টিলার ওপর সোনার খাঁচা

টিলার ওপর সোনার খাঁচা 

“পাহাড়ে শান্তি চাই’। মরিচা পড়া এই সাইনবোর্ডটার পাশ দিয়ে সরু পাহাড়ি রাস্তা চলে গিয়েছে। পাহাড়ে যে শান্তি এসেছে, এই মরিচা পড়া সাইনবোর্ডটাই তার প্রমাণ। সত্তরের দশকে এখানে খুব বাজে ধরণের একটা বিদ্রোহ হয়েছিল। সত্তরের দশকের আগে এদিকে টি এস্টেট, বোটানিক্যাল গার্ডেন থাকলেও এখন এদিকে আর মানুষের বসতি নেই। তাই অশান্তিও নেই। যেখানেই মানুষ সেখানেই অশান্তি। 

রাস্তার দুইদিকেই ঘন বন। আকাশমডু গাছের পাতাগুলো নরম রোদ পাহাড়ি রাস্তায় ছায়া ফেলেছে। মাঝে মাঝে বাতাস দিচ্ছে। সেই বাতাস বনের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়ার সময় অপার্থিব এক রকমের শব্দ করছে। সেই শব্দ শুনলে গায়ে কাঁটা দেয়। হঠাৎ হঠাৎ টিয়া পাখির তীক্ষ্ণ ডাক শোনা যায়। ডাহুকের মন খারাপ করা উঁহু উঁহু ডাকও কানে আসে। পাহাড়ি বনে সাধারণত জলাশয় থাকে না। তাহলে ডাহুক ডাকে কোথা থেকে? আসলে ওটা বানরের ডাক। 

কিছুক্ষণ এই ডাকাডাকি। তারপর সব নিশ্চুপ। 

নির্জনতা ভেঙে একটা কালো ল্যান্ডরোভার সাইনবোর্ডটা পেছনে ফেলে চলে যায়। 

“এই যে বনটা দেখছেন না এর একটা নাম আছে। জানেন?” বশির বললেন। তার হাত স্টিয়ারিং-এ। শংকর তার পাশের সিটেই বসে আছেন। তার দৃষ্টি বাইরে। বশির জামানের কথা তিনি শুনেছেন কিনা বোঝা গেল না। 

বশির জামান উত্তরের অপেক্ষা না করেই বললেন, “এইটা মানুষখেকো বন। লোকজন এই বনের ভেতরে গেলে আর ফিরে আসে না। গন ওয়ান্স এন্ড ফর অল।”

শংকর বাইরে থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই বললেন, “কিভাবে জানলেন?”

“জেনারেল একদিন গল্প করছিলেন। সত্তরের বিদ্রোহের সময় উনি এইদিকেই থাকতেন।” 

“জেনারেল মকবুল বাশার?” 

“হ্যাঁ।” 

“কি বলেছিলেন?” 

“প্রায়ই এই জঙ্গলে বিদ্রোহীরা গা ঢাকা দিত। বিশেষ করে সন্ধ্যা হওয়ার পর পরই ওরা জঙ্গলের ভেতর ঢুকে পড়ত। এটা ওদের এলাকা। গা ঢাকা দেওয়া ওদের জন্য সহজ। সরকারি বাহিনী অন্ধকারে আর বনের ভেতর ঢোকার সাহস করত না। সকাল পর্যন্ত পুরো বনটা ঘিরে রাখত। কিন্তু সকালবেলা কাউকে বনের ভেতর থেকে বের হতে দেখা যেত না। বেলা একটু বাড়লে সরকারি বাহিনী বনের ভেতরে যেত বটে। কিন্তু কোন মানুষের চিহ্ন পেতো না। যেন বনের ভেতরে কেউ ঢোকেইনি।” 

“হুম। বুঝলাম।” 

শংকরকে মানুষখেকো বন সম্পর্কের খুব একটা আগ্রহী বলে মনে হল না। তার চোখে মুখে ক্লান্তি আর চাপা বিরক্তি। 

বশির কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, “আপনার কি মনে হয়? সত্যিই বনটা মানুষ খেয়ে ফেলত?” 

“বনে মানুষ খেতে পারলে লোকে এইখান থেকে গাছ কেটে বন সাবাড় করতে পারত না।” 

“জেনারেল কি তাহলে বানিয়ে গল্প বলল নাকি?” 

শংকর কোন উত্তর দিলেন না। বশির ফ্যাসফ্যাসে গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, “আর কতদূর?” 

শংকর হাত ঘড়ি দেখে বললেন, “এই তো চলেই এসেছি প্রায়। আর দশ মিনিটের মতো।” 

দশ মিনিট পরে শংকর ঘুমিয়ে গেলেন। জেলখানা সম্পর্কে বশির জামানও আর প্রশ্ন করলেন না। নীরবে গাড়ি চালাতে লাগলেন। রাস্তার দুই পাশের বড় বড় গাছপালা কমতে শুরু করল। ছোট ছোট গাছ আর বাশের ঝাড় দেখা গেল। রাস্তাও খারাপ হতে শুরু করল। সেই রাস্তা আস্তে আস্তে ওপর দিকে ঢালু হতে শুরু করলে বোঝা গেল, সামনে পাহাড়। ফোর হুইলারটা পাহাড়ের গা ঘেঁষে যেতে থাকল। ঝকঝকে রোদ ঢাকা পড়ল মেঘে। পাহাড়ের ঠিক নিচে আসার পরে আকাশ মেঘলা হয়ে গেল। মনে হল যেন বিকেল হয়ে গিয়েছে। রাস্তাও খানিকটা ভেজা ভেজা। উইন্ডশিল্ডে ঝাঁঝরির মত পানি জমতে শুরু করল। তারপর শুরু হল গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। বশির জামান গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে দিলেন। ভেজা রাস্তায় পড়া আকাশের ছায়া মাড়িয়ে ল্যান্ডরোভারটা সামনে যেতে থাকল। 

উইন্ডশিন্ডে ওয়াইপারের চাপা শব্দ শুনেই শংকরের ঘুম ভাঙল। নড়ে চড়ে বসতে বসতে বললেন, “সামনে বামে একটা ঢালু রাস্তা চলে গিয়েছে। ওইটা।” 

পাহাড় পেছনে ফেলে আসতেই বৃষ্টি থেমে গেল। কিন্তু আকাশ তখনও মেঘলা। সামনে কিছুদূর গিয়েই বাম দিকে একটা মাটির রাস্তা নিচের দিকে ঢালু হয়ে নেমে গিয়েছে। ল্যান্ডরোভারটা ঢালু রাস্তাটা বেয়ে নিচে নামতে শুরু করল। তারপর বড় বড় ঘাসে ঘেরা সমতলভূমি। তার ভেতর এলোমেলোভাবে দাঁড়িয়ে থাকা আকাশ ছোঁয়া গগনশিরিষ গাছ। গাছের ঘনত্ব এখানে কম। 

শংকর একটা গগনশিরিষ গাছের কাছে গাড়ি রাখতে বললেন। এখান থেকে আর গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে না। জেলখানায় যাওয়ার কোন রাস্তা নেই। পায়ে চলা পথও নেই। যেতে হলে ঝোপ জঙ্গল মাড়িয়ে যেতে হবে। 

শংকর আর বশির গাড়ি থেকে নামলেন। মেঘলা আকাশ আর ভ্যাপসা গরম। এদিকে বৃষ্টি হয়নি বলে মনে হল। শংকর বশির জামানকে বললেন, “স্যুট খুলে রাখেন, হাঁটতে হবে।” 

বশির জামান পরণের নেভি-ব্লু স্যুটটা খুলে রাখলেন। তার কোমরের হোলস্টারে রাখা .৪৪ ম্যাগনামের ছোট্ট রোগার আলাস্কান রিভলভারটা চোখ এড়ালো না শংকরের। এই জিনিস এদেশের কারও কাছে থাকার কথা না। শংকর নিজের সরকারি রিভলভারটায় একবার হাত বুলিয়ে নিলেন। সুযোগ আসবে। শংকর জানেন। একটা সুযোগ খুব তাড়াতাড়িই আসবে। কোনভাবে এই টেকোটাকে সরিয়ে দিতে পারলেই শংকর প্রধানমন্ত্রীর কাছে সব ফাঁস করে দেবেন। তিনি সরকারি লোক। দেশের মানুষের সাথে তিনি বেঈমানী করতে পারেন না। শংকর লম্বা একটা শ্বাস নিলেন। 

গাড়ি লক করে বশির সাদা শার্টের আস্তিন গুটিয়ে নিতে নিতে বললেন, “চলেন।” 

বড় বড় ঘাস মাড়িয়ে হাঁটা শুরু করলেন দুইজন। সামনে বশির, পেছনে শংকর। শংকর বললেন, “সোজা গেলেই একটা প্রাচীরে ঘেরা বড় বাড়ি দেখতে পাবেন। ওটাই জেলখানা। সত্তরের বিদ্রোহের সময় ওটা চা বাগানের অফিস ছিল। চা বাগানের শ্রমিকরাই বিদ্রোহের সময় চা-বাগানে আগুন লাগিয়ে দেয়। বাড়িটাও পুড়ে যায়। পরে সংস্কার করে এখন জেলখানা বানানো হয়েছে।” 

বশির সামনের ঘাসগুলো সরাতে সরাতে বললেন, “আপনি এর আগে এসেছেন এদিকে?” 

“হ্যাঁ। একবার।” 

বশির জামান আর কিছু বললেন না। শংকর বশিরের কাছ থেকে আরও প্রশ্ন আশা করছিলেন। কিন্তু শংকর জানেন না, এটা একটা মানসিক চাল। নীরব স্রোতার সামনে মানুষ নিজের অজান্তেই বেশি কথা বলে ফেলে। শংকরও তাই করলেন। বললেন, “প্রধানমন্ত্রী স্যারের সাথে এসেছিলাম। গত পার্টির নির্বাচনের দুই মাস আগে। হেলিকপ্টারে এসেছিলাম। কপ্টার ছাড়া জেলখানায় যাওয়ার আর কোন উপায় নেই।” 

তারপর আবার নীরবতা। বশির আর শংকর বড় বড় ঘাসগুলো পেরিয়ে সামনে এগোচ্ছেন। কিন্তু কারও কোন কথা নেই। 

এই নীরবতা শংকরের ভালো লাগল না। নীরবতা ভাঙতেই তিনি আবার ফাঁদে পা দিলেন। বললেন, “অথরাইজেশান ছাড়া গার্ডরা দেখা মাত্রই গুলি করবে বশির সাহেব। এখানে শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী বাদে সবার অথরাইজেশান লাগে। শুধু শুধু রিস্ক নিয়ে লাভ আছে?” 

বশির জামান এই প্রথম কথা বললেন, “সে নিয়ে ভাবতে হবে না। আপনি শুধু চিনিয়ে দিন।” 

সময়ের সাথে সাথে শংকরের হৃৎস্পন্দন বাড়ছে। আর একটু সামনে এগোলেই এই টেকোটাকে সরিয়ে দেওয়ার সুযোগ আসবে। আর শংকর সেই সুযোগটা কাজে লাগাবেন। তার হাতে সময় থাকবে শুধু একটা সেকেন্ড। এই সেকেন্ডে তাকে যা করার করতে হবে। ভুল করার সুযোগ নেই। 

বড় বড় ঘাস পেরিয়ে সামনে যাওয়া আস্তে আস্তে কঠিন হয়ে গেল। ঘাসগুলো ধারালো। চামড়ায় লাগলে ছিলে যাচ্ছে। পায়ের নিচে মুচড়ে যাওয়া ঘাসগুলো থেকে এক রকমের গন্ধ বের হয়েছে। ঘাসের ভেতরে অবিরাম ঝিঁঝিঁর ডাক। ভ্যাপসা গরম। উঁচু গাছ নেই বলে বাতাসও কম। মাঝে মাঝে মেঘ সরে গিয়ে রোদ উকি দিলে সেই রোদও সোজা এসে গায়ে লাগছে। কিছুক্ষণের ভেতরেই দুইজনই ঘেমে গোসল হয়ে গেলেন। 

বশির বললেন, “চীনের প্রাচীর দেখেছেন কখনও শংকর সাহেব?” 

“দেখেছি। টিভিতে দেখেছি।” 

“চীনের প্রাচীর বানানো হয়েছিল মঙ্গলদের আগ্রাসন থেকে বাঁচার জন্য। তাছাড়া খুচরো যাযাবরদের অত্যাচার তো ছিলই। চীনের প্রথম সম্রাট কিন শি হুয়াং এই প্রাচীর বানিয়ে মনে করলেন চীনকে তিনি অসভ্য যাযাবরদের হাত থেকে রক্ষা করে ফেলেছেন। চীনরা আবার প্রাচীর ট্রাচীর তুলতে খুব ওস্তাদ। ১৯৭১ সালের আগ পর্যন্ত ওরা বাইরের দেশের সাথে খুব কমই মিশেছে। এই প্রাচীর তোলার পরেও দেখা গেল প্রায়ই মঙ্গলরা চীনের ভেতর ঢুকে পড়ছে। একবার তো স্বয়ং চেঙ্গিস খানই প্রায় ঢুকে পড়েছিলেন চীনের ভেতরে। তো……”

“সাপটাপ থাকতে পারে। পায়ের দিকে তাকিয়ে হাঁটবেন।” 

“তো তাহলে বলেন তো, কেন বারবার যাযাবররা প্রাচীর টপকে শহরের ভেতরে ঢুকে পড়তে পারত? আপনার কি মনে হয়?” 

শংকর সাহেবের উত্তর দেওয়ার মত কোন লক্ষণ দেখা গেল না। তার ভীষণ বিরক্ত লাগছে। এমনিতে গরম। তার ওপরে সামনে কি ঘটতে চলেছে সে বিষয়েও কোন ধারনা নেই। আর এই টেকো বকবক করেই যাচ্ছে। 

আস্তে আস্তে রাস্তা আরও দুর্গম হতে শুরু করল। চারপাশে এত বড়বড় ঘাস যে দুহাতেও আর সরানো যায় না। শংকর সাহেবের হাতের ছিলে যাওয়া জায়গাগুলো ঘামে ভিজে জ্বালা করতে শুরু করেছে। 

এভাবে আরও পনের মিনিট হাঁটার পর আস্তে আস্তে ঘাস কমে যেতে শুরু করল। এর মানে সামনেই সেই জায়গাটা। শংকর শিকারী বাঘের মত অপেক্ষা করতে লাগলেন। বশির জামান কয়েক পা এগিয়েই একটা জায়গায় গিয়ে থেমে গেলেন। সামনে একটা শুকনো জমি। ঘাস প্রায় নেই বললেই চলে। বশির জামান কি যেন ভাবলেন। শংকরের বুকের ভেতরে হৃৎপিণ্ডটা ধড়াস ধড়াস করতে লাগল। 

ফিরোজ বললেন, “শংকর সাহেব। এইটা কি দেখেন তো?” 

শংকর সাহেবের হৃৎস্পন্দন থেমে গেল যেন। উনার ডান হাতটা চলে যাচ্ছিলো হোলস্টারের দিকে। অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করলেন। স্বাভাবিকভাবে সামনে এগিয়ে গেলেন। আর তখনই বশির জামান তাকে ধাক্কা দিয়ে সামনে ফেলে দিলেন। শংকর মুখ থুবড়ে শক্ত মাটির ওপরে পড়ে গেলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই পেছনে রিভলভারের সেফটি ক্যাচ খোলার শব্দ শুনলেন। 

“আপনি জানতেন এখানে একটা মাইন ফিল্ড আছে?” বশির বাম হাতে রোগার আলাস্কানটা ধরে শংকরকে প্রশ্ন করলেন। রোগারের মাজল শংকরের দিকে তাক করা। শংকর ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দাঁড়ালেন। ভেতরে ভেতরে অনেক অবাক হলেও বশিরের প্রশ্নের উত্তর দিলেন না তিনি। টেকোটা কিভাবে বুঝে গেল যে এটা একটা মাইন ফিল্ড? শংকর এক দৃষ্টিতে বশিরের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তার থেকে মাত্র পাঁচ ফুট দুরে দাঁড়িয়ে থাকা এই মানুষটার হাতেই তার জীবন মরণ নির্ভর করছে। 

শংকর আরও প্রশ্ন আশা করছিলেন। কিন্তু বশির জামান কোন প্রশ্ন করলেন না। শুধু বললেন, “আপনার পিস্তলটা দেন।” 

শংকর যতটা সম্ভব শীতল গলায় বললেন, “এটা দেওয়া যাবে না। সরকারি লাইসেন্স করা পিস্তল।” 

“কথা না বাড়িয়ে ওটা দিয়ে দেন। এই মুহূর্ত থেকে ওটা আপনার বোঝা বাড়াবে। ওটা দিয়ে দেন। হালকা বোধ করবেন।”

শংকর কাঁপা হাতে পিস্তলটা বশিরের দিকে ছুঁড়ে দিলেন। সত্যি সত্যিই তার হালকা লাগতে শুরু করল। কিন্তু একটা অদ্ভুত একটা ভয় তাকে জড়িয়ে ধরল। বশির জামান শংকরের রিভলরটা নিজের হোলস্টারে রাখতে রাখতে বললেন, “হাঁটেন।” 

রিভলভারহীন শংকরের নিজেকে অনেক বেশি অসহায় মনে হল। একটা সাফাই গাইতে গিয়ে শংকর ঢোঁক গিলে মিথ্যা বললেন, “আমি জানতাম না যে এখানে একটা মাইন ফিল্ড আছে।” 

বশির জামান বললেন, “মাইন ফিল্ডের মাটি বিষাক্ত হয়ে যায়। ফসফরাস, মানে গান পাউডারের বিষক্রিয়া। তাই এখানে ঘাস কম। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে এটা একটা মাইন ফিল্ড। আপনি ভুল লোকের কাছে সঠিক চালটা চেলেছেন। শুধু শুধু সময় নষ্ট হচ্ছে শংকর সাহেব, হাঁটেন। এখনও যে আমি আপনাকে আপনি আপনি করছি, এটা আপনার সৌভাগ্য। আপনার এখনকার প্রতিটা নিঃশ্বাসের দাম আপনাকে দিতে হবে।” 

শংকর যেন নিজেকে নিজেই সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “আমার কিছু হয়ে গেলে আপনি জেলখানাটা চিনতে পারবেন না। আর গুলির শব্দ শুনে জেলখানার গার্ডরা গন্ধ শুঁকে শুঁকে এখানে চলে আসবে।” 

“গার্ডরা গন্ধ শুঁকে শুঁকে চলে আসলে আমার জন্যই ভালো শংকর বাবু। শিকারী কুকুরই শিকারের কাছে শিকারীকে নিয়ে যায়। আমিও গার্ডদেরকে অনুসরণ করে জেলখানাটা চিনে নেব। আপনি কি সামনে এগোবেন? “ 

শংকর এক মুহূর্ত কি যেন চিন্তা করলেন। তারপর সামনে তাকালেন। সামনের কয়েক গজের ভেতরে ছড়িয়ে আছে মৃত্যু। একবার সুতপার কথা মনে হল শংকর সাহেবের। তারপর মাথা নিচু করে হাঁটা শুরু করলেন। সুযোগ হাত ছাড়া হয়ে গিয়েছে। 

এবার সামনে শংকর, পেছনে বশির। পায়ের নিচে অনিশ্চয়তার জালে বোনা মৃত্যু মঞ্চ। বশির জামান বললেন, “আপনি সবই বলেছেন, শুধু বিদ্রোহীদের বানানো এই মাইন ফিন্ডের কথাটা বাদ দিয়ে গিয়েছেন। সত্তরের দশকে এই মাইন ফিল্ড বিদ্রোহীরা বানালেও এখন এটা জেলখানার সুরক্ষা রেখা হিসাবে ব্যবহার করা হয়।” 

শংকর কিছুই বললেন না। ফসকে যাওয়া সুযোগের জন্য নিজের ওপর খুব রাগ হল শংকরের। তখনই যদি হোলস্টার থেকে রিভলভারটা বের করে বশিরের খুলি উড়িয়ে দিতেন। বড় ভুল হয়েছে। এখন বড় মাশুল গুনতে হবে। 

এক একটা পদক্ষেপ যেন এক একটা জীবন। একটু ভুল, আর শংকর ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবেন। তীব্র রোদে তার কাঁধ পিঠ পুড়ে যাচ্ছে। পেছনে বশিরের পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। শংকর যেখানে যেখানে পা রাখছে বশির জামানও সেখানে সেখানেই পা রাখছেন। সময় যেন এই মাইনফিল্ডের ওপরে এসে থেমে গিয়েছে। এভাবে কতক্ষণ কেটেছে শংকরের খেয়াল নেই। পায়ের দিকে অখণ্ড মনযোগ তাকে ভেতর থেকে নিঃশেষিত করে ফেলতে লাগল যেন। বেঁচে থাকার মাদকতা প্রতি পদক্ষেপে বাড়তে লাগল তার। 

একটা সময় আবার বড় বড় ঘাস দেখা গেল। শেষ হল মাইন ফিল্ডের দুঃস্বপ্ন। চোখে পড়ল একটা টিলা। আর টিলার ওপরে সেই জেলখানা। শংকর দাঁড়িয়ে পড়লেন। শার্টের আস্তিন দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, “এটাই।” 

বশির জামান কোন কথা বললেন না। উঁচু প্রাচীর ঘেরা ভাঙ্গা বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। টিলার আশেপাশে কোন গাছ নেই। ইচ্ছে করেই সব কেটে ফেলা হয়েছে। কোন ঝোপ জঙ্গলও নেই জেলখানার আশেপাশে। 

শংকর হাঁটু মুড়ে বসে পড়লেন। জন্তুর মত হাঁপাতে লাগলেন। বশির জামানকে শূন্য দৃষ্টিতে জেলখানার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাঁপাতে হাঁপাতেই বললেন, “বলেছিলাম। বিশ্বাস হয়নি। এটা অভেদ্য দুর্গ বশির সাহেব। এটা সাধারণ জেলখানা না। টিলার আশেপাশে উঠতে গেলেই গুলি চালাবে গার্ডরা।” 

বশির জামান শংকরের কথা গুরুত্ব দিলেন কিনা বোঝা গেল না। তিনি পকেট থেকে সাদা রঙের ছোট্ট একটা যন্ত্র বের করে যন্ত্রটার বোতাম টিপতে শুরু করলেন। বশিরের মুখ দেখে বোঝা গেল না তার প্রতিক্রিয়া কি। কিন্তু এই বশির জামানের প্রতিক্রিয়াহীন চাহনিই শংকরকে পৈশাচিক আনন্দ দিল। টেকোটা নিরুপায় হয়ে এখন ‘মোবাইল’ টিপছে। তিনি মনের বিষাক্ত ভালোলাগা মিশিয়ে কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু হঠাৎ দমকা পাহাড়ী বাতাস দিল। শংকর ভীষণ ক্লান্তি বোধ করলেন। শরীরটাকে টেনে নিয়ে গেলেন একটা গগনশিরিষ গাছের নিচে। গাছের নিচটায় ঠেশ দিয়ে বসে পুরো শরীরটাকে ছেড়ে দিলেন। সূর্যটা মেঘে ঢেকে গেল। বশির জামান তখনও অভিব্যক্তিহীনতার সাথে দূরের জেলখানার দিকে তাকিয়ে আছেন। বামহাতে এখনও ঝুলছে রোগার আলাস্কান। 

সময় কেটে যাচ্ছে। 

পাহাড়ি পাখির ডাক আর পাহাড়ি বাতাসের সেই রহস্যময় শব্দ। এছাড়া আর কোন শব্দ নেই। শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক হতেই শংকর বললেন, “দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই বশির সাহেব। চলেন ফিরে যাই। অথরাইজেশান ছাড়া কিছু হবে না। সোজা প…।” 

শংকরের কথা শেষ হল না। হঠাৎ বিকট শব্দে একটা বিস্ফোরণ হল। শংকর চমকে মাটিতে শুয়ে পড়ে মাটি খামচে ধরলেন। কেঁপে উঠল মাটি। পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে সেই শব্দ যেন কয়েকগুন বেড়ে গেল। মনে হল যেন কয়েকটা বজ্রপাত একসাথে হল। দুরের পাহাড়ি বন থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ে গেল। কিছুক্ষন চাপা গুম গুম কয়েকটা শব্দ হল। পুরো জেলখানাটা একটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হল একমুহূর্তে। 

শংকর বিস্ফোরিত চোখে দেখতে পেলেন, টিলার ওপর দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। কালো ধোঁয়ায় টিলার অর্ধেকটা ঢেকে গিয়েছে। সেখান থেকে ভেসে আসছে চাপা গুলির আওয়াজ। টরর টরর… টর টর। বশির জামান তখনও প্রতিক্রিয়াহীন। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *