টেককা টেককি – কণা বসুমিত্র
ঠাণ্ডায় জবুথবু হয়ে চাদরটা গায়ে জড়িয়ে বসেছিল তিলক। ওর চোখের সামনে দিয়ে সকাল ফুরিয়ে যাচ্ছে। রোববার অথচ বেরোতে পারেনি। এই রোববারের সকালটাই সব থেকে দামি মনে হয় তিলকের কাছে। অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। সামনের রাস্তাটায় রীতিমতো জল দাঁড়িয়ে গেছে। আকাশ এখন মেঘলা। তিলক শীতকাতুরে হলেও শীত ভালবাসে। গরম মোটেই সহ্য হয় না ওর। লোডশেডিংয়ের দাপটে প্রায়ই ও সদিগর্মিতে ভোগে। অসহ্য গরমের পর সবে বর্ষা নেমেছে। সেই সঙ্গে ঝোড়ো বাতাস। তিলক বারান্দায় বসে হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে বাগানের আমগাছের ডালে কাকের বাসা দেখছে। কদিন ধরে ঠোঁটে করে খড়কুটো এনে কাকটা দিব্যি বাসা বানিয়েছে। তারপর ডিম পেড়েছে। এখন যত্ন করে সেই ডিমে তা দিচ্ছে। ঝড়ের বেগে সব ডালপালা তখন ওলোট পালোট খাচ্ছে, কাকটা অসহায় ভীত চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তিলক ভাবে, কাকটাকে যদি ও সাহায্য করতে পারত।
ওদিকে তিলকের বউ রান্নাঘর থেকে তখন হাঁক পাড়ছে, কি গো বাজার টাজার যাবে না?
তিলকও চেঁচায়, এই জল কাদায় যাই আর কি? খিচুড়ি আলু-পেঁয়াজ ভাজা আর ডিমভাজা করে দাও। ফার্স্ট ক্লাস। আজ তো খিচুড়ি খাবার দিন।
তিলক একেই কুঁড়ে। বাজারে যেতে চায় না। তারপর আবার বৃষ্টি হওয়ায় পোয়া বারো। কিন্তু বৌয়ের হাত থেকে কি আর রেহাই আছে? তেড়ে আর এক চোট বৃষ্টি নামে। তিলক মনে মনে খুশি হয়ে একটা সিগারেট ধরায়।
তিলকের বৌয়ের গলা শোনা যায় রান্নাঘরে। তিরিক্ষি মেজাজে কী নিয়ে যেন ঝিয়ের সঙ্গে চঁচামেচি করছে। তিলক জানে, আসল ঝালটা তিলকের ওপরেই ঝাড়ছে। ঝি উপলক্ষ্য মাত্র। তু তিলক নট নড়ন চড়ন।
ওর চোখের সামনে উঠোনের ওই প্যাঁচপেচে কাদা। আমের ডালটা যদি ভেঙে ওর মাথায় পড়ে?
তিলক মরলে বৌ বড়োলোক। কথাটা ভেবেই চাপা রাগে দাঁত কিড়মিড় করে তিলক। তিলকের বৌ কাপড়ে হলুদ মুছতে মুছতে ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। হাত নেড়ে বাজখাঁই গলায় বলে, শুধু চালে ডালে চড়িয়ে দিলেই হবে? নুন আনবে না? পেঁয়াজ আদা লঙ্কা? ডিমভাজা, আলু ভাজার ফরমাশও তো আছে?
তিলকের মাথায় ধাঁই করে বেজে ওঠে পেঁয়াজ শব্দটা। তিলক ব্যঙ্গ মেশানো। গলায় বলে, আমাদের বাড়ি বাপু পেঁয়াজ টেয়াজ চলত না। পেঁয়াজ, মুরগি, এসব শব্দগুনো তুমি আসার পরই আমদানি…। তিলকের বৌ তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে।
–কী কী বললে? আমি এসে? আমি এসে তোমার জিভের স্বাদ বাড়িয়েছি। বল? জানতে কিছু? পেঁয়াজ ছাড়া কি মশুর ডালের পাতলা খিচুড়ি হয়? পেঁয়াজ টমেটো..? এতদিন তো শুধু খেয়েছ তোমরা মুগডালের খিচুড়ি।
তিলক হেসে বলে, মুগডালের খিচুড়িতে কেমন পুজো পুজো ভাব বল তো?
–কী, কী বললে?
তিলক বিড়বিড় করে বলে, ড্যামভ্যান উইল।
–কী বললে?—এবার তিলকের বৌয়ের গলার স্বর আরও চড়া। তিলক কথা ঘুরিয়ে মুচকি হাসে। বলে, বলছিলাম ভোগের খিচুড়িই হোক না আজ।
তিলকের বৌ চোখ বড়ো বড়ো করে বলে, বললেই হল? কোথায় তোমার গরম মশলা ঘি নারকেল,পেস্তা বাদাম কিশমিশ?
তিলক বৌয়ের ফর্দ শুনে আঁতকে ওঠে।–এসব তোমার স্টকে নেই?
–কী করে থাকবে? বাজার যাও কদিন?
—তুমিও তো যেতে পার। তুমি তো বাপু পর্দানসীন যুগের বালিকা বধুটি নও?
–নই। কিন্তু কেন যাব? তুমি রান্নাঘরের হেঁসেলটি ধরবে? আজকাল তো ফিফটি ফিফটির যুগ, তাই না? দুজনেই দুজনের কাজ সমান ভাবে ভাগ করে নেব।
—বেশ, তুমি তবে অফিস যাও?
–অফিস তো যেতুম। চাকরিটা ছাড়িয়ে দিলে কেন? হেঁসেলটা ধরার জন্যে নয়?
—যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে।
–এখন একথা বলছ, কিন্তু সেদিন? আমি তো তাই চেয়েছিলুম?
কথা চলে যাচ্ছে অন্যদিকে। অশান্তির ঝড় উঠবে। তিলক চট করে বলে বসে, বৌ ট্রামে, বাসে, ঠেলাঠেলি তোণ্ডতি খেয়ে চাকরি করতে যাবে, আর আমি তাই বসে বসে দেখব?
—ওসব ছাড়ো, ঢের হয়েছে আদিখ্যেতা। এবার ভোগের খিচুড়ি না কী বলছিলে, তাই বল?
তিলক বলে, কী বলব? ঘরে কি মুগডাল, গোবিন্দভোগ নেই? নারকেল, কাজুর দরকার কী? আমার মাও তো খিচুড়ি করতেন!
তিলকের বৌ বলে, কী বললে। তোমার মা ঘি গরমমশলা পেস্তা ছাড়া ভোগের খিচুড়ি করতেন কী করে? ভোগের খিচুড়ি বলতে আমরা তাই বুঝি গো। তোমাদের বাড়ির সঙ্গে আমাদের বাড়ির ঘরানার এটাই ফারাক। আমি বনেদি বাড়ির মেয়ে বুঝলে? কথাগুলো বলেই তিলকের বৌ ব্যঙ্গের হাসি হাসে।
বৌয়ের কাছে হেরে গিয়ে তিলক মনে মনে লজ্জা পায়। কারণ, তিলক জানে, ওর বাপের বাড়ির গল্পের এখানেই শেষ নয়। তিলক তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ভোগের খিচুড়ি আমার মাও অমনি করে করতেন। তবে এখানে মানুষের ভোগের প্রশ্ন উঠছে কিনা।
তিলকের বৌ ভেঙে পড়া এলোখোঁপা ঠিক করতে করতে বলে, দেবতার ভোগ শেষ পর্যন্ত কাদের পেটে যায় মানুষছাড়া?
তিলক বলে, আহা! থামবে? এই বৃষ্টির মধ্যে দোকানপাট কি তেমন খুলেছে। বল? তুমি বরং সস্তার খিচুড়ি টিচুড়ি কিছু একটা করে দাও।
তিলকের বৌ ফের জ্বলে ওঠে। বলে না, সস্তা নয়। সস্তার খিচুড়ি আমি জানি না। আমি তো সস্তা বাড়ির মেয়ে নই? জানব কী করে?
–মুশকিল! জানা উচিত ছিল। দ্যাখো দেখি, এই দুর্দিনের বাজারে…।
তিলকের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ওর বৌ বলে, তোমার মায়ের তাহলে মেয়ে দেখতে যাবার সময় বলা উচিত ছিল, তুমি সস্তার রান্না কী শিখেছ মা? তা না বলে, উনি তো আমায় পোলাও, কালিয়া, চিংড়ির মালাইকারির রেসিপি জিজ্ঞেস করেছিলেন? ছেলের ক্ষমতার কথাটা ভেবে সস্তার রান্নার রেসিপি জিজ্ঞেস করলেই পারতেন?
বৌয়ের কাছে মুখ ঝামটা খেয়ে তিলক চুপ করে যায়। এমন সুন্দর বর্ষার সকাল! কোথায় রসের কথা বলবে তা নয়। কী ঠিকুজি মিলিয়েই না মা বিয়ে দিলেন আহা! কিন্তু সেই বা কম যাবে? তিলক বলে, ওসব রান্নার রেসিপি জিজ্ঞেস করলেই তুমি পারতে? এমন একটা ভাব দেখাচ্ছ যেন কোনো হাই ফাই ঘর থেকে আসছ তুমি।
তিলকের বৌ বলে, তাহলে কী আর তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হত?
–সক্কালবেলা তুমি কি থামবে? তিলকের বৌ বলে, তুমি যত জোরে চ্যাঁচাবে, আমিও ততজোরে চ্যাঁচাব। তিলক বলল, তা আর চ্যাঁচাবে না? জ্যোতিষীকে দিয়ে ফলস্ কুষ্ঠি করে তো তোমার মা বিয়ে দিয়েছিলেন।
তিলকের বৌ চোখ কপালে তুলে বলে, আর তোমার মা বুঝি ধোওয়া তুলসী পাতা? উনি যাননি পঞ্চানন জ্যোতিষীর কাছে তাঁর ছেলের নতুন কুষ্ঠি করতে?
তিলক বলে, গিয়েছিলেন নিশ্চয়। যেমন তোমার মা গিয়েছিলেন।
—এই খবরদার আমার মা তুলে কথা বলবে না বলছি। অত ছোট কাজ আমার মা করেন না বলছি।
আমার মা-ই বুঝি করেন? —তিলক চেঁচিয়ে বলে, তিলকের বৌ ততোধিক চেঁচায়। উনি স্বর্গে গেছেন। ওঁকে নিয়ে আর কথা বাড়াতে চাই না। তোমাদের পরিবারের নাড়ি নক্ষত্র আমার জানা।
বৌয়ের সঙ্গে তর্কে তিলক একেবারেই পেরে ওঠে না। ও দারুণ রেগে যায়। ও পাঞ্জাবির পকেট বাজিয়ে বলে, তোমার মা, বাবা কি খোঁজ খবর না নিয়েই বিয়ে দিয়েছিলেন? আমার অফিসে যান নি খবর নিতে? আমি রিটায়ার করলে কত পাব, না পাব, একেবারে ক্যালকুলেশন করেই না ওঁরা…।
—থামো, থামো। —তিলকের বৌ বলে, তোমার মা বড়ো গলা করে বলেছিলেন, বিয়ের পরই নাকি তুমি ফরেন চলে যাবে?
–ফরেন? —তিলক কপালে চোখ তোলে। বলে, একথা আবার কে বলল?
তিলকের বৌ চোখ ঘুরিয়ে বলে, কে আবার বলবেন? তোমার মা-ই বলেছিলেন।
তিলকের মেজাজ এবার সত্যি চড়ে যায়। ও দুহাত অস্থিরভাবে চুলের মধ্যে চালাতে চালাতে বলে, বাজে বকবে না বলছি। একদম বাজে বকবে না। আমার মায়ের তো আর মাথা খারাপ হয়নি? তিলকের বৌ বলে, মাথা খারাপ কেন হবে? একেবারে সুস্থ স্বাভাবিক মাথাতেই বলেছিলেন উনি।
–দ্যাখো, আমার মায়ের নামে মিথ্যা বলবে না বলছি।
তিলকের বৌ কপালে হাত ছুঁয়ে বলে, ছিঃ! মিথ্যে বলব কেন? উনি স্বর্গে গেছেন। ওঁর নামে কি মিথ্যে বলতে পারি? তিলক কোনো কথা বলে না। ও গম্ভীরভাবে বারান্দায় মোড়ার ওপর বসে বসে পা দোলায়। ওর মা যদি এখন বেঁচে থাকতেন? ও সোজা গিয়ে চেপে ধরত ওঁকে। মায়ের স্বভাবই ওই ছিল, ছেলের
মতা থাক বা নাই থাক, বানিয়ে বানিয়ে তিলকে তাল করা। বিয়ের বাজারে ছেলের নাম তো বাড়ালেন, এখন ঠেলা সামলাবে কে?
তিলককে জব্দ করতে পেরে তিলকের বৌ মহা খুশি। আড়চোখে সে স্বামীকে রিপ করতে করতে বলে, তোমার মা অবশ্য মিথ্যে বলেন নি। সত্যি তো ফরেন গিয়েছিলে তুমি। বাংলাদেশ যাওনি—কথাগুলো বলেই ও মুখ টিপে হাসে।
অপমানে তিলকের মুখ লাল। সে আগুন চোখে স্ত্রীকে দেখে। তারপরই চেঁচিয়ে ওঠে, থামবে?
ঠিক সেই সময় গেট খুলে কারা যেন হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে। তিলক একগাল হেসে বলে, একেবারে কাকভেজা হয়ে যে। আরে এসো, এসো।
তিলকের বৌ পর্দা সরিয়ে বলে, ওমা, তোমরা? বোসো, বোসো।
তিলক ত্যারছা চোখে স্ত্রীর দিকে তাকায়। আগন্তুক মহিলাটির চোখে মুখে হাসির বান। বলে যাক, চিনতে পারছ?
তিলকের বৌ বাঁকা হাসি ছুঁড়ে বলে, কী যে বল? ও মুখ কি ভোলবার? তিলক বিরক্ত হয়, বৌয়ের ব্যঙ্গে। মহিলা তিলকের পূর্ব প্রেমিকা। বর্তমানে বন্ধুপত্নী। ওদের প্রেম যদিও বেশিদূর এগোয় নি। এই আড়ে আড়ে চাওয়া, কথার পৃষ্ঠে দু একটা কথা। ছোঁড়া। লুকিয়ে চুরিয়ে দূর থেকে চোখাচোখি। পয়লা বৈশাখের সকালে শুভেচ্ছা জানানোর ছলে একে অন্যকে রক্ত গোলাপ দেওয়া। হাতে হাত ছুঁইয়ে প্রেমের প্রতিশ্রুতি। এই আর কী। কিন্তু সেই পূর্বরাগের পালা চলতে না চলতেই মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পরই তিলক আবিষ্কার করে, ওরই এক বন্ধু ওর প্রেমিকার স্বামী।
সেই সব গল্পই দুর্বল মুহূর্তে তিলক করেছে বৌয়ের কাছে। ব্যস, আর যায় কোথায়? উঠতে বসতে সেই খোঁটা।
বন্ধু-পত্নী এলেই তিলক আজকাল খুব স্মার্ট হবার চেষ্টা করে। বুকের ভেতর পাথর চাপা যন্ত্রণা নিয়েও তিলক হাসিমুখে ওদের অভ্যর্থনা জানায়। এখন তিলক ঠোঁটে একটা সিগারেট গুঁজে বন্ধুর দিকে আর একটা এগিয়ে দেয়।
সহাস্যে বন্ধু-পত্নীকে বলে, তারপর? অ্যাদ্দিনে মনে পড়ল? এ রাস্তা দিয়ে কি আর হাঁটা টাটা হয় না? বন্ধুপত্নীও কলকল করে ওঠে, আমাদের বাড়িটাই কি খুব বেশি দূরে? মনে আছে নিশ্চয়?
তিলক উত্তর দেবার আগেই ওর বৌ বলে ফেলে, না না, এত তাড়াতাড়ি ভুল হবার নয়। তিলক শ্যেনদৃষ্টিতে বৌয়ের দিকে তাকায়। এতদিন বাদে দেখা, কিন্তু এভাবে বাগড়া দিলে কি কথা জমে? বৌয়ের মুখ নাড়া খেয়ে যে তিলক শামুকের খোলের মধ্যে গুটিয়েছিল, সেই তিলকই এখন একটু একটু করে বেরিয়ে আসে। তিলক ভাবে, এই বিবাহ শব্দটার মধ্যেই যত গণ্ডগোল। বিয়ে ফিয়ে না করলে তো দিব্যি বন্ধু-পত্নী টীদের নিয়ে চালিয়ে দেওয়া যেত।
তিলকের বন্ধুটিও কম স্মার্ট নয়। তিলকের বৌয়ের দিকে তাকিয়ে সে বলে, কী ব্যাপার? আমার বৌ-ই বুঝি এ বাড়ির প্রধান অতিথি? আমি আর কেউ নই? আমায় বসতে বলনি তো?
তিলকের বৌ ব্যস্ত হয়ে বলে, বসুন, বসুন। এক যাত্রায় পৃথক ফল, তা কি হতে পারে?
গোঁফ মুচড়ে তিলকের বন্ধু আয়েশ করে বসে। তিলকের দিকে তাকিয়ে বলে, জানিস তো বেশিদিনের অদর্শনে সম্পর্কটা জোলো হয়ে যায়।
তিলকের বৌ বলে, তাই নাকি। আমার তো মনে হয়, সম্পর্কটা আরো গাঢ় হয়। আমাদেরই দেখুন না, রোজকার এই মাজাঘষা জীবনে…। তিলকের বৌ আরো কী বলতে চায়। কিন্তু তিলক কড়া চোখে একবার তাকিয়েই বৌকে থামিয়ে দেয়। তিলক ভাবে, এই মুখরা স্ত্রীলোকদের জন্যেই সংসারে যত অঘটন। ওর বন্ধু-পত্নী তখন ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাড়ি দেখছে। গোটা বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখে এসে তিলকের একদা প্রেমিকা বলে, যা একখানা বাড়ি করেছে, দারুণ!
তিলক খুশি হয় না। ওর মুখটা ব্লটিং পেপারের মতো চুপসে যায়। সেই মুহূর্তে ওর চোখ চলে যায় ঘরের ফাটা দেওয়ালের দিকে। চুইয়ে চুইয়ে বৃষ্টির জল পড়ছে। এক বছরও হয়নি বাড়ির বয়স। এরই মধ্যে দেওয়াল ফেটে চৌচির। সিমেন্টে ভেজাল। কন্ট্রাকটর পয়সা মেরেছে। তিলক ভাবে সত্যিই কি প্রশংসা করল নাকি ওটা ওর শ্লেষ? তিলক কিছুই বলে না চুপ করে থাকে। ওর বৌই বলে, বাড়ির মালিক যদি মিষ্টি হয়, তবে ফাটা বাড়িও মিষ্টি কী বল?
কোয়দায় পড়ে তিলক ভেতরে ভেতরে জ্বলতে থাকে। সেই বেকায়দা অবস্থা থেকে ওকে অবশ্য উদ্ধার করে ওই একদা প্রেমিকাটিই। সে বলে, বাড়ির মালিক মিষ্টি না টক, ঝাল, তেতো সে ভাই যে ঘর করে সে বোঝে। মিষ্টি হলেই বা, মিষ্টির ভাগটা তার ভাগ্যে জোটে কি?
তিলকের বন্ধু বলে, চ্যাপ্টারটা এখন বন্ধ করলে হয় না? —সে তার স্ত্রীর দিকে তাকায়। তিলক তাড়াতাড়ি বৌকে বলে, যাও যাও চটপট চা করে নিয়ে এস। লাহিড়ীর গিন্নি একেবারে ভিজে ফিজে গেছে।
তিলক সহজভাবে ওদের দিকে তাকায়। কিন্তু তিলকের বৌয়ের বুকে কথাটা ধ করে বাজে। তিলকের বৌ ভাবে, আহা, সে কি এ বাড়ির দাসী বাঁদি? লাহিড়ী গিন্নির জন্যে চা করতে যাবে? তিলকের বৌ তাই সঙ্গে সঙ্গেই নড়ে না। উল্টে তিলককে বলে, তুমি যাও তো চটপট বাজারটা সেরে ফেল। চায়ের ভাবনা তোমায় ভাবতে হবে না। তারপরই তিলকের বৌ অদ্ভুত এক কাণ্ড করে ফেলে। সে খপ করে লাহিড়ী গিন্নির হাত চেপে ধরে গলায় মধু ঢেলে বলে, এসো ভাই, কাপড়টা ছেড়ে ফেলো।
অপ্রস্তুত লাহিড়ী গিন্নি বলে, আমার কিছু অসুবিধে নেই। সিনথেটিক শাড়ি। হাওয়ায় দিব্যি শুকিয়ে যাবে। কথাগুলো বলেই লাহিড়ীর বউ উঠে দাঁড়িয়ে। ফ্যানের রেগুলেটারের গতিটাকে বাড়িয়ে দেয়। শাড়ির আঁচলটা ছড়িয়ে ধরে পাখার নিচে। সময়টা বর্ষাকাল হলেও শীতকাতুরে তিলক খক খক করে কাশে। এতক্ষণে ওদের দুজনেরই খেয়াল হয়, তিলকের গায়ের চাদরটার দিকে। লাহিড়ীর বউ হেসে বলে, কী ব্যাপার? আপনার গায়ে কি দার্জিলিঙ পাহাড়?
তিলক লাজুক লাজুক হাসে। তিলকের বউ বলে, ওর তো সব সময় শীত শীত বাকি।
লাহিড়ীর বউ অন্যমনস্কভাবে বলে, জানি?
তিলকের বউ আড়চোখে তাকিয়ে বলে, জানো?
তিলক সপ্রতিভভাবে কথাটা ঘুরিয়ে দিয়ে বলে, হ্যাঁ, পূর্বজন্মের স্মৃতি থেকে।
তিলকের বন্ধু লাহিড়ী বলে, তোমরা আপাতত পূর্বজন্মের স্মৃতিচারণ কর। আমি একটা সিগারেট ধরাই।
লাহিড়ীর কথায় সবাই হেসে ফেলে। তিলকের বউ উঠে দাঁড়ায়। এবার সত্যি সে চা করতে যায়। বউয়ের পেছন পেছন তিলকও যায় রান্নাঘরে। তিলক গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলে, কিগো শুধু চা-ই দেবে? কিছু আনতে টানতে হবে না?
তিলকের বউ কোনো জবাব দেয় না। গুম হয়ে থাকে। তিলক নরম গলায় আমতা আমতা করে, মানে ওরা ভিজে টিজে এল তো? আর অদ্দিন বাদে এল, তাই বলছিলাম, গরম চপটপ…।
তিলকের বউ ফোঁস করে ওঠে, এই না বাজার করার নামে তোমার জ্বর এসেছিল?
তিলকের আর দ্বিতীয় কথা বলা হয় না। ও কেন্নোর মতো গুটিয়ে যায়। তিলক ভাবে, ধিক্ তার পুরুষ জন্ম। এই রকম চল্লিশ ইঞ্চি বুকের ছাতি নিয়েও বউয়ের বিনা
অনুমতিতে ভূতপূর্ব প্রেমিকার জন্য কিছু খাবার দাবার আনার সাহস নেই তার? গোমড়া মুখে ফিরে গিয়ে বাইরের ঘরেই বসে তিলক। ভিজে কাপড়ের মধ্যে থেকে ভুরভুর করে বন্ধু-পত্নীর গায়ের মিষ্টি গন্ধ। তিলক সাবধানে টেনে নিঃশ্বাস নেয়। চোরের মতো চেয়ে দেখে বন্ধু পত্নীকে। লাহিড়ীর বউ আরও গোলগাল হয়েছে। তিলক চাপা নিঃশ্বাস ছেড়ে ভাবে, এই পুরুষোচিত বিশাল শরীরটা নিয়েও সে মেয়েমহলে ভিতুই থেকে গেল? শুধুমাত্র অধিকার প্রয়োগের অভাবে সে এই মেয়েটির জীবনসঙ্গী হতে পারল না
তিলকের বউ খানিকবাদে চা নিয়ে আসে। অন্য প্লেটে চানাচুর। কিছু পকৌড়াও ভেজে এনেছে বউ। তিলক অবাক হয়। তিলককে আরও অবাক করে দিয়ে বউ বলে, বিষ্টি ফিষ্টি পড়ছে, আমাদের সঙ্গে আজ দুটো খিচুড়ি হয়ে যাক না?
কথাটা ছুঁড়েই সে তিলকের দিকে তাকায়। তিলক বোঝে, বউ ওকে টেক্কা দিতে চায়। তিলকের হয়তো খুশি হওয়াই উচিত ছিল। লাহিড়ী আর লাহিড়ীর বউ কিছু বলার আগেই তিলক তাড়াতাড়ি বলে, হ্যাঁ, ওদের বয়েই গেছে তোমার খিচুড়ি
খেতে। রোববারের দুপুর। ওদের হয়তো অন্য কোনো প্রোগ্রাম ট্রোগ্রাম…।
লাহিড়ীর বউ বলে, না সেসব কিছুই নেই। দুপুরটা কাটিয়ে যেতে পারলে তো আমাদেরও ভালই লাগত। কিন্তু ছেলে মেয়েকে ফেলে এসেছি তো? চায়ের কাপে চুমুক মেরে লাহিড়ী বলে, আজ্ঞার পক্ষে খিচুড়ি কিন্তু উত্তম। বৃষ্টিও পড়ছে। তিলক! তাস ফাস চলবে নাকি?
তারপর নিজের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি না হয় বাড়ি যাও। অনেকদিন পর আমাদের আজ এখানে তাসের আড়াই হোক।
ফ্যাসফেসে গলায় তিলক কী বলতে যায়, তিলকের বউ হেসে বলে, ওই বা যাবে কেন? একটা দুপুর কাজের লোকই না হয় ছেলেমেয়েকে দেখবে। ফোন করে, দিলেই হয়?
তিলক আশ্চর্য হয়, তার বউ হাত গলে বেরিয়ে গিয়ে কেন বারবার প্রথম হবে? তিলককে জিততে দেবে না? এখন যে খেলার চালটা তার বউ চালছে, তাতে অবশ্য তিলক খুশি। স্বামীর পূর্ব প্রেমিকার সঙ্গে ভদ্রতা করে বউ উদার হতে চায়। তো হোক হা। চায়ের কাপ শেষ করে তিলক হাসি মুখে উঠে দাঁড়ায়। এই মুহূর্তে তিলকও খুব উদার হয়ে যায়। বউকে বলে, দাও বাজারের ব্যাগটা।
তিলকের বউয়ের চোখে তখন ছুরির ধার। তিলক বউকে এবার গ্রাহ্য না করে সাহসী হয়ে যায়। লাহিড়ী, লাহিড়ীর বউ দুজনেই বাধা দিয়ে বলে, এই না খিচুড়ির মেনু হল? তবে আবার বাজার কেন?
তিলক বলে, শুধু খিচুড়ি খাওয়ালে আমার বউয়ের প্রেসটিজ থাকবে? সেই সঙ্গে ইলিশ মাছ ভাজা যদি না হয়? এই বর্ষার বাজারে যা ইলিশ উঠছে না?
তিলকের বউ তাড়াতাড়ি বলৈ, টিফিন ক্যারিয়ারটা দিয়ে দিই? আসবার পথে অন্নপূর্ণা হোটেল থেকে কিছু কষা মাংসও নিয়ে এসো।
তিলক এবার বিপদে পড়ে যায়। ও মনে মনে গজরায়, মাসের শেষ। পকেট ফাঁকা। হোক গে প্রেমিকা…। তিলক ভালই জানে বউ ঝুটঝামেলা পছন্দ করে না। বাড়িতে মাংস রান্নার ঝামেলা তুললে ও সুড়সুড় করে লেজ গুটিয়ে পালাবে। তিলক বলে, রেস্তারাঁর মাংস খাওয়াবে? তার চেয়ে বাড়িতেই তুমি মাংসটা…। তোমার হাতের কষা মাংস তো চমৎকার।
তিলকের বউ কিন্তু খুশি হয়। হেসে বলে, থাক এদের সামনে আর স্ত্রৈণভাব দেখাতে হবে না। অন্নপূর্ণার কষা মাংস তো তোমার খুব প্রিয়। বন্ধু আর বন্ধু-পত্নীকে তোমার প্রিয় রেস্তরাঁর কষা মাংসের টেস্টটা করানোর সুযোগ যখন পেয়েইছো…।
লাহিড়ী, লাহিড়ী বউ আর একবার বাধা দেয়। তিলকের বউ ততক্ষণে স্বামীর হাতে টিফিন ক্যারিয়ার আর বাজারের ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়েছে। জোর করে সরু এক ফালি হাসি টেনে বেরিয়ে যায় তিলক। ভাবে, এক মাঘে শীত যায় না। ও দুপুরে এর শোধ তুলবে। বউকে সে চেনে।
তাসের আড্ডায় ওরা তিনজন দারুণ জমাবে। তিলকের বউ তাস চেনে না। খেলতে জানে না। লাহিড়ীর বউ তাসে ওস্তাদ। তিলক তাস খেলতে খেলতে লাহিড়ীর বউয়ের চোখে চোখ ফেলতে ফেলতে মাংসের খরচের টাকাটা তুলে নেবে।
বাজার নামিয়ে তিলক বলে, কই গো শুনছ? নাও তুমি তোমার অতিথিদের ইলিশ মাছ ভাজা খাইয়ে শখ মেটাও। আমরা তাসে বসি।
তিলকের বউ বলে, ওমা সেকি! ওর সঙ্গে দুটো সুখ-দুঃখের কথা কইব না? সেজন্যই তো আটকালুম। এসো, এসো, ভাই…। লাহিড়ীর বউয়ের হাত ধরে তিলকের বউ প্রায় টেনেই নিয়ে যায় রান্নাঘরে। মোড়ায় বসতে দেয়।
তিলক চাপা নিঃশ্বাস ছেড়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়। তিলকের মনে হয়, সংসারের এই ম্যারাথন রেসে তিলক আর তার বউ যেন অনবরত ছুটছে। তিলক যতই আগে ছুটতে চাইছে, ততই সে পিছিয়ে পড়ছে। এভাবে তাকে হারিয়ে দিয়ে তিলকের বউ বিজয়িনীর হাসি নিয়ে যেন তিলককে বলছে, বোকা, বোকা, বোকা…।
তিলক ভাঙা মন নিয়ে তাসের আসরে বসে। কিন্তু এখানেও সে হেরে যায়। বিবিহীন তাসের আসরে ওর যেন সব গোলমাল হতে থাকে। রান্নাঘর থেকে তখন ভেসে আসে, তিলকের বউয়ের অজস্র কথা আর হাসির টুকরো। লাহিড়ীর বউয়ের রিনরিনে গলা।…
Excellent story.