টুকরো কথার ছিন্নপত্র

টুকরো কথার ছিন্নপত্র

বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানুষের অনুরোধে সর্বশ্রী সলিল চৌধুরি, নচিকেতা ঘোষ, হিমাংশু দত্ত সুরসাগর, সুধীন দাশগুপ্ত, মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, তিমিরবরণ, ভি বালসার প্রভৃতি বহু গুণী মানুষের সম্পর্কে কিছু কিছু আমায় লিখতে হয়েছে৷ আমার আকাশ ছোট্ট তাই আমার দেখার দৃষ্টিও ছোট পরিধিতে বিধৃত— তাই কোনও ক্ষেত্রেই আকাশের বিস্তার, মহিমা প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি, আমার বামন অস্তিত্বের কারণেই৷ তবু হয়ত সে সব রচনা আন্তরিক ও সত্যনিষ্ঠ ছিল৷ তাই বারবার মহান শিল্পীদের সম্পর্কে কিছু লেখবার সুযোগ দিয়েছে আমায়, বিভিন্ন পত্রিকার পরিচালকেরা৷ তাই এঁদের কাছে আমি কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ৷

আমি নিজের কথা লিখতে খুবই কুণ্ঠিত হই৷ যে দেশে মহাপ্রভু, শ্রীরামকৃষ্ণ, প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথের চৈতন্য সন্ধানের দায়বদ্ধ অনুসন্ধান নেই— যে দেশে রবীন্দ্রসংগীত, সলিল সংগীত নির্মাণের গবেষণা নেই— যে সময়ে বিশ্বায়নের ব্যবসা সংস্কৃতির পদতলে ঐতিহ্য সংস্কৃতি পদদলিত, —সেখানে সে সময়ে আমার মতো এক ক্ষুদ্র অস্তিত্বের ব্যক্তিপরিচয়ের মূল্য কি? তবু এড়াতে পারলাম না তাদের কথা যারা বারবার আমায় আন্তরিকভাবে অনুরোধ করেছে নিজের বিষয়ে কিছু লিখতে৷ ভাবলাম আমার মতো সামান্যের কাছে এই ভালবাসার দাবি যারা পেশ করে তাদের যথাযথ মর্যাদা দিলে আমারই মূল্যবোধ বর্ধিত হবে৷ তাই দু-চারটি কথা লিখব৷ পাঠকবর্গের কাছে অনুরোধ এই রচনায় কোথাও যদি আমার আন্তম্ভরিতার প্রকাশ দেখেন আপনারা আমায় ক্ষমা করবেন না৷ অন্তত মনে মনে বিরাগ পোষণ করবেন৷ তাতেও আমার কল্যাণ হবে৷

আমার জন্ম উত্তর কলকাতার এক গোঁড়া ব্রাহ্ম পরিবারে৷ আমার ঠাকুরদাদা অবিনাশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়৷ কাঁসারিপাড়া গোস্বামী পরিবারের কন্যাকে হিন্দু মতে বিবাহ করেন অথচ পরে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন এবং ব্রাহ্মধর্মকে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দেন৷ ইনি একজন ধীশক্তিমান সত্যনিষ্ঠ শিক্ষাবিদ ছিলেন৷ তাঁর সময়ে তাঁর রচিত বিভিন্ন ইংরেজি ভাষাশিক্ষার গ্রন্থ ছিল স্কুলপাঠ্য৷ তাঁর কবিতার একটি বইও তখন পড়ানো হত— Popular poems; তা ছাড়া ইংরেজি Conversation, ব্যাকরণ, translation ইত্যাদি গ্রন্থও ছিল৷ তাঁর কণ্ঠে যে সুর ও সংগীত ছিল— তার সম্পদেই তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের পুষ্টি৷

পিতৃ তরফের সবাই গান করতে পারতেন৷ বাবা শ্রীনিরাময় বন্দ্যোপাধ্যায়, কাকা, জেঠা, পিসিরা৷ তার মধ্যে মেজজেঠা নিরুপম বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন উচ্চাঙ্গ সংগীত সাধক৷ অসাধারণ ধ্রুপদী কণ্ঠস্বর৷ শুনেছি তিনি সংগীতাচার্য গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীত শিক্ষা করেন৷ রমেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবিনয় রায় যে ধরনের ধ্রুপদী রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষা করতেন, পরিবেশনা করতেন, আমার মেজজেঠামশায়ও তাই৷ আমার কাকা গানও গাইতেন আবার সেতারও বাজাতে পারতেন৷ বাবা, কাকা, জেঠামশায় পিসিরা সকলেই ব্রাহ্ম উপাসনায় গান করতেন৷ কিন্তু কেউই বাণিজ্যিকভাবে সংগীতকে গ্রহণ করেননি, যা আমরা গ্রহণ করেছি৷ আমার মা শ্রীমতী লাবণ্য বন্দ্যোপাধ্যায় অর্গ্যানের মতো করে দু হাতে হারমোনিয়াম বাজাতে পারতেন৷ বড় মামা খুব ভাল বাঁশি বাজাতে পারতেন৷ আমার ছোট মামা সুকবি ছিলেন, এদিকে এসরাজ বাজাতেন৷ তিনি ছিলেন আমাদের শৈশব-কৈশোরের সাথী৷ আমাদের নিয়ে বাড়ির ছাদে মঞ্চ তৈরি করে অনুষ্ঠান করাতেন৷ কুষ্টিয়া থাকাকালীন ‘জাগরণ’ বলে একটা পত্রিকায় একটি শিশু কিশোর বিভাগ তৈরি করে আমাদের কবিতা নিয়ে ছাপাতেন— লিখবার প্রেরণাও তাঁর৷ পিতৃমাতৃ উভয়কুলেই ছিল সংগীত সংস্কৃতি ও ধর্মসাধনার বিচরণভূমি৷

স্কুলজীবন কেটেছে মূলত ঢাকুরিয়া ‘রামচন্দ্র হাই স্কুলে’৷ তবে ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় দু বছর আমরা ছিলাম বর্তমান বাংলাদেশ নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া শহরে৷ তখন ওই সময় আমরা দু ভাই পড়াশোনা করি কুষ্টিয়া মিউনিসিপ্যাল আকাডেমিতে৷ তখনকার দিনগুলো স্মৃতিসমৃদ্ধ করে রেখেছে এর ওর গাছের জাম, জামরুল, খাঁটি দুধ, সবরি কলা— তা ছাড়া সবরকম শাকসবজি তো আছেই৷ গাওয়া ঘিয়ের গন্ধ এখনও নাকে ভেসে আসে৷ গড়াই নদীর ধারে বাড়ি থাকার সুবাদে স্নানের সময় তেল মেখে, ঘাটে বাঁধা নৌকায় বসে রোদে তেল মাখা, স্নান তারপর গড়াই নদীতে সাঁতার৷ স্বাস্থ্যের উন্নতি ওই দু’বছরে যা হয়েছিল তাতে আমরা ফিরে আসার পর বড় পিসিমা আমাদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থেকে বাবাকে বললেন, ওদের আনলি কেন? সেই স্কুলে আমাদের গান-বাজনার অনুষ্ঠান, নাটক নিয়মিত হত৷ সেখান থেকেই পরিচয় অভিনেতা হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে, তাঁর সঙ্গে অভিনয়ও করেছি৷ তখন ক্রিকেট নিয়ে এত মাতামাতি ছিল না— ফুটবল খেলতে খুব ভালবাসতাম, সেন্টার ফরোয়ার্ড— প্রিয় দল ছিল ইস্টবেঙ্গল— আজও তাই৷ তাছাড়া গাদি খেলা, ডাংগুলি আর গুলি খেলা এই সব ছিল প্রিয়৷

কলকাতা ফিরে আসার পর ক্লাস সেভেন থেকে ফের শুরু হল ঢাকুরিয়ার রামচন্দ্র হাইস্কুলের জীবন৷ যখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র তখন বয়সকালীন গলা ভেঙে যায়— তখন গান ছেড়ে একটা শখের নাচের দলে Xylophone বাজাতে আরম্ভ করলাম৷ তার দু’বছর বাদে দাদার বন্ধু প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক শ্রী প্রবীর মজুমদারের প্রেরণা ও তত্ত্বাবধানে আবার শুরু করলাম গান গাওয়া৷

পরিবার সূত্রে ও ব্রাহ্ম পরিবারে জন্মাবার সুবাদে রবীন্দ্র চেতনা ও রবীন্দ্রসংগীত ছিল আমার স্নায়ুতে রক্তে মিশে৷ রবীন্দ্রনাথ আমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের যেন অবলম্বন৷ অবশ্য সেটা বহু মানুষেরই৷ একটা ঘটনা মনে পড়ছে— তখন মহাকরণে চাকরি করি৷ মেঘলা দিন— বৃষ্টি ভেজা আকাশ— আমার মন গানের পাখি হয়ে উড়তে চাইছে৷ সুচিত্রা মিত্রের গাওয়া ‘আমি কী গান গাব যে’— গানটি তখন সদ্য প্রকাশিত৷ মনে আমার বেগ আর আবেগ একাকার৷ পকেট গড়ের মাঠ৷ এক অফিস বন্ধুর কাছ থেকে টাকা ধার করে মধ্য কলকাতা থেকে দক্ষিণ কলকাতা পর্যন্ত ট্যাক্সি নিয়ে চষে বেড়াচ্ছি৷ অবশেষে রাসবিহারী অ্যাভিনিউতে ‘মেলোডি’ থেকে গানটি কিনে বাড়িতে এনে প্রায় দশ থেকে পনেরো বার বাজিয়ে তবে আমার শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক করলাম৷ আমার জীবনে যে কোনও ঋতুর দুপুর টানে৷ খাঁ খাঁ দুপুরে উদাস করা ঘুঘুর ডাক আমার অতি প্রিয়— তবু যে কোনও সৃষ্টিশীল মানুষের মতো বর্ষা প্রকৃতির সঙ্গে আমার যে একাত্ম সাধন করে তা অন্য কোনও ঋতুতে হয় না৷ তবে বর্তমানে প্রকৃতি ঘেরা গৃহে বাস করার সুবাদে গ্রামবাংলার উদাস চৈত্রের বাতাস যেন আমার হৃদয়ের সমমর্মী৷

ব্রাহ্ম সমাজের প্রভাব আমাদের মধ্যে শিল্প, সংস্কৃতি সংগীত বিস্তারের মন, হৃদয় অনুভবের বিকাশ সাধনায় রীতিমতো পুষ্টি জুগিয়েছে৷ মাঘ মাসের নগর সঙ্কীর্তন যা পথ পরিক্রম করে মন্দিরে এসে শেষ হয়, ও পৌষ মাসের প্রভাতী কীর্তন,— যা বৈতালিকের মতো এক এক পাড়ায় ব্রাহ্ম ভক্তরা জমায়েত হয়ে গিয়ে এক একদিন এক এক বাড়িতে গিয়ে উপাসনায় মিলিতে হতেন— তা আমার কাছে ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়৷ এইভাবেই আমার সংস্কারকে রূপ দিয়েছে ব্রহ্মসংগীত৷ আমি ছেলেবয়সে, যখন মুখ দিয়ে ভাল করে কথা ফোটেনি, গাইতাম ‘অনন্ত অপার তোমায় কে জানে?’ — পরে শুনেছি আমি অনন্ত অপার উচ্চারণ করতে পারতাম না— বলতাম অনন্ত ঢপার৷ কিন্তু এই সব ধ্রুপদী সংগীতধ্বনি আমার সংস্কারের সুরবাহারে তুলত তার মন্দ্রমন্ত্র৷ একটা ঘটনা মনে পড়ে— তখন আমি কুষ্টিয়ায় ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র— একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে Class room-এর মধ্যে— আমি গান গাইলাম, ‘নিত্য নব সত্য তব/পরিপূর্ণ জ্ঞানময়/কবে হবে বিকশিত/ মম চিত্ত আকাশে৷’ আমি পরিতৃপ্তিতে আপ্লুত— কয়েকজন শিক্ষক ও উঁচু শ্রেণীর কয়েকজন ছাত্র আমায় বললেন ‘কিরে এইটুকু ছেলে— এত বুড়ো বুড়ো গান করলি কেন?’ আমি কিন্তু আদৌ বিচলিত হলাম না— আত্মতৃপ্তির রসে নিজেকে ডুবিয়ে দিলাম৷ আমার এই ধ্রুপদী পর্দার আত্মমগ্ন আবেশ আমায় এখনও উদ্দীপিত করে৷ রবীন্দ্রনাথের ‘ভুবন জোড়া আসনখানি’ বা ‘বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দ ধারা’ আমার কুঁজো হয়ে বসে থাকা স্বভাবটাকে বুক ফুলিয়ে টান টান করে বসিয়ে দেয়৷ মনে হয় আমি এক বিরাট অস্তিত্বের মধ্যে অবস্থিত, জারিত একটি অণু অস্তিত্ব৷ এটাই আমার গর্ব৷ মনে হয় গেয়ে উঠি, ‘সকল গর্ব দূর করি দিব/ তোমার গর্ব ছাড়িব না’ [রবীন্দ্রনাথ]৷

ছাত্রজীবনে আমার মূলত বিচরণ ছিল রবীন্দ্রনাথের গানের ওপর ভিত্তি করে, কিছু কিছু অন্যান্য গানও ছিল৷ যেমন মনে পড়ে শচীন দেববর্মন গীত ‘তাজমহলের মর্মরে গাঁথা’, ‘পিলে পিলে হরিনাম কা পেয়ালা’৷ এইসব গান পাড়ার জলসায় গেয়ে বেড়াতাম৷ কলেজ জীবনে এই পরিধি বিস্তৃত হয় হেমন্তদার গানকে অবলম্বন করে৷ হেমন্তদা আমাদের দুই ভাই— আমাকে আমার দাদা অরিন্দম বন্দ্যোপাধ্যায়কে খুবই আকর্ষণ করতেন৷ মনে আছে ‘কথা কয়োনাক শুধু শোন’, ‘এখনি নয় নাইবা গেলে এই তো এলে’— এ সব গান আমাদের খুবই প্রিয় ছিল এবং পাড়ার অনুষ্ঠানে আমরা গাইতাম৷ পরে আমার পরের ভাই অম্বুজিৎ হেমন্তদার গান গেয়েই বহু মানুষের মন জয় করেছিল৷

কলেজজীবনে খেলাধুলা, বেড়ানো, আড্ডা, অনুষ্ঠান সবই চলত৷ আড্ডার বিকল্প আনন্দ জীবনে কী আছে আমার জানা নেই৷ আড্ডা যদি ধর্ম, সাহিত্য, কবিতা সংগীত নিয়ে হয়— আর সঙ্গে মুড়ি সিঙ্গারা তবে আর কোনওরকম আনন্দের জন্য তৃষ্ণার্ত হতে হয়নি৷ শরৎচন্দ্রের প্রেমের গল্প পড়তে ভাল লাগত৷ আমাদের পাঁচজনের একটা গ্রুপ ছিল৷ মাঝে মাঝে সাহিত্য বিতর্ক চলত৷ লড়াই হত রবিঠাকুর আর শরৎচন্দ্র নিয়ে৷ আমি সব সময় রবিঠাকুরের পক্ষে থাকতাম৷ পরে অবশ্য শরৎ-সাহিত্যে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম৷ অনুভব করেছিলাম শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মরমি বোধ ও বোধিকে৷ বিশেষত নারীর প্রতি সম্ভ্রম৷ যখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি, কম টাকায় ফ্রন্ট রো-তে বসে এত সিনেমা দেখেছি যে, চোখের ডাক্তার দেখাতে হয়েছিল৷ যার কারণেই সেই সময় থেকেই আমার চোখে চশমা উঠল৷

আমার দাদা অরিন্দম বন্দ্যোপাধ্যায় ও আমি ১ বছর ৮ মাসের ছোট-বড়৷ সব সময় আমরা একসঙ্গে ব্রাহ্মদের নগর কীর্তনের নকলে বাড়িতে খেলার কীর্তন করতাম৷ আবার পাঁচিল টপকে বাড়ি থেকে পালানো ও তার পরিণামে মায়ের হাতের প্রহার— সবই আমরা একসঙ্গে অংশগ্রহণ করতাম৷ এই দাদা-ই পরবর্তী সময়ে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় সৃষ্টির বীজ বপন করে৷ হঠাৎ একদিন একটা গীতিকবিতার বাণী নিজে লিখে নিয়ে এনে বলল, ‘নে এটা সুর দে তো৷’ আমি বললাম— ‘দুর আমি কি সুর দিতে পারি নাকি?’ দাদা জোর করল, ‘কর না সুর, আমি পাশে আছি৷’ আমি একটা সুর দিলাম একেবারে রবীন্দ্রসংগীতের সুরের মতো৷ কিন্তু তারপরের ঘটনা বেশ আশ্চর্যজনক৷ দাদা সেই গানের পরই সত্যেন দত্তর ছিপখান তিনদাঁড় কবিতাটি এনে আমায় সুর দিতে বলল৷ আমি একেবারে আকাশ থেকে পড়লাম— এত বড় একটা কবিতা, আমি সুর করব কী করে? দাদা আবার জোর করল ও একই উচ্চারণের পুনরাবৃত্তি— সুর কর, আমি পাশে আছি৷ বিস্ময়করভাবে খুব কম সময়ে আমার ওই গানটি রচিত হয় এবং আমি নিজেই পরে আশ্চর্য হই সেই সময়ে ওই গানটি সৃষ্টির যে আঙ্গিক পরিকাঠামো ব্যবহার করেছিলাম তা আমি করলাম কী করে? কারণ তখন আমার Major, minor সম্পর্কে কোনও জ্ঞানই ছিল না অথচ গোড়ার অংশের প্রতিটি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে একবার Major এসেছে একবার minor৷ এখন বুঝি আমার সংস্কার-সুরই এর ইন্ধন৷ তারপর গানটির তাল পরিবর্তন ও সর্বশেষ নৌকা চালকদের ক্লান্তির ধীর লয় ব্যবহার, এসব করলাম কী করে? এই গানটি তো আমার জীবনের দ্বিতীয় সৃষ্টি৷ এটা নিয়ে পরবর্তীকালে ভেবে বুঝতে পেরেছি আমার এই সৃষ্টিটির ব্যাকরণের প্রেরণা কোথা থেকে৷

অনেকে ভাবতে পারেন পাল্কি চলে-ই ছিপখান তিনদাঁড়ের প্রেরণা৷ সেটা সম্পূর্ণ ভুল, কারণ ছিপখান তিনদাঁড় পাল্কি চলে সৃষ্টির অন্তত দু’বছর আগের সুর৷ তবু বলব, ছিপখান তিনদাঁড় সলিলদার নির্মাণ কৌশলেরই অনুসারী৷ সলিলদার গাঁয়ের বধূ, রানার এসব গান থেকে মর্মে স্থান করে নিয়েছিল লম্বা গান সুর করার সুর প্রক্রিয়া৷ তবু কৌশলটা সেদিন জানতাম না— পরে জেনেছি সলিলদার কাছে— বলেছিলেন লম্বা গানে সুরকে একঘেয়েমির হাত থেকে রক্ষা করতে হলে Be economic in using notes৷ কিন্তু সলিলদা কেন আমার ‘সর্বসময়ের সৃষ্টির God Father’— সে সম্পর্কে কিছু বলা অত্যন্ত প্রয়োজন৷ তিনি কী করে আমার জীবনে নিরবচ্ছিন্নভাবে সৃষ্টিদিশারি হয়ে উঠলেন তার ক্রমবিকাশের প্রথম দৃশ্যটি পাঠককে জানানোর প্রয়োজন বোধ করছি৷

ঢাকুরিয়া রেল স্টেশনের সংলগ্ন একটি মাঠে ছেলেবয়সে আমরা খেলাধুলো করতাম৷ আবার সেই মাঠে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে সভাও করতেন ঢাকুরিয়াবাসী, তখন আমাদের সেদিনটা আর খেলা হত না৷ এমনই একটি দিন৷ রেলধর্মঘট উপলক্ষে একটি সভা হচ্ছে৷ কৃষ্ণবর্ণ, ছিপছিপে, নাতিদীর্ঘ একজনের আবির্ভাব ঘটল, গায়ে একটা বিস্কুট রঙের কোট৷ পরনে পায়জামা এবং শার্ট৷ গায়ের কোটটা খুলেই হারমোনিয়ামের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গান শুরু করলেন, ‘এক হো, এক হো, হিন্দু মুসলিম বাবু মজদুর এক হো, লড়কে লেঙ্গে আজাদী ভাইরে/রেল মজুরের পেটে ভাত নাইরে৷’ কী বলিষ্ঠ ভঙ্গিমা৷ সংগীতটির পরিবেশনে কী প্রাণবন্ততা৷ সাংগীতিক অভিব্যক্তি বিস্ময়কর৷ রেল স্টেশনের লোহার বেড়া ধরে আমি হতবাক হয়ে শুনছি৷ সেই শোনার মধ্যে দিয়েই আমার প্রথম প্রেম৷ আর প্রচ্ছন্নভাবে আমার পরবর্তী সৃষ্টির উৎকর্ষের অজান্তে সাংগীতিক গুরুকরণ, চিরযোদ্ধা ক্ষত্রিয় স্বভাবের মানুষ শ্রদ্ধেয় সলিল চৌধুরিকে মনে মনে আমার মনের গভীরে, সৃষ্টিশীলতায় স্থান দিয়ে ফেলেছিলাম৷

ছেলেবয়সে একটা প্রথা চালু ছিল দেখেছি— অবসরপ্রাপ্ত পিতা তাঁর নিজের কেদারায় বসিয়ে দিয়ে যেতেন তাঁর নিজ পুত্রকে৷ সলিলদা আমাদের বাণিজ্যিক সংগীত জগতে নিয়ে আসেন নিজে অবসর না নিয়েই— তাঁর সহযোদ্ধা করে৷ কেবল আমি, প্রবীরদা, অনলই না৷ স্বর্ণযুগের একঝাঁক গীতিকার, সুরকার শিল্পীর সমাবেশ ঘটল সলিলদার সক্রিয় মধ্যস্থতায়৷ এতে কেবল নতুন মুখ নতুন গানই পাওয়া গেল, তা নয়— স্বর্ণযুগের উদ্বোধনী সংগীত কোনও এক ‘গাঁয়ের বধূর’ নেতৃত্বকে সামনে রেখে আধুনিক বাংলা গানের জীবনবোধ, প্রয়োগ কৌশল সব গেল বদলে৷ অনুপম ঘটকের মতো অসাধারণ সুরস্রষ্টাও সৃষ্টি করলেন দুপিঠ জুড়ে কাহিনী গান৷ রানারের গানে যে মেহনতী মানুষের প্রতি দরদ মিশ্রিত অনুভব, তার সমমর্মিতার অভিব্যক্তি ফুটে উঠল দিলীপ সরকার রচিত ‘রিকশা চালাই মোরা রিকশাওয়ালা’ গানে৷ নচিকেতা ঘোষের ‘ভাঙ ভাঙ পাথর ভাঙ’ সুরেও সলিল আঙ্গিকের বলিষ্ঠতা ধরা পড়ল৷ রবীন্দ্র রচনার ‘মাথার পরে খুলে গেছে আকাশের এই সুনীল ঢাকনা’-র অনুভব নতুন ভাষায় নতুন আঙ্গিকে ধরা পড়ল সুধীন দাশগুপ্তর বাণী ও সুরে মান্না দে-র গাওয়া ‘আকাশ করে ছাদটাকে/বাড়াই যদি হাতটাকে’, বাণী ও সুরের নবধারা প্রকাশে৷

সলিলদা আমায় একটা চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘অভিজিৎ Urban Music আমাদেরই সৃষ্টি করে যেতে হবে’— এই উচ্চারণের তাৎপর্য এখন ভালভাবে অনুভব করি৷ এখন বুঝি সলিলদার ‘উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা’ best example of urban Music৷ এই সময়ে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারছি নাগরিক সভ্যতার সুর সৃষ্টির আদর্শ সংগীতায়ন ‘একফালি নাগরিক আকাশে’— শব্দযুক্ত ওই গানটি৷ আমার নিজের গান— ‘নগর জীবন ছবির মতন’ বা ‘সন্ধ্যা লগনে’, ‘সারাদিন তোমায় ভেবে’, ‘এ যেন সেই চোখ’ ‘এমন একটা ঝড় উঠুক’— এসব গান সেই নাগরিক জীবনের সত্য সাংগীতিক রূপ, যার আঙ্গিক ভিত্তিভূমি দ্বন্দ্ববাদী হৃদয়বৃত্তির প্রকাশের সংগীত সিম্ভনি— যার উৎপত্তি ও সার্থক প্রয়োগ রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু৷ স্বর্ণযুগের সময়ে রচিত গানে নাগরিক সভ্যতার প্রগতিশীল দিকটাই বারবার উঠে এসেছে৷ সুধীনদার ‘এলো বরষা’ নচিদার ‘আজ কেন ও চোখে লাজ কেন’, শৈলেনের ‘কত রাজপথ জনপদ’ গানগুলো সেই নাগরিক সভ্যতার সাংগীতিক ক্রমবিকাশেরই স্বাক্ষর৷ এই সময়ে দাঁড়িয়ে স্বর্ণযুগের সংগীতগুলোর মূল্যায়ন ভালভাবে করতে পারছি৷ কারণ সে সব সৃষ্টিতে নাগরিক সভ্যতার উজ্জ্বল দিকগুলোই প্রকাশিত— যা আজকের সৃষ্টিতে ধরা পড়ছে না— কারণ সংস্কৃতিতে নাগরিক জীবনের বিকৃতিকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়োজনীয়তা বেড়ে গেছে— বিশ্বায়নের (ব্যবসায়নের) স্বার্থে৷ তারই অপ্রতিহত অভিযান চলছে৷ আমার নিজের কথা লিখতে গিয়ে এসব প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া যায় না৷ কারণ, একজন শিল্পী সমাজবিচ্যুত একটা চিড়িয়াখানার জীব নয়৷ সচল, সজীব, অনির্বচনীয় প্রাণশক্তি৷ সমাজ, জীবন, মানুষ— এসব নিয়েই তার কাজ৷ আর রবীন্দ্রনাথের একটি বাণী এ বিষয়ে খুবই প্রাসঙ্গিক— রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘সংগীতে এতখানি প্রাণ থাকা চাই, যাহাতে সে সমাজের বয়সের সহিত বাড়িতে থাকে৷ সমাজের ওপর নিজের প্রভাব বিস্তৃত করিতে পারে ও তাহার ওপরে সমাজের প্রভাব প্রযুক্ত হয়৷’ রবীন্দ্রনাথের এই বাণীর যথার্থতা বারবার প্রমাণিত হয়েছে বাংলা গানের ধারায়৷ চৈতন্যযুগ, ব্রাহ্মযুগ, স্বদেশি আন্দোলনের যুগ প্রভৃতি সময়ে আমরা অজস্র সংগীত, শিল্প, সংস্কৃতির দানে সমৃদ্ধ হয়েছি৷ আমার জীবনে প্রথম প্রভাব ফেলে ব্রহ্মসংগীত, ব্রাহ্ম সমাজের কীর্তন ও রবীন্দ্রসংগীত৷ সেই ঐতিহ্যের ক্যানভাসে গড়ে ওঠা আমার সাংস্কৃতিক জীবনের চলমানতা সলিলদার হাত ধরে গণনাট্য সঙ্ঘের কর্মকাণ্ডের অবদানে, ঘটিয়েছে আমার সুরকার জীবনের বিকাশ ও প্রকাশ৷

মনে পড়ে প্রয়াত সংগীত পরিচালক প্রবীরবন্ধু মজুমদারের কথা৷ একদিন এসে বললেন, অভিজিৎ চল তোমায় এক জায়গায় নিয়ে যাই৷ প্রবীরদা দাদার বন্ধু তথাপি সংগীতকে ঘিরে তাঁর সঙ্গে আমার খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল৷ কৈশোর থেকে যৌবনের সন্ধিক্ষণে অনেকের গলা ভাঙে— গান বন্ধ হয়, আমারও হয়েছিল৷ আমি তখন একটা শৌখিন নাচের দলে Xylophone বাজাতাম—আগেই বলেছি প্রবীরদাই আবার আমায় রবীন্দ্রসংগীত শিখিয়ে আবার গানে ফিরিয়ে আনেন৷ এই প্রবীরদাই সেদিন নিয়ে গেলেন আমায় গণনাট্য সঙ্ঘের এক অনুষ্ঠানে৷ মনে আছে টিকিট কেটে ভেতরে প্রবেশ করার পয়সা নেই৷ একটা বাড়ির পাঁচিলে বসে অনুষ্ঠানটি দেখি— এতটাই অভিভূত যে পরে মনে হল, এ বাবা এমন ঘোরে তো পাঁচিল থেকে পড়েও যেতে পারতাম৷ মনে আছে— বাড়ি ফিরে সারারাত আমার মাথায় গুঞ্জন করেছে— জর্জদার (দেবব্রত বিশ্বাসের) মন্দ্র গম্ভীর ধ্বনি, ‘জাগা দেশ হামারা’— আর সজল রায়চৌধুরির কণ্ঠের বুক কাঁপানো আওয়াজ ‘সাম্রাজ্যবাদ’৷ বিস্তারিত বলছি না৷ গণনাট্যের অনুষ্ঠান বারবার আমায় মুগ্ধ করেছে, উদ্বুদ্ধ করেছে জীবনের গান গাইবার প্রেরণায়৷ তবে দাদার নিরবচ্ছিন্ন সঙ্গ, আমি গণনাট্য করি বলে আমায় বিচ্ছিন্ন করেনি দাদার থেকে৷ কারণ আমরা দুই ভাই হবার সুবাদে আমিও আর এস পি পরিচালিত সংগঠন ‘ক্রান্তি শিল্পী সঙ্ঘ’তে অনুষ্ঠান করেছি৷ এমন কি আর এস পি-র পক্ষ থেকে একবার ঢাকুরিয়ার প্রার্থীর রাজনৈতিক সভাতেও সংগীত পরিবেশ করেছি, দাদার রচনা, আমার সুরে— ‘মিছিল চলে মিছিল চলে৷’ আবার দাদার রচনা আমার সুর— ‘ঘুমাস না আর খোকা আমার বর্গী এল দেশে’ গানটিও গণনাট্য সঙ্ঘের মঞ্চ থেকে পরিবেশিত হয়েছে৷ এমনকি ওয়েলিংটন স্কোয়্যারে সমবেতভাবে গাইবার সময় সলিলদাও গলা মিলিয়েছেন৷

প্রথম আমি গণনাট্য সঙ্ঘে যোগ দিই ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পরে— তখন গণনাট্য মঞ্চ থেকে স্বদেশি গান গাওয়া হচ্ছে৷ আমি প্রবীরদা সেই সময়ে প্রথম প্রবেশ করি৷ তারপর ১৯৪৮ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিলাম তখন গণনাট্য থেকে সাময়িক সরে এলাম, আবার সেই প্রবীরদার হাত ধরে গণনাট্যে ফিরে এলাম৷ এবার সোজাসুজি সলিলদার কাছে৷ নিত্য সলিলদার সাহচর্যে সাংগীতিক জীবনের রসাস্বাদন করছি, মনে কোনও ভাবেই বাণিজ্যিক মনস্কতা ঠাঁই পায়নি৷ এমন সময় একটা চাকরি পেলাম— দিনে চাকরি রাতে বি কম পড়া৷ গণনাট্য ও সলিলদা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম৷ সলিলদার সঙ্গে আর দেখা হয় না৷ বারবার খবর পাঠান প্রবীরদার মারফত কিন্তু আমি যাব কী করে৷ এমন সময় একদিন খবর পাঠালেন রবিবার শ্রী সিনেমায় একটা অনুষ্ঠান আছে, সেখানে আসতে৷

অনেক কথার মধ্যে মূল যে কথা— সলিলদা বললেন, সেটা হচ্ছে জীবনে চাকরি-লেখাপড়া সবই দরকার৷ তবে প্রতিভাকে অবহেলা করা অন্যায়৷ দিনটি ছিল রবিবার৷ সেদিন সলিলদা যে সব ভাষা বললেন, তারপর আর কলেজ যাইনি৷ জীবনের সবচেয়ে বড় ডিসিশন সেদিন নিই৷

এই দাদা, প্রবীরদা ও দাদার আরও দুই সমবয়সী বন্ধু মলয়দা, কচিদা এঁরা মিলে ঢাকুরিয়ায় একটি সংগঠন তৈরি করেন৷ যার নাম ছিল ‘উদীচী’৷ এই উদীচী নামটিও দাদারই দেওয়া৷ আমি ও প্রবীরদা এই সংগঠনের সংগীত বিভাগ পরিচালনা করতাম৷ এই সংগঠনের সবাই সাংস্কৃতিক কর্মী৷ কেউ কবি, কেউ সাহিত্যিক, কেউ গায়ক— এবং প্রত্যেকেই ছিল সুদক্ষ সংগঠক৷ সলিলদা মাঝে মাঝে এখানে আসতেন এবং আমাকে যখন গণনাট্য কলকাতা কেন্দ্রের মূল শাখায় প্রতিনিধিত্ব করতে পাঠান তখন বলেছিলেন, ‘অভিজিৎ এমন এক সংগঠনে জড়িত ছিল যার প্রতিটি সভ্য এক একটি আলাদা আলাদা সংগঠন গড়ার, পরিচালনা করার ক্ষমতা রাখে৷’ এই উদীচী— আমার সাংগীতিক জীবন গড়ে ওঠা ও পরিমার্জিত হওয়ার পথে অনেক পাথেয় জুগিয়েছে৷ প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্রবোধকুমার সান্যাল, গজেন্দ্রকুমার মিত্র, সুমথনাথ ঘোষ এঁরা প্রায় আসতেন৷ আসতেন শিশু কবিতার কবি সনির্মল বসু, শৈল চক্রবর্তী এঁদের আসার অন্যতম শর্ত থাকত অভিজিতের মুখে রবীন্দ্রনাথের গান শুনবেন৷ নববর্ষ, রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন, নজরুলের জন্মদিন— এই সমস্ত অনুষ্ঠান নিয়মিত হত৷ নতুন গান, নতুন কবিতা, নতুন গল্পের আসর হত নিয়মিত৷ প্রবীরদার শিক্ষকতায় একটা গানের ক্লাসও হত৷ গণনাট্য সঙ্ঘ, উদীচী, আমার সংগীতে পরিশীলিত রুচিবোধের বুনিয়াদ বীজমন্ত্র, সোপান৷ বাণিজ্যিক জগতে প্রবেশ করেও এই বোধগুলো আমার সঙ্গ ছাড়েনি৷ ব্রাহ্ম পরিবারের সন্তান হয়েও কবি-সন্ন্যাসী পরমানন্দ সরস্বতীর দীক্ষামন্ত্র লাভ করে যখন বৈষ্ণবীয় ভাবধারায় জীবনকে আস্বাদন করেছি— তখনও অনুভব করছি— ব্রহ্মসংগীত, স্বদেশ চেতনার গান, গণনাট্যের জীবন ও সলিল চৌধুরির গান ও আমার পূর্বসূরিদের সৃষ্টি সংগীতপ্রবাহ সব সময়ে আমার সাংগীতিক জীবনবোধে আছড়ে আছড়ে পড়েছে৷ পঙ্কজ কুমার মল্লিক, রাইচাঁদ বড়াল, হিমাংশু দত্ত (সুরসাগর), অনুপম ঘটক আমায় বারবার বিস্মিত করেছেন৷ অনুপম ঘটক আমাদের ঢাকুরিয়ার এক শৌখিন যাত্রাদলের সংগীত পরিচালনা করতেন— পাহাড়ের মতো এক দীর্ঘকায় ব্যক্তি— একটা রিকশা চড়ে আসছেন, আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম— আর তিনি যে সব গান সুর করতেন তা আমার মনকে এতই টানত যে ছেলেবয়সে পাড়ার জলসায় তাঁর সুরসৃষ্টি ‘রাম নির্বাসন’ পালার গান আমি মধ্যে মধ্যে গাইতাম৷ ছোটবেলায় শোনা কিছু কিছু গান মনে গেঁথে রয়ে গেছে৷ একটি গান যেমন এখনও আমি বিভিন্ন সময়ে উদ্ধৃতি দিয়ে থাকি৷ গানটি শোনা একজন ভিক্ষা করতে আসত তার মুখে— ‘ভব সংসারের মাঝে আমি মা তোর বোকা ছেলে’— তাতে লাইন ছিল৷ ‘রামরাবণে যুদ্ধ হল লোয়ার চিৎপুরে’ শক্তিশেলে লক্ষ্মণ মোল মেছো বাজারে৷ কাশীধামে কাগ মরেছে বৃন্দাবনে হাহাকার’ গানটি সৃষ্টিকর্তা কে জানা নেই৷ তবে এখনও যখন কেউ আমার কাছে গান শেখে, আমার অচেনা অজানা কোনও তবলা বাদকের সঙ্গে তবলায় তালিম নিতে চায়— আমি এই গানটি শুনিয়ে তাকে বোঝাই যে দুই শিক্ষক দুই প্রান্তে বসে এক শিক্ষা পদ্ধতিকে এগিয়ে নিতে পারে না৷ আর একটি গানও মনে পড়ে ‘তিনজনা বৈষ্টমী থাকেন আমার ঘরে, দুইজন ভিক্ষায় যান একজন সেবা করেন৷ হরিনামের মালা রয়েছি ভাজন৷ আমি অনেক দুঃখেতে রেখেছি শ্রীচৈতন৷’

একটু পেছনে হাঁটছি— আমার দাদা শ্রী অরিন্দম বন্দ্যোপাধ্যায়, যার নাম আগেও উল্লেখ করেছি— পিঠোপিঠি হওয়ার কারণে দুজনে সব কাজ একসাথে করার একটা স্বাভাবিক প্রবণতা উভয়েরই ছিল৷ যেমন আগে লিখেছি পাঁচিল টপকে বাড়ি থেকে পালিয়ে পরে মায়ের হাতে জবরদস্ত প্যাঁদানি, তাতেও আমি দাদার Share holder থাকত৷ এই দাদার সঙ্গেই ফুটবল, ভলি, ব্যাডমিন্টন প্রভৃতি খেলাধুলোও চলত৷ আবার বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক বোধ বিনিময়ের ক্ষেত্রও তৈরি হয়েছিল৷ ঠাকুরদা, বাবার মধ্যে যে প্রগতিশীল বাম-মনস্কতা ছিল তার মনন যেন দাদার ওপর সক্রিয়ভাবে এসে পড়েছিল৷ দাদার রাজনৈতিক চেতনা কেবল emotion ভিত্তিক না— শিক্ষিত বোধের মধ্যে থেকে তা গড়ে ওঠা৷ দাদা মার্কসীয় দর্শনও পড়েছে৷ আবার উপনিষদও৷ কেবল তাই নয় সুন্দর সংস্কৃতি ও সুস্থ সংগীত, শিল্প নিয়ে যে সামাজিক দায়বদ্ধতায় নিজেকে নিয়োগ ও প্রয়োগ করতে হয় তা শিখেছি দাদার অনুসারী হয়ে৷ পরবর্তী জীবনে আমি যখন সলিলদার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পূর্ণভাবে গণনাট্য সঙ্ঘে নিজেকে কর্মী হিসাবে জড়িয়েছি— যার রাজনৈতিক ভাবধারা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে এক মননে পরিচালিত— দাদা তখন আর এস পি প্রভাবিত রাজনীতিতে বিশ্বাসী৷ আমি রাজনীতিতে সচেতন হয়ে গণনাট্য করতাম তা নয়— গণনাট্যের নাটক, সংগীত, তার প্রাণবন্ত উপস্থাপনা আমার প্রবলভাবে আকর্ষণ করত৷ আমার রক্তে স্নায়ুতে হিল্লোল তুলত গণনাট্যের সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ৷

আমার সাংগীতিক শিক্ষা অতি অল্প৷ আমি দীর্ঘদিন শ্রদ্ধেয় ঊষারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীত শিক্ষা নিয়েছি— কিন্তু নিয়মিত ছিলাম না বলে, ওই দীর্ঘ সময়ে যা শেখা উচিত ছিল তার অনেক কম শিখেছি৷ আরও মনে হয়েছে— সংগীত পরিচালকের ভূমিকা নিয়ে যেমন শিক্ষা নিয়েছি তার সঙ্গে গায়ক মনটাকেও বাঁচানো দরকার ছিল— তাতে স্বরক্ষেপণ সাবলীল হত এবং সংগীত নির্মাণের ক্ষেত্রে আমার বিচরণ ক্ষেত্র বিস্তৃত হতে পারত৷ মান্নাদার অনেক গানের সুর শোনার পর আমার এই বিশ্বাস জাগে৷ তবে একটা কথা বলব, ঊষাদা আমায় যখন যে রাগ শেখাতেন— তার রূপ রস চলন এমনভাবে শেখাতেন যে সেই রাগ নিয়ে আমার গান রচনা করতে খুব স্বাভাবিক বোধ হত ও আধুনিক নির্মাণে, আমায় একটি গান গঠনে সাহায্য করত৷ ‘হংসপাখা দিয়ে’ এবং ‘ও পাখি উড়ে আয়’ ‘ফুলে ফুলে বঁধু’, ‘ঝননন তননন’, ‘শুনি সখী মোহনিয়া’ ‘এখনো সারেঙ্গিটা’— এমনকি ‘সবাই চলে গেছে’ পর্যন্ত আমার ওই রাগ সচেতন অনুভব আমার নির্মাণের রসদ হয়েছে৷ সঙ্গে chord ও হার্মনি বোধ৷ এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের সংগীত চিন্তাও আমায় অসম্ভব প্রেরণা জুগিয়েছে৷ রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, বাংলা গানের পনেরো আনা নির্মাণ হিন্দুস্থানি গান থেকে৷ লিখছেন, সংগীত রাগ রাগিণীর সংগীত নয়— ভাবের সংগীত৷ লিখেছেন রাগ রাগিণী পর্দার রাগ রাগিণী নয়— ভাবের রাগ রাগিণী৷ লিখছেন, বাংলা গানে বাণী ও সুরের সম্পর্ক সার্থক দাম্পত্য সম্পর্কের মতো,— একজন অপরের ওপর জোরজবরদস্তি করবে তা নয়৷ লিখেছেন, ‘সুর ও হার্মনির মিলিবার সময় আসিয়াছে৷ ইউরোপীয় সভ্যতা আমাদের দ্বারে উপস্থিত— আমরা কি বনমানুষ না বর্বর যে আমরা সেই সুরকে আমাদের সুরের মধ্যে মিশ্রিত করতে পারব না৷ পশু এই মিশেল পারে না— মানুষই তা পারে৷’ আমার সুরসৃষ্টিতে এইসব আদর্শ আমায় বিশেষভাবে সাহায্য করছে৷ এক রাগের মধ্যে অন্য রাগ— সেই মিশ্রণের তাগিদে tonic change-Major থেকে minor-এ অবাধ বিচরণ সবই রবীন্দ্র ভাবনায় উদ্দীপিত, সলিল সংগীত চেতনায় তা বিধৃত৷ রবীন্দ্রনাথ এক জায়গায় বলেছেন, মৃদঙ্গের মধ্যে তাল নাই— তাল হারমনির মধ্যে— এই বোধটা বর্তমানে নির্মাণের সময় আমায় প্রভূত সাহায্য করছে— কারণ বাণী প্রাধান্যের যুগে বাণীর বিচরণ অবাধ করতে তালকে passive ভাবে ব্যবহার করে আমি আমার বাণীকে সহজ আবৃত্তিতে প্রকাশ করতে পারছি৷ এই তালযন্ত্রের দাসত্ব সলিলদাও মানতেন না বরঞ্চ বিরক্ত হতেন৷ এমন ঘটনা আমি জানি,— একজনের একটি গান শুনে বলেছিলেন, গানটার কী মন্তব্য করব বলত,— গানটা তো তবলা বাজিয়ে শেষ করে দিয়েছিস৷ রবীন্দ্রনাথ, সলিল চৌধুরি যে European Symphony Music-কে বাহন করেছিলেন, তা একদিকে ঐতিহ্য সুর ও ইউরোপীয় পদ্ধতির মেলবন্ধন৷ যা বাদী সম্বাদীর সামন্ততন্ত্র বা রাজতন্ত্র ভাঙা, পর্দার বিচরণের গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র— অর্থাৎ সাত পর্দার সমান অধিকার৷ আমার নির্মাণে এইসব ভাবনারই ফসল ফলেছে৷ অবশ্যই নির্মাতা হিসাবে আমার দক্ষতার সীমিত শক্তির ওপরই তা নির্ভরশীল৷

আমার পরম সৌভাগ্য যে আমি ভারতবর্ষের প্রায় সমস্ত শিল্পীর গান করবার সুযোগ পেয়েছি৷ লতাজি, আশাজি, কিশোরবাবু, ঊষা, মান্নাদা, ভূপেন্দ্র সিং, শৈলেন্দ্র সিংহ, অনুরাধা পড়োয়াল, আবার হেমন্তদা, শ্যামলদা, মানবদা, সতীনাথদা, ধনঞ্জয়দা, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতি, হৈমন্তী, অরুন্ধতী, প্রতিমাদি, উৎপলা সেন থেকে শুরু করে মৃণাল, শৈলেন, সনৎ সিংহ, বাণী ঘোষাল, ইলা বসু, গায়ত্রী বসু, পিন্টু ভট্টাচার্য, জপমালা ঘোষ, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুপ্রীতি ঘোষ— কে নয়? আবার মজা করে কাজ করেছি দুজন শিল্পীর সঙ্গে— দ্বিজেনদা ও তরুণদা৷ এঁরা দুই অভিন্নহৃদয় বন্ধু৷ আর এঁদেরই দুজনের পুজোর গান বছরের পর বছর একসঙ্গে করেছি৷ মজা হত— নিজের গানের থেকে, একে অপরের গানের খবর নিত বেশি৷ এক অদ্ভুত আন্তরিক Healthy Competition.

যদিও ব্রাহ্ম পরিবারে জন্ম, তবু জীবনের চলমানতা একদিন আমায় বৈষ্ণব ভাবধারায় যুক্ত করে৷ জীবনকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার দৃষ্টি পাই তখন৷ তখন সে সব পরপর সংগীত সৃষ্টি হতে লাগল তার মধ্যে সবাই চলে গেছে, এমন একটা ঝড়৷ অনেক অরণ্য পার হয়ে৷ সুপ্রকাশ চাকি অরুণ দত্তর গানের সেই ভাবধারা প্রবেশ করল৷ আর সেই সময় আমার সেই সব গানের মূল অবলম্বন শিল্পী হচ্ছে সুবীর সেন৷ পরপর গান করছি আর সে পরপর record করছে৷ ‘সারাদিন তোমায় ভেবে’, ‘এ যেন সেই চোখ’, ‘মোনালিসা’, ‘হয়ত তোমার অনেক ক্ষতি’ ইত্যাদি ইত্যাদি৷ ওই শিল্পীর সঙ্গে যেন আমার একটা নাড়ির যোগ সৃষ্টি হয়েছিল৷ প্রতিদিন আড্ডা হত জিম বিবস, ন্যাট কিং কোল আবার গজল, নিজের তৈরি রচনা সব শোনাত, বলত এটা শুনুন, ওটা শুনুন৷ সেই উপাদেয় খাদ্য সমৃদ্ধ আড্ডার ফসলই হল— ‘সারাদিন তোমায় ভেবে’, ‘মোনালিসা’, ‘এ যেন সেই চোখ’ প্রভৃতি গান৷

আমার জীবনে যে সব উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বের অবদান তার মধ্যে দাদা সলিলদার পরই অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্বনামধন্য গীতিকার পবিত্র মিত্র৷ যিনি স্বর্ণযুগের রূপকার৷ গ্রামোফোন কোম্পানির তৎকালীন ম্যানেজার৷ কোন সময়ে কার গান, কে লিখবে, কে সুর দেবে, কবে থেকে পুজোর গান রচনা, রেকর্ড শুরু হবে থেকে শুরু করে যাবতীয় তত্ত্বাবধান করতেন৷ তিনি যেমন সলিলদা, হেমন্তদা, সন্ধ্যা মুখার্জি, বম্বের শিল্পীদের গানের ব্যবস্থা করতেন, তেমনি আমাদের জন্যে গড়ে দিয়েছিলেন শনিবারের আসর৷ প্রতি শনিবার নলিন সরকার স্ট্রিটের মহলা গৃহে তিনি হাট বসিয়ে দিতেন৷ আমরা কমবয়সী সুরকার, গীতিকার এবং কিছু গায়করা মিলে প্রতি শনিবার মিলিত হতাম৷ যেখানে হত আমাদের বিনিময়৷ এর সুর সৃষ্টিতে ওর ছোট্ট প্রবেশ— এর বাণী রচনায় ওর অবদান,—নতুন সৃষ্টি এনে ওকে এর শোনান,— তারপর কোন শিল্পী তা গাইবেন তা নির্বাচন— সবই সেখানে বসে স্থির হত৷ আর পবিত্রদা দিতেন তার পুরোপুরি নেতৃত্ব ও রেকর্ডের রূপ৷ এই বৈঠক নিয়েই আলাদা একটি প্রবন্ধ রচনা করা যায়৷ সৃষ্টিশীল কাজেও এই Community বোধ কতটা পুষ্টি জোগাতে পারে শনিবারের এই বৈঠক হচ্ছে তার ঐতিহাসিক দলিল৷ যেমন আমি, প্রবীরদা, অনল, শৈলেন, মাঝে মাঝে রতুবাবু, পুলকবাবু, তেমনি গীতিকার হিসেবে মিন্টু ঘোষ, অমিয় দাশগুপ্ত, আনন্দ মুখার্জি, রঞ্জিত দে, প্রবোধ ঘোষ ও মাঝে মাঝে শিবদাসবাবুরা সব জড়ো হতাম৷ সনৎ সিংহ ছিলেন নিয়মিত বন্ধু৷ দ্বিজেনদা শ্যামপুকুরে থাকার সুবাদে প্রায়ই আসতেন,— মাঝে মাঝে উৎসাহ দিতে আসতেন নচিদা৷ আর খুব কাছে কাছে থাকতেন সুধীনদা৷ এই সমগ্র সমাবেশ আমায় অনেক শিখিয়েছে, অনেক দিয়েছে— আমার যতটুকু প্রতিষ্ঠা তার অনেকটা জুড়েই এই বৈঠকের অবদান৷ আমার জীবনের সব থেকে মহত্তম সংযোগ আমার ব্রাহ্ম পরিবারের আঙিনা থেকে বেরিয়ে বৈষ্ণব ধারার সঙ্গে যুক্ত হওয়া৷ আমার মন্ত্রদীক্ষাদাতা গুরু শ্রীমৎ স্বামী পরমানন্দ সরস্বতী ছিলেন এক উঁচু মাপের জাত কবি৷ কবি জগদীশ ভট্টাচার্য তাঁকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন— কবি-সন্ন্যাসী বলে৷ ডাকসাইটে মার্কসীয় কবি বিমল ঘোষও ছিলেন তাঁর আশ্রিতজন৷ গুরুদেব নিজেও এক সময় শ্রীহট্টে প্রগতিশীল লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘের ছিলেন সম্পাদক৷ তাঁর চিন্তাধারাও ছিল প্রগতিশীল কবিগত আধুনিক৷ আর আমার এই সংযোগ ঘটিয়েছিল আমার সৃষ্টিশীল জীবনের শক্তি শ্রীমতী সুমিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ যিনি আমার বিখ্যাত অনেক গানের মূর্তিমতী প্রতিমা৷ তিনি আমার জীবনে আসার পর আমার প্রথম ছবি মুক্তি পায় আর দুরারোগ্য ক্যান্সার ব্যাধিতে চলে যাওয়ার ১৪ বছর আর কোনও আমার ছবি করা হয়নি৷

সিনেমার গান নির্মাণের পরিবেশ, পদ্ধতি, প্রক্রিয়া সে আবার আলাদা ধরনের, আলাদা অভিজ্ঞতা৷

আমার ছবির গানের গীত রচয়িতা মূলত পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়৷ গৌরীদা, শিবদাসবাবু, পার্থপ্রতিম চৌধুরি, মোহিনী চৌধুরি— এঁরাও দু’একটা ছবিতে গান লিখেছেন,— তবে মূল কাজটা পুলকবাবুর সঙ্গেই হয়েছে৷ আর যে সব গান জনপ্রিয় হয়েছে তার প্রায় সব কটিই পুলকবাবুর রচনা৷ ওঁর সঙ্গে কাজ করার সব থেকে সুবিধা ছিল উনি গান বুঝতেন৷ নিজে হারমোনিয়াম বাজাতে পারতেন৷ গায়ত্রী বসু গীত আমার একটা basic গান ‘দূর বনপথে’-এর সঞ্চারী সুরটা পুলকবাবুরই তৈরি৷ আমাদের মধ্যে এ ধরনের বিনিময়ের নজির অনেক আছে৷ যেমন ‘ছিপখান তিনদাঁড়’ গানটি তাইরিয়া নাইরিয়া refrain লাইনটি প্রবীরদার সৃষ্টি৷ অনেক গীতিকারের লেখা অনেক গানের অনেক লাইন আমি লিখে দিয়েছি৷ আমার সুরারোপিত বহু গানের মুখড়া আমার দেওয়া৷ আবার অন্যের সুরের ক্ষেত্রেও আমার সহযোগিতা তাদের কাজে লেগেছে৷ পুলকবাবুর অন্যতম আর একটি গুণ সুরের বন্দিশ বুঝতেন৷ একটা বাণী সুর করতে গিয়ে যথাযথ বন্দিশে করতে পারছি না— উনি শুনেই বুঝতে পারতেন আমার কোথায় আটকাচ্ছে— সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করে দিতেন৷ শব্দ ব্যবহারের কোথায় শব্দকে সহজিয়া করে ব্যবহার করতে হবে— কোথায় ভাবপ্রবণতা বাড়াতে হবে অসম্ভব দক্ষভাবে তা করতে পারতেন৷ আর পুলকবাবুর গানে thought repeatation থাকত না৷ বিষয়কে মূলস্রোতে বেঁধে ভাষাকে স্রোতস্বিনী করতে পারতেন৷ ওঁর বাণীতে জীবনদর্শনের গভীরতা বেশি পেতাম৷

চলচ্চিত্রে-কণ্ঠ শিল্পীদের অবদানের কথাও না বললে চলে না৷ হেমন্তদা প্রথম ছবিতে গান গাইতে এসে প্রশ্ন করেন কার ঠোঁটে গানটি হবে আর গানটি indoor না outdoor অর্থাৎ ছবিতে চরিত্রের কণ্ঠস্বরের সঙ্গে তাঁর কণ্ঠস্বরকে মিলিয়ে স্বরক্ষেপণ করতে হবে আর indoor outdoor বিচার করে স্বরের আন্তরিকতা ও ব্যাপ্তিকে স্থির করতে হবে৷ মান্নাদা একজন দিকপাল শাস্ত্রীয় সংগীতজ্ঞ হয়ে কীভাবে গানে ‘গিমিক’ সৃষ্টি করতে পারেন চরিত্রানুযায়ী, সে অভিজ্ঞতা আমায় বুঝতে শিখিয়েছে যে ছবির গান সাংগীতিক চিত্রায়ণ আর non-film গান সুরের ভাবচিত্রায়ণ৷ হৈমন্তী শুক্লা হরিহর শুক্লার কন্যা শাস্ত্রীয় সংগীত তার রক্তে, স্নায়ুতে অথচ সে প্রথম প্লে ব্যাক করতে এল তা বাচ্চাদের গান, ‘শিব ঠাকুরের গলায় দোলে’, — তাতে ওই শাস্ত্রীয় ঘরানার শিল্পী যে বিস্ময়কর ‘গিমিক’কে প্রয়োগ করল তা পরবর্তীকালে ইতিহাস হয়ে গেছে৷ তখন একটা ছবিতে যে সব কলাকুশলী কাজ করত তারা ছবির বিষয়বস্তুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেত৷ ‘হারায়ে খুঁজি’ ছবিতে ‘আরতি’ ‘ঝননন তননন’ ও ‘টুংটাং পিয়ানো’— গেয়ে আমায় বলল, অভিজিৎদা— নায়িকাকে একটু নড়াচড়া করতে বলবেন৷ বোম্বেরও কাজের বলবার মতো ঘটনা আছে, সব বিষয় নিয়ে আলাদা আলাদা লিখলে তবে বোঝা যাবে৷

অনেক গল্প৷ অনেক ঘটনা৷ অনেক ইতিহাসের সঙ্কলন এই আটান্ন বছরের [১৯৫১-২০০৯] সাংগীতিক জীবনে— এত ছোট পরিসরে ও সময়ে যার যোগ্য চিত্র তুলে ধরা যায় না৷ চলচ্চিত্রের কথা,— বহু গান নির্মাণের গল্প— পূর্বসূরীদের কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা—রেকর্ডিং-এর অভিজ্ঞতা— বোধবুদ্ধির ক্রমবিকাশ অনেক কিছুই বলার রসদ আছে— যদি কখনও সুযোগ আসে তা লিপিবদ্ধ করবার ইচ্ছা রইল৷ এই রচনায় কিছু কথা তার থেকেই বললাম৷ যেটুকু লিখলাম এ আমার টুকরো কথার ছিন্নপত্র৷

যে সব স্রষ্টার কাজ নিয়ে আমার এই গ্রন্থ প্রকাশ তাঁদের সবার থেকে আমি বয়ঃকনিষ্ঠ৷ তাই তাঁদের যেটুকু বুঝেছি,— যেটুকু আমার নিজের চলার পথে পাথেয় করতে পেরেছি— যেটুকু বোধ ও শিক্ষার আলো জ্বলেছে তারই কিছু আভাস দিয়েছি৷ আমার এসব দেখা পূর্ণ দেখা নয়— বরঞ্চ বলা যায় আমার সীমিত জ্ঞান, বোধ, শিক্ষা অঙ্গনে দাঁড়িয়ে যেটুকু জায়গায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করা যায় সেটুকু দেখেছি— যা কখনওই দিগন্ত দর্শন হতে পারে না৷ আমার এই গ্রন্থ প্রকাশ করার মূল প্রেরণা বাংলা গানের যে ঐশ্বর্যপূর্ণ ইতিহাস তার নির্মাণ কৌশল, ঔজ্জ্বল্য, সার্থকতা, বহমানতা নিয়ে গবেষণা শুরু হোক, যেখানে এই গ্রন্থ বর্ণ-পরিচয়ের কাজ যদি করতে পারে আমার সাধনা সার্থক৷

নিজের জীবন সংগীতের পটভূমিকার এক ছোট্ট চিত্র এঁকে দিলাম কিন্তু আমার গানের কাজ, নির্মাণের বিষয়ে গবেষণা আমার কাজও নয়, অন্যের কাজ৷ কারণ আমার নিজের নির্মাণের বিশ্লেষণ আমার দ্বারা হলে যথাযথ হবে না— এমনকি পক্ষপাত দুষ্টও হতে পারে৷ কবি গুরুর ভাষায় তাই বলছি ‘গানে গানে সব বন্ধন যাক টুটে৷’

বাংলা গানের পথ চলার ইতিহাস রচনা শুরু করলাম— গতি প্রগতি পাক এই প্রার্থনা৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *