টুনি-ফারিহা স্টিং অপারেশান

টুনি-ফারিহা স্টিং অপারেশান 

প্রতিদিনের মত আজকেও সবাই তাদের কাজকর্ম শেষ করে দাদির (কিংবা নানির) ঘরে একত্র হয়েছে। দাদি তার সোফায় বসে একই সাথে একটা বই পড়ছেন এবং টিভি দেখছেন। দাদির পায়ের কাছে বসে ঝুমু খালাও টিভি দেখছে। টিভিতে একটা বাংলা সিরিয়াল দেখাচ্ছে, এই মুহূর্তে নায়িকা ছয়তলা বিল্ডিংয়ের ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে আছে, যেকোনো মুহূর্তে সে ঝাঁপ দিবে, সেজন্য ঝুমু খালা খুবই উত্তেজিত টেলিভিশনে নায়িকার দিকে তাকিয়ে তাকে নানারকম সান্ত্বনার কথা বলে যাচ্ছে, লাভ হবে কি না বোঝা যাচ্ছে না। 

ঘরের মেঝেতে বাচ্চারা গোল হয়ে বসে আছে। সাধারণত তাদের চিৎকার চেঁচামেচির যন্ত্রণায় দাদি এবং ঝুমু খালার টেলিভিশন দেখতে খুবই সমস্যা হয় এবং একটু পরে পরে বাচ্চাদের শান্ত করার জন্য হয় ঝুমু খালা, না হয় দাদিকে নানারকম হুমকিধামকি দিতে হয়। তবে আজকে বাচ্চারা কোনোরকম চেঁচামেচি করছে না, কারণ তারা গভীর মনোযোগ দিয়ে তান্ত্রিক সাধনা করছে। ঠিক মাঝখানে শান্ত চোখ বন্ধ করে পদ্মাসনে বসে আছে, তার মাথার উপর একটা টকটকে লাল জবাফুল। সামনে জেলির একটা খালি বোতলে একটা টিকটিকির লেজ। টুম্পার হাতে একটা মোটা লাল রঙের বই, বইয়ের নাম ‘খাঁটি তান্ত্রিক সাধনা’। টুম্পা সেই বই দেখে দেখে একটা জটিল মন্ত্র শান্তর কানে ফিসফিস করে বলছে এবং শান্ত সেই মন্ত্রটি উচ্চারণ করছে। খাঁটি তান্ত্রিক সাধনা বইয়ে লেখা আছে—এই মন্ত্রটি তিনবার উচ্চারণ করা হলে একজন অদৃশ্য হয়ে যাবে। মন্ত্র যথেষ্ট লম্বা, এর মাঝে দুইবার উচ্চারণ করা হয়েছে, তৃতীয়বার শেষ হওয়ার পথে, শান্ত সত্যি সত্যি অদৃশ্য হয়ে যায় কি না সেটা দেখার জন্য সবাই খুবই কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করছে। 

টেলিভিশনে একটা বিজ্ঞাপন দেখানো শুরু করার পর ঝুমু খালা দাদির সাথে বাংলা সিরিয়ালে নায়িকার আত্মহত্যা করে ফেলার আশঙ্কার পুরো ঘটনাটি নিয়ে আলোচনা করল, নায়িকাকে কীভাবে এই কঠিন অবস্থা থেকে রক্ষা করা যায় সেটি নিয়ে দুজনে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাল। তখন হঠাৎ করে বাচ্চাদের তান্ত্রিক সাধনার দৃশ্যটি ঝুমু খালার চোখে পড়ল। ঝুমু খালা জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কী কর?” 

একজন চাপা গলায় বলল, “চুপ ঝুমু খালা। কথা বল না এখন।” 

ঝুমু খালা গলা আরেকটু উঁচিয়ে বলল, “কেন? কথা বললে কী হবে?”

“আমরা তান্ত্রিক সাধনা করছি। তান্ত্রিক সাধনার মাঝখানে কথা বলতে হয় না।” 

ঝুমু খালা গলা আরো উঁচিয়ে বলল, “কীসের সাধনা!” 

“শান্ত ভাইয়া মন্ত্র পড়ে অদৃশ্য হয়ে যাবার চেষ্টা করছে।” 

ঝুমু খালা খুবই বিরক্ত হয়ে বলল, “তোমরা পোলাপাইন এইরকম বিপদের কাম কেন কর?” 

একজন বলল, “বিপদের কাম? কেন এইটা বিপদের কাম?” 

ঝুমু খালা গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বলল, “এইসব তন্ত্রমন্ত্র—খুবই ডেঞ্জারাস। উল্টাপাল্টাভাবে বললে বিপদ হতে পারে।” 

ঝুমু খালার কথা শুনে তান্ত্রিক সাধনা বন্ধ করে সবাই তার কথা শোনার জন্য এগিয়ে এল। জিজ্ঞেস করল, “কী বিপদ?” 

“ভূতপ্রেত জিন-পরী চলে আসে, ঘরে ঘুরঘুর করে যেতে চায় না। পোলাপান ভয় পায়।” 

“সত্যি?” 

“সত্যি নাতো মিথ্যা নাকি! আর অদৃশ্য হবার মন্ত্র খুবই কড়া মন্ত্র। উল্টাপাল্টা হলে বিপদ আছে।” 

“কী বিপদ?” 

“আমাদের গ্রামের একজন চেষ্টা করেছিল, পুরা কাম করে নাই। শরীরের অর্ধেক অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। অন্য অর্ধেক ঠিক আছে। খুবই আজব অবস্থা।” 

“তারপর কী হল?” 

“কী আর হবে। সংসারে অশান্তি। বউ তারে ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে গেল। বউরে কী দোষ দেওয়া যায়? অর্ধেক দেখা যায় বলে মানুষটারে সবাই ডাকে আধা মিয়া আর বউরে ডাকে আধা মিয়ার বউ।” 

ঝুমু খালার কাছ থেকে আধা মিয়া এবং আধা মিয়ার বউয়ের কাহিনি আরেকটু শোনার ইচ্ছা ছিল কিন্তু বিজ্ঞাপন শেষ হয়ে আবার সিরিয়াল শুরু হয়ে গেল বলে ঝুমু খালা টেলিভিশনে ফিরে গেল। 

কয়েকবার চেষ্টা করেও অদৃশ্য হতে না পেরে শান্ত একটু হতাশ হয়ে গেল। টুম্পা তখন বইটা ঘেঁটে এক কলসি সোনার মোহর আনার মন্ত্রটা খুঁজে বের করল। সবাই মিলে যখন সেই মন্ত্র উচ্চারণ করছে, তখন হঠাৎ করে ছোটাচ্চু এসে হাজির। ছোটাচ্চু ঘরে ঢুকল হাসতে হাসতে। একজন মানুষ সাধারণত একা একা হাসে না। যখন কেউ একা একা হাসে, সবাই তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকায়। তাই বাচ্চারা সবাই ছোটাচ্চুর দিকে সন্দেহের চোখে তাকাল। 

টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “ছোটাচ্চু তুমি হাসছ কেন?” 

ছোটাচ্চু একটা খালি চেয়ারে বসতে বসতে বলল, “যা একটা হাসির ঘটনা ঘটেছে সেটা বলার মত না।” 

কথা শেষ করে ছোটাচ্চু আবার দুলে দুলে হাসতে থাকে। 

“কী হাসির ঘটনা?” 

“না, এইটা বলা যাবে না।” বলে ছোটাচ্চু আবার হাসতে লাগল। এবারে আরও কয়েকজন ছোটাচ্চুকে ঘিরে ধরল, বলল, “কেন বলা যাবে না? বললে কী হবে?” 

ছোটাচ্চু কোনোভাবে হাসি একটু থামিয়ে বলল, “আমি মানুষটাকে কথা দিয়েছি কাউকে বলব না।” 

“কেন কাউকে বলবে না?” 

ছোটাচ্চু উত্তর না দিয়ে আবার হা হা করে হাসতে শুরু করে। শান্ত মুখ গম্ভীর করে বলল, “আমার কী মনে হয় জান ছোটাচ্চু?” 

“কী মনে হয়?” 

“আমার মনে হয় ঘটনাটা মোটেও হাসির না। খুবই ফালতু ঘটনা। তুমি জোর করে হাসির ভান করছ।” 

ছোটাচ্চু এবার হাসি বন্ধ করে মুখ শক্ত করে তাকাল, বলল, “আমি জোর করে কেন হাসির ভান করব?” 

“তোমার মাথার ঠিক নাই ছোটাচ্চু—তুমি অনেক উল্টাপাল্টা কাজ কর, আমরা সহ্য করি। এইটা সেরকম কিছু।”

ছোটাচ্চু এবারে রেগে গেল, বলল, “তুই কী বলতে চাইছিস?” 

“আমি বলতে চাইছি যে আমরা যেন ঘটনাটা শুনতে আগ্রহ দেখাই, সেইজন্য তুমি জোর করে হাসার চেষ্টা করছ। তোমার হাসি দেখলেই বোঝা যায় এইটা ভুয়া হাসি।” 

যারা একটু বেশি ছোট তারা হাত উপরে তুলে বলল, “ভুয়া! ভুয়া!”

ছোটাচ্চু আরও রেগে গেল, বলল, “ভুয়া হাসি? ভুয়া?” 

“হ্যাঁ। কারণ তুমি যখন সত্যি সত্যি হাস তখন তোমার চোখ ছোট ছোট হয়ে যায়। তোমার নাকের গর্ত বড় হয়ে যায়। এখন তোমার চোখ ছোট হয় নাই, নাকের গর্তও বড় হয় নাই।”

ছোটরা মাথা নাড়ল, বলল, “হয় নাই। হয় নাই।”

ছোটাচ্চু তখন বলল, “ঠিক আছে আমি ঘটনাটা বলছি, তোরা আমাকে বল ঘটনাটা হাস্যকর কি না।” 

সবাই আনন্দে চিৎকার করল, শুধু টুনি বলল, ‘ছোটাচ্চু তোমার ঘটনাটা বলা ঠিক হবে না।” 

বাচ্চারা টুনির দিকে রাগ হয়ে তাকাল, “কেন? কেন বলা ঠিক হবে না।” 

“ছোটাচ্চু কথা দিয়েছে ঘটনাটা কাউকে বলবে না। কথা দিলে কথা রাখতে হয়।” 

“ছোটাচ্চু তো অন্যদেরকে বলছে না। ছোটাচ্চু বলছে আমাদের। আমরা তো ছোটাচ্চুর টিম।”

সবাই জোরে জোরে মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ। টিম, টিম। নিজের টিমকে তো বলতেই হবে। আমাদেরকে না বললে আমরা আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির অফিস দখল করে ফেলব।”

এবারে সবাই আরো জোরে জোরে মাথা নাড়ল, এক দুইজন শ্লোগানও দিল। শেষ পর্যন্ত ঠিক হল ছোটাচ্চু ঘটনাটা বলবে, তবে যে মানুষটাকে দিয়ে ঘটনা ঘটেছে সেই মানুষটার নাম কিংবা পরিচয় বলবে না, সেটা গোপন থাকবে। তারপর ছোটাচ্চু যে ঘটনাটা বলল সেটা এরকম : 

ছোটাচ্চু তার অফিসে বসে কাজ করছে, তখন আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির রিসেপশনিস্ট নীলিমা ছোটাচ্চুর অফিসে মাথা ঢুকিয়ে বলল, “স্যার—” ছোটাচ্চু বলল, “তোমাকে কতবার বলেছি আমাকে স্যার ডাকবে না।” 

“ও আচ্ছা—মনে থাকে না। শাহরিয়ার ভাই—” 

“বল।” 

“একজন আপনার সাথে দেখা করতে এসেছেন, বলছেন খুবই গোপনীয়। শুধুমাত্র আপনার সাথে কথা বলবেন।”

“ঠিক আছে নিয়ে এসো।” 

“আমি ভদ্রলোকের নাম ঠিকানাও জানি না, উনি আমাদের ফরম পর্যন্ত ফিলআপ করতে রাজি না। সবকিছু গোপন।”

ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “হুম! ইন্টারেস্টিং।” 

“একটা মাফলার দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছেন, মাথায় ক্যাপ যেন চেহারা দেখা না যায়।” 

“ভেরি ইন্টারেস্টিং। পাঠিয়ে দাও।” 

“ঠিক আছে।” নীলিমা তখন এই রহস্যময় গোপন মানুষটিকে পাঠানোর জন্য চলে গেল। 

একটু পরেই মানুষটি ছোটাচ্চুর অফিসে এল। ছোটাচ্চুর সামনে চেয়ারে বসে সে খুব সাবধানে ইতিউতি তাকায়। 

ছোটাচ্চু বলল, “আপনাকে আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি?” 

মানুষটি একটু সামনের দিকে ঝুঁকে চাপা গলায় বলল, “ব্যাপারটি খুবই গোপন।” 

“বুঝতে পারছি।” 

“আপনি ছাড়া কেউ যেন না জানে।” 

ছোটাচ্চু বলল, “দেখেন, আমার এটা ডিটেকটিভ এজেন্সি। এখানে সব কাজ আমি করি না। আমার টিম কাজ করে। কাজেই আমি ছাড়া আর কেউ জানবে না হলে আমরা আপনার কেস নিতে পারব বলে মনে হয় না।” 

লোকটা তার টুপি খুলে মাথা চুলকালো। তারপর বলল, “দেখেন, ব্যাপারটা খুবই লজ্জার। সেইজন্য আমি চাই না আর কেউ জানুক।” 

“অনেকেই আমাদের কাছে তাদের কেস নিয়ে আসেন যেটা তার জন্য কিংবা তার পরিবারের জন্য লজ্জার—আমরা সেটা গোপন রাখি।”

“ধরেন, আমার একটা মান সম্মান আছে, আমার ঘটনাটি জানাজানি হলে বেইজ্জতির চূড়ান্ত হবে। আমি কারো সামনে মুখ দেখাতে পারব না। আমার বিজনেসের বারোটা বেজে যাবে।” 

“আমাদের সাইড থেকে আমরা কাউকে জানাব না।” 

“সেইজন্য মনে করেন পুলিশের কাছে যাই নাই। আপনার কাছে এসেছি।” 

“এরকম অনেকেই আমার কাছে আসে। এখন কী হয়েছে আপনি সেটা বলেন।” 

“মনে করেন আমার নাম এক্স।” 

ছোটাচ্চু বলল, “উহু উহুঁ এভাবে হবে না। আপনি যদি আমাদের সাহায্য নিতে চান তাহলে আপনার নাম পরিচয় দিতে হবে। এক্স ওয়াই দিয়ে হবে না। মুখে বলতে না চাইলে আপনার বিজনেস কার্ড দিতে হবে। সেখানে টেলিফোন নাম্বার ঠিকানা ই-মেইল থাকতে হবে। আপনার টুপি খুলে মাফলার সরিয়ে চেহারা দেখাতে হবে।” 

“চেহারাও দেখাতে হবে?” 

“হ্যাঁ। দুই জায়গায় লজ্জা করলে হয় না। একটা হচ্ছে ডাক্তার অন্যটা হচ্ছে ডিটেকটিভ। এই দুইজনের কাছে সবকিছু খুলে বলতে হয়।” 

মানুষটা কিছুক্ষণ চিন্তা করল, তারপর বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে।” 

তারপর মানুষটা তার টুপি খুলল, মুখের উপর থেকে মাফলার সরালো। মাথায় টাক এবং একটু বোকা বোকা চেহারা। তবে মানুষের চেহারা বোকা বোকা হলেই মানুষটা বোকা হয় সেটি সত্যি না, পৃথিবীর সবচেয়ে ধুরন্ধর মানুষদের চেহারা শুধু যে বোকা বোকা হয় তা না, তারা চাইলে বোকা বোকা করেও রাখতে পারে। 

মানুষটা গলা পরিষ্কার করে বলল, “আমি একটা বিজনেস গ্রুপের মালিক, আমার নানারকম ব্যবসা আছে। গার্মেন্টস, এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ছোটখাটো ইন্ডাস্ট্রি। রিয়েল এস্টেট। এই লাইনে থাকতে হলে মাথা ব্যবহার করতে হয়। আমার মাথা যথেষ্ট ভালো। আমি চাইলে যেকোনো মানুষকে কিনে তাকে বেচে ফেলতে পারি।” 

ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “আশা করছি মানুষ কেনাবেচার কথাটা একটা কথার কথা, আসলে আপনি এই কাজ করেন না।” 

“না। করি না। কিন্তু বুদ্ধির কাজ করি। অথচ অথচ—” মানুষটা থেমে গিয়ে ফোঁস করে বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। 

“অথচ কী?” 

“আমার মুখে উচ্চারণ করতে লজ্জা লাগছে, আমি আপনাকে দেখাই।” 

মানুষটা তখন তার ব্যাগের ভেতর থেকে একটা খাম বের করে ছোটাচ্চুর দিকে এগিয়ে দিল। ছোটাচ্চু খামটা হাতে নিয়ে খাম খুলে একটা কাগজ বের করল। কাগজটা একটা দলিল। ছোটাচ্চু চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারল এই দলিলে লেখা আছে দুই কোটি তেত্রিশ লাখ টাকা দিয়ে এই মানুষটি সরকারের কাছ থেকে শহিদ মিনারটি কিনেছে। 

ছোটাচ্চু কিছুক্ষণ কাগজটির দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর মুখ হা করে মানুষটির দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “আপনি শহিদ মিনার কিনেছেন?” তারপর হা হা করে হাসতে লাগল। হাসি আর থামাতে পারে না। 

মানুষটি মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “বুঝতেই পারছেন এটা হচ্ছে ভুয়া। একজন আমাকে বোকা বানিয়েছে।” 

“দুই কোটি তেত্রিশ লাখ টাকা?” ছোটাচ্চু আবার হাসতে থাকে হাসতে হাসতে তার চোখে পানি চলে আসে। হাসতে হাসতে বলল, “এত টাকা দিয়েছেন?” 

“না—পুরো টাকা এখনও দেই নাই, শুধু বায়নার টাকাটা গেছে। ছোটাচ্চু অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল, “আপনি কিছু মনে করবেন না, কিন্তু কেউ যদি এরকম একটা কাজ করে তাহলে তাকে সাহায্য করার কিছু নাই।”

মানুষটা মনমরাভাবে মাথা নাড়ল, বলল, “জানি।”

“আপনি আমার কাছে কী চান? টাকাটা উদ্ধার করে দিতে হবে?” 

“না। আমার টাকার অভাব নাই।” 

“তাহলে?” 

“যে মানুষটা আমাকে এভাবে বোকা বানিয়েছে তাকে বের করে দেবেন। সেজন্য আপনি যত টাকা চান দিব।” 

ছোটাচ্চু গম্ভীর মুখে বলল, “সেটা নির্ভর করবে আপনার উপর আপনি আমাকে পুরো ঘটনাটা কত ডিটেলসে বলতে পারবেন, কত তথ্য দিতে পারবেন তার ওপর।” 

মানুষটা মাথা চুলকে বলল, “সেটাই হচ্ছে মুশকিল। মানুষটা সম্পর্কে আর কিছুই জানি না।” 

“সে আপনার সাথে যোগাযোগ করেছে কীভাবে?” 

“ই-মেইল আর টেলিফোনে।” 

“তার সাথে দেখা হয় নাই? কথা হয় নাই?” 

“তা হয়েছে।” 

“ছবি নাই?” 

“নাহ্।” 

ছোটাচ্চু হতাশভাবে মাথা নাড়ল, বলল, “চেহারার বর্ণনা দিতে পারবেন? দেখলে চিনবেন?” 

মানুষটা আবার তার টাক মাথা চুলকালো, “শ্যামলা রং, মাথায় কাঁচাপাকা চুল, গোঁফ-দাড়ি আছে, চোখে চশমা, বয়স চল্লিশের মত, সামনের দাঁত একটু উঁচু—” 

ছোটাচ্চু আবার হতাশভাবে মাথা নড়ল, বলল, “মানুষ যখন তার চেহারা পাল্টাতে চায় তখন গায়ের রং শ্যামলা করে, নকল চুল দাড়ি পরে, চশমা পরে চুলের রং কাঁচাপাকা করে নকল উঁচু দাঁত লাগায়—কাজেই আপনার বর্ণনার সাথে মানুষটার সাথে আসল চেহারার মিল থাকার কথা নয়।”

মানুষটা মাথা নাড়ল। 

ছোটাচ্চু বলল, “আর টাকা কোথায় দিয়েছেন? ব্যাংক একাউন্ট?” মানুষটা বলল, “টাকা ক্যাশ দিয়েছি, ব্যাগে করে। 

ছোটাচ্চু বলল, “হায় হায়! আপনি তো সেধে তাকে টাকা দিয়েছেন। ক্যাশ কেন দিলেন?” 

“আমার ভুল। মানুষটা ক্যাশ চায় নাই— বলেছে আমার লোক দিয়ে ব্যাংকে জমা দিতে। আমি তাকে এত বিশ্বাস করেছি যে, বলেছি সে যেন নিজে জমা দেয়।” 

“কী আশ্চর্য!” 

মানুষটা বলল, “জি, আশ্চর্য! সে কথা বলে মানুষকে মুগ্ধ করে ফেলতে পারে। আমাকে মুগ্ধ করে ফেলেছিল।” 

ছোটাচ্চু বলল, “ঠিক আছে, যা হওয়ার হয়েছে। আমার মনে হয় না আমার এজেন্সি কিছু করতে পারবে। যেহেতু টেলিফোন ই-মেইলে যোগাযোগ করেছে, পুলিশের সাথে যোগাযোগ করলে তারা টেকনোলজি ব্যবহার করে কিছু একটা লাইন বের করতে পারে।” 

মানুষটা মাথা নাড়ল। বলল, “না, আমি পুলিশের কাছে যেতে চাই না। আপনি যা পারেন করেন।” 

ছোটাচ্চু তখন মানুষটার সব কাগজপত্র কপি করে রেখে দিল।

.

ছোটাচ্চু তার গল্প শেষ করে হা হা করে হাসতে লাগল। বাচ্চারা কেউ তার হাসিতে যোগ দিল না। বরং একটুখানি অবাক হয়ে ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে রইল। ছোটাচ্চু তার হাসি থামিয়ে বলল, “কী হল? হাসির ঘটনা না!” 

শান্ত মাথা নাড়ল, বলল, “না। এটা হাসির ঘটনা না, এটা হচ্ছে শিক্ষামূলক ঘটনা।”

ছোটাচ্চু চোখ কপালে ভুলে বলল, “শিক্ষামূলক? এখানে কোন ব্যাপারটা শিক্ষামূলক?” 

“কেন? কীভাবে টাকা রোজগার করা যায় সেই আইডিয়া হচ্ছে শিক্ষামূলক।” 

“মানে?” 

“এই যে মানুষটা কী বুদ্ধি করে শহিদ মিনার বেচে দিল! অসাধারণ।” 

“ ছোটাচ্চু মুখ শক্ত করে বলল, একটা ক্রিমিনাল কাজকে তোর কাছে অসাধারণ মনে হল? তুই ক্রিমিনাল হতে চাস?” 

“আমি ক্রিমিনাল কাজটাকে অসাধারণ বলছি না, আমি আইডিয়াটাকে অসাধারণ বলছি।” 

ছোটাচ্চু রেগে গেল, “আইডিয়াটা অসাধারণ? একটা চোট্টামির আইডিয়া অসাধারণ! মানুষকে ঠকানোর আইডিয়া অসাধারণ?” 

শান্ত হতাশার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, বলল, “ছোটাচ্চু তোমার সহজ জিনিসটা বুঝতে এত সমস্যা হচ্ছে কেন?” 

ছোটাচ্চু আরো রেগে গেল, বলল, “ঠিক আছে তুই সহজ জিনিসের আইডিয়াটা আমাকে সহজ করে বোঝা!” 

শান্ত গম্ভীরভাবে বলল, “আইডিয়াটা হচ্ছে- যে জিনিসটার কোনো মালিক নাই সেটা বিক্রি করা।” 

“কোন জিনিসটার মালিক নাই।” 

শান্ত বলল, “ধরো আমি চাঁদের জমি প্লট ভাগ করে বিক্রি করলাম!” ছোটাচ্চু তোতলাতে লাগল, “তুই চাঁ-চাঁদের জমি বিক্রি করবি?”

“হ্যাঁ। সমস্যা আছে? রীতিমত দলিল করে দিব।” 

“দলিল করে দিবি?” 

“হ্যাঁ।” 

“তুই চাঁদের মালিক?” 

“কেউ চাঁদের মালিক না—তাতে সমস্যা কী?” 

ছোটাচ্চুর হাসির ঘটনা শুনে কেউ হাসেনি কিন্তু শান্তর বিজনেস আইডিয়া শুনে সবাই হি হি করে হাসতে লাগল। শুধু শান্ত হাসল না, সত্যিকারের বিজনেসম্যানের মত মুখ গম্ভীর করে রাখল। 

.

একটু পর ছোটাচ্চু যখন তার নিজের ঘরে বিছানায় আধশোয়া হয়ে একটা বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছে, তখন টুনি সেখানে হাজির হয়েছে। ছোটাচ্চু মুখ তুলে টুনির দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “কিছু বলবি?” 

“হ্যাঁ, ছোটাচ্চু। তোমাকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করতে এসেছি।”

“কী জিনিস?” 

“এই যে মানুষটা শহিদ মিনার বিক্রি করে দিল, তুমি তাকে ধরার চেষ্টা করবে না?” 

“কীভাবে চেষ্টা করব? যেকোনো কাজ শুরু করতে হলে একটা কু দরকার। এখানে আমার জন্য কোনো ক্লু নাই। পুলিশের কাছে গেলে পুলিশ মনে হয় পারত। টেলিফোন ট্র্যাক করত। যেখানে টাকা দিয়েছে সেখানে সিসিটিভি দেখত, বিক্রির ভুয়া দলিলে ফিঙ্গার প্রিন্ট দেখত, সেই ফিঙ্গার প্রিন্ট তাদের ডাটাবেসে মিলাত—আমার এজেন্সির এইগুলো করার ক্ষমতা নাই। আমি খালি বুদ্ধির কাজ করি—” ছোটাচ্চু বুদ্ধির কাজ বোঝানোর জন্য নিজের মাথায় একটা টোকা দিল। টুনির পরিষ্কার মনে হল সেখান থেকে একটা ফাঁপা শব্দ বের হচ্ছে। 

টুনি বলল, “আমি তোমাকে সেটাই বলতে এসেছি ছোটাচ্চু। তুমি বুদ্ধির কাজটা করবে না?” 

ছোটাচ্চু মুখ শক্ত করে বলল, “কোন বুদ্ধির কাজটা করা হয় নাই?”

“মানুষটা যেহেতু শহিদ মিনার বিক্রি করে দিতে পেরেছে, সে নিশ্চয়ই আবার কারো কাছে বিক্রি করবে।” 

ছোটাচ্চু মাথা চুলকালো, বলল, “হ্যাঁ সেটা তো হতেই পারে মনে হয়।”

“তাহলে যারা রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা করে তাদের কাছে খোঁজ নিলে হয় না? তাদের সাথে যোগাযোগ করা যায় না?” 

ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “সেইটা অবশ্য তুই খারাপ বলিসনি।”

“যদি এরকম কারো সাথে যোগাযোগ করে তখন তার সাথে একটা মিটিং করে—” 

ছোটাচ্চু মুখ সুচালো করে চিন্তা করতে থাকে। 

টুনি বলল, “এইটা কাজ করবে কি না বলা যায় না, কিন্তু চেষ্টা করতে তো ক্ষতি নেই।”

“ঠিকই বলেছিস। এই দেশের বড় বড় রিয়েল এস্টেট বিজনেসম্যানদের ঠিকানা জোগাড় করে তাদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। কী বলিস?” 

টুনি মাথা নাড়ল, তাকে ধমক দিয়ে বিদায় না করে দিয়ে তার বুদ্ধিটা ছোটাচ্চু নিয়েছে তাতেই সে খুশি। 

.

এদিকে শান্ত সত্যি সত্যি তার চাঁদের প্লট বিক্রি করার কাজ শুরু করে দিল। সবচেয়ে প্রথমে দশ কাঠার একটা জমি সে দাদির কাছে বিক্রি করল। কাজটা অবশ্য খুব সহজ হয় নাই, দাদি (কিংবা নানি) জমি বেচাকেনার বিষয়টা খুব ভালো বুঝেন না বলে ঝুমু খালা দাদির পক্ষে দরদাম করেছে। শান্ত এক হাজার টাকা কাঠা হিসেবে দশ কাঠা চাঁদের জমির জন্য দশ হাজার টাকা চাইছিল কিন্তু ঝুমু খালা কিছুতেই তাতে রাজি হল না। কাজেই শেষ পর্যন্ত দশ টাকা কাঠা হিসেবে একশ টাকা দিয়ে দশ কাঠা জমি বিক্রয় হল। শান্ত খুবই দক্ষভাবে সাথে সাথে জমির রেজিস্ট্রেশন করে দাদিকে একটা দলিল ধরিয়ে দিয়েছে। দলিলটা খুবই সুন্দর, দেখে বাচ্চারা সত্যিই মুগ্ধ হয়ে গেল। এত সুন্দর দলিল দেখে ঝুমু খালা পর্যন্ত শান্তর কাছ থেকে আড়াই কাঠা জমি কিনে ফেলল। 

তবে জমির ক্রেতা হিসেবে ঝুমু খালা যথেষ্ট জটিল। তার জমিটা যেন অন্য কেউ দখল করতে না পারে সেইজন্য সেখানে একটা সাইনবোর্ডে বড় করে যেন লিখে দেওয়া হয় “ক্রয়সূত্রে এই জমির মালিক ঝুমু খালা”, সেটা নিয়ে ঝুমু খালা শান্তর সাথে যথেষ্ট দেনদরবার করল। শেষ পর্যন্ত শাহানা আপাকে এসে বলতে হল যে, চাঁদের জমি এখন অন্য কেউ দখল করে নেওয়ার ভয় খুব বেশি নেই। 

দলিলটি যথেষ্ট সুন্দর এবং আকর্ষণীয় হওয়ার জন্য বাসার অন্য আরো অনেকেই জমি কেনার আগ্রহ দেখাল, শাহানা আপু পর্যন্ত দশ টাকা দিয়ে এক কাঠা জমি কিনতে রাজি হল, কিন্তু আগেই বলে দিল তার জমিটি হতে হবে একটা নির্দিষ্ট জায়গায়। 

শান্ত মাথা চুলকে বলল, “শাহানা আপু, চাঁদের সব জায়গা তো একই রকম—তুমি যেখানেই জমি কিনো—সেটার তো কোনো পার্থক্য নাই!” 

শাহানা আপু ধমক দিয়ে বলল, “তোকে বলেছে কোনো পার্থক্য নাই? একশ বার পার্থক্য আছে!” 

“কী পার্থক্য?” 

“আমাকে যদি উল্টোপাশে জমি বিক্রি করে দিস, তাহলে সেখান থেকে আমি পৃথিবীটাকে দেখতে পর্যন্ত পারব না।” 

“কেন পারবে না?” 

“গাধা, তুই জানিস না, পৃথিবীর দিকে চাঁদের একটা সাইড সবসময় মুখ করে থাকে?” 

শান্ত জানত না কিন্তু সে এটা নিয়ে খুব ব্যস্ত হলো না, বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে, তোমার জমিটা পৃথিবীর সাইড থেকে দেব।” 

শাহানা আপু তাতেও অবশ্য এত সহজে রাজি হয়ে গেল না। বলল, “শুধু পৃথিবীর সাইড থেকে হলে হবে না, আমাকে হাইপেশিয়া ক্রেটারের পাশে জমি দিতে হবে।”

শান্ত আবার মাথা চুলকালো, বলল, “হাইপেশিয়া ক্রেটার আবার কী?” 

“চাঁদে যে গর্তগুলো আছে সেগুলো হচ্ছে ক্রেটার। আর হাইপেশিয়া হচ্ছে একজন মহিলা ম্যাথমেটিশিয়ান, যার নামে এই ক্রেটার!” 

শান্ত হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, “ঐ মহিলা মেডিকেল না পড়ে ম্যাথমেটিক্স পড়তে গেল কোন দুঃখে? মেডিকেলে চান্স পায় নাই?” 

শাহানা আপু শান্তর মাথায় একটা চাটি দিয়ে বলল, “হাইপেশিয়া নিয়ে বাজে কথা বললে তোর চামড়া খুলে ফেলব। আলেকজান্দ্রিয়ার ম্যাথমেটিশিয়ান, মেয়ে বলে মেরে ফেলেছিল। তার নামে চাঁদে একটা ক্রেটার আছে। বুঝেছিস?” 

“বুঝেছি।” 

“সেই ক্রেটারের পাশে আমার জমি চাই। শুধু দলিল দিলে হবে না। চাঁদের ছবিতে আমাকে দেখাতে হবে কোথায় জমি দিচ্ছিস। এপোলো এগারো যেখানে নেমেছিল তার দক্ষিণে—”

শান্ত দুর্বলভাবে বলল, “মাত্র এক কাঠা জমির জন্য এত কিছু?” শাহানা আপু বলল, “ব্যবসা করতে নেমেছিস, এখন যে যত কিনবে তাকে তত দিতে হবে। না হলে হাইকোর্টে মামলা করে দিব!” 

হাইকোর্টে যেন মামলা না হয় সেজন্য ইন্টারনেট ঘেঁটে চাঁদের ছবিতে হাইপেশিয়া ক্রেটার খুঁজে বের করে সেখানে জায়গাটা দেখিয়ে শান্ত শেষ পর্যন্ত শাহানার জন্য দলিল করে দিল। শাহানা আপু খুশি হয়ে বলল, “জমিটা যখন বুঝে নিতে যাব তখন সেখানে হাইপেশিয়ার বিশাল একটা বিলবোর্ড লাগিয়ে আসব। কী বলিস?” 

শান্ত বলল, “তোমার যেরকম ইচ্ছা!” 

পরদিন রাতে টুনি ছোটাচ্চুর ঘরে গেল খোঁজ নেওয়ার জন্য। গিয়ে দেখল ছোটাচ্চু যথেষ্ট মনমরা। টুনিকে দেখে আরেকটু রেগে গেল, বলল, “তোর বুদ্ধি শুনে আমার মার খাওয়ার অবস্থা।” 

টুনি ভয়ে ভয়ে বলল, “কেন ছোটাচ্চু? কী হয়েছে?” 

“কী হয়েছে শুনবি? আমি একটা রিয়েল এস্টেটের ব্যবসায়ীর সাথে দেখা করতে গিয়ে তাকে মাত্র বলেছি, আমি একটা জিনিস খোঁজ নিতে এসেছি, সাথে সাথে সেই মানুষ খ্যাকখ্যাক করে উঠল। আমাকে বলল, আপনি কি সাংবাদিক? আপনি কী খোঁজ নিতে চান? আপনার কি ধারণা আমি ভূমিদস্যু? আপনার তাই ধারণা?” 

টুনি শুকনো গলায় বলল, “তখন তুমি কী বললে?” 

আমি বললাম, “না, না, না—আমি সাংবাদিক না, আমি মোটেও আপনার ভূমিদস্যুগিরির খোঁজ নিতে আসি নাই। আমি জানতে এসেছি আপনার সাথে কি কেউ যোগাযোগ করেছে যে, আপনি কোনো বিখ্যাত সরকারি স্থাপনা কিনবেন কি না—” ছোটাচ্চু কথা বন্ধ করে ফোঁসফোঁস করতে নাগল। 

টুনি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “তখন কী হল?” 

“তখন লোকটা রেগে ফায়ার! বলে, আপনি আমাকে কী ভেবেছেন? আমি বেআইনিভাবে সরকারি খাসজমি কিনব? আপনি জানেন আমরা খাঁটি ব্যবসায়ী? আমাকে অপমান করছেন আপনার এত বড় সাহস—লোকটা এত চেঁচামেচি শুরু করল যে, সেটা শুনে তার দুই বডিগার্ড এসে হাজির। পারলে তখনই আমাকে খুন করে ফেলে। অনেক কষ্টে জান নিয়ে বের হয়ে এসেছি।” 

টুনি চুপ করে রইল। 

ছোটাচ্চু গজগজ করে বলল, “আমি কি ঐ মানুষকে ছেড়ে দেব ভেবেছিস? আমার সাথে বেয়াদবি। কত বড় সাহস!” 

“তুমি কী করবে?” 

“আমার সাংবাদিক বন্ধুকে বলেছি ঐ মানুষের উপরে রিপোর্ট করতে! দেখবি কাল পত্রিকায় বিশাল রিপোর্ট বের হবে!” 

ছোটাচ্চু তার বিছানায় বসে গজগজ করতে লাগল। টুনি ধৈর্য ধরে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে। ছোটাচ্চুর রাগটা একটু কমে আসার পর আস্তে আস্তে বলল, “আমার কী মনে হয় জান ছোটাচ্চু?” 

“কী মনে হয়?” 

“রিয়েল এস্টেটের ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলার জন্য তুমি নিজে না গিয়ে অন্য কাউকে পাঠাও।” 

“কেন?” 

“কারণ তুমি অল্পতে রেগে উঠো, সেইজন্য।”

ছোটাচ্চু রেগে উঠে বলল, “আমি অল্পতে রেগে উঠি? কখন তুই আমাকে কখনো অল্পতে রেগে উঠতে দেখেছিস? দেখেছিস কখনো? 

“এই যে এখন দেখছি!” 

ছোটাচ্চু কোনো কথা না বলে গরম চোখে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল। টুনি বলল, “কাজেই তুমি এমন একজনকে পাঠাও যে খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারে।” 

“কে সুন্দর করে কথা বলতে পারে?” 

টুনি দাঁত বের করে হাসল, বলল, “কেন? ফারিহাপু!” 

ছোটাচ্চু ভেবেছিল ফারিহাকে রাজি করতে অনেক কষ্ট হবে। কিন্তু সবকিছু শুনে ফারিহাপু প্রথমে অনেকক্ষণ হি হি করে হাসল, তারপর খুব সহজেই রাজি হয়ে গেল। ছোটাচ্চু তখন তাকে বেশ কয়েকজন রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীর নাম ঠিকানা দিল। বলল, ফারিহার তাদের সাথে কথা 

বলতে হবে। 

দুইদিন পর সন্ধ্যেবেলা দরজায় টুংটাং শব্দ শুনে টুনি দরজা খুলে দেখে ফারিহাপু দাঁড়িয়ে আছে। টুনি খুশিতে চিৎকার করে বলল, “ফারিহাপু! তোমাকে দেখতে আজকে কী সুইট লাগছে!” 

ফারিহাপু হাসিহাসিমুখে বলল, “সুইট? কোন জায়গাটা সুইট?” 

“তোমার সবকিছু সুইট! তুমি যখন চুল ছোট করো তখন তোমাকে সুইট লাগে, যখন লম্বা করো তখন সুইট লাগে। যখন রং করো তখন সুইট লাগে—” 

“একবার মাথা ন্যাড়া করে আসব, তখন দেখি তুমি কী বল।” 

টুনি হি হি করে বলল, “তখনও তোমাকে সুইট লাগবে। ফারিহাপু ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “শাহরিয়ার আছে? ডাকো দেখি।” 

টুনি ফারিহাপুকে বসিয়ে ভিতরে ছোটাচ্চুকে ডাকতে গেল। ছোটাচ্চু ফারিহাকে দেখে একটু অবাক হল, বলল, “তুমি? এত রাত্রে কোথা থেকে?” 

ফারিহা বলল, “রাত? রাত কোথায়, মাত্র নয়টা বাজে। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম তোমাকে খবরটা দিয়ে যাই।” 

ছোটাচ্চু সোফায় বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল, “কীসের খবর?”

“রিয়েল এস্টেট টাইকুনের সাথে কথা বলে এসেছি। তার খবর।” ছোটাচ্চু বলল, “তোমার সাথে কথা বলেছে?” 

“বলবে না কেন? অনেকক্ষণ কথা বলেছে। হ্যান্ডসাম ইয়াং ম্যান। সেই জন্যই তো দেরি হল।” 

ছোটাচ্চু মুখটা গম্ভীর করে জিজ্ঞেস করল, “কী নিয়ে এত কথা বলেছে?” 

“সবকিছু। সোশ্যাল নেটওয়ার্ক, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ওয়ার্ল্ড পলিটিক্স, এনভায়রনমেন্ট, ক্লাইমেট চেঞ্জ” 

ছোটাচ্চুর মুখটা এবারে আরো গম্ভীর হল, বলা যায় একটুখানি ভোঁতা হয়ে গেল। শুকনো গলায় বলল, “আমি ভেবেছিলাম তুমি গেছ আমাদের ক্রিমিনাল নিয়ে কথা বলতে—” 

“হ্যাঁ, হ্যাঁ সেটা নিয়েও কথা বলেছি। সেটা তো বেশিক্ষণ লাগে নাই।” 

“বেশিক্ষণ লাগে নাই?” 

ফারিহা মাথা নাড়ল, “নাহ।” 

“কী বলেছে?” 

“আমি যখন এই স্ক্যামটার কথা বলেছি, মানুষটা শুনে অনেকক্ষণ হাসল। তারপর বলল, সেও একটা এরকম ই-মেইল পেয়েছে কিন্তু সেটাকে কোনো পাত্তা দেয় নাই।” 

“তারপর?” 

“তারপর আমি বললাম আমরা মানুষটাকে ধরতে চাই। মানুষটা সাথে সাথে সাহায্য করতে রাজি। দুইজন মিলে একটা স্টিং অপারেশান প্ল্যান করে ফেলেছি।” 

ছোটাচ্চু মুখ শক্ত করে বলল, “দুইজন মিলে? মানে তোমরা দুইজন?” 

“হ্যাঁ। আমি আর হ্যান্ডসাম বিজনেস টাইকুন।”

ছোটাচ্চু চোখ ছোট ছোট করে বলল, “আমি ভেবেছিলাম এইটা আমার আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির প্রজেক্ট।” 

ফারিহা বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, এইটা শেষ পর্যন্ত তোমার ডিটেকটিভ এজেন্সির প্রজেক্ট—কিন্তু সেটার কথা বলে তো আর ক্রিমিনালকে আমাদের স্টিং অপারেশানের ট্র্যাপে ফেলা যাবে না। তাই ক্রিমিনালকে বলা হচ্ছে অন্য কথা।”

“কী কথা!” 

“আমাদের বিজনেস টাইকুন তখনই সেই ক্রিমিনালকে একটা ই-মেইল পাঠাল।” 

“কী ই-মেইল?” 

“সেখানে লিখেছে আমি তার পার্সোনাল সেক্রেটারি—” 

ছোটাচ্চু এবারে রীতিমত রেগে উঠল, বলল, “পার্সোনাল সেক্রেটারি? তুমি রাজি হলে?” 

ফারিহা বলল, “আহ্ হা! আমি কি সত্যি সত্যি পার্সোনাল সেক্রেটারি নাকি? স্টিং অপারেশানের জন্য একটা ক্যামাফ্লেজ।” 

ছোটাচ্চু গজগজ করতে লাগল। টুনি তখন জিজ্ঞেস করল, “আর কী কী লিখেছে ই-মেইলে?” 

“লিখেছে সে বড় একটা রাষ্ট্রীয় স্থাপনা কিনতে চায়—কিন্তু কেনার আগে বিষয়টা নিয়ে নিশ্চিত হতে চায়। কিন্তু সে খুবই ব্যস্ত—তাই তার পার্সোনাল সেক্রেটারির সাথে—মানে আমার সাথে একটা মিটিং করে সবকিছু ঠিক করতে হবে।” 

ছোটাচ্চু মেঘ গলায় বলল, “কোনোদিন ব্যাটা মিটিং করতে রাজি হবে না।” 

ফারিহা ঘাড় ঝাঁকালো, বলল, “দেখা যাক! যদি সে নিজের থেকে যোগাযোগ না করে তাকে তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। টাকার লোভ বড় লোভ, যোগাযোগ করতেও পারে।” 

ছোটাচ্চু দার্শনিকের মত বলল, “দেখা যাক।”

ফারিহা ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বলল, “শাহরিয়ার, তোমার এখন কোনো কাজ আছে?” 

“না—মানে সেরকম কিছু নাই—” 

“তাহলে চল কফি খেয়ে আসি। তোমাকে আবার নামিয়ে দেব।” 

ছোটাচ্চু তখন তার কাপড় বদলানোর জন্য ভেতরে গেল। টুনি ফারিহার কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, “ফারিহাপু, তুমি দেখেছ তুমি যখন হ্যান্ডসাম বিজনেস টাইকুনের কথা বলেছ, তখন ছোটাচ্চু কেমন রেগে উঠেছে!” 

ফারিহা হি হি করে হাসল, বলল, “হ্যান্ডসাম না কচু! মানুষটা এই মোটা—এত বড় একটা ভুঁড়ি। যখন হাসে তখন ভুঁড়ি থরথর করে কাঁপে! তোমার ছোটাচ্চুকে রাগানোর জন্য বলেছি হ্যান্ডসাম!” 

টুনিও তখন হি হি করে হাসল। তারপর বলল, “ফারিহাপু—এই মানুষটা যদি আসলেই দেখা করতে রাজি হয় তাহলে আমাকে নিয়ে যাবে? আমি অন্য টেবিলে বসে থাকব। মানুষটাকে দেখব।” 

“ঠিক আছে।” 

“ছোটাচ্চু কোনোদিন নিয়ে যাবে না।” 

“দেখি, আলাদা আরেকটা স্টিং অপারেশান করতে হবে।” 

ঠিক তখন ছোটাচ্চু তার শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে ঢুকল। তাই আরেকটা স্টিং অপারেশানের পরিকল্পনাটা শেষ করা গেল না। 

ছোটাচ্চু আর ফারিহা বের হয়ে গেল। 

দুইদিন পর ছোটাচ্চু বাসায় এসেছে মুখে একগাল হাসি নিয়ে। বাচ্চারা দাদি (কিংবা নানির) ঘরে হুটোপুটি করছিল, ছোটাচ্চুকে এরকমভাবে হাসতে দেখে সবাই হুটোপুটি থামিয়ে ছোটাচ্চুর দিকে তাকালো। একজন জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে ছোটাচ্চু?” 

“মনে আছে তোদের, একটা ক্রিমিনালের কথা বলেছিলাম, যে একজন বোকা মানুষের কাছে শহিদ মিনার বিক্রি করে দিয়েছিল?” 

শান্ত মাথা নাড়ল, বলল, “মনে আছে! তার কাছ থেকেই তো আমি বিলিয়নিয়ার হওয়ার আইডিয়াটা পেয়েছি। খালি একটু বড় হয়ে নিই, তারপর নক্ষত্র আর গ্যালাক্সি বিক্রি করা শুরু করব!” 

টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “ছোটাচ্চু তুমি কি সেই মানুষটাকে ধরে ফেলেছ?” 

ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “না এখনও ধরি নাই। কালকে তাকে ধরা হবে।” 

সবাই একসাথে চিৎকার করে বলল, “কালকে?” 

“হ্যাঁ।” 

“কখন? কোথায়?” 

“সন্ধ্যা ছয়টায়। একটা কাফেতে—” 

ছোটাচ্চু কাফেটার নাম বলতে যাচ্ছিল, টুনি থামালো, বলল “ছোটাচ্চু নামটা বলো না। তাহলে সবাই মজা দেখতে চলে যাবে।” 

শান্ত গরম হয়ে বলল, “যাবই তো। একশবার যাব। গেলে কী হয়? ছোটাচ্চু তুমি কাফেটার নাম বল।” 

টুনি বলল, “সবাই গিয়ে ভিড় করলে সেই মানুষ কাফের ভিতরেই ঢুকবে না।” 

শান্ত আরও গরম হয়ে গেল, “কেন ঢুকবে না?” 

অন্যরাও চিৎকার করতে লাগল, বলতে লাগল, “যাব! যাব! আমরা যাব।” 

দাদির কাছে বসে ঝুমু খালা টিভি দেখছিল, সে হুংকার দিয়ে বলল, “চোপ। সবাই চোপ! তোমাগো যন্ত্রণায় শান্তিমত টিভি পর্যন্ত দেখতে পারি না।” 

 ছোটাচ্চু হাত তুলে সবাইকে থামাল, বলল, “সবাই চুপ কর। আমার মনে হয় টুনি ঠিকই বলেছে। মানুষটা কাফেতে এসে যদি সন্দেহজনক কিছু দেখে তাহলে সে ভিতরে ঢুকবেই না—”

টুনি বলল, “কিংবা ভিতরে ঢুকে একটা টেবিলে বসে এক কাপ কফি খেয়ে চলে যাবে। কেউ তাকে চিনে না।” 

মুনিয়া জিজ্ঞেস করল, “শুধু কফি? সাথে আর কিছু খাবে না?” 

টুনি বলল, “সেটা জানি না। খেতেও পারে।” 

ছোটাচ্চু বলল, “এখন তোরা কেউ কিছু করিস না। আমার এই মূল্যবান প্রজেক্ট নষ্ট করিস না। পরের বার।”

সবাই হতাশা, যন্ত্রণা এরকম শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। একজন বলল, “কালকে কীভাবে মানুষটাকে ধরবে সেটা অন্তত বল।” 

ছোটাচ্চু তখন খুবই উৎসাহ নিয়ে কীভাবে ফারিহাপু রিয়েল এস্টেট টাইকুনের সাথে কথা বলে তার সেক্রেটারির ভান করে এই ক্রিমিনাল মানুষটার সাথে যোগাযোগ করেছে এবং প্রাথমিক আলাপের জন্য কালকে এই কাফেতে আসতে রাজি করিয়েছে সেই কাহিনিটা বললেন। টুনি অবশ্য সবকিছু আগে থেকেই জানে, তাই সে চুপচাপ শুনে গেল। ছোটাচ্চুকে কথা দিতে হল ক্রিমিনালটাকে ধরার পর সে যে ফি পাবে সেটা দিয়ে সবাইকে নিয়ে কিছুটা একটা করতে হবে। “কিছু একটা” বলতে ঠিক কী বোঝানো হবে সেটা সবাই অস্পষ্ট রাখল, নেপাল ভ্রমণ দিয়ে শুরু করে কতটুকুতে রফা করা যায় সেটা সময় হলে দেখা যাবে। 

ছোটাচ্চু তার ঘরে যাওয়ার একটু পরে টুনি তার ঘরে হাজির হল। টুনিকে দেখে ছোটাচ্চু বলল, “টুনি, এসেছিস? ফারিহা তোর সাথে কথা বলতে চাচ্ছিল। তোর সাথে তার আবার কী দরকার?” 

টুনি রহস্যের ভান করলে, “সেটা তুমি বুঝবে না ছোটাচ্চু। আমাদের মেয়েদের অনেক রকম নিজস্ব ব্যাপার থাকে!” 

ছোটাচ্চু চোখ উল্টে তার ফোনে ফারিহাকে ডায়াল করে টুনির হাতে ধরিয়ে দিল। টুনি ফোনটা হাতে নিয়ে একটু সরে গিয়ে কানে লাগিয়ে বলল, “ফারিহাপু, তুমি আমার সাথে কথা বলতে চাইছিলে?” 

“হ্যাঁ। কালকে ঐ মানুষটা আমার সাথে কথা বলতে আসবে।”

“জানি ফারিহাপু।” 

“জান? কীভাবে জান?” 

“ছোটাচ্চু সবাইকে বলেছে।” 

ফারিহা অবাক হয়ে বলল, “সবাইকে বলেছে? সে কী! এটা না গোপন থাকার কথা—”

টুনি বলল, “যে ব্যাপারটা যত গোপন, ছোটাচ্চু তত বেশি উৎসাহ নিয়ে আমাদেরকে সেটা বলে!” 

“ইন্টারেস্টিং। তোমার ছোটাচ্চু খুবই ইন্টারেস্টিং। সে কীভাবে একটা ডিটেকটিভ এজেন্সি করে ফেলেছে সেটা একটা রহস্য!” 

“তুমি আমার সাথে কেন কথা বলতে চাইছিলে ফারিহাপু?” 

“তুমি বলেছিলে যেদিন মানুষটাকে ধরা হবে তুমি দেখতে চাও—কালকে তুমি কীভাবে যাবে?” 

টুনি বলল “না ফারিহাপু আমার যাওয়া হবে না।” 

“কেন?” 

“সবাই হইচই করে দেখতে যেতে চাইছিল। আমি সবাইকে থামিয়েছি, এখন আমি নিজে গেলে সবাই মিলে আমাকে খুন করে ফেলবে! তাছাড়া—” 

“তাছাড়া কী?” 

“আমার মনে হয় কালকে মানুষটা আসবে শুধু অবস্থাটা দেখতে। বোঝার চেষ্টা করবে তুমি সত্যি সত্যি এসেছ নাকি তাকে ধরার জন্য ফাঁদ পাতা হয়েছে।” 

“তোমার তাই মনে হয়।” 

“হ্যাঁ।” 

ফারিহাপু কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “তুমি ঠিকই বলেছ টুনি। আমি হলেও তাই করতাম। অবস্থাটা আগে বোঝার চেষ্টা করতাম।”

টুনি বলল, “তাই তুমি কিন্তু কাফেতে ছোটাচ্চুর সাথে কিংবা ছোটাচ্চুর লোকজনের সাথে কোনো কথা বল না—লোকটা মনে হয় এক কোনা থেকে বসে বসে দেখবে তুমি কী করো। অপেক্ষা করে করে যখন দেখবে সে আসছে না, বিরক্তির ভান করে চলে যেও।” 

ফারিহাপু বলল, “তুমি ঠিকই বলেছ টুনি। ইউ আর এ জিনিয়াস।” টুনি হাসল, বলল, “না ফারিহাপু, এর মাঝে কোনো জিনিয়াস নাই।”

.

পরের দিন ছোটাচ্চু ঘরে ঢুকল খুবই মনমরাভাবে। সবাই চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, “ধরেছ? ধরেছ লোকটাকে?” 

ছোটাচ্চু বলল, “নাহ্! লোকটা আসে নাই।” 

“আসে নাই? আসে নাই কেন?” 

মুনিয়া বলল, “যে কথা দিয়ে কথা রাখে না তার সাথে খেলতে হয় না।” 

শান্ত তার মাথায় চাটি মেরে বলল, “এইটা কোনো খেলা না গাধা।”

টুনি জিজ্ঞেস করল, “লোকটা ফারিহাপুর সাথে যোগাযোগ করেছে? বলেছে কেন আসে নাই?” 

“নাহ্। এখনও বলে নাই। 

“ফারিহাপুকে বলো লোকটার সাথে দেখা করার জন্য বেশি উৎসাহ যেন না দেখায়। যেন ভান করে খুব বিরক্ত।” 

ছোটাচ্চু নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ভান করতে হবে না। ফারিহা এমনিতেই বিরক্ত।” 

মুনিয়া বলল, “ছোটাচ্চু, এরপর থেকে তুমি শুধু মার্ডার কেসগুলো নিবে। সেগুলো হচ্ছে ইন্টারেস্টিং। আজকাল মার্ডার হয় না?” 

ছোটাচ্চু কোনো কথা না বলে মুনিয়ার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। 

.

বেশ কয়েকদিন হয়ে গেছে, এখনও ক্রিমিনালটিকে ধরা যায়নি। মানুষটা আরো দুইবার সময় দিয়েছে কিন্তু কোনোবারই শেষ পর্যন্ত ফারিহার সাথে দেখা করেনি। দুইবারই ছোটাচ্চু নিজে তার টিমকে নিয়ে কাফেতে ছিল কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। টুনির ধারণা প্রত্যেকবারই মানুষটা কাফেতে এসেছে কিন্তু কিছু একটা সন্দেহ করে শেষ পর্যন্ত এগিয়ে আসেনি। মনে হচ্ছে মানুষটা আর আসবে না। ফারিহার সাথে যখন দেখা হয় তখন ছোটাচ্চু ফারিহাকে নিয়ে রীতিমত ঠাট্টা করে, জোরে জোরে হেসে বলে, “ডিটেকটিভ প্রজেক্ট কি এত সোজা ফারিহা? তুমি চাইলেই কি একজন হ্যান্ডসাম বিজনেস টাইকুনকে নিয়ে ক্রিমিনাল ধরে ফেলতে পারবে? যদি এত সোজা হতো, তাহলে কিন্ডার গার্টেন স্কুলের মত মোড়ে মোড়ে ডিটেকটিভ এজেন্সি থাকত!” 

ফারিহাকে রাগানোর জন্য ছোটাচ্চু এগুলি বলে কিন্তু ফারিহা রাগ হয় না। হাসিহাসিমুখে বলে, “পরের বার যখন কাঁচুমাচু হয়ে হাতজোড় করে আমার কাছে আসবে তখন মনে রেখো!” 

সবাই যখন মোটামুটি হাল ছেড়ে দিয়েছে, তখন হঠাৎ করে একদিন বিকাল বেলা ফারিহাপু বাসায় এসে কলিংবেল বাজিয়েছে। টুনি দরজা খুলে ফারিহাপুকে দেখে বলল, “ও! ফারিহাপু? ছোটাচ্চু তো বাসায় নাই।” 

“জানি। আমি তোমার কাছে এসেছি।”

টুনি অবাক হয়ে বলল, “আমার কাছে? কেন?” 

“ঐ মানুষটা একটা এস.এম.এস পাঠিয়েছে।”

“কী লিখেছে?” 

“লিখেছে পনেরো মিনিটের মাঝে সে একটা কাফেতে আসবে—আমি যেন যাই।” 

টুনি বলল, “মাত্র পনেরো মিনিট সময় দিয়েছে?” 

“হ্যাঁ।” 

“নিশ্চয়ই ইচ্ছা করে কম সময় দিয়েছে, যেন আমরা ইচ্ছা করলেও কিছু করার জন্য রেডি হতে না পারি।” 

“হ্যাঁ।” ফারিহাপু বসার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “প্ৰথমে ভেবেছিলাম না করে দিই। একা একা গিয়ে আবার কোন বিপদে পড়ব। পরে ভাবলাম গিয়ে দেখি তো মানুষটাকে। কিছু একটা তো জানা যাবে।” 

টুনি মাথা নাড়ল। বলল, “সেটা ঠিক।” 

“তখন তোমার কথা মনে হল। ভাবলাম তুমি যদি ফ্রী থাকো তাহলে তোমাকে নিয়ে যাই। একজন থেকে দুইজন অনেক ভালো।” 

টুনির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বলল, “হ্যাঁ ফারিহাপু আমি ফ্রী আছি। এক সেকেন্ড দাঁড়াও আমি আম্মুকে বলে আসি। 

টুনি তার আম্মুকে বলে দ্রুত তার টি-শার্টটা বদলে নিল। বাচ্চাদের একটা ম্যাগাজিন নিয়ে সে দুই মিনিটের ভিতর নিচে নেমে আসে। এসে দেখে ফারিহাপু সোফায় বসে তার স্মার্টফোন টিপাটিপি করছে। টুনিকে দেখে ফারিহাপু বলল, “আমি মানুষটাকে জানাচ্ছি যে আমি রেডি না, আমার সাথে আমার বোনের বাচ্চা মেয়ে আছে। তাকে নিয়ে আসতে হবে। দেখি সে রাজি হয় কি না।” 

টুনি বলল, “মনে হয় রাজি হবে। বাচ্চা মেয়েকে কেউ ভয় পায় না?” 

টুনির ধারণা সত্যি, আসলেই মানুষটা রাজি হয়ে গেল। 

টুনি গাড়িতে ফারিহাপুর পাশে বসল, ফারিহাপু গাড়ি স্টার্ট করে বলল, “তোমার কী মনে হয়, মানুষটা আসবে?” 

“মনে হয় আসবে।” 

“দেখি। এবারে যদি না আসে তাহলে এই প্রজেক্ট বাতিল।” 

পনেরো মিনিটের আগেই তারা কাফেটাতে পৌঁছে যায়। গাড়ি থেকে নামার আগে ফারিহাপু তার মোবাইল ফোনটা টুনির হাতে দিয়ে বলল, “নাও। দেখো তুমি কয়েকটা ছবি আর ভিডিও তুলতে পার কি না।”

“যদি কেউ ফোন করে?” 

“ব্লক করে দিয়েছি, কোনো ফোন আসবে না।” 

টুনি হাসিহাসিমুখে বলল, “ফারিহাপু, তুমি চেষ্টা করে দেখো কোনো জায়গায় তার ফিঙ্গার প্রিন্ট নিতে পার কি না।”

“দেখব।” 

টুনিকে নিয়ে ফারিহাপু কাফেতে ঢুকে একটা খালি টেবিলে বসল। নিজের জন্য একটা লাটে আর টুনির জন্য একটা চকলেট আইসক্রিম অর্ডার দিয়ে দুইজন চুপচাপ বসে থাকে। কিছুক্ষণের মাঝেই তাদের টেবিলের পাশে একজন মানুষ এসে দাঁড়াল। ফারিহাপুর দিকে তাকিয়ে খসখসে গলায় বলল, “আপনি কি মিস ফারিহা?” 

টুনি তার আইসক্রিম খেতে খেতে মানুষটার দিকে তাকাল। কাঁচাপাকা চুল, জোড়া ভুরু, মুখে চাপ দাড়ি। সামনের একটা দাঁত কালো। বোঝাই যাচ্ছে গলার স্বর থেকে শুরু করে চেহারার সবকিছু নকল। 

ফারিহাপু মাথা নাড়ল। মুখে একটু বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে বলল, “আপনি এই নিয়ে তিন বার সময় দিয়ে দেখা করেন নাই—” 

“আমি সরি। সরকারি ব্যাপারে আমার হাত নাই।” 

“আজকে কি কথা বলবেন?” 

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, কথা বলতেই এসেছি। কিন্তু—” মানুষটা তখন টুনির দিকে তাকালো, মুখে না বললেও বুঝিয়ে দিল সে টুনির সামনে কথা বলতে চাচ্ছে না। 

ফারিহাপু টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “টুনি, তুই ঐ কোনার খালি টেবিলটাতে গিয়ে বস দেখি।” 

টুনি চেহারায় এই বয়সি ছেলেমেয়েদের অধৈর্য ভাবটা ফুটিয়ে বলল, “খালামণি, তোমার কি দেরি হবে?” 

ফারিহাপু বলল, “না, বেশি দেরি হবে না।” 

টুনি গলায় নেকু নেকু ভাব ফুটিয়ে বলল, “তুমি সবসময় বল দেরি হবে না, তারপরে খালি দেরি কর।” 

ফারিহা টুনির অভিনয় দেখে মুগ্ধ হল। নিজেও একটু চেষ্টা করণ, বলল, “ঢং করিস না। দরকার হলে বসে বসে আরেকটা আইসক্রিম খা।” 

টুনি মুখে এই বয়সি বাচ্চার উপযুক্ত আহ্লাদী, ঢং, বিরক্তি এবং অধৈর্য ফুটিয়ে উঠে গেল। কোনার টেবিলে বসে প্রথমেই হাতের ম্যাগাজিনটার কভারে একটা ছোট ফুটো করল, তারপর সেই ফুটোতে ফারিহার মোবাইল ফোনের লেন্সটা বসিয়ে ম্যাগাজিন পড়ার ভান করে দূর থেকে মানুষটার ছবি এবং ভিডিও তুলতে লাগল। সে যেখানে বসেছে সেই জায়গাটা বেশ দূরে, তাই মানুষটা ফারিহাপুর সাথে কী নিয়ে কথা বলছে সেগুলো শোনা যাচ্ছিল না। 

মানুষটা ফারিহাপুর সামনে বসে তার খসখসে গলায় বলল, “আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন প্রজেক্টটা খুবই গোপন।” 

“প্রজেক্টটা গোপন সেটা বুঝতে পেরেছি কিন্তু কেন গোপন সেটা বুঝতে পারছি না।” 

“এটা সরকারের ডিসিশন, এখনই মিডিয়াকে জানতে দিতে চায় না।” 

ফারিহা মুখটা খুবই গম্ভীর করে বলল, “আমার বস খুবই ইন্টারেস্টেড কিন্তু আগে নিশ্চিত হতে চান এটা আইনসম্মত এবং সত্যি। আমাকে সেটা দেখার দায়িত্ব দিয়েছেন। এখন আপনি বলেন আপনি কীভাবে আমাকে এ ব্যাপারে গ্যারান্টি দেবেন।” 

মানুষটা একটা ফাইল বের করে সেখান থেকে কয়েকটা কাগজ বের করে ফারিহার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “আমরা আগে এ ব্যাপারে সরকারি প্রজ্ঞাপন দিয়ে শুরু করতে পারি।” 

ফারিহাপু মানুষটার ফিঙ্গার প্রিন্ট বাঁচিয়ে রাখার জন্য কাগজগুলো দেখল কিন্তু নিজের হাতে নিল না, বলল, আপনি কি এগুলো খামে করে আমাকে দিতে পারবেন? আমি একটু সময় নিয়ে দেখব।” 

মানুষটা কী যেন ভাবল তারপর বলল, “ঠিক আছে, কিন্তু আপনাকে অরিজিনালগুলো দিতে পারব না। শুধু কপি—” 

ঠিক এই সময় ফারিহার এক বান্ধবী তাদের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে গেল, আনন্দে চিৎকার করে বলল, “আরে, ফারিহা! তুই এখানে।” 

ফারিহা একটু চমকে ওঠে, এখন তার আসল পরিচয় বের হয়ে না যায়। ফারিহা বান্ধবীকে বিদায় করার জন্য বলল, “হ্যাঁ, আমি এখানে একটা কাজে। তুই গিয়ে বস। আগেই চলে যাস না, আমি কথা শেষ করে তোর কাছে আসছি।” 

“শাহরিয়ার কেমন আছে?” 

ফারিহা বলল, “ভালো ভালো।” 

“তার ডিটেকটিভ এজেন্সি?” বান্ধবী হি হি করে হাসল, “যখন শুরু করেছিল তখন আমি ভেবেছিলাম পাগলামী। এখন দেখছি সে আসলেই দেশের চোর ডাকাত বদমাইশ ফ্রড সবাইকে ধরে ফেলছে! হাউ ওয়ান্ডারফুল!” 

ফারিহা বুঝল সর্বনাশ হয়ে গেছে। মানুষটা জেনে গেছে তার সাথে ডিটেকটিভ এজেন্সির সম্পর্ক আছে। যেটুকু বাকি ছিল ফারিহাপুর বান্ধবী সেটাও শেষ করে দিল, বলল, “শুনেছি তুই নাকি মাঝে মাঝে শাহরিয়ারকে সাহায্য করিস? যাকে বলে রিয়েল লাইফ স্টিং অপারেশান! এখন কোনো অপারেশান করছিস?” 

ফারিহা শুকনো গলায় বলল, “তুই বস—আমি আসছি।” 

ফারিহার বান্ধবী হি হি করে হাসতে হাসতে কাছাকাছি একটা টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। ফারিহা এবার মানুষটার দিকে তাকালো, মানুষটা দ্রুত কাগজগুলো ফাইলের ভেতর ঢুকিয়ে চাপা গলায় বলল, “আপনি আসলে ডিটেকটিভের জন্য কাজ করছেন? আসলে আমাকে ধরার চেষ্টা করছেন?” 

ফারিহাপু প্রতিবাদ করার চেষ্টা করতে গিয়ে থেমে গেল, বুঝতে পারল মানুষটা জেনে গিয়েছে, তাই শুধু শুধু আর অভিনয় করার চেষ্টা করল না, সত্যি কথাটা বলল, “আমি আপনাকে ধরার চেষ্টা করছি না। আপনাকে ধরে ফেলেছি। কাজেই এখান থেকে পালানোর চেষ্টা করবেন না। হাত দুইটা টেবিলের উপর রেখে চুপচাপ বসে থাকেন। আগে আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দেন।” 

মানুষটা হিংস্র চোখে ফারিহার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, “আমাকে ধরা এত সোজা না-”

ফারিহাপু বলল, “খুব সোজা। আমি শুধু গলা ফাটিয়ে একটা চিৎকার দিয়ে বলব, ধর ব্যাটা ক্রিমিনালকে—সাথে সাথে এই কাফের সবাই আপনার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিছু না জেনেই পিটিয়ে তক্তা করে দেবে।”

মানুষটা এদিক সেদিক তাকালো, ফারিহা বলল, “দেব চিৎকার?” 

মানুষটা কোনো উত্তর না দিয়ে হঠাৎ উঠে দাঁড়াল, তারপর কেউ কিছু বোঝার আগে দুই লাফ দিয়ে টুনির কাছে পৌঁছাল। এক হাত দিয়ে টুনির চুল ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে তাকে দাঁড় করিয়ে দেয়, অন্য হাত দিয়ে একটা পিস্তল বের করে সেটা তার গলার মাঝে ধরে চিৎকার করে বলল, “খবরদার, কেউ নড়বে না।” 

টুনির হাত থেকে ম্যাগাজিনটা পড়ে গেছে, সে তখনও ফারিহার মোবাইলটা ধরে ভিডিও করে যাচ্ছে। 

ফারিহাপু একটা আর্তচিৎকার করল, কাফের অন্য সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে। মানুষটা টুনির চুল ধরে তাকে ঠেলে সামনের দিকে নিতে নিতে হিংস্র গলায় বলল, “কেউ একটু নড়লে গুলি করে দেব। খবরদার।” 

টুনির বুঝতে একটু সময় লাগল। যখন কী হচ্ছে বুঝতে পারল, তখন রিনরিনে গলায় বলল, “ফারিহাপু ভয় পেয়ো না।” 

ফারিহাপু আতঙ্কিত হয়ে বলল, “ভয় পাব না?” 

“না। এটা খেলনা পিস্তল।” 

“খেলনা পিস্তল?” 

“হ্যাঁ।” 

“তুমি শিওর?” 

“আমি শিওর।’ 

মানুষটা একটা গর্জন দিল, কিন্তু গর্জনের আওয়াজ যথেষ্ট মৃদু! 

ফারিহাপু এদিক সেদিক তাকাল, তারপর একটা চেয়ার হাতে তুলে নিয়ে এগিয়ে আসে, তারপর কেউ কিছু বোঝার আগে সেই চেয়ারটা দিয়ে মানুষটার মাথার মাঝে বসিয়ে দেয়। মানুষটা কোঁক করে একটা শব্দ করে মাথা চেপে বসে ধরল। ফারিহাপু যখন দ্বিতীয় বার চেয়ারটা তুলে ধরেছে, তখন আশেপাশে যারা ছিল তারাও মানুষটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। 

টুনি ছাড়া পেয়ে ফারিহাপুর ফোন দিয়ে ভিডিও করতে করতে বলল, “মানুষটার চুল ভুরু দাঁত সব নকল।” 

একজন টান দিয়ে তার পরচুলা, আরেকজন জোড়া ভুরু খুলে আনে। দাঁত কেমন করে খুলবে বুঝতে না পেরে গালে একটা ঘুষি দিতেই নকল কয়েকটা দাঁত খুলে মানুষটাকে অন্য রকম দেখাতে থাকে।” 

উৎসাহী একজন বলল, “মনে হয় চামড়ার রংও নকল।” তার ধারণাটা সত্যি কি না পরীক্ষার করার জন্য একজন তার কপালে থুতু দিয়ে সজোরে ডলতে থাকে। মানুষটা যন্ত্রণায় চিৎকার করে বলল, “চামড়ার রং আসল। আসল।” 

ফারিহাপু ততক্ষণে তার চেয়ারটা রেখে এগিয়ে এসে সবাইকে সরিয়ে বলল, “প্লিজ, প্লিজ ওকে মারবেন না। কেউ একজন পুলিশে ফোন করেন।” 

ফারিহাপু মানুষটার হাত থেকে তার খেলনা পিস্তলটা নিয়ে টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “টুনি তুমি বুঝলে কেমন করে পিস্তলটা নকল?” 

টুনি বলল, “আসল পিস্তল হলে নলটা ঠান্ডা হতো। নলটা প্লাস্টিকের তাই ঠান্ডা ছিল না।” 

ফারিহাপু টুনির মাথার এলোমেলো চুলগুলো আরো এলোমেলো করে দিয়ে বলল, “টুনি! ইউ আর এ জিনিয়াস।” 

টুনি তার ভিডিও থামিয়ে বলল, “না ফারিহাপু জিনিয়াস না। এটা কমনসেন্স!” 

ফারিহাপু তখন মানুষটাকে মাটি থেকে টেনে তুলে একটা চেয়ারে বসিয়ে তার দিকে তাকাল। তার নকল চুল দাড়ি ভুরু দাঁত খুলে নেওয়ার পর তাকে দেখতে নিরীহ গোবেচারা মানুষের মত দেখাতে থাকে। ফারিহাপু তার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার মাথায় এত বুদ্ধি, ঘাগু বিজনেসম্যানদের ঘোল খাইয়ে তাদের কাছে শহিদ মিনার বিক্রি করে দিতে পারেন, আপনি এরকম দুই নম্বুরী কাজ করেন কেন? মাথা খাটিয়ে ভালো কিছু করতে পারেন না?” 

মানুষটা চিঁচিঁ করে বলল, “ চেষ্টা করেছিলাম, একটুর জন্য বিসিএসটা মিস হয়ে গেছে। এখন বয়স নাই।” 

“বিসিএস ছাড়া কাজ নাই দেশে?” 

“ভাবছিলাম বিজনেস করব। ক্যাপিটেল শর্ট—তাই ক্যাপিটেল তোলার জন্য—” 

মানুষটাকে ঘিরে থাকা মানুষগুলো হা হা করে হেসে উঠল।

.

দাদির (কিংবা নানি) টেলিভিশনে সবাই গোল হয়ে বসে তৃতীয় বারের মত টুনির তোলা ভিডিওটা দেখেছে। দেখা শেষ হওয়ার পর সবাই যখন টুনিকে নিয়ে হাসাহাসি জাপটাজাপটি লাফালাফি করছে, তখন দাদি গম্ভীর মুখে টুনিকে ডাকলেন, “টুনি।” 

টুনি দাদির সামনে গিয়ে বসল। দাদি টুনির কান ধরে তাকে টেনে কাছে এনে বললেন, “আর যদি কোনোদিন বন্দুক পিস্তল নিয়ে খেলিস, তোর কান ছিঁড়ে ফেলব।” 

“আমি খেলি নাই দাদি—ঐ মানুষটা—” 

“কোন মানুষটা আমি শুনতে চাই না। খবরদার কোনোদিন বন্দুক পিস্তলের কাছে যাবি না।”

টুনি অনেক কষ্টে দাদির হাত থেকে নিজের কান ছুটিয়ে নিয়ে বলল, “দাদি ঐটা খেলনা পিস্তল ছিল—”

“আমি নকল না আসল, সত্যি না খেলনা জানতে চাই না। পিস্তল হচ্ছে পিস্তল। তার ধারে কাছে যেন যেতে না হয়। মনে থাকবে?” 

“মনে থাকবে দাদি।” 

ঝুমু খালা তার সবগুলো দাঁত বের করে হেসে বলল, “খালা, টুনির মনে থাকব না, আমারে অনুমতি দেন আমি তার পিঠের মাঝে গুড়ুম গুড়ুম করে কয়টা কিল দেই তাইলে মনে থাকব।” 

দাদি অনুমতি দেওয়ার পরও টুনিকে গুডুম গুডুম করে কিল না দিয়ে ঝুমু খালা তাকে আদর করে জড়িয়ে ধরে রাখল। 

ঘরে যখন এত সব ঘটনা ঘটছে, তখন এক কোনায় ছোটাচ্চু মনমরা হয়ে বসে আছে! ফারিহাপুকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করার পর ছোটাচ্চুর কোনো সাহায্য ছাড়াই শুধু টুনিকে নিয়ে মানুষটাকে ধরে ফেলার পর ফারিহাপু পাল্টা ছোটাচ্চুকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করছে। সেটা একটা কারণ কিন্তু সেটা আসল কারণ না। 

আসল কারণ হচ্ছে শহিদ মিনার কিনতে বায়নার টাকা দেওয়া বোকা বোকা চেহারার রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী ছোটাচ্চুকে একটা পয়সা দিতে রাজি হয় নাই। সে নাকি ছোটাচ্চুকে একবারও মানুষটাকে ধরে ফেলতে বলে নাই, সে বলেছিল মানুষটাকে বের করে দিতে। ছোটাচ্চু যখন অবাক হয়ে ‘ধরে ফেলা’ আর ‘বের করার’ মাঝে পার্থক্য কী জানতে চেয়েছে তখন বলেছে, প্রতারক মানুষটার অসম্ভব বুদ্ধি এবং খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারে, তাকে সে নিজের কোম্পানির সেলস ডিভিশনে চাকরি দিতে চেয়েছিল। 

মানুষটাকে ধরে ফেলার পর সব জায়গায় জানাজানি হয়ে গেছে, এখন শুধু যে নিজের মান সম্মান নিয়ে টানাটানি তাই নয়, এখন এই মানুষটার কথাও সবাই জেনে গেছে। তাই এই মহাবুদ্ধিমান মানুষটাকে আর চাকরি দিতে পারবে না। রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী ছোটাচ্চুর উপর এটা নিয়ে মহা বিরক্ত। 

ছোটাচ্চুর কাহিনি শুনে এই প্রথমবার বাচ্চারা হেসে কুটি কুটি হল! 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *