টিরা গ্রহের ভয়ঙ্কর

টিরা গ্রহের ভয়ঙ্কর

এক : প্রথম দুর্ঘটনা

অ `ন্ধকার মহাকাশে মিটমিট করে জ্বলছে অসংখ্য নক্ষত্র। যেন দেওয়ালির | উৎসব শুরু হয়েছে চারিদিকে। মহাকাশযান ‘সোলার’ ছুটে চলেছে .অন্ধকারের বুক চিরে। লক্ষ্য পৃথিবীর কক্ষপথ। সুদীর্ঘ অভিযান শেষ করে সোলার ঘরে ফিরে চলেছে।

অশোক চিরিমার নেভিগেশান প্যানেলের দিকে তাকিয়ে বসে ছিল। মুখচোখ ফ্যাকাশে। মহাকাশ-মানচিত্র খুঁটিয়ে দেখতে চেষ্টা করছে ও। হঠাৎই ওর গোটা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল। শরীরে কেমন একটা অস্বস্তি। বুকের ভেতরটা যেন মোচড় দিয়ে উঠছে।

ঠিক তখনই লম্বা-চওড়া চেহারার আর-একজন মানুষ নেভিগেশান রুমের খাটো দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। অশোক চিরিমারের পিঠে আলতো থাপ্পড় মেরে হেসে বলল, ‘যাক, শেষপর্যন্ত তাহলে বাড়ি ফেরা হচ্ছে! ওই কাঠখোট্টা রুক্ষ গ্রহে দু-মাস কাটিয়ে আমার মেজাজটাই কাঠখোট্টা হয়ে যাচ্ছিল।’

কথা বলতে-বলতে নেভিগেশান প্যানেলের টিভি-পরদায় চোখ রাখল ধনপত রাই। পরদায় একটা উজ্জ্বল লাল ফুটকি। পৃথিবী! সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে পুরু প্লাস্টিকের স্বচ্ছ আবরণ দেওয়া জানলার দিকে তাকাল ধনপত রাই। অন্ধকার মহাকাশে অসংখ্য তারার ফুটকি জ্বলছে।

‘ঘরে ফেরার এত আনন্দ জানতাম না।’ ধনপত রাই বলল। তারপর অশোকের পাশে ঝুঁকে পড়ে জিগ্যেস করল, ‘চিরিমার, তোমার আনন্দ হচ্ছে না?’ অশোক ফ্যাকাশে বিবর্ণ মুখে ধনপতের দিকে দেখল : ‘আনন্দ হচ্ছে— তবে শরীরটা ভীষণ খারাপ লাগছে— ‘

সঙ্গে-সঙ্গেই একটা ঝটকা মেরে উঠল অশোকের শরীর। চোখ বিস্ফারিত। ঘন-ঘন শ্বাস পড়ছে। ও ঝুঁকে পড়ল নেভিগেশান প্যানেলের ওপরে।

ধনপত রাই ওকে চেপে ধরল দু-হাতে। উত্তেজিত স্বরে বলল, ‘চিরিমার, কী হয়েছে! শরীর কেমন লাগছে?’

অতিকষ্টে ফিশফিশ করে জবাব দিল অশোক, ‘রাই, শিগগির ডক্টর শ্রীবাস্তবকে খবর দাও। আমার বুকের ভেতরে খুব কষ্ট হচ্ছে। যন্ত্রণায় মাথা ছিঁড়ে পড়ছে। শিগগির আবার ঝাঁকুনি খেল অশোকের দেহ। প্যানেলের ওপরে ওর হাতের বাঁধন শিথিল হল। অশোক হুমড়ি খেয়ে পড়ল নেভিগেশান রুমের মেঝেতে।

ধনপত রাই তৎপর ভঙ্গিতে ওকে ধরতে চেষ্টা করল। চিত করে শুইয়ে দিল। জরুরি স্বরে বলল, ‘ঘাবড়ানোর কিছু নেই, চিরিমার, এক্ষুনি ডক্টর শ্রীবাস্তবকে খবর দিচ্ছি।’

কিন্তু ততক্ষণে অশোক চিরিমারের দেহ যন্ত্রণায় বেঁকে গেছে। কাশির দমকে মুখ লাল, দম আটকে চোখজোড়া ঠেলে বেরিয়ে আসছে, মুখের রং নীল। তীব্র আক্ষেপে শরীরটা ঝাঁকুনি খেতে-খেতে হঠাৎই স্থির হয়ে গেল। সব শেষ।

ধনপত রাই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেল নেভিগেশান প্যানেলের শেষ প্রান্তে। এক ঝটকায় তুলে নিল টেলিফোনের রিসিভার। দ্রুত হাতে ডায়াল ঘুরিয়ে ব্যস্ত গলায় বলে উঠল, ‘সেন্ট্রাল কন্ট্রোল? নেভিগেশান রুম থেকে বলছি! শিগগিরই ডক্টর শ্রীবাস্তবকে এখানে পাঠিয়ে দিন। মনে হচ্ছে…।’

‘কী মনে হচ্ছে?’ ও-প্রান্ত থেকে উৎকণ্ঠিত প্রশ্ন ভেসে এল।

‘মনে হচ্ছে…’ মেঝেতে পড়ে থাকা নিথর নিস্পন্দ দেহটার দিকে ভয়ার্তভাবে একবার দেখল ধনপত রাই। তারপর বলল, ‘মনে হচ্ছে নেভিগেশান রুম সুপারভাইজার অশোক চিরিমার এইমাত্র মারা গেছে।’

দুই : সন্দেহের সূত্রপাত

নিউম্যাটিক রিল্যাক্সার-এ আধশোয়া ভঙ্গিতে বসেছিলেন ডক্টর মোহন শ্রীবাস্তব। পলিথিনের ব্যাগে বাতাস ঠেসে তৈরি বিচিত্র এই নিউম্যাটিক রিল্যাক্সার—আধুনিক আরামকেদারা। হেলান দিয়ে বসলেই চোখে ঘুমের আমেজ জড়িয়ে আসে। কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে, ডক্টর শ্রীবাস্তবের চোখে ঘুমের আমেজ নেই, বরং দুশ্চিন্তায় মাথাটা ভার হয়ে আছে। সামনে পা ছড়িয়ে থমথমে মুখে তিনি তাকিয়ে আছেন অবজারভেশান পোর্টের স্বচ্ছ আবরণ ভেদ করে বাইরের অন্ধকারের দিকে। অভিব্যক্তিহীন শূন্য দৃষ্টি। মাথার চুল এলোমেলো। ডান হাতের সরু-সরু আঙুলের ফাঁকে ধরা একগোছা কাগজ। সোলার মহাকাশযানে উপস্থিত একাশি জন অভিযাত্রীর মেডিক্যাল রিপোর্ট। একটু আগেই কম্পিউটার রুম থেকে রিপোর্টগুলো তাঁর হাতে এসেছে। রিপোর্টগুলো দেখার পরই ভীষণ ক্লান্ত লাগছে, একা লাগছে, আর ভয় করছে।

ডক্টর শ্রীবাস্তব রিল্যাক্সার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। মাথার অগোছালো চুলে হাত চালিয়ে পায়চারি করতে লাগলেন। তাঁর দশাসই লম্বা কাঠামো সামান্য ঝুঁকে পড়েছে। শক্ত চোয়ালের ওপর খোঁচা খোঁচা দাড়ি। সরু গোঁফ। মাথার সামনের দিকে চুল পাতলা হয়ে কপাল অনেকটা বড়। কপালে একটা নীল শিরা দপদপ করছে। দুশ্চিন্তার স্পষ্ট ইশারা।

ডক্টর শ্রীবাস্তব ধীরে-ধীরে কথা বলেন, মার্জিত তাঁর আচরণ, সকলের সঙ্গে মানিয়ে চলতে চেষ্টা করেন, সবসময় সকলের শরীর-স্বাস্থ্যের খোঁজখবর করেন, বুদ্ধি খুব তীক্ষ্ণ না হলেও তিনি পরিশ্রমী, কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্পর্কে বেশি সচেতন। হয়তো এই কারণেই ‘টিরা’ গ্রহের দীর্ঘ অভিযানে বিশজন চিকিৎসকের মধ্যে থেকে তাঁকে বেছে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাঁর অতিরিক্ত দায়িত্বজ্ঞানের জন্য সঙ্গী অভিযাত্রীরা তাঁকে ঠাট্টাও করে। বলে, ‘ডক্টর, আপনি বড় বেশি ডাক্তারি করেন।’

ডক্টর শ্রীবাস্তব হেসে উড়িয়ে দেন সে-কথা। তিনি জানেন, এইসব গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে সাবধান হওয়াটা কত জরুরি। আর সাবধান ছিলেন বলেই না মেডিক্যাল রিপোর্টের মারাত্মক গরমিলটা তাঁর নজরে পড়েছে। এর আগে তিন-তিনটে গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে মেডিক্যাল চেকআপে ঢিলেমির জন্যে পৃথিবীতে ফিরে আসা মহাকাশযানে গ্রহান্তরের মারাত্মক জীবাণুর সন্ধান পাওয়া গেছে।

টিরা গ্রহের অভিযান ব্যর্থ হয়েছে। শুধু ব্যর্থ বললে অনেক কমই বলা হয়। সৌরজগৎ থেকে ৮.২৬ আলোকবর্ষ দূরের তারা ম্যাক্সিমা সেন্টরি। আধুনিকতম মহাকাশযান সোলার হাইপারস্পেসের মধ্যে দিয়ে স্পেস জাম্প করে অনেক কম সময়ে অতিক্রম করেছে ৮.২৬ আলোকবর্ষের সুবিশাল দূরত্ব। পৃথিবীর অভিযাত্রী দল সেখানে পৃথিবীর হিসেবে প্রায় দু-মাস সময় কাটিয়েছে। তন্নতন্ন করে অভিযান চালিয়েছে টিরা গ্রহের রুক্ষ জমিতে। কিন্তু সমস্ত পরিশ্রমই ব্যর্থ হয়েছে। টিরা সম্পর্কে মানুষের এত আশা ছিল, এত উত্তেজনা ছিল, অথচ শেষপর্যন্ত নিট ফল হল শূন্য। শুরু থেকে শেষপর্যন্ত শুধুই হতাশা। এই অভিযানের ফলাফলে কোনও কৃতিত্ব নেই, কোনও যশ নেই, কোনও আবিষ্কার নেই, কিচ্ছু নেই।

অন্তত একঘণ্টা পর্যন্ত ফলাফল সেইরকমই ছিল। কারণ তখনও মেডিক্যাল রিপোর্টগুলো মোহন শ্রীবাস্তবের হাতে আসেনি, সেগুলো পরীক্ষা করে দেখা হয়নি। কিন্তু রিপোর্টগুলো খুঁটিয়ে স্টাডি করার পর অবয়বহীন বিকৃত এক আতঙ্ক জমাট বেঁধেছে ডক্টর শ্রীবাস্তবের মনে।

পায়চারি থামিয়ে বাইরে করিডরে এলেন। আঁধারি করিডরের শেষে ক্যাপ্টেন মিত্রের কেবিন। কেবিনের খাটো দরজার ওপরেই একটা ছোট্ট আলো জ্বলছে। ক্যাপ্টেন মিত্র ঘরেই আছেন তা হলে! দৃঢ় পায়ে সেদিকে এগোলেন ডক্টর। কলিংবেলে চাপ দিলেন। ক্যাপ্টেন কি বিশ্বাস করবেন তাঁর কথা? বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, আর কোনও পথ খোলা নেই মোহন শ্রীবাস্তবের সামনে।

ডক্টর শ্রীবাস্তব ঘরে ঢুকতেই ক্যাপ্টেন নীতীশ মিত্র ঘুরে তাকালেন। হেসে বললেন, ‘আসুন ডক্টর, কী খবর বলুন—’

মোহন শ্রীবাস্তব ক্যাপ্টেনের টেবিলের কাছে এগিয়ে গেলেন। ক্যাপ্টেনের পাশে একটা রিল্যাক্সার টেনে নিয়ে বসলেন। বললেন, ‘খবর খারাপ, ক্যাপ্টেন। একটা বিপদের আঁচ পেয়েছি আমি—।’

‘বিপদ! কীসের বিপদ?’ হালকা মেজাজে হাসলেন নীতীশ মিত্র, ‘এই নিষ্ফলা অভিযানে বিপদটা আসবে কোত্থেকে?’

‘তা জানি না, তবে এসেছে।’ গম্ভীরভাবে বললেন শ্রীবাস্তব, ‘আমাদের মহাকাশযানে একজন বিচিত্র মানুষ রয়েছে, ক্যাপ্টেন।’

ক্যাপ্টেন মিত্রের হালকা হাসি মিলিয়ে গেল : ‘বিচিত্র মানুষ!’

‘বিচিত্র শুধু নয়, অবিশ্বাস্য। মানুষটা দিব্যি হেঁটে-চলে বেড়াচ্ছে, সুস্থ, জোয়ান——অথচ তার মরে যাওয়ার কথা।’

‘মরে যাওয়ার কথা!’ অবাক বিস্ময়ে ডক্টর শ্রীবাস্তবকে দেখলেন ক্যাপ্টেন, ‘আপনি একজন ডাক্তার হয়ে এসব কী বলছেন!’

মেডিক্যাল রিপোর্টের কম্পিউটার আউটপুটগুলো ক্যাপ্টেনের দিকে এগিয়ে দিলেন মোহন শ্রীবাস্তব : ‘এই মেডিক্যাল রিপোর্টগুলো একবার দেখুন। আপনি তো জানেন, টিরা থেকে রওনা হওয়ার পরদিনই আমি প্রত্যেকের থরো মেডিক্যাল চেকআপের নির্দেশ দিয়েছিলাম। তাতে সোলার-এর একাশি জন যাত্রীর প্রত্যেককে মেডিক্যাল বোর্ডের মুখোমুখি হতে হয়েছে—আপনি আমি কেউই বাদ যাইনি। কোনও অভিযান থেকে ফেরার পর এটাই সাধারণ নিয়ম—অভিযাত্রী দলের কেউ যে কোনও জীবাণু বা অন্য কিছু থেকে ইনফেক্টেড হয়নি সে-সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্যেই এত নিয়ম-কানুন।’ একটু থেমে ডক্টর শ্রীবাস্তব যোগ করলেন, ‘মেডিক্যাল চেকআপের যে-রিপোর্ট পাওয়া গেছে তা ভারি অদ্ভুত— ‘

ক্যাপ্টেন মিত্র একটা সিগারেট ধরালেন। তাঁর মুখে দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগের রেখা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছিল।

ডক্টর বলে চললেন, ‘একাশি জনের মধ্যে আশি জনের কোনও গোলমাল নেই। তারা সসম্মানে পাশ করেছে পরীক্ষায়। কিন্তু একজন—’ কথা থামিয়ে সেই বিশেষ রিপোর্টটি বের করলেন তিনি: ‘এ-মানুষটির সবকিছুই স্বাভাবিক—ব্লাড কাউন্ট, ক্লোরাইড, ক্যালসিয়াম, অ্যালবুমিন – গ্লোবিউলিন রেশন, সবকিছু। কিন্তু ব্লাড সুগার পরীক্ষা করে আমরা হোঁচট খেলাম—’ সামনে পা ছড়িয়ে দিলেন ডক্টর। মেঝের দিকে তাকালেন। কিছুক্ষণ পরে মুখ তুলে নীতীশ মিত্রের চোখে সরাসরি চোখ রেখে বললেন, ‘এই লোকটার বডিতে ব্লাড সুগারের কোনও নামগন্ধ নেই! ব্লাড সুগার জিরো।’

ক্যাপ্টেন মিত্রের মুখ কঠিন হল, চোখ বিস্ফারিত অবিশ্বাসে : ‘কী বলছেন, ডক্টর! আমি ডাক্তার নই, তবে আমিও জানি যে ব্লাড সুগার ছাড়া কোনও মানুষ—।’

‘বাঁচতে পারে না।’ ক্যাপ্টেনের কথা কেড়ে নিয়ে শেষ করলেন শ্রীবাস্তব। তারপর মাথা নাড়লেন সম্মতি জানিয়ে : ‘ঠিকই বলেছেন আপনি। তবে এখানেই শেষ নয়—আরও আছে। ব্লাড সুগারের কোনও হদিস না পেয়ে আমরা ব্লাড ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা করে দেখলাম। ক্রিয়েটিনিন তৈরি হয় শরীরের প্রোটিন ভেঙে। কিডনি এটাকে চটপট ছেঁকে বের করে দেয় রক্ত থেকে, আর ক্রিয়েটিনিন শরীর থেকে বেরিয়ে আসে ইউরিনের সঙ্গে। ক্রিয়েটিনিন ছেঁকে রক্ত থেকে বের করে না দিতে পারলে বিপদ নেমে আসে খুব তাড়াতাড়ি। একশো সিসি রক্তে সাধারণত ক্রিয়েটিনিন থাকে এক থেকে চার মিলিগ্রাম। এর পরিমাণ দশ মিলিগ্রামের ওপরে গেলেই রোগীর পক্ষে তা মারাত্মক। কখনও যদি এটা কুড়ি-পঁচিশের ওপরে চলে যায় তা হলে ডায়ালিসিস ছাড়া রোগীকে বাঁচানো অসম্ভব। ক্রিয়েটিনিন ভ্যালু কুড়ি-পঁচিশের কাছাকাছি নিয়ে কোনও মানুষ সুস্থভাবে হাঁটা-চলা তো দূরের কথা, বেঁচে থাকতেই পারে না। অথচ—’ এক মুহূর্ত থামলেন মোহন শ্রীবাস্তব। কপালের কাল্পনিক ঘাম মুছলেন ঃ ‘পরীক্ষায় এই লোকটার ক্রিয়েটিনিন ভ্যালু বেরিয়েছে একশো পঁয়তিরিশ!’

অপলকে ডক্টর শ্রীবাস্তবের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন ক্যাপ্টেন মিত্র। তারপর মেডিক্যাল রিপোর্টগুলো নিয়ে টেবিলে ঝুঁকে পড়লেন। চুপচাপ সেগুলো উলটেপালটে দেখতে থাকলেন।

দেখা শেষ হলে অনেকটা আপনমনেই বললেন, ‘স্যাম্পল নেওয়ার সময় যদি কোনও ভুল হয়ে থাকে…অথবা ল্যাবরেটরির টেস্টে যদি কোনও বাজে কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়ে থাকে…।’ আচমকা মুখ তুলে শ্রীবাস্তবের দিকে তাকালেন। বেশ জোরের সঙ্গেই বললেন, ‘…তা ছাড়া, কম্পিউটারও তো ক্যালকুলেশনে ভুল করতে পারে—মানে, প্রোগ্রামে যদি কোনও গোলমাল হয়ে গিয়ে থাকে।’

মোহন শ্রীবাস্তব হেসে ফেললেন : ‘ক্যাপ্টেন, পরিষ্কার বুঝতে পারছি আপনার সন্দেহগুলো আপনার নিজের কানেই বেসুরো ঠেকছে। তবুও বলি, না, আপনি যেরকম ভাবছেন সেরকম কোনও গোলমাল হয়নি। আমার মেডিক্যাল রিপোর্টগুলো হান্ড্রেড পার্সেন্ট কারেক্ট।’ একটু থেমে আবার বললেন, ‘ওই বিচিত্র মানুষটির ব্লাড সুগার ও ক্রিয়েটিনিন ভ্যালু পাওয়ার পর আমি তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম। সে হাসিমুখে ল্যাবরেটরিতে এসে হাজির। সুস্থ-সবল চেহারা, অসুস্থতার ছায়া পর্যন্ত নেই। আমি আবার তার শরীর থেকে রক্ত নিলাম। তারপর অ্যানালিসিস করলাম আমি নিজেই। দ্বিতীয়বারে যে-রিপোর্ট পেলাম তাতে আবার দুশ্চিন্তা কমে না গিয়ে উলটে বেড়ে গেল। কারণ দ্বিতীয়বারের রক্ত একেবারে স্বাভাবিক- হাত বাড়িয়ে একটা মেডিক্যাল রিপোর্ট দেখিয়ে দিলেন শ্রীবাস্তব, ‘এই যে, দু-বারের রিপোর্টই এতে আছে।’ “

ক্যাপ্টেনের আঙুল কেঁপে উঠল। অস্বাভাবিক গলায় তিনি বললেন, ‘কোনও মানুষের রক্তের কেমিক্যাল কম্পোজিশন কি এভাবে নিজে থেকে পালটে যেতে পারে—এরকম আচমকা?’

‘না, পারে না। কাকতালীয়, দুর্ঘটনা, যা-ই বলুন না কেন, কোনওমতেই এটা সম্ভব নয়। অথচ এক্ষেত্রে তাই ঘটেছে। দু-বার রক্ত নেওয়ার মধ্যে সময়ের ব্যবধান ছিল মাত্র কুড়ি ঘণ্টা। না, স্যাম্পল ওলটপালট হয়নি। কারণ প্রত্যেক স্যাম্পল-এর সঙ্গে ছিল নির্দিষ্ট নম্বর এবং যার স্যাম্পল তার আঙুলের ছাপ। আমরা সেগুলো চেক করে দেখেছি। একই লোকের শিরা থেকে দুটো ব্লাড স্যাম্পল নেওয়া হয়েছে।’

টেবিলে রাখা ইন্টারকম টেলিফোন বেজে উঠল। নীতীশ মিত্র রিসিভার তুললেন। ও-প্রান্তের ধাতব স্বর ব্যস্তভাবে কী সব বলল। নীতীশ জবাব দিলেন, ‘ঠিক আছে, এক্ষুনি যাচ্ছি।’

রিসিভার নামিয়ে রেখে ঝটিতি ঘুরলেন ডক্টরের দিকে : ‘ডক্টর শ্রীবাস্ত নেভিগেশান রুমে আরও বড় বিপদ হয়েছে। সুপারভাইজার অশোক চিরিমার এইমাত্র মারা গেছে!’

তিন : ভয়ঙ্করের সূচনা

মানুষটার দেহে প্রাণ নেই।

মোহন শ্রীবাস্তব মৃতদেহের পাশ থেকে উঠে দাঁড়ালেন। মাথার চুলে আঙুল চালিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর ধনপত রাইয়ের বাহুতে হাত রেখে বললেন, ‘ধনপত, তোমার কিছু করার ছিল না। তুমি ফোনে খবর দেওয়ার আগেই অশোক মারা গেছে।’

দীর্ঘকায় স্বাস্থ্যবান ধনপতের চুল উসকোখুসকো, চোখ লালচে, ডানহাত মুঠো, করছে আর খুলছে। রুদ্ধস্বরে ধনপত বলল, ‘আজ সকালবেলা ওকে দারুণ মেজাজে দেখেছি। সারাদিন ধরে আমার সঙ্গে কাজ করেছে, একটিবারের জন্যেও মনে হয়নি ও অসুস্থ। হঠাৎই কী করে যে এমনটা হল..…!’

দু-পকেটে হাত ঢুকিয়ে ক্যাপ্টেন বললেন, ‘কী মনে হচ্ছে, ডক্টর?’

ইশারায় ধনপতকে নেভিগেশান রুমের বাইরে যেতে নির্দেশ দিলেন মোহন শ্রীবাস্তব। তারপর ঘুরে দাঁড়ালেন ক্যাপ্টেনের মুখোমুখি। বললেন, ‘অশোক চিরিমারের ব্লাড টেস্ট না করে আমি কিছু বলতে চাই না।’

দুজনেই চুপচাপ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে। চোখে-চোখে অনেক কথাই যেন হয়ে গেল। অবশেষে ডাক্তারি ব্যাগ খুলে সিরিঞ্জ বের করলেন শ্রীবাস্তব। অ্যালকোহল দিয়ে সিরিঞ্জ পরিষ্কার করে ঝুঁকে পড়লেন অশোকের মৃতদেহের ওপর।

ক্যাপ্টেন মিত্র দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন। শ্রীবাস্তবের চোয়ালের রেখা কঠিন। সেখানে দৃঢ় প্রতিজ্ঞার ছাপ এঁকে দিয়েছে কেউ।

কাজ শেষ করে মোহন শ্রীবাস্তব উঠে দাঁড়ালেন। বললেন ‘ক্যাপ্টেন, দশ মিনিটের মধ্যে টেস্ট রিপোর্ট নিয়ে আমি আপনার ঘরে হাজির হচ্ছি।’

দুজনেই বেরিয়ে এলেন নেভিগেশান রুমের বাইরে। ধনপত করিডরের একপাশে দাঁড়িয়েছিল। ক্যাপ্টেন বললেন, ‘রাই, এখন থেকে তুমি হলে নেভিগেশান রুম সুপারভাইজার।’

‘থ্যাঙ্ক য়ু, ক্যাপ্টেন।’ ধনপত কাছে এগিয়ে এল।

‘“সাব জিরো” রুমে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। তুমি একটু হেল্প কোরো।’ ‘ওকে ক্যাপ্টেন।’ ধনপত রাই নেভিগেশান রুমে ঢুকে পড়ল।

উইশ য়ু লাক।’ একটু থেমে আবার বললেন নীতীশ, ‘চিরিমারের বডিটা আবছায়া করিডর ধরে ওঁরা দুজনে ফিরে চললেন। মোহন শ্রীবাস্তবের মুখে

নতুন আশঙ্কার ছাপ বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

পনেরো মিনিট পরে ক্যাপ্টেনের ঘরে আশঙ্কা পরিণত হল আতঙ্কে। ‘ব্লাড সুগার জিরো, ক্রিয়েটিনিন লেভেল একশো তিরিশের বেশি, আর এন পি এন একশো পঞ্চাশ!’ অবসন্ন সুরে উচ্চারণ করলেন ডক্টর শ্রীবাস্তব, ‘অশোক চিরিমারের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব ছিল না।’

‘এন পি এন…’ ক্যাপ্টেন একটু অবাক হয়ে তাকালেন।

‘নন-প্রোটিনাস নাইট্রোজেন। ক্রিয়েটিনিনের সঙ্গেই তৈরি হয়। নরমাল লেভেল প্রতি একশো সি সি রক্তে আট থেকে দশ মিলিগ্রাম। ক্রিয়েটিনিন বাড়লে এন পি এন-ও বাড়ে। পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার জন্যে এন পি এন-টাও চেক করেছি. কিন্তু বুঝতে পারছি না…।’

ডক্টরকে বাধা দিয়ে নীতীশ মিত্র বলে উঠলেন, ‘তা হলে অশোক চিরিমারই সেই বিচিত্র মানুষ! কিন্তু আপনি না বললেন তার রক্ত আবার স্বাভাবিক হয়ে গেছে?’

শ্রীবাস্তব দু-হাতের আঙুলে জট পাকালেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘সেটাই তো অবাক কাণ্ড, ক্যাপ্টেন! আমি যার কথা বলেছিলাম সে অশোক চিরিমার নয়।’

নীতীশ মিত্র স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কয়েক মুহূর্ত পরে অস্ফুটে বললেন, ‘অশোক চিরিমার নয়!…তা হলে কে সে?’

‘কমল সেনগুপ্ত। প্রেসার চেম্বারের মেইনটিনান্সে আছে। চিরিমারের রিপোর্ট এর আগে পুরোপুরি নরমাল ছিল।’

‘ডক্টর, কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। আমাদের স্টেরিলাইজেশানকে ফাঁকি দিয়ে কোনও জীবাণু হয়তো পৃথিবী থেকেই ঢুকে পড়েছে মহাকাশযানের ভেতরে—।’

‘অসম্ভব! অবাস্তব!’ উত্তেজিত স্বরে বলে উঠলেন ডক্টর, রিল্যাক্সার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন : ‘মহাকাশযান থেকে টিরার মাটিতে পা দেওয়ার আগে প্রত্যেকটি অভিযাত্রীর মেডিক্যাল চেকআপ করা হয়েছে। তখন কোনও গোলমাল ধরা পড়েনি। পৃথিবীর আবহাওয়ার সঙ্গে টিরার মিল থাকায় কোনওরকম স্পেস স্যুট ছাড়াই আমাদের লোকজন টিরা গ্রহের বুকে ঘুরে বেড়িয়েছে। দু-মাস ধরে তারা নানা অভিযান চালিয়েছে। তারপর যখন তারা মহাকাশযানে ফিরে আসে তখন ডিসইনফেক্ট করার জন্য প্রত্যেককে আলট্রাভায়োলেট রেডিয়েশানের মধ্যে দিয়ে পাঠানো হয় সোলার-এর ভেতরে। তখন তো রোগজীবাণুর হদিস আমরা পাইনি! দু-মাসেও কারও কোনও রোগ হয়নি, অথচ এখন হঠাৎ—’ ক্যাপ্টেনের খুব কাছে মুখ এনে শ্রীবাস্তব প্রশ্ন করলেন, ‘এটাকে আপনার কি কোনও রোগ বলে মনে হচ্ছে, ক্যাপ্টেন?’

নীতীশ সামান্য শিউরে উঠলেন। বাতানুকূল পরিবেশে তাঁর শীত-শীত করতে লাগল। তিনি চেষ্টা করে যুক্তি খুঁজে পেতে চাইলেন : ‘ডক্টর—বহু স্পেসশিপকে আমি রোগের কবলে পড়তে দেখেছি। যেমন গত মাসে টাইটান উপগ্রহ থেকে যে স্পেসশিপটা ফিরে আসে তাতে প্লেগ-এর মারাত্মক জীবাণু পাওয়া গিয়েছিল। কোনও উপায় না দেখে শেষপর্যন্ত মহাকাশযানটিকে জ্বালিয়ে দিতে হয়। ওই জীবাণু প্রতিটি যাত্রীর ফুসফুস অ্যাটাক করেছিল—এবং মাত্র ছ’ঘণ্টার মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা মহাকাশযানে। অতএব, আবারও ভেবে দেখুন, ডক্টর—।’

মোহন শ্রীবাস্তব কোনও কথাই শুনছিলেন না। চোখ বন্ধ করে রিল্যাক্সারে হেলান দিয়ে কী একটা বিষয় মনে করার চেষ্টা করছিলেন। খুব কাছাকাছি এসেও ব্যাপারটা তাঁর মনের পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। অশোক…অশোক চিরিমার..অশোক চিরিমার…মনে পড়েছে!

রিল্যাক্সার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন শ্রীবাস্তব। লম্বা কাঠামো ঋজু করে নিশ্চিত পদক্ষেপে এগিয়ে গেলেন দেওয়ালে আঁটা একটা ক্যাবিনেটের দিকে। মহাকাশযানের যাবতীয় মেডিক্যাল রিপোর্ট থাকে ক্যাপ্টেনের ঘরে, এই ক্যাবিনেটে।

‘উইথ ইয়োর কাইন্ড পারমিশান, ক্যাপ্টেন—’ বলে ক্যাবিনেট খুললেন। নতুন-পুরোনো নানা কম্পিউটার প্রিন্টআউট নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করলেন। কতকগুলো রিপোর্ট বেছে নিয়ে সেগুলো মিলিয়ে দেখলেন। বারবার চেক করলেন। তারপর থমথমে কালো মুখে ক্যাপ্টেনের দিকে ফিরে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘আমি জিতেছি, ক্যাপ্টেন—তবে না জিতলেই বোধহয় ভালো হত…।’

নীতীশ মিত্র অবাক জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে রইলেন শ্রীবাস্তবের দিকে।

রিপোর্টগুলো আবার ক্যাবিনেটে ঢুকিয়ে রেখে মোহন শ্রীবাস্তব ক্যাপ্টেনের কাছে এসে দাঁড়ালেন। স্পষ্ট উচ্চারণে বললেন, ‘অশোক চিরিমার একবারের জন্যেও টিরার বুকে পা দেয়নি! গত দু-মাসের ওপর ও সোলারের সিক রুমে ছিল। টিরা থেকে রওনা হওয়ার দুদিন পরে ও সেরে ওঠে। গতকাল ওকে আমি লাস্ট ইঞ্জেকশান দিয়েছি। অর্থাৎ, যখন আমরা সবাই টিরার জমি চষে বেড়াচ্ছি তখন ও ছিল বিছানাবন্দি। ওর ইনফেক্শাস মনোনিউক্লিওসিস হয়েছিল। একবারের জন্যেও অশোক চিরিমার মহাকাশযান ছেড়ে মাটিতে নামেনি।’

ক্যাপ্টেন মিত্রের চোখে-মুখে দিশেহারা উৎকণ্ঠা। পরাজিত কোণঠাসা মানুষের মতো নিরুপায় সুরে তিনি বললেন, ‘এসবের কারণ কী? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না, ডক্টর!

রিল্যাক্সারে আবার বসলেন শ্রীবাস্তব। তারপর বললেন, ‘মনে হয় আমি বুঝতে পেরেছি। টিরা গ্রহের কোনও অদ্ভুত অজ্ঞাত প্রাণী আমাদের কয়েকজন অভিযাত্রীর দেহে ঢুকে পড়েছে!’

চার : অনুমান, আলোচনা, সিদ্ধান্ত

অতিকায় মহাকাশযান সোলার ছুটে চলেছে মহাশূন্যের শরীর ভেদ করে। পৃথিবীর হিসেবমতো চতুর্থ রাত শুরু হয়েছে। পঞ্চম দিনের শুরুতেই সোলার স্পেস জাম্প দেবে হাইপারস্পেসের মধ্যে দিয়ে। সুতরাং মহাকাশযান পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ সব কাজ সাময়িকভাবে শেষ করে নীতিশ মিত্র এসেছেন শ্রীবাস্তবের কেবিনে। দুজনের আলোচনা চলছিল। একসময় আলোচনায় ছেদ টেনে কফি তৈরি করতে উঠলেন ডক্টর শ্রীবাস্তব। কেবিনের একপাশে টেবিলে বসানো মাইক্রোওয়েভ কুকারে কফি তৈরি করে কাপে ঢাললেন। একটা কাপ এগিয়ে দিলেন ক্যাপ্টেনের দিকে, অন্যটায় নিজে চুমুক দিলেন।

ক্যাপ্টেন মিত্র পায়চারি করছিলেন। কফির কাপ নিয়ে একটা রিল্যাক্সারে শরীর এলিয়ে বসলেন। তাঁর চোখে-মুখে স্পষ্ট উত্তেজনার ছাপ।

মোহন শ্রীবাস্তব নরম সুরে বললেন, ‘কুল ডাউন, ক্যাপ্টেন, উত্তেজিত হবেন না।

কফিতে চুমুক দিয়ে নীতীশ মিত্র জবাব দিলেন, ‘উত্তেজিত না হয়ে উপায় কী! এই মহাকাশযানের প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব আমার—আমি এই স্পেসশিপের ক্যাপ্টেন। এমনিতেই আমাদের টিরা অভিযান সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। দেশের মানুষের কোটি-কোটি টাকা খরচ করে শূন্য হাতে আমি ঘরে ফিরছি। টিরাতে কোনওরকম প্রাণের সন্ধান আমরা পাইনি, কোনও উদ্ভিদ সেখানে নেই, দামি খনিজ পদার্থের টিকিও দেখা যায়নি। তবুও আমরা প্রাণপণ খেটেছি। স্যাম্পল নিয়েছি পাথরের, মাটির, বাতাসের। ফটো তুলেছি, রিপোর্ট লিখেছি, তারপর কাগজপত্র গুটিয়ে রওনা হয়েছি বাড়ির দিকে। এ যেন পরীক্ষায় ফেল করে মার্কশিট হাতে নিয়ে বাড়ি ফেরার মতো।…আর এখন, বাড়ি ফেরার পথে রওনা হওয়ার তিনদিন পর আপনি আমাকে ভয়ঙ্কর কথাগুলো শোনালেন। টিরার অদ্ভুত অজ্ঞাত প্রাণী!’ কফির কাপ টেবিলে নামিয়ে গলার স্বর স্বাভাবিক করে বললেন, ‘বিশ্বাস হতে চায় না, অথচ অশোক চিরিমার যে মারা গেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আর ওই বিচিত্র মেডিক্যাল রিপোর্টগুলোকেও তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না!’

রিল্যাক্সার টেনে নিয়ে ক্যাপ্টেনের মুখোমুখি বসলেন ডক্টর শ্রীবাস্তব : ‘ক্যাপ্টেন, একটা ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ। অশোক চিরিমার আর কমল সেনগুপ্তের শরীরে যে-অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখা গেছে তা কোনও মানুষের শরীরে হওয়া অসম্ভব। আমাদের বড়ির মেটাবলিজ্‌ম্ নানান অবস্থার মধ্যে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়। কিন্তু কতকগুলো জিনিস আছে যা হিউম্যান মেটাবলিজ্‌ম্‌এর পক্ষে অসম্ভব ঃ যেমন, জিরো ব্লাড শুগার, একশো তিরিশের ওপর ক্রিয়েটিনিন আর এন পি এন ভ্যালু, অথচ মানুষটা বেঁচে আছে!’

‘হতে তো পারে টিরা গ্রহের কোনও-কোনও রোগজীবাণু—।’

‘না, হতে পারে না!’ এক ঝটকায় মোহন শ্রীবাস্তব সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। কফি চলকে পড়ল তাঁর হাতে ধরা কাপ থেকে : ‘কতবার একই কথা আপনাকে বলতে হবে, ক্যাপ্টেন? এটা নতুন কোনও রোগজীবাণুর ব্যাপার নয়, এটা সম্পূর্ণ অসম্ভব একটা ঘটনা। হিউম্যান মেটাবলিক সিস্টেমে এ-ধরনের ঘটনা কোনওদিন ঘটতে পারে না, পারে না, পারে না!’

নীতীশ মিত্রের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। কফির কাপ টেবিলে রেখে আবার রিল্যাক্সারে বসলেন শ্রীবাস্তব। তাঁর হাত কাঁপছে থরথর করে। কাঁপছে কপালের নীল শিরা।

অনেকক্ষণ দুজনে চুপ করে রইলেন। তারপর ইতস্তত করে নীচু গলায় ক্যাপ্টেন বললেন, ‘টির৷ গ্রহে কোনও প্রাণের সন্ধান তো আমরা পাইনি, ডক্টর।’ ‘না, পাইনি। আর কেন পাইনি তারও একটা ব্যাখ্যা আমি অনুমানে খাড়া করেছি।’ ডক্টর শ্রীবাস্তব সশব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন : “টিরাকে আমরা যেরকম প্রাণহীন ভেবেছি সেরকম যদি না হয়, ক্যাপ্টেন? হ্যাঁ, আপনি হয়তো বলবেন পাগলের কল্পনা, কিন্তু তবুও ধরে নিন টিরা গ্রহে প্রাণ ছিল—চালাক, বুদ্ধিমান, চিন্তাশীল এবং শক্তিশালী প্রাণ। আমরা যখন টিরা গ্রহে নেমেছি তখন ওরা হয়তো তৈরি ছিল—হয়তো ওরা আগে থেকেই টের পেয়েছিল আমরা টিরায় ল্যান্ড করতে চলেছি। তারপর থেকে সর্বক্ষণ ওরা আমাদের চোখে-চোখে রেখেছে। আমাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অভিযান, খোঁজাখুঁজি যখন চলছিল তখন ওরা সবসময়েই ছিল আমাদের সঙ্গে, তবে অলক্ষ্যে, গোপনে। হয়তো ওরা আমাদের দেখা দিতে চায়নি, অন্য কোনও উদ্দেশ্য ছিল ওদের। যদি এমন হয়, টিরার যেসব অংশে আমরা অভিযান চালিয়েছি সেগুলো আমাদের জন্যে আগেভাবেই তৈরি করে রাখা হয়েছিল। ওরাই তৈরি করে রেখেছিল যাতে আমরা কিছু দেখতে না পাই, কিছু খুঁজে না পাই, কিছু জানতে না পারি টিরা সম্পর্কে, এবং ব্যর্থ হয়ে খালি হাতে ফিরে যাই পৃথিবীতে—যেমন খালি হাতে আমরা রওনা হয়েছিলাম পৃথিবী থেকে।’

সামনে ঝুঁকে এলেন ডক্টর শ্রীবাস্তব। দু-হাত নেড়ে জোর দিয়ে নিজের বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন : ‘এবারে তর্কের খাতিরে ধরে নিন, টিরার প্রাণীদের আমাদের মতো নির্দিষ্ট কোনও চেহারা নেই। হয়তো ওরা নিছকই এক ধরনের জেলির মতো প্রোটোপ্লাজম—যে-কোনও ধরনের অবস্থার সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারে। হয়তো খুশিমতো ওরা যে-কোনও জিনিসকে নকল করতে পারে। এইরকম নকল কোনও চেহারা নিয়েই ওরা হয়তো আমাদেরই নাকের ডগায় বসে আমাদের প্রতিটি কার্যকলাপের ওপরে নজর রাখছিল। কে বলতে পারে, ওরা হয়তো পাথর, বালি, কিংবা জল সেজে আমাদের দেখছিল। এমনকী—।’

‘এমনকী মানুষের চেহারাও নিয়ে থাকতে পারে!’ শ্রীবাস্তবের না-বলা কথাগুলোই উচ্চারণ করলেন ক্যাপ্টেন মিত্র। তাঁর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল বিশ্বাসঅবিশ্বাস সম্ভব-অসম্ভবের সীমারেখার বাইরে চলে গেছেন তিনি।

‘ঠিক বলেছেন, ক্যাপ্টেন।’ ডক্টর শ্রীবাস্তব সমর্থন করলেন নীতীশ মিত্রকে : ‘এবারে একটা প্রশ্ন করি আপনাকে। মনে করুন, টিরার প্রাণীরা আমাদের গ্রহ সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে চায়, আমাদের স্টাডি করে দেখতে চায়, পৃথিবীতে গিয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে চায় নিজেদের কৌতূহল মেটানোর জন্যে

তা হলে বলুন, কী করে এসব কাজ ওদের পক্ষে সহজে করা সম্ভব?’ নীতীশ মিত্র নিশ্চুপ। ডক্টর শ্রীবাস্তবের প্রশ্নের সুর শুনেই বোঝা যায় তার উত্তর সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা তাঁর মনে রয়েছে। অতএব দু-এক মুহূর্ত অপেক্ষা

করে উত্তরটা তিনিই দিলেন। ‘ক্যাপ্টেন, আমার অনুমান টিরার প্রাণীদের কেউ মানুষের চেহারা নিয়ে উঠে এসেছে আমাদের মহাকাশযানে। হয়তো টিরার পাথর-বালি ছড়ানো রুক্ষ প্রান্তরে ওরা খুন করেছে কমল সেনগুপ্তকে। তারপর তাকে নকল করে—চেহারায়, কথাবার্তায়, হাবভাবে, সবকিছুতে—ওদের একজন ঢুকে পড়েছে সোলারে। এই আশা নিয়ে ঢুকে পড়েছে যে, তাকে কমল সেনগুপ্ত মনে করে আমরা পৃথিবীতে নিয়ে যাব। কিন্তু ধরুন, নকল করতে গিয়ে কোথাও যদি গরমিল হয়ে গিয়ে থাকে! মানছি, ওই বিচিত্র প্রাণী কমলের স্মৃতি পর্যন্ত চুরি করেছে, নইলে আপনাকে বা আমাকে নকল কমল চিনতে পারল কেমন করে! কিন্তু তা সত্ত্বেও মানুষের শরীরে এমন কতকগুলো ব্যাপার আছে যা বিশেষজ্ঞ ছাড়া জানা সম্ভব নয়। অতএব সেই কারণেই নকল কমল জানতে পারেনি মানুষের রক্তের স্বাভাবিক রাসায়নিক গঠন কীরকম হয়। আর সেখানেই তার পা ফেলতে ভুল হয়েছে। নিজের আকৃতির পরিবর্তন ঘটিয়ে কমলকে নকল করতে প্রাণীটার সময় লেগেছে। বাইরের খোলসটা হুবহু নকল করে সে তাড়াহুড়ো করে সোলারে ঢুকে পড়েছে, কিন্তু তখন ভেতরটা পুরোপুরি বুঝে ওঠা হয়নি। সে পাগলের মতো তথ্য হাতড়ে চলেছে…দিশেহারা, বিভ্রান্ত…যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভেতরটা সঠিক নকল করা দরকার। ঠিক এইরকম বিপদগ্রস্ত অবস্থায় তার শরীর থেকে ব্লাড স্যাম্পল টানা হল। অতএব স্বাভাবিক কারণেই যে-‘রক্ত’ আমরা পেলাম তা ভুলভাল, গোলমেলে, অবাস্তব, অসম্ভব। প্রাণীটা কিন্তু বসে নেই। তার মন ও অনুভবের অদৃশ্য অ্যান্টেনা দিয়ে সে প্রতিমুহূর্তে তথ্য সংগ্রহ করে চলেছে সোলারের অন্যান্য অভিযাত্রীর কাছ থেকে, মহাকাশযানের নানান নথিপত্র থেকে—সকলের সম্পূর্ণ অজ্ঞাতে। এইভাবেই সে জানতে পারল মারাত্মক ভুলটা কোথায় হয়েছে। এও বুঝতে পারল ভুলটা মেডিক্যাল রিপোর্টে ধরা পড়েছে, এবং আমাদের চোখে পড়েছে। তখন আমাদের চোখে ধুলো দিতে, ভুল চাপা দিতে, সে খুন করল অশোক চিরিমারকে। তাকে নকল করল, তারপর মরে যাওয়ার ভান করল। ইচ্ছে করে রক্তে দেখিয়ে গেল ‘কমল সেনগুপ্তের’ মতো গোলমাল। এর কারণ, আমরা ভাবব কোনও রহস্যময় রোগের জীবাণু আমাদের মধ্যে সংক্রামিত হয়েছে। আর বাড়ি ফেরার পথে সারাটা সময় এই রহস্যের সমাধান খুঁজে খুঁজে হয়রান হবে আমাদের মস্তিষ্ক। কিন্তু কোনওমতেই সঠিক উত্তর খুঁজে পাবে না। আমার এই ধারণা যদি সত্যি হয়, ক্যাপ্টেন?’

ক্যাপ্টেন মিত্র হাতে হাত ঘষলেন। মাথা নীচু করে গম্ভীর স্বরে জবাব দিলেন, ‘যদি তাই হয় তা হলে কমল সেনগুপ্ত কমল সেনগুপ্ত নয়! অশোক চিরিমার অশোক চিরিমার ছিল না!’ আচমকা মুখ তুললেন তিনি  ‘কিন্তু প্রমাণ কই, ডক্টর, প্রমাণ কই? কী করে নিঃসন্দেহ হব আমরা?’

‘ভালো প্রশ্ন করেছেন।’ কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবলেন মোহন শ্রীবাস্তব। তারপর বললেন, ‘টিরার প্রাণীটি মানুষের দেহে ঢুকে পড়েছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চষে বেড়িয়েছে দেহের প্রতিটি স্নায়ু, প্রতিটি কোষ, রাসায়নিক গঠন, অনুপাত, মস্তিষ্কের প্রতিটি চিন্তার ছাপ। তারপর স-ব সে নকল করে ফেলেছে। এবং খুন করেছে মানুষটিকে। কমল সেনগুপ্তের রক্তাক্ত মৃতদেহ হয়তো পড়ে আছে টিরার কোনও খাদে। আর অশোক চিরিমারের মৃতদেহ সম্ভবত সোলারের ডিসপোজাল চেম্বার দিয়ে ছুড়ে দেওয়া হয়েছে মহাশূন্যে। এখন এই নকল মানুষটা সব দিক দিয়েই আসল মানুষটির মতো—অণু-পরমাণু পর্যন্ত নিখুঁত কপি করেছে ওরা। শুধু নকল দেহটার ভেতরে এককোণে রয়ে গেছে একটা শয়তান ভিনগ্রহের মন, শয়তানি মতলব নিয়ে শুধু ভাবছে…ওত পেতে রয়েছে।’ শ্রীবাস্তব মাথার চুলে আঙুল চালালেন। হাত ছড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে বললেন, ‘যত নিখুঁত নকলই ওরা করুক, ক্যাপ্টেন, হিউম্যান মেটাবলিক সিস্টেম এক বিচিত্র জিনিস—একমেবাদ্বিতীয়ম্। সেইখানেই ফাঁদ পাতব আমি। তবে গোপনীয়তার খাতিরে আমার মতলবটা এখনই আপনাকে খুলে বলতে পারছি না। কারণ, নিজেকে ছাড়া আমি এখন আর কাউকে বিশ্বাস করি না!’

দুজনে পরস্পরের চোখে চোখ রাখলেন। মোহন শ্রীবাস্তবকে শ্রান্ত দেখাচ্ছে। ইঞ্জিনের চাপা গুনগুন শব্দ কেবিনের নিস্তব্ধতাকেও আরও প্রকট করে তুলেছে। ক্যাপ্টেন মিত্রের হাত ঘামছে। সোলারের একাশি জন মানুষ—নাকি ঊনআশি জন?… শুধু তাই নয়, টিরার ভয়ঙ্কর প্রাণী যদি একবার পৃথিবীতে পৌঁছোয় তা হলে গোটা মানবজাতির সর্বনাশ নেমে আসবে। ডক্টরকে সে-কথাই জিগ্যেস করলেন তিনি।

‘প্রাণীটার উদ্দেশ্য কোনওরকমে একবার পৃথিবীতে পৌঁছোনো, তাই না?? ‘হ্যাঁ—ভয়ঙ্কর মনে হলেও কথাটা সত্যি।’

মহাশূন্যে উড়িয়ে দিই?’ উত্তেজনায় দপদপ করছে নীতীশ মিত্রের মুখ।

‘যদি আমরা এক্সপ্লোসিভ দিয়ে সোলারকে

‘তাই দেব—যদি না ফাঁদ পেতে ধরতে পারি।’

‘আমাদের হাতে সময় বেশি নেই, ডক্টর—’।

‘জানি। সোলারকে বিস্ফোরণে উড়িয়ে দিলে এতগুলো মানুষের প্রাণ যাবে, তা ছাড়া, ধুলো হয়ে যাবে কোটি-কোটি টাকার এই মহাকাশযান। সুতরাং শেষ চেষ্টা আমি করবই, ক্যাপ্টেন। এ পর্যন্ত এমন কোনও জালিয়াতি বা নকলের কথা আমি শুনিনি যা ধরা পড়েনি। সুতরাং টিরার প্রাণীকেও ধরা পড়তেই হবে।

আমি হাতেনাতে প্রমাণ করে দেব যে-কমল সেনগুপ্ত আমাদের মহাকাশযানে এখন রয়েছে সে টিরার প্রাণী—একটা নকল পুতুল! এমন ফাঁদ পাতব যা আন্দাজ করা সেই ভয়ঙ্কর প্রাণীর কল্পনার বাইরে।

রিল্যাক্সার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন শ্রীবাস্তব : ‘খুব ঘুম পাচ্ছে, ক্যাপ্টেন। আপাতত গুড নাইট। একটা কথা, আমাদের আলোচনার ব্যাপারটা একটু গোপন থাকলে ভালো হয়—।’

শুভরাত্রি জানিয়ে নীতীশ মিত্র বেরিয়ে এলেন শ্রীবাস্তবের কেবিন থেকে। দুশ্চিন্তার ঢেউ ঘুরপাক খাচ্ছে মাথার ভেতরে। মাথা দপদপ করছে। তবুও কোথায় যেন একটা কৌতূহল খোঁচা মারছে : কী ফাঁদ পেতেছেন ডক্টর শ্রীবাস্তব? সেই ফাঁদে টিরা গ্রহের প্রাণী পা দেবে তো? কে জিতবে এই বুদ্ধির খেলায়?

পাঁচ : হার-জিত

মানুষটা বাঙ্কে শুয়ে ছিল। নিশ্চল। ঘুমন্ত। তার মাথার ভিতরে, নিমীলিত দু-চোখের পিছনে অন্য একটা মন নড়ে উঠল—পিছল সরীসৃপের মতো। তারপর চিন্তা ও অনুভূতির অদৃশ্য অ্যান্টেনা ছড়িয়ে দিয়ে আর-একটা মনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করল। ভিনগ্রহী দুটো শয়তান মন কথা বলতে লাগল। মহাকাশযানের দু-প্রান্তের দুটো কেবিনের মধ্যে যেন তৈরি হয়ে গেল অদৃশ্য টেলিফোন—যার অন্য নাম টেলিপ্যাথি। একটা মন নৃশংস, নিষ্ঠুর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আর অন্যজন ভয়ার্ত, সন্ত্রস্ত, দিশেহারা।

‘আমাদের ফিরে যেতে হবে। আমরা ধরা পড়ে গেছি। ডক্টর শ্রীবাস্তব আমাদের ধরে ফেলেছে…!’

‘কক্ষনো না!’ তীব্র স্বরে উত্তর দিল দ্বিতীয় মন।

‘এখনও ফিরে যাওয়ার সময় রয়েছে! সোলার স্পেস জাম্প দেওয়ার পর আমরা অনেক দূরে চলে যাব। তখন আর ফিরে যাওয়ার পথ থাকবে না।’ ‘ভীতু! বিশ্বাসঘাতক!’ দ্বিতীয় মন রাগে গর্জে উঠল। সরীসৃপের মতো কিলবিল করে ফুঁসতে লাগল : ‘এসব চিন্তা করার আগে তোমার মরে যাওয়া উচিত!’

‘কিন্তু আমাকে সন্দেহ করছে যে! …ডক্টর আমাকে ফাঁদে ফেলতে চাইছে। এত নিখুঁতভাবে নকল করেছি যে, কোথাও কোনও গরমিল নেই, অথচ…ডক্টর মনে-মনে কী মতলব ফেঁদেছে কে জানে…।’

ঘৃণা মেশানো শাসনের সুর ভেসে উঠল নীরব কণ্ঠে : ‘ডক্টর শ্রীবাস্তব একটা গর্দভ, বুন্ধু! ও কিছুতেই আমাদের ধরতে পারবে না।’

‘কিন্তু আমাকে যে কোণঠাসা করতে চাইছে!’ আতঙ্ক আরও গাঢ় হয়েছে, তীব্র হয়েছে প্রথম মনে : ‘ডক্টরের মতলব আমি আঁচ করতে পারছি না। জানি না নকল করতে গিয়ে কোথাও কোনও ভুল করে ফেলেছি কি না—’

মনঃসংযোগে শোনা গেল নিষ্ঠুর ব্যঙ্গের হাসি : ‘ডক্টর আমাকে সন্দেহ করে না—বরং বিশ্বাস করে। ভয় পেয়ো না। ডক্টর শ্রীবাস্তব একটা আস্ত বোকা। আর কয়েকদিনের মধ্যেই ওরা পৃথিবীতে নামবে। সেখানে এরকম কত তাজা মানুষ রয়েছে একবার ভাবো তো! সেখানে আমরা দিব্যি লুকিয়ে কাজ সারতে পারব—’ নির্লজ্জ প্রত্যাশায় যেন লালা ঝরছে দ্বিতীয় মন থেকে : ‘তারপর ওদের শেষ করে ওদেরই মহাকাশযান নিয়ে আমরা ফিরে আসব আমাদের দেশে। মহাকাশযান বোঝাই করে আর সবাইকে নিয়ে যাব পৃথিবীতে। ওঃ, তখন সেখানে হবে আমাদের নতুন বসতি…।’ আনন্দে উল্লাসে টগবগ করে উঠল নীরব কণ্ঠস্বর।

‘কিন্তু ডক্টর…ওকে আমাদের খুন করতে হবে…।’

‘না, না…তা হলে ওরা মহাকাশযান পৃথিবীতে নামাবে না। সবাই সন্দেহ করবে। পৃথিবীকে বাঁচাতে ওরা মহাকাশযান উড়িয়ে দেবে মহাকাশে। তার চেয়ে বরং ডক্টরকে ওর খেলা খেলতে দাও। ভয় পেয়ো না একটুও।

‘কিন্তু টের পাচ্ছি, আমি কোণঠাসা হয়ে পড়ছি—কীভাবে তা বুঝতে পারছি না। আমাদের ফিরে যাওয়া উচিত। এখনই। এখনও সময় আছে…।’ নিষ্ঠুর হাসির মধ্যে দিয়ে ঘৃণা ভরা নৃশংস মনটা যেন তার হাজারো অ্যান্টেনা

দিয়ে উগ্র বিষ ঢেলে দিল : ‘ভয় পেয়ো না। মনে রেখো, আমাদের একজন বেঁচে থাকলেই চলবে। তুমি…কিংবা আমি…।’

ক্যাপ্টেন নীতীশ মিত্রের কেবিনে ঢুকলেন মোহন শ্রীবাস্তব। ক্যাপ্টেন ফিরে তাকাতেই বলে উঠলেন, ‘আমি জিতেছি, ক্যাপ্টেন। আমার পাতা ফাঁদে পা দিয়েছে নকল কমল সেনগুপ্ত। সে ধরা পড়ে গেছে হাতেনাতে।’

শ্রীবাস্তবের মুখে জয়ের হাসি। রিল্যাক্সারে বসে একটা সিগারেট ধরালেন তিনি। লাইটারটা হাতে নিয়ে খেলা করতে লাগলেন।

ক্যাপ্টেন মিত্র জয়ের খবরে তেমন যেন আশ্বস্ত হতে পারেননি। নীচু গলায় বললেন, ‘ডক্টর, আপনার অনুমানই তা হলে সত্যি হল! আমি আর ভাবতে পারছি না। সবকিছু যেন দুঃস্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে। কাল রাতে এক মুহূর্তের জন্যেও আমি ঘুমোতে পারিনি। তা ছাড়া, আজ যতবারই কমলের মুখোমুখি হয়েছি ততবারই নিজেকে কেমন অপরাধী বলে মনে হয়েছে। ছেলেটা এত নিষ্পাপ, সরল—।’

ক্যাপ্টেনকে বাধা দিয়ে শ্রীবাস্তব বললেন, ‘যে-কমল সেনগুপ্তকে আপনি দেখছেন : ঘোর পাপী এবং কুটিল। প্রথম সুযোগেই সে আপনাকে আমাকে সবাইকে খতম করে দেবে। কিন্তু এখন আর তা হবে না। উলটে আমরাই তার ব্যবস্থা করব…।’

‘কী প্রমাণ পেয়েছেন, ডক্টর?’ অপেক্ষাকৃত শান্ত স্বরে জিগ্যেস করলেন নীতীশ মিত্র।

পকেট হাতড়ে একটা খাম বের করলেন ডক্টর শ্রীবাস্তব। খাম থেকে বেরোল একটা ফিল্ম। সেটা আলোর দিকে ধরে একবার দেখলেন। তারপর ক্যাপ্টেনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘কমল সেনগুপ্তের পাকস্থলীর সনোগ্রাফিক ফিল্ম। সনিক জেনারেটার লাগিয়েছিলাম কেবিনের সিলিংয়ে, এবং ওর বাঙ্কের তলায় ফিল্ম প্লেটটা সেট করে অনেক কষ্টে লুকিয়ে এই ছবি তুলেছি। দেখুন—।’ ক্যাপ্টেন মিত্র ফিল্মটা দেখলেন : ‘কীসের ছবি?’

‘কাল রাতে কমল সেনগুপ্ত যা-যা খেয়েছিল তার ছবি।’

‘কই, কিছু তো দেখা যাচ্ছে না!’ ক্যাপ্টেন অবাক হলেন।

শ্রীবাস্তব আত্মপ্রসাদের হাসি হাসলেন : ‘কমল আমার ফাঁদে পা দিয়েছে, তাই কিছু দেখা যাচ্ছে না।’

ক্যাপ্টেন বিমূঢ় চোখে ডক্টরকে দেখতে লাগলেন। মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছেন না তিনি।

শ্রীবাস্তব হাসলেন। তারপর পকেট থেকে আর-একটা খাম বের করলেন। খাম থেকে বেরোল ছ’টা একই ধরনের ফিল্ম।

‘ক্যাপ্টেন, কমলের ছবির সঙ্গে এই ছবিগুলো মিলিয়ে দেখুন। আমাদের মেডিক্যাল টিম বহু পরিশ্রমে গোপনে ছবিগুলো তুলেছে। অবশ্য আমি ছাড়া আর কেউ ছবি তোলার কারণ জানে না।’ হাতের সিগারেটে গভীর টান দিলেন ডক্টর। ফিল্মগুলো রাখলেন ক্যাপ্টেনের ডেস্কের ওপরে। তারপর বললেন, ‘ক্যাপ্টেন, কাল রাতে ক্রু-দের যে-খাবার দেওয়া হয়েছিল তাতে আমি গোপনে পাথরের গুঁড়ো মিশিয়ে দিয়েছিলাম—না, আপনার অনুমতি নিতে পারিনি—তার জন্যে আমি দুঃখিত। রাতের খাবার খেয়ে আজ সকলেই বদহজমের অভিযোগ করেছে— একমাত্র কমল সেনগুপ্ত ছাড়া। ওই ছ’টা ফিল্ম লক্ষ করলে দেখতে পাবেন স্টোনডাস্টের ছবি সনোগ্রাফে অত্যন্ত স্পষ্ট—যা কমলের ছবিতে নেই। অর্থাৎ, স্বাভাবিক কারণেই খাবারের সঙ্গে অজান্তে পাথরের গুঁড়ো খেয়ে ছ’জন অভিযাত্রী তা হজম করতে পারেনি। কিন্তু নকল কমল জানত না পাথরের গুঁড়ো তার হজম করা উচিত কি অনুচিত। আসল কমলের মস্তিষ্কের স্মৃতিভাণ্ডার থেকে এ-বিষয়ে কোনও খবর সে জানতে পারেনি—আর জানা সম্ভবও ছিল না। এ-খবর একমাত্র দিতে পারত হিউম্যান মেটাবলিক সিস্টেম—যার আচার-আচরণ টিরার অতিচালাক প্রাণীর পক্ষেও হুবহু নকল করা সম্ভব নয়। অতএব পাথর হজম করে নকল কমল নিজেকে এক্সপোজ করে দিয়েছে! আর তার লুকোনোর পথ নেই!’

সিগারেটে শেষ টান দিয়ে হাসলেন ডক্টর শ্রীবাস্তব। লাইটার জ্বেলে নতুন একটা সিগারেট ধরালেন : ‘আপনাকে তো আগেই বলেছিলাম ক্যাপ্টেন, এ-পর্যন্ত এমন কোনও জালিয়াতি বা নকলের কথা আমি শুনিনি যা ধরা পড়েনি। দরকার শুধু সময়…।’

ক্যাপ্টেন মিত্র একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে রাখলেন। তারপর ডক্টরের হাত থেকে লাইটারটা নেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন।

‘খবরদার!’ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিলেন মোহন শ্রীবাস্তব : ‘ছোঁবেন না আমাকে!’

ডক্টরের দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করলেন নীতিশ মিত্র : ‘আমি লাইটারটা নিতে যাচ্ছিলাম, ডক্টর।’

সশব্দে নিশ্বাস ফেললেন শ্রীবাস্তব। লজ্জিতভাবে লাইটারটা এগিয়ে দিলেন ক্যাপ্টেনের ডেস্কে। বললেন, ‘সরি, ক্যাপ্টেন, আমি একটু উত্তেজিত হয়ে পড়েছি। সবাইকেই আমি ভয় করতে শুরু করেছি। সবসময় টিরার প্রাণীর দুঃস্বপ্ন দেখছি। ওদের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করছি। সবটাই হয়তো বোকামি, কিন্তু আমি সাবধান থাকতে চাই, ক্যাপ্টেন…’ ছোট্ট করে হাসলেন শ্রীবাস্তব : ‘এখন চলুন, নকল কমলের একটা ব্যবস্থা করি।’

‘কী ব্যবস্থা?’ সিগারেট ধরিয়ে লাইটারটা ডক্টরের তালুর ওপর ছেড়ে দিলেন ক্যাপ্টেন। ডক্টর শ্রীবাস্তব সেটা লুফে নিয়ে পকেটে ঢোকালেন। তারপর ফিল্মগুলো খামে ভরে নিয়ে রিল্যাক্সার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। ক্যাপ্টেনও উঠে দাঁড়ালেন তাঁর সঙ্গে রওনা হওয়ার জন্য।

শ্রীবাস্তবের চোয়াল শক্ত হল। খোঁচা-খোঁচা দাড়িতে হাত বুলিয়ে তিনি বললেন, ‘চরম ব্যবস্থা। চলুন, নিজের চোখেই দেখবেন…।’

ওঁরা দুজনে বেরিয়ে এলেন ক্যাপ্টেনের কেবিন ছেড়ে। করিডর ধরে এগোতে-এগোতে মোহন শ্রীবাস্তব বললেন, ‘একটু আগে আমি কমলকে স্টারবোর্ডের দিকে স্পেস লকটা পরিষ্কার করতে বলে এসেছি। ও যদি স্পেস লকের মধ্যে থাকে তা হলে আমাদের কাজের সুবিধে হবে।’

ক্যাপ্টেন মিত্র কোনও কথা বললেন না। তিনি এই মহাকাশযানের ক্যাপ্টেন, কিন্তু ডক্টর শ্রীবাস্তবের র‍্যাঙ্ক তাঁর সমান। তা ছাড়া, মহাকাশযান ও অভিযাত্রীদের রোগজীবাণুমুক্ত রাখতে ডক্টর শ্রীবাস্তব যা ভালো বোঝেন করতে পারেন— ক্যাপ্টেনের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। একই কারণে তিনি হুকুম চালাতে পারেন ক্রু-র ওপরে। গত এক দশকে রোগজীবাণুর জন্য বিভিন্ন মহাকাশঅভিযানের শোচনীয় ব্যর্থতা সকলের চোখ খুলে দিয়েছে। সেই কারণেই আজকাল যে-কোনও অভিযানে চিফ মেডিক্যাল ম্যান ক্যাপ্টেনের মতোই গুরুত্বপূর্ণ—হয়তো বা তার চেয়েও বেশি। তবে নীতিশ মিত্র এটুকু আশা করেন, শ্রীবাস্তব যা করবেন তা বুঝে-শুনে দায়িত্ব নিয়েই করবেন।

মোহন শ্রীবাস্তব নিজের বোকামির কথা ভাবছিলেন। কমল সেনগুপ্ত ছাড়াও যে অন্য কেউ টিরার প্রাণী হতে পারে এই সন্দেহের কথা ওভাবে প্রকাশ করাটা ঠিক হয়নি। ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে ব্যাপারটা যদি পাঁচকান হয় তা হলেই বিপদ! নিজের সন্দেহের কথা এই মুহূর্তে তিনি কাউকে জানাতে চান না।

স্টারবোর্ডের স্পেস লকের সামনে করিডরে অফিসার অংশুমান যাদবের সঙ্গে দেখা হল। ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারা করলেন মোহন শ্রীবাস্তব। তারপর যাদবকে বললেন, ‘নেভিগেশান রুমে গিয়ে ধনপত রাইকে বলো স্পেস জাম্পের জন্যে তৈরি হতে। আমরা একটু পরে আসছি।’

যাদবকে সরিয়ে দিয়ে দুজন এগিয়ে গেলেন স্পেস লকের দরজার সামনে। ভারী ধাতব দরজা। দরজার ওপরের অংশে পুরু প্লাস্টিকের স্বচ্ছ প্যানেল বসানো। প্রেসার চেম্বারের ভেতরে কমল সেনগুপ্ত কাজ করছে। একটা ভ্যাকুয়াম ক্লিনার নিয়ে ঘরটা পরিষ্কার করছে। নিখুঁত একজন মানুষ—চেহারা, চালচলন, সব।

হঠাৎই ক্ষিপ্র চিতার মতো দরজার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন শ্রীবাস্তব। এক ঝটকায় লক আটকে বেরোনোর পথ বন্ধ করে দিলেন। তারপর দরজার পাশেই একটা প্যানেলের লাল বোতামে চাপ দিলেন। চেম্বারের ভেতরে লাল আলো জ্বলে উঠল। মৃদু গুঞ্জন তুলে বায়ু-নিষ্কাশন পাম্প কাজ শুরু করল। প্রেসার চেম্বারের বাতাস ক্রমশ বেরিয়ে যেতে লাগল।

লাল আলো দেখে কমল চমকে উঠল, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ছেড়ে ছুটে এল দরজার কাছে। আতঙ্কে চোখ বেরিয়ে আসছে, মুখে বিমূঢ় বিস্ময়।

‘ডক্টর!’ ও চিৎকার করে উঠল। ভারী দরজা ভেদ করে ওর ক্ষীণ ভাঙা কণ্ঠস্বর শোনা গেল : ‘ডক্টর, শিগগির সবুজ বোতামটা টিপে দিন! দেখছেন না, আমার গায়ে প্রেসার স্যুট নেই!’

ক্যাপ্টেন মিত্রের ঠোঁট চিরে একটা অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এল। পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়ে তিনি ডক্টরকে দেখছেন। কোনওরকমে বললেন, ‘কী করছেন আপনি! ছেলেটা যে মরে যাবে!’

‘ছেলেটা নয়, টিরার প্রাণী!’ গম্ভীর গলায় শ্রীবাস্তব উত্তর দিলেন, ‘আমাদের মতো ওরাও বায়ুমণ্ডলে অভ্যস্ত। অতএব বায়ুশূন্য অবস্থায় বাঁচতে পারবে না। চুপচাপ শুধু দেখে যান।’ ডক্টরের চোখ প্লাস্টিক প্যানেলের ওপরে নিবদ্ধ।

কমল সেনগুপ্ত অন্ধ আতঙ্কে কাঁপছে। মরিয়া হয়ে চিৎকার করে উঠল আবার, ‘ডক্টর! ক্যাপ্টেন! সবুজ বোতামটা টিপে দিন, প্লিজ! ডক্টর, শিগগির করুন! নইলে আমি মরে যাব—আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে

পাগল-করা রাগে, উত্তেজনায়, হতাশায়, কমল ঘুসি মারতে লাগল ধাতব দরজায়, প্লাস্টিক প্যানেলের ওপরে। ওর হাত ফেটে রক্ত বেরিয়ে এল। স্বচ্ছ প্যানেল লালে মাখামাখি হয়ে গেল। তারপর লাল থেকে ধীরে-ধীরে পালটে যেতে লাগল বিচিত্র বেগুনি রঙে।

কমল নিজের গলা আঁকড়ে ধরল, হাঁটুগেড়ে পড়ে গেল মেঝেতে। প্রেসার গেজ-এর কাঁটা ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে শূন্যের দিকে। কমল ছটফট করছে আহত সরীসৃপের মতো, কাশির দমকে কেঁপে উঠছে ওর শরীর।

হঠাৎই ওর নাক দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল। শেষ আক্ষেপে মোচড় খেল ওর দেহ। তারপরই সব স্থির। নিস্পন্দ।

এবং কমল সেনগুপ্তের দেহে পরিবর্তন শুরু হল। আকৃতি পালটে যেতে লাগল ধীরে-ধীরে। সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অবয়ব গলে-গলে মিশে যেতে লাগল— হাত-পা, চুল—অবশেষে রয়ে গেল শুধু একতাল বেগুনি জেলি। যেন এক অতিকায় অ্যামিবা। তিরতির কাঁপন জাগছিল জেলির স্তরে। আচমকা সেটাও থেমে গেল। প্রাণের সব স্পন্দন শেষ।

প্যানেল থেকে চোখ সরিয়ে মাথা নাড়লেন ডক্টর। অবসাদ ভরা শরীরে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। ক্লান্ত স্বরে বললেন, ‘এই আমার সবচেয়ে বড় প্রমাণ, ক্যাপ্টেন। আমি ভুল করিনি।’

ক্যাপ্টেন মিত্র কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই এক লহমায় টানটান হয়ে দাঁড়ালেন মোহন শ্রীবাস্তব : ‘ক্যাপ্টেন, একটা বিরাট ভুল হয়ে গেছে! অশোক চিরিমার মরেছে, কিন্তু তার ভেতরের বেগুনি জেলি মরেনি! নকল কমল সেনগুপ্তেরই একটা অংশ তৈরি করেছিল নকল চিরিমার। সে মরে যাওয়ার ভান করে আমাদের চোখে ধুলো দিয়েছে। আমি এক্ষুনি গিয়ে সাব জিরো রুম লক করে সিল করে দিয়ে আসছি। পৃথিবীতে ফিরে গিয়ে “মৃত” চিরিমারকে পরীক্ষা করে দেখব। আর এই প্রেসার চেম্বারটা আপনি সিল করে দিন। কেউ যেন এটা না খোলে। দেখি, ওদিকে আবার কোনও বিপদ হল কি না!’

শ্রীবাস্তব ক্ষিপ্র পায়ে করিডর ধরে ছুটতে শুরু করলেন। ঘটনাচক্রে অথবা দুর্ঘটনায় কোনও অভিযাত্রী মারা গেলে তার মৃতদেহ অক্ষত রাখার জন্যেই সাব জিরো রুমের ব্যবস্থা। কপাল ভালো বলতে হবে, এখন সেখানে একমাত্র অশোক চিরিমারের ‘মৃতদেহ’ রয়েছে। তার হাতে সোলারের অন্য কেউ আক্রান্ত হয়েছে কি না কে জানে! আবার কাউকে খুন করে শয়তানটা তাকে নকল করেনি তো! না, এখানে আর পরীক্ষা চালানোর সময় নেই। সামনেই বিপজ্জনক স্পেস জাম্প। অতএব যা করার পৃথিবীতে ফিরেই করতে হবে।

ছুটতে-ছুটতে সাব জিরো রুমে এসে দাঁড়ালেন ডক্টর। দরজা বন্ধ। আশপাশে কেউ নেই। রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলেন। হাতল ঘুরিয়ে দরজা খুললেন। বরফ-ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটায় তাঁর চোখ-মুখ যেন জমে গেল। ঘরের মধ্যে সাদা ধোঁয়ার রেখা চোখে পড়ছে। ধাতব দেওয়াল, ধাতুর বাঙ্ক, সব—সব জায়গাতেই চাপচাপ বরফের স্তর জমে আছে। একটা বাঙ্কে নিশ্চল শুয়ে আছে মৃত অশোক চিরিমার। হাতে মুখে তুষারের কণা।

স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন মোহন শ্রীবাস্তব। দরজা বন্ধ করে লক করে দিলেন। কাউকে ডেকে সিল করার ব্যবস্থা করতে হবে এখুনি।

দরজা সিল করে কেবিনে ফিরে যেতে-যেতে তাঁর মনে হল, সাব জিরো রুমের ওই হিমশীতল তাপমাত্রায় টিরার প্রাণী কি আর বেঁচে আছে? স্পন্দনের ইশারা কি এখনও অবশিষ্ট রয়েছে ওই বেগুনি জেলিতে? পৃথিবীতে ফিরে গিয়েই সব প্রশ্নের উত্তর তন্নতন্ন করে খুঁজে বের করবেন তিনি।

ছয় : শত্রুর মুখোমুখি

পরদায় পৃথিবীকে বিশাল দেখাচ্ছে। সবুজ, উজ্জ্বল, প্রক্সিমা সেন্টরির দিকে যাত্রা শুরুর সময় যেরকম দেখা গিয়েছিল। স্পেস জাম্পের পরীক্ষায় নির্বিঘ্নে উত্তীর্ণ হয়েছে সোলার। এখন তার গতি কমে আসছে। পৃথিবীর কক্ষপথে কয়েকবার পাক দেওয়ার পর নির্দিষ্ট ‘ব্যালিস্টিক পাথ’ ধরে পৃথিবীর দিকে এগিয়ে চলেছে সোলার। অভিযাত্রীরা যার যার নির্ধারিত জায়গায় তৈরি। মহাকাশযান নামার সময় গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো প্রত্যেকটি কর্মীকে অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে করতে হবে। সেখানে চুলচেরা ভুল হওয়ার উপায় নেই। সুতরাং প্রত্যেকেই তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছে।

ছায়া-অন্ধকার করিডর ধরে মহাকাশযানের পিছনের অংশে এগিয়ে চলেছেন মোহন শ্রীবাস্তব। সঙ্গে সনোগ্রাফের ফিল্ম সমেত খাম দুটো। ক্যাপ্টেন মিত্রকে তিনি ভালো করে বুঝিয়ে এসেছেন যে, বিপদ কেটে গেছে। টিরার প্রাণী মৃত। একজন মারা গেছে বায়ুশূন্যতায়, অন্যজন হিম তাপমাত্রায়। অতএব সোলার এখন বিপদমুক্ত।

কিন্তু সবটাই শ্রীবাস্তব ভুল বুঝিয়েছেন। গালগল্প প্রচার বন্ধ করার জন্যই তাঁকে ক্যাপ্টেনের কাছে মিথ্যে বলতে হয়েছে। এখন তিনি লাইফবোট রকেটে চড়ে একা রওনা হয়ে যাবেন পৃথিবীর দিকে। পৌঁছোবেন সোলারের আগে। ফিল্মগুলো কর্তৃপক্ষকে দেখিয়ে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেবেন সোলার-এর প্রতিটি যাত্রীকে যাচাই করার জন্য। বিপজ্জনক মহাকাশযানে নীতীশ মিত্রকে রেখে যেতে তাঁর খারাপ লাগছে, কিন্তু কোনও উপায় নেই। অন্যান্য যাত্রীর মতো ক্যাপ্টেনকেও তিনি সন্দেহ করেন। কে বলতে পারে, টিরার রুক্ষ ভূমি থেকে একজন, দুজন, না তিনজন—ক’জন ছদ্মবেশী প্রাণী উঠে এসেছিল সোলারে!

লাইফবোট রুমে মোট ন’টা রকেট ছিল। টর্চের আলোয় আটটা রকেটের ইগনিশান সার্কিট শর্ট করে দিলেন শ্রীবাস্তব। এগুলো ঠিক করতে এখন কয়েক ঘণ্টা লেগে যাবে। অতএব পৃথিবীতে সবাইকে নামতে হবে সোলারে বন্দি হয়েই। তারপর…।

ন’নম্বর রকেটটা সোলারের আশ্রয় ছেড়ে গা ভাসাল মহাকাশে। সাবলীল গতিতে নেমে চলল উষ্ণ সবুজ পৃথিবীর দিকে।

টিরার প্রাণীরা অজেয় নয়। ডক্টর শ্রীবাস্তব ভাবলেন। ওদের একজনকে তিনি বুদ্ধির খেলায় হারিয়েছেন, ফাঁদে ফেলেছেন, শেষ করেছেন। অতএব চেষ্টা করলে বাকিগুলোকেও পারবেন। শুধু দরকার সাহস, আর আত্মবিশ্বাস। মৃত্যুর সময় নকল কমল সেনগুপ্তের চোখে-মুখে পাগল করা রাগ ফুটে উঠেছিল। চরম ঘৃণায় টলটল করছিল চোখের দৃষ্টি। টিরার প্রাণী কমলের চোখ দিয়ে তাঁকে দেখছিল। ফুঁসছিল রাগে।

ডক্টর শ্রীবাস্তব শিউরে উঠলেন। কমল সেনগুপ্তের বেলায় ভাগ্য তাঁর সহায় ছিল। কিন্তু এবারে?

একঘণ্টার মধ্যেই ক্যালকাটা কসমোড্রোমে ল্যান্ড করল শ্রীবাস্তবের লাইফবোট রকেট। তারপরই ব্যস্ত কথাবার্তা, উত্তেজনা, ছুটোছুটি, সনোগ্রাফ পরীক্ষা, সংশয় আতঙ্ক। একটা ম্যাগনেটিক কারে চড়ে আনডারগ্রাউন্ড টানেল ধরে শব্দের গতিতে রওনা হয়ে গেলেন মোহন শ্রীবাস্তব। লক্ষ্য : কসমোড্রোম সিকিওরিটি ব্যুরো।

আকাশের দিকে রুপোলি নাক উঁচিয়ে বিশাল মহাকাশযান সোলার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে। যেন অপরূপ এক অতিকায় পাখি ডানা মেলার মুহূর্তে ছবি হয়ে গেছে। মনে-মনে সোলারের গঠনের তারিফ করলেন মোহন শ্রীবাস্তব। তারপর অটোমেটিক এলিভেটরে চড়ে সোলারের গা বেয়ে উঠতে শুরু করলেন। তাঁর সঙ্গে সবুজ য়ুনিফর্ম পরা চারজন কসমোড্রোম সিকিওরিটি পুলিশ। তাঁদের প্রত্যেকের হাতে আলট্রাসনিক-শকার। ট্রিগারে চাপ দিলেই লাভাস্রোতের মতো বেরিয়ে আসবে অদৃশ্য আলট্রাসনিক শক্তির ফোয়ারা। শব্দোত্তর তরঙ্গের জোয়ারে অদৃশ্য শত্রু সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়বে। বেশিক্ষণ ব্যবহার করলে তার করুণ মৃত্যুও ঘটবে।

ধাতব শব্দের আর্তনাদ তুলে ওপরে, আরও ওপরে, উঠতে লাগল এলিভেটর। এক সময় এসে থামল সোলারের প্রধান দরজার সামনে। সেখানে দুজন সিকিওরিটি অফিসার দাঁড়িয়ে ছিলেন। ডক্টরকে দেখেই তাঁদের একজন বললেন, ‘সবাই নেমে গেছে, ডক্টর শ্রীবাস্তব। আপনার কথা মতোই সকলকে সিকিওরিটি পুলিশের তত্ত্বাবধানে সেন্ট্রাল ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে—।’

‘থ্যাংক য়ু, অফিসার।’ নির্বিঘ্নে কাজ শেষ হওয়ার তৃপ্তি পেলেন মোহন শ্রীবাস্তব।

সিকিওরিটি কমান্ডার তাঁর কথায় বিশ্বাস করেছেন। কমান্ডারই আদেশ দিয়েছেন সোলারের প্রতিটি যাত্রীকে সিকিওরিটি ফোর্স দিয়ে সেন্ট্রাল ক্লিনিকে নিয়ে যেতে। অবশ্যই ডক্টর শ্রীবাস্তবের পরামর্শে। ক্লিনিকে প্রত্যেককে খুঁটিনাটি পরীক্ষা করে জেরবার করে ছাড়বেন শ্রীবাস্তব। একের পর এক নতুন-নতুন ফাঁদ পাতবেন। সময় লাগবে, ধৈর্যও লাগবে। তবে টিরার একটি প্রাণীও রেহাই পাবে না।

হঠাৎ কী মনে হতে মোহন শ্রীবাস্তব অফিসারকে লক্ষ্য করে প্রশ্ন করলেন, ‘স্পেসশিপ থেকে নামার সময় প্রত্যেক প্যাসেঞ্জারের ফটো আর ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিলিয়ে দেখা হয়েছে?…আর একটা বডি ছিল…।’

‘হ্যাঁ, ডক্টর। আমরা লিস্ট মিলিয়ে নিয়েছি। কোনও গরমিল হয়নি। অশোক চিরিমারের ডেডবডি আমরা সাবধানে নামিয়েছি। তারপর পাঠিয়ে দিয়েছি ক্লিনিকে। আপনার কথামতো বডিটা আমরা চেক করেছিলাম। কিন্তু তাতে কোনওরকম ডিফেক্ট পাইনি। তখন স্টেরিলাইড্ ব্যাগে ভরে নামিয়ে নিয়েছি।’

যাক, নিশ্চিন্ত। হাতে হাত ঘষলেন শ্রীবাস্তব। মাটি থেকে ষাট ফুট উঁচুতে দাঁড়িয়ে আরও বেশি শীত করছে। এখানে হাওয়ার দাপট অনেক বেশি। নীচে শুয়ে থাকা কলকাতাকে লিলিপুট-শহরের মতো দেখাচ্ছে। সেন্ট্রাল ক্লিনিকে ফিরে গিয়ে ল্যাবরেটরি টেস্ট শুরু করার জন্য তাঁর মন ছটফট করতে লাগল। কিন্তু, না। এখনও সামান্য একটু কাজ বাকি রয়েছে। স্টারবোর্ড স্পেস লক থেকে সংগ্রহ করতে হবে বেগুনি জেলির পিণ্ডটা—এতক্ষণে ওটা হয়তো শুকিয়ে এসেছে। তা ছাড়া কেবিন থেকে নিতে হবে কিছু নোট্স, কয়েকটা রিপোর্ট। শুধু নোট্স আর রিপোর্টের কথাই অফিসারকে বললেন তিনি। একজন সিকিওরিটি পুলিশের হাত থেকে একটা আলট্রাসনিক-শকার চেয়ে নিয়ে অফিসার দুজনকে বললেন, ‘আপনারা অ্যালার্ট থাকুন। আমি ভেতরে যাচ্ছি। দেখবেন, আর-কেউ যেন ভেতরে না ঢোকে। কেউ না!’

‘ওকে, ডক্টর!’ একসঙ্গে বলে উঠলেন দুজন অফিসার। কমান্ডারের নির্দেশ, ডক্টর শ্রীবাস্তবের কথা অক্ষরে অক্ষরে শুনতে হবে। এত কাণ্ডকারখানার কী কারণ তা তাঁরা কেউই জানেন না।

শকার হাতে নিয়ে সোলারে ঢুকলেন শ্রীবাস্তব। তাঁর চোখে ঘুম নেই, ক্লান্তি নেই, স্বস্তি নেই, শান্তি নেই—যতক্ষণ না পৃথিবীকে বাঁচাতে পারছেন টিরার ভয়ানক শত্রুর হাত থেকে।

পিছনে প্রধান দরজা বন্ধ হয়ে যেতেই করিডর আবছায়া অন্ধকার হয়ে গেল। অতিকায় মহাকাশযানে নিজেকে ভীষণ একা মনে হল ডক্টর শ্রীবাস্তবের। ইঞ্জিনের সেই চেনা গুঞ্জন নেই, নেই অভিযাত্রীদের কর্মব্যস্ততা। সব শান্ত, চুপচাপ, শূন্য।

করিডরে বাঁক নিয়ে নিজের কেবিনের দিকে চললেন তিনি। তাঁর পায়ের শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ধাতব দেওয়াল থেকে দেওয়ালে।

হঠাৎই তিনি থমকে দাঁড়ালেন। বিভিন্ন প্রতিধ্বনি থেকে যেন শব্দের ধাঁধা তৈরি হচ্ছে। আর-একটা শব্দ কানে এল না! তাঁর পায়ের শব্দ নয়। একটু অন্যরকম। ডক্টর পাথরের মতো দাঁড়িয়ে। উৎকর্ণ। প্রতিটি স্নায়ু টান-টান। শকার যে-কোনওরকম পরিস্থিতির জন্য তৈরি।

ওই আবার! অন্ধকার ভেদ করে দেখতে চেষ্টা করলেন ডক্টর। সব আলো কি বিকল হয়ে গেছে? কবরখানার নিস্তব্ধতা ছেয়ে গেছে চারিদিকে। কপালে জন্ম নিচ্ছে নোনা ঘামের বিন্দু। এবারে স্পষ্ট শোনা গেল শব্দটা। পায়ের শব্দ! ভেসে এল করিডরের অন্য প্রান্ত থেকে।

সোলারে মোহন শ্রীবাস্তব একা নন! আরও কেউ রয়েছে…লুকিয়ে…গোপনে…। কী ভীষণ বোকামি করেছেন তিনি! মহাকাশযানে একা ঢুকে পড়া তাঁর উচিত হয়নি। তিনি ছাড়া আরও একজন রয়েছে ভেতরে। তাঁর শত্রু! কিন্তু কে? সবাই তো নেমে গেছে সিকিওরিটি পুলিশের তত্ত্বাবধানে! তা হলে?

আলট্রাসনিক-শকার চারপাশে ঘুরিয়ে সতর্ক চোখে সব জরিপ করলেন শ্রীবাস্তব। তাঁর মন তখন ব্যস্তভাবে একই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে।

সোলারে এমন কেউ রয়েছে যে কমল সেনগুপ্তের পুরো ঘটনাটা জানে। সে জানে ভিনগ্রহের প্রাণী ছদ্মবেশে ঢুকে পড়েছে সোলারে। জানে, কেন মহাকাশযানের সব যাত্রীকে পাহারা দিয়ে ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেইজন্যই সে ভয়ে নামেনি সোলার থেকে—ধরা পড়ার ভয়ে। সে জানে ডক্টর শ্রীবাস্তবের সন্দেহের কথা।

এত সব জানে শুধু দুজন। একজন ডক্টর মোহন শ্রীবাস্তব নিজে, আর দ্বিতীয় জন…।

‘ক্যাপ্টেন মিত্র।’ চিৎকার করে উঠলেন শ্রীবাস্তব, ‘চালাকি করে কোনও লাভ নেই! পালাবার কোনও পথ নেই তোমার! সব আমি ফাঁস করে দিয়েছি। একজন ক্যাপ্টেন মিত্র আগেই নেমে গেছে সোলার থেকে। মহাকাশযানের চারিদিকে কড়া পাহারা। মাছি গলার জো নেই। তুমি ফাঁদে পড়ে গেছ নকল নীতীশ মিত্র!’

বারবার প্রতিধ্বনিত হয়ে বিদ্রূপের কলরোল তুলে একসময় মিলিয়ে গেল কথার স্বনন। সব চুপচাপ। শত্রুর তরফ থেকে কোনও জবাব নেই। মোহন শ্রীবাস্তবের শরীর কাঁপছে, হৃৎপিণ্ড ছুটে চলেছে পাগলা ঘোড়ার মতো উদ্দাম বেগে। একটা ভয় হঠাৎই তাঁকে জড়িয়ে ধরতে চাইল। ঘুরে দাঁড়িয়ে করিডর ধরে ছুটতে শুরু করলেন। ফিরে চললেন প্রধান দরজার দিকে।

দরজার কাছে পৌঁছেই শরীর হিম হয়ে গেল। দরজা ভেতর থেকে লক করা, এবং লকের চাবি উধাও। চেঁচিয়ে বা শব্দ করে কোনও লাভ নেই। বাইরে থেকে কেউ দরজা খুলতে পারবে না। যদি দরজা কাটতে হয়, তা হলে তো ঘণ্টাদুয়েকের ব্যাপার! ততক্ষণে…।

শ্রীবাস্তবের গলা বুজে আসতে চাইল ক্ষোভে, হতাশায়। অসহায় কান্না দলা পাকাতে লাগল বুকের ভেতরে। কী মারাত্মক ভুল করেছেন তিনি! একেবারে ভুলে গেছেন টিরার একজন অনায়াসে দুজন মানুষকে নকল করতে পারে। যেমন, একজন নকল করেছিল অশোক চিরিমার ও কমল সেনগুপ্তকে। বাকি অভিযাত্রীদের সঙ্গে ক্যাপ্টেন মহাকাশযান থেকে নেমে গেছেন, তবে তাঁরই একটা অংশ থেকে গেছে সোলারের ভেতরে। এখনও যার চেহারা নীতীশ মিত্রের মতো। সে অপেক্ষা করছে। কিন্তু কীসের জন্য?

যতক্ষণ পর্যন্ত টিরার প্রাণী মহাকাশযানে বন্দি ততক্ষণ পর্যন্ত সে অসহায়। এখন সে হয়তো মাথা খুঁড়ে মরছে কী করে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে বাইরে বেরোনো যায়। নৃশংস নিষ্ঠুর ভিনগ্রহীর মনে কোনও দয়া নেই, মায়া নেই। ডক্টরকে বাগে পেলেই সে শেষ করে দেবে। সুতরাং শ্রীবাস্তবই আগে খুঁজে বের করবেন তাকে।

সন্তর্পণে পা ফেলে ছায়া-ছায়া করিডর ধরে আবার এগিয়ে চললেন মোহন শ্রীবাস্তব। শব্দটা আবার শুনতে পেলেন তিনি: ওপরের ডেক থেকে আসছে। পায়ের শব্দ এগিয়ে চলেছে সামনে। দ্রুতগতিতে বেড়ালের মতো ক্ষিপ্রতায় করিডর ধরে নিঃশব্দে ছুটলেন ডক্টর—যেদিকে চলেছে ওপরতলার পায়ের শব্দ সেদিকে।

খাড়া ধাতব সিঁড়ির কাছে পৌঁছে মোহন শ্রীবাস্তব হাঁফাতে লাগলেন। ওপরে একটা কেবিনের দরজা খুলল, বন্ধ হল। ক্যাপ্টেনের কেবিনে ঢুকেছে নকল তীশ মিত্র। ওপরের করিডর ছাড়া ওই কেবিন থেকে বেরোনোর দ্বিতীয় পথ নেই। শত্রুকে ফাঁদে পাওয়া গেছে। সুতরাং ধীরে-ধীরে চুপিসাড়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলেন শ্রীবাস্তব। উঁকি মেরে দেখলেন। ক্যাপ্টেনের কেবিনের দরজার ফাঁক দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে।

ছোট ফোঁকর দিয়ে লম্বা শরীরটাকে তৎপরভাবে ওপরের করিডরে তুলে ফেললেন ডক্টর। তারপর শকার উঁচিয়ে দেওয়ালে পিঠ দিয়ে তৈরি হলেন।

‘বেরিয়ে এসো, নীতীশ!’ গর্জন করে উঠলেন তিনি, ‘তোমার বাঁচার কোনও পথ নেই! স্পেসশিপটা ওরা তুলোধোনা করে খুঁজবে। দরকার হলে সোলারকে ওরা জ্বালিয়ে ছাই করে দেবে—তোমাকে সমেত। এখনও বেরিয়ে এসো বলছি।’

কোনও শব্দ নেই। কোনও উত্তর নেই। দরজার পাল্লায় এক জোরালো লাথি বসিয়ে দিলেন শ্রীবাস্তব। পাল্লা খুলে গেল ভেতরে। কেবিন ফাঁকা! সেখানে কেউ নেই।

বিমূঢ় ভাবটা কেটে ওঠার আগেই একটা জোরালো আঘাত আছড়ে পড়ল শ্রীবাস্তবের হাতে। প্রতিটি স্নায়ু যেন চিৎকার করে উঠল যন্ত্রণায়। শকার ছিটকে পড়ল যন্ত্রণাবিদ্ধ অসাড় হাত থেকে। ধাতুর সঙ্গে ধাতুর সংঘর্ষ হল। ঠনঠন। একটা ভারী শরীর ঝাঁপিয়ে পড়ল ডক্টরের ওপরে। কিন্তু আহত হলেও সহজাত ক্ষিপ্রতায় পলকে সরে গেলেন ডক্টর। দেখলেন নীতীশ মিত্রের দেহটা আবার সোজা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আবার আক্রমণের জন্য তৈরি হচ্ছে।

‘সাবধান!’ চিৎকার করে উঠলেন শ্রীবাস্তব। লাফিয়ে পড়লেন ছিটকে পড়া শকার লক্ষ করে : ‘তোমার রেহাই নেই, নকল ক্যাপ্টেন! পাহারাদারদের চোখকে তুমি ফাঁকি দিতে পারবে না!’

একটা ঠান্ডা হাসি ভেসে এল শত্রুর দিক থেকে। স্ফটিকের পাহাড় ঝুরঝুর করে খসে পড়ার মতো আলতো সেই হাসি। সরীসৃপের হাসি। তীব্র ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের হাসি। এবং একটা ভারী ধাতব পিণ্ড ছুটে গেল ডক্টরকে লক্ষ্য করে। তখন তাঁর হাত সবে ঠিকরে পড়া শকারটা ছুঁয়েছে। ভারী ধাতুর আঘাতে ডানহাতের তালুর হাড়গোড় যেন গুঁড়ো হয়ে গেল। লক্ষ ভোল্টের বিদ্যুৎ বয়ে গেল ডান বাহু বরাবর। মস্তিষ্কে পৌঁছে বৈদ্যুতিক শক অচেতন করে দিতে চাইল শ্রীবাস্তবকে। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে এক রক্ত-হিম-করা দৃশ্য ডক্টরের চেতনাকে ঝাঁকুনি দিল প্রাণপণে।

কারণ, নীতীশ মিত্রের অবয়ব তখন ধীরে-ধীরে পালটে যাচ্ছে অন্য এক চেহারায়। শ্রীবাস্তবের বিস্মিত দৃষ্টির সামনে নীতীশ মিত্রের কাঠামো আরও লম্বা হল, চোয়াল শক্ত হয়ে ফুটে উঠল সরু গোঁফ, মাথার সামনের চুল অদৃশ্য হয়ে কপাল বিস্তৃত হল, সেখানে দপদপ করছে নীল শিরা। একটা জেলির তাল যেন নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে তৈরি করল নতুন মানুষ।

ডক্টর মোহন শ্রীবাস্তব!

মেঝেতে পড়ে থাকা শ্রীবাস্তব দেখলেন অবিকল তাঁরই চেহারার একজন মানুষ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নিষ্ঠুরভাবে হাসছে। টিরার ভয়ঙ্কর প্রাণীর দাবা খেলার শেষ চাল। আসল ডক্টরকে খুন করে নকল ডক্টর শ্রীবাস্তব নিরাপদে নির্বিঘ্নে নেমে যাবে মহাকাশযান থেকে। কেউ তাকে সন্দেহ করবে না। সে সেন্ট্রাল ক্লিনিকে গিয়ে আসল মানুষগুলোকে খতম করে মুক্তি দেবে নকল মানুষগুলোকে। তারা বুকভরা হিংসা ও লালসা নিয়ে ছড়িয়ে পড়বে পৃথিবীর বুকে। তারপর…।

নকল মানুষটা তখন দু-হাতে তুলে নিয়েছে ইস্পাতের তৈরি অস্বাভাবিক ভারী একটা কন্ট্রোল-বক্স। কয়েক মুহূর্ত…তারপরই সব শেষ হয়ে যাবে…প্রাণপণ শক্তিতে শরীরটাকে দু-পাক গড়িয়ে শকারের কাছে এগিয়ে গেলেন মোহন শ্রীবাস্তব। সুস্থ বাঁ-হাতে কোনওরকমে তুলে নিলেন আলট্রাসনিক-শকার। ভারী কন্ট্রোল-বক্সটা ছুটে আসছে তাঁর দেহ লক্ষ্য করে। ঝাঁকুনি দিয়ে একপাশে সরে গিয়ে যন্ত্রণায় চোখ বুজে শকারের ট্রিগার টিপলেন ডক্টর। হাই এনার্জি আলট্রাসনিক ওয়েভ ফোয়ারার মতো ছড়িয়ে পড়ল শত্রুকে লক্ষ্য করে। ঝনঝন শব্দে কন্ট্রোলবক্স দেওয়ালে আছড়ে পড়ল। একটা মরণ-আর্তনাদ বেরিয়ে এল শত্রুর ঠোঁট চিরে। কেঁপে-কেঁপে প্রতিধ্বনি তুলে সেটা মিলিয়ে গেল সোলারের গহ্বরে-কন্দরে।

নকল শ্রীবাস্তবের দেহটা আবার নমনীয় হয়ে গেল। মেঝেতে আছড়ে পড়ল সশব্দে। অবয়বহীন হয়ে জমাট বাঁধতে লাগল বেগুনি জেলির তাল। তখনও কাঁপছে তিরতির করে। কমল সেনগুপ্তের মতো।

শকারটা ফেলে দিয়ে কোনওরকমে উঠে দাঁড়ালেন মোহন শ্রীবাস্তব। হাতমুখ ঘাম ও রক্তে মাখামাখি। শরীর ক্লান্ত, দুর্বল। কিন্তু আত্মবিশ্বাস এখন যেন শতগুণ বেড়ে গেছে। সামান্য খোঁজ করতেই দরজার লকের চাবিটা দেখতে পেলেন তিনি। জেলির পিণ্ড থেকে কয়েক হাত দূরে পড়ে আছে। ঝুঁকে পড়ে সেটা তুলে নিলেন। ধাতব চাবিতে এখনও এক অদ্ভুত উত্তাপ।

করিডর ধরে রওনা হওয়ার আগে আলট্রাসনিক-শকার থেকে জেলি লক্ষ্য করে আর-একবার ফায়ার করলেন শ্রীবাস্তব। জেলির কাঁপন স্থির হয়ে গেল। সব শেষ!

চোয়াল শক্ত করে সোলারের প্রধান দরজার দিকে এগোলেন ডক্টর মোহন শ্রীবাস্তব। মনে-মনে উচ্চারণ করলেন : সেন্ট্রাল ক্লিনিকে টিরার প্রাণী যদি কেউ থেকে থাকো তা হলে মরবার জন্যে তৈরি হও। ডক্টর মোহন শ্রীবাস্তব তোমাদের খতম করতে আসছে।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *