টীকা
১. মার্কণ্ডেয়—মৃকণ্ডু ঋষির পুত্র। ব্রহ্মার মানসপুত্র ঋষি ভৃগু; ভৃগুর পুত্র বিধাতা, আর বিধাতার পুত্র মৃকণ্ডু। সেই মৃকণ্ডুর পুত্র হলেন মার্কণ্ডেয়। ইনি পরম শিবোপাসক ছিলেন ছোটবেলা থেকেই। ষোল বছরের পরমায়ু নিয়ে জন্মেছিলেন। ছোটবেলাতেই সমস্ত বেদের জ্ঞান তার অধিগত ছিল। শিবের কৃপায় স্বয়ং যমরাজ তাঁর প্রাণ নিতে পারেন নি। সেই থেকেই শিব মৃত্যুঞ্জয় নামে খ্যাত হয়েছিলেন। মার্কণ্ডেয় ঋষির আশ্রম ছিল হিমালয়ের উত্তরভাগে পুষ্পভদ্রা নদীর তীরে। মার্কণ্ডেয় ঋষিকে আমরা মহাভারতেও বহুবার পাই। বণপর্বে পাণ্ডবদের তিনি ধর্মোপদেশ দিয়েছিলেন।
২. মনু—হিন্দুধর্ম অনুসারে সৃষ্টি এবং ধ্বংস চক্রাকারে চলতে থাকে। দেবতারাও জন্ম মৃত্যুর অধীন। ব্রহ্মা সৃষ্টির দায়িত্বে আছেন। ব্রহ্মার একদিনকে (শুধুমাত্র দিন, রাত নয়; দিন ও রাত মিলিয়ে হয় অহোরাত্র) বলা হয় কল্প। তাঁর একদিনের শেষে, তিনি নিদ্রিত হলে প্রলয় আসে। সে সময় কারণসলিলে অনন্ত নামক মহাসর্পের উপর বিষ্ণু নিদ্রিত থাকেন। পুনরায় ব্রহ্মার দিন হলে, তিনি সৃষ্টি করেন। এখন, একটি কল্পে, অর্থাৎ ব্রহ্মার একদিনে ১৪টি মন্বন্তর আসে। প্রতিটি মন্বন্তরে শাসন করেন একজন মনু। তার মানে, প্রতি কল্পে ১৪ জন মনুর রাজত্ব পরপর আসে। প্রতিটি মন্বন্তরে ৭১টি চতুর্যুগ আসে। এক একটি চতুর্যুগ সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর এবং কলি এই চারযুগ নিয়ে তৈরী। প্রতিটি মন্বন্তরের শেষে নতুন দেবতারা, নতুন ইন্দ্র এবং নতুন সপ্ত ঋষি আসেন। একজন ব্রহ্মার পরমায়ু ১২০ ব্রহ্মবর্ষ; একে বলা হয় মহাকল্প। একটা কথা বলে রাখি যে, মানুষের বছর বা দিন, দেবতাদের দিন বা বছর এবং ব্রহ্মার দিন বা বছর এক নয়। মানুষের এক বছরে দেবতাদের একটি অহোরাত্র। দেবতাদের ৩৬০টি অহোরাত্র নিয়ে এক দেববর্ষ হয়। ১২,০০০ দেববর্ষ নিয়ে চতুর্যুগ। ৭১টি চতুর্যুগ নিয়ে মন্বন্তর, ১৪টি মন্বন্তর নিয়ে ১টি কল্প, ২টি কল্প নিয়ে ব্রহ্মার একটি অহোরাত্র। ৩৬০টি ব্রহ্মার অহোরাত্র বিয়ে একটি ব্রহ্মবর্ষ। যাইহোক, মহাকল্পের পরে ব্রহ্মা মারা গেলে মহাপ্রলয় আসে; মহাপ্রলয়ের শেষে নতুন ব্রহ্মা দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বর্তমানে শ্বেত বরাহ কল্প চলছে। এই কল্পে, সপ্তম মনুর রাজত্ব চলছে। এঁর নাম বৈবস্বত মনু। এই মন্বন্তরে যিনি ইন্দ্রপদে রয়েছেন তাঁর নাম পুরন্দর। এর আগে যথাক্রমে স্বয়ম্ভুব মনু, স্বারোচিষ মনু, উত্তম মনু, তামস মনু, রৈবত মনু, এবং চাক্ষুষ মনুর রাজত্বকাল অতিবাহিত হয়ে গেছে। অষ্টম মনু, যিনি ভবিষ্যতে আসবেন তাঁর নাম সাবর্ণি মনু। তিনি তাঁর পূর্বজন্মে ছিলেন রাজা সুরথ, যাঁর কথা এখানে বলা হচ্ছে। দেবীর আশীর্ব্বাদে তিনি ভবিষ্যতে সাবর্ণি মনু হিসেবে জন্ম নেবেন ও দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।
৩. বসু—এখানে বসু বলতে অষ্টবসুর কথা বলা হচ্ছে। প্রজাপতি দক্ষ, যিনি ব্রহ্মার ডান অঙ্গুষ্ঠ থেকে উৎপন্ন হয়েছিলেন, তাঁর অনেকগুলি কন্যা ছিল। তারমধ্যে এক কন্যার নাম বসু; তার বিয়ে হয়েছিল ধর্মদেবের সঙ্গে। ধর্মদেবও ব্রহ্মার থেকে উৎপন্ন হয়েছিলেন। বসুর গর্ভে ধর্মদেবের আট পুত্র জন্ম নেয়, এদের অষ্টবসু বলা হয়। এরা হচ্ছে গণদেবতা। বিষ্ণুপুরাণ অনুসারে এদের নাম হল আপ, ধ্রুব, সোম, ধর্ম, অনিল, অনল, প্রত্যুষ এবং প্রভাস। অষ্টবসু একদিন তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। ঘুরতে ঘুরতে তারা ঋষি বসিষ্ঠের আশ্রমে এসে পরে। সেখানে তারা নন্দিনী নামক একটি সুন্দর গরুকে দেখতে পায়। নন্দিনী বসিষ্ঠের অত্যন্ত প্রিয় গরু। প্রথম বসু অর্থাৎ আপের স্ত্রীর গরুটি খুব পছন্দ হয়ে যায়। স্ত্রীকে খুশি করতে আপ নন্দিনীকে চুরি করে নিয়ে যায় আশ্রম থেকে। অন্য বসুরাও তার সাথে এই অপকর্মে লিপ্ত ছিল। বসিষ্ঠ ফিরে এসে তপস্যার প্রভাবে সবই জানতে পারেন এবং অষ্টবসুকে শাপ দেন যে তাদের মানুষ হয়ে পৃথিবীতে জন্ম নিতে হবে। অষ্টবসু তখন ঋষির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। বসিষ্ঠ তখন করুণাবশতঃ শাস্তি কমিয়ে দেন। বলেন যে সামান্য সময়ের জন্য তাদেরকে জন্ম নিতে হবে, কিন্তু যে আপ যে চুরি করেছিল তাকে দীর্ঘ জীবন পৃথিবীতে কাটাতে হবে। অষ্টবসু তখব গঙ্গাদেবীকে গিয়ে বলেন যে আমরা শাপগ্রস্ত হয়েছি; এখন আপনি যদি দয়া করে পৃথিবীতে কোন রাজাকে বিবাহ করেন তাহলে আপনার গর্ভে জন্ম নিয়ে আমরা শাপমুক্ত হতে পারি। গঙ্গাদেবী রাজি হন, এবং চন্দ্রবংশীয় রাজা শান্তনুকে বিবাহ করেন।
৪. লোক—ব্রহ্মাণ্ডে মোট ১৪টি লোক রয়েছে। পৃথিবী হচ্ছে ভূলোক। এর উপরে রয়েছে ভূবর্লোক বা অন্তরীক্ষ। তার উপরে স্বর্লোক। এর উপরে একে একে রয়েছে মহর্লোক, জনলোক, তপলোক, এবং সবার উপরে সত্যলোক (বিষ্ণুপুরাণে বিশদে বিবরণ রয়েছে)। জনলোক, তপলোক ও সত্যলোককে মিলিত ভাবে বলা হয় ব্রহ্মলোক। ভূলোক থেকে সত্যলোক পর্যন্ত এই সাতটি লোক হল দেবলোক। স্বর্লোক থেকে সত্যলোক পর্যন্ত এই পাঁচটি হল স্বর্গলোক। সত্যলোকের উপরে আছে দেবী ভগবতীর বাসস্থান মণিদ্বীপ (দেবীভাগবতপুরাণে বিশদে বিবরণ রয়েছে); যা ১৪ লোকের হিসেবের বাইরে। ভূলোকের নীচে রয়েছে পাতাললোক। সপ্তপাতাল অর্থাৎ সাতটি পাতাললোক রয়েছে। সেগুলি হল অতল, বিতল, সুতল, তলাতল, মহাতল, রসাতল এবং সবার নীচে পাতাল (ভাগবতপুরাণে বিশদে বিবরণ রয়েছে)। পাতালের নীচে রয়েছে সহস্রমস্তক বিশিষ্ট মহাসর্প অনন্ত বা আদিশেষ। স্বর্গলোক, ভূলোক বা পৃথিবী বা মর্ত্য এবং পাতাললোক এই তিনকে একত্রে বলা হয় ত্রৈলোক্য বা ত্রিলোক।
৫. গণ—শিবের অনুচর। রুদ্র স্বয়ং এদেরকে সৃষ্টি করেছিলেন নিজের রূপের অনুরূপে। এদের মাথায় জটা, তাতে শোভা পায় অর্দ্ধচন্দ্র, গ্রীবা নীল বর্ণের। এরা ত্রিনয়ন বিশিষ্ট। এরা সংখ্যায় কোটি কোটি। বিভিন্ন দলপতির অধীনে এরা থাকে। যেমন শঙ্খকর্ণের অধীনে ১ কোটি গণ রয়েছে। কেকরাক্ষের অধীনে রয়েছে ১০ কোটি। বিকৃতের অধীনে গণের সংখ্যা ৮ কোটি। এরকম আরো অনেক গণাধিপতি রয়েছে, যাদের অধীনে কোটি কোটি গণ রয়েছে। এরা অত্যন্ত শক্তিশালী, অদম্য সাহসী, ধ্বংসের মূর্ত প্রতীক। সতীর মৃত্যুর পর দক্ষযজ্ঞ নষ্ট করার জন্য মহাদেব এদেরকেই পাঠিয়েছিলেন বীরভদ্রের নেতৃত্বে। এরা সমস্ত দেবতাদের পরাজিত করেছিল এবং বীরভদ্র দক্ষের মাথা কেটে ফেলেছিল। শিবপুরাণে এদের সম্বন্ধে বিশদে বলা আছে।
৬. ত্রিবিধ দুঃখ—সাংখ্য শাস্ত্র অনুসারে এই সংসার দুঃখময়; ত্রিবিধ দুঃখের অভিঘাত মানুষকে পেতে হয়। এই তিন প্রকার দুঃখ হল—আধ্যাত্মিক দুঃখ, আধিভৌতিক দুঃখ এবং আধিদৈবিক দুঃখ। আধ্যাত্মিক দুঃখ অর্থাৎ নিজের শরীর ও মন থেকে জাত দুঃখ। যেমন শরীর খারাপ হওয়া বা অসুখ, মন খারাপ হওয়া বা শোক পাওয়া। আধিভৌতিক দুঃখ অর্থাৎ অন্য বস্তু বা জীব থেকে প্রাপ্ত দুঃখ যেমন ছুরিতে হাত কেটে যাওয়া বা অস্ত্রের আঘাত পাওয়া, শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হওয়া, কোন জীব দ্বারা আক্রান্ত হওয়া—কুকুরের কামড় বা সাপের কামড় খাওয়া ইত্যাদি। আধিদৈবিক দুঃখ অর্থাৎ দৈব দুর্বিপাক যেমন বন্যা, ভূমিকম্প ইত্যাদি থেকে জাত দুঃখ। এই ত্রিবিধ দুঃখ থেকে শান্তি কামনায় তিনবার শান্তি বলা হয়, অর্থাৎ শান্তি, শান্তি, শান্তি।