টিক্কা

টিক্কা

ডাক্তার সঈদ আমার বন্ধু।

তার বাড়ি আমার বাড়ির থেকে মাত্র দুশো গজ দূরে। বাড়ির নীচেই তার রোগী দেখার ঘর।

আমি মাঝে মাঝে তার বাড়ি চলে যেতাম। এক দু’ঘণ্টা বেশ আড্ডা মেরে কেটে যেত। ডাক্তার সঈদ ছিল যেমন জ্ঞানী তেমনই রসিক! তার উপর নিরহঙ্কারী।

ব্যাঙ্গালোরে তার আদত বাড়ি। কিন্তু দুর্দান্ত উর্দু বলতে পারত। প্রায় সমস্ত বড় উর্দু কবির কবিতাই তার কণ্ঠস্থ! যেন এম.বি.বি.এস.-এর পাঠ মুখস্ত!

মাঝে মাঝেই আমার মনে হত ডাক্তার সঈদের ডাক্তারি না পড়ে বরং অন্য কিছু নিয়ে এম.এ., পি.এইচ.ডি করা উচিত ছিল।

একবার তাকে জিগ্যেস করেছিলাম, ‘ডাক্তারবাবু, আপনি এই পেশায় এলেন কেন?’

‘কেন?’

‘আপনি চাইলে উর্দু বা ফার্সি ভাষার প্রফেসর হতে পারতেন! বড় বড় জ্ঞানী গুণীরাও আপনাকে সেলাম ঠুকতেন!’

ডাক্তার হেসে ফেলেছিল, ‘একই ব্যাপার।…আসলে…না, ব্যাপারটা এক না!…এখানে এক জায়গায় বসে আমি দিব্যি দিনে একশো-দুশো টাকা রোজগার করি। অন্য কোনো কাজ করলে কী আর এত টাকা পেতাম?…খুব বেশি হলে মাসে ছ’-সাতশো টাকা!’

‘মাসে ছ’-সাতশো তো যথেষ্ট!’

‘আপনার যথেষ্ট মনে হয়। দুশো টাকা তো আমার হাতখরচ! তার উপর আমার আবার একটু পানের দোষ আছে। আপনি তো জানেন, দিনে শ’খানেক টাকা তো ওই কিনতেই চলে যায়। তারপর সিগারেটের খরচা, বন্ধুবান্ধবদের পিছনে খরচা…এত কিছু লেকচারার বা প্রফেসর হলে কি সম্ভব? আপনিই বলুন!’

আমি বললাম, ‘না, সম্ভব না। আমি শুধু ভাবছিলাম যে আপনি ডাক্তার না হয়ে সাহিত্যিক হতে পারতেন।’

‘আর না খেতে পেয়ে মরতাম!’ এই বলে ডাক্তার হেসে উঠল।

আমিও হেসে ফেললাম।

ডাক্তারের খরচ সত্যিই প্রচুর ছিল। সে কিপটেমি করত না। ডাক্তারি শেষ করে সে প্রায় রোজই বন্ধুবান্ধব নিয়ে আসর বসাত।

ডাক্তার বিবাহিত। তার স্ত্রীও আদতে ব্যাঙ্গালোরের বাসিন্দা। দুটো ছোট বাচ্চা—এক মেয়ে, এক ছেলে। ভদ্রমহিলার উর্দুতে কোনো উৎসাহই ছিল না। তাই তার বেশিরভাগ সময় কাটত একা বা বাচ্চাদের সঙ্গে। মাঝে মাঝে মেয়ে নীচে ডাক্তারখানায় এসে বাবার কানে কানে মায়ের বক্তব্য জানিয়ে যেত।

অল্পদিনের মধ্যেই ডাক্তার সঈদের সঙ্গে আমার বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল। অনায়াস বন্ধুত্ব। ডাক্তার তার জীবনের সাতকাহন আমায় শুনিয়ে দিয়েছিল। সে গল্প বিশেষ কিছু নয় বলে আপনাদের আর শোনাচ্ছি না।

আমি প্রায় রোজই তার কাছে যেতে শুরু করলাম। আমিও পানরসিক বলে আমাদের বন্ধুত্ব গাঢ় হতে বেশি সময় লাগল না।

মাসদুয়েক পরের কথা।

আমার মনে হতে লাগল ডাক্তার কেমন যেন চিন্তিত, খানিকটা অন্যমনস্ক। কাজে মন নেই। প্রথমে ক’দিন আমি ভাবলাম কিছু বলা উচিত কিনা। তারপর একদিন আর থাকতে না পেরে পরিষ্কার জিগ্যেস করলাম, ‘ভাই সঈদ! কী হয়েছে বলো তো তোমার?! কোথায় মন থাকে আজকাল?!’

সে শুকনো হেসে উত্তর দিল, ‘কই, না তো!’

‘না মানে কী! আমি কি গাধা নাকি? কিছু তো একটা হয়েছে! সারাদিন কী এত ভাব?’

সে নিজের হুইস্কির গেলাস হাতে নিয়ে মুখের কাছে এনে বলল, ‘তোমার ধারণা ভুল ভাই। বা তুমি আমার উপর মনোবিজ্ঞান ঝাড়ার চেষ্টা করছ।’

আমি প্রসঙ্গ পাল্টালাম। যদিও আমি নিশ্চিত বুঝতে পারলাম যে কিছু একটা হয়েছে। ডাক্তারের মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে সে ধরা পড়ে গেছে। কিন্তু তার স্বীকার করার সাহস নেই।

ক’দিন বাদে ধীরে ধীরে সে নিজের ক্লিনিকে আসাও কমিয়ে দিল।

সে কী করে, কোথায় যায়, কী নিয়ে এত ভাবে—জানতে আমি উৎসুক হয়ে উঠলাম। ভাবলাম দেখা হলেই সেই প্রশ্নগুলো আবার জিগ্যেস করব। কিন্তু সুযোগ হল না।

একদিন সন্ধেবেলায় তার ক্লিনিকে গেলাম। তার চাকর আমায় আটকাল, ‘সাহেব, ভিতরে যাবেন না।…ডাক্তারবাবু একজন রোগী দেখছেন।’

‘তো! দেখুক না!’

চাকর বিনীতভাবে বলল, ‘ইয়ে…রোগী একজন মহিলা! সাহেব।’

‘ওঃ! কখন ফাঁকা হবে সে? কিছু জান?’

‘জী না!…প্রায় একঘণ্টার উপর হয়ে গেল ডাক্তারবাবু ওই বেগমসাহেবাকে দেখছেন!’

একটু থেমে তারপর হাসলাম, ‘বিশেষ কোনো রোগী মনে হচ্ছে!’

বলে আমি অনিচ্ছাসত্ত্বেও তার রোগী দেখার ঘরে ঢুকে পড়লাম।

সঈদ একজন মাঝবয়সি মহিলার সঙ্গে বসে! সামনের তেপায়ায় বিয়ারের বোতল আর দুটো গেলাস রাখা। দুজনে কথাবার্তায় মশগুল!

আমি লৌকিকতাবশত তৎক্ষণাৎ তাদের কাছে ক্ষমা চাইলাম। বেরিয়ে আসব, এমন সময় সঈদ ডাকল, ‘কোথায় যাচ্ছ!? এসো, বসো।’

আমি বললাম, ‘আমি তোমাদের বিরক্ত করতে চাই না ভাই।’

সঈদ উঠে আমার হাত ধরে আমায় চেয়ারে বসিয়ে দিল।

‘ধুর! পাগল নাকি! এসব ভদ্রতা ছাড় তো!’

বোতল থেকে একটা গেলাসে বিয়ার ঢেলে আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সে বলল, ‘এই নাও।’

আমি দু’চুমুক দিতে না দিতেই সে ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমার আলাপ করাল। ভদ্রমহিলার গায়ে দামি জামাকাপড়, গয়না। দেখে বোঝা যায় যে টাকাপয়সার কোনো কমতি নেই।

‘ইনি সলমা রেহমানী…ইনি আমার প্রিয় বন্ধু সাদত হাসান মান্টো…’

সলমা রেহমানী বেশ খানিকক্ষণ অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, ‘সঈদ! ইনি সত্যিই সাদত হাসান মান্টো! এনার সবক’টা গল্প আমি কিছু না হোক বার তিনেক তো পড়েইছি!’

সঈদ আরেকটা গেলাসে বিয়ার ঢালতে ঢালতে বলল, ‘হুঁ। ইনি তিনিই। অনেকবার ভেবেছি তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। কিন্তু তারপর মনে হল তুমি এনার নাম জানবে নিশ্চয়ই। শয়তানকে কে না চেনে!’

শুনে সলমা রেহমানী তার মোটাসোটা পেট কাঁপিয়ে হাসতে লাগল।

এরপর আমার সলমা রেহমানীর সঙ্গে বেশ অনেকবারই দেখা হল। সলমা বড় ঘরের শিক্ষিত মহিলা। খোঁজখবর নিয়ে তার সম্বন্ধে খুব বেশি কিছু জানতে পারিনি। যা জেনেছিলাম তার সারাংশ—সলমার তিনবার তালাক হয়েছে। বাচ্চাকাচ্চা নেই। একা একটা বাড়িতে থাকে, বাড়িতে দুটো ছোট ঘর আর একটা স্নানের ঘর, স্থাবর সম্পত্তি থেকে মাসে প্রায় পাঁচশো টাকা আয় হয়, আর সে আঙুলে হীরের আংটি পরে থাকে। ব্যস, এটুকুই!

তার আঙুলের আংটিগুলোর একটা একদিন দেখতে পেলাম সঈদের আঙুলে।

আর একদিন সঈদের ডাক্তারখানায় গিয়ে দেখলাম, সলমা রেহমানী বসে। দুজন ভীষণ খুশি, হেসে একে অন্যের গায়ে পড়ে যাচ্ছে! আমিও তাদের বিয়ারের আড্ডায় যোগ দিলাম।

কয়েক সপ্তাহ ধরেই দেখছিলাম, ডাক্তারের রোগী দেখার ঘরের পাশ দিয়ে ভিতরে ঢুকে যে দুটো খালি ঘর ছিল, সেগুলোর মেরামত চলছে! একদিন দেখলাম, নতুন আসবাবপত্র এল। সলমার বাড়িতে যে আসবাব দেখেছিলাম, সেই একই! দরজা খোলা ছিল। ভিতরে ঢুকলাম।

প্রত্যাশিতভাবেই ডাক্তারের পাশে বসেছিল সলমা।

সঈদ আমায় বলল, ‘এস…পরিচয় করিয়ে দিই…সলমা রেহমানী…আমার স্ত্রী।’

এর আগে অন্তত পঞ্চাশবার আমার দেখা হয়েছে সলমার সঙ্গে। ফলে কী বলব বুঝতে পারলাম না।…তার উপর চতুর্থ বিয়েতে লোককে ঠিক কীভাবে অভিনন্দন জানাতে হয়, তাও আমার জানা ছিল না। কিন্তু কিছু একটা বলতেই হত, তাই বেশি না ভেবে বলে দিলাম, ‘তাহলে অবশেষে নাটকের ড্রপ সিন দেখতে পেলাম।’

মিঞা-বিবি দুজনেই হেসে উঠল।

সঈদ আমায় বসিয়ে বিয়ারের গেলাস ধরাল। আমরা বিয়ে বাদ দিয়ে পৃথিবীর যাবতীয় বিষয় নিয়ে আড্ডা মারতে শুরু করলাম।

কতক্ষণ কেটে গেল বুঝতে পারিনি। বিকেল পাঁচটা নাগাদ ওদের ওখানে ঢুকেছিলাম। ঘড়ির দিকে খেয়াল হতে দেখি রাত নটা! আমি সঈদ কে বললাম, ‘ভাই, চলি এবার। গল্পের চোটে সময়ের দিকে নজরই ছিল না।’

সলমা রেহমানী, থুড়ি সলমা সঈদ আমার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল, ‘তাই হয় নাকি?…না খেয়ে যাওয়া যাবে না। খাবার তৈরি আছে। আপনি বললে এখনই দিয়ে দেব।’

তার অনুরোধে আমি খেতে বসলাম। সে কী চমৎকার রান্না!

দু’বছর নির্বিঘ্নে কেটে গেল।

একদিন অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছি, এমন সময় চাকর এসে খবর দিল, ‘ডাক্তার সঈদ সাহেব এসেছেন।’

আমি বললাম, ‘ভিতরে নিয়ে এস।’

সঈদ এলে দেখলাম, চিন্তায় তার চোখ-মুখ শুকিয়ে গেছে।

আমায় কিছু জিগ্যেস করার কষ্ট করতে হল না। সে নিজেই বলতে শুরু করল। সলমার সঙ্গে তার মনোমালিন্য শুরু হয়ে গেছে। সলমা নাকি খুবই স্বার্থপর মহিলা; অন্য কারো কথা ভাবে না!

‘আমি ওকে বিয়ে করেছিলাম কারণ আমি ভেবেছিলাম ও একা! ওর আত্মীয়রা ওর কোনো খোঁজ খবর নেয় না।…ও যখন অসুস্থ হল…যখন ডিপথেরিয়া হল…আমি সব ছেড়ে ওর কাছে ছিলাম! সারাদিন সারারাত ওর সেবা করেছি! আল্লাহর দয়ায় ও ঠিকও হয়ে গেল!…কিন্তু এসব কিচ্ছুর কোনো দাম নেই ওর কাছে!…সব ভুলে গেছে ওর জন্য কী না কী করেছি আমি!…এত দুর্ব্যবহার করে আমার সঙ্গে, যে কী বলব!’

বুঝলাম, শেষের শুরু হয়ে গেছে।

ডাক্তার সঈদের বাড়ি আমার বাড়ির মাত্র দুশো গজ দূরে। তাই তাদের ঝগড়ার খবর নিত্য নিয়মিত বিভিন্ন সূত্রে আমার কানে আসতে লাগল।

একদিন খবর পেলাম সঈদ আর সলমার ঝগড়া হয়েছে। দুজনেই নেশা করে ছিল। সঈদ নেশার ঘোরে কী বলেছে কে জানে, সলমা রেগে আগুন হয়ে নিজের দুই কাজের লোককে ডাক দিয়েছে।

ওঃ! বলতে ভুলে গেছি যে সলমার দুই বিশ্বস্ত দাসী ছিল। খরখরে, তেজী, গাট্টাগোট্টা। তাদের বরেরাও সলমার অনুগত। সলমার কথায় তারা প্রাণ অবধি দিতে পারত।

তো দুই দাসী দৌড়ে আসতে সলমা তাদের হুকুম দিয়েছে ডাক্তারকে আচ্ছাসে ধোলাই দিতে। হুকুম পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা বেঁটেখাটো ডাক্তার সঈদকে ধরে পেটাতে শুরু করে। তাদের বরেরাও নাকি এসে জোটে। লাঠি, ঘুঁষি, থার্ড ডিগ্রি সব মিলিয়ে সঈদের সে একেবারে ধরাশায়ী অবস্থা!

কোনওরকমে হাঁপাতে হাঁপাতে সে পালায়। ডাক্তারখানার পিছনের দরজা দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে জমাদারের সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলায় নিজের বাড়িতে পৌঁছোয়। তার প্রথম স্ত্রী নাকি নার্সের মতো তার সেবা-শুশ্রূষা করে।’

এর পর প্রায় দু’মাস সে নীচের ওই দুই ঘরের ধারপাশও মাড়াল না। সলমার সঙ্গে আর কোনো সম্পর্কই রাখার তার আর ইচ্ছা ছিল না।

‘যা হয়েছে হয়েছে…আর না!’, প্রথমপক্ষের স্ত্রী আর বাচ্চাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিবিড় থেকে নিবিড়তর হয়ে উঠল।

মাঝে মাঝে তার মনে হত, যে মহিলার সঙ্গে বিয়ের নাটক করেছে সে তার ঘাড়ের উপর না চেপে বসে! সে নিজের বাড়ি চলে গেলেই সঈদ খুশি হত। তার আর সলমার সঙ্গে কোনো কথা বলার প্রবৃত্তি হত না।

আরো দু’মাস কেটে গেল।

ডাক্তার সঈদ এর মধ্যে খবর পেল যে সলমা ইউ. পি.-র একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে প্রেম করছে। শুধু নামেই ব্যবসায়ী; লোকটার কাছে ধনসম্পত্তি কিছুই নেই। শুধু একটা বাড়ি আছে, তাও দেশ ছাড়ার সময় সে নিজের নামে লিখিয়ে নিয়েছে বলে!

একদিন সঈদ বিরক্তির সঙ্গে আমায় বলল, ‘এই ব্যবসায়ীটা শালা রোজ সন্ধ্যেবেলায় আসে! তারপর ওদের মদ আর মোচ্ছব শুরু হয়। গা জ্বালা করে আমার!’

আমি শক্ত হয়ে উত্তর দিলাম, ‘ভাই, তোমার প্রথম ভুল ওই সলমাকে বিয়ে করা…দ্বিতীয় ভুল ওকে তোমার বাড়িতে থাকতে দেওয়া…ওকে বলো পাততাড়ি গুটিয়ে নিজের বাড়ি যেতে! মামাবাড়ি নাকি?’

সঈদ লজ্জায় মাথা নীচু করে ফেলল, ‘ছাড় সেই কথা।’

‘কথা ছাড়তে তো আমি-তুমি দুজনেই রাজি! কিন্তু এই কেচ্ছা তোমায় ছাড়লে তো!…আর ছাড়বেই বা কেন?…একটা পুরুষ মানুষের মতো কাজ করতে পারছ না তুমি? ওকে বের করে দিচ্ছ না!’

সে চুপ করে রইল।

আমি আবার বাক্যবাণ নিক্ষেপ করলাম, ‘সত্যি কথা বলি, কিছু মনে কোরো না…তুমি একটা নপুংসক!…তোমার জায়গায় থাকলে এতদিনে আমি ভদ্রমহিলাকে কিমা বানিয়ে দিতাম!…তুমি একটু অতিরিক্ত ভদ্র!’

সে দুর্বলভাবে উত্তর দিল, ‘আমি জঘন্য অপরাধ করতে পারি, ভাই!…তুমি আমায় চেনো না!’

আমি ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বললাম, ‘সেই!…জঘন্য অপরাধ!…সব জানি।…ওর হাতে মার খেয়েছ, নিজের সম্মান খুইয়েছ।…’

সে বলে উঠল, ‘ভাই, এবার থামো!…’

তার গলায় এমন এক আকুতি ছিল যে আমি চুপ করে গেলাম। একটু বাদে উঠে তার ডাক্তারখানা থেকে চলেও এলাম। স্থির করে নিলাম যে এরপর যখনই দেখা হবে, জ্বালাময়ী ভাষণে তাকে জেরবার করে দেব, যাতে তার পৌরুষ ফিরে আসে!

পরেরদিন সন্ধেয় আমি কিছু বলার আগেই সে আমায় বলল, ‘ও চলে গেছে। শুধু নিজের না, আমারও জিনিসপত্র নিয়ে গেছে।’

আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলাম, ‘আরে, জিনিসপত্র চুলোয় যাক!…আপদ বিদেয় হয়েছে এই অনেক!…তুমি খুশি, তোমার আল্লাহও খুশি!…চলো, এই আনন্দে এক এক বোতল বিয়ার হয়ে যাক!…তারপর কোনো হোটেলে গিয়ে ভালোমন্দ খেয়ে আসব।’

সলমার চলে যাওয়ার পর প্রায় এক মাস অবধি ডাক্তার সঈদ একটু অন্যমনস্ক থাকত। ধীরে ধীরে তা ঠিক হয়ে গেল। প্রত্যেকদিন সন্ধেবেলা তার সঙ্গে আমার দেখা হত; আমরা আড্ডা মারতাম, হাসিঠাট্টা করতাম আর বিয়ার খেতাম।

কয়েকদিন ধরে আমার শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। ঋতু পরিবর্তনের কারণে বোধহয়। আমি বিছানায় শুয়ে ছিলাম, এমন সময় ডাক্তার সঈদের চাকর এসে উপস্থিত হল।

সে বলল, ‘ডাক্তারবাবু আপনাকে ডাকছেন, সাহেব!…বলছেন খুব জরুরি কাজ!’

আমার উঠতে ইচ্ছা করছিল না। কিন্তু সঈদকে না বলতে মন চাইল না। তাই উঠে শেরওয়ানী পরে গেলাম তার বাড়ি।

ডাক্তারখানার বাইরের ছোট্ট লনে চারটে বড় বড় কাঠ দিয়ে চুল্লি বানানো। তাতে আগুন জ্বলছে।

কসাই মাংসের টুকরো কেটে কেটে তার উপর ফেলছে!

আশপাশে প্রচুর লোক জমা হয়ে গেছে।

আমি ভাবলাম, কোনো বড় জমায়েত হবে হয়তো! তারই ব্যবস্থা চলছে।

মাংসের একটা বেশ বড় টুকরোর দিকে চোখ পড়তে দেখলাম, টুকরোর সঙ্গে যেন দুটো হাত! মানুষের হাতের মতো!

আমি ভালো করে তাকালাম। হ্যাঁ, মানুষেরই তো হাত!

আমার মাথাটা গুলিয়ে গেল।

কসাইয়ের ছুরি আর কুড়ুল চলছে! কাঠের আগুনে পেঁয়াজ লাল হচ্ছে! মাথায় জোর দিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে করতেই ডাক্তার সঈদ এসে হাজির হল।

সে আমায় দেখে ডাকল, ‘এসো এসো…তোমার কথামতো কিমা তো হল না, ভাই!…কিন্তু টিক্কা হয়ে যাবে!…এখনো রান্না হয়নি!…হলে তোমায় একটা টিক্কা খাওয়াব!…চেখে দেখো তো নুন-মশলা সব ঠিক আছে কিনা!…’

প্রথমে আমার গা গুলিয়ে বমি ঠেলে এল; তারপর আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *