টিক-টক
১
ঘড়িটা দেখতে ভারী অদ্ভুত! মেহগনি কাঠের জগদ্দল চেহারার প্রায় ছ’ফুট লম্বা ঘড়ি৷ বাদামি মসৃণ দেহের চারপাশে সোনালি বর্ডার৷ প্রস্থেও কিছু কম নয়৷ ডায়ালটাও বিচিত্র! বিরাট গোলাকৃতি ডায়ালের ভেতরে সোনালি-রুপোলিতে লতাপাতার কারুকাজ৷ কতগুলো ডিজাইনের খপ্পরে এমন জড়িয়ে পেঁচিয়ে আছে সংখ্যাগুলো যে চট করে সময় উদ্ধার করা দুষ্কর! নীচে কাচের চতুষ্কোণ অংশে সোনালি পেন্ডুলাম মন্থর ভঙ্গিতে দুলছে৷ সবমিলিয়ে অদ্ভুত৷
এতবড় ঘড়ি দিয়ে কী করত সাহেবগুলো ভগবানই জানেন! ঘড়ি তো নয়, আস্ত আলমারি! ওদের বিটকেল শখগুলো বোঝার ক্ষমতা বেশির ভাগ লোকেরই নেই৷ হাতে গোনা যে কয়েকটি লোক এই অদ্ভুত শখগুলোর মর্মার্থ বোঝেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন আমাদের মনিকাকু৷ তাঁর আবার আদ্যিকালের জিনিসপত্র কেনার খুব শখ! যত রাজ্যের ভারী ভারী ভিক্টোরিয়ান আসবাবপত্রে ঘর ভরিয়ে রেখেছেন৷ এ বাড়িতে ঢুকলই মনে হয়, ভুল করে কোনও জাদুঘরে ঢুকে পড়েছি বুঝি! অথবা ফ্ল্যাশব্যাকে ইংরেজ আমলে চলে গিয়েছি৷ মনিকাকুর এই জাতীয় শখে কাকিমা যথারীতি বিরক্ত! কথায় কথায় একদিন বলেই ফেললেন, ‘এ বাড়িতে তো দেড়শো-দুশো বছরের কমবয়সি কোনও জিনিসই নেই! তাও আবার খাঁটি ইংরেজ স্টাইলের৷ তা এতই যখন ইংরেজ প্রীতি, তখন বিয়ে করার সময়ে দুশো বছরের একটি ইংরেজ পাত্রী জোগাড় করতে পারলে না? ল্যাটা চুকত!’
মনিকাকুর নিস্পৃহ জবাব, ‘সে চেষ্টা করিনি ভাবছ? পার্কস্ট্রিটের গোরস্থানে গিয়ে অনেকবার খুঁজে দেখেছি৷ কিন্তু কোনও মেমসাহেবের প্রেতাত্মাই এই ‘নিগারের’ প্রতি ইন্টারেস্ট দেখালেন না! অগত্যা…!’
বলাই বাহুল্য কাকিমার বিরক্তিও কাকুকে থামাতে পারেনি৷ প্রতি বছরই তিনি কিছু না কিছু জিনিস দিব্যি আমদানি করে চলেছেন৷ বসার ঘর থেকে মাস্টার বেডরুম অবধি সবকিছুই প্রায় ঐতিহাসিক হয়ে উঠেছে৷ কিন্তু ঐতিহাসিক জিনিসপত্তরের ম্যাও সামলানোও যে চাট্টিখানি কথা নয়, তা কাকু প্রথম টের পেলেন যখন টেলিফোনটা বিগড়ে গেল৷ রিসিভার তুললে প্রায়ই ডায়ালটোনের বদলে বজ্র-বিদ্যুৎসহ বৃষ্টিপাতের আওয়াজ শোনা যেতে লাগল৷ ভাগ্যক্রমে যদি বা কখনও লাইন লেগেও যায়, উল্টোদিকের কণ্ঠস্বর শুনলে মনে হয় যে বক্তার নির্ঘাত হুপিং কাশি হয়েছে!
বাধ্য হয়েই ফোন সারাই করার উদ্যোগ নিতে হল৷ যে ভদ্রলোক টেলিফোন ঠিক করতে এসেছিলেন, তিনি টেলিফোনের চেহারা দেখে প্রায় ভির্মি খেয়ে পড়েন আর কী! যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে বিষম খেয়ে বললেন, ‘এটা…! এটা কক…ক্ষী!’
মনিকাকু সবিনয়ে জানান, ‘আজ্ঞে টেলিফোন৷ এটা অবশ্য পুরোনো মডেলের রিসিভার৷ আসলে এটা হ্যামিলটন সাহেবের বাড়ির ফোন৷ বহুবছর আগে…!’
তিনি হয়তো রিসিভারের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বোঝাতে যাচ্ছিলেন৷ তার আগেই ভদ্রলোক মুখ লম্বাটে করে বললেন, ‘আজ্ঞে, আমায় মাফ করুন৷ আমি টেলিফোন ঠিক করতে পারি; শিলনোড়া নয়!’
কী মর্মবিদারী ডায়লগ! অমন শখের ঐতিহাসিক রিসিভারকে শিলনোড়া বললে মন ভেঙে যাওয়াই স্বাভাবিক৷ আমরা সবাই ভেবেছিলুম, হয়তো কাকু এই ট্র্যাজেডির পর ক্ষান্ত দেবেন৷ কিন্তু আমাদের ভাবনার ওপরে কয়েক গ্যালন জল ঢেলে কয়েকদিন পরেই তিনি এই জগদ্দল চেহারার ঘড়িটি আমদানি করলেন৷
‘এই ঘড়িটার নাম কী জানিস?’ কাকু সগর্বে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘টিক টক!’
‘টিক টক!’ আমি অবাক, ‘এ আবার কী জাতীয় নাম! ঘড়ির নাম আবার এরকম হয় নাকি!’
‘হয়…হয়…জানতি পারো না৷’ কাকু হেসে বললেন, ‘হিস্ট্রি আছে৷ একেবারে যাকে বলে রোমহর্ষক ইতিহাস!’
আমার দিদি মুখটা পাঁপড়ভাজার মতো করে বলল, ‘প্লিজ, ফের বানিয়ে বানিয়ে কোনও ভূতের গল্প বলবে না৷ এর আগে বলেছিলে, ও ঘরের খাটটা যে মেমসাহেবের ছিল, তিনি নাকি আজও প্রতিরাতে নিজের পালঙ্কটা দেখতে আসেন৷ সেই গল্প শুনে বোন ওই পালঙ্কে শুয়ে সেরাতে ঘুমোতেই পারেনি! এসব ভুলভাল গল্প বলে বেচারিকে ভয় দেখানোর কোনও মানে হয়?’
‘আমি ভুলভাল গল্প বলি?’ কাকু গাল ফুলিয়েছেন, ‘আচ্ছা বেশ, বলব না!’
এমন সুন্দর একটা গল্প শুরু হওয়ার আগেই গেল ভেস্তে! এমনিতেই আমার স্বভাব হিন্দি হরর ফিল্মের নায়িকাদের মতো৷ ভয়ও পাব, আবার সব কিছু দেখা বা শোনাও চাই৷ তাই প্রতিবাদ করলাম, ‘মোট্টেও না৷ আমি একটুও ভয় পাই না৷ কাকু, তুমি বলো৷’
কাকু সোৎসাহে বললেন, ‘আচ্ছা৷ তবে নিজের দায়িত্বে শুনবি কিন্তু৷ নয়তো তোর দিদি বলবে আমি ভুলভাল গল্প বলে তোকে ভয় দেখাচ্ছি৷ ভয় পেলে কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়৷’
‘কিচ্ছু বলবে না৷ তুমি বলো৷’ আমি রীতিমতো আবদার ধরে বসেছি৷ দিদি বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়, ‘ধ্যুৎ! ফের গাঁজাখুরি গপ্প শুরু হবে৷ তুই একাই শোন৷ আমি বরং…!’
আর কিছু বলার আগেই আচমকা ‘খ্যাঁও’ করে একটা আর্তচিৎকার! আমি ভয় পেয়ে কাকুকে প্রায় জাপ্টে ধরেছি! দিদিও লাফ মেরে সরে গিয়েছে৷ কিছু বোঝার আগেই দেখলাম একটা সাদা উলের বল বিদ্যুৎবেগে পালিয়ে যাচ্ছে!
‘জো-বি-স্কো! বাঁদর কোথাকার!’ দিদি রেগে লাল, ‘একদিন এটাকে আমি ঠিক গলা টিপে মারব! কথা নেই, বার্তা নেই, যেখানে-সেখানে লেজ পেতে শুয়ে থাকবে৷ আরেকটু হলেই লেজ মাড়িয়ে দিতাম…!’
এবার ঘটনাটা বোঝা গেল৷ বাঁদর নয়, জোবিস্কো কাকুর পোষা বিড়ালের নাম৷ আমি অনেক ধরনের বিড়াল দেখেছি, কিন্তু এমন বজ্জাত বিড়াল কখনও দেখিনি৷ জোবিস্কো নিজের লেজটাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভাবে৷ সে অন্যান্য বিড়ালদের মতো সোফায়, বিছানায় বা আলমারির মাথায় উঠে বসে থাকে না৷ বরং যে রাস্তা দিয়ে লোকজন বেশি যাতায়াত করে ঠিক সেখানেই লেজটি পেতে দিয়ে শুয়ে থাকাই ওর স্বভাব৷ ভাবটা এমন, একবার শুধু ন্যাজে পাড়া দিয়ে দ্যাখ৷ তাপ্পর দেখাচ্ছি কী হয়…!
আমি আর দিদি ছাড়া আমাদের বাড়ির এমন কেউ বাকি ছিল না যে এ বাড়িতে বেড়াতে এসে অন্তত একবার জোবিস্কোর আঁচড়-কামড় খায়নি৷ এমনকি কাকিমাও তার ফাঁদে, থুক্কু…লেজে ভুল করে পা দিয়ে ফেলেছিলেন! এবং জব্বর কামড়ও খেয়েছিলেন৷ কাকিমা রাগে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বহুবার জোবিস্কোকে পগারপার করাতে চেয়েছিলেন৷ কিন্তু কাকুর জন্য পারেননি৷
‘আহা, অমন বলিসনি৷’ মনিকাকু জোবিস্কোর প্রতি পরম মমতায় বললেন, ‘অবোলা জীবটাকে গলা টিপে মারার কথা আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারি না! শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরার যে কী যন্ত্রণা, তা মর্মে মর্মে না বুঝলেও খানিকটা আন্দাজ করতে পারি৷ যেদিন থেকে টিকটকের গল্প শুনেছি, সেদিন থেকে তো আরও বেশি…!’
আমি বিরক্ত হয়ে বলি, ‘খালি ভণিতাই করবে, না গল্পটাও বলবে?’
‘শুনবি?’ তাঁর চোখ চকচক করে ওঠে, ‘আচ্ছা, শোন তাহলে৷’
২
‘এই ঘড়িটা একসময়ে জর্জ মাউন্টফোর্ড নামের এক সাহেবের ছিল৷’
কাকু সিগারেটে আয়েশ করে একটান মেরে বললেন, ‘সে বহুবছর আগেকার কথা৷ ১৮৫৭ সাল৷ সিপাহি বিদ্রোহের আগুন ক্রমাগত চতুর্দিকে লেলিহান শিখার মতো ছড়িয়ে পড়ছে৷ মীরাট, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, দিল্লি তখন জ্বলছে৷ ভারতীয় সেপাইরা তখন সাদা চামড়া দেখলেই হয় গুলি করছে, নয়তো কুপিয়ে মারছে বা মুন্ডু উড়িয়ে দিচ্ছে৷ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি ভেবে কূল পাচ্ছে না কীভাবে এই ভয়ংকর বিদ্রোহকে থামাবে! বিশেষ করে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীরাই ছিল সেপাইদের টার্গেট৷ একের পর এক সাহেবদের কুঠিতে আক্রমণ চালাচ্ছে বিদ্রোহীরা৷ কিছু সাহেব সপরিবারে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাল৷ কেউ পারল না৷
জর্জ মাউন্টফোর্ড তখন বিহারে ছিলেন৷ তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেন যে কোনও মুহূর্তে আক্রান্ত হতে পারেন৷ নিজেকে নিয়ে বিশেষ চিন্তা ছিল না৷ কিন্তু তাঁর সুন্দরী স্ত্রী অ্যাডেলাইন, শিশুপুত্র জ্যাক ও কন্যা ক্লারার জীবনও বিপন্ন৷ সিপাহীরা কাউকে রেয়াত করবে না৷ তাই তলে তলে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করছিলেন৷ কিন্তু পালাবার সময় পেলেন না৷ এক অভিশপ্ত রাতে ভারতীয় সেপাইরা তাঁর কুঠি আক্রমণ করল! চাকর-বাকররা কে কোথায় পালাল কেউ জানল না! মাউন্টফোর্ড ছিলেন ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির ডাকাবুকো কর্মচারী৷ তিনি একাই রাইফেল নিয়ে সিপাহিদের মোকাবিলা করতে চলে গেলেন৷ তবে যাওয়ার আগে প্রিয় পুত্র ও নাবালিকা কন্যাকে নিরাপদ জায়গায় লুকিয়ে রেখে গেলেন৷ তিনি ছাড়া একমাত্র তাঁর স্ত্রী অ্যাডেলাইনই জানতেন যে জ্যাক আর ক্লারা কোথায় আছে৷ কিন্তু ক্ষিপ্ত সেপাইরা দুজনকেই কচুকাটা করে, কুঠি লুটপাট করে চলে গেল৷’
কাকু চুপ করে কিছুক্ষণ সিগারেটে টান মেরে ধোঁয়ার রিং বানাতে লাগলেন৷ আমি তখন চোখ গোলগোল করে গল্প শুনছি৷ কোনওমতে বললাম, ‘তারপর?’
‘তারপর আর কী?’ তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, ‘সাহেবের দাসদাসীরা পালিয়ে কোনওমতে প্রাণ বাঁচিয়েছিল৷ কিন্তু তাদের মধ্যে সেই ভগ্ন কুঠিতে ভয়ের চোটে আর কেউ ফিরে গেল না৷ বিলাসবহুল কুঠিটা জনমানবহীন বিধ্বস্ত শ্মশানের মতো পড়ে রইল৷ শুধু সাহেবের এক অতিবিশ্বস্ত কাজের লোক ছিল, আগাথা! না, ঠিক কাজের লোক বলা যায় না তাকে৷ আসলে সে জ্যাক আর ক্লারার ধাত্রী৷ প্রাণ হাতে করে সে চব্বিশ ঘণ্টা পরে গোপনে ফিরে গেল কুঠিতে৷ মনে এই অসম্ভব অথচ ক্ষীণ আশা ছিল, যদি জ্যাক এবং ক্লারা কোনওমতে রক্ষা পেয়ে থাকে৷ কিন্তু আগাথা গোটা কুঠি তন্ন তন্ন করেও খুঁজে পেল না তাদের৷ ভগ্নমনোরথ হয়ে যখন ফিরে আসছে, তখনই আচমকা শুনতে পেল এই ঘড়ির ভেতর থেকে একটা অদ্ভুত শব্দ আসছে! কেউ যেন প্রাণপণে ঘড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে! মৃদু ধাক্কার সঙ্গে আঁচড়ের শব্দও পেল সে৷ কেউ যেন পাগলের মতো আঁচড় কাটছে ঘড়ির গায়ে!
আগাথা অতি সন্তর্পণে কান পাতল ঘড়ির গায়ে৷ কিন্তু যা শুনল তাতে তার রক্ত হিম হয়ে যায়৷ কে যেন ঘড়ির ভেতর থেকে ক্ষীণ স্বরে বলে চলেছে, ‘টিক টক, টিক টক,…টিক টক!’
সে বিস্মিত হয়ে দেখল ঘড়ির বাইরের অংশে একটা ছোট্ট আংটা লাগানো আছে৷ সহজে চোখে পড়ে না৷ ঘড়ির গায়ের বাদামি রঙের সঙ্গেই বার্নিশ করে দেওয়া হয়েছে আংটাটাকে৷ ফলে সেটা আপাত অদৃশ্য৷ সম্ভবত সিপাইদের চোখেও পড়েনি৷ সে আংটাটাকে ধরে টানতেই ঘড়ির গায়ে একটা ছোট্ট দরজা খুলে গেল৷ এই দ্যাখ, একদম এই ভাবে…!’
বলতে বলতেই ঘড়ির গায়ের সেই আংটা ধরে টান মারলেন কাকু! সঙ্গে সঙ্গেই যেন খুলে গেল একটা ছোট্ট দরজা৷ বিস্ময়াভিভূত হয়ে দেখলাম, ওই জগদ্দল দশাসই ঘড়ির নীচের অংশটা ফাঁপা! রীতিমতো গুপ্ত কুঠুরির মতো একটা ফাঁপা জায়গা আছে সেখানে৷ একটা আস্ত পূর্ণ দৈর্ঘের চেহারার মানুষ না ঢুকতে পারলেও, ছোটখাটো চেহারার নাবালিকা বা একজন শিশু অনায়াসেই ঢুকে যেতে পারে সেখানে৷ অর্থাৎ এটাই সেই গোপন জায়গা, যেখানে মাউন্টফোর্ড সাহেব জ্যাক আর ক্লারাকে লুকিয়ে রেখেছিলেন!
‘মাউন্টফোর্ড সিপাইদের হাত থেকে পুত্র-কন্যাকে বাঁচিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু ভাবেননি ওই স্বল্প পরিসর জায়গায় কতক্ষণ তারা বদ্ধ হয়ে বাঁচতে পারবে! সঠিক সময়ে ওদের উদ্ধার না করলে যে ওই ঘড়িই তাঁর পুত্র-কন্যার জীবন্ত সমাধি হয়ে যাবে তাড়াহুড়োর মাথায় এ সম্ভাবনা মনে আসেনি৷ এবং যা হবার তাই হয়েছিল৷ দমবন্ধ হয়ে শিশুপুত্র জ্যাক অনেক আগেই মারা গিয়েছিল৷ তার বরফ-শীতল কঠিন মৃতদেহ কোলে নিয়ে আস্তে আস্তে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর দিকে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিল ক্লারা! একটু অক্সিজেনের জন্য হাঁকপাক করতে করতে সে শুধু শুনতে পেয়েছিল ঘড়ির টিক টক শব্দ! এক একটা সেকেন্ড চলে যাচ্ছে, আর নাবালিকা প্রতীক্ষা করে যাচ্ছে এই গুপ্ত দরজা কখন খুলবে! এক একটা মুহূর্ত কাটছে, আর সে আশা ক্ষীণ হচ্ছে! ঘড়ির টিকটকের সঙ্গে সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে বেঁচে থাকার লড়াই করছে সে৷ চোখের সামনেই নিঃশ্বাস নিতে না পেরে ততক্ষণে মারা গেছে ভাই জ্যাক! সে বুঝতে পেরেছিল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার আয়ুও শেষের পথে যাচ্ছে! শেষ পর্যন্ত সময়ের শব্দই অসহ্য মানসিক যন্ত্রণায় পাগল করে তুলেছিল তাকে!
আগাথা দরজাটা খুলে দিতেই ভিতর থেকে ক্লারার অবসন্ন দেহ ঢলে পড়ল তার বুকে৷ মেয়েটা ততক্ষণে জীবনের শেষপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছে৷ তার মুখ নীল! মৃত্যুযন্ত্রণায় হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ৷ কোনওমতে শুধু উচ্চারণ করল অন্তিম দুটো শব্দ, ‘টিক টক!’
তিনি কিছুক্ষণের জন্য চুপ করলেন৷ এক অদ্ভুত মনখারাপ করা নীরবতা নেমে এল কিছুক্ষণের জন্য৷ আমি অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম৷ কাকু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজার ওপরে আলতো করে হাত রাখলেন, ‘সেই থেকেই এই ঘড়িটার নাম ‘টিকটক’৷ আর এই দ্যাখ, এখনও পাল্লায় আঁচড়ের দাগগুলো রয়ে গিয়েছে…!’
সত্যিই এখনও সেখানে নখের আঁচড়ের দাগগুলো সুস্পষ্ট হয়ে জ্বলজ্বল করছে!
কাকু ভারী গলায় বললেন, ‘আশ্চর্য ব্যাপার জানিস, অনেক রং, বার্নিশ করার পরেও, বহু চেষ্টা করেও এই আঁচড়ের দাগটা মুছে দেওয়া যায়নি৷ যতবার রং করে ঢেকে দেওয়া হয়; ঠিক তার পরদিনই দেখা যায়, নখের আঁচড়গুলোর দাগ ফের স্পষ্ট হয়ে যথাস্থানে জ্বলজ্বল করছে! যতদিন যায়, আঁচড়ের দাগটাও যেন তাজা হয়ে ওঠে!’
‘সে কী!’ আমি অবাক, ‘তা কী করে সম্ভব!’
তিনি জবাব দিলেন, ‘দেয়ার আর মোর থিংস ইনি হেভেন অ্যান্ড আর্থ হোরেশিও…৷’
৩
রাতে ঘুম আসছিল না! বারবার মনে পড়ছিল হতভাগ্য জ্যাক আর ক্লারার কথা৷ মাউন্টফোর্ড সাহেব আর তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু বরং অনেক সহজে হয়েছিল৷ বড়জোর কয়েক মুহূর্তের মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছিল ওঁদের৷ কিন্তু সেই শিশু আর নাবালিকার কপালে যে এমন ভয়ংকর অভিশপ্ত মৃত্যু লেখা ছিল তা কে জানত!
আমি মনে মনে ভাবছিলাম ক্লারার কথা! কত বয়েস ছিল তার? বড়জোর দশ বা বারো! কেমন দেখতে ছিল সে? কল্পনায় তার চেহারাটাও দেখতে পাচ্ছিলাম৷ আইভরির মতো স্নিগ্ধ গায়ের রং৷ একঢাল কোঁকড়ানো সোনালি চুল! বার্বি ডলের মতো অবয়ব! চোখদুটো ঘন নীল! টুকটুকে গোলাপি ঠোঁটদুটোতে মায়াবী হাসি মাখানো! সেই মেয়ে একটা অন্ধকূপের মধ্যে বসে প্রতি মুহূর্তে তার মৃত্যুর প্রহর গুনছিল! চোখের সামনে শিশু ভাইটা দমবন্ধ হয়ে ধড়ফড় করে মারা গেল, অথচ কিচ্ছু করার নেই! কী অসহায়! তার প্রাণহীন দেহটাকে কোলে নিয়ে জীবন্ত সমাধির ভেতরে বসে আছে সে৷ কেমন লেগেছিল তার? কী ভেবেছিল ক্লারা? দম নিতে পারছে না৷ একটু বাইরের হাওয়ার জন্য পাগলের মতো হাঁকপাক করছে৷ প্রাণপণে অন্ধকূপের দরজায় ধাক্কা মারছে, উন্মত্তের মতো আঁচড়াচ্ছে! একটা জীবিত, পরিচিত মানুষের কণ্ঠ শোনার জন্য উৎকর্ণ হয়ে আছে এই আশায়, যদি কেউ এই অন্ধকূপ থেকে তাকে উদ্ধার করে৷ অথচ কানের কাছে শুধু একটাই শব্দ, টিকটক, টিকটক, টিকটক! শব্দ নয়, মৃত্যুর পদধ্বনি!
ঘড়িটাতে ঢং ঢং করে বারোটার ঘণ্টা পড়ল৷ চিন্তায় চিন্তায় মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল৷ গলাও শুকিয়ে গিয়েছে৷ অগত্যা বিছানা ছেড়ে উঠে গেলাম ডাইনিং রুমের দিকে৷ একটু ফ্রিজের ঠান্ডা জল না খেলে চলছে না! কী কুক্ষণে যে জ্যাক আর ক্লারার গল্প শুনতে গিয়েছিলাম! দিদি ঠিকই বলেছিল৷ মনিকাকুর গল্প না শুনলেই বোধহয় ভালো হত…!
এসব ভাবতে ভাবতেই আপনমনে ডাইনিংরুমের দিকে চলেছিলাম৷ আচমকা একটা অদ্ভুত শব্দ কানে আসতেই থমকে গেলাম! এ কী! এ কীসের আওয়াজ! কেমন খড়খড় শব্দ! তার সঙ্গে অস্ফুট গুমগুম! যেন কেউ দরজার পাল্লায় ধাক্কা মারছে৷
আওয়াজটা আসছে কোথা থেকে? সদর দরজায়? এত রাতে কে আসবে? মনিকাকুর ঘরের দিকে তাকাই৷ সে ঘরের দরজা খোলা৷ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ভিতর থেকে নাইট বালবের নীলাভ আলো চুঁইয়ে আসছে বাইরে৷ আমাদের ঘরের দরজা এইমাত্রই খুলে এসেছি৷ অতএব কারোর ধাক্কা মারার প্রশ্নই নেই! তবে? আমি কি ভুল শুনছি?
উৎকর্ণ হয়ে চুপচাপ আওয়াজটা শোনার চেষ্টা করি৷ নাঃ, মনের ভুল নয়৷ সত্যিই শব্দটা শোনা যাচ্ছে৷ স্পষ্ট শুনতে পেলাম হলঘর থেকেই ধাক্কা মারা ও আঁচড়ানোর শব্দ আসছে৷ আর ওই ঘরেই রাখা আছে সেই বিখ্যাত ঘড়ি! টিকটক! জ্যাক আর ক্লারার জীবন্ত সমাধি…!
মুহূর্তের মধ্যেই মনে হল গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেছে! আওয়াজটা যেন ক্রমাগতই বাড়ছে৷ আমি যেন আর আমার মধ্যে নেই৷ মনে হচ্ছে হাত-পা গুলো ক্রমাগতই ভারী হয়ে উঠছে৷ এ যেন আমার হাত-পা নয়! যেন অন্য কেউ নিয়ন্ত্রণ করছে আমায়৷
সম্মোহিতের মতো এসে দাঁড়ালাম হলঘরে৷ আমি আর ঘড়িটা একদম মুখোমুখি! আর সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই! স্পষ্ট বুঝতে পারছি ধাক্কা মারার ও আঁচড়ানোর শব্দ ওই ঘড়ির চোরাকুঠুরির ভেতর থেকেই আসছে! এখন আরও জোরালো! অনেক বেশি সুস্পষ্ট! কে আছে ওর ভেতরে? তবে কি জ্যাক আর ক্লারা এখনও মুক্তি পায়নি ওই মৃত্যুকূপ থেকে! আজও শ্বাসরোধকারী যন্ত্রণায় আছাড়িপিছাড়ি খেয়ে মরছে! আমি কে? আমার ভূমিকা কী? সেই গভর্নেস আগাথা’র জায়গায় তবে কি আজ আমিই এসে দাঁড়িয়েছি! যার হাতে ওই চোরাকুঠুরির দরজা খুলবে!
বুকের ভিতর থেকে আচমকা আওয়াজ এল টিক টক, টিক টক! হৃৎপিণ্ডটা যেন লাফিয়ে লাফিয়ে বলে চলেছে, টিক টক, টিক টক, টিক টক…! ঘড়ির পেন্ডুলামটা প্রবল ব্যঙ্গে তাল মারছে, টিক টক, টিক টক…! ঘড়ির চোরাকুঠুরির ভেতর থেকে কে যেন ফিসফিসিয়ে উঠল, ‘টিক টক…টিক টক…টিক টক…! চতুর্দিকে,…দেওয়াল, ছাত ফুঁড়ে ভেসে আসছে শুধু একটাই শব্দ :
‘টিক টক…টিক টক…টিক টক…!’
এবার ঘড়িটার ভেতর থেকে আসছে শব্দটা! না, ভুল নয়৷ স্পষ্ট শুনতে পেলাম, একটা কচি গলা হাঁকপাক করতে করতে বলছে, ‘টিক টক—টিক টক…!’ আমার অসহ্য লাগছে! না, এ শব্দ শুধু শব্দ নয়! জাগতিক আওয়াজ তো নয়ই…! হয়তো অন্য কোনও দুনিয়া থেকে ভেসে আসছে! এই শব্দের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে নিষ্ঠুর মৃত্যুর দ্যোতনা!…এ শব্দ মৃত্যুযন্ত্রণারই আরেক নাম! মনে হল দু-কান চেপে ধরি! কিন্তু আওয়াজ থামছে না! চোরাকুঠুরির দরজায় খড়খড় আঁচড়ের আওয়াজ ক্রমাগতই বাড়ছে৷ গুমগুম করে কে যেন দরজা পিটছে! দমবন্ধ মুহূর্তের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে প্রাণপণ ধাক্কা মারছে! প্রচণ্ড শক্তিতে দরজা ভেঙে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে সে!
হঠাৎ মনে হল, চারপাশের নিশ্ছিদ্র অন্ধকার শ্বাসরোধ করে ফেলছে আমার! এত বড় হলঘরটা কবে এত ছোট হয়ে গেল? পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম৷ কিন্তু কীসে যেন পিঠ ঠেকে গেছে৷ আমি এগোতে পারছি না, পিছোতেও পারছি না! টের পেলাম, দরদর করে ঘামছি৷ নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে! ফুসফুস দুটো পাথরের মতো ভারী! শরীর শিথিল হয়ে আসছে৷ আমিও কি ক্লারার মতোই অন্ধকূপে বন্দি? শুধু শুনতে পাচ্ছি ঘড়ির কুঠুরির দরজায় প্রবল ধাক্কা পড়ছে! আর সব কিছু মিলিয়ে যেতে যেতে মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষে খেলা করে বেড়াচ্ছে একটাই অমোঘ শব্দ :
‘টিক টক! টিক টক! টিক টক!’
কানের কাছে ফিসফিস করে কে যেন বলল৷…কেউ আমার হাত ধরেছে৷ শিউরে উঠি! কী ঠান্ডা তার হাত! মৃত্যুযন্ত্রণায় শীতল হয়ে এসেছে! হাওয়া নেই! অথচ কার সুগন্ধী চুল যেন চোখে মুখে এসে আছড়ে পড়ছে৷ সিল্কের রাতপোশাকের সুগন্ধ ও মৃদু খসখস…! টের পাচ্ছি! সব টের পাচ্ছি!
যেটুকু শক্তি দেহে বাকি ছিল তা জড়ো করে কোনওমতে চেঁচিয়ে উঠি, ‘কাকু, উ-উ-উ-উ!’
মুহূর্তের মধ্যে দুড়দাড় করে মানুষের ছুটে আসার শব্দ! হঠাৎ করে হলঘরের আলো জ্বলে উঠল৷ খড়খড় আওয়াজটা আরও বাড়ছে৷ আমি প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম! কে যেন ধরে ফেলল৷ দিদি! আবছা চোখে দেখলাম মনিকাকু থমকে দাঁড়ালেন ঘড়িটার সামনে! ভীতসন্ত্রস্ত চোখে কাকিমার দিকে তাকাচ্ছেন৷ অর্থাৎ শব্দটা তাঁর কানেও গিয়েছে৷ কাকিমার মুখও ফ্যাকাশে!
কয়েকটা অসহ্য মুহূর্ত! তারপরই কাকু এগিয়ে গেলেন ঘড়ির দিকে৷ অত্যন্ত সন্তর্পণে চোরাকুঠুরির দরজা খুলে দিলেন তিনি…আর সঙ্গে সঙ্গেই…!
‘ম্যাঁও!’
একটা সাদা উলের বল আর্তনাদ করে, লম্ফ মেরে বেরিয়ে এল চোরাকুঠুরির ভেতর থেকে৷ তারপর এমনই পাঁই পাঁই করে দৌড় মারল, যেন তাকে ভূতে তাড়া করেছে!
মনিকাকু লাফ মেরে উঠে ক্রুদ্ধ চিৎকার করে উঠলেন, ‘হতভাগা জোবিস্কো! আরেকটু হলেই বাড়িসুদ্ধু লোকের হার্টফেল হচ্ছিল! শয়তান বিড়াল কোথাকার! কালই যদি তোকে কান ধরে বাড়ি থেকে বের না করেছি…!’
নাঃ, জ্যাক বা ক্লারা নয়, এসব জোবিস্কোরই কীর্তি! যখন মনিকাকু দরজাটা খুলে গল্প বলায় মগ্ন ছিলেন, আর আমি শুনতে শুনতেই অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম, সেই সুযোগেই জোবিস্কো সুট করে ঢুকে পড়েছিল চোরাকুঠুরির ভিতরে৷ মনিকাকু সেটা লক্ষ না করেই দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিলেন৷ এরপরের ঘটনা বলাই বাহুল্য৷ আচমকা আটকা পড়ে বিড়াল মশাই হতভম্ব! প্রথমে বুঝতে পারেননি ঘটনাটা কী ঘটেছে! যখন হৃদয়ঙ্গম হল তখন সেখান থেকে বেরোবার জন্য দরজায় ধাক্কা এবং আঁচড় দুইই তিনিই মারছিলেন! বাদবাকি ভৌতিক পরিবেশটা আমারই উত্তপ্ত মস্তিষ্কপ্রসূত!
এরপরও অনেকবার গিয়েছি মনিকাকুর বাড়ি৷ ঘড়িটা, অর্থাৎ টিকটক এখনও সেখানে আছে৷ তবে এরপর মনিকাকু আর কোনও ঐতিহাসিক জিনিস কেনেননি৷ জোবিস্কোও ওই একরাতের ধাক্কাতেই সোজা হয়ে গিয়েছিল৷ আর কোনও বেয়াদবি করেনি৷
সবই ঠিক৷ শুধু একটা কথা আজও কাউকে বলিনি! সে রাতে এক ভিনদেশি অসহায়, ভীত, মৃত্যুপথযাত্রী নাবালিকার যন্ত্রণা সামান্য হলেও টের পেয়েছিলাম আমি! কয়েক মুহূর্তের জন্য হলেও এক ইংরেজ আর এক ভারতীয় মেয়ের অনুভব এক হয়ে গিয়েছিল৷ আজও সেই অদেখা হতভাগিনী মেয়েটার জন্য সহানুভূতি রয়ে গিয়েছে মনের এক কোণে৷
তাই ক্লারাকে আজও ভুলিনি৷ ওকে ভোলা যায় না৷
আরও একটা কথা কোনওদিন কাউকে বলিনি, বলবও না৷ সে রাত্রে আমি সত্যিই ঘড়ির ভেতর থেকে মানুষের কণ্ঠস্বরে একটানা বলে যাওয়া ‘টিক টক’ শব্দটা শুনতে পেয়েছিলাম৷ জোবিস্কোর ডাক শুনতে পাইনি৷ আমি কি ভুল শুনেছিলাম? নাকি অন্যকিছু? আর পরদিন আঁচড়ের দাগটাও ভালো করে দেখেছিলাম৷ আশ্চর্য বিষয়, সেখানে বিড়ালের তীক্ষ্ণ নখের আঁচড়ের দাগ ছিল না!
কিন্তু মানুষের নখের আঁচড়ের দাগ ছিল! আরও স্পষ্ট! আরও জ্বলজ্বলে!
তবে?…
সমাপ্ত