টেপ-মেজার মার্ডার

টেপ-মেজার মার্ডার

০১.

মিস পলিটকে দেখা গেল উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার দরজায় শব্দ করেছে। সে আরও একবার করবে কি না ভাবছে। কিছুক্ষণের নীরবতা, তারপর আবার সে খটখট করে শব্দ করল। তার বাঁ হাতে একটা মোটা সোটা পালে ধরা আছে। নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করল সে। এই পার্শেলের মধ্যে আছে শ্রীমতী স্পিনলোর নতুন সবুজ শীতকালীন পোশাক। একেবারে মাপসই করে বানানো হয়েছে মিস পলিটের বাঁ হাতে কালো সিল্কের তৈরি একটা ব্যাগ ঝোলানো আছে। ব্যাগের মধ্যে আছে মালা নেবার ফিতে, পিন কুশন আর মস্তবড়ো কঁচি।

মিস পলিট দীর্ঘদেহী তরুণী, তীক্ষ্ণ নাক তার। ঠোঁট দুটি লালাভ এবং লোভনীয় চুলের রংকে আমরা ঈষৎ বাদামি বলতে পারি। আরও একবার দরজায় আঘাত করা উচিত হবে কি না মনে মনে ভাবতে চেষ্টা করে সে। তারপর রাস্তার দিকে তাকায়। দেখে একটা শরীর ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছে, কে এই ভদ্রমহিলা? মিস হার্টনেল না? সময় যাকে কখনো ব্যস্ত করতে পারে না। পঞ্চান্ন বছর বয়স প্রায়। চিৎকার করে বলে উঠলেন–শুভ সন্ধ্যা, মিস পলিট।

ড্রেস মেকার উত্তর দিল শুভ সন্ধ্যা মিস হার্টনেল, কিন্তু তার কণ্ঠস্বরের মধ্যে কেমন একটা মায়াবী মৃদুময়তা খেলা করছে। কথা বলার আসল শক্তি কি সে হারিয়ে ফেলেছে? জীবন শুরু করেছিল একজন ভদ্রমহিলার পরিচারিকা হিসেবে। সে বলেই চলল–একটা কথা জানতে চাইছি, আপনার সাথে কি মিসেস স্পিনলোর দেখা হয়েছে? উনি কি বাড়িতে আছেন?

মিস হার্টনেল বলে উঠলেন–এ ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই, আসলে ওনার সাথে আমার খুব একটা কথাবার্তা হয় না।

-দেখুন না, আমি কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি। মিসেস স্পিনলোর জন্য নতুন ড্রেস নিয়ে এসেছি। তিনি বলেছিলেন সাড়ে তিনটের সময় আসতে। আমি কিন্তু সময় মেনে চলতে ভালোবাসি।

মিস হার্টনেল তার হাতঘড়ির দিকে তাকালেন। আধঘণ্টা হয়ে গেছে, বেচারি, তোমার জন্য সত্যি আমার মায়া হচ্ছে।

ইতিমধ্যে আমি তিনবার দরজায় শব্দ করেছি, কিন্তু ভেতর থেকে কোনো উত্তর পাইনি। বুঝতে পারছি না, এখন আমি কী করব? আমার মনে হয় মিসেস স্পিনলো বোধহয় বাইরে চলে গেছেন আর আমি যে আসব–এই ব্যাপারটা একেবারে ভুলে গেছেন। তবে উনি কিন্তু সাধারণত খুব একটা ভুলো মনের নন। তিনি এই পোশাকটা পরবেন, আমাকে বারবার তাগাদা দিয়েছিলেন। পরশুদিন কোনো একটা অনুষ্ঠানে এই পোশাকটা পরে যাবেন।

মিস হার্টনেল দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন। মিস পলিট তাকে অনুসরণ করল। র‍্যাভারনাম কটেজের বাইরে এসে তারা দাঁড়ালেন।

তিনি বলে উঠলেন–গ্ল্যাডির উত্তর শোনা যাচ্ছে না কেন? ওহ আজ তো বৃহস্পতিবার, তার মানে আজ গ্ল্যাডি ছুটি নিয়েছে। আমার মনে হয় মিসেস স্পিনলো হয়তো গভীরভাবে ঘুমিয়ে পড়েছেন। আপনি কি বার বার বেল বাজিয়ে ওনার ঘুম ভাঙাতে পারবেন? না হলে কিন্তু ওনার ঘুম ভাঙবে না। আর আপনাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে।

এবার শুরু হল বার বার বেল বাজানোর পালা। ট্যাক ট্যাক শব্দে কলিং বেল বেজে উঠল। মনে হল দরজায় ধ্বনি প্রতিধ্বনির শব্দ শোনা যাচ্ছে। তিনি চিৎকার করে ডাকলেন–কোথায় আছেন কেউ? কেউ কি ভেতরে আছেন?

ভেতর থেকে কোনো উত্তর ভেসে এল না।

মিস পলিট মনে মনে কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন। অস্ফুটে বললেন–আমার মনে হয় মিসেস স্পিনলো এই ব্যাপারটা ভুলে গেছেন। তিনি কখনো বাড়িতে নেই। দেখি অন্য কোনো একটা সময় আসতে হবে আমাকে।

তিনি বাইরে বেড়িয়ে আসার জন্য হাঁটতে শুরু করলেন।

 মিস হার্টনেল বলে উঠলেন–একেবারে বোকা বুদ্ধি। এভাবে তোমার সঙ্গে ব্যবহার করাটা মোটেই উচিত হয়নি ভদ্রমহিলার। আমি হলে কখনো তা করতে পারতাম না। দেখা যাক, জানলা দিয়ে ভেতরের দিকে তাকিয়ে। জীবনের কোনো স্পন্দন চোখে পড়ে কি না?

ভদ্রমহিলা হেসে উঠলেন। এভাবেই হেসে তিনি সকলের সঙ্গে কথা বলতে ভালোবাসেন। ভাবলেন, ভারি সুন্দর একটা জোক বলা হয়েছে। তারপর, জানলার ভেতর দিয়ে ভেতরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করলেন। বেশ কিছুক্ষণ ধরে এই প্রয়াস চলতে থাকল। কিন্তু এইভাবে তিনি কি ওই কাজে সফল হবেন? আসলে মিস্টার এবং মিসেস স্পিনলো যে বাতাবরণের মধ্যে জীবন কাটাতে ভালোবাসেন, সেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষেধ।

মিস হার্টনেল জীবনের স্পন্দন কোথাও দেখতে পেলেন না, বরং জানলার দিকে তাকিয়ে তার মনে হলো ভেতরে কিছু একটা বিপর্যয় ঘটে গেছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মিসেস স্পিনলোর শরীরটা নোয়ানো আছে, দেখলেই বোঝা যাচ্ছে মৃত্যু হয়েছে তার। তার মানে? একটা ভয়ঙ্কর ঝামেলার সামনে দাঁড়িয়ে বুক চিতিয়ে লড়াই করতে হবে এই দুই মহিলাকে।

পরবর্তীকালে এই গল্পটা বলার সময় হার্টনেল বলেছিলেন–আমি আমার মাথা ঠাণ্ডা রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম। বেচারি পলিট, ও তো বুঝতেই পারছে না, এই পরিস্থিতিতে তার কী করা দরকার। আমি ওকে বলেছিলাম–ব্যাপারগুলো আমার ওপর ছেড়ে দাও, তুমি শান্ত মাথায় এখানে চুপটি করে দাঁড়াও, আমি এখনই গিয়ে কনস্টেবল পলককে ডেকে আনছি।

আমার এই কথা শুনে পলিট কোনো জবাব দেয়নি। হয়তো সে একেবারে বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল। আমিও তার প্রতি বেশি মনোযোগ দিলাম না। তখন কাউকে না কাউকে তো শক্ত হতেই হবে। এই ব্যাপারটা নিয়ে বেশি আলোচনা আমি মোটেই পছন্দ করি না। আমি কনস্টেবলকে ডাকার জন্য বার হচ্ছি, ঠিক সেই সময় মিস্টার স্পিনলো বাড়ির এককোণ থেকে বেরিয়ে এলেন।

এত অব্দি বলার পর মিস হার্টনেল ইঙ্গিতপূর্ণ বিরতি টানলেন। মনে হল তিনি বোধহয় কিছু একটা বলতে চাইছেন। আর শ্রোতার কণ্ঠে তখন জেগেছে ঔৎসুক্য। শ্রোতা জানতে চাইলেন, তাঁকে দেখে কীরকম লাগছিল আপনার? তিনি কি বিধ্বস্ত চেহারার নাকি উৎফুল্ল।

মিস হার্টনেল কথা চালিয়ে গেলেন। সত্যি কথা বলতে কী, তখনই আমার মনে হয়েছে তার আচরণের মধ্যে কোথায় যেন একটা অসঙ্গতির চিহ্ন লুকিয়ে আছে। তিনি বেশি রকমের শান্ত। তিনি একেবারেই উত্তেজিত হননি। এই অবস্থায় কেউ কি এই ভাবে শান্ত থাকতে পারে? যদি কাউকে বলা হয় তার স্ত্রীকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে, তাহলে সেই ভদ্রলোক কোনো রকম আবেগ দেখাবেন না, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?

পরে উপস্থিত সকলে এই বক্তব্যের সাথে সহমত পোষণ করলেন।

পুলিশও এই ব্যাপারটাকে মেনে নিয়েছিলেন। তাহলে মিস্টার স্পিনলোকেই কি আমরা সম্ভাব্য হত্যাকারী বলতে পারি? নাকি এর মধ্যেও অন্য কোনো কারণ লুকিয়ে আছে? নিজের স্ত্রীর মৃত্যুর খবর শুনে ভদ্রলোক কি এমন হয়ে গিয়েছিলেন? ইতিমধ্যে ঝুলি থেকে বেড়ালটা বেরিয়ে পড়ল। জানা গেল এই দম্পতির মধ্যে একটি আশ্চর্য চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। যদি কোনো কারণে শ্রীমতীর মৃত্যু হয়, তাহলে তার সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী হবেন ওই স্বামী বাবাজীবন। একথা শোনার পর কেউ কি তাকে চোখের বাইরে রাখতে পারে?

এবার মিস মার্পলের কথা বলার পালা। তার মুখমণ্ডলে একটা অদ্ভুত লাবণ্য লুকিয়ে আছে। তার জিভও অত্যন্ত দ্রুত এপাশ থেকে ওপাশে চলে যায়। স্পিনলের পাশের বাড়িতে আপাতত তার অবস্থান। আধ ঘন্টার মধ্যে খবর সেখানে পৌঁছে গেছে। পুলিশ কনস্টেবল পলকের সাহায্যে। পলকের সঙ্গে একটি নোটবুক আছে। তিনি শান্ত মনে সব কিছু লিপিবদ্ধ করছেন।

পলকের কণ্ঠস্বর শোনা গেল–ম্যাডাম, আপনি যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে কি আমি আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারি?

মিস মার্পল বললেন–এটা কি মিসেস স্পিনোর হত্যা সংক্রান্ত প্রশ্ন? তাহলে জবাব দিতে আমার কোনো আপত্তি নেই।

পলক কথা বলা শুরু করলেন–আমি জানতে চাইছি, ম্যাডাম, আপনি কী ভাবে এই বিষয়টির কথা জানতে পারলেন?

মিস মার্পলের ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠেছে তাচ্ছিল্যের হাসি। তিনি বললেন–কোন বিষয়? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। মাছের টুকরোটা কেমন সেটা জানতে চাইছেন?

এমন প্রশ্ন আশা করেননি কনস্টেবল পালক। তিনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হলেন। আসলে জেলে যে মাছটা ধরে এনেছে যে সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ থাকবে কেমন করে? এই মাছটাই আজ মিস মার্পলের সান্ধ্যকালীন খাবার টেবিলে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে।

মিস মার্পল সাবধানে কথা বলে চললেন–এটা সিটিং রুমের মেঝের ওপর পড়েছিল। ছোট্ট একটা বেল্ট দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা। পরবর্তীকালে ওটাকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

পলকের মুখমণ্ডলে ঔৎসুক্যের ছাপ পরিস্ফুটিত। তিনি বললেন–কীভাবে ওই বাচ্চা ছোকরা প্রে সবকিছু জানতে পারে বলুন তো?

মিস মার্পল তাঁর কথা শেষ করতে দিলেন না। তিনি বললেন–আপনার টিউনিকের ওপর একটা পিক লেগে আছে।

কনস্টেবল পলক তাকালেন। বুঝতে পারলেন এই কথার অন্তরালে কী অর্থ লুকিয়ে আছে। তিনি বললেন–সকলেই বলে থাকে ছাই দেখলেই উড়িয়ে দেখা উচিত সেখানে আগুন আছে কিনা, তাহলে হয়তো আমরা অনেক আপাত অকিঞ্চিৎকর প্রশ্ন থেকে রহস্যের সমাধান করতে পারব।

-এবার বোধহয় আপনি সত্য পথের পথিক হতে পেরেছেন। বলুন আমার কাছে আপনি কি জানতে চাইছেন, আমি আন্তরিক ভাবে চাইছি এই রহস্যটার সমাধান তোক।

কনস্টেবল পলক তার গলা আবিষ্কার করলেন। নোটবুকের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাববার চেষ্টা করলেন। তার পর বললেন–মৃত ভদ্রমহিলার স্বামী মিস্টার আর্থার স্পিনলো যে জবানবন্দি দিয়েছেন সেটা আমি সযত্নে রেখে দিয়েছি। মিস্টার স্পিনলো মারফত জানতে পারলাম, আজ দুটো বেজে তিরিশ মিনিটে আপনি ওনাকে ফোন করেছিলেন। আপনি ওনাকে আপনার বসার ঘরে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আপনাদের মধ্যে কোনো একটা বিষয়ে আলোচনা হবে বলে। আপনি তিনটে বেজে পনেরো মিনিট ওই ভদ্রলোককে এখানে আসতে বলেছিলেন। কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে আপনি খুবই উদ্বিগ্ন। ম্যাডাম, আমি যা বলছি সব সত্যি কি?

কনস্টেবলকে অবাক করে দিয়ে মিস মার্পল বলে উঠলেন–কখনোই তা নয়, এসব বানানো গল্প কথা।

–সে কী? মিস্টার স্পিনলোকে আপনি দুটো বেজে তিরিশ মিনিটে ফোন করেননি?

–কখনোই না, দুটো তিরিশ-তিনটে তিরিশ-চারটে তিরিশ–কখনোই না।

 বেশ বোঝা যাচ্ছে মিস মার্পল এখন বিরক্ত হয়ে উঠেছেন। হবারই কথা, কেউ যদি তার নামে মিথ্যে কিছু বলে থাকে তাহলে বিরক্তি তো মনের মধ্যে জাগবেই।

কনস্টেবল পলক বললেন-ঠিক আছে, এরপর তিনি পরম আনন্দের সঙ্গে তার গোঁফ জোড়া মুচড়ে দিলেন। উত্তেজিত হলে তিনি এভাবেই তার উত্তেজনার প্রশমনের চেষ্টা করে থাকেন।

মিস্টার স্পিনলো আর কী বলেছেন?

মিস্টার স্পিনলোর জবানবন্দির ভেতর অনেক কথাই জানা গেছে। তিনি নাকি অনুরোধে পড়ে এখানে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি তাঁর বাড়ি থেকে তিনটে বেজে দশ মিনিটে বেরিয়ে আসেন। তারপর মিস মার্পলের বাড়িতে পৌঁছে যাবার পর কাজের মেয়ে মারফত শুনতে পান, মিস মার্পল বাড়িতে নেই।

মিস মার্পল বললেন–গল্পের এই অংশটা একেবারেই সত্যি। ওই ভদ্রলোক হয়তো এখানে এসেছিলেন। কিন্তু আমি তখন উওমেনস ইনস্টিটিউটে একটি কাজে ব্যস্ত ছিলাম।

কনস্টেবল পলক আবার বললেন–ঠিক আছে তো?

 মিস মার্পল বললেন-কনস্টেবল, মিস্টার স্পিনলো সম্বন্ধে আপনার কী ধারণা? আপনি কি ওনাকে এখানে সম্ভাব্য অপরাধী হিসেবে ইতিমধ্যে চিহ্নিত করেছেন?

-তদন্তের এই অবস্থায় আমি কোনো মন্তব্য করতে পারব না। অনেকগুলো নাম মিছিল করে হেঁটে চলেছে কিন্তু কে যে সত্যিকারের দোষী তা বের করব কীভাবে? আমাকে আরও সাবধানে পা ফেলতে হবে।

মিস মার্পল জিজ্ঞাসা করলেন–মিস্টার স্পিনলো?

মেয়েটি মিস্টার স্পিনলোকে ভালোবাসে। মিস্টার স্পিনলো মানুষ হিসাবে খুব একটা আকর্ষণীয় নন। খর্বাকৃতি প্রাচীন ভাবধারা আঁকড়ে ধরে পথ চলতে ভালোবাসেন, সাবধানে মেপে মেপে কথা বলেন। তাঁর চরিত্রের মধ্যে সম্মানীয় ব্যক্তিত্বের ছাপ আছে। মনে হয় তিনি বোধহয় কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে গ্রামাঞ্চলে বসবাস করতে এসেছিলেন। এতদিন পর্যন্ত তিনি শহরেই তার জীবন কাটিয়ে গেছেন। তাই মিস মার্পলের কাছে এই চরিত্রটা খুব একটা আকর্ষণীয় না হলেও কৌতূহলের উপাদান নেই যে তা বলা যায় না।

তিনি বললেন–ছোটো থেকেই আমি আমার জীবনটা নিজের মতো কাটাতে চেয়েছি। আমি চেয়েছিলাম কোনো একদিন শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাব। ছোট্ট একটি বাগান বাড়ি থাকবে আমার। ফুল আমি অসম্ভব ভালোবাসি। আপনি জানেন আমার বউয়ের একটি ফুলের দোকান আছে। সেই দোকানে তার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল।

এই ধরনের জবানবন্দির মধ্যে আলাদা কোনো আকর্ষণ নেই। কিন্তু এর অন্তরালে রোমান্সের একটু ছোঁয়া আছে তা স্বীকার করতেই হবে। দেখা গেল ফুলের জলসাঘরে কমবয়েসী সুন্দরী শ্রীমতী স্পিনলো বসে আছেন।

শ্রীযুক্ত স্পিনলো অবশ্য ফুল সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানেন না। বীজ, বীজতলা তৈরি করা, এসব ব্যাপারে তাঁর অজ্ঞতা সকলেই জানে। অবশ্য তার মধ্যে একটা আশা আছে। যে আশা তাকে ওই সুন্দর বাগান বাড়িটায় মালিক করে তুলেছে। এখানে পা রাখলে মনে হবে আপনি বুঝি পৃথিবীর বাইরে অন্য কোথাও পৌঁছে গেছেন। চারপাশে সুগন্ধি যুক্ত ফুলের মেলা। সাতরঙা রামধনু বুঝি পাখা মেলে উড়ে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যেই তাকে নানা ধরনের প্রশ্ন করা হচ্ছে, তিনিও কিছুটা উদাসীন ভাবে উত্তর দিয়ে চলেছেন। শুধু তাই নয়, মিস মার্পলের কথাগুলো ছোট একটি নোটবুকে তুলে নিচ্ছেন।

তাঁকে দেখে শান্তস্বভাবের মানুষ বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু পুলিশ কেন তার সম্পর্কে এতখানি আগ্রহী হয়ে উঠবে? আসলে মৃত স্ত্রীর খবর শুনেও তিনি যে ভাবে তার আবেগ সামলাচ্ছেন, সেটাই অনেকের মনে সন্দেহের উদ্রেক করেছে। এই পৃথিবীতে অবশ্য এমন কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা শোক অথবা দুঃখ, আনন্দ অথবা উল্লাসে একই রকম থেকে যান। শ্রীমতী স্পিনলো সম্পর্কে অনেক কথাই তখন জানা গেছে। বারবার প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া হচ্ছে শ্রীযুক্ত স্পিনলোর কাছে। তা সত্ত্বেও আমরা কি তার হৃদয়ের গোপন দুয়ার খুলতে পারছি?

মস্ত বড়ো একটি বাড়িতে শ্রীমতী স্পিনলো একজন সাহায্যকারিনী হিসাবে জীবন শুরু করেছিলেন। তিনি ওই কাজটা ছেড়ে দিলেন, বাগান পরিচর্যা যিনি করতেন, তাঁকে বিয়ে করলেন। তাঁরই সহায়তায় লন্ডনে একটি ফুলের দোকান খুলেছিলেন। ধীরে ধীরে দোকানের শ্রীবৃদ্ধি হল। কিন্তু ওই উদ্দাম পরিচালকের অবস্থার ক্রমাবনতি দেখা গেল। দীর্ঘদিন রোগে ভুগে শেষ পর্যন্ত তিনি মারা গেলেন।

এবার ওই বিধবা মহিলা আশা ও ভালোবাসাকে পাথেয় করে এগিয়ে চললেন। তার দোকানের আরও শ্রীবৃদ্ধি ঘটল। তারপর? তিনি উক্তৃষ্ট দামে দোকানটা বিক্রি করে দিলেন। এবার আবার তাকে বিয়ের আসরে বসতে হল, তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের স্বামী হলেন শ্ৰীযুক্ত স্পিনলো। মধ্যবয়সী একজন রত্ন ব্যবসায়ী, যিনি একটা ছোট্ট ব্যবসাকে স্বীয় উদ্যম এবং বুদ্ধি বলে বড়ো করে তুলেছেন। কিছুদিন বাদে তারা ঐ ব্যবসাটাও বিক্রি করে সেন্ট ম্যারিমেড-এ চলে আসেন।

শ্ৰীমতী স্পিনলোকে আমরা এক মোটামুটি অবস্থাপন্ন মহিলা বলতে পারি। আসলে ফুলের দোকান বিক্রি করে তিনি যে বিপুল অর্থ পেয়েছেন, তার থেকে নিয়মিত সুদ মাঝে মাঝে তার হাতে পৌঁছে যায়। জীবন যাত্রার মান খুব একটা উঁচু নয়। তাই হয়তো যে কোনো বিপর্যয় মোকাবিলা করার মতো সাহস এবং শক্তি তার আছে।

তিনি বুদ্ধি করে বিভিন্ন লগ্নীতে টাকা রেখেছেন। এর ফলে আগের গরিমাটা যথেষ্ট বেড়ে গেছে। আর এর ফলেই হয়তো তিনি আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝুঁকেছেন। শ্রীমতী স্পিনলো মাঝে মধ্যেই সম্মোহনের আসর বসান। শুধু তাই নয়, পরলোক সম্পর্কে তাঁর অগাধ আস্থা। মিডিয়াম ব্যবহার করে তিনি পরলোকের মানুষকে টেনে আনার চেষ্টা করেন। তিনি এক অদ্ভুত ধর্মমতে বিশ্বাস করেন। এর মধ্যে ভারতীয় আধ্যাত্ম শক্তির ছাপ আছে। শুধু তাই নয়, প্রাণায়াম এবং যোগক্রিয়াতেও তার উৎসাহ চোখে পড়ার মতো। সেন্ট ম্যারি মেড-এ আসার পর তার ধার্মিক ভাবনাতে কিছু পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল। তিনি পুরোনো দিনের গোড়া ক্রিশ্চান হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছিলেন। মাঝে মধ্যেই চার্চে যেতেন। চার্চের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখতেন। শুধু তাই নয়, স্থানীয় ঘটনাবলী সম্পর্কে তার আগ্রহের কোনো সীমা ছিল না। এমনকি তিনি মেয়েদের সঙ্গে বসে ব্রিজ খেলার আসরেও মেতে উঠতেন।

একটি সাধারণ জীবনযাত্রা, সেখানে কেন আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা? কেন এভাবে নিহত হতে হল তাকে।

.

০২.

 কোনো ব্যাপার একবার তার মাথার মধ্যে ঢুকে গেলে আর নিস্তার নেই। সেটার শেষ না দেখে তিনি ছাড়বেন না। তিনি পরিষ্কার ভাবে বললেন–স্যার, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, স্বামীটাই খুন করেছে, তাকে আগে গারদে পুরতে হবে।

–তোমার কি তাই মনে হয়?

-এটা আমার অনুমান নয়, স্যার, আমার স্থির সিদ্ধান্ত। আপনি শুধু একবার ওই ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখবেন। সমস্ত মুখ অপরাধে থমথম করছে। ওনার মধ্যে আপনি কি এক টুকরো আবেগের বিচ্ছুরণ দেখেছেন? উনি জানতেন যে, ভদ্রমহিলা মারা গেছেন। তাই অত আস্তে আস্তে হেঁটে বাড়ির দিকে আসছিলেন।

এছাড়া তুমি আর কাউকে সন্দেহের তালিকায় রাখতে পারছ না? ভেবে দেখ তো শোকের ভূমিকায় অভিনয় করা কি খুবই শক্ত?

–অনেকের ক্ষেত্রে এটা হয় না, স্যার। কোনো কোনো মানুষ আছে যারা আরোপিত ব্যক্তিত্বে বিশ্বাস করে না। স্পিনলো সেই জাতের বলে আমার মনে হয়।

–তার জীবনে কি অন্য কোনো মহিলার ছাপ আছে? কর্নেল জানতে চাইলেন।

-না, এখনও পর্যন্ত তেমন কোনো খবর আমার হাতে আসেনি। অবশ্য ওই ভদ্রলোক নানা ছলাকলা জানেন। তিনি যে কোনো গোপন অভিলাষ চেপে রাখতে পারেন। আমার মনে হচ্ছে উনি বোধহয় স্ত্রীকে আর সহ্য করতে পারছিলেন না। স্ত্রীর অগাধ অর্থ আছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই জাতীয় মহিলাদের সহ্য করা সত্যি সম্ভব নয়। স্বামীদের এঁরা চাকর করে রাখতে ভালোবাসেন। তাই উনি ঠাণ্ডা মাথায় এই খুনের পরিকল্পনাটা করেছিলেন। উনি হয়তো ওনার খিটখিটে মেজাজের স্ত্রীর কাছ থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন। বাকি জীবনটা সুখে শান্তিতে কাটিয়ে দেবার ইচ্ছে লুকিয়ে ছিল ওনার মনের মধ্যে।

–হ্যাঁ, হয়তো তোমার অনুমান সঠিক। এখন আমার তাই মনে হচ্ছে।

-এই অনুমানটার ওপরেই নির্ভর করে থাকুন স্যার, আমি বলছি আপনাকে ঠকতে হবে না। ওই ভদ্রলোক ধীরে ধীরে ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছিলেন। তাই বোধ হয় ফোন কল এসেছে এমন একটা অছিলায় বের হয়ে যান।

মেলচেট জানতে চাইলেন–তার মানে কোনো ফোন কল আসেনি?

–না, স্যার। এর কী অর্থ হতে পারে? হয়তো ওই ভদ্রলোক মিথ্যে কথা বলেছেন, অথবা ওই কলটা এসেছিল পাবলিক টেলিফোন বুথ থেকে। এই গ্রামে মাত্র দুটো পাবলিক টেলিফোন বুথ আছে। একটা স্টেশনে, অন্যটা পোস্ট অফিসে। পোস্ট অফিসের টেলিফোন থেকে কল আসেনি। কারণ মিসেস ক্লোক মোটামুটিভাবে সকলকেই চেনেন। স্টেশনের টেলিফোন বুথ থেকে কলটা আসতে পারে। ট্রেন আসে দুটো সাতাশ মিনিটে, তখন খানিকটা হৈ চৈ হয়। তবে একটা ব্যাপার আমার মাথায় আসছে না। সেই ব্যাপারটা সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে হবে। তিনি বলেছেন, মিস মার্পল তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। এটা কিন্তু একেবারে ডাহা মিথ্যে। মিস মার্পলের বাড়ি থেকে ফোন কলটা আসেনি, কারণ মিস মার্পল তখন ইনস্টিটিউটে চলে গিয়েছিলেন।

–তাহলে তুমি কি মনে করছ? স্বামী ইচ্ছে করেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। যাতে অন্য একজন আততায়ী এসে মিসেস স্পিনলোকে হত্যা করতে পারে?

হ্যাঁ, আপনি ট্রেড ইয়ার্ডের কথা মনে রেখেছেন? আমি তার সঙ্গে কাজ করেছি, আমি দেখেছি, তিনি খুব এলোমলো স্বভাবের মানুষ। তিনি একটু পরে কী করবেন আগে থেকে তা নির্বাচন করতে পারেন না।

হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ, তার চরিত্রের মধ্যে কোনো দৃঢ়তা নেই। তার চরিত্রে একাধিক দোষও লুকিয়ে আছে।

-স্যার, আমার মন্তব্য যে একেবারে সঠিক আমি তা বলছি না। আমার মনে হয় এই ব্যাপারের সঙ্গে সেও জড়িয়ে থাকতে পারে। হয়তো সে এই ভাবে তার কৃতিত্ব জাহির করার চেষ্টা করেছে।

মেলচেট অবাক হয়ে জানতে চাইলেন–অক্সফোর্ড ব্লুবার্ডদের খবর কি?

-এই ব্যাপারটাও আমি ভেবে দেখেছি। মনে হয় কেউ হয়তো টাকার লোভে এই কাজটা করেছে। আমি এ ব্যাপারে কয়েকটা ক্ল্য আপনাকে দিয়ে গেলাম। আপনি এই ক্লু গুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করবেন। আমার মনে হয় আপনি কদিনের মধ্যেই আসল আততায়ীকে ধরতে পারবেন।

কর্নেল মেলচেট বললেন-তোমার মন এত সন্দেহে ভরা কেন? যাক, তুমি কি মিস মার্পলের সঙ্গে কথা বলেছ?

এই ব্যাপারের সঙ্গে মিস মার্পলের কী যোগ থাকতে পারে, স্যার, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার তো মনে হচ্ছে এটা আমরাই সমাধান করতে পারব।

-না, হয়তো আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে যোগসূত্ৰতা বলে কিছু নেই। কিন্তু ওই ভদ্রমহিলার অগাধ আস্থা এবং অসীম জ্ঞানের প্রতি আমি উপেক্ষা দেখাব কী করে? তোমার এখনই উচিত ওনার বাড়িতে গিয়ে ওনার সাথে আলোচনায় অংশ গ্রহণ করা। ওনার বয়স হয়েছে, কিন্তু মাথাটা এখনও পরিষ্কার আছে।

প্যাট ইচ্ছে করেই বিষয়টা ঘোরাবার চেষ্টা করে বললেন–স্যার, একটা ব্যাপারে আপনার কাছ থেকে পরামর্শ চাইছি। মৃতা ভদ্রমহিলা যেখান থেকে তার পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন, আমি বলতে চাইছি যেখানে তিনি পরিচারিকার কাজ করতেন, সেই ফ্ল্যাট রবার্ট অ্যাবার ক্রমগট জায়গাটা একবার দেখে এলে কেমন হয়? আমার মনে হচ্ছে সেখানে গেলে আমরা কোনো একটা সূত্রের সন্ধান পাব। ওখান থেকেই তো হীরে জহরত চুরি হয়ে গিয়েছিল। আমি বলতে চাইছি মরকত মণির কথা, আপনার তো মনে আছে, স্যার। সেগুলো আর কখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি যথেষ্ট নাড়াচাড়া করেছিলাম, আমার মনে হচ্ছে ওই ভদ্রমহিলা যখন সেখানে কাজ করতেন তখনই এই ঘটনাটা ঘটে গিয়েছিল। এই সময় অবশ্য তিনি নেহাতই এক কিশোরী কন্যা ছিলেন। আপনার কি কখনো মনে হয় না স্যার, এর সাথে ওই ভদ্রমহিলার কোনো যোগ সূত্র থাকতে পারে? আসল স্পিনলো তো সেই সময় জুয়েলারির দোকান নিয়ে নাড়াচাড়া করতেন, মনের ভেতর উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকাটাই স্বাভাবিক, তাই নয় কি? ঘটনাটার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। পুলিশ মহলে একটা চালু কথা ছিল, তা হল ওই বাড়ির কোনো একটি ছেলে এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত আছে, তার নাম হল জিম অ্যাবার ক্রমগই। সে হল বড়োলোকের বখে যাওয়া ছেলে। প্রচুর দেনা করে ফেলেছিল, আর ওই ভয়ঙ্কর ডাকাতিটা হবার পর সব দেনা সে শোধ করে দেয়। বলা হয়, কোনো এক ধনী ভদ্রমহিলা নাকি তার হয়ে এই সব দেনা শোধ করে দিয়েছিল, ব্যাপারটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য বলেই ঠেকেছিল। ভেবে দেখ, বৃদ্ধ অ্যাবারক্রমগই কিন্তু এই ব্যাপারটা নিয়ে বেশি আলোচনা করতে চাননি। আমার মনে হয়, এটা বোধহয় নেহাতই একটা পারিবারিক কলঙ্ক, তাই তিনি চেষ্টা করেছিলেন এটাকে ধামা চাপা দেবার।

প্যাট একটু বিষণ্ণ হয়ে বলল–আমি আপনাকে আমার মনের কথা জানালাম স্যার, আমার তো ভুল হতে পারে।

.

০৩.

 মিস মার্পল প্যাটকে অভিবাদন জানালেন। সাবধান এবং সন্তর্পণে। যখন শুনতে পেলেন যে, প্যাটকে কর্নেল মেলচেট পাঠিয়েছেন তখন তার মধ্যে আতিথেয়তার ভাব ফুটে উঠল। আসলে তিনি সব মহলের সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে চাইতেন।

-কর্নেল মেলচেটকে আমার অভিবাদন জানাবেন। আমি তো ভাবতেই পারছি না যে, তিনি এখনও আমাকে মনে রেখেছেন।

এটাই হলো মিস মার্পলের চরিত্রের ভদ্রতা।

–উনি সবসময় আপনার কথা মনে রাখেন, ম্যাডাম। উনি আমাকে বললেন এখনই আপনার সঙ্গে দেখা করতে। সেন্ট মেরিমেড-এ যেসব ঘটনা ঘটে চলেছে, আশা করি আপনি সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। এই ব্যাপারে আপনার অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞান আমাকে সাহায্য করে।

–আমি আবার কর্নেলকে আমার ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন এই ঘটনাটা সম্পর্কে আমি বিন্দু বিসর্গ কিছুই জানি না। কীভাবে যে হত্যাকাণ্ডটা ঘটেছে সে ব্যাপারে আমি এখনও অন্ধকারের মধ্যে আছি।

–আপনি কি বুঝতে পারছেন কী বিষয় নিয়ে আমরা কথা বলতে চলেছি?

-হ্যাঁ, আমি খানিকটা অনুমান করতে পারছি, এইভাবে কথা বলে কোনো লাভ হবে বলে আমার মনে হচ্ছে না। শুধু শুধু কথা বলে সময় কাটানোর কী দরকার?

প্যাট বুঝতে পারছেন, পরিস্থিতি ক্রমশই তাঁর হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও তিনি শেষ চেষ্টায় খড় কুটো আঁকড়ে ধরার প্রয়াসে মত্ত থেকে বললেন–এটাকে নেহাতই একটা ব্যবসায়িক বা শুকনো আলোচনা বলে ভাববেন না, ম্যাডাম। মনে করা যাক আমরা অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় এসেছি। গোপনে আপনার সাথে কিছু শলা পরামর্শ করতে চাই।

-আপনি কি বুঝতে পারছেন, আপনার কথার অন্তরালে কী অর্থ লুকিয়ে আছে? আপনি কী সাহায্য আমার কাছ থেকে পেতে চাইছেন তা একবার খুলে বলবেন কী? আপনি কি সত্যিটার সন্ধানে আমার কাছে এসেছেন?

-হ্যাঁ, তা হতে পারে।

-তাহলে শুনুন, এব্যাপারে কথা বলার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে আমি মনে করছি। অবশ্য এক্ষেত্রে কিছুটা অনুমান শক্তির কথাও বলতে হবে। এখানে কি দুটো আলাদা শিবির হয়ে গেছে? আপনি কি আমার কথার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা অর্থ বুঝতে পারছেন? আসুন, আমি সূত্রটা ধরিয়ে দিই। কিছু কিছু মানুষের দৃঢ় বিশ্বাস জেগেছে যে, ওর স্বামীটাই আসল খুনি, তিনি বোধহয় এইভাবে নিজেকে চাপা দেবার চেষ্টা করছেন। আসলে যখনই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়, তখন যে বেঁচে থাকে তার ওপর আমরা জোর করে অভিযোগের দায়ভার চাপিয়ে দিই। আপনার মনেও কি ধারণা তাই নয়?

–হতে পারে, প্যাট নিজের মনোভাব গোপন রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করলেন।

-তাহলে? আমি কি ঠিক বলিনি? সবক্ষেত্র থেকেই সন্দেহটা মিস্টার স্পিনলোর ওপর পড়তে পারে। আমি শুনেছি মিসেস স্পিনলো নাকি অঢেল অর্থের অধিকারিনী ছিলেন। তাঁর মৃত্যু হলে সমস্ত অর্থ মিস্টার স্পিনলো পাবেন।

-এটাই তো আমরা জানি, এ ক্ষেত্রে আমাদের মনে কোন সন্দেহ হয়? অর্থের লোভে স্বামী স্ত্রীকে মেরে ফেলেছেন তাইতো? আমি কিন্তু এই ব্যাপারটার সাথে একদম একমত হতে পারছি না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় একেবারে শেষ মুহূর্তে আমাদের অনুমান ধারণা সবকিছু ভেঙে ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে।

-হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন, ম্যাডাম, স্ত্রীর মৃত্যুর ফলে হঠাৎ ভদ্রলোক বিপুল সম্পত্তির অধিকারী হয়ে গেছেন।

আর তার জন্য কি তাকে দোষী সাব্যস্ত করা যায়? ব্যাপারটার মধ্যে একটুখানি অবিশ্বাস্য আছে একথা আমি অস্বীকার করতে পারছি না। কিন্তু শুধু টাকার জন্য একজন পুরুষ মিছিমিছি তার স্ত্রীকে হত্যা করবেন কেন? আমার তো মনে হয় এর অন্তরালে অন্য একটা ব্যাপার লুকিয়ে আছে, কতকগুলো বিষয় অবশ্য আমি গোপন করতে পারছি না। যেমন, তিনি কেন মিথ্যে করে বললেন যে, আমার কাছ থেকে টেলিফোনের খবর পেয়ে তিনি ছুটে এসেছিলেন? তারপর ফিরে গিয়ে দেখেন যে, তার স্ত্রী মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন। অর্থাৎ এই হত্যার ঘটনাটা ঘটেছে যখন তিনি বাড়িতে ছিলেন না, তার মানে? তার মানে কি কোনো অচেনা অজানা আগন্তুক এসে এই হত্যাকাণ্ডটা ঘটিয়েছে? এটা কি কোনো ছিঁচকে চোরের কাজ? হয়তো শ্ৰীমতী বাধা দেবার চেষ্টা করেছিলেন। ছিঁচকে চোর তার পাপের কোনো সাক্ষী রাখতে চায়নি।

ইন্সপেক্টার মাথা নাড়লেন–আপনি কি একবার টাকা পয়সার লেনদেনের কথাটা ভাববেন না? আমরা শুনেছি ইদানীং স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা ছিল না। পাড়া প্রতিবেশীরা মাঝে মধ্যেই তাদের চিৎকার শুনতে পেতেন।

মিস মার্পল এই কথা শেষ করতে না দিয়ে বললেন–এটা স্বামী স্ত্রীর মধ্যে অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা।

–তাহলে আপনি কী অনুমান করেন?

–না, সকলে যা ভাবছে আমি কিন্তু তা ভাবছি না। কী বিষয় নিয়ে তাদের ঝগড়া হত সে ব্যাপারটা একবার ভেবে দেখেছেন কি? আমার মনে হয় ওই পরিচারিকা গ্রাইট বেন্টের ওপর নজর রাখা দরকার। এই বেন্টের মারফতই তো খবরগুলো বাইরে চলে গেছে, তাই নয় কি?

এবার ইন্সপেক্টারের কণ্ঠস্বরের ভেতর কেমন একটা মলিনতা জেগেছে। ইন্সপেক্টার আমতা আমতা করে বলতে চেষ্টা করলেন–আসলে হয়তো এই কাজের মেয়েটি সব খবর জানে না। নেহাত উত্তেজনার বসে সে কিছু গুজব ছড়িয়েছে।

শুকনো ঠোঁটের কোণে হাসির চিহ্ন আঁকবার আপ্রাণ চেষ্টা করলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত পারলেন না।

মিস মার্পল তখন গড়গড়িয়ে বলে চলেছেন–এখানে অবশ্য আর একটা দল গড়ে উঠেছে, এবার টেড গোর্যান্টের কথা বলি, টেড গোর্যান্ট হল এক সুপুরুষ সুদর্শন যুবক। আমার মনে হয় রূপের সাহায্যে মানুষ অনেকের মন ভোলাতে পারে। টেডের ক্ষেত্রে কি তেমনই ঘটনা ঘটে গিয়েছিল? যে সমস্ত মেয়েরা চার্চে আসত, বিকেলে অথবা সকালবেলা, তাদের অনেকের সাথেই আমি কথা বলেছি। শুধু কী তাই? দেখা গেল মধ্যবয়সিনী মেয়েরাও চার্চের কাজে আরও বেশি মাত্রায় যোগ দিতে আসছে। তারা সঙ্গে আনছে টেডের জন্য ক্লিপার এবং স্কার্ট। এই ব্যাপারটা ওই মানুষটির মাথা ঘুরিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট নয় কি?

…কিছু দেখা যাক, এর মধ্যে কোনো সন্দেহ বা সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। আবার আমি টেড গোর্যান্টের কথা বলব। কেন টেড গোর্যান্টের নাম বারবার উচ্চারণ করছি বলুন তো? আসলে টেড গোর্যান্টে তো মাঝে মধ্যেই মিসেস স্পিনোর সঙ্গে দেখা করতে আসত, সেই খবরটা কি আপনার জানা আছে? মিসেস স্পিনলো কথা প্রসঙ্গে আমাকে একবার বলেছিলেন যে, তিনি অক্সফোর্ড গ্রুপের মধ্যে ঢুকে গেছেন। আসলে এখানে এক একটা ছোটো ছোটো গ্রুপ তৈরি হয়েছে। এক সময় অক্সফোর্ড গ্রুপ নামে একটি ধার্মিক আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল, আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি এই মতবাদে যাঁরা বিশ্বাস করেন তারা সকলেই নিজস্ব কর্ম সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন এবং প্রাণপণ চেষ্টায় কাজটা শেষ করার কথা ভাবেন। আমার মনে হয় মিসেস স্পিনো বোধ হয় ওই ছেলেটির কথাবার্তা শুনে কিছুমাত্রায় তার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছিলেন।

নিঃশ্বাস নেবার জন্য মিস মার্পল কিছুক্ষণের জন্য বিরতি দিলেন। তারপর আবার গড়গড়িয়ে বলতে শুরু করলেন–তাদের মধ্যে অন্য কোনো ঘটনা ঘটেছিল কিনা সেটা আমি ঠিক বলতে পারব না। তবে আমার মন এত নীচ নয় যে, আমি পুরুষ এবং নারীর মধ্যে কোনো সহজ-সরল সম্পর্ক মেনে নেব না। তবুও আমার মনে হয় কোথায় যেন একটা ছোট গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। যে গোলমালের কেন্দ্রে পৌঁছোতে না পারলে এই রহস্যের সমাধান করা কখনোই সম্ভব হবে না। অনেকেই বলে থাকে, মিসেস স্পিনলো নাকি ওই অল্পবয়সী ছেলেটির দ্বারা বিশেষ ভাবে আকর্ষিতা হয়েছিলেন। শুধু তাই না, তিনি ওই ছেলেটিকে বেশ কিছু টাকা ধার হিসেবে দিয়েছিলেন। এই ঘটনার মধ্যে কতটা সত্যি লুকিয়ে আছে তা আমি জানি না। কিন্তু ওই ছেলেটিকে সেদিন স্টেশনে দেখা গিয়েছিল। দুটো সাতাশ মিনিটে ডাউন ট্রেনে সে চড়ে বসেছিল। থাকতেই পারে। কিন্তু তার আচরণের মধ্যে কিছু কিছু অস্বাভাবিকতা চোখে পড়েছে। ট্রেন যখন ছুটে চলেছে, তখন ছেলেটি কোথায় গেল? সে কি ট্রেনের কামরার মধ্যে দিয়ে অন্য দিকে চলে যায়? তারপর বাঁশের বেড়া পার হয়ে কাটাঝোপকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায় স্টেশনের প্রবেশ পথের দিকে। তাকে কিন্তু কটেজের চারপাশে আর দেখতে পাওয়া যায়নি। আর একটা বিষয়ের কথাও আপনাকে মনে রাখতে হবে, তা হল মিসেস স্পিনলো কোনো পোশাক পরিধান করেছিলেন? সেই পোশাকের মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা আছে বলে আপনার কি মনে হয়?

–আমি তো এ ব্যাপারটা কখনো ভেবে দেখিনি, এ প্রশ্নটা আপনি কেন করছেন?

মিস মার্পল বলে উঠলেন–উনি একটা কিমোনো পরে ছিলেন, কোনো সাধারণ পোশাক নয়। কিমোননা কিন্তু কোনো কোনো মানুষের কাছে বিশেষ অর্থ বহন করে।

–আপনি কি তাই মনে করছেন?

-না, আমি ঠিক সেভাবে বলতে চাইছি না। আমি বলতে চাইছি, এর মধ্যে একটা অস্বাভাবিকতা লুকিয়ে আছে।

–আপনি কি এটাকে স্বাভাবিক বলে মনে করছেন?

মিস মার্পলের চোখ দুটি জ্বলে উঠল। এখনও সেখানে বজায় আছে শৈত্য ভাব এবং প্রতিফলনের ক্ষমতা। তিনি বলে উঠলেন–হ্যাঁ, কোনো কোন ক্ষেত্রে এটাকে সাধারণ ভাবে দেখা উচিত।

এবার ইন্সপেক্টার প্যাট মন্তব্য করলেন–তাহলে? ওনার স্বামীর বিরুদ্ধে আরেকটা অপরাধ-তত্ত্ব খাড়া করা যেতে পারে সেটা হল প্রচণ্ড হিংসা।

-না না, এখানে আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে, মিস্টার। আমার মনে হয় মিস্টার স্পিনলো কখনোই স্ত্রীকে হিংসা করতেন না। তিনি এসব ছোটোখাটো ব্যাপারে মাথা ঘামাতেন বলে আমার মনে হয় না। যতটুকু আমি তাকে দেখেছি, তার ভিত্তিতেই এ কথা বলছি। যদি ওনার বউ বাইরে চলে যায় এবং লণ্ঠনের ওপর একটা চিরকূট রেখে যান, তাহলেও কিন্তু উনি কিছু মনে করবেন না। ওনার স্বভাবটা এমন নয় বলেই আমার বিশ্বাস।

মিস মার্পল সন্দেহ ভরা দৃষ্টিতে ইন্সপেক্টার প্যাটের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। প্যাট একটু বিব্রত বোধ করলেন। এই মুহূর্তে প্যাটের মন থেকে ভাবনারা দূরে কোথায় হারিয়ে গেছে। মিস মার্পলের কথার বিরুদ্ধে যাবার মতো সাহস এবং শক্তি তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। শেষ অব্দি মিস মার্পল জোরের সঙ্গে বললেন-ইন্সপেক্টার স্পটে গিয়ে আপনি কি কোনো সূত্র খুঁজে পেয়েছিলেন? নাকি অন্ধকারে হাতড়েছেন?

–মিস মার্পল, এখনকার দিনে কেউ আর আঙুলের ছাপ কিংবা সিগারেটের ছাই রাখে না অনুসন্ধানের জন্য। এখন ব্যাপারটা একেবারে পাল্টে গেছে।

-কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এটা বোধহয় একটা পুরোনো ধরনের অপরাধ।

–প্যাট সঙ্গে সঙ্গে বললেন–এ কথার অর্থ কী? আমি তো ঠিক বুঝতে পারছি না।

মিস মার্পল শান্তভাবে জবাব দিলেন–আপনি কি কনস্টেবল পলকের সঙ্গে কথা বলেছেন? আমার মনে হয় এই ব্যাপারে কনস্টেবল আপনাকে যথেষ্ট সাহায্য করতে পারবেন। তিনিই কিন্তু প্রথম এই অপরাধটা দেখেছেন, তাই তার জবানবন্দির একটা আলাদা দাম আছে বৈকি।

.

০৪.

 ডেক চেয়ারের ওপর বসে আছেন মিস্টার স্পিনলো। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি বোধ হয় জগৎ সংসার থেকে দূরে কোথাও হারিয়ে গেছেন। তিনি ঠাণ্ডা শান্ত স্বরে বলছেন–আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, কীভাবে ঘটনাটা ঘটেছে। আমার শ্রবণ শক্তি খুব একটা প্রখর না, অনেক শব্দ আমি ঠিক মতো শুনতে পাই না। কিন্তু আমার মনে হল একটি অল্প বয়সী ছেলে আমাকে ডেকে বলেছিল-ক্লিসেন্ট কার নাম? তার গলার শব্দ শুনে আমি ভেবেছি সে হয়তো কাউকে খুঁজছে, কিন্তু আমি, আমি ভাবতেই পারিনি যে, আমার প্রিয় সহধর্মিনী আর বেঁচে নেই। আমি, আমি কী করে তাকে জগৎ থেকে হারিয়ে ফেললাম।

মিস মার্পল একটি মৃত গোলাপের পাপড়ির দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন-তার মানে ওই ছেলেটি কি আপনাকে কোনো খবর দিতে এসেছিল? এই ব্যাপারে আমি একেবারে সুনিশ্চিত।

কিন্তু একটি বালকের মাথার ভেতর থেকে এমন বুদ্ধি আসবে কি? আমি তো কিছুই মাথা মুণ্ডু বুঝতে পারছি না।

মিস মার্পল বললেন–হ্যাঁ, এখন দেখা যাক বড়োরা কী কথা বলতে পারে?

তার মানে? অন্য অনেকের মনেও একই ভাবনা ঘুরপাক খেয়েছে?

 –সেন্ট ম্যারিমেড-এর বাসিন্দাদের মধ্যে অর্ধেকজনই এই ভাবনাটায় একেবারে আপ্লুত হয়ে গেছে।

-কেন, কেন বলুন তো? এই ধরনের একটা ভাবনা কেন ভাবনায় এসেছে? আমাকে সবাই দোষী সাব্যস্ত করতে চাইছে কেন? আমি করেছি? আমি যে আমার স্ত্রীকে কতখানি ভালোবাসতাম তাতো সকলেই জানেন। আহা, আমি ভাবতেই পারছি না এখন আমার জীবন কীভাবে কাটবে? আসলে তার জন্য আমি শহর ছেড়ে গ্রামে বসবাস করতে শুরু করি। আমি ভেবেছিলাম এখানে আমাদের দিনগুলো ভালোভাবেই কেটে যাবে। হয়তো কোনো কোনো ব্যাপারে আমাদের মধ্যে সামান্য মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে, সেটাই স্বাভাবিক, তার জন্য আমি কখনো তাকে দোষারোপ পর্যন্ত করিনি। এই শূন্যতা আমি সামাল দেব কী করে?

–হয়তো আপনার মুখ থেকে ছুটে আসা প্রতিটি শব্দ সঠিক, কিন্তু আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য আপনি কী বলবেন? আপনার হাতে কোনো অস্ত্র আছে কি?

মিস্টার স্পিনলো এবার উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন–আমার প্রিয় মহাশয়া, অনেক বছর আগে আমি এক চীনা দার্শনিকের কথা শুনেছিলাম। যিনি তাঁর স্ত্রীকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তখনকার দিনের নিয়মানুসারে সেই মহিলাটিকে রাস্তায় নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে নানাভাবে আহত এবং আক্রান্ত করা হয়। যেটা ছিল চীনা সমাজের এক বিকৃত উল্লাস, আমি জানি, তখন তার মনের ভেতর কী ভাবনার অনুরণন ধ্বনিত হয়েছিল। এক্ষেত্রে আমার মনও একই ভাবনায় প্লাবিত হয়েছে। আমি কী ভাবে আমার মনোভাব প্রকাশ করব?

মিস মার্পল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন মিস্টার স্পিনলোর দিকে। তারপর বললেন সেন্ট ম্যারিমেড-এর মানুষরা কিন্তু আপনার এসব তত্ত্ব কথায় বিশ্বাস করবে না। তাদের কাছে চীনা দার্শনিক তত্ত্বের কোনো মূল্য নেই।

-কিন্তু আপনি কি আমার কথা বুঝতে পারছেন?

 মিস মার্পল এবার বললেন–আঙ্কেল হেনরি এই ধরনের মানুষরা আবেগ এবং অনুভূতিকে সংযত রাখতে পারে না। মাইকেল হেনরির উদ্দেশ্য কী ছিল? কখনো সর্বজন সমক্ষ্যে আবেগ দেখাবে না। ওই ভদ্রলোক কিন্তু ফুল ভালোবাসতেন।

এবার মিস্টার স্পিনলো বললেন–আমি একটা অন্য জিনিস ভাবছি, আপনার কথা বলার মধ্যে এক ধরনের ঔৎসুক্য ফুটে উঠেছে। আমি বাগানের এককোণে একটি সুন্দর পুরু বাগিচা তৈরি করেছি। একেবারে পশ্চিমদিকে। সেখানে গোলাপি গোলাপেরা সুবাস ছড়ায়। উসটোরি ফুলও আছে। এছাড়া একটি তারার মতো দেখতে সাদা ফুলও আছে, যার নাম এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে না।

ওই ভদ্রলোক খুব আস্তে আস্তে কথা বলছেন, তখনই মিস মার্পল বলছেন-এই তো, এখানে যে তালিকা আছে, সেখানে ফুলের নাম ও ছবি আছে। আপনি হয়তো এই ধরনের ফুলের কথা বলতে চাইছেন। এমন ফুল গ্রামে অনেক দেখতে পাওয়া যায়।

মিস্টার স্পিনলো ওখানে বসে থাকলেন, তার কোলের ওপর ক্যাটালগ। মিস মার্পল তার ঘরের ভেতর চলে গেলেন, একটি বাদামি কাগজে কোনো একটি পোশাক তুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তাকে এখন অতি দ্রুত পোস্ট অফিসে যেতে হবে। ড্রেস মেকার মিস্ পলিট ওই পোস্ট অফিসের পাশের ঘরেই বসবাস করেন।

মিস মার্পল সোজা ওপরের সিঁড়ি ধরে উঠে গেলেন। দুটো বেজে তিরিশ মিনিট, এক মুহূর্ত দেরি হয়েছে, মাচঝেহেমের বাস পোস্ট অফিসের দরজার সামনে এসে থামল। সেন্ট মেরিমেড-এর দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় এটা একটা মনে রাখার মতো ঘটনা। পোস্ট-মিস্ট্রেস পার্শেল নিয়ে বেরিয়ে এলেন। পার্শেলটা এখনই বিলি করতে হবে। পোস্ট অফিস যে শুধুমাত্র ডাক বিলি করে তা না, এখান থেকে সন্দেশ পাওয়া যায়, ছোটোদের খেলনা বাটি আর সস্তা দামের বই পত্র।

কিছুক্ষণের জন্য অন্তত চার মিনিট মিস মার্পল পোস্ট অফিসে একলা ছিলেন।

 পোস্ট-মিস্ট্রেস ফিরে আসার পর্যন্ত মিস মার্পল সেখানেই থাকলেন। তিনি সিঁড়ি ধরে ওপরতলায় গিয়ে মিস পলিটের কাছে সব কথা খুলে বললেন। তাকে একটা পুরোনো ধূসর রঙের ক্রেপের কাপড় দিতে হবে। আরও কিছু, মিস পলিট সব কিছু দেবার প্রতিশ্রুতি দিলেন।

.

০৫.

মিস মার্পলের নাম শুনে চিফ কনস্টেবল একটুখানি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি এসে নানা ধরনের ক্ষমা প্রার্থনা করে বললেন–খুব দুঃখিত, আপনাকে এভাবে বিরক্ত করতে হচ্ছে বলে। আমি আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আপনাকে অত্যন্ত ব্যস্ত মুহূর্ত কাটাতে হয়। কর্নেল মেলচেট আশা করি আপনি আমার ধৃষ্টতা ক্ষমা করবেন। আমার মনে হচ্ছে ইন্সপেক্টার প্যাট না হয়ে আপনি আমার সঙ্গে কথা বলতেন তা হলে রহস্যের সমাধানটা এতদিনে হয়ে যেত। একটা বিষয় আপনাকে আমি খুলে বলছি। কনস্টেবল পলককে বলবেন, সে যেন সাহায্য করে। সত্যি কথা বলতে কী কনস্টেবল পলকের সাক্ষ্য এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হতে পারে।

এসব কথা শুনে কর্নেল মেলচেট কেমন যেন হয়ে গেলেন। তিনি বললেন–পলক? সেন্ট ম্যারিমেড-এর কনস্টেবল? এই সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে তার কাছে যেতে হবে। নাকি?

–ওই ভদ্রলোক একটা পিন তুলে নিয়েছিলেন, আপনি কি তা জানেন? এটা ছিল টিউনিকের সঙ্গে লাগানো। আমার মনে হয় এই পিনটা বোধহয় পাওয়া গেল মৃতা স্পিনলোর বাড়ি থেকে।

শান্ত হোন, শান্ত হোন। ঠিক করে বলুন তো, এই পিনটা নিয়ে এত চিন্তা করার কি আছে? মিসেস স্পিনসোর মৃতদেহের কাছে এই পিনটা ছিল, তাই তো? প্যাট তো এই কথাটা গতকাল আমাকে জানিয়েছিল, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। না, কোনো বস্তু তো সরানো হয়নি। ব্যাপারটা নিয়ে এত মাথা ঘামাবার কিছু আছে কি? এতো একটি অত্যন্ত সাধারণ পিন, এইদিন মেয়েরা যা সচরাচর ব্যবহার করে থাকে।

-না না কর্নেল মেলচেট, এখানেই কোথাও বোধহয় আপনার ভুল হচ্ছে। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির তফাতে অনেক বস্তু তার বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে। একজন সাধারণ পুরুষের চোখে যাকে অতি সাধারণ পিন বলে মনে হচ্ছে, এটা কিন্তু তা না। এটা এক বিশেষ ধরনের পিন, অত্যন্ত পাতলা, যেটাকে আমরা ব্যবহার করে থাকি কোনো পোশাক পরিচ্ছদ পরার জন্য। ড্রেসমেকাররা সচরাচর যে পিন ব্যবহার করে যাবে।

মেলচেট এবার অবাক চোখে মিস মার্পলের দিকে তাকালেন। তিনি কি সমস্যার গভীরে প্রবেশ করতে পারছেন? মিস মার্পল অধৈর্য হয়ে বার বার তার মাথা নাড়লেন।

-হ্যাঁ, এবার আমি একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছি। তার মানে? ওই ভদ্রমহিলা কিমানো পরেছিলেন কেন? তিনি তার নতুন পোশাকটা পরার চেষ্টা করছিলেন। তার জন্য তিনি সামনের ঘরে চলে গিয়েছিলেন। মিস পলিট তখন কী করছিলেন? মিস পলিট বোধ হয় ব্যস্ত ছিলেন তাঁর কাজে। আর তিনি সামান্য অসতর্কতার মুহূর্তে ভদ্র মহিলার গলায় টেপ পেঁচিয়ে দিয়েছিলেন। কেন একাজটা তিনি করেছিলেন? হা, এই হত্যাকাণ্ড করা হয়েছে গলায় টেপ পেঁচিয়ে দিয়ে। তারপর? আবার অতি দ্রুত মিস পলিট বাইরে বেরিয়ে যান। দরজা বন্ধ করে দেন। তারপর? সামনে দাঁড়িয়ে বারবার দরজায় বেল বাজাতে থাকেন। এর অর্থ কী? এর অর্থ তিনি সকলকে বোঝাতে চেয়েছিলেন, তিনি বোধহয় তখনই ওখানে এসেছেন। কিন্তু ওই পিনই তার সর্বনাশের প্রহর ঘনিয়ে এনেছে। ওই পিনই বলে দিয়েছে আগেই তিনি ঘরের মধ্যে ঢুকেছিলেন, বাকিটুকু সবটাই তার অভিনয়।

তার মানে? মিস পলিট শ্রীমতী স্পিনলোকে খুন করেছিল, তাই তো?

–হ্যাঁ, পোস্ট অফিস থেকে ফোনটা করা হয়। দুটো বেজে তিরিশ মিনিটের সময়, তখন বাসটা আসে এবং কিছুক্ষণের জন্য পোস্ট অফিস ফাঁকা হয়ে যায়, তখন মিস পলিট এই সুযোগটাই গ্রহণ করেছিলেন।

কর্নেল মেলচেট বললেন–কিন্তু মিস মার্পল কেন? কেন এমন একটা হত্যার সঙ্গে মিস পলিট নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন? আমরা জানি যে কোনো হত্যার অন্তরালে একটা সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য থাকে। যাকে আমরা মোটিভ বলে থাকি। এক্ষেত্রে মোটিভটা কী, সেটাই তো আমার বোধগম্য হচ্ছে না।

আচ্ছা, আমি সব কিছু বুঝিয়ে বলছি। কর্নেল মেলচেট, আপনি কি বুঝতে পারছেন, এই হত্যার পরিকল্পনাটা অনেক বছর আগে করা হয়েছে। আপনি কি আমার দুজন ভাইয়ের গল্প শুনবেন? আমার নিজের ভাই নয়, তুতো ভাই। কিন্তু মনে হচ্ছে এই গল্পটা আপনার শুনে রাখা দরকার। তাদের নাম হল অ্যান্টনি আর গর্ডন। অ্যান্টনি যা কিছু করত সেটাকে সঠিক বলে মনে করত। হতভাগ্য গর্ডন কিন্তু কোনো ব্যাপারে তার সঙ্গে একমত হতে পারত না। এইভাবে তাদের মধ্যে একটা ঝগড়ার পরিবেশের সৃষ্টি হয়। আর এক্ষেত্রে কী হয়েছে? এক্ষেত্রে দুই মহিলা একে অন্যের বিপরীতে চলতে গিয়ে এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, যার ফলে দুজনকে প্রাণ দিতে হয়।

কর্নেল মার্পলের কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারছেন না। তিনি প্রশ্নবোধক চোখে তাকিয়ে থাকলেন মিস মার্পলের দিকে। তারপর বললেন–আপনি কি অনুগ্রহ করে আমাকে সব বুঝিয়ে বলবেন?

–ওই ডাকাতির ঘটনাটা একবার ভাবুন তো। কত দামী মরকত মণি চুরি হয়ে গিয়েছিল, অন্তত আমি যা শুনেছি। এই ঘটনার সাথে দুজন মহিলার নাম জড়িয়ে যায়, একজন হল ওই ভদ্রমহিলার পরিচারিকা, আর একজন অচেনা মহিলা। একটি ব্যাপার কিন্তু এখনও পর্যন্ত অমীমাংসিত থেকে গেছে, যখন ওই মেয়েটি উদ্যান পরিচালককে বিয়ে করে তখন তার হাতে কি এত অর্থ ছিল, যা দিয়ে সে একটা ফুলের দোকান তৈরি করতে পারে? এই সমস্যার সমাধান হল ডাকাতির একটা ভালো অংশ সে পেয়েছিল। এটাই হল একটা সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত। আপনি তো জানেন, টাকায় টাকা বাঁধে। কিন্তু ওই বেচারি পরিচারিকা? তার কী হল? সে কি চিরদিন দুর্ভাগ্যকে সাথী করে দিন কাটাবে? সে একটা গ্রামে এসে সাধারণ পোশাক সরবরাহকারীর পেশা গ্রহণ করল। অনেক বছর পরে তাদের মধ্যে আবার দেখা হয়। আমার মনে এক্ষেত্রে টেড গের্যান্টের কিছু ইতিবাচক ভূমিকা আছে।

..মিসেস স্পিনলো সব সময় বিবেকের দংশনে ভুগতেন, তিনি অত্যন্ত আধ্যাত্মিক স্বভাবের মহিলা ছিলেন। আর ওই ভদ্রলোক যখন তাঁর জীবনে নতুন বার্তা নিয়ে এল, তখন তিনি আপনার সামনে দাঁড়িয়ে ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি হয়তো সব কথা খুলে বলার জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠেছিলেন। আবার মিস পলিটের ক্ষেত্রে ঘটনাটা একেবারে অন্যভাবে ঘটে যায়। পলিট বুঝতে পারছিল যদি মিসেস স্পিনলো বেঁচে থাকেন তাহলে একদিন হয়তো ডাকাতির অপরাধে তাঁকেই দোষী সাব্যস্ত করা হবে। শেষ পর্যন্ত তার দিন কাটবে রুদ্ধ কারার অন্তরালে। অনেক বছর আগে ঘটে যাওয়া একটা মারাত্মক ঘটনার ফল তাকে এই ভাবেই ভোগ করতে হবে। অথচ মিসেস স্পিনলোকে কেউ সন্দেহ পর্যন্ত করতে পারবে না। এই সমস্যার সমাধান কী ভাবে হতে পারে? অনেক দিন বেচারী পলিট নিজের বিবেকের সঙ্গে লড়াই করেছে, শেষ পর্যন্ত সে একটার ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছে গেল। যে করেই হোক মিসেস স্পিনলোকে পৃথিবী থেকে সরাতেই হবে। মাঝে মাঝে মানুষ আবেগ দ্বারা তাড়িত হয়ে কত অসম্ভব কাজ যে করে ফেলে, এছাড়া মিস পলিটকে যতটুকু দেখেছি, সে কিন্তু অত্যন্ত শয়তানি মনোভাবের মেয়ে। সে-ই এই বুদ্ধিটা করে, যাতে মিস্টার স্পিনলোকে ফাঁসিকাঠে ঝুলতে হয়, তাহলে হয়তো তার দুটো উদ্দেশ্য সফল হবে।

কর্নেল মেলচেট আমতা আমতা করে বলতে থাকেন–আপনার এই তথ্যটাকে আমি একেবারে খারিজ করতে পারছি না। কিন্তু কি সত্যি সত্যি অ্যাবারক্রমগাই এর পরিচারিকা? এ ব্যাপারে আপনি একশো ভাগ নিঃসন্দেহ?

এবার মিস মার্পলের ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি দেখা গেল। তিনি আশ্বস্ত সুরে বললেন–আমার অনুসন্ধানের কাজে কখনো কোনো ভুল হয় না, কর্নেল। আমি যখন যে কথা বলি, অনেক ভেবে চিন্তেই বলি। তাহলে কী হল? তাহলে দেখা গেল সত্য একদিন প্রকাশিত হবেই। এছাড়া আমি ওই টেপটার মাটা নিয়েছি, গতকালই আমি এটা করেছি। দেখা গেল, পুলিশ এদিকে নজর দেয়নি, আসলে পুলিশ বুঝতেই পারেনি যে, এখন থেকে হত্যার বিষ তীর ছুটে আসতে পারে। আমার মনে হয় আপনি ব্যাপারটা এই ভাবে সাজিয়ে নিন। তাহলে এই কেস-এ আপনি জিতে যাবেন।

এবার মার্পলের ঠোঁট থেকে বেরিয়ে এল আশাব্যঞ্জক হাসি। তিনি বললেন আপনার কোনো সমস্যা হবে না, আমি আপনাকে একশো ভাগ সাহায্য এবং সহায়তা করব।

অনেক দিন বাদে মিস মার্পলের ঠোঁটে আবার আশ্বস্ত ভরা হাসি দেখা গেল। মনে হল এক ছাত্র বোধহয় অনেক কষ্টে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে কলেজে ঢোকার ছাড়পত্র পেয়ে গেছে।

সত্যি কথা বলতে কী, ওই পরীক্ষায় কর্নেল ভালোভাবেই পাশ করতে পেরেছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *