার ফলে তার অনেক হার হয়, এবং বিস্তর দেনা হয়ে যায়। তখন সে অরূপের কাছে হাত পাতে। বলে, তাকে উদ্ধার না করলে আত্মহত্যা ছাড়া তার আর গতি নেই। অরূপ তাকে সাহায্য করে কীভাবে সেটা আপনি জানেন কি?’
‘এখন বুঝতে পারছি।’
‘কী বুঝছেন?’
‘আমার বাড়িতে সিন্দুকে একটা অতি মূল্যবান জিনিস ছিল। এটা আমার ঠাকুরদার সম্পত্তি। একটা হীরের আংটি।’
‘হ্যাঁ। আপনার ঠাকুরদাদা ছিলেন চণ্ডীপুর স্টেটের রাজার গৃহচিকিৎসক। রাজাকে একবার দুরারোগ্য ব্যাধির হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন বলে রাজা খুশি হয়ে তাঁকে এই আংটিটি দেন। ঠিক বলিনি?’
‘ঠিক।’
‘এই আংটিটি সিন্দুক থেকে বার করে আপনার ছেলে আমার ছেলেকে দিয়ে দেয়।’
‘আশ্চর্য ব্যাপার! আমরা এই আংটি অন্তর্ধান রহস্যের কোনো কিনারা করতে পারি নি। পুলিশও পারে নি।’
‘পারবে কি করে? আপনার ছেলে এত ভালো, তাকে আপনারা সন্দেহ করবেন কি করে?’
‘তা ত বটেই।’
‘সেই আংটি কিন্তু আমার ছেলের কাছেই থেকে যায়। আংটিটা তার এত ভালো লাগে যে সেটা সে হাতছাড়া করতে চায় না। শেষটায় আমি ছেলের অবস্থা জানতে পেরে মহাজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তার দেনা শোধের ব্যবস্থা করি।’
‘সেই আংটি কি এখনো আপনার ছেলের কাছেই আছে?’
‘হ্যাঁ, কিন্তু সেটা সে আপনাকে ফেরত দিতে চায়। তার আংটির সখ মিটে গেছে। আংটি ফেরত দিয়ে সে কলঙ্কের হাত থেকে রেহাই পেতে চায়। তাছাড়া আপনার ছেলের মনেও একটা গ্লানি রয়েছে, সেটাও দূর করা দরকার।’
‘আপনার ছেলে কি আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়?’
‘হ্যাঁ—এবং এখনই। সে রওনা হয়ে গেছে। এতক্ষণে সে প্রায় আপনার বাড়ি পৌঁছে গেছে।’
‘তার নাম যেন কী বললেন?’
‘শ্রীপতি।’
‘আর আপনার নাম গণপতি?’
‘হ্যাঁ।’
‘আপনাদের নাম কি সম্প্রতি খবরের কাগজে বেরিয়েছে?’
‘তা বেরিয়েছে।’
‘দাঁড়ান, মনে করতে দিন।’
‘করুন। সময় নিন।’
বীরেশবাবুর একটু ভাবতেই মনে পড়ল। বললেন, ‘মনে পড়ছে। কালকের কাগজেই বেরিয়েছে আপনাদের নাম। ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোডে একটা গাড়ি আর লরিতে সংঘর্ষের ফলে গাড়ির তিনজন যাত্রী তৎক্ষণাৎ মারা যান। তার মধ্যে একজন গাড়ির চালক, আর দুজন বাপ ও ছেলে—নাম গণপতি সোম আর শ্রীপতি সোম।’
‘আপনি ঠিকই বলেছেন। আমিই সেই গণপতি সোম।’
‘আ-আপনি···তার মানে···’
‘তার মানে আপনি যা ভাবছেন তাই।’
‘কিন্তু এ যে অসম্ভব!’
‘কেন অসম্ভব হবে? দেখুন ত আপনি কোনো শব্দ শুনতে পাচ্ছেন কিনা।’
‘হ্যাঁ, পাচ্ছি।’
‘কী শব্দ?’
‘কে যেন আমার নীচের দরজায় টোকা মারছে।’
নিস্তব্ধ রাত্রে বীরেশবাবু স্পষ্ট শুনতে পেলেন সে শব্দ—টক্-টক্···টক্-টক্···টক্-টক্···। তারপর টেলিফোনে শুনলেন—
‘দরজাটা খুলে দিন। আমার ছেলে অপেক্ষা করছে।’
‘না না—আমি দরজা খুলব না।’
বীরেশবাবু বুঝলেন তাঁর গলা শুকিয়ে আসছে। তাঁর ডান হাতে রিসিভারটা কাঁপছে। আবার টেলিফোনে কথা—
‘দরজা না খুললেও সে ঢুকতে পারবে। সে ক্ষমতা তার আছে। এবার শুনুন ত কোন আওয়াজ পাচ্ছেন কিনা।’
‘সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে পায়ের শব্দ।’
‘আপনি কোনো চিন্তা করবেন না বীরেশবাবু। সে আপনাকে বিরক্ত করবে না। শুধু আপনার পাশের ঘরে গিয়ে টেবিলের উপর রেখে আসবে আংটিটা।’
চরম আতঙ্কে বীরেশবাবু বললেন, ‘না না—আপনি আপনার ছেলেকে ডেকে নিন, ডেকে নিন!’
‘তার ত উপায় নেই বীরেশবাবু। সে আপনার দোতলায় পৌঁছে গেছে।’
বীরেশবাবু স্পষ্ট শুনলেন পাশের ঘরে পায়ের শব্দ। শব্দটা একমুহূর্তের জন্য থামল, তারপর আবার শোনা গেল। এবার সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাওয়ার শব্দ। টেলিফোনে কথা এল—
‘এবারে আপনি নিশ্চিন্ত। আপনি টেলিফোন রেখে পাশের ঘরে গিয়ে দেখুন। আমি আসি। আপনার সঙ্গে আলাপ করে ভালো লাগল। গুড নাইট।’
বীরেশবাবু রিসিভারটা রেখে দিলেন। তাঁর কপাল এই পৌষ মাসেও ঘর্মাক্ত। কিছুক্ষণ বিছানায় চুপ করে বসে থেকে তিনি উঠলেন। অতি সন্তর্পণে এগিয়ে গিয়ে পাশের ঘরের ভেজানো দরজাটা খুলে ঘরে ঢুকে বাতিটা জ্বালালেন।
হ্যাঁ, সত্যিই পড়ে আছে টেবিলের উপর। এই অল্প আলোতেও ঝলমল করছে তার দ্যুতি—সাত বছর পরে ফিরে পাওয়া তাঁর ঠাকুরদাদার হীরের আংটি।